You are currently viewing নিভৃতচারী এক পরার্থপ্রাণ – আলী সিদ্দিকী

নিভৃতচারী এক পরার্থপ্রাণ – আলী সিদ্দিকী

অরুণদা-

দা’মণি….

নিষ্ঠাবান, নির্ভীক শব্দসৈনিক, কবি ও মনবতাবাদী সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত। চট্টগ্রামে একঝাঁক শব্দযোদ্ধা তৈরির সফল কারিগর।  যে নামেই তাঁকে ডাকি না কেন, সাড়া পেতাম প্রাণকাড়া। সেই ১৯৭৮ সাল থেকে অরুণদা’র সাথে আমার সম্পর্ক। জীবনের প্রথম লেখা ছড়াটি নিয়ে যখন পুরনো আজাদী অফিসে (ঘাটফরহাদবাগ) গেলাম, লেখাটি হাত বাড়িয়ে নিয়ে বললেন, বসো। অফিসে তেমন কেঊ ছিলো না। চেয়ারে বসার পর আমার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কি কি বই পড়েছি, কি কি পড়তে ভালো লাগে জানতে চাইলেন। রবিন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র , মানিক বন্দোপাধ্যায়, সুকান্ত পড়তে বললেন। আর বললেন পড়ালেখায় মনোযোগী হতে। আমি ঘাড় নাড়িয়ে চলে আসি।

কিছুদিন পর আগামীদের আসরে আমার প্রথম লেখা, প্রথম ছড়া ‘টিকটিকি’ ছাপা হলে লেখার ব্যাপারে আমি সিরিয়াস হয়ে উঠি এবং একের এক লেখা অরুণদাকে দিয়ে আসতে থাকি। তিনি আমাকে গদ্য লেখার ব্যাপারেও উৎসাহ দেন এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় আমি কবিতা ও কথাসাহিত্যের জগতে বিচরণ শুরু করি। আজাদী এবং পরবর্তীতে দৈনিক পূর্বকোণ ও ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় গদ্য পদ্য দুই শাখায় সমান্তরাল বিচরণ করতে থাকি।

ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আমি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি এবং নগর ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়ে লড়াই সংগ্রাম সংগঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এই সময়ে শাহিদ আনোয়ারের সাথে আমার পরিচয় হয় ক্যাম্পাসে। সেও যুক্ত হয় নগর ছাত্র ইউনিয়নে। লেখালেখির পাশাপাশি লড়াই সংগ্রাম করা কঠিন হলেও শাহিদ আমাকে লেখার ব্যাপারে উৎসাহ দেয় এবং বোস ব্রাদার্স ও ফুলকি’র আড্ডায় নিয়ে যায়। ফুলকি’র আড্ডা হয়ে অরুণদা’র বাসায় প্রায়ই যাই। বিশেষত: সান্ধ্য আড্ডায় অনেকেরই আগমন ঘটতো। মিনার মনসুর, কমল সেনগুপ্ত, চৌধুরী জহুরুল হক, জোতির্ময় নন্দী, আশীষ সেনসহ আরো অনেকেই আসতেন। সবার মধ্যমণি আমাদের দা’মণি। আপাদমস্তক এক প্রগতিবাদী ছিলেন দা’মণি। আমার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় উৎসাহ দিতেন এবং রাজনৈতিক সাহিত্য পাঠের জন্য প্রেরণা দিতেন।

দিলরুবা আর আমার সম্পর্কের বিষয়ে জানার পর দেখতে চাইলেন। একদিন সন্ধ্যায় দা’মণির কাছে আমরা গেলাম। তিনি আপ্যায়নের আয়োজন করলেন এবং দিলরুবার সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করে বললেন, আলী খুবই চঞ্চল, খেয়াল রেখো।

শাহিদকে নিয়ে অরুণদা’র বাসায় প্রায়ই যেতে হতো। অসুস্থতাজনিত কারণে শাহিদকে নানানভাবে দা’মণি সহযোগিতা করতেন। ড. অনুপম সেনও দা’মণির বাসায় আসতেন এবং শাহিদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। জোতির্ময়েরও কিছু অস্থিরতা ছিলো এবং দা’মণি তার প্রতিও বিশেষ খেয়াল রাখতেন দেখেছি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রচুর ব্যস্ততার ফলে যোগাযোগ সীমিত হয়ে পড়ে এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর কর্মোপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম ছাড়ার কারণে সকল আড্ডা থেকে ছিঁটকে পড়ি। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম এলে অবশ্যই দা’মণির সাথে দেখা হতোই। অনিয়মিত হলেও লেখালেখি চলতে লাগলো। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামে ফিরে আসি এবং আগের মতো না হলেও আড্ডার প্রাণকেন্দ্র দা’মণির সাথে কমবেশি দেখা হতো। তখন দা’মণি শৈলীর প্রকাশক রাশেদ রউফের ব্যাপারে আমাকে জানান এবং বই করতে বলেন। ২০০০ সালে শৈলী আমার প্রথম ছোটগল্প গন্থ ‘শঙ্খসোহাগ’ প্রকাশ করলে বই নিয়ে আমি দা’মণির বাসায় যাই। উত্তম সেনের করা দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে হাত বুলিয়ে বললেন, এখানকার প্রায়ই গল্পই তো আমার পড়া, আবারো পড়বো।

২০০০ সালের মাঝামাঝি আমি সপরিবারে আমেরিকাবাসী হলে দা’মণির সাথে যোগাযোগে ব্যতয় ঘটে। একমাত্র শাহিদ আনোয়ারের কাছ থেকে দা’মণির অল্পবিস্তর খবর পেতাম। ২০০২ সালে আমি দেশে যাই এবং পূর্বা প্রকাশনী থেকে মঈনুল আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘নীলমণি’ প্রকাশ করে। বইয়ের এককপি নিয়ে শাহিদসহ দা’মণির বাসায় যাই। তিনি সেদিন একটু অসুস্থ ছিলেন। বই পেয়ে খুশি হলেন। কিন্তু বেশি সময় নিলাম না। দা’মণির স্বাস্থ্য অনেকটা ভেঙে পড়েছে।

এরপর দা’মণির সাথে আমার আর সাক্ষাত হয় নি। ফোনে যোগাযোগ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। শাহিদ একবার ফোনে জানালো দা’মণির বাসা বদল হয়েছে এবং রহমতগঞ্জ বাংলা কলেজের আশপাশে আছেন। ২০০৫ সালে দেশে গিয়ে অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও দা’মণির সাথে দেখা হয় নি। শাহিদকে নিয়ে কাকভেজা হয়ে বাসা খুঁজেছি কিন্তু শাহিদ বাসা চিনতে পারলো না। এরপর আরো দুইবার দেশে গেলেও পারিবারিক জটিলতায় সময় করে উঠতে পারিনি।

কিন্তু দা’মণির ব্যাপারে আমরা দু’জন কথা বলতাম। কতো স্মৃতি কতো মুখরতাময় সময় ছিলো। গত বছর থেকে কবি রবীন ঘোষের মাধ্যমে দা’মণির খবরাখবর নিয়েছি। তিনি এবং কবি আশীষ সেন দা’মণির সাথে যোগাযোগ রাখেন। এই করোনাকালীন দুরত্বের দুষ্কালেও তারা এই অকৃতদার মহান মানুষটির খোঁজখবর রাখেন। আজীবন নির্লোভ মানুষটি জীবন সায়াহ্নে এসে নির্ভর করেছেন আর্থিকভাবে অসচ্ছল কিন্তু মানবিক গুণে মহান নারায়নদার পরিবারের উপর। কবি রবীন ঘোষের মাধ্যমে নিয়মিতই এসব পাচ্ছিলাম।

বছরের শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার একটি কাব্যগ্রন্থ দা’মণিকে উৎসর্গ করবো। বন্ধুবর কবি হোসাইন কবিরের সার্বিক সহযোগিতায় আপন আলো প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মায়াকাঞ্চন মালীর পৌরাণিক উনুন’ দা’মণিকে উৎসর্গ করলাম। কবি আশীষ সেনের হাতে বইয়ের একটা কপি ধলঘাটস্থ অরুণদার বর্তমান আবাসে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন কবি রবীন ঘোষ।

সম্প্রতি প্রকাশিতব্য কবিতা ও কথাসাহিত্যের অন্তর্জাল ‘মন-মানচিত্র-এ প্রকাশের জন্য অরুণদা’র উপর একটি স্মৃতিগদ্য লিখছেন রবীন ঘোষ। দুইদিন আগে জানালেন, লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। আমি আশ্বস্ত করলাম। এর মধ্যেই ভোরের কাগজ অরুণদা’র উপর একপাতা ফিচার প্রকাশ করেছে। সেখানে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখা দা’মণির জীবনচিত্র।

একদিন পরেই জীবনাবসান ঘটলো এক নিভৃতচারী পরার্থপর মহাপ্রাণের। বিদায় দা’মণি। অনন্তলোকে আপনার যাত্রা মঙ্গলময় হোক।

 

 

জুলাই ১০, ২০২১

পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।