নাহিয়ান অপু’র একগুচ্ছ কবিতা
নির্বাসন
নাগরিক কোলাহলে নান্দিক পাখির বাস পুরনো দেবদারুগাছের চিলেকৌঠায়,
না ফেরা ঘুমে শেষ চুম্বন মৃত্যুর মতন ভারী!
চামেলী, কাঠগোলাপ আর টিউলিপ এবং
স্টেটব্যাংকে জমানো প্রেম ঠোঁটে তার অসমাপ্ত বেদনার আলিঙ্গন।
খোলা শাওয়ারের জলের নিক্কণে ভেসে যায় নিকট নিঃসঙ্গ একেকটি হাত
রাঙা রনাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে হেঁটে যায় ইতিহাস অতীতের খোলা রুটে,
ঘোমটা টেনে এই গৌধূলীভাষ্যে সাগ্রহে নির্বাসন আমি মেনে নিয়েছি!
মেনে নিতে হয়েছিলো আমাকে দীর্ঘ ইনসোমনিয়া।
দীর্ঘশ্বাসের ত্রাসে অসম্ভবের মুখে আমি শুনেছি হাওয়ার প্রলাপ
অরণ্যের স্বাধীনপ্রাণে ছুঁড়ে দিয়েছি হারানো মেঘের ক্রন্ধন
তন্দ্রালস রাতের বুকে সঙ্গমতাড়ির ভ্রমরের গুঞ্জনে জেগে ওঠে প্রেম
গভীর অন্ধকারের ঘুমে পাশবিক লোলুপ চোখে লাগিয়েছিলাম আগুন
ফাগুনরঙে কোকিল কিন্নরে ডেকে ওঠে বাসন্তীগান।
******
হাওয়ার রাত
সন্ত্রস্ত, হিরণ্ময় পথের বুক পদ্ম মুকুরে জমে ওঠা,
হেমন্তের রাঙাচোখে হুতুমের নিশানা ছেদ করে
বাঁকা কম্পাসে জাহাজি দেখে নিকটদ্বীপের হাতছানি,
জলতীর ঠোঁটে রাঙা শ্রাবণের গায়ে বর্ষনের অলঙ্কার।
যুগলচোখ এলিয়ে স্রোতে বেতোফুল মল্লিকাবনে
ফুটে যায় শৈবাল চোখ স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের পলেস্তারায়,
গহিনরাতের জমিতে ফোটে তারাপুঞ্জের দেহ!
শবদেহ যামিনী শশী তীব্র নিঃশ্বাসে
চেতনার সংগীতে তোলে মাউথঅর্গান সুর।
হাওয়ামুখে জনরোষের চুম্বনে
নিজেকে অজানার যাত্রি করে ভয় পেয়েছে বিষুব সমুদ্র,
কোন সব কামনার রাতে আমি বেদনার চোখ
ভাসিয়েছি জলে, মোনে নেই!
মোনে রইলো কেতকিবনে আহত গোলাপ
শরীরী সেজেছে আজ।
মুষল বেদনার ওপারে মেঘ
ক্রুশবিদ্ধ রাতের কায়োটি বেসাতির ঘরে
ছুড়েছে নাইট্রোজেন হাত।
সময়ের ফিনকি দিয়ে ঝরে সকালের রৌদ্রধমনী
শতকোটি সিংসীর মাংসাশী প্রাণে
আমি জ্বালিয়েছি আগুন,
যে আগুনে পুড়ছে আজ সভ্যতার বিংশ শতক।
প্রেমহীন চোখে চোরাচালানি শিমুলের যোনিস্তনের ভেতর,
অনন্ত পৃথিবীর কটিদেশ জড়ায়ূ জুড়ে,
পালকছেঁড়া বসন্তের বিমিশ্র বান্ধবহীন পথ,
নক্ষত্রের মাস্তুলের জোছনার ধ্বংশাবশেষ,
আমাকে মেনে নিতে হয়েছিলো!
আমাকে মেনে নিতে হয়েছিলো
আড়ম্বর দিবসের ভয়ংকর আরতি।
*****
ঘুর্ণায়মান আঁধার
হে হাওয়ার রাত
অপসৃয়মান অন্ধকারের শরীর
প্রাচীন বেদনার নৈঋতে
কল্পলোকের গহ্বর হয়ে
তুমি পালিয়ে গিয়েছো!
