নজরুলের কবিতার মূল্যায়ন ও দুই বাংলায় নজরুল চর্চার সীমারেখা> কামরুল ফারুকী Post author:monmanchitra Post published:May 26, 2023 Post category:চলতি সংখ্যা / প্রবন্ধ Post comments:0 Comments নজরুলের কবিতার মূল্যায়ন ও দুই বাংলায় নজরুল চর্চার সীমারেখা কামরুল ফারুকী বাংলা ভাষায় যে কবি এত উচ্চকণ্ঠী সাম্যবাদী হয়েও সাম্প্রদায়িকতার শিকার তার নাম নজরুল।যেখানে নজরুলের মূলায়ন সেখানে শুধু তার সমস্ত প্রতিভার এক খণ্ডিত অংশের অতিমূল্যায়ন আবার যেখানে অবমূল্যায়ন সেখানে তার কবি প্রতিভার সামগ্রিক মূল্যায়ন না করে প্রকৃতিসুলভ কিছু দুর্বলতাকে খুব গাঢ় করে দেখানো—এইতো এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় নজরুল।নজরুল যে সময় লিখতে এসেছেন তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলমান বা তার উত্তাপ তখনও শেষ হয়ে যায়নি।উপরন্তু রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টির সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমস্ত পৃথিবীতে এক নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে।নতুন পৃথিবীর জাগরণের সম্মুখ ঢেউ এই নজরুল।নজরুল প্রথমে বিপ্লবী,সমাজ সংস্কারক,তারপর তিনি কবি।কবিতা তার সমস্ত মনীষার স্মারক নয়,কবিতা তার রক্তিম মানসের একটি অস্ত্র মাত্র।তাই কবিতায় বাণীই তার কাছে প্রধান,অন্তর্মুখী রহস্য নয়। বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে মূলায়নের পাশাপাশি তাকে ‘প্রতিভাবান বালক‘ বলে উল্লেখ করেছেন যিনি কবিজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই পদ্ধতিতে ও একই ভাষায় লিখে গেছেন।জীবনানন্দও নজরুলের কবিতার উচ্চ মূল্যায়ন করেননি বরং নজরুল অপেক্ষাকৃত অগ্রসর পাঠকের কবিতাতৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম নয় বলে অভিযোগ করেছেন।বলাই বাহুল্য জীবনানন্দীয় আদর্শ দিয়ে, বিমূর্ততার পাটকাঠি দিয়ে নজরুলের ইস্পাত সদৃশ কবিতাকে মূল্যায়ন করতে গেলে নজরুল সম্পর্কে এরকম একমুখী সিদ্ধান্তে পৌঁছাই সম্ভব।মূলত বুদ্ধদেব বসু,জীবনানন্দ কিংবা তিরিশের পশ্চিমাভিমুখী আধুনিক কবিগণ নজরুলকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।তারা যেরকম শিল্পের জন্য শিল্প করতে এসেছিলেন,নজরুল তা ছিলেন না।তিনি জীবনের জন্য শিল্প করতে এসেছিলেন।সমাজ ও মানুষের প্রয়োজনে তাই শিল্পকে তিনি তার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।নজরুল শুধু শিল্প সৃষ্টি করেননি, সমগ্র জীবন দিয়ে তার দৃষ্টান্তও হয়েছেন।তাই তার কবিতায় অভ্যন্তরীণ শিল্পগুণের চেয়ে তার বহির্মুখী উপযোগিতার প্রতি লক্ষ বেশি।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এককোটি শরনার্থী যখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল,মানবেতর জীবন–যাপন করছিল—তখন তাদের নিয়ে একটি পঙক্তিও উচ্চারণ না করা বুদ্ধদেব বসু বা তার কবিতাদর্শন দিয়ে নজরুলের এসিডীয় পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না।বুদ্ধদেব বসু এবং তার সতীর্থরা অবশ্যই তাদের কবিতাঞ্চল নিয়ে স্বতন্ত্র ও নতুন বিশ্ববীক্ষার দাবিদার।এখানে তাদের আক্রমণ করা উদ্দেশ্য নয়।কিন্তু যখন লাল আলোতে গাছের সবুজ পাতা কালো দেখায় তখন সবুজের মান রক্ষার্থে লালকে অবশ্যই বলতে হবে যে তুমি সাতরঙের মিশ্রণ সাদা আলো নও।তাই তোমার দৃষ্টি এত পক্ষপাতপূর্ণ। বুদ্ধদেব বসু ও আবু সয়ীদ আইয়ুব তাদের স্ব স্ব আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলনে নজরুলের যে সামান্য কয়েকটি কবিতার স্থান দিয়েছেন তা মনে হয়েছে নজরুলের তুমুল জনপ্রিয়তার নিতান্ত দায়বদ্ধতা থেকেই।আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলনে নজরুলের কবিতা স্থান পেয়েছে মাত্র চারটি।তাও আবার রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতার বাঁকবদলকারী প্রথম স্টেশন ‘বিদ্রোহী‘ কবিতাকে বাদ দিয়ে।বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলনে নজরুল উপস্থিত দায়সারা মাত্র তিনটি কবিতা নিয়ে।এখানেও বাংলা কবিতার শান্ত ধারার মাঝে তুমুল তরঙ্গ ‘বিদ্রোহী‘ অনুপস্থিত!প্রমথ চৌধুরি,যার প্রাবন্ধিক হিসেবেই মূলত স্বীকৃতি—এই সংকলনে তারও দুইটি কবিতা স্থান পেয়েছে।রবীন্দ্রনাথের ষোলটি,সুধীন্দ্রনাথের আটটি,অমিয় চক্রবর্তীর ষোলটি,জীবনানন্দের উনিশটি,বুদ্ধদেব বসুর পনেরটি এবং অন্নদাশঙ্কর রায়েরও পাঁচটি কবিতা সংকলনে স্থান পেয়েছে।কবিতার সংখ্যা অবশ্যই মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি নয় তবে দৃষ্টিভঙ্গী ও বাস্তবতার প্রতি ভ্রূক্ষেপহীনতা প্রকাশে কখনও কখনও সংখ্যাতত্ত্ব জরুরি হয়ে পড়ে। হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন তো আরেক মহাজাগতিক শিল্পমানচিত্র।শুধুমাত্র আস্তিক হওয়ায় ও উপনিষদীয় ভাবপুষ্টতার কারণে যেখানে আধুনিক কবিতার ভিত্তিপ্রস্তরকারী রবীন্দ্রনাথই অনুপস্থিত সেখানে শ্যামা সঙ্গীত ও ইসলামী গজল রচনাকারী নজরুল নেই কেন—সে কথা আর বলারই অপেক্ষা রাখে না।একই কারণে আল মাহমুদের অনুপস্থিতিও আজাদের কূপমণ্ডুকতারই স্মারক।অশ্রুকুমার সিকদার তার ‘আধুনিক কবিতার দিগ্বলয়‘ গ্রন্থে নজরুলের সৃষ্টিশীলতাকে ‘অশিক্ষিত পটুত্ব‘ বলে যেভাবে একবাক্যে তাকে খারিজ করে দিতে চেয়েছেন সেটাও দেখার বিষয়।এটা যেন ফুলে পোকা বাসা বেঁধেছে বলে ফুলকে পোকার ঘর বলে সাব্যস্ত করার মত ব্যাপার।আগে থেকেই যিনি পুষ্পবিরোধী মনোভাব নিয়ে বসে আছেন তিনি ফুলে শুধু পোকাই খুঁজে পাবেন এটাই স্বাভাবিক।এটা দর্শকেরই সংকীর্ণতা এবং কীটহীন প্লাস্টিকের ফুলই তার জন্য যথার্থ। ১৯৪২ সালে বাকরুদ্ধ হওয়ার পর থেকেই নজরুলকে নিয়ে পক্ষপাতপূর্ণ রাজনীতি শুরু হয়।সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় থেকেই মুসলমানরা তার উপর ইসলামী কবির পাগড়ী পড়াতে শুরু করে।দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে নজরুলের উপর রাজনৈতিক কারণে চাপানো হয় একান্তভাবে ইসলামী ঐতিহ্যের তিলক।এমনকি নজরুলের কবিতার হিন্দুয়ানী শব্দ সংস্কার করে সেখানে ইসলামী ভাবপুষ্ট শব্দ বসিয়ে দেওয়ার অশিল্পীত দায়িত্ব দেওয়া হয় কবি গোলাম মোস্তফাকে।পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের প্রতি হিন্দুয়ানী চিহ্ন আরোপ করে নজরুলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয় তার সম্পূর্ণ প্রতিপক্ষ হিসেবে।গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে নানা রূপকথা যার কিঞ্চিত শুনে বাল্যকালে আমরাও রোমাঞ্চিত হয়েছি।একই কারণে দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা নজরুল সম্পর্কে হয়ে পড়েন আশ্চর্যজনকভাবে নীরব।ফলে নজরুলের একটি খণ্ডিত অংশই সমাজে চর্চিত হতে থাকে এবং সামগ্রিক মূল্যায়ন থেকে নজরুল বঞ্চিত হন।নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও তার সামগ্রিক আদর্শকে এখনও বাংলাদেশ রপ্ত করতে পারেনি।তার একটি গানকে রণসংগীতের মর্যাদা দান ও বছরে বছরে নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন করলেই তার মূল্যায়ন হয় না,যদি না সমাজের সর্বস্তরে নজরুলের সাম্যবাদী বোধের সারবস্তুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নজরুলের স্মরণীয় পঙক্তি নির্মাণের ক্ষমতা অবিস্মরণীয়।বাংলা কবিতায় স্মরণীয় পঙক্তি নির্মাণে সংখ্যার দিক থেকে নজরুলই সবচেয়ে এগিয়ে।স্মরণীয় পঙক্তিতে প্রবাদের গুণ থাকতে হয় যা গভীর মনীষা ও বোধবীক্ষণ ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।একটি সমাজের সমস্ত আকাঙ্ক্ষাকে,জীবনের সমস্ত অনুভূতিকে কয়েকটি পঙক্তির মাঝে অশ্রুবিন্দু বা শিশিরবিন্দুর মতো কেন্দ্রঅভিমুখী করতে পারলেই তা স্মরণীয় পঙক্তির মর্যাদা পেতে পারে।নজরুলের কবিতায় শব্দ–সম্ভার মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে তার কবিজীবনের শুরুতেই যখন ‘অগ্নিবীণা‘ প্রকাশিত হয়।নজরুলের কবিতার ভাষার মধ্যেই একটা বাধ ভাঙা আওয়াজ,বৃত্তভেদী চেতনার স্ফূরণ লক্ষ করা যায়।ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে শুরু করে নানা কুশীলবের দ্বারা বাংলা ভাষাকে যখন পরিপূর্ণভাবে সংস্কৃতঘেঁষা করার কাজ চলছিল,সেই যজ্ঞোৎসবের মাঝে নজরুলই প্রথম কবিতায় কথ্য ঢঙ নিয়ে আবির্ভূত হন।একদম দেশী ও লোকায়ত শব্দকে তিনি কবিতায় অবলীলায় ব্যবহার করতে থাকেন।তার সাথে আরবী–ফারসি শব্দের ব্যবহার তার কবিতাকে রবীন্দ্রযুগের গীতল মাধুর্যময় ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে তোলে।আরবী–ফারসি সেসব শব্দের বেশিরভাগই তখন হিন্দু–মুসলমান উভয় সমাজেই কথোপকথনে প্রচলিত ছিল।ভারতীয় উপমহাদেশে দীর্ঘকাল মুসলিম শাসন,মুসলমান বণিকদের বাণিজ্য ও বসবাস ইত্যাদি কারণে এসব শব্দ স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল।সুতরাং নজরুল জোর করে বাংলা কবিতায় আরবী–ফারসি শব্দের আমদানি করেননি বরং কথ্য শব্দকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলা কবিতায় তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।তবে কথ্য শব্দকে গুরুত্ব দিলেও নজরুলের কবিতার ভাষা কিন্তু কথ্য ঢঙের মত এলায়িত হয়নি বরং বদ্ধাক্ষর,যুক্তবর্ণ ও মধ্যানুপ্রাসের অনুশাসনে তিনি তার কাব্যভাষাকে উর্ধ্বমুখী ও উচ্চকণ্ঠী করেছেন। শব্দ ব্যবহারে নজরুল হিন্দুপুরাণ,ইসলামী পরিভাষা,গ্রীক মিথ সর্বত্র অবাধে বিচরণ করেছেন।এ বিষয়ে তার কোন শুচিবায়ুতা ছিল না।‘বিদ্রোহী‘ কবিতা তার একটি অন্যতম উদাহরণ।এখানে একইসাথে হিন্দুপুরাণ,গ্রীকপুরাণ ও ইসলামি পরিভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে। নজরুলের কবিতাকে কতিপয় বুদ্ধিজীবী অনাধুনিক বলে প্রচার করতে গর্ববোধ করেন।এটাও করা হয় পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।আমরা জানি উনিশ শতকের শুরুর দিকে বোদলেয়ার ইউরোপীয় কবিতায় আধুনিকতার যে সূচনা করেন তার প্রধান উপকরণ ছিল অমঙ্গলবোধ।বোদলেয়ার রবীন্দ্রনাথেরও অনেক আগের মানুষ।ইউরোপের কবিতায় যখন নগর সভ্যতায় যন্ত্রণাদগ্ধ ও শিকড়বিচ্ছিন্ন মানুষের হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছিল,বাংলা কবিতায় তখনও গীতি কবিতার রোমান্টিক ধারা চলছিল।নজরুলই প্রথম অমঙ্গলবোধকে তার কবিচেতনায় ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।তিনি অমঙ্গলবোধকে একমাত্রিক করে কবিতায় উপস্থাপন করেননি বরং এই অমঙ্গলের আয়োজনকে উচ্ছেদ করার তীব্র হুঙ্কার তুলেছেন কবিতায়।সেই হিসেবে তিনি আধুনিকতার চেয়েও একধাপ এগিয়ে।মূলত নজরুলের আবির্ভাবে তথাকথিত আধুনিকতার অবসান হয়ে নতুন আধুনিকতার সূচনা হয়েছিল যার একটি শাখাতে দোল খেয়েই তিরিশের কবিগণ তাদের সমস্ত জীবন পার করে দিয়েছেন এবং নজরুলের প্রতি নিশ্চুপ থেকে ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তার প্রতিদান দিতে ভোলেননি। নজরুল কবিতার কাঠামোতে বড় ধরণের আধুনিকতা নিয়ে না এলেও তিনিই প্রথম বাংলা কবিতার চেতনায় আধুনিকতার সঞ্চার করেন। নজরুল রচিত ‘বিদ্রোহী‘ কবিতাতেই সর্বপ্রথম মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সার্থক প্রয়োগ ঘটে।একদিকে মাত্রাবৃত্তের অপেক্ষাকৃত ধীর লয়ের ভেতর তিনি এক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতনভাবে কবিতার বীরভাব অনুযায়ী স্বরবৃত্তের গতি এনেছেন।নজরলের কবিতার বিষয়বস্তুকে যে অর্থে সাময়িকতা দ্বারা প্রভাবিত বলা হয় সেটাই মূলত আধুনিকতার প্রধান লক্ষণ।যা কিছু চিরায়ত ধারার অনুসারী সাহিত্যবিচারে তার মান যত উর্ধ্বেই হোক বোদলেয়ার পরবর্তী সাহিত্যের পরিভাষায় যাকে আধুনিক বলা হয় তা মূলত জীবনের প্রত্যক্ষ সত্যের উপস্থিতি নিয়ে।সেই অর্থে নজরুল পূর্ণমাত্রায় আধুনিক ছিলেন।আধুনিকতার লক্ষণ হিসেবে ব্যক্তিচেতনা,সমাজচেতনা,মানবিকতা,জাতীয়তাবোধ,আন্তর্জাতিকতা ইত্যাদি গুণের যে উল্লেখ করা হয় তার কোনটির অভাব ছিল নজরুলের কবিতায়?শুধু অন্তর্মুখীতা ও রহস্যই কী কবিতায় আধুনিকতার একমাত্র মাপকাঠি?মাইকেল মধুসূদন মধ্যযুগীয় পয়ারধর্মী একমাত্রিক ধারা থেকে বেরিয়ে বাংলা কবিতায় যে শব্দমাধুর্যগত বীরভাব এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই বীরভাবকে অনেকটা লঘু করে তাতে অনুভূতি ঢালতে সক্ষম হয়েছিলেন।নজরুলই প্রথম কবিতায় বীরভাব ও অন্তর্গত অনুভূতিকে সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।আবার অপেক্ষাকৃত গীতিধর্মী রোমান্টিক ধারার কবিতাও নজরুলের কম নেই।সুতরাং তিনি দুদিকেই পারঙ্গম। পত্রিকা সম্পাদনাতেও নজরুলের সাফল্য লক্ষ করার মত। কোন রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই যৌবনের শুরু থেকেই তিনি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছেন।নবযুগ,ধূমকেতু,লাঙল,গণবাণী—এসব পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে তিনি সম্পাদনা করেছেন নিজস্ব সৃষ্টিশীল প্রতিভায়।সমাজের নানা বৈষম্য,ইংরেজ শাসনের নানা উৎপীড়ন সরাসরি তুলে আনতে তিনি দ্বিধা করেননি।তারই ধারাবাহিকতায় যখন ধূমকেতু পত্রিকায় “আনন্দময়ীর আগমনে” র মতো ইংরেজ শাসনের প্রতি সুতীব্র আক্রমণকারী কবিতা প্রকাশ করেন তখন ইংরেজরা তাকে কারারুদ্ধ করে।জেল থেকে বের হয়ে এসে তিনি আবার ‘লাঙল‘ পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন।কোন রক্তচক্ষুকে তিনি তার সত্য বলার পথে গুরুত্ব দেননি।তাইতো বাংলা সাহিত্যে একমাত্র তিনিই এত প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ শাসনের বিরোধীতা করতে পেরেছিলেন।অনয়াসে লিখতে পেরেছিলেন এমন ঘূর্ণী বাণী–“এদেশ তোরা ছাড়বি কিনা বল/নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল“।শুধু কবি হওয়া লক্ষ্য হলে এ কথা লেখার সাহস তিনি দেখাতেন না।কবিতার ক্ষেত্রে তিনি একজন যুগস্রষ্টা,কবিতার বাইরেও তিনি মানুষের মুক্তকামী এক সাম্যবাদী মহামানব।বিপ্লবের প্রতি নজরুলের মানসিকতা কতটা উদ্বুদ্ধ ছিল তার চিহ্ন তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা‘তে তো পাওয়া যায়ই এমনকি লক্ষ করার বিষয় ‘অগ্নিবীণা‘র উৎসর্গপত্র।প্রথম সৃষ্টি যেখানে মানুষ মা–বাবা বা একান্ত কাছের মানুষকে উৎসর্গ করেন সেখানে তিনি তা উৎসর্গ করেছিলেন বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে।বারীন্দ্রকুমার ঘোষ তখন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারী তালিকায় সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য ছিলেন এবং অস্ত্র মামলায় তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল।সুতরাং উৎসর্গপত্রে এমন নিষিদ্ধ নাম দেখে প্রশাসন তার প্রতি খড়গহস্ত হবে কি হবে না—এসব নিয়ে শুরু থেকেই নজরুল ভ্রূক্ষেপহীন ছিলেন।নজরুলের এই ক্ষ্যাপাটে প্রকৃতির প্রতি লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ তাকে প্রায়ই বলতেন “দেখ উন্মাদ,তোর জীবনে শেলীর মত,কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে–তুই প্রস্তুত হ“।আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের এই ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়েছিল। কবিতা ছাড়াও শিশুতোষ ছড়া রচনায় নজরুলের সাফল্য পর্বতস্পর্শী।নজরুলের ছড়াগুলো একদিকে শিশুদের আনন্দের খোরাক মিটিয়েও তা বৃহৎ আদর্শের অনুগামী।তিনি যখন বলেন “থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে/দেখব এবার জগতটাকে” অথবা “তোমার ছেলে জাগলে মাগো/রাত পোহাবে তবে” তখন তা একইসাথে সার্থক ছড়া হয়েও ভাবগুণে জীবনের গভীর উদ্দেশ্য ও দর্শনকে ধারণ করে। আবার ‘খুকী ও কাঠবিড়ালী‘র মতো সম্পূর্ণ শিশুতোষ রচনাও তার রয়েছে যেখানে একান্তভাবে শিশুসুলভ মানসিকতার অসাধারণ প্রকাশ ঘটেছে।তাছাড়া ছোটগল্প,নাটক,উপন্যাস,প্রবন্ধ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নজরুলের অবদান প্রশংসনীয়।নজরুল চলচ্চিত্র পরিচালক ও সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন।শিল্পের সকল শাখায় পদচারণার পাশাপাশি একই নজরুল আবার দেশের রাজনৈতিক মঞ্চসমূহেও ছিলেন সোচ্চার।এক হাতে বাঁকা বাশের বাঁশরী নিয়ে যেমন তিনি সুন্দরের সাধনা করেছেন আবার আরেক হাতে রণতূর্য নিয়ে তিনি বিদ্রোহের বাণী ছড়িয়েছেন। তার ‘বিদ্রোহী‘ মূলত এই সৃষ্টি ও সুন্দরের ভিত্তি নির্মাণের জন্যই।বাংলা গানের জগতে নজরুল এক দারুণ প্রাণ সঞ্চার করেছেন।বাংলা গানে সুরের এত বিচিত্র চর্চা নজরুল ছাড়া আর কেউ করেননি।আধুনিক গান, পল্লীগীতি, জারি–সারি,ভৈরবী, আধ্যাত্মিক, সুফি ও ভক্তিমূলক, গজল এবং শাস্ত্রীয় সংগীত সকল ক্ষেত্রে তার অবাধ বিচরণ।ইসলামি গান তার অন্যতম একটি অবদান।ইসলামী গান রচনা করে মুসলমান সমাজকে তিনিই প্রথম এত বিস্তীর্ণভাবে সঙ্গীতমুখী করতে পেরেছিলেন।নজরুল রচিত “ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” গানটি ছাড়া এখন বাঙালী মুসলমানের রমজানের ঈদই কল্পনা করা যায় না। নজরুল যেকোন অনুষ্ঠানে বেশিরভাগ সময় লাল পোশাক পড়তেন।এটা ছিল তার বিপ্লবের প্রতীক। ভেতরে ও বাইরে আপাদমস্তক তিনি বিপ্লবের এই রক্তাভ আলো ধারণ করেছিলেন।নজরুলের সৃষ্টিমানস ছিল বাইরের দিকে উন্মুখ। তার উচ্চারণ ছিল বলিষ্ঠ ও প্রত্যক্ষ।তাই তার কবিতায় রহস্য ও অন্তর্মুখীতা খোঁজা বোকামি।তবে অন্তর্মুখীতা পাওয়া যাবে তার গানে। মার্ক্সবাদী চেতনা,রুশ বিপ্লবের কম্পাঙ্ক,তুরস্কের জাতীয়তা সংগ্রাম সবকিছুই আন্দোলিত করেছে তাকে।ঝাপিয়ে পড়েছেন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে।আদর্শ উচ্চারণে কখনও তিনি পরিণাম নিয়ে ভাবেননি।কবিতা লিখে জেলে গিয়ে কয়েদীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে সেখানেও অনশন করেছেন।নজরুলকে সবচেয়ে যিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি সেই বিশ্বমনীষা রবীন্দ্রনাথ।তাইতো সেই সময় সাহিত্যের একমাত্র সিংহাসন আরোহী রবীন্দ্রনাথ তরুণ কবি নজরুলের অনশন ভাঙাতে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন–“Give up hunger strike, our literature claims you”।তবে নজরুল এই বার্তাটি তখন পাননি।