‘সব কিছুই রাজনৈতিক।এমন কি একটি গোল্ডফিশের যৌনজীবন ও রাজনৈতিক।’
উপস্থিত পাঠকের প্রশ্নের উত্তরে যখন এইরকম একটা কথা ছুড়ে দেন, তখন তিনি আর শুধুমাত্র ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’র লেখক থাকেন না, তিনি তখনপুরো বিশ্বের কণ্ঠের রিপ্রেজেনটেটিভ হয়ে ওঠেন। ২০১৭সালের জুন মাসের ৬ তারিখ প্রকাশিত হয় ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ আর নিউইয়র্কের ব্রুকলিন একাডেমি অব মিউজিকের অপেরা হাউসের সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ১৯জুন ২০১৭সালে। সেখানে ও ঘটেছে এক অনন্য ঘটনা, তিনি বলেছিলেন, ‘কী বলব, তারচেয়ে বরং আমার বই থেকেই পড়ে শোনাই’। তিনি যেন কিছুটা বিব্রত, অপ্রস্তুত ছিলেন।পুরো হল ভর্তি মানুষের হাতে তার লেখা বই ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’।
একটা উপন্যাসের আলোচনা যখন একজন ব্যক্তিতে বার বার আপতিতহয়, তখন বোঝা যায়, সেই ঔপন্যাসিকের ইমেজারি ভিউও লেখার তীব্রতা কতটা প্রবল!
১৯৯৭ সাল, নীলক্ষেতের রাস্তায় তীব্র উত্তাপ, আর আমার ভেতরে আরও উত্তাপ। কারণ বিশ্ব তোলপাড় করা উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মলথিংস’ প্রকাশিত হয়েছে। পুরো মাসের হাতখরচের তোয়াক্কা না করে কিনে নিলাম ‘দ্য গড অব স্মল থিংস, যখন আমার মনের মধ্যে তীব্রভাবে আসন গেড়ে আছেন ফিওদর দস্তয়ভস্কি, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, বোর্হেস, লিও তলস্তয়, আন্তন চেখভ, জ্যাক লন্ডন, আলব্যেয়ার কামু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা প্রমুখেরা। কিন্তু ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ পড়ার পর, একলাফে ভালোলাগার পারদ ওঠে গেল এবং তালিকায় যুক্ত হলো অরুন্ধতী রায়। সেটা যেমন তার উপন্যাসের ভাষিক রাজনীতির জন্য, তেমনি তার ব্যক্তিজীবনের নানা নিরন্তর সংগ্রামের জন্য।অরুন্ধতী রায় এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, তিনি আর ফিকশন লিখবেন না, তার যুক্তি ছিল এমন: তার যা বলার ছিল, তা তিনি ইতিমধ্যে বলে ফেলেছেন।দ্য গড অব স্মল থিংস প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ বছর কেটে যায়। তারপর প্রকাশিত হয় ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’।
দ্য গড অব স্মল থিংস বইটি ছিল একটি নিষিদ্ধ প্রেমের অনন্য মন্থন।গীতল নন্দন আর কাব্যময় ভাষায় একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডির পরিমিত প্রকাশ।অরুন্ধতী রায়ের উপন্যাসের ভাষার নির্মিতি চোখে পড়ার মতো, দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দেয়ার মতো, যে চোখ থকে মনের গভীরে পড়ে সেই অনুরণন।দ্য গড অফ স্মল থিংস বইটি প্রকাশের পরবর্তী ২০ বছর অরুন্ধতী রায় যে নিভৃতে নীরবে কাটিয়েছিলেন, তা নয়। সেই সময়ে সাহিত্য ছেড়ে দেন এবং পক্ষান্তরে তিনি বেছে নেন ‘প্রতিবাদ রাজনীতি’। জড়িয়ে পড়েন ভারত সরকারের নিগ্রহনীতির বিরোধিতায়। যুক্ত হন মাওবাদীদের সঙ্গে। ভূমিহীন–দলিতদেরসঙ্গে।ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষেও কথা বলেছেন স্বদর্পে।অরুন্ধতী রায় ভারতের পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একদিকে সরকার, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও তার সুবিধাভোগীদের রোষানলে পড়েন। ইরাক যুদ্ধ এবং বিশ্বজুড়ে মার্কিনসাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও তিনি হয়ে ওঠেন এক প্রধান সমালোচক। ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে নিউইয়র্কের কুপার ইউনিয়নে কয়েক হাজার লোকের সামনে ওই যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী ও নয়াউপনিবেশবাদী চরিত্র তুলে ধরেন।
মূলত আলাদা করে অরুন্ধতী রায় সম্পর্কে বহু বহু আলোচনা চলে আসে কারণ তার ব্যক্তিজীবন এত বৈচিত্র্যপূর্ণ বলেই। একজন কথাসাহিত্যিক কীভাবে যেন রাজনৈতিক ভাষ্যকার হয়ে ওঠেন। তখন সমালোচনাও কম হয়নি।রাশান সাহিত্যের বড় বড় সাহিত্যিকেরা অ্যাকটিভিস্ট না হলেও মানুষের পাশে থাকার নিরন্তর সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন।সেই তুলনায় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের লড়াইয়ে একাত্ম হয়ে আবার লেখায়ও সারা পৃথিবীকে জানান দেওয়ার সংখ্যা নেই বললেই চলে। মহাশ্বেতা দেবী‘র পর অরুন্ধতী রায়–ই সবচেয়ে ভাস্বর, বলা চলে সর্বাধিক আলোচিত। অন্যভাবে বললে সারাবিশ্বেই আলোচিত।
