You are currently viewing দয়াময়ীর কথা: নারীর চোখে দেশভাগ/ ড. নিলুফা আক্তার

দয়াময়ীর কথা: নারীর চোখে দেশভাগ/ ড. নিলুফা আক্তার

দয়াময়ীর কথা: নারীর চোখে দেশভাগ

ড. নিলুফা আক্তার

(সার সংক্ষেপ: মাতা-পিতা এবং মাতৃভ‚মি পরস্পর মানব অস্তিত্বের সম্পূরক। এই দুই সত্তাকে কেন্দ্র করে জীবন তথা মানুষের অন্তর্জগত ও বহির্জগত স্থিতি ও গতি পায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বাঙালির জীবনে ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। মানুষের জীবনে স্থিতি ও গতির সমন্বয় ও সামঞ্জস্য সমুলে ধ্বংস করে দেয়। এই ধ্বংসের শিকার হাজারও বাঙালির মতো সুনন্দা সিকদার অর্থাৎ দয়াময়ী। এক দিকে জন্মভ‚মি অন্যদিকে মাতাপিতা এবং মধ্যখানের শূন্যস্থানে ভালোবাসা আর অস্তিত্বের টানাপোড়ন নিয়ে বেড়ে ওঠা দশ বছরের বালিকা ‘দয়া’। প্রেম এবং অস্তিত্বের সংকটের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে ওঠা দয়ার স্মৃতির মানচিত্র ‘দয়াময়ীর কথা’। শিশু দয়া থেকে নারী সুনন্দা সিকদারের উত্তরণের পথে দেশভাগকালীন সংগঠিত ঘটনা, বিচিত্র উপলব্ধিবোধ, গভীর বেদনা তথা একজন নারীর দৃষ্টিতে দেখা ‘দেশভাগ’ এর মর্মভেদী বয়ান আলোচ্য সেমিনার পেপারের মূল প্রতিপাদ্য। )

‘পূর্বপুরুষের ভিটা এমনি কেউ ছাড়ে না, বহু দু:খে পরানের অর্ধেকটা রাইখ্যা যাইতাছি।’ (সিকদার, ২০১২ : ৭০) দেশভাগের অন্তর্জ্বালার এই মর্মভেদী স্বীকারোক্তি শুধু কী লাহিড়ী কর্তার একার ছিল? না, বরং পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু, শরণার্থী, বাস্তুহারা, ভূমি বিনিময়ী পরিবার, লতায়-পাতায় বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে যাপিত পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষের অনুভূতি ঐ পরানের অর্ধেকটা রেখে যাওয়ার রক্তাক্ত স্মৃতিতে গুম হয়েছিল। যে স্মৃতির কথা বলাও যায় না; সহাও যায়না। দশ বছরের শিশু ‘দয়া’র ছোট জীবনের আনন্দ, দেশভাগের মর্মান্তিক দু:খভার হয়ে গেঁড়ে থাকে লেখক ‘সুনন্দা শিকদারে’র গোটা সত্তায়। দাদার ‘মৃত্যুচিঠি’ সুনন্দা সিকদারের স্মৃতির হীমঘরে বাঁধ ভাঙা প্লাবন আনে। সুনন্দা, কাঁকন, দয়াময়ী সব ছাপিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় ‘দয়া আর দেশভাগ।’ লেখক ‘সুনন্দা সিকদারে’র নারী সত্তায় জোনাকী আলোর মত প্রজ্জ্বলিত তাঁর অস্তিত্বের খন্ডাংশ, ‘শিশু দয়া’ আর শিকড় ‘জন্মভূমি’ পূর্ববঙ্গ। দুই যুগেরও অধিক সময়  ধরে যক্ষের ধনের মত বুকে পুষে রাখা শিশু দয়ার স্মৃতির মূল আকর ‘দেশভাগ’। দেশভাগ এর জটিল কুটিল আবর্তে দিকভ্রান্ত মানুষের জীবন দেখেই পূর্ববঙ্গের দিঘাপাইত গ্রামে অতিবাহিত দয়ার দশ বছরের শৈশব জীবন। সেই ‘দয়া’ পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ‘সুনন্দা সিকদার’ আজ পরিণত নারী। ‘সুনন্দা সিকদারে’র স্মৃতিতে সদা-জাগ্রত ‘দয়া’র শৈশবে দেখা দেশভাগের সঙ্কটকালীন দিঘাপাইত ও আশেপাশের গ্রামের মানুষের স্মৃতি নিয়ে রচিত প্রবন্ধ ‘দয়াময়ীর কথা: নারীর চোখে দেশভাগ।’ সুনন্দা সিকদারের অতিবাহিত কালের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, রসে গন্ধময়, রূপ-চিত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্য, স্পর্শে অনুভব যোগ্য স্মৃতি জাগানিয়া অতীত ‘দয়াময়ীর কথা’। দয়া থেকে সুনন্দা সিকদারে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমণে মিশে আছে দিঘাপাইত গ্রাম থেকে পশ্চিম বঙ্গ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ বছরে জীবন পরিক্রমার গভীরবোধ ও প্রজ্ঞার নিবিড় রসায়ন।

ইংরেজি Partition শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘ভাগ’ যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘দেশ’। বাঙালির ইতিহাসে ‘Partition’ শব্দটি আক্ষরিক অর্থের উর্ধ্বে নতুন একটি ভাবার্থ নিয়ে উপস্থিত তা হলো ‘দেশভাগ’। অর্থাৎ বাঙালি ‘Partition’ বলতে মূলত ‘দেশভাগ’কেই বোঝে। অর্থাৎ মানুষের জন্ম-কর্ম-ধর্ম তথা সম্পর্ণূ মানুষ সত্তা খন্ডিত হয়ে যাচ্ছে এই একটি শব্দের দ্বারা। যার সামনে-পিছনে আশে-পাশে কোন সহায়ক শব্দ নেই। সরাসরি ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এই ‘Partition’ শব্দটি। যার প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া মানুষের ভাগ। নির্মম মূলচ্ছেদ। অসহ্য শূন্যতা। গভীর ‘না’। স্বদেশী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের মূল আঁকড়ে আছে অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ অর্থাৎ ‘হা’ এর জন্য যুদ্ধ। এই Being এর জন্য যুদ্ধে মানুষ বিভাজিত হয় না বরং একত্রিত হয়। যুদ্ধ মানে হারানো প্রাপ্তির খেলা। তথাপি জয়ী হলে হারানো বোধটি মৌন হয়ে উচ্চকিত হয়ে উঠে প্রাপ্তি। কিন্তু দেশভাগ কী আদৌ মানুষের এই সর্বজনীন সত্তা অর্থাৎ Universal Being এর জন্য যুদ্ধ? শ্বাশত জনতার প্রাপ্তির জন্য যুদ্ধ না কি কেবল হারানোর যুদ্ধ? নিজের অস্তিত্বকে নিজের কাছ থেকে খন্ডিত করার জন্য যুদ্ধ? মানুষের মধ্যে যখন বিভাজন শব্দটি প্রয়োগ হয় তখন সেখানে আদৌ কি কোন ইতিবাচক ফল বাস্তবায়িত হয়? হয় না। ফলে যে অহংকার আত্মবিশ্বাস নিয়ে মানুষের কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস উচ্চারিত হয় ঠিক ততটাই বেদনা আর গ্লানি নিয়ে মানুষ উচ্চারণ করে ‘Partition’ বা ‘দেশভাগ’ শব্দটি। ভারতবর্ষ জয়ের গৌরবময় ইতিহাস দেশভাগের এই কলংকিত অধ্যায়ের অন্ধকারে বিবর্ণ ম্রিয়মান, ধূসর। অবিভক্ত ভারতের জয় চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে দেশভাগের ধারালো অস্ত্রে বাঙলির সর্বজনিন সত্তাকে দ্বিখন্ডিত করে। ১৯৪৭ এর ১৫ অগাস্ট ভারত ভ‚-খন্ডের জয় এবং বাঙালির জাতীয় সত্তার পরাজয়, এই পরস্পর বিপরীতমুখী চেতনা নিয়ে ‘বাঙালি-অস্তিত্ব’ আজও প্রবহমান। আরো একটি নির্মম বাস্তবতা হলো দেশভাগ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে মানচিত্র অর্থাৎ ঠিকানা, ভ‚গোল, ইতিহাস, জলবায়ু, আবহাওয়া, এমনকি খাদ্যাভাস সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। কিন্তু সমাজ তার স্থিতিস্থাপকতা দিয়ে মানুষ বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্ভ‚ত বস্তুগত শূন্যস্থান নিয়ত পূর্ণ করে দিয়েছে, ভাবগত শূন্যতা প্রেতাত্মা হয়ে আমৃত্যু মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

সুনন্দা সিকদার অর্থাৎ দয়াময়ীর জন্ম পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত অ লের দিঘাপাইত নামক কোনো এক গাঁ-এ। পালিকা মায়ের মুখে শিশু দয়া তার জন্ম বৃত্তান্ত শুনে,

……দ্যাখ দয়া……তোমারে যে আজ আমি কোলে পাইচি, তাও নিয়তির খেলা। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হইল, তোমার মা বাপ হিন্দুস্তানে চাকরি পাইয়া চইলা গেল। তোমারে তখন দেখাশুনা করে তোমার বড়দা দুলু। এই দুলু আবার চাকরি পাইল হিন্দুস্তানের রূপনারায়নপুর। কেমুন কইরা সে আপিস যায়। তুমি তখন কয় মাসের শিশু। দুলু আমাদের কইলো, পিসিমা, এটারে তুমি নিয়া যাও। দুলুর কথায় তোমারে আইনলাম। বুড়ির দুধ খাইয়া আস্তে আস্তে বড়ো হইয়া গেলে।’ (সিকদার, ২০১২ : ৭২)

অর্থাৎ দয়ার জন্ম ’৪৬ এর দাঙ্গা, ’৪৭ এর দেশভাগের ক্রান্তিকাল ধরে ১৯৫১ সালে। দয়ার জন্ম ইতিহাস থেকে পাঠক জানতে পারে দেশভাগের কারণে একটি পরিবারের খন্ডিত হওয়ার, শিকড়চ্যুত হওয়া বেদনাময় কাহিনি, আটমাসের একটি শিশুর পিতা-মাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মর্মান্তিক ইতিহাস। পরবর্তীতে দেখি দেশভাগের নীরব ব্যথা অন্তরে গোপন করে শিশু দয়ার বেড়ে ওঠা। ১০ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গে মা-বাবার কাছে ফিরে যাওয়া। শিশু ‘দয়া’ই একসময় ‘সুনন্দা সিকদার’ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকা আকাশ বাতাস জলে জড়িয়ে যায়। আদৌ কী জড়িয়ে যায়, জড়ানো কী যায়? সুনন্দা সিকদারের দয়াময়ীর কথা থেকেই তার মনোজগতের কথা জানা যাক, ‘যারা মনের গতিবিধি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাই বলতে পারবেন, আমি কেন শৈশবের দশটা বছর এমন যক্ষের মতো আগলে রেখেছি এত কাল।….চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পশ্চিমবঙ্গের এক মফস্সল শহরের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও মনে হয় আমি অনধিকার প্রবেশকারী ’(সিকদার, ২০১২ : ৪২) এ শুধু দয়ারূপী সুনন্দার একার মনোকথা নয়, দেশভাগের কারণে ভিটেমাটি ছাড়া, হারা সকল মানুষেরই মনোকষ্টের কথা। দশ বছরের শিশু দয়া আজ পরিণত নারী সুনন্দা, কারো স্ত্রী, কারো মা। ভরাভারা সংসারের কর্ত্রী। জন্মক্ষণ থেকে শুরু করে জীবনের দশটা বছর সে অতিবাহিত করেছে পূর্ববঙ্গের দিঘাপাইত গ্রামে, আর চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর জীবন পশ্চিমবঙ্গে অথচ শৈশবের সেই দশটা বছর তাঁর কাছে যক্ষের ধন হয়ে আছে। পিতামাতা ভাই বোনের সান্নিধ্য, স্নেহ, ভালবাসা, স্বামীর প্রেম, সন্তানের ভালবাসাও তাঁর মাতৃভূমির টানের অভাব পূর্ণ করতে পারেনি। জীবনের এই গভীর উপলব্ধিবোধ দয়া কোথায় পেল? কেমন করে?

অভীক মজুমদার এর আলোচনা থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় :

ধর্ম-ভাষা-বর্ণ গাত্রবর্ণ প্রভৃতি বহুলাংশ মানব অস্তিত্বের তথা মানুষের আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু, এসবের পাশাপাশি মানুষের একটা বড় পরিচয় তার ভূখন্ড, তার মানচিত্রগত অ লবৈশিষ্ট্য, অধ্যাপক হিতেশরঞ্জন সান্যালের কথা ধার করে বলা চলে, মানুষের স্থানিক মাত্রা। যে বিশেষ জল মাটি পরিবেশ এবং জন-মানুষ, জীবিকা জীবনচর্যার সান্নিধ্যে কোনও ব্যক্তির জন্ম, সে নিতান্ত সংকীর্ণ তল্লাটের ছোট ছোট বৈশিষ্ট্যও অজান্তে ধারণ করতে থাকে মানুষ, বড় হওয়ার সঙ্গে সেসব অনু-পরমানু মিশে যেতে থাকে তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে-হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্বের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ( ঘোষ, ২০১৪ : ১৪৯)

এই বক্তব্যের সত্যতা মেলে ‘দয়া’র স্মৃতিচারণে ‘পরবর্তী জীবনে আমার আরও দুটি নাম হয়েছিল, বাবার আর আমার জন্মদার্ত্রী মায়ের দেয়া-কাঁকন আর সুনন্দা। এই দুই নামের আড়ালে গাঁয়ের সেই দয়াময়ী তার কিছু গ্রাম্য সংস্কার নিয়ে আজও বেঁচে আছে আমার মধ্যে। (সিকদার, ২০১২ : ৭৪)

কিংবা,

‘যদি বর্ষে মাষের শেষ

ধন্য রাজা পুণ্য দেশ।’

এই সব প্রবাদ প্রবচন-বচন আমাকে আলাদা করে রেখেছে আমার শহুরে বন্ধুদের থেকে।’ (সিকদার, ২০১২ : ৪৩) প্রায় সত্তর বছর পরে দেশবিভাগের স্মৃতিচারণে এই একই বোধে আবদ্ধ ‘ছবি দাস’−⎯‘তবু রাতে শুইয়া মাঝে মাঝে মনে হয়। তুলসী গাছ করছিলাম, বুড়িগঙ্গা থিক্যা মাটি আইন্যা……। কত কাঁচের চুড়ি পরতাম হাত ভইরা……এ দেশে তো ও চলে না।’ ( ঘোষ, ২০১৪ : ৯৭)। এই স্মৃতিতে ট্রমাগ্রস্ত দেশভাগের নির্মম শিকার সকল শ্রেণির সকল ধর্মের মানুষ। আর এই ট্রমার উৎস দেশভাগজনিত নিষ্ঠুরতা। হারানো ভিটে, হারানো মানুষগুলোর সঙ্গে মানুষের গোপন অনুভূতি, অভ্যস্ততা স্মৃতিকাতরতা জড়িয়ে থাকে। চল্লিশোর্ধ দয়াময়ীর স্বীকারোক্তি⎯‘এই শহরের জীবন যাপনের সবগুলো অভ্যেস আমার মধ্যে ঢুকে গেছে। তবু সমস্ত কিছুর মধ্যেই দাদার এক অনিবার্য উত্তরাধিকার আমি বহন করে চলেছি।’ (সিকদার, ২০১২ : ১১) কিংবা, ‘তিনি আমার পালিকা মায়ের ননদ ভুলিপিসিমা। আমার জীবনের ওপর আমার এই পিসিমা স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছেন।’ (সিকদার, ২০১২ : ৩৪) ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, দাঙ্গায় অস্থির উভয় বঙ্গ, হিন্দু মুসলমানের বংশ পরস্পরা সম্প্রীতির বন্ধন বিপর্যস্ত। দয়ার বেড়ে ওঠা দিঘাপাইত গ্রামেও উচুঁ-নীচু, জাত-পাত নিয়ে বড় অশান্তি। ‘দয়াময়ীর কথা’য় বার বার এই বিড়ম্বনার কথা, বেদনার কথা উঠে এসেছে। দয়া রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের সন্তান আর দাদা (মাজম শেখ) ধর্মপ্রাণ দরিদ্র মুসলমান। এই সাম্প্রদায়িক সমাজে সেই দাদার উত্তরাধিকার দয়া কী করে বহন করে? এই ছোট শিশু দয়ার মধ্যে উদার মানবতাবোধ তৈরী হলো কী করে? মাত্র দশ বছর বয়সে অর্থাৎ শিশুর জীবনের শুরু বলা হয় সেই সময়টুকুতে পশ্চিমবঙ্গে মাতা-পিতা, পরিবারের কাছে এলেও পূর্ববঙ্গের মাটি ও মানুষের কথা কেন সে ভুলতে পারে না? সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে সম্প্রীতির এই হাওয়া এলো কোথা থেকে? এই প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক ভাবেই পাঠক কে বিচলিত করে। দয়ার শৈশব স্মৃতিকে প্রত্যক্ষ করলে তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়।

শিশু ‘দয়া’ মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার প্রথম পাঠ নেয় মুসলমান হতদরিদ্র; তাদের বাড়ির দিনমজুর দাদা মাজম শেখের কাছ থেকে। আর মাতৃভূমির মাটির মানুষের গভীর টান ‘দয়া’ প্রথম পরম বিস্ময় নিয়ে অনুভর করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত রহিমা দাদির আঁচলে বেঁধে নিয়ে আসা ‘তিন মুষ্টি মাটির’ অস্তিত্বে। রহিমা দাদি ওদের বাড়ির ‘তিন মুষ্টি মাটির’ গোপন ইতিহাস শিশু দয়াকে শুনিয়েছিলেন। সেই বোধকে লালন করেই দয়ার জন্মভূমির মাটি আর মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার বন্ধন জাগ্রত হয়। অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধে ‘এ তিনমুষ্টি মাটির’ টান এর স্মৃতিই যেন ফিরে আসে-

‘শেষ পর্যন্ত সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বন্ধুটি তুলে দিল আমার হাতে এক কৌটো মাটি। আমার পিতৃ-পিতামহের  আশিস-পূত বসতবাটি ‘বসু বাড়ির ভিটের’ মাটি। এ মাটি আমার মা। এ মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পূর্ব-পুরুষের পুণ্যস্মৃতি…মাথায় ঠেকালাম সে মাটি……এ মাটি বাঙলার হৃদয়-নিঙ্ড়ানো রক্তে সিক্ত আজ।’ (ঘোষ, ২০১৪ : ১৬৭)

‘হারানো দিন হারানো মানুষ’ স্মৃতি গ্রন্থের রচয়িতা সুজিৎ চৌধুরী তাঁর ভূগোলের শিক্ষক বীরেন বাবুর স্মৃতিচারণ করেন ‘ছেড়ে আসা ভূমির প্রতি যে মমতোবোধ থেকে এই আত্মকথনের সূচনা তার আদিম শিখাটি বীরেন বাবুই জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন’  (চৌধুরী, ২০০৮, ১০৭) লেখক সুনন্দা সিকদারের ‘দয়ামীর কথা’ রচনার নেপথ্যের কাহিনীও প্রায় একই ধরণের অনুভ‚তি ও অভিজ্ঞতা সঞ্জাত।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ক্ষমতার নীতিনির্ধারক মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিই থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনে তাদের কল-কাঠি সঞ্চালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ এই তথাকথিত নীতি-নির্ধারকদের চিন্তার ফসল। এর ভয়ংকর বিরূপ প্রভাব ভোগ করে পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ জনগন। এ প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামানের বক্তব্য স্মর্তব্য-‘জনসাধারণ যে আন্দোলনের নায়ক নয় তার সাফল্যে সীমাবদ্ধতা থাকে।’ (ঘোষ, ২০১৪ : ৩৯) এই বাস্তবতা দেশভাগের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ হয়। সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বৃটিশ শাসক আর ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতারা, সাধারণ মানুষের ভেতরে সংক্রামিত করে দিয়েছে, সেই সংক্রমনের প্রতিষেধক মানবতাকে সর্বস্তরের জনগন নানাবিধ কারণে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, ফলে ভাঙ্গনের ভেতরেও নতুন করে গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে মানুষ এগিয়েছিল, তা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ক্ষমতালোভীদের ছড়ানো বিষাক্ত জীবানুর সংক্রমণে সহস্র বছরের প্রীতিতে লালিত বাঙালির জাতিসত্তায় গ্যাংগ্রিনের মতো পচন ধরে। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সত্তা সন্দেহের বিষবাষ্পে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঐ নির্মম বাস্তবতার স্মৃতি প্রত্যক্ষ হয় রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে-

‘১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা খুব প্রবল হয়ে উঠল, তারপর দেশ বিভাগ হয়ে গেল। প্রায় মুসলমানেই চলে যেতে লাগল ভারত ছেড়ে বাংলাদেশে। আমরা তখন বলতাম হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান। সে সময়ে চারিদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না হিন্দু মুসলমান। দু’দলেই মুখে যদিও সবাই সবাইকে বলছে ভাই ভাই কিন্তু সকলের মুখেই যেন কেমন অবিশ্বাসের ছাপ, হিন্দুরা বলছে কোথায় যাবে বাপ পিতামহের দেশ ছেড়ে, মুসলমানরা যদিও বলছে সেতো ন্যায্য কথা, তবুও তাদের চোখে ভয় চকতি চাহনি- কোথায় যেন গলদ আটকে গেছে। হিন্দুরা তাকায় মুসলমানের দিকে সন্দেহের চাহনিতে, মুসলমানেরা তেমনি করেই তাকায় হিন্দুর দিকে। ( ঘোষ, ১৯৯০ : ১৪৬)

তথাপি জন্মভূমিপ্রেম, ধর্ম নির্বিশিষে মানবিকপ্রেম মানুষ ত্যাগ করতে পারেনি। দাঙ্গার আগুন দিঘাপাইত গ্রামকে পোড়াতে পারেনি ফলে জাত-পাত, উচুঁ-নীচু ভেদের ভেতরেরও কোনো না কোনো ভাবে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, মানবতাবোধ অটুট ছিল। এর গভীর প্রভাব দয়ার জীবনের খন্ড খন্ড স্মৃতি কথায় খুঁজে পাওয়া যায়। দাদা, সমসের চাচা, ইয়েদালি কাকা, পালিকা মা, ভুলি পিসি, আমুদা, আছর ভাই প্রমুখ এই স¤প্রীতির ধারক। দাদার সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দয়ার মধুমাখা শৈশব। ধর্ম শ্রেণী নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসা মানুষের পাশাপাশি এমন কী পৃথিবীর প্রতিটি জীব-জন্তু, ফুল বৃক্ষ লতা পাতার জন্য আর্শীবাদ চাওয়া অর্থাৎ মানবতার প্রথম পাঠ দয়া, দাদার কাজ থেকেই গ্রহণ করে। নিষ্ঠাবান, ধর্মপ্রাণ মুসলমান বৃদ্ধ দাদার কাজে দয়ার প্রশ্ন ছিল  ‘দাদা, যারা হিন্দু, দুগ্গা কালী লক্ষীপূজা করে, তাগরে আল্লাহ কী করব?’ জবাবে দাদা বলে, ও মা দয়া, তুই কি পাগুলনি। আল্লাহর সঙ্গে দুগ্গা ল²ীর কুন কাজিয়া নাই। ও সব মাইনষে করে।’ (সিকদার, ২০১২ : ১২) ‘দয়াময়ীর কথা’য় সুনন্দা সিকদারের স্বগোক্তি-‘আমার বড় আকাক্সক্ষা হয় দাদার ঐ ভালোবাসার ধর্মটি অর্জন করার। কিন্তু সব কি আর অর্জন করা যায়।’ (সিকদার, ২০১২ : ১২) তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি এখনও মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান কিছু হতে পারেন নি। সম্ভবত হতেও চান নি। ইয়েদালি কাকা দয়াকে শুনিয়েছে বুদ্ধদেবের বাণী, সবমানুষই সমান কিংবা, আগে মানুষ এসেছে, পরে ধর্ম এসেছে। ধর্ম জাত-পাত সব মানুষের তৈরী। সাদিকাকার বড়ছেলের কাছ থেকে দয়া জেনেছে যিশুখৃস্ট বারবার মানুষকে ভালোবাসার কথা বলে গেছেন। সোবহান দাদা বলেছেন, এই সব কথা যদি মানুষ শুনত তাহলে আর হিন্দুস্থান পাকিস্তান হত না। ভুলি পিসি তাকে বলেছে, ‘তবে বেশির ভাগ সময় ভগবানটাই মাইন্ষের মধ্যে জাইগা থাকে। দেখস না মানুষ মানুষেরে কত ভালবাসে।’ (সিকদার, ২০১২ : ৩৫) পালিকা মায়ের  জাতপাতের ছুৎমার্গ থাকলেও মানুষের প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা। একদিকে পালিকা মা আর গায়ের স্বচ্ছল, ক্ষমতাবান হিন্দু স¤প্রদায়ের জাত-পাতের লড়াই-বড়াই, মায়ের কঠোর রক্ষণশীল মানসিকতার ফল স্বরূপ দয়ার উপর সার্বক্ষণিক নিষেধাজ্ঞা ‘দয়া জলডা খাইয়ো না। মোসলমানের হাত জল খাইলে মহাপাপ। শুকনা জিনিসে দোষ নাই’। (সিকদার, ২০১২ : ৫০) শ্রেণিভাগ অর্থাৎ উচুঁ-নীচু ভেদাভেদের কথাও দয়া নিয়তির অমোঘ বানীর মতো তার পালিকা মায়ের মুখে শুনে-‘দয়া, ভুইল্যা যাইয়ো না মাজম আমাদের কামলা, মোসলমানের পোলা, গোরু বাছুর খ্যাত-খামার দ্যাখনের মানুষ, তোমার রক্তের সম্পর্কের কেউ না, মিলন- মিশনের কাম নাই’। (সিকদার, ২০১২ : ১১) কিন্তু দয়ার আমার এই গোড়া পালিকা মার-ই ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসার একটা গভীর মানবিক দিক ছিল ‘ইস্কুলে সব ব্যাপারেই মা মাথা গলাত। ঠিক সময়ে কাইন্ছাদা ঘন্টা দিল কি না, যে ছাত্রেরা ঐ ইস্কুলে থেকে যায়, যাদের বাড়ি দূরে তাদের জন্যে কি ছালুন রান্না হল, ঈদে কিংবা সরস্বতী পূজায় কী খাবে, কি দিয়ে সরকাই (ভোররাত্রের খাওয়া, সূর্যোদয়ের আগে, রমজান মাসে) খাবে, এসব ব্যাপারে মায়ের মাথা ব্যথা ছিল’ (সিকদার, ২০১২, ৬৩) সুজিৎ চৌধুরী তাঁর রক্ষণশীল জাতপাত মানা ব্রাহ্মণ ‘দিদিমণি’র প্রসঙ্গে একই ধরণের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন ‘সেখানকার ছেলেদের অসুখ-বিসুখ হলে পথ্য জোগানোর দায়িত্ব দিদিমণি সমঝে নিয়েছিলেন।…আমাদের টিফিন দিতেন দিদিমণি। তখন থেকে সামসুলও আমাদের টিফিনের সঙ্গী হল। বাসনকোসন দিদিমণি তুলে নিয়ে যেতেন-কোনওদিন এই নিয়ে কোন অস্বস্তি করতে দেখিনি।  (চৌধুরী, ২০১৪, ৩০) অর্থাৎ এই দুই লেখকের স্মৃতিচারণ থেকে প্রতীয়মান হয়, যে খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়, সাধারণ মানুষ সেই কূটজাল এর শিকার মাত্র।

অন্যাদিকে পালিকা মায়ের প্রতিনিয়ত শাসনে ধর্ম ও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার বোধ শিশু মনে টানাপোড়েন তৈরী করলেও শেষ পর্যন্ত মানবতারই জয় হয়। ‘দয়ামায়ীর কথা’য় স্মৃতিচারণ-‘ইয়েদালি কাকার কাছে গৌতম বুদ্ধের কথা শোনার পর আমি মায়ের সব কথা শুনি না,মা আমাকে জাইতখাউনি নাম তো দিয়েই রেখেছে।’ (সিকদার, ২০১২ : ৮৩)

ধর্মের টানা-হেঁচড়া,ধনী-গরীব ভেদাভেদ শিশু দয়ার মনে চেতনে-অবচেতনে ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতার জন্ম দেয়। এই ধর্মকে কেন্দ্র করে দেশভাগ, মানুষের সীমাহীন দু:খ-দুর্দশা, চোখের জল, বিভাজন, ভিটেমাটি ত্যাগ এই বিষয় গুলো দয়ার মনে দাগ কেটে যায়। বোধ হওয়া পর থেকেই দয়া দেখেছে, দিঘাপাইত গ্রামের মানুষ গ্রাম ছাড়া হচ্ছে তার পিতৃপুরুষের ভিটার সামনে দিয়ে⎯

‘মা সারাদিন ধরে চোখের জল মুছত। যারাই গ্রাম ছাড়ত তারাই যেত আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। চোখ মুছতে মুছতে কেউ যেতেন, কেউ আবার চিৎকার করে বলতে বলতে যেতেনÑ ‘ওগো চলি জন্মের মতো, যদি, কোন অপরাধ কইরা থাকি, মাপ কইরা দিয়ো’ (সিকদার, ২০১২ : ১৯)

গ্রামছাড়া মানুষগুলোর হৃদয় বিদারক আহাজারি শুনেই দিঘাপাইত এ দয়ার দশ বছরের শৈশব। অনেক আনন্দের ম্মৃতির সঙ্গে, এই বেদনার ম্মৃতি তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে-‘ওরে বুড়ি, যাইতেছি সারাজীবনের মতো, গাঁয়ের কারুর সঙ্গে আর তো দেখা হইব না। হিন্দু স্থনে গেলে তুই দেখা করিস।’ (সিকদার, ২০১২ : ১৯)

কিংবা, মা বলে, ‘দয়া জমি আছিল মায়ের মতো, বছরের পর বছর খাওয়াইচে। আর তারে পরের হাতে দিয়া যাই।’ (সিকদার, ২০১২ : ২৫)

আসন্ন দেশত্যাগের বেদনা নিয়ে গান বেঁধেছিল এক গাইয়ে ‘মনে ছিল অনেক আশা

তোর বুকে মা বাঁধব বাসা

তোকে ছেড়ে গিয়ে দূরে

বাঁচব না মা, বাচঁব না রে। (সিকদার, ২০১২ : ৯৭)

দেশ ত্যাগের ব্যথাভরা এই গান দয়া কোনদিন ভুলতে পারেনি।

অথবা, ‘মায়ের চোখের জল এসে গেছে। কণ্ঠস্বর ভারী শোনাল। সবই তো বুঝিরে দয়া, মন মানে না। বালতিটা আমার মায়ের হাতের আছিল’ (সিকদার, ২০১২ : ৬১)

মায়ের হাতের বালতি, এমন কী ছিল ঐ বালতিতে, যা অন্যকে দিতে চোখ জলে ভরে যায়, বুক ভেঙ্গে যায়? আসলে ওতে মায়ের স্পর্শ স্মৃতি জড়ানো ছিল,যা বহুজনের ব্যবহারের মুছে গেছে কিন্তু তার অনুভূতি রয়ে গেছে। এমন কি মানুষ যখন কোন হোটেল বা কারো বাসস্থানে কিছুদিনের জন্য বাস করে, সে স্থানটির প্রতিও মানুষ অব্যক্ত টান, মায়া অনুভব করে। চলে আসার আগে বার বার মনে হয়, কিছু ফেলে গেলো নাতো। যারা সংবেদনশীল তারা ঠিকই টের পায় আসলে তারা কী ফেলে গেছে। তারা ফেলে গেছে স্মৃতি। স্মৃতি আসলে কী সে কী বায়বীয়? সে দৃশ্য-অদৃশ্য যাই হোক মানুষের সত্তার খন্ডাংশ। আর জন্মভূমি, ভিটে মাটি তো স্মৃতি নয় এই মৃত্তিকা  স্পর্শ করে শিশুর প্রথম পথ হাটা। অন্ধও ঠিক তার বসত ভিটা চিনে নেয়। তাই ভিটে মাটি তার দেহ আত্মা তার মানব অস্তিত্বের ঠিকানা। যা হারিয়ে গেলে, ছেড়ে গেল শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দেশভাগ বা Partition শব্দটি রাজনৈতিক কার্যকারণসূত্রে চিহ্নিত কিন্তু এর ফলাফলকে অভিঘাতের স্থান থেকে চর্চা করা যায়। দেশভাগের কারণ গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে অভিঘাত। মানব ইতিহাসের যে কোন বিপর্যস্ত ঘটনায় অভিঘাত-ই শেষপর্যন্ত স্থায়ী হয়। দয়াময়ীর কথায় যে স্মৃতির চিত্রন তার ভেতর দেশভাগের ফলাফল অর্থাৎ অভিঘাতই চেতনে অবচেতনে স্থান করে নিয়েছে।  সেই অভিঘাত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের মানসিক-শারীরিক বিচ্ছিন্নতা মাটি ও মানুষের সঙ্গে অর্থাৎ অব্যক্ত, অসহনীয়, অপ্রতিরোধ্য মানবিক বিপর্যয়। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক জ্ঞানেন্দ্র পান্ডের বক্তব্য স্মর্তব্য The meaning of partition for those who lived through it, The trauma it produced and the transformation it wrought.(ঘোষ, ২০১৪, ১২)

আর তাই দেশবিভাগজনিত রাজনীতির নোংরা ষড়যন্ত্র মানব সত্তাকে খন্ড-বিখন্ডিত করে উভয় বঙ্গে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটায়, যা ব্যাখ্যার অতীত। এই প্রসঙ্গে অবিভক্ত ভারতের খ্যাতিমান লেখক সাদত হোসেন মান্টোর উক্তি যথার্থ।

Hindustan had become free Pakistan had become independent soon after its inception but man was still slave in both countries…slave of prejudice…slave of religious fanaticism…slave of barbarity and inhumanity. (net)

একটা সময়ের পরে এই ক্রান্তির ভেতরে দিয়ে অতিক্রান্ত মানুষ গুলো তার অনুভূতির আর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আরও ভাবা হছে, ‘দেশভাগ মানে সামাজিক এর মৃত্যু, পরিভাষায় ‘দ্য ডেথ অব দ্য সোশ্যাল’। (ঘোষ, ২০১৪ : ১৫) এই মৃত্যুর শিকার ‘দয়া’র অস্তিত্বের খন্ডাংশ ‘সুনন্দা সিকদার’ নিজে। নিজের যাপিত জীবন সম্পর্কে তাঁর স্বীকারোক্তি -‘অনায়াসে নয় এক অনিবার্য সত্যকে অস্বীকারের তাড়ণায়, পাঁচজনের চোখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে, শহুরে অভ্যেস আয়ত্ত¡ করতে অতি দ্রæত ছুটেছিলাম। অতর্কিতে খাদে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়িয়েছি ঠিকই, কিন্ত চকিতে পূর্বজন্মের স্মৃতির মতো মনে পড়ে যায় কোন এক বাতরের অর্থাৎ আলের ধারে আমার চাষের জমি তৈরী করতে হবে। গুড় মুখে নিয়ে যে আম-কাঁঠালের গাছগুলো পুঁতেছিলাম, সেগুলো কি গুড়ের মতো মিষ্টি হল। এত বছরেও দেখা হল না কেমন আছে বৃদ্ধ চিনি- পেতনি আমের গাছ’ (সিকদার, ২০১২ : ৬১) গনি মিয়া, মোদিভাবী দয়াকে  পিছু ছাড়েনি পিছু ছাড়েনি বিষ্যুতের মা  পচা কাকা, ফালানি, মঞ্জু, আচিয়া, লক্ষণ, মতিলাল, কানুদা, আছর দাদা, আসগর চাচা, পিছু ছাড়েনি গাভী টেবি, বুড়ি, পার্বতী, গ্রাম নদী, নালা, বৃক্ষ, পিছু ছাড়েনি দশ বছরে অতিক্রান্ত সময়, আর জল মাটি, বাতাস, পিছু ছাড়েনি সাদি কাকার পুকুরের সেই বয়েসী মাছ। সে মাছ ধর্মের উধের্ব বন্ধুত্বের বন্ধনের সাক্ষী হয়েও শেষ পযর্ন্ত জলের পিপাসায় কাতর হয়ে ধড়ফড় করে মারা যায়। এ মৃত্যু কী নয় দেশভাগের শিকার দুইবঙ্গের মানুষের আত্মহাহাকার দমবন্ধ করা অসহনীয় যন্ত্রনা, ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার হিন্দু-মুসলিম বিভক্তিকরণের হীন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নীরব প্রতীকী প্রতিবাদ। বৃটিশের দুইশত বছরের দাসত্ব থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করেছে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তি। পরাজিত বেনিয়ারা প্রস্থানের পূর্বে অবিভক্ত ভারতের মাটিতে শেষ দুটি আঘাত হেনে যায়। মাটির ভাগের মাধ্যমে হিন্দুস্থান-পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিতকরণ, শেষ আঘাত হানে দ্বি-জাতিতত্ত¡ নামক অভিনব, অলীক প্রক্রিয়ায় বাঙালির জাতিসত্তাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্নকরণ। নতুন রাষ্ট্র গঠনের নামে বাঙালির জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ এক প্রহসনের খেলা। বাঙালির অখন্ড জাতি সত্তাকে খন্ডিত করে ধর্মের মাধ্যমে নতুন করে হিন্দু মুসলিম জাতিত্ববোধ গড়ার অসুস্থ আকাক্সক্ষাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে বাঙালি আত্মঘাতী দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। এক তীব্র আত্মপ্রব নার শিকার হয় দুই বঙ্গের আগুতিন মানুষ। হিন্দু-মুসলিম নয় বরং তাদের নতুন নামকরণ হয় ‘উদ্বাস্তু’। পাখির ডানা আছে তাই সে ‘উদ্বাস্তু’দের চেয়ে ভাগ্যবান, পাখা মেলে উড়ে প্রকৃতির কূলে কোথাও না কোথাও ঠিকই সে ঠাঁই নিয়ে নেয়, সেখানে মানুষের দৌরাত্ম্য নেই। কিন্তু উদ্বাস্তুদের ডানা নেই প্রকৃতির ক‚লে নিঃশর্ত আশ্রয়ও তার নেই। ভ‚মির সন্তান হয়েও লড়াই করে তাকে ভ‚মির অধিকার নিতে হয়। অর্থাৎ সত্যিকারের নীড়হারা পাখি হচ্ছে ‘মানুষ’। এই নিমর্ম প্রহসনের খেলাকে একজন ব্যাখ্যাকার মন্তব্য করেন যে ‘নতুন রাষ্ট্র গঠন হলো উদ্বাস্তু সৃজনের প্রক্রিয়া’ ( চ্যাটার্জী, ২০১৬ : ১১৯) বলা যায় এক কিম্ভূতকিমাকার জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া।

অর্থাৎ দেশভাগ শুধু মাটি ভাগ করেনি। সেই মাটি ভাগ করেছে ধর্মের ভিত্তিতে। দেশভাগ শুধু মানুষ ভাগ করেনি। সেই মানুষকে ভাগ করেছে মানবতাকে খুন করে। ধর্ম সা¤প্রদায়িকতার কথা বলে না, স¤প্রীতির  কথা বলে। কিন্ত কিছু স্বার্থান্বেষী নেতা ধর্মে বিভাজনের অস্ত্র তুলে মানুষে মানুষে আত্মহননের রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছে। দেশভাগের ইতিহাস আসলে মানুষে মানুষে ব্যবধানের ইতিহাস। যে ব্যবধান একপক্ষে নির্মিত হয়নি, নানাপক্ষে নানাভাবে নির্মিত হয়েছে। ধর্ম ভাষা, সংস্কৃতির সূত্রে আধিপত্যের নানা প্রয়াস মানুষে মানুষে ব্যবধানের সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতাবানদের শাসন-শোষণের শিকার সাধারণ মানুষ। অন্নদা শংকর রায় তাঁর দেশভাগ বিষয়ক ছড়ায় দেশভাগের কল-কাঠি নাড়কদের বিরুদ্ধে প্রতীকী বিষোদগার করেছেন তীব্র শ্লেষাত্বক শব্দ ব্যঞ্জনায়।

‘তেলের শিশি ভাঙ্গল বলে খুকুর পরে রাগ করো, তোমরা যে বুড়ো খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো, তার বেলা? তার বেলা?’  (চৌধুরী, ২০০৮, ২২৯)

‘ধর্মভাগে-মানুষভাগ’ এই ভেদনীতিতে উদ্ভূত হয়েছে মানুষের নব সংস্করণকে চিহ্নিতকরণের নানা সড়কছাপ শব্দাবলী যেমন ‘রিফুজি’। ‘উদ্বাস্তু’,‘বাস্তুহারা’, বিকল্প বা ড়ঢ়ঃববং, ‘শরণার্থী’ ‘ঘটি-বাটি’ ‘বাঙাল’ মানবতার আত্মহনন এই শব্দগুলোর পরম্পর্যে মানুষ আর মাটির সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা যাক। ধর্ম দিয়ে মানুষ ভাগ করা যায়, ভিটে-মাটি ভাগ করা যায় এ বোধ শুধু শিশু দয়া নয়, সেই সময়ের নিমর্ম শিকার অধিকাংশ সাধারণ মানুষের বোধগম্য ছিল কী না, আজ হয়ত অনেকেরই প্রশ্ন? আসলে যায় না। তাই দেশভাগে ‘বাস্তহারা’ মানুষের কাছে ধর্মের চেয়ে বড় হয়ে উঠে মানুষ। মানুষের প্রতি মানুষের আছে এক অদম্য অবিচ্ছেদ্য অদৃশ্য টান, প্রেম, ভালোবাসা স্নেহ, মায়া, দয়া। ফলে ’৪৬ এর দাঙ্গার ভয়াবহতা সব অ লে এক নয়। দয়ার পূর্ব পুরুষের গ্রাম দিঘাপাইত এ সেই অর্থে দাঙ্গা সংঘটিত হয় নি, তথাপি মানুষ অদৃশ্য আতঙ্কে, কেউ বাধ্য হয়ে, কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বা হিন্দু মুসলিম ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে উৎসাহিত হয়ে স্থান ত্যাগ করে। মানুষের এই বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত পরিস্থিতি ছোট দয়ার মনোজগতে গভীর রেখাপাত করে। দয়াময়ীর কথায় স্মৃতিচারণ-

‘আরেকটা কথাও আমি বুঝেছিলাম, যে কথাটা আমায় কেউ বলে দেয়নি। আমার চারধারটা বড় অস্থির ছিল যেন বড় তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছে চারিদিকের দৃশ্যপট। যখন আমি সবেমাত্র দরজা পেরিয়ে ঘরের পইঠাতে, পইঠা থেকে উঠোনে নাবতে শিখেছিলাম, তখনই দেখেছিলাম সামনে পলুদাদের বাড়িটা কী তাড়াতাড়ি ভিটে হয়ে গেছে। চলে গেছে গোরুর গাড়িতে করে থালাবাসন, কাঁঠাল, কাঠের পিড়ি, পোঁটলায় ভরতি চিড়েমুড়ি, ট্রাংক, শতরঞ্জি দিয়ে বাঁধা বিছানা-বালিশ। একই দৃশ্য দেখেছিলাম পেছনের বাড়ির কানাই-বলাই যখন চলে গেল। আর শুনেছি কান্নাকাটির রোল। (সিকদার, ২০১২ : ১৮)

‘রিফিউজি’ শব্দটির দুটি বাংলা প্রতিশব্দ আছে। একটা হল শরণার্থী’ যার আক্ষরিক অর্থ এমন কোনও ব্যক্তি যিনি কোনও উধ্বর্তন শক্তির (তিনি ঈশ্বর হতে পারেন) শরণ নিয়েছেন অথাৎ আশ্রয় এবং নিরাপত্তা প্রার্থনা করেছেন। অন্য প্রতিশব্দটি হল ‘উদ্বাস্তু’, যার মানে গৃহহীন, একটা বিশেষ অর্থে গৃহহীন, কারণ বৈদিক ঐতিহ্যে সংস্কৃত, বাস্ত (বাড়ি) শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। ‘বাস্ত’ শব্দের সংজ্ঞার্থ হিসেবে মনির উইলিয়মস আরও নানা কিছুর সঙ্গে জানাচ্ছেন, দ্যা সাইট অর ফাউন্ডেশন অব আ হাউস,’ (ঘোষ, ২০১৪ : ১৬৩) সাধারণ বাঙালি এই শব্দটিকে ভিটা মাটির সঙ্গে জুড়ে দেয় অর্থাৎ বাস্তুভিটা তার কাছে পূর্বপুরুষের ভিটা। যার সঙ্গে তার পূর্ব-পুরুষের বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য, ইতিহাস, অতীত জড়িয়ে আছে। ফলে প্রতীয়মান হয়,

‘যাকে বাঙালি সংস্কৃতি বলা হয়, দেশভাগজনিত হিংসা ও সন্ত্রাস তাতে একটা ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটিয়েছে, সামগ্রিক ভাবে মূল্যবোধকে ধ্বস্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে ‘হোম’ অর্থাৎ বাড়ির ধারণাটিই মূল্যবোধের ধারক হিসেবে কাজ করে।’ (ঘোষ, ২০১৪ : ১৬৫)

গৃহহীন মানেই মানুষ নিজেকে অস্তিত্বহীন ভাবতে শুরু করে। আর যখন মানুষ মাতৃভূমিহারা হয়ে যায় তখন মানুষের অনুভূতি ‘শূন্যের কোঠা’য় দাঁড়ায়। যা ব্যক্ত করা প্রায় অসম্ভব। শ্রীযুক্ত অজয় বসু রায় এর স্মৃতি থেকে জানা যায়-‘১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি নেতাজির জন্মদিন। আমরা বিজয়গড় বিদ্যাপীঠের ছোট বড় ছেলেরা লাইন করে এলাকায় প্যারেড করছি। সঙ্গে মাস্টার মশাইরাও আছেন। মাঝেমাঝে ব্যান্ডে আজাদ হিন্দের চেনা গানের সুর বাজছে আর আমরা পা মেলাতে মেলাতে নেতাজির জয়ধ্বনি দিচ্ছি আর তার ফাঁকে ফাঁকে সমবেত চিৎকারে বলে উঠেছি-’ আমরা কারা? / বাস্তহারা।’ যেন এটাই সব- যুদ্ধ জয়ের মন্ত্র। তখন বুঝিনি ‘বাস্তহারা’ পরিচয়ের পেছনে কত যন্ত্রণা, চোখের জল আর অপমান লুকিয়ে ছিল…। (ঘোষ, ২০১৪ : ৭৭)

দয়া বোধ হবার পর থেকেই ‘রিফিউজি’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। যাদের সান্নিধ্যে দয়ার বড় হওয়া, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হওয়া, শিশু বয়সেই মাতৃজঠরের চেয়েও মাতৃভূমির প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ তৈরী হওয়া সার্বোপরি ‘দয়া’ থেকে ‘সুনন্দা শিকদার’ তথা ‘দয়াময়ী কথা’য় উত্তরণ, তাদের বেশির ভাগই রিফিউজি,শরণার্থী, বাস্তুহারা। একটা সময় এই খাতায় নাম লেখায় ‘ দয়া’ আর তার  ‘পালিকা মা’। তার  পিতা- মাতা যে পশ্চিমবঙ্গে রিফুজি এই সত্য, দয়ার পালিকা মা প্রায়ই ভুলে যেতেন।

ঐ একই যন্ত্রণা, চোখের জল আর অসম্মাননের অজস্র দৃশ্য দিঘাপাইত গ্রামেও প্রত্যক্ষ হয়। দেশভাগের বিরূপ প্রতিক্রিয়া কেবল মানুষকে পথভ্রষ্ট করেনি, মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরী করেনি এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি এবং গোটা সমাজ ব্যবস্থায়। জীবনধারণের বিভিন্ন অবস্থার উপর ভিত্তি করে ‘দয়া’ মানুষের হরেক রকম ভাগ দেখেছে, এ ভাগ বর্ণ বা শ্রেণিগত নয়, তারও চেয়ে অভিনব, নিমর্ম, অসম্মানের। দয়ার স্মৃতিচারণ⎯

‘যারা গ্রামে আসতেন নতুন, সবাই আসতেন কুচবিহার থেকে বাড়িজমি বদল করে.. একে ‘মুসলমান, তায় আবার ‘রিপুচি’। মা রিফিউজকে বলত ‘রিপুচি।’ তখন আমি রিফিউজ কথার মানে জানতাম না। ‘রিপুচি’ কথাটার মানে আন্দাজ করেছিলাম। ‘রিপু’ মানে শক্র এটা আমার জানা ছিল। কারণ রামায়ণ পড়ে জেনেছিলাম রাম আর রাবণ একে অন্যের রিপু। সমসের চাচারা যে মায়ের রিপু এটা আমি বুঝে গিয়েছিলাম।…মা ওদের দুচক্ষে দেখতে পারত না। মা’ র খুব রাগ, যেখানে ম্যাঘাকাকারা শনি-সত্যনারায়ণের পূজো করত, সেখানে আজগরচাচারা নামাজ পড়ে, ফজরের আজান দেয়। মা এই সব সহ্য করতে পারে না।’ (সিকদার, ২০১২ : ৮৩)

দয়ার সমসের চাচা, ইয়েদালিকাকা, আজগরচাচা, আনারমিয়া চাচা, জহর চাচা, আছর ভাই, ছৈয়দ ভাই প্রমুখ নিজের দেশ হিন্দুস্থান ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে পেটের ধান্দায়, প্রাণের ভয়ে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে আগত বেশ কয়েকটি পরিবারের মর্মবেদনায় ভারাক্রান্ত দয়াময়ীর কথা

‘দয়া আমার ঠাকুদার বাপ প্যাটের লাইগ্যা নিজের দ্যাশ দ্বারভাঙ্গা জেলা ছাড়চিল অনেক বছর আগে। তখন থিক্যা আমাদের জাইত, ধর্ম সব গেছে। এখন খালি আছে পরাণ বাঁচানোর ধর্ম। পরাণে যদি না- ই বাঁচলাম, ধর্ম দিয়াই বা কী হোব জাইত দিয়াই বা কী হোব।’ (সিকদার, ২০১২ : ২৬)

কিংবা,

‘আছরভাই দিন দিন দিঘাপাইতের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিল গভীর ভাবে। তবু মাঝে মাঝেই তোরসা নদীর পারে ফেলে আসা গাঁয়ের কথা বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলত।’ (সিকদার, ২০১২ : ৫৪)

দুই বঙ্গেই রিফিউজি, বাস্তহারাদের ছিল করুণদশা। স্থানান্তরিত, স্থানচ্যুত মানুষের দু:খ, বেদনা,ক্ষোভ, বিক্ষোভ, অপমানবোধ শিশু দয়াকে সবচেয়ে বেশি আহত করেছে। তাদের প্রতি স্থানীয় মানুষের দয়া, করুণা, অচ্ছুৎ মনোভাব, ব্যবহার তার মনে গভীর দাগ কেটেছে। ‘নিজের দ্যাশ গাঁও ছাড়লে মানুষ আর মানুষ থাকে না রে। তারে ভিন গাঁওয়ের মাইন্ষে কুত্তার নাহাল দ্যাহে।’ (সিকদার, ২০১২ : ৫৫) আজগর চাচার সে দিনের তীব্র যন্ত্রণা, অপমানবোধ থেকে ব্যক্ত কথাগুলোর কোনো উত্তর ছোট দয়া দিতে পারিনি। কিন্ত দেশভাগের ভয়াবহতা, অপমানের শিকার মানুষের বাস্তবতা সে ভুলতে পারিনি। এর প্রকাশ পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী সুনন্দা সিকদারের জবানীতে প্রকাশ পায়। কারণ পশ্চিমবঙ্গে এসে দয়াকে মুখোমুখি হতে হয় আরও কিছু অভিনব শব্দের সঙ্গে যেমন ‘বাঙ্গাল’, ‘ঘটিবাটি’। তখন সে নতুন আরেক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। ‘দেশ বিভাগের অনেক আগে এখানে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত আড়াই লাখের মতো লোক ছিল, পূর্ববঙ্গে এসব ‘বাঙালদের ‘ঘটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। (চ্যাটার্জী, ২০১৬ : ১৩২) অর্থাৎ সে সময়ের বাস্তবতা এবং দেশবিভাগকালীন বাস্তবতা প্রায় একই ছিল। দেশবিভাগকালীন পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত পূর্ববঙ্গের মানুষগুলোর নতুন নাম দেয়া হলো বাঙাল; আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে আগতদের বলা হলো ‘রিফিউজি’। অর্থাৎ উভয়বঙ্গে স্থানান্তরিত মানুষগুলো কেউ-ই সম্মানজনক অবস্থায় ছিল না।

সম্পত্তি বিনিময়ের ইতিহাস দেশ বিভাগের আরেক নিমর্ম বাস্তবতা এর খন্ড খন্ড চিত্র দয়াময়ীর স্মৃতি থেকে জানা যায়। সুরেশের বাবা গনেশ লাহিড়ি বলেছিল- ‘হিন্দুস্থান- পাকিস্তান হইলে একদিনও এ দ্যাশে থাকুম না; মন্ত্রীরা হইব মোসলমান, মোসলমানের প্রজা হইয়া থাকন যাবো না। (সিকদার, ২০১২ : ৬৯) অর্থাৎ দেশবিভাগ নিয়ে স্বচ্ছল পরিবার গুলোতে কিছু বিচিত্র মনস্তত্ত¡’ কাজ করে।

বেশির ভাগ স্বচ্ছল শিক্ষিত পরিবারের সিদ্ধান্ত ছিল পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ার চেয়ে পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। তারা মনে করে যে, পাকিস্তানে থাকার অর্থ হলো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়া। ভারতে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য তাদের হয়ত সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু তারা ‘নিজেদের লোকদের’ মধ্যে থাকবে, (চ্যাটার্জী, ২০১৬ : ১২৬) দিঘাপাইত গ্রামের স্বচ্ছল, হিন্দু পরিবারগুলোর দেশ ত্যাগের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই বাস্তবতা সক্রিয় ছিল।

জয়া চ্যাটার্জীর দেশভাগের অর্জন গ্রন্থ থেকে পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানদের সম্পর্কেও জানা যায়

দেশভাগের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা একেবারে অনাবৃত ও অরক্ষিত সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে যায়। দেশভাগের পর সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা ভীতির মধ্যে বসবাস করে-১৯৪৬ সালের কলকাতা হত্যাযজ্ঞের পর এতে বিস্ময়কর কিছু ছিল না।…….অধিক সংখ্যক মুসলিমের একটা স্পষ্ঠ প্রতিক্রিয়া ছিল যে, তারা পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করবে এবং পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যাবে। ( চ্যাটার্জী, ২০১৬ : ১৮৭)

অর্থাৎ দেশভাগ কোনো নতুন যুগের নতুন পৃথিবীর সূচনা করেনি বরং অতীতের দ্বন্দ্ব, সংঘাত হানাহানির জের নিয়েই শুরু হয়েছিল নব যাত্রা। এ যাত্রা মানুষের অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা। মানবতার ভয়াবহ বিপর্যের যাত্রা। যার রেশ এই বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও নানাভাবে বাঙালি জাতি অনুভব করতে পারে। প্রত্যক্ষ করতে পারে দেশভাগের পূর্ব পারিকল্পনার ফল দাঙ্গা। এই ভয়াবহ দাঙ্গার ইতিহাসের ক্ষীণ আভাস মেলে ‘দয়াময়ীর কথায়’ ‘আমার জন্মের কয়েক বছর আগে নোয়াখালিতে বিরাট দাঙ্গা হয়ে গেছে। সোবহানদাদা বলেছে, ওখানে হিন্দুদের উপর মুসলনানেরা ভীষণ অত্যাচার আর জুলুমবাজি করেছে, হিন্দু মেয়েদের অপমান করেছে।’ (সিকদার, ২০১২ : ৮৯)

হিন্দু স¤প্রদায়ের চরম ধর্মীয় গোড়ামির কথাও জানা যায় দয়াময়ীর কথায় :

‘তবে দীর্ঘকাল ধরে মুসলমানদের এত ‘অপঘিন্না’ হিন্দুরা করেছে তারও তুলনা নাই। সোবহান দাদা বলে, দ্যাখ দয়া, হিন্দু কুনদিন মুসলমানদের ঘরে ঢুকতে দেয় নাই। ছুঁইলে জাত যায়। আলাদা  হুকা, আলাদা বাসন। মুসলমান মেহমানদের বাইরে বসাইয়া খাওয়ায়। অনেক বছর ধইর‌্যা এই ভুলগুলো হিন্দুরা করছে। তবে যেভাবে মোসলমানেরা শোধ তোলতাচে, এইডা কিন্ত আমাগো পছন্দ না।’ (সিকদার, ২০১২ : ৮৯)

মুসলমান পাড়া প্রতিবেশীর প্রতি হিন্দুদের বৈরী আচরণ সিরাজ দাদার অন্তর গভীর ক্ষোভে, দু:খে তিক্ত করে তোলে। তার সংক্ষুদ্ধ মন দয়ার মনে তীব্র বেদনা জাগায় -‘বাবা কয়, তাই তগরে দেখবার আহি তরা হিন্দুস্থানে চইল্যা গেলে আমি আর কুন হিন্দুর বাড়িতে পেচ্ছাপ করতেও ঢুকমু না। যারা বর্ষার ঢলের সময় মাইনষেরে ঘরে ঢোকায় না তাগো সঙ্গে কিসের আত্মীয়তা? (সিকদার, ২০১২ : ৯০)

এই দু:খ, লজ্জা, অপমানের কথা মাকে বললে, মা জানালে,

‘বড় বড় কথা কইয়ো না, তুমি কী জানো দয়া। ভগবান ওগরে পাঠাইচে মুসলমানের ঘরে, আমাগো হিন্দুর ঘরে। ইসব ভগবানের বিধান। তুমি বুঝবা না।’ (সিকদার, ২০১২ : ৯০)

ছোট দয়া আত্মপ্রশ্নেবিদ্ধ, কারণ তার মা বলে এসব ভগবানের বিধান অথচ ইয়াদালি কাকা বলে, সব মানুষ সমান । দাদা বলে, আল্লাহ ভগবান যিশুতে কোন কাজিয়া নাই যিশু বুদ্ধা তো ঐ একই কথা বলে।

ওদের বাড়ির দুধেল গাভীর মৃত্যু দয়া কে জাত নিয়ে আরও একবার ভাবায়। ওর জন্যে কবর খোঁড়া হচ্ছিল দেখে মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘মা বুড়ি, বুড়ি কি মুসলমান ছিল?’ মা আমার জবাবে বলেছিল, ‘ও তো জন্তু, জন্তুজানোয়ারের আবার জাইত কী? জন্তু মরলে মাটি চাপাই দেয়। ‘তখন শিশু  দয়ার  খেদোক্তি কী ভাল হত মানুষের যদি জাত না থাকতো।’(সিকদার, ২০১২ : ৮৭) দয়ার উপলব্ধিবোধ প্রতীকীরূপ নিয়ে প্রত্যক্ষ হয় ‘সুজিৎ চৌধুরী’র দেশভাগের স্মৃতিচারণে।

মুরগি-মোরগ ছোটোছুটি করে জানান দিচ্ছে এটা মুসলমান পাড়া, হিন্দু বাড়িতে মুরগি পোষা তখন অভাবনীয় ছিল। একটা মজাদার দৃশ্য দেখেছিলাম ওখানে একবার। এক পাল পালক না ওঠা মুরগির বাচ্চা একটা হাঁসের সঙ্গে সঙ্গে ছোটোছুটি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। ব্যাপার আর কিছু নয়, মুরগির ডিম তা দিয়ে ফুটিয়েছে ওই হংসমাতা।  বাচ্ছাগুলো যেমন মায়ের বিজাতীয় পরিচয় সম্পর্কে অবহিত নয়, বাচ্চাগুলোর জাতপাত নিয়ে মায়েরও তেমন কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। (চৌধুরী, ২০০৮, ১২১)

মানুষ শ্রেষ্ট জীব অথচ জন্তু, জানোয়ার, পশুপাখী, মানুষের চেয়েও মহৎ অসাম্প্রদায়িক। মানুষ পশুপাখিকে জাতে ভাগ করে না অথচ নিজেরা বিভক্ত হয়। দেশভাগ এর কারণে দেশত্যাগ, দেশছাড়া, সম্পত্তি বিনিময়ের ফলে স্থানান্তরিত মানুষ বিচিত্র নামে চিহ্নিত হলেও যারা বংশ পরম্পরা ধর্ম নির্বিশেষে একই গ্রামে বসবাস করছে, পূর্ববঙ্গের সে রকম অনেক গ্রামেই ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল সেই সাধারণ মানুষের স¤প্রীতির বন্ধন নষ্ট করতে পারেনি। অভীক মজুমদারের গবেষণায় বলা হয়, ‘দেশভাগ সংক্রান্ত বিশ্লেষণে ধর্ম বড় ভূমিকা সংগত কারণেই পালন করেছেন কিন্তু বিশেষ অ ল বৈশিষ্ট্য অনেক ক্ষেত্রে ধর্মপরিচয়কে অতিক্রম করে যেতে পারে গেছেও, আজও যায়।’ (ঘোষ, ২০১৪ : ১৪৯) ঐ প্রীতির কারণে দয়ার রক্ষণশীল, পালিকা মায়ের রিফিউজিদের প্রতি ছিল অনেক ক্ষোভ, বিদ্ধেষ বিরুক্তি স্থায়ী মুসলমানদের প্রতি ছিল বিশেষ পক্ষপাত। সেখানে ধর্মের বিভাজনের চেয়ে বড় হয়ে উঠে ধর্ম নির্বিশেষে পূর্ব পুরুষের ভিটেয় সহাবস্থান। রিফিউজদের সম্পর্কে দয়ার পালিকা মা, চাঁন্দ মিয়া প্রমুখের মনোভাব ছিল খুব হীন। রিফিউজিদের তারা ‘নেংটি’র জাত বলে চিহ্নিত করে। গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে এদের তুলনা দয়ার মা সহ্য করতে পারে না। ‘মা খুব রেগে গিয়েছিল গ্রামের ভূমিপুত্র মুসলমানদের সঙ্গে রিফিউজি মুসলমানদের তুলনা করায়। মায়ের বোধ ছিল না পশ্চিমবঙ্গে মায়ের গর্ভের ভাইও, উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। (সিকদার, ২০১২ : ২১) উদ্বাস্তু, রিফিউজি, বাস্তুহারা, এই মানুষ গুলোর প্রতি উভয় বঙ্গের স্থানীয় মানুষের ছিল একটা তীব্র বৈরী আচরণ, এর সাক্ষী দেশভাগের ইতিহাস। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় মানুষগুলোর কাছে এই স্থানান্তরিত মানুষগুলো ছিল অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসার মত। তাদের বংশ পরম্পরায় যাপিত পারিবারিক, সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে এরা চরম অনাকাক্সিক্ষত আগন্তক হিসাবে গণ্য হয়। এই স্থানান্তর, স্থানান্তরিত মানুষ এবং স্থায়ী মানুষ উভয়ের জীবনে এক বিকট ছন্দপতন ঘটায়। গভীর অপ্রতিরোধ্য, ব্যাপক এক মানসিক চাপের সম্মুখীন হয় স্থায়ী ও স্থানান্তরিত উভয় পক্ষের জনগন। এই বাস্তবতাকে অনুভব করেই সম্ভবত ঐতিহাসিক জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে অভিমত দিয়েছিলেন।

…যে সব মানুষ দেশভাগের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তার ভয়াবহ মানসিক আঘাত সহ্য করেছেন এবং যার ফলে তাদের জীবনে চূড়ান্ত পরিবর্তন ঘটেছে, সেই সব মানুষ দেশভাগ/পার্টিশান বলতে কী বোঝেন তার মর্মার্থ বুঝতে চেষ্টা করা।  (ঘোষ, ২০১৪ : ৭৮)

দেশভাগ মানুষের জাগতিক জীবনের গভীর সংকট শুধু নয়, এর চেয়েও তীব্র বিপর্যয় ঘটিয়েছে একটি জাতীর মনন ও মেধার জগতে। যে আজন্ম মূল্যবোধ, সংস্কৃতি চেতনা দিয়ে একটি জাতীর চেতনার পর্যায়ক্রমিক স্তর, গোষ্ঠী, বংশ, এমনকি ধর্ম পরমপরায় সংঘটিত হয়, দেশভাগ এই বোধকে মূলচ্যুত করে দিয়েছে। সুজিৎ চৌধুরীর যন্ত্রনার্ত ক্ষোভোক্তি ‘দেশভাগ আমাদের শুধু বাস্তুচ্যুতই করেনি, সংস্কৃতিক বহুতর উত্তরাধিকারের শিকড়কেও উপরে দিয়েছে।’  (চৌধুরী, ২০০৮, ১২১)

দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় ব্যপক প্রভাব পড়ে। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণœ ছাড়াও, বিভিন্ন পেশাজীবীরা পূর্ব-পুরুষের পেশা ছেড়ে নানা ধরনের নি¤œমানের পেশায় নিয়োজিত হয় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। এ ছাড়া বিভিন্ন পেশার লোক স্থানত্যাগ করাতে ঐ পেশাসংম্পৃক্ত লোকের অভাবে দ্রব্যাদির সংকট দেখা দেয়। এভাবে সামাজে নানা ধরনের ব্যবসায়িক তথা অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এছাড়া শিক্ষিত শ্রেণির একটা বৃহৎ অংশ দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করলে সেক্ষেত্রেও তৈরী হয় শূন্যতা। প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে খন্ড-বিখন্ডিত হয়ে যায়। দয়াময়ীর কথা এর স্মৃতিচারণ হতে সেই বাস্তবতাকে পর্যালোচনা করা যায়। দয়ার রসগোল্লা, সন্দেশ খাওয়ার খুব শখ হত। অনুদার বিয়েতে জামালপুর থেকে রসগোল্লা, সন্দেশ আনা হয়েছিল, গায়ে কেন পাওয়া যায় না এ প্রশ্নের উত্তরে মা জানালো-

রসগোল্লা সন্দেশ পাওয়া যাইত না, কী কও। তুমি দিঘাপাইতের দ্যাখছ কী? কাঁইয়ারা দোকান করছিল, রসগোল্লা, সন্দেশ পানিতাত্তয়া কত কিসিমের মিষ্টি পাওয়া যাইত। ছাইতানি ঘোষেরা ছানা বেইচা বড়লোক হইয়া গেল। (সিকদার, ২০১২ : ৭৩)

এখন আর পাওয়া যায় না কেন, দয়ার এ প্রশ্নের উত্তর মা খেদের সঙ্গে জানালো-‘গায়ের হিন্দুরা সব চইল্যা গেল। হিন্দুদেরইÑতো জমি জমা আছিল, পয়সাকড়ি শখ সাধ আছিল। (সিকদার, ২০১২ : ৭৫)

দয়ার মা-বাবা পূর্ব বঙ্গের মৈমনসিংহ এ কোন এক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। দেশভাগের নাজুক পরিস্থিতিতে তাদের হঠাৎ ই সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে হয়। এভাবে শিক্ষিত মানুষগুলো চলে যাওয়ায় পূর্ববঙ্গে এসব ক্ষেত্রেও হঠাৎ শূন্যতা তৈরী হয়। দেশভাগের কারণে বিভিন্ন পেশাজীবি কারিগরদের পেশা অর্থাৎ জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জয়া চ্যাটার্জীর ‘দেশভাগের অর্জন’ গ্রন্থে এই চিত্রের ঐতিহাসিক সত্যতা লিপিবদ্ধ আছে। দয়ার পালিকা মায়ের শ্বশুড় বাড়ী সিরাজগঞ্জের জীবনের চিত্র থেকে ঐ ঐতিহাসিক সত্যতার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

…তবে দিনে দিনে ওদের অর্থনৈতিক সংকট শুরু হল। এই পদ্মাপারে বসবাসকারী পরিবারগুলোর অনেকেই ছিল মালবাহী পরিবহনের ব্যবসা-মালবাহী নৌকায় কাঁসা, পিতল, তামার বাসন কাপড়, জামা ঘি, মধু এসব তারা সব পাইকার বা মহাজনের কাছে পাঠাতেন। দেশভাগের ফলে এই সব পাইকার বা মহাজনেরা আস্তে আস্তে ব্যবসা গুটিয়ে হিন্দুস্থানে চলে যান। ওই সব মূল্যবান জিনিস কেনার ক্ষমতাও মানুষের কমে আসে……যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে রিফিউজ হয়ে এসেছেন, তখনও তাঁরা থিতু হয়ে বসার লড়াই করে যাচ্ছেন।…..অর্থনৈতিক সংকট ক্রমেই বাড়তে লাগল, অনিবার্যভাবে অত বড় যৌথ পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। (সিকদার, ২০১২ : ৩৩)

হিন্দু মহাজন বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিন্দু দক্ষ কারিগর যেমন শঙ্খের চুড়ি প্রস্ততকারী, হিন্দুদের পূজার দেব দেবী প্রস্তুতকারী অর্থাৎ কুম্ভকার, স্বচ্ছল  হিন্দু পরিবারের জন্য রেশম ও সূতা কাপড়ের তাঁতি, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের আনুষ্ঠিকতা সম্পন্নকারী পুরোহিত, গনক, প্রমুখ সম্প্রদায়ের লোক দেশভাগের প্রথম পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গ চলে গিয়েছিল, চলে যাবার নেপথ্যের কারণ হিসেবে ঢুলি স¤প্রদায়ের কাছ থেকে জানা যায়⎯

বাবুদের বাড়িতে পুজা, বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে ঢোল বাজিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্ত তারা সব দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে। পূর্ববঙ্গে এখন আমাদের আর কোনো কাজ নেই। সেখানে থাকার অর্থ হলো আমাদের মৃত্যু’ ( চ্যাটার্জী, ২০১৬ : ১২৭)

দেশভাগের নিপীড়ণে পর্যুদস্ত কৃষকশ্রেণির জীবন দয়াময়ীর কথায় বিবৃত হয়েছে চরম বেদনা নিয়ে, ‘তারা যে, ‘মাটি চাইট্টা’ খেতো সে মাটিও নিজেদের ছিল না।’ (সিকদার, ২০১২ : ৪১) তবে এই হত দরিদ্র ভূমিপুত্র কৃষকদের চেয়ে উদ্বাস্তুদের অবস্থা ছিল আরও শোচণীয় আরও অপমানের। দেশভাগের কারণে ‘সম্পত্তি বিনিময়’ করে দিঘাপাইত গ্রামে আগত মানুষের স্মৃতিচারণ করেছে ‘দয়া’ এভাবে⎯

‘গায়ের অভাব চারপাশে বনজঙ্গল, তবু কুচবিহার তোরসা নদীর পাড় থেকে নিজের দেশগাঁও ছেড়ে বহু মানুষ এসেছে আমাদের এই গাঁয়ে।’ (সিকদার, ২০১২ : ৪৬) রিফিউজি নারী পুরুষ উভয়ের কেবল সামাজিক বিড়ম্বনাই শুধু নয় অমানবিক অর্থনৈতিক চাপের শিকার হতে হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য কর্মসংস্থান করাও তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। পুরুষরাতো কাজ পেতই না। গৃহস্থ পরিবারের নারীরাও পর্যন্ত এই উদ্বাস্তু অসহায় নারীগুলোর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতো না, এ তথ্য এক নারী উদ্বাস্তু ‘বড়চাচি’র কাছ থেকে জানা যায়⎯

রিফিউজিদের কেউ ‘কাম দিতে চাইত না। অনেক কয়ে বলে খুব কম ধানের বিনিময়ে রহিমা বারা ভানার (চাল কোটা) কাজ জুটিয়েছিল। (সিকদার, ২০১২ : ৫১)

পুরুষ উদ্বাস্তুদের অবস্থাও ঐ একই রকম ছিল- ‘জহর চাচা’  ছৈঞা চাচা এখনও কোন জমি বর্গা পায়নি। যারা জমি বর্গা দেয় গ্রামের মানুষকেই দেয়। ওরা যদি ‘রিপুচি না হত, যদি কিছু জমির বর্গাদারি পেত। তবে একটু নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারত’ (সিকদার, ২০১২ : ৫২)

রিফিউজদের কাজ না দেয়ার কারণ দয়ার স্মৃতিচারণে প্রত্যক্ষ ‘রিফিউজি চাচারা সারা বছর খুব একটা কাজ পেত না। বাড়তি কাজ গ্রামের চাষিরাই পেত।.. মাও পারতপক্ষে ‘রিপুজি’দের কাজে ডাকত না। গাঁয়ে কামের মানুষ এত থাকতে মা কেন ভিনদেশি ‘রিপুচিদের ডাকবে। (সিকদার, ২০১২ : ১২২) সুতরাং দেখা যাচ্ছে অনাহুতরা  পূর্ব-পশ্চিম উভয় বঙ্গে প্রচন্ড নিগৃহীত ছিল। এদের শ্রমের বিনিময়েও যোগ্য পারিশ্রমিক দেয়া হতো না। সামাজিক ভাবে ‘অচ্ছুৎ’ হিসাবে দেখা হতো। সম্পত্তি বিনিময়ের মাধ্যমে, কিংবা অবস্থাপন্ন রিফিউজদের আড়ালে কটাক্ষ করা হতো। তবে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে সঙ্গে নি¤œ শ্রেণির হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মানুষ ছিল সমাজে অপাঙ্তেয়।

দেশভাগ কী আদৌ সাধারণ মানুষ চেয়েছিল? এর উত্তরে দেশভাগের নিমর্ম শিকার অগুনিত মানুষের স্মৃতিচারণ এ বহুকষ্ঠস্বর একক স্বর হয়ে জানান দেয় একই অনুভূতির কথা- দেশ দেশ, আপনদেশ, দেশ কি কেউ ছাড়তে চায়? (ঘোষ, ২০১৪ : ১৪৭)।

ঐ একই আক্ষেপ বেদনার মর্মন্তুদ হাহাকার পূর্ববঙ্গের সিলেট অ লের রাজনীতিবিদ দেশপ্রেমিক অবলাকান্দের যিনি দেশছাড়া হয়েও দেশের জন্য হাহাকার করেছেন। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ধিক্কার দিয়েছেন।

…ভারত স্বাধীন হইল, কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত হইল। আজ নিজ বাসভ‚মে এক দল লোক পরবাসী। হায়রে পাকিস্তান-হায়রে হিন্দুস্তান’  (চৌধুরী, ২০১৪, ৪১৩)

‘সুজিৎ চৌধুরী’র পিতার না ছিল জমি-জমা না স্থায়ী চাকুরী তার উপর পাকিস্তানের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত তবুও তিনি দেশ ছেড়ে যেতে চাননি, নিজের দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার স্বল্প দিনের মধ্যেই হিন্দু পরিবারের উপর পাকিস্তান সরকারের পরোক্ষ নির্যাতন শুরু হয়। পূর্ববঙ্গের সিলেট অ লের তাদের বাসস্থানে জোর করে প্রবেশ করে সরকারী কর্মকর্তা মুন্সেফ। ডিসির কাছে অভিযোগ করলে জানানো হয় পাকিস্তানে সকলকেই শেয়ার করে থাকতে হবে শুধু তাই নয় যারা বেশি জায়গা জুড়ে রয়েছে তাদেরকে কিছু জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। সুজিতের দেশ প্রেমিক শিক্ষক পিতার আত্মসম্মান এই গ্লানির বোঝা বইতে রাজী হয়নি। লেখকের স্মৃতিচারণ

সমস্ত ঘটনা প্রবাহ থেকে যে বাণীটি বেরিয়ে এল তা হলো, ‘যাবার সময় হল বিহঙ্গের’, কুলায় যদি সময় তাকতে রিক্ত না করে দেওয়া হয় তবে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে। অতএব পাকিস্তানের থেকে যাওয়ার বাবার শেষ ইচ্ছেটুকুও লুপ্ত গেল।  (চৌধুরী, ২০১৪, ২৩১)

সুনন্দার পালিকা মা, সুজিতের পিতার মত একই মানসিক অবস্থায় বিপর্যস্ত যতীন সরকারের পিতা ‘দেশান্তরে যাবার ইচ্ছে বাবার একদম নেই, কিন্তু নানা জনের নানা কথায় দূর্বল হয়ে পড়েছেন। এমনকি আমার মা আর ঠাকুর মাও বাবার এই দূর্বলতা বাড়িয়ে দিলেন’ (সরকার, ২০০৮, ১১৪) অর্থাৎ নিজের জন্মভূমি মাতৃভূমি, নিজের ভূমি, ভিটেমাটি কেউ ছাড়তে চায় না। এই চরম সত্য দয়াময়ীর কথা’র স্মৃতিচরণে বার বার করুণ আর্তির বীনা হয়ে বেজেছে। দেশছাড়া মানুষ শেষ সম্বল, কর্দপহীন হয়ে চিরতরে চলে যাবার সময় পথে যেতে যেতে চেনা-অচেনা মানুষের কাছে চোখের জলে বিদায় নিতে নিতে যায়। এই চোখের জল বলে যায়, তাদের বাধ্য হয়ে চলে যাবার তীব্র বেদনার কথা। আর তাই দেখি, দেশভাগ মানুষে মানুষে আপাত হিংসা বিদ্বেষের দেয়াল তুলে যেমন বিচ্ছেদ ঘটায় তেমনি সেই ‘শূন্য-ভিটা’ মানুষকে কাঁদায়। দত্ত বাড়ির পরিত্যক্ত ভিটা এর সাক্ষী। ধর্মের বিভাজনে যে ভিটা ভাগ হলো, সেই হিন্দু-মুসলিম ধর্মের মানুষেই আবার দত্ত বাড়ির শূন্য ভিটায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলে। হিন্দু দত্ত বাবুর ভিটায় চোখের জল ফেলে মুসলমান মাজম দাদা, আছর ভাই, আজিম ভাইদের বেদনার্ত উক্তি- ‘মানুষে কত কষ্টে সংসার গড়ে, আর উপরওলা যখন চায়, ভাইঙ্গ্যা দেয়। তার কি দয়ামায়া নাই।’ (সিকদার, ২০১২ : ১২৩) এখানেই শেষ নয়, দত্তদের পরিত্যক্ত ভিটার  বাঁশের খুটিতে পাওয়া আট টাকায় তাদের ভিটার সত্যনারায়ণ পূজা হয়। গ্রামে হিন্দু-মুসলমান সকলেই উপস্থিত ছিল। সবার চোখেই প্রায় জল ছিল। দেশ ত্যাগের প্রককালে আমুদার হিন্দু মুসলিম সবাইকে পেটচুক্তি নিমন্ত্রণ খাওয়ানো, ব্যয়বহুল জেনেও গ্রামের সবাইকে নিয়ে ছবি তোলা, এসব গভীর সম্প্রীতির পরিচায়ক। দয়ার বাবার বাল্য বন্ধু মুসলমান সোবহান দাদা। দেশভাগের সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতেও প্রীতির বন্ধন ছিল অমলিন।

‘দিঘাপাইত গ্রামের স্কুলে সরস্বতী পূজা হতো। দুজন মাত্র হিন্দু ছাত্র ছিল। বাকী সব মুসলমান, শিক্ষকগনও সব মুসলমান। কিন্ত মুসলমান ছাত্র শিক্ষকদের পূজা নিয়ে উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না। পূজার আনন্দ হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি করে নিতো। (সিকদার, ২০১২ : ৪৫)

গ্রাম্য মেলাতেও হিন্দু-মুসলিম স¤প্রীতির কথা জানা যায়। এই হিন্দু মুসলিম বন্ধুত্ব প্রমাণ করে দেশের বেশীর ভাগ সাধারণ মানুষ স¤প্রদায়িকতা নয় বরং ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনে প্রীতিতে অভ্যস্ত ও বিশ্বাসী ছিল।

এতো জাতপাত, এতো শ্রেণি-বিভেদ এতো ধর্মযুদ্ধের পরও কঠিন সত্য হলো ‘মানবতা’ যার  কোনো বিকল্প নাই। ‘দয়াময়ীর কথা’র পরতে পরতে এই মানবতার সাক্ষী রয়ে গেছে। দয়ার রক্ষণশীল পালিকা মায়ের জগৎ জুড়ে যে ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কঠিন প্রাচীর ছিল, উচুঁ-নীচু শ্রেণি ভেদাভেদের তীব্র শাসন ছিল ছোট ‘দয়া’র উপর। সেই মা-ই দেশ ছাড়ার সময় মানুষের তৈরী সব সংস্কার ভুলে যায়। সংস্কারের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে সত্যিকারের মানুষটা। মানুষের, মানুষের প্রতি যে গভীর টান, মমত্ববোধ, অপরিসীম ভালোবাসা, অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ সেই উদাহরণ টুকুই রেখে যায় শেষ পর্যন্ত। মা তার সাত রাজার ধন শখের অনেক দ্রব্যাদি ধর্ম নির্বিশেষে অকাতরে মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। তার মায়ের শেষ স্মৃতি পেতলের বালতিটা চোখের জল ফেলতে ফেলতে কান্দু চোরকে দিয়ে দেয়। চলে যাবেন জেনেও শেষদিন পর্যন্ত পরম যত্নে পিতৃ পুরুষের ভিটায় সবজি গাছ ফলান। চোখের জল ফেলতে ফেলতে সমসের চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘দ্যাখো সমসের, বাত্তি হইলে তুইল্যা খাইয়ো, মনে কইরো দিদির হাতের জিনিস। (সিকদার, ২০১২ : ১৩৪)

‘দয়ামীর কথা’র দেশভাগের স্মৃতি কবি, ঔপনাসিক, গল্পকার এর শিল্পকর্মে স্থান পেয়েছে চরম মানবিক যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে। তার কথার প্রতিধ্বনি যেন বিচিত্র অবয়বে স্মৃতির বিচ‚র্ণ আয়নার খন্ড-বিখন্ডিত প্রতিবিম্ব হয়ে ফিরে আসে বার বার নানা শিল্পকর্মে। ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে প্রতাপের সংক্ষুব্ধ বেদনার ভেতর যেন দিঘাপাইত গ্রামের আছর ভাই, সমসের চাচা প্রমুখের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।

‘পিতৃশ্রাদ্ধ করতে প্রতাপ শেষবার গিয়েছিলেন মালখাননগরে। প্রতাপ শক্ত চরিত্রের মানুষ, সবাই তাকে তেজস্বী পুরুষ হিসেবে মানে, কিন্তু সেবার তিনি খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-পুরুষদের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল, মাটি থেকে উপড়ে তোলা হলো এক বর্ধিষ্ণু বৃক্ষের শিকড়। পূর্ব বাংলার এই নদীময় প্রান্তর, এই মিষ্টি বাতাস, খেজুর রসের স্বাদের মতন ভোর, ঠাকুমার গল্পের আমেজমাখা সন্ধ্যা, এসব আর দেখা হবে না। এরপর থেকে কলকাতায় ভাড়াটে বাড়ির অন্ধকার ঘুপচি ঘরে চির নির্বাসন। (গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম খন্ড, ১৯৯১, ২৫১)

দিঘাপাইত গ্রামের মানুষ ধর্ম ভাগে মানুষ ভাগ এই বাস্তবতাকে মানতে পারে না। তাই জাত-পাতের বাড়াবাড়ির পরেও তারা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে চোখের জলে গ্রাম ছাড়ে। দয়ার স্মৃতি থেকে আরও জানা যায় ‘দিঘাপাইত গাঁ-টা যে একটা মুসলমান রাষ্ট্রে এটা গ্রামের কেউ জানত বলে মনে হয় না। হিন্দু জমিদারের ভয়ে সবাই কাঁপত’ (ঘোষ, ২০১৪, ৪০) এই বাস্তবতা থেকে আরও প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত হয়, ক্ষমতাবানরাই যুগে যুগে দুর্বল, সাধারণদের শাসন-শোষণ করেছে। হিন্দু-মুসলমান ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ সাধারণ মানুষের ইচ্ছায় ঘটেনি। ঐ হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে গুটিকয়েক ক্ষমতাবানদের গভীর ষড়যন্ত্রে সহ¯্র বছরের সম্প্রীতির বন্ধনে গাথা হিন্দু-মুসলমান মিলনের স্তম্ভ চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হয়ে যায়। ধর্মভাগে, মানুষকে দ্বিখÐিত করার বেদনা দিঘাপাইত গ্রামের মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করে, তার অযৌক্তিকতা সম্পর্কেও ধারণা করতে পারলেও, কৃত্রিম জটিল পরিস্থিতি তাদের কথা বলার সাহস জোগাতে পারেনি। কখনো কখনো পরোক্ষভাবে উপলব্ধি করেছে কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে বলতে পারেনি, বলতে চায় নি নানা মানসিক জাগতিক জটিলতার কারণে। দিঘাপাইত তথা পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গের বাস্তুহারা মানুষের উপলব্ধির যৌক্তিক কথাগুলো আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসের গ্রামের সাধারণ নারী ‘মেজ বৌ’ এর প্রশ্নে উত্থাপিত।

সত্যি বলছি বাবা, আমি ক্যানে তোমাদের সাথে দেশান্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝাইতে পারে নাই। পেথম কথা হচে, তোমাদের যে একটা আলেদা দ্যাশ হয়েছে তা আমি মানতে পারি না। একই দ্যাশ, একই রকম মানুষ, একইরকম কথা শুদু ধম্ম আলেদা সেই লেগে একটা দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ একটি তালগাছ। তারা দুটো আলাদা দ্যাশ হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়। শুদ ধম্মোর কথা বলো না বাবা, তাহলে পিথিমির কুনো দ্যাশেই মানুষ বাস করতে পারবে না।’ (হক, ২০১৩, ২২২)

সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসের নায়ক ‘আলী আহমদ’ এর ঐ একই প্রশ্ন ‘শুধু একটি ধর্মীয় বিশ^াসের কারণেই তো ওকে পালাতে হচ্ছে। তবে স্বাধীনতাটা কিসের? শুধুই কি ধর্মের?’ (হোসেন, ১৯৯৪, ৮০) ‘ঐ একই জিজ্ঞাসা কখনো ক্ষোভে, কখনো যন্ত্রণা হয়ে দিঘাপাইত গ্রাম অতিক্রম করে পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে তীব্র বেদনায় বিপর্যন্ত করেছে।

দয়ারূপী ‘সুনন্দা সিকদার’ বোধ হবার পর থেকেই প্রতিনিয়ত দেখেছে, তারপর একটা সময় উপলব্ধি করতে শুরু করেছে মানুষ আর ভিটেমাটির উপর দেশভাগ নামক এক ভয়ঙ্কর অদৃশ্য অস্ত্রের নির্মমতা। কী নিষ্ঠুরভাবে, কী সুকৌশলে এই হাতিয়ার মানুষে মানুষে গড়া মানবিক বন্ধনকে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করছে তারপর তাকে নাম দিয়েছে হিন্দু-মুসলিম, দুই জাতি, দুই ধর্ম, দুই দেশ। বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে হিন্দু-মুসলিম মিলনে যে দেশ ছিল ‘আমাদের দেশ’। সেই দেশ ধর্মভাগে হয়ে গেল হলো ‘আমার দেশ,’ ‘তোমার দেশ’। লেখক, গবেষক গ,ঋ গড়ড়হুধলবৎ ‘এই দ্বিজাতিত্ত¡’ কে মানবতা অর্থাৎ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রæ বলে চিহ্নিত করেছেন⎯‘ঋৎড়স ঃযব ভৎরংঃ ফধু বি যধাব নববহ ভরমযঃরহম ঃযব ৎিড়হম বহবসু; ড়ঁৎ পড়সসড়হ বহবসু রং ৎবষরমরড়হ যিরপয ফরপঃধঃবং ঁঢ়ড়হ ঁং ফরংরঃরড়হ ধহফ ঢ়ধৎঃরঃরড়হ.’ এই চরম দুর্ভাগ্যের ইতিহাস ধরেই পূর্ববঙ্গে দয়ার জীবন শুরু। দয়া খুব কাছ থেকে দেখেছে জাত-পাতের বাড়াবাড়ি, উচুঁ-নীচুর কড়াকড়ি, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সংকট অর্থাৎ মানবিক বিপর্যয়। দিঘাপাইত গ্রামে সা¤প্রদায়িকতার ভয়াবহ রূপ দয়াকে প্রত্যক্ষ অবলোকন করতে হয়নি কিন্ত তার পরোক্ষ ফল ছোট দয়ার মনস্তত্তে¡ চেতনে-অবচেতনে স্থায়ী ক্ষত হয়ে গ্রোথিত হয়ে যায়। সেই ক্ষত নিয়েই দয়ার পশ্চিমবঙ্গে গমন, পরিবারের সঙ্গে এগারো বছর পর দেখা, একত্রে বসবাস। পশ্চিমবঙ্গে ভাইবোনের সঙ্গে কথোপকথনের পর্বটি ছিল এরকম

‘তোদের দেশে নদী আছে?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘থাকবো না ক্যান? মেলা নদী-পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতী, ব্রক্ষপুত্র। এ ছাড়াও আরও অনেক নদী আছে আমাদের দ্যাশে।’ সেই দাদা তারপর বলে, ‘আমাদের হিমালয় থিক্যা তোমাদের দেশে নদী গেছে। নদীর মুখ বাইন্ধা দিলে তোদের দেশে জল যাবো না। দেখবি তখন তোদের কী হয়? আমি রেগে বললাম, ‘আপনের কুন খ্যম্তা আছে। এসব জহর লাল নেহেরু করলে তয় হোব। নেহেরু সে কাম কোরব না। হে ভাল লোক। তখন ওরা ভাইবোনেরা মিলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে লাগল। তারা বলল, তাদের সঙ্গে নেহেরুর খুব ভাব, আর আমার সঙ্গে তো আয়ুব খানের  আলাপ-পরিচয়ই নেই। (সিকদার, ২০১২ : ১০৫)

দেশভাগের বিষাক্ত রাজনীতির কূটজালে কী ভয়াবহভাবে জড়িয়ে পড়ে একই মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ভাইবোনেরা। দয়ার সঙ্গে তার বাবার পরিচয় ও বাবাকে চেনা ছিল দেশভাগের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্য প্রান্তকে দেখার মত করেই আতিœক যোগাযোগের কোথায় যেন একটা গভীর মৌনতা ছিল। যে মৌনতা মুখর হয়ে ওঠেনি কোনদিন, এর কারণও দেশভাগ। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ককে ‘নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণ’ আখ্যা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু দয়ার সঙ্গে তার মায়ের সেই সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বরং গড়ে উঠেছে তার পালিকা মায়ের সঙ্গে। আদৌ কী সত্যিকারের মাতৃত্বের বন্ধন শিশু দয়ার গড়ে উঠেছিল তার জন্মদার্ত্রী মা কিংবা পালিকা মায়ের সঙ্গে? ‘দয়াময়ীর কথা’ এ মা শব্দটি দুটি বিশেষণ যুক্ত হয়ে উচ্চারিত হয়েছে জন্মদার্ত্রী, পালিকা। এই বিশেষণ থেকে উপলব্ধি করা যায় মা নামক মানুষটাকে ঘিরে তার অস্তিত্বে গভীর শূন্যতাবোধ। এই দুই মায়ের মধ্যখানে হারিয়ে গেছে তার ‘মা’। তাই পাঠক মাত্রই অনুভব করে মা ও মেয়ের মাঝখানে কোথায় যেন তীব্র নীরবতা, সেই নীরবতার নাম ‘দেশভাগ’ এই নিস্তব্ধতাও কোনদিন সরব হয়নি। মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দয়া বলেছে⎯‘আমার পালিকা মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে খুব মূল্য দিতেন আমার গর্ভধারিনী মা। কোনও দিন তিনি আমার উপর মায়ের অধিকার  প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি।’ (সিকদার, ২০১২ : ১২৭) যাদের সঙ্গে দয়ার রক্তের বন্ধন, তাদের সঙ্গে তার আতœার বন্ধন গড়ে ওঠেনি। এর কারণও ‘দেশভাগ’ বরং গড়ে উঠেছে পূর্ববঙ্গের দশ বছরে যাপিত জীবনে মিশে থাকা মানুষ গুলোর সঙ্গে। দেশভাগ শুধু মানুষে মানুষ ভাগ নয়, পরিবার অর্থাৎ মা-বাবা-ভাই-বোনকে খন্ড-বিখন্ডিত করেছে। মানুষের চেতনা, অস্তিত্বকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ছোট দয়ার সঙ্গে মা-বাবা-ভাই-বোনের স্থান কালের দূরত্ব কী গভীর যন্ত্রণাময় মানসিক দূরত্ব তৈরী করে দিয়েছে। দেশভাগের চরম প্রতিক্রিয়ায় ছোট এই মেয়েটি বয়সের আগে বড় হয়ে যাওয়া, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, পরবর্তী কালে মিলিত হলেও সেই ভাঙ্গনের দাগ সে কোনদিন আর নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, যেমন আজ পর্যন্ত উভয় বঙ্গের মানুষ পারেনি দেশভাগের অদৃশ্য দেয়াল থেকে মুক্ত হতে। কোনো না কোনো দিন, কোন না কোন কারণে মানুষের গোপন বোধে ‘দেশভাগ’ দু:স্বপ্নের মতো, দু:সহ যন্ত্রণার মতো ঠিকই উকিঁ দেয়। যে ভাবনার কথা মানুষ উপলব্ধি করে কিন্তু ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয়। এই ভাঙ্গনের জ্বালা নিয়ে ‘দয়া’র আজন্ম বাস

আমি যত বড় হয়েছি তত এটা বুঝেছি, আমার ভাইবোন, মা বাবা খুবই ভাল। তবে এদের আমি কখনও আমার সুখ দু:খের শরিক করতে পারব না। আমার একটা গোপন জগৎ আছে, যার কথা এদের বলতে পারব না’। (সিকদার, ২০১২ : ১০৬)

সেই গোপন জগতের নাম ‘দেশভাগ।’ পরিবারের জগৎ পেরিয়ে ‘দয়া’র যখন সামাজিক পৃথিবীতে পথহাঁটা শুরু হয়। সেখানেও সে অস্তিত্বের সংকটে অব্যক্ত মানসিক চাপ দ্বারা তাড়িত হয় প্রতিনিয়ত। ‘আপন ঘরে পরবাসী’ দয়া সমাজে একাত্মতা খুঁজে পাবে কেমন করে? পায় নি কখনই। কারণ তার চিন্তা চেতনায়, তার শ্বাস প্রশ্বাসে প্রাণের নির্যাস হয়ে প্রবাহিত পূর্ববঙ্গের জীবন। যে জীবন থেকে ‘দয়া’ কোনদিন বের হতে পারেনি। ‘সুনন্দা সিকদার’Ñ এর সত্ত¡ায় প্রাণ হয়ে গেঁথে আছে দশ বছরের ছোট ‘দয়া।’ পশ্চিমবঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে অভ্যস্ত ‘সুনন্দা সিকদার’ কখনোই ভুলেনি সে বাঙাল, সে উদ্বাস্তু। কারণ যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তার দশ বছরের জীবন অতিক্রান্ত, সেই জীবনের সঙ্গে তার পশ্চিমবঙ্গে পিতৃ পরিবার আর পূর্ববঙ্গের পরিবারের বন্ধন তৈরী করতে ব্যর্থ হয়। এই দুই জীবনের মধ্যখানে স্তব্ধতা হচ্ছে ‘দেশভাগ’ এর স্থায়ী ক্ষত অর্থাৎ ট্রমা। এগারো বছরে পশ্চিমবঙ্গে পা রেখে, দুই যুগেরও অধিক সময় সেখানে বাস করে, সেখানের নাগরিক অধিকার পেয়েও জন্মভূমি ত্যাগের হৃদয় বিদারক স্মৃতি আজন্ম ক্ষত হয়ে এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়াছে। উদ্বাস্তু, শরণার্থী, রিফিউজি, বাস্তুহারা, ড়ঢ়ঃবপং নামে চিহ্নিত পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের, প্রায় সব মানুষই কোনো না কোনো ভাবে ট্রমা তাড়িত। দেশভাগের কথা বলতে গিয়ে একটা সময় তারা চুপ হয়ে যায়। আর যখন বলে তখন ট্রমা-গ্রস্তের মতো সরে সরে, রয়ে রয়ে, বিচ্ছিন্ন ভাবে বলে। কোথায় যেন একটা মানসিক স্থানচ্যুতি হয়ে যায় বাব বার। কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে না। মানব মনস্তত্তে¡র মানবিক খুন এই ‘দেশভাগ’। অভিজ্ঞতা তাড়িত মানুষটা প্রতিনিয়ত চেতনে অবচেতনে সেই খুনের শিকার হতে থাকে নীরবে। সুনন্দা সিকদার এর স্বীকারোক্তি ‘চল্লিশ বছরের বেশী সময় পশ্চিমবঙ্গের মফস্সল শহরের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থেকেও মনে হয় আমি যেন অনাধিকার প্রবেশকারী।’ (সিকদার, ২০১২ : ৪২)

শিকড় উপড়ে তুলে আনা জীবনের মানসিক বিড়ম্বনাই শুধু নয়, এর যন্ত্রণা আরো গভীরে প্রোথিত ‘ভদ্রগোছের একটা পোশাক পরলে যেন অপরের পোশাক ধার করে পরেছি, এমন একটা অপমানবোধ হয়। আত্মবিশ্বাস যেন নষ্ট হয়ে যায়।’ (সিকদার, ২০১২ : ৪৩) অর্থাৎ দেশভাগ তার দেহটাকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে গেছে, কিন্তু অস্তিত্ব রোপিত পূর্ববঙ্গে। দিঘাপাইতের শিশু দয়ার স্মৃতিতে গ্রোথিত পূর্বঙ্গের রিফিউজি আজগর, সমসের, আছর দাদাদের অসম্মানের জীবন খেদোক্তি, সংক্ষুদ্ধ অব্যক্ত বেদনা। লেখক ‘সুনন্দা সিকদারে’র চৈতন্যের সর্বলোকে জাগ্রত দেবীর মতো স্পন্দিত ‘দয়াময়ীর কথা’। এই ‘দয়াময়ীর কথা’ কোনো নির্দিষ্ট নারীর জীবনের মর্মন্তুদ বেদনার স্মৃতিচারণ না। বরং পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গে দেশভাগের নির্মম অভিজ্ঞতা আক্রান্ত প্রতিটি মানুষেরই কষ্টের স্মৃতি। মাটি আর মানুষকে চিরতরে ছেড়ে আসার অসহনীয় গভীর বেদনা ছোট দয়া তার পালিকা মায়ের অবয়বে প্রথম যেদিন দেখছে। সেই বেদনার ভার দয়া আর কোনদিন তার পালিকা মাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায়নি। এ প্রসঙ্গে দয়ার অনুভ‚তি।

সে দিন মায়ের মুখের দিয়ে তাকিয়ে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কখনও দেশের কথা উচ্চারণ করব না, মা আর আমার মধ্যে চিরকাল দেশের প্রসঙ্গ অনুচ্চারিত ছিল। আমার এই একটা প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পেরেছিলাম। মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের কথা আমি উচ্চারণ করিনি।’ (সিকদার, ২০১২ : ১৩৫)

আসলে কী এই অনুচ্চারিত শব্দগুলো সুনন্দা শিকদারের প্রতিজ্ঞা ছিল না-কি দয়ার স্মৃতির দরজা খুলে পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গের উদাস্তু মানুষের মর্মান্তিক যন্ত্রণার কথা বলতে না পারার গভীর বেদনাবোধ ছিল? সুজিৎ চৌধুরীর শিক্ষিত রাজনৈতিক পিতা আর সুনন্দা সিকদারের নিরক্ষর পালিকা মায়ের যন্ত্রনার্ত মুখাবয়বের অব্যক্ত বোধ স্বতন্ত্র হলেও, মূল এক ও অদ্বিতীয় আর তা হল গভীর দেশপ্রেম

তবুও সে দিনের যে রিক্ত মানুষের মুখচ্ছবি বাবার চেহারায় দেখেছিলাম, তা শুধু মাত্র এই টুকু দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না, বাড়ি নয়, ঘর নয়, সম্পত্তি নয় তবুও বাবার মুখে সর্বস্ব হারানোর বেদনা ফুটে উঠেছিল কেন? এখন মনে হয় বাবা, সেদিন এসবের চাইতে অনেক বড় একটা সম্পদ হারিয়েছিলেন।’ (চৌধুরী, ২০১৪, ৩৯৬)

দয়ার মত সুজিৎ চৌধুরীকেও সুদীর্ঘ ষাট বছর পরেও বাবার রিক্ত চেহারা তাড়া করে ফিরে।

‘স্মৃতির মধ্যে একটা সচেতন প্রক্রিয়া থাকে ‘বাছাই’-এর সে বাছাই-এর নকশাটা পাঠক বা শ্রোতা  তো জানতে পারেনই না, অনেক সময় স্মরণ-কর্তা নিজেও জানতে পারে না।’(ঘোষ, ২০১৪ : ১৯) কিন্তু তবুও ‘দয়াময়ীর কথা’র স্মৃতির ভেতর দিয়ে পাঠক যেন চেতনার একটা আদল খুঁজে পায়। যে চেতনার প্রাণবায়ু পূর্ববঙ্গের মাটি ও মানুষ। তারপর এক সময় ‘দেশভাগ’ এর নিষ্ঠুরতায় এই গোটা মানুষ সত্তা গ্রাস হয়ে যায়। দেশভাগের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে ‘মূক’ হয়ে যায় ‘দয়াময়ীর কথা।’ দেশভাগের ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস স্মৃতি নিয়ে পূর্ব বঙ্গের ‘চাঁদপুর’ নামক একটা ছোট্ট শহর থেকে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে  চিরতরে চলে আসা কবি ‘শঙ্খঘোষ’ এর স্তব্ধ হয়ে থাকা অক্ষরগুলো ভিতর যেন ‘সুনন্দা সিকদারে’র অর্থাৎ দয়াময়ীর আত্মযন্ত্রণার স্মৃতি সমাহিত।

আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত

আমার বুকে পালানোর পালানোর আরো পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি। (ঘোষ, ২০১৪ : ০১)

‘দয়া’ কে দিয়ে যে স্মৃতির শুরু ‘সুনন্দা সিকদারে’র ‘দয়াময়ীর কথা’ এ সে স্মৃতির শেষ কথা গুলো বাকরুদ্ধ হয়েই ‘দেশভাগে’র অমানবিক মানবিক কষ্টের কথা পাঠককে জানান দিয়ে যায়।

 

ড. নিলুফা আক্তার

সহযোগী অধ্যাপক

বাংলা বিভাগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

 

তথ্যনির্দেশ

১। ঘোষ, বারিদবরণ (১৯৯০)। বিভ‚তি স্মৃতি। কলকাতা: সাহিত্যম্;

২। গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল (১৯৯১)। পূর্ব-পশ্চিম (প্রথম খÐ); কলকাতা: আনন্দ

৩। হক, আজিজুল (২০১৩)। আগুন পাখি। ঢাকা: ইত্যাদি গ্রন্থ;

৪। হোসেন, সেলিনা (১৯৯৪)। গায়ত্রী সন্ধ্যা। ঢাকা: বিদ্যা;

৫। সিকদার,সুনন্দা (২০১৪)। দয়াময়ীর কথা। কলকাতা : গাঙচিল;

৬। চ্যাটার্জী, জয়া (২০১৬)। দেশভাগের অর্জন। ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স;

৭।   ঘোষ, সেমন্তী (২০১৪)। দেশভাগ । কলকাতা : গাঙচিল;

৮। চৌধুরী, সুজিৎ (২০১৪)। হারানো দিন হারানো মানুষ। কলকাতা: প্যাপিরাস;

৯। সরকার, যতীন (২০০৮)। পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন। ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।