শিলং থেকে রবীন্দ্রনাথ বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে।কিন্তু নজরুল তখন ছিলেন হুগলি জেলে যা রবীন্দ্রনাথ তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেননি। বাঙালীর চেতনায় নজরুল এতটাই মিশে গেছেন যে তাকে সহজাত অর্জন ভেবে তার চর্চা থেকে আমরা দূরে থাকি।এখানেই বিপদ।নজরুল সহজ,নজরুলকে আমরা আয়ত্ত্ব করে ফেলেছি ভেবে নজরুল মানস থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে থাকি।ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও পাঠকমহল তৈরি হয়েছে যারা নজরুল বিষয়ে উদাসীন থাকাকে নিজেদের উচ্চস্তরের চিন্তাশীলতার চিহ্ন হিসেবে প্রকাশ করেন।ফলে পরাবাস্তবতা সম্পর্কে,মার্ক্সবাদ সম্পর্কে,পাশ্চাত্য শিল্পবিদ্যা সম্পর্কে আমরা একেকজন গবেষক হয়ে উঠছি ঠিকই কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতির ধারকদের সাথে ন্যূনতম যোগসূত্র রাখছি না।এটা স্পষ্টভাবেই আমাদের দীনতার লক্ষণ ও পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের ফল।বলা হয়ে থাকে নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি।নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি হোক বা না হোক,নজরুল এতোই বড় যে তাতে নজরুলের মর্যাদা কমে বা বাড়ে না।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে,বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ যাকে জাতীয় কবি বলে জানেন,পাঠ্য বইয়ে শৈশব–কৈশোর থেকেই যাকে জাতীয় কবি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়—সরকারীভাবে তার জাতীয় কবির কোন স্বীকৃতি নেই!স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে নাগরিকত্ব প্রদান করলেও,সেই সময় তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেও এখন পর্যন্ত কোন সরকার কাগজে কলমে তাকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি।আমি মনে করি নজরুলের জন্য এটা জরুরিও নয়।কিন্তু যখন একইসাথে সরকার প্রণীত পাঠ্যবইয়ে তাকে জাতীয় কবি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে তখন এ ব্যাপারে সরকারি দলিল না থাকাটা জনগণের সাথেই একধরণের প্রতারণা। নজরুল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছিলেন বলে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সাথে তার নামকে সরাসরি জড়িয়ে না নেওয়া তবে কি একইসাথে কোন বৈদেশিক কূটনীতিরই অংশ? নজরুলকে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে যখন কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালী জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তখন থেকেই তিনি জাতীয় কবি হিসেবে বাঙালী সমাজে পরিচিত।এলবার্ট হলের সেই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও সেই সময়ের অনেক গুণী মানুষ উপস্থিত ছিলেন।সুতরাং নজরুল শুধু বাংলাদেশের জাতীয় কবি নয়,পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্মের বহু আগেই তিনি বাঙালীর জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত।নজরুলের কবিতা ও গানে বাঙালীর স্বপ্ন,চেতনা এত গভীরভাবে জাগ্রত ছিল বলেই নজরুল এই সম্মান পেয়েছিলেন।তবে আজ হঠাৎ নজরুলকে দুই বাংলাতেই এত আড়াল করার চেষ্টা কেন,নজরুলের সৃষ্টিশীলতাকে এত পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেন—তা আমাদের ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে।পশ্চিমবঙ্গে নানা কারণে নজরুল একপ্রকার উপেক্ষিত,নজরুল সঙ্গীতের অপার মহিমার জন্যই বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে তার সামান্য চর্চা হয় মাত্র।কিন্তু বাংলাদেশেও নজরুল নানাভাবে উপেক্ষিত তা আগেই বলা হয়েছে।বাংলাদেশে নজরুলচর্চা পাঠ্যপুস্তকের সামান্য অধ্যয়ন ও সরকারী কিছু বক্তৃতামালাতেই সীমাবদ্ধ। নজরুলের আদর্শকে সমাজের সর্বস্তরে প্রসারের কোন উদ্যোগ আমাদের নেই।এমনকি এমনও শোনা যায়,নজরুল বিষয়ে পিএইচডি করেও অনেকে ভাল চাকরি পান না।অন্যান্য ডক্টরেট ধারীর মত তাদের মূল্যায়ন করা হয় না।ভাবা হয় নজরুলের উপর পিএইচডি—এ আর এমন কী? তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে নজরুল বিষয়ে এখনও সমৃদ্ধ কোন ওয়েবসাইট গড়ে ওঠেনি যেখানে যে কেউ চাইলেই তার লেখা পড়তে পারেন।নজরুল ইনস্টিটিউট গঠন করে আমরা হয়তো নজরুল চর্চার সমস্ত ভার তার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছি।অথচ নজরুল ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটেও সঞ্চিতা কবিতাগ্রন্থ,নজরুলের পাঁচ পাতার অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত জীবনসূচি,ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত নজরুল বিষয়ক গ্রন্থতালিকার লিঙ্ক ছাড়া উল্লেখ করার মত আর কিছুই নেই! নজরুল জীবনবাদী যেকোন কিছুকে নিজের দিকে টেনে নিতেন।মাঠ থেকে সদ্য তুলে আনা পাতাগন্ধী ফসলে যেমন সামান্য ধুলোবালি মিশে থাকে নজরুলের কবিতাতেও প্রগাঢ় মমতাময়ী উচ্চারণে কোথাও কোথাও কাব্যগুণে শিথিলতা স্বাভাবিক।কলকারখানায় পরিশোধিত চালে ধুলোবালি আর কীট না থাকতে পারে কিন্তু ধানের খোসার গন্ধ থেকেও সে বঞ্চিত।নজরুলই বাংলা সাহিত্যের একমাত্র কবি যিনি শুধু কবিতা দিয়ে গণমানুষের এত কাছে যেতে পেরেছিলেন।কবিতাকে শুধু অবসর যাপনের বিষয় না করে তিনিই প্রথম সমাজে ও ব্যক্তিজীবনে তার উপযোগিতা দেখিয়েছেন।প্রয়োজনের কথা,নীতি ও আদর্শের কথা বললেই যদি তা শিল্পমাধুর্যহীন মোটাদাগের কথা বলে বিবেচিত হয় তবে বলতে হবে আমাদের বিবেচনাতেই ঘুণ ধরেছে।সহজ কথা বলা যদি সহজই হত তবে নজরুলের সমস্থানীয় দ্বিতীয় কেউ অবশ্যই এই সহজের সুযোগ নিতেন। তাই বাংলা কবিতায় নজরুলের আসন ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবার মতোই প্রলয়োল্লাসী। You Might Also Like জেবুন্নেছা জ্যোৎস্না’র গুচ্ছকবিতা September 16, 2021 পিপুফিশু- ১০ || আলী সিদ্দিকী October 4, 2023 পিপুফিশু -১৫ || আলী সিদ্দিকী November 26, 2023