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’র পাঠ শেষ। আলাপচারিতা চলছে এবং প্রশ্নোত্তর। ‘সাহিত্যিক যখন রাজনীতিক হয়ে ওঠেন, তা কি সাহিত্যের জন্য অশনিসংকেত নয়?’ এমন প্রশ্নে তিনি রেগে যাননি, তিনি বলেন, ‘লেখক যদি তাঁর সমাজ নিয়ে না লেখেন–যে সমাজ অসাম্য, বিভক্তি ও নিবর্তনে জর্জরিত—তাহলে অন্য আর কী নিয়ে তিনি লিখবেন? আর এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। ’দীর্ঘসময় ধরে না লেখার অভিযোগে অরুন্ধতী রায় খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘উপন্যাস লেখা কঠিন কাজ।এর জন্য সময় চাই।’ একদশকের বেশি সময় ধরে অরুন্ধতী রায় তাঁর এই দ্বিতীয় উপন্যাসটি নিয়ে ভেবেছেন, অল্প অল্প করে লিখেছেন। বস্তুত, তাঁর ভাষায়, ‘৩৭ বছর ধরেই বইটি আমি লিখছি।’
“যদি আপনি ধার্মিক হয়ে থাকেন, তাহলে মনে রাখুন, এই বোমা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের চ্যালেঞ্জ। যেন খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, তুমি যা কিছু সৃষ্টি করেছো, সে সবকিছু ধ্বংসের ক্ষমতা আমাদের আছে। আর যদি আপনি ধার্মিক না হন, তাহলে এভাবে ভাবুন, আমাদের ৪৬০ কোটিবছরের পুরোনো এই পৃথিবী এক বিকেলেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।”
এই কথাগুলো পড়েই পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কতটা গভীর সূক্ষ্মতার বুননে তিনিভাবেন।একই সঙ্গে দুটো আলাদা মানসিকতার মানুষদের কথা মাথায় রেখে তাদের একইধারায় চিন্তা করতে বাধ্য করার মতো ডেলিগেট ডিপ্লোমেটিক সেন্স তিনি ধারণ করেন।১৯৯৮ সালে তিনি ভারত সরকারের নিউক্লিয়ার পলিসির একটি সমালোচনা লিখেন ‘দ্য অ্যান্ড অব ইমাজিনেশন’ নামে। সেখানেই উক্ত কথাগুলো উল্লেখ করেন তিনি।অরুন্ধতীরায়একজনবিখ্যাতভারতীয়ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিকএবংমানবাধিকারকর্মীওপরিবেশআন্দোলনকর্মী।১৯৯৭সালেনিজেরপ্রথমউপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’র জন্যে ম্যানবুকারপুরস্কার পান তিনি। ভারতে বসবাসরত কোনো ভারতীয় নাগরিক কর্তৃক রচিত সবচেয়ে অধিক বিক্রীত বই।অন্যায়ের সঙ্গে আপসহীনতা, ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধেঅবস্থান নেওয়া, মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ও ফিলোসোফিক্যাল ইনসাইট সম্পন্ন এক মহান লেখক বুদ্ধিজীবী, তিনি অরুন্ধতী রায়।
২০০৮ সালে তিনি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্বপক্ষে তার মতামত ব্যক্ত করেন। ১৮আগস্ট, ২০০৮ কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে প্রায় ৫ লাখ কাশ্মীরি জনতার র্যালীর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, তাদের এই র্যালী ছিল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্ক্ষার নিদর্শন।তার মতে, কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় কাশ্মীরি জনগণকে স্বাধিকার প্রদান করা। নর্মদা ড্যাম প্রজেক্টের বিরুদ্ধে তীব্র কন্ঠ ছিলেন অরুন্ধতী।তিনি বলেছিলেন, এই প্রকল্পে প্রায় আধা মিলিয়ন মানুষকে গৃহহীন করে ছাড়বে এবং তাও কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়া।নিজের বুকারপ্রাইজ থেকে পাওয়া অর্থ ও বইয়ের স্বত্ব হতে পাওয়া অর্থ তিনি দান করেন ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনে। তার এই আন্দোলনও কংগ্রেস ও বিজেপি নেতাদের সমালোচনার শিকারহয়।
পরিবেশ–ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ ও অরুন্ধতীর এই আন্দোলনকে তীব্র সমালোচনা করেন। তার মতে, মিস রায়ের এই পক্ষ সমর্থন অতিরঞ্জিত ও আত্মকেন্দ্রিক এবং তিনি পরিবেশগত বিশ্লেষণের নাম খারাপ করে দিয়েছেন। প্রত্যুত্তরে অরুন্ধতী সোজাসাপটা বলে দেন, ” আমি বিকারগ্রস্ত।আমি ছাদে উঠে চেঁচিয়ে যাচ্ছি, আর উনি আর ওনার ফিটফাট শাবকেরা আমাকে বলছেন, ‘হিসসস…প্রতিবেশীরা জেগে যাবে!’ আমি প্রতিবেশীