You are currently viewing নগ্ন সুন্দরী || হাসিন আরা

নগ্ন সুন্দরী || হাসিন আরা

নগ্ন সুন্দরী || হাসিন আরা

জোহরা বেরিয়ে যেতেই গোলাপের কী যে হয়। আর একমুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। যে মানুষটাকে জোহরা পরিত্যাগ করে এসেছে সেই অসহায় একাকী ওয়াহিদের মূর্তি তার মানসপটে উদয় হয়ে তাকে অস্থির করে তুলছে। শান্তিকুঞ্জের অতবড় বাড়িটায় একটা মেয়েমানুষ নেই। স্নেহময়ী মা লুৎফুন্নেসা, কর্তব্যপরায়ন পারিবারিক পরিচারিকা ফুলবুড়ি, আদরিণী বোন ময়না কেউ নেই। সাধারণ পরিচারিকা জোছনা,শেফালি,শিউলি,জুই- চামেলিদের তো প্রশ্নই আসে না। কেউ আর ওয়াহিদের নেই। না না।ওয়াহিদের কেউ না থাক গোলাপ এখনও আছে শুধু তার তারই। শান্তি নামের কেউ নেই গোলাপের জীবনে। শান্তি তাকে কোন আনন্দ, কোন সুখ, কোন বিস্ময় দিতে পারে নি। যা দিয়েছিল ওয়াহিদ। শান্তির পৌষ্যপিতা। ওয়াহিদ তার জীবনে বিস্ময় ও চমক এনে দিয়েছিল। শান্তি আর জোহরার জন্য তা রুদ্ধ হয়েছে। ভাগ্যিস জোহরা তাকে লাইব্রেরী ও নাচের স্কুলের দায়িত্ব দিয়েছিল। নইলে সে কী নিয়ে বাঁচতো? ফুল আর শিল্প তো তার জীবন থেকে শেষ হয়ে গিয়েছিল সেদিনই যেদিন ওয়াহিদ তার ছবি আঁকতে গেলে বিপর্যয় ঘটলো। এতদিন সে শুধু ছায়ার মত চলছে যার ভেতরে কোন জীবন ছিল না। শুধু বইএর মাঝে মুখ গুঁজে আর নাচের স্কুলে মেয়েদের নাচ শিখিয়ে জীবনের খোরাক মিটিয়েছে। নইলে শান্তিকুঞ্জের সেই ফুলপ্রেমিক, গোলাপপ্রেমিক বলাই উচিৎ। সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো অদ্ভুত যাদুময় শিল্পীকে ছেড়ে সে কিভাবে বাঁচতো?গোলাপ দ্রুতহাতে স্যুটকেস গোছায়। টেবিলের উপর থেকে কলম আর রাইটিংপ্যাড টেনে নিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখে ‘’ শান্তি, আমি চলে গেলাম যেখানে কোনদিন তুমি যাবে না।’’
সারা রাস্তা সে একটা ঘোরের ভেতর গাড়িতে বসে থাকে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে কখনও টিপটিপ কখনও মোষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কেমন শীত শীত অনুভূতি হচ্ছে গোলাপের। নিজ শহরের মুখে গাড়িটা ঢুকতেই তার হৃদয়টা দুলে ওঠে। বাসটার্মিনালে এসে গাড়ি থামতেই গোলাপ স্যুটকেস হাতে নিয়ে লাফ দিয়ে নামে গাড়ি থেকে। ওকে দেখে বাবা- মা দুজনেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। শেষে জামালউদ্দিন মুখ খোলেন,
কিরে গোলাপ কেমন আছিস মা?
ভাল আছি বাবা বলে কদমবুঁচি করে গোলাপ।
মা বলেন, তুই একা যে শান্তি আসে নাই?
গোলাপ কোন কথা না বলে ঘরে ঢোকার পর দুজনে আবার শান্তির কথা জিজ্ঞেস করেন। গোলাপ মিথ্যে করে বলে
শান্তি আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে গেছে। তার ক্লাশ আছে না? আমি তো বিপদে পড়ে এসেছি।
বিপদের কথা শুনে দুজনের আবার প্রশ্ন। গোলাপ আবার মিথ্যের আশ্রয় নেয়
শান্তিকুঞ্জে তোমাদের বেহাই খুব অসুস্থ। আমার শাশুড়ি মিসেস জোহরা মেয়ের কিছু একটা খবর পেয়ে ভোরে চলে গেছেন মেয়ের ওখানে। আমাকে আজই শান্তিকুঞ্জে যেতে বলেছেন। রাতে তো আর গ্রামে যেতে পারব না। ভোরে শ্বশুরের শহরের বাসা থেকে কেয়ারটেকার করিমবক্সকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি করে চলে যাব। বাবা তুমি রাতেই তাকে খবরটা দিয়ে আস।
খবর পেয়ে পরদিন ভোরে সাইকেল নিয়ে এসে হাযির করিমবক্স। গোলাপ বেরিয়ে এলো। সে সাজ- সজ্জা করেছে একটু অন্যরকম ভাবে। পা দুটি তরল আলতায় রাঙিয়ে হাতে মেহেদী লাগিয়েছে রাতেই। গোলাপের মা মেয়ের সাজগোজ দেখে একটু আশ্চর্য হলেন। শ্বশুর অসুস্থ আর সে কিনা সাজ- সজ্জা করছে। সেদিকে মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষন করলে গোলাপের সোজাসাপ্টা উত্তর, এটা ঐ বাড়ির রেওয়াজ। বউ হয়ে বিধবার মত সাজ- সজ্জা ছাড়া বাড়িতে পা রাখা চলবে না।
যাওয়ার আগে বাগান থেকে দুটি গোলাপকুঁড়ি ও একটি ফুটন্ত গোলাপ খোঁপায় গুঁজে নিল। যদিও জানে শান্তিকুঞ্জে পৌছুঁতে পৌঁছুতে এ ফুল টলে যাবে ম্লান হয়ে। তবু গন্ধটা থাকবে গোলাপকে ঘিরে। যেখানে যে অলংকার মানায় পরেছে গোলাপ।,পরণে লালপেড়ে গরদের শাড়ি। ভেলভেটের লালরঙের ম্যাচিং ব্লাউজ। কানে চুনির দুল। গলায় লাল পাথর বসানো ছোট্ট লকেট। এক হাতে কাল ফিতের ঘড়ি অন্য হাতভর্তি স্বর্ণের চিকন চুড়ি। অলংকারগুলি ও বাড়ি ছেড়ে যাবার পর জোহরা কর্মকারের দোকানে ফরমায়েশ দিয়ে বানিয়ে দিয়েছিল। কোনদিন পরে দেখেনি। আজ এই প্রথম পরলো। স্টেশনে গিয়ে বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে রাণীর মত ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে বসল।
ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটতে শুরু করলে গোলাপ মনে মনে ওয়াহিদের সাথে কথোপকথন জুড়ে দিল। শান্তিকুঞ্জে পৌছে গোলাপ ওয়াহিদকে সালাম করে ওয়াহিদের বুক ঘেঁষে দাড়ালে ওয়াহিদ গোলাপকে বলবে
সালাম করছ কেন গোলাপ? আমি এ সব পছন্দ করি না।
আপনি আমার দেবতা।
দূর! এ সব সেকেলে কথা।
আপনি আমার মানসকুমার।
তুমিও আমার মানসকন্যা। তাই তোমার জায়গা আমার পায়ে নয়, বুকে।
তাইতো আপনার বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি আমি। আমাকে আশ্রয় দেন।
বোকা। তোমার আশ্রয় চিরদিনই আমার বুকে ছিল, আছে এবং থাকবে। এই নাও তার প্রমান।
ওয়াহিদ তাকে বুকের মাঝে পিষ্ট করবে দু’ বাহুর বন্ধনে। গোলাপের ঘোমটা খসে পড়বে। ওয়াহিদের চোখে পড়বে তার খোঁপায় দুটি গোলাপকুঁড়ি ও একটি ফুতন্ত গোলাপ। ঘ্রাণ নিতে নিতে ওয়াহিদ বলবে
কোনটা তোমার খোঁপার ঘ্রাণ, কোনটা ফুলের আর কোনটা তোমার দেহের কিছুই যে আলাদা করা যাচ্ছে না।
এরপর গোলাপের মুখটি দু হাতে তুলে নিয়ে বলবে
সেই তো এলে গোলাপ! এত পরে কেন এলে? এখন তোমাকে কী দেব আমি? কী দিয়ে সুখি করব?
কেন আপনার রঙ তুলি দিয়ে। আমি আপনার ন্যুড মডেল হব। শুধু বুকের আঁচল ফেলে নয়, পরিপূর্ণ নগ্নসুন্দরী হয়ে আপনার চোখের সামনে দাঁড়াব। ছবি আঁকা শেষ হলে সেদিনের মত বুকে করে আমাকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিবেন। তারপর আমার চোখে, ঠোঁটে, কপোল- কপালে যেখানে খুশি চুমোয় চুমোয় ভরে দিবেন। এটুকু পেলেই আমি সুখি আমি সুখি আমি সুখি।
নিজের কন্ঠ নিজের কানে যেতেই ধ্যান ভংগ হয় গোলাপের।
আচ্ছা কেমনভাবে নেবে তাকে ওয়াহিদ? যেমনভাবেই নিক। সে ফুলবুড়ির মত আশ্রিতা হয়ে থাকবে। ফুলবুড়ির কাজগুলি করবে। আচ্ছা কেমন হবে যদি ওয়াহিদকে বলে
আমাকে ‘ফুলবউ’ বলে ডাকবেন। ওয়াহিদ কি বলবে?
না না। আমি তোমাকে গোলাপবউ বলে ডাকব।
এত কিছু ভাবার সময় নেই আর। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার কাছে প্রায় চলে এসেছে।
হন্তদন্ত হয়ে রহমত ছুটে এসে বলে, ছোটসাহেব! বৌমণি আইছেন।
বৌমণি? বিস্ময়ের উপর বিস্ময়। বৌমণির তো আসার কথা না আর। তুমি ঠিক দেখেছ তো? জোহরা এসেছে?
না ছোটকর্তা ছোটবৌমণি আইছেন।
টনক নড়ে ওয়াহিদের। ঘোড়ার গাড়ি একেবারে প্রধান গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লালপেড়ে গরদের শাড়ির তলা দিয়ে আলতারাঙা কাঁচা হ্লুদবর্ণের পা দুটি দেখেই ওয়াহিদ বুঝল ঐ দেবীর মত পা গোলাপের ছাড়া আর কারও হতেই পারে না। ওয়াহিদের ইচ্ছে করছে ঘোড়ার গাড়ির ভেতর বসে থাকা গোলাপের রাঙাপায়ে বাগানের যতো গোলাপ আছে সব তুলে এনে ঢেলে দিতে আর সেটাই হবে তার যোগ্য সম্মান। কিন্তু গোলাপ যে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। একমাত্র ছেলে কিশোর তন্ময়কে বলবে নাকি অন্তত একটি গোলাপ তুলে এনে ওর হাতে দিয়ে তার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাতে। গোলাপ তার ঘরের দিকেই আসছে। চোখাচোখি হতেই ওয়াহিদ নিজের ভেতর একটা তোলপাড় অনুভব করে।

*****************************