রাত্রিচর নাইটিংগেল কিংবা
কন্ঠকাকীর্ণ শতাব্দির শৈশবে,
গত হওয়া সময়ের নেকাবে
মহাকাশের সিলিংয়ে ঝুলে আছে
মৃতপ্রায় মানুষিক শরীর,
গণরোষের চুম্বণে নিস্পাপ পদ্মের
দেহে জলের শৈল্পিক নৃক্কণে
ফুটে আছে নীলচে শবদেহ।
******
প্রতিক্ষণ
চাইলেই দিতে পারি মেঘ,
রোদ ঝরা ফাগুন!
আগুন দিতে পারি খড়তাপে পোড়া
সোনালি হরিণের চোখে।
ঘাসের নিমন্ত্রণে জলরঙা শিশির
ফোটাতে পারি!
দেবদারু বনে
কেতকী সবুজ আঁকি চোখে।
বাদসাধা সময়ের হাতে জীবন ধরে,
সরল ফুলের জোছনায় ডুবে যেতে পারি।
পারি তো খানিক বৃষ্টি দিতে
পদ্মের পাতায়,
ম্লান ঝরানো শ্রমে ও ত্রাসে
জ্বালাতে পারি দ্রুতগামী বিদ্যুৎ,
রোদ্দুর দিবসের কপোল ছুঁতে পারি
চুম্বণ মাখা ঠোঁটের ভাঁজে ।
*****
সংশয়
রমণীয় জোছনার ফাঁদে
প্রেম জমেছে রাতের,
সমুদ্রের ঢেউ ঘুমচোখে ডেকে নিয়ে
চাঁদ হিল্লোল তোলে নিরবচিত্তে
নৈরাশ্যের কুন্ডলীপাশে
উত্তরের হাওয়ায় এমন শীতমাখা বুক
আগে আসেনি কখনও ধরিত্রীপুরে!
পাছে তবু নেই নিঃসংশয় মোন,
কোলাহল গিলে খাওয়া
জমা ধুলোর ঝরে পড়া শরীরে,
আঁচ লাগে অন্ধকারের।
ডেকে যাওয়া ভোর
পুড়ে যায় দিবসের আগুনে
বৃষ্টিদল নৃত্যের সঙ্গে দেখে যায়
সুঠাম শ্রাবণের জোড়া চোখের কাঁপন।
*****
স্বর্গের নৈঋতে
সেন্সরে আটকে থাকা ধুলোর জঞ্জাল
অসম্ভবের চূড়ো থেকে নেমে আসা ভুল
কিছু ফুল তুলে রাখি ছায়ায়।
হাহুতাশের হাওয়ার রাত,
ত্রাসের জমিতে বোনা শিউলিদল,
ভেজা বৃষ্টির মত শুল্ক কিছু হাত,
জমে ওঠা হিমের শরীর,
তীব্র দাবদাহে বোশেখী রঙের মেঘ,
হৃদয় হতে ঢের দূরে
খেয়ালি চোখ, দৃষ্টির স্রোত
কিছু ফুল কিছু ভুল
তবু নখের আঁচড়ে বিক্ষত।
ক্লান্ত বিমূর্ত বেঢপ বাদুড়ের গায়ে রং
ছায়াবাজি খেলে,
ঝর্ণাদল গঙ্গার জলে আঁচরে পড়া কামনার বিষে
খয়েরী মুখ শ্রান্তির নিশান আঁকে,
ঈশানকোনে গর্জনে কাঁপে ধরিত্রী।
পাইনবনের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ঘর,
খড়কুটোয় বাবুইয়ের ইমারত।
খসে পড়া বিমূর্ত নক্ষত্রের ঠোঁট
চুমু আঁকে আঁধারে গোলাপ।
গ্লোবের চোখে দেখা পৃথিবীর মুখ
অগ্নিবাষ্পে পুড়ে যাওয়া পাপে
ত্রাসের ঘর উন্মুখ
চলতি দিনের শৈশব
মেঘের দমক
গর্জনে কাঁপে বন শিকারির বন্দুক।
ভ্রষ্ট তবু ক্লিষ্ট চোখে বয়ে যাওয়া হরিণীর প্রাণ,
ঘ্রাণ ডাকে শ্রবণ উড়ে চলা বক!
পেঙ্গুইনের গলে হাড়ের মালায় পুঁতি
শঙ্খের মত বাজে
পাঁজরের পথে ট্রাম চলে বেদনার দেহ।
********************************