নিউইয়র্কের শরৎ
আদনান সৈয়দ
নিউইয়র্কে শরৎ আসে সব রকম উৎসবকে সঙ্গে নিয়ে। তখন মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে শুরু হয় নতুন জীবনের শিহরণ! জীবনের ভাঁজে ভাঁজে রঙের ছাপ পড়ে। পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতোই শরৎকাল নিউইয়র্কের একটি উৎসবের মাস। সেপ্টেম্বর ২২ তারিখ থেকে এখানে শুরু হয় ‘সরকারিভাবে’ শরৎকাল। কিছুটা শীতের আমেজ আবার গরমের উষ্ণতাকে আলিঙ্গন করে তখন শুরু হয় পথ চলা। নিউইয়র্কে শরৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার গাছের পাতায় বিভিন্ন রংবেরঙের শিল্পীর তুলির আঁচড় পড়তে শুরু করে। তখন যত দূর চোখ যায়, দেখা যায় গাছের পাতায় পাতায় শুধুই লাল, কমলা আর হলুদের ছড়াছড়ি। পাহাড়ের বুকে আঁকাবাঁকা হাজার রকমের নকশা কেটে সরু কালো পিচের রাস্তাটি মনে হয় যেন চলে গেছে দূর বহু দূরে কোনো এক অজানা গায়ের গঁা ছুঁয়ে। কোন সে গাঁ? সে গাঁয়ের নামটি কী গো? খুব জানতে ইচ্ছে করে। আবার সবুজ পাহাড়ের ঢালের ভাঁজে ভাঁজে হলুদ প্রজাপতির দল তাদের রঙিন পাখা নাচিয়ে দুরন্ত কিশোরীর মতো ইতি-উতি ঘুরে বেড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরে। তখন বুনো ফুলের গা থেকে ভেসে আসা মাতাল করা বোটকা ঘ্রাণে গোটা মেপল বনে যে আনন্দের উৎসব লাগে। ঠিক এমন এক মোক্ষম সময়ে নিউইয়র্কের কালো পিচের রাস্তার দুপাশে শুরু হয় পাতা ঝরার এক প্রাণবন্ত ট্যাংগো নাচ। বুনো মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় নবাগত কোনো কুঁড়ির সন্ধানে। হাজার রকম পাখির কিচিরমিচির শব্দে হঠাৎ থেমে যায় নিষ্পাপ হরিণের চকিত মায়াবী দুটো চোখ। তখন নিউইয়র্কের মেপল বনের দমকা হাওয়ায় প্রকৃতি যেন অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে গায়ে নানান রঙের গয়না পরতে শুরু করে। ঠিক মোক্ষম সময়ে কবিগুরুকে মনে পড়ে।
‘জাগুক মন, কাঁপুক বন, উড়ুক ঝরা পাতা—
উঠুক জয়, তোমারি জয়, তোমারি জয়গাঁথা।
ঋতুর দল নাচিয়া চলে
ভরিয়া ডালি ফুলে ও ফলে
নৃত্যলোল চরণতলে মুক্তি পায় ধরা-
ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়া ওঠে জরা।’ (উদবোধন)
জানিয়ে রাখি নিউইয়র্কের শরৎ মাসটা খুব জগৎ বিখ্যাত। যদিও করোনার কারণে এখন মানুষ আগের চেয়ে বেশি ভীতসন্ত্রস্থ কিন্তু তারপরেও আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যতো বটেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকেও পর্যটকেরা নিউইয়র্কের কোলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন এই শরতের সুধা পান করতে। হালকা গরম থেকে প্রকৃতি যখন শীতের পোশাকে সাজতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ঠিক তখন এই মধ্যবর্তী সময়টাই এখানকার শরৎ। অক্টোবর আর নভেম্বর মাসে গাছের সবুজ পাতাগুলো যখন ধীরে ধীরে তাদের রং পরিবর্তন করে হলুদ, বাদামি, লাল, খয়েরি কমলাসহ বিভিন্ন রকম পোশাকে সজ্জিত হয় তখন মনে হয় এক চিলতে স্বর্গ যেন ভুল করেই এই পৃথিবীতে বুকে আছড়ে পড়েছে। তবে এই সময়ে শুধু প্রকৃতির বুকেই রং ধরে না। মানুষের চোখেরও রং বদলায়, আর সেখানেও নেশা ধরে। তখন প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই মানব সমাজে শুরু হয় বিভিন্ন রকম উৎসবের আয়োজন। অক্টোবরে থেকেই শুরু হয় আদি আমেরিকান অর্থাৎ রেড ইন্ডিয়ানদের ভুট্টা উৎসব। এই ভুট্টা উৎসবে চাষিরা জাঁকজমক করে বিভিন্নরকম আনন্দ আয়োজন করে মাঠের ফসল ঘরে তোলে। ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা উদ্যাপন করে বিভিন্ন রকম রেড ইন্ডিয়ান নৃত্য। যাকে আমরা এখানে স্থানীয় ভাষায় বলি ‘পো ওয়াও’। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে অক্টোবরের মাঝামাঝি অব্দি চলতে থাকে ‘এপল পিকিং’ নামে এক প্রাণের উৎসব। নিউইয়র্কের আপস্টেট, লং আইল্যান্ডসহ ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে আপেল বাগানে এই উৎসবের সূচনা ঘটে। নির্দিষ্ট একটা ফি দিয়ে বিশেষ সাইজের ব্যাগ সংগ্রহ করে আপেল খেকোরা ঢুকে পড়ে তাদের পছন্দসই কোনো এক আপেল বাগানে। তারপর মনের সুখে আপেল ভক্ষণ আর সেই সঙ্গে চলে প্রকৃতির সঙ্গে খুনসুটি। বলা প্রয়োজন যে আপেল পিকিং শুধু নিছক আপেল সংগ্রহ বা ভক্ষণ নয় বরং বলা যায় এই আপেলকে ঘিরে আমেরিকানরা এক অপার আনন্দে মেতে ওঠে। আপেল পিকিং এর পাশাপাশি চলতে থাকে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন রকমের ভূতের আকার দেওয়া মুখোশ। মনে রাখতে হবে অক্টোবরের ৩১ তারিখ হলো আমেরিকানদের আরেক জনপ্রিয় দিন, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে হ্যালোইন। এই হ্যালোইনে মিষ্টিকুমড়ার কঙ্কাল দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন রকম ভুতুড়ে মুখোশ বাড়িতে বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হলো এখানকার উৎসবের অন্যতম রীতি। সেই দিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভূতের পোশাকে সেজে ছোট পামকিনের ঝুড়ি হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়ে চকলেট-ক্যান্ডি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। নভেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার আমেরিকানদের খুবই জনপ্রিয় উৎসব ‘থ্যাংক্স গিভিং ডে’।
জানা যায় ষোলো শতকের দিকে ‘মে ফ্লাওয়ার’ জাহাজে চড়ে যে ক’জন খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ইংল্যান্ড থেকে এই আমেরিকায় প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন তারা স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রচুর ভুট্টা চাষ করেন আর এই ভুট্টার ফসল ঘরে তোলার উৎসবে বুনো টারকি রোস্ট করে সবাই আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। সেই দিন থেকেই দিনটি ‘থ্যাক্স গিভিং ডে’ হিসেবে পালিত হয়। অর্থাৎ টারকি ফিস্ট এর বিনিময়ে নেটিভদের সঙ্গে বন্ধুত্বের আয়োজন। মূলত রেড ইন্ডিয়ান এবং দখলদার বিলাতিদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে আমেরিকায় এই ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ শুরু হয়। এই দিনে আমেরিকানরা টার্কি রোস্ট আর সেই সঙ্গে কেনবেরি সস সহযোগে আপ্যায়নের মাধ্যমে আত্বিয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটান। যা বলছিলাম, সব মিলিয়ে শরতের এই কটা মাসের প্রাকৃতিক আনন্দকে ভাগাভাগি করে মানুষ আর প্রকৃতি যেন মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। আকাশের নীলের সঙ্গে মিশে যায় মানব-মানবীর গোপন অভিসারের কথা। প্রকৃতির লাল হলুদ আর কমলা রং এর আভায় রক্তাক্ত হয় ব্যাকুল হৃদয়। তখন চোখের সামনে শুধুই জীবনানন্দ দাশ।
‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে-আকাশে;
জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে’!-সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা-আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল’ (নির্জন স্বাক্ষর)
কিন্তু প্রকৃতির এই রূপ-রং বেশি দিন টিকে না। শুরু হয় পাতা ঝরার বিরহের গান। তখন চৈত্রের ধূসর ধুলায় মিলেমিশে একাকী হয়ে মানুষের প্রাণ যেন কেঁদে ওঠে। টুপটাপ পাতা ঝড়ে, আকাশ ধূসর হয়, তখন নীরব এক শূন্যতা বাসা বাঁধে মানুষের মন আর তার অন্তরাআত্মায়। পরিত্যক্ত মাঠের খয়েরি ভুট্টা খেতে পরে থাকে নাম না জানা কোনো এক বন্য পাখির ডিমের খোলস। এক নিদারুণ বিরহে কাতর হয়ে মানুষ তখন চেয়ে থাকে আলোকিত এক সকালের দিকে। জার্মান কবি রেইনার মারিয়া রিল্কে তার কবিতায় এই মিষ্টি বিরহকে ধারণ করেছিলেন:
“Who now has no house, will not build one
Who now is alone, will remain so far long,
will wake, and read, and write letters
and back and forth on the boulevards
will restlessly wander, while the leaves blow”
Autumn শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ automne থেকে। ষোলো শতকের আগেও শরতের এই সময়টাকে আমেরিকানরা নবান্ন উৎসবের মাস বলতেই বেশি পছন্দ করত। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের জীবনে শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে। প্রকৃতির কোল ঘেঁষে জন্ম নেওয়া এই মানুষেরা ধীরে ধীরে যান্ত্রিক হয়ে উঠে। তাদের মন আর মননের চূড়ায় বাসা বাঁধে শহুরে জীবনের দীপ্র আধুনিকতা। কল কারখানার কালো ধুয়ার আড়ালে হারিয়ে যায় নবান্নের স্বর্গীয় আনন্দ। মানুষের সুখ-দুঃখ তখন সবকিছু ভাগাভাগি হয়ে যায় বৎসরের ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গেই। মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে তৈরি হয় হাজার মাইল ব্যবধানের এক কঠিন দূরত্বের দেয়াল। কিন্তু মানুষ কি প্রকৃতির সেই রং গায়ে মেখে তার সুবাস ছড়াতে পারছে? বিষ্ণুদের কবিতার শব্দ থেকে বের হয় সেই আর্তনাদের সুর,
‘তাই তো ছুটির গ্রাম্য সন্ধ্যা অন্ধকারের সংগীত
উপচে-উপচে ওঠে শহরের দেশজোড়া শত কান্নায়!
কবে যে মানুষ প্রকৃতির রঙে সাজবে,
এ গ্রাম শহর আর নয়!’ (হেমন্ত)
তারপরও নিউইয়র্কে শরৎ আসে প্রকৃতির সব রং চুড়ি করে। গাছে গাছে পাতায় পাতায় জীবনের নতুন পরশ লাগে। ঝরাপাতায় ঢেকে যায় নিউইয়র্কের কালো রাস্তা আর সব চেনা অচেনা পথঘাট। বাতাসের হালকা দোলায় মেপল গাছগুলো এক সাথে যেন দুলে উঠে। তখন নিউইয়র্কের আগুন ঝরা বন আর বাতাসে উড়ে আসা খয়েরি পাতা জীবনানন্দ দাশকে খুঁজে পায়।
‘সমস্ত পৃথিবী ভরে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস
দোলা দিয়ে গেল কবে!-বাসি পাতা ভূতের মতন
উড়ে আসে!-কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস,-
যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন!-
জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ!’ (জীবন)