You are currently viewing নির্বাচিত ১০ কবিতা : হোসাইন কবির

নির্বাচিত ১০ কবিতা : হোসাইন কবির

দেবযানীর কূয়া যযাতির হাত

বদরুজ্জামান আলমগীর

আজকাল দেখি কবির সঙ্গে কবিতার তফাৎ এক অমোচনীয় দূরত্বে এসে ঠেকেছে। কবিতার সর্বংসহা মাটির স্বভাব লুপ্ত হয়েছে- কবিরা এখন কৌশলী, ধূর্ত, ক্ষমতাকেন্দ্রের দ্বাররক্ষী- এ বড় পরিতাপ, বড় লাঞ্ছনার দিক। এ কবিতাদুনিয়ার এক নতুন বিপন্নতা।

চাইলেই তো হয় না, কিন্তু আমরা চাই- কবি কেবল একজন কবিমাত্র থাকবেন না- তিনি সময় ও জমানার কাঙ্ক্ষার মুখে একজন ভরসাসুন্দর অকাট্য বুদ্ধিজীবীও হয়ে উঠবেন; এ অসুখ ও ক্ষরণের কালে একজন কবি মোকাবেলা করবেন ন্যায়-অন্যায়ের বাহাস; এভাবেই এক পোয়েটিক জাস্টিসের এজলাস তৈরি করার স্থপতি হয়ে উঠবেন তিনি।

কবি হোসাইন কবিরের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হলো- সে আশা এখনও গুড়ে বালি হয়নি, স্তব্ধ টানেলের শেষ মাথায় একফোঁটা কেমন অনল তিরতির করে কাঁপে এখনও।

তাঁর মধ্যে একটি একান্ত বেদনা আছে, আছে যাবার মুখেও পিছনে ফিরে নিজের বাড়িটি আবার, বারবার দেখে নেবার আকুতি, তিনি জানেন আমাদের অর্জনগুলো বেহাত হয়ে যাচ্ছে, সবকিছু চলে যাচ্ছে নষ্টদের দখলে- কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞান স্থির- বন্ধুরা কোথাও না কোথাও আছে- যাদের কাছে স্মৃতি ও রুক্ষতার রুমালখানি রেখে যেতে চান।

কবি হোসাইন কবিরের প্রাণের মহল্লা ভরা কাঞ্চিকাটা রোদ্দুরে, কিন্তু তিনি তাঁর কবিতায় আমাদের বলে যাচ্ছেন পাহাড়ের খাঁজে হেলে পড়া গোধূলির কথা- তাঁর বলার কথাটি মায়াবী বড়- মনে হয় এ কথা নয়, এ বুঝি হেলেঞ্চার শাক ও তাদের মাথা দোলানো, যা-কে আমরা বিবৃতি ভাবি তা আসলে চাতকপাখির ঠোঁটে মেঘমল্লার।

শর্মিষ্ঠার হিংসায় কুয়াতে পড়ে থাকা দেবযানীকে তৃষ্ণার্ত যযাতি হাত বাড়িয়ে স্থলের সমতায় তুলে আনেন; কচের অভিশাপপ্রাপ্ত দেবযানী যযাতির সহমর্মিতার দিকে ক্ষণেক্ষণ আকুলতায় ঝুঁকে পড়ে, কিন্তু এখানে কবির বিজয় উলটো নিজেকে সঁপে দেবার মধ্যে- যযাতিকেই বরং দেবযানীর অঙ্গুরীর জন্য হাহাকারে বাঙময় হয়ে উঠতে দেখি।

বনে বনে হাওয়ার সঞ্চারিতে কবি প্রাণের মৌচাক ভেঙে কথাটি বলছেন হিয়াকন্যা দেবপ্রতিমা দেবযানীর কানে কানে- আমরা আছি প্রতিবেশী সব পাখপাখালি বনের সাধারণ- ফলে আমরাও মেঘরোদ্দুরের দানাগুলো মনোনীত আনন্দে মনমনুরার কোঠরিতে তুলে রাখি।

এখানে হোসাইন কবির-এর ১০টি কবিতা চয়ন করা হলো।

ডাহুক এখনো ডাকে

 
পরম্পরা
 
নদী ভাঙে! নদীপাড়ে হাড়গোড় মানুষের কঙ্কাল–
আমি তার, তাদেরই পরম্পরা
 
পেছনে তাকাই–
ডেকে যায় ডাক দেয় কেউ বুঝি রাতের গভীরে
কালো আর নীলে মিলে মিশে অজস্র মলিন মুখ নিঃস্পন্দ
ভেসে যায় নিউরন সজ্জায় অস্তিত্বে
দূর-গ্রাম প্রাচীন বসতিতে
 
মোহনায় সংযোগ সঙ্গমে-
কে আমি? জলঘরে আজও জল মাপি
           ধূলিতে ধূসর প্রান্তরে একা….
 
****
 
 
স্বপ্নঘোর, মাতাল সময়
 
আঙ্গিনায় রোদের ছায়ায় অচিন পাখির পালক–
স্বপ্নঘোর, মাতাল সময়– উধাও সবই
তবু প্রেম– প্রসন্ন মনন
চোখের তারায় উপকূলে নীলে সমুদ্রে-গ্রহণের কাল
 
ডাক শুনি দূরে কাছে হারানো সব সকাল দুপুর
বিচিত্র রঙে বর্ষার জলে জলকেলী– মৎসপ্রেম
 
আমাদের বিশুষ্ক প্রান্তরে পুকুরের ঘন জলে আলোর প্রপাতে
জাগবে একদিন–
নবান্নে কামের পবিত্র ধ্যানে– অবাধ্য সংলাপ
 
*****
 
 
ঝুলছে তালা জং-পড়া
 
অজস্র ঠিকানায় তালা ঝুলিয়ে
লোকটা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে ঠিকই
 
ওয়াসা সার্কেল হয়ে চাঁনমারী সড়ক সংযোগ
সোজা রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে
ডানপাশে সেলাইঘর– অনুরূপা টেইলার্স
বাঁক নিয়ে গলিতে ঢুকলেই
ল্যাম্পপোস্ট লাগোয়া লোহার গেট
ভবনের বিপরীতে কাঁঠাল আর সুপারি গাছ–
প্রতিদিনই চঞ্চল দৃষ্টি বিনিময়–
হেলেদুলে জানায় প্রীতির সম্ভাষণ
 
সিঁড়ি ভেঙে চারতলা– কলাপসিবল কেচি-গেট
ভেতরে তেইশ বসন্তের অস্থায়ী আবাস
দেয়ালে লোনাধরা এবড়ো থেবড়ো বিবর্ণ রঙের প্রলেপ
              মুক্ত ক্যানভাস–
                       অবয়ব আঁকিবুঁকি শিশুর গড়ন
ঝুলছে তালা জং পড়া মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়ে
 
লোকটা! তালা ঝুলিয়ে হারিয়ে যাবে ঠিকই
বহু ঠিকানায় ঠিকানা বদলে
লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও
না, গতকালের লোকটাকে আজ কিংবা আগামীকাল–
কোন সময়ে কোন ঠিকানায়–
কবিতার শহরে– শিল্পকলায়
জিলাপি পাহাড়ে– সিআরবির সবুজ চত্বরে–
কাজীর দেউড়ি– জামালখান–  চেরাগীর মোড়ে
নন্দন– খড়িমাটি– বলাকা– বাতিঘর— বইয়ের আড়তে
কিংবা সীমান্ত পারাপারে
অতলান্তিক– হাডসন– ইস্ট রিভারের কোল ঘেঁষা
নিউইয়র্কের তুষার প্রভাতে– রৌদ্র-জোছনায়, কিংবা
হেমন্তে আগুনলাগা ঝরাপাতাদের কোলাহলে–
গ্রিনউড সিমেট্রি আর প্রোসপেক্ট পার্কে–
            না, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে
 
অজস্র ঠিকানায় তালা ঝুলিয়ে
লোকটা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে ঠিকই একদিন
 
 
****
 
 
দেবযানী তোমার জন্যে
 
 
পৃথিবীর বুকে নামে রাতের আঁধার
পালকের ওমে ঝরে বাউল বাতাস
কুয়াশা জড়ানো পথে যাবো কতদূর
পাথর-হৃদয় ছিঁড়ে ধূলো বালি ঘাস
যাবো তো সমুদ্রজলে অনন্ত অন্তিমে
পেছনে দীঘল ছায়া মৃতের কফিন
শুনি ডাক আজো তার নির্জন ঘরেতে
দূরে কার বাজে বাঁশি একাকী প্রস্থান
 
কার দেখা মিলেছিল কিছু নেই মনে
আবছায়ায় আলোয় নিষেধে বারণে
বিমূর্ত সে অবয়ব শুধু ভাসে মনে
উদ্বেগ আকাঙ্ক্ষা তার শত দিব্য জানি
তবু জাগি জেগে থাকি মনোভূমে ভ্রমি
আমিই কৃষ্ণকুমার শুনো দেবযানী
*****
 
 
মানুষও এক কালো মাছি
 
 
অনন্যা মাসখানেক হয়, ওর বাবার সাথে কথা বলেছিল।
এ ক’দিন বেশ কাজের চাপে ছিল ।
দেশ থেকে কল সাধারণত ওর বাবাই করে।
সেবার বাবা তাকে বলেছিল সপ্তাহখানেক ধরে
শরীর তার খুব একটা ভালো যাচ্ছে না;
করোনা আতংকে একা একা তার সময় কাটছে
নিজের ব্যস্ততা আর ক্লান্তির কথা বলে
অনন্যা লাইনটা কেটে দিয়েছিল ।
আজ দেশ থেকে খবর এলো–
ওর বাবা যে বাসায় থাকতো,
সে বাসার বন্ধ দরজা ভেঙে পুলিশ দেখতে পায়
বাসা ভর্তি বড় কালো মাছি ভন ভন করছে;
দরজা খোলা মাত্র অসংখ্য মাছি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো
 
 
নিঃসঙ্গ পাতার বাঁশি
*****
 
 
শাটল ট্রেন
 
 
শাটল ট্রেন যাবে কতদূর দেবযানী
 
আজও ট্রেনে যেতে নিস্তব্ধ হয়ে যাই
পাতালে সমতলে কিংবা উড়ন্ত আকাশে
হুইসেল বাজলেই কান পেতে শুনি—স্বপ্নঘোর ঘুঙুরের শব্দ
 
আজও ট্রেনে যেতে অলৌকিক অচেনা
কোন এক স্টেশনে নেমে
মৃত সব সারিবদ্ধ লাশ দু’হাতে সরাই
হ্যাঁ কিংবা না—ঈশ্বর ঈশ্বরীর খণ্ড-বিখণ্ড অবয়ব-অসংখ্য অগণন
 
আজও রাতের আকাশে দূর নক্ষত্র-আলোয় পরখ করি
অস্তিত্ব-অবয়ব
          নীলকণ্ঠ সমুদ্রজল
                   জলের গভীরতা
                         জন্মপাঠ
                  জীবনের সমূহ স্পন্দন
 
আজও শাটল ট্রেনে
না কিংবা হ্যাঁ অস্তিত্বের সহযাত্রী এক বাড়ি ফিরি
প্রহর গুনি গতিময় জীবন ও যৌনতায়
 
শাটল ট্রেন যাবে কতদূর দেবযানী
হুইসেল বাজলেই ঝাউতলা সময় মাপার পালা
*****
 
 
রাত হতে চাই
 
 
রাত শুয়েছিল তার পাশে গণিকালয়ে
রাত শুয়েছিল
দিনের পাশে
            রাতের পাশে আলো-আঁধারিতে
 
রাত শুয়েছিল
দেবতার পাশে
           দেবীর পাশে
                   বিশ্বাসের পাশে
                               ঈশ্বরের পাশে
পুণ্যতায় বেদনায় অগ্নিজ্বালা মশালে মশালে
 
আমিও আজ
         দেবীর পাশে
         দেবতার পাশে—গণিকালয়ে পুণ্যতায় বেদনায়
         রাত হতে চাই
         মদ্যপ
         মাতাল
 
********
 
 
আমিও একা নই
 
 
পা ফেলতেই চমকে উঠি
পথে পথে কার চোখ ছড়ানো ছিটানো!
 
এতকাল হেঁটেছি যে পথে
সেই পথ–
             তবে কি তার করতলরেখা!
 
বন্ধ ঘর
কড়া নাড়তেই দুলে উঠি বহুদিন পর!
হাতে হাত যুগলবন্দি
             দরজার দু’কপাট!
 
পা ফেলতেই চমকে উঠি
পথে পথে কার চোখ ছড়ানো ছিটানো !
 
******
 
 
হুইসেল বাজবে দেবযানী
 
 
হুইসেল বাজবে
হুইসেল বাজবে দেবযানী
ফিরবে না কোনোদিন পথ ও পথরেখায়
     আমাদের স্বপ্নঘোর তরুণ বয়স—
             না তুমি, না আমি
 
গলির মুখে ফুল-পাপড়ি হয়ে
দুপুরের ক্লান্ত রোদে
            কেউ আর কোনোদিন বুনবে না স্বপ্ননদীর গল্প
 
দেবযানী, তবু আশা জাগে আশা জাগিয়ে রাখা—
প্রদীপের নিবু নিবু আলোয়
তোমাকে কিংবা আমাকে
        শেষ কথা হয়তো বলবে একদিন
        পথ ও পথের কাঙাল মানুষ
 
******
 
 
ব্ল্যাক আইস
 
 
ব্যান্ডেজ হাতে নয় পায়ে নয়
এমনকি শরীরের কোথাও নয়
তবু অদ্ভুত অদৃশ্য কালো ব্যান্ডেজ জড়িয়ে
চুপচাপ হাঁটছে সবাই
ব্যান্ডেজ হাতে নয় পায়ে নয় কোথাও নয়
তবু ব্ল্যাক আইসে থমকে আছে
তন্ত্রমন্ত্র সময়ের চাকা আমাদের যাবতীয় আয়োজন
 
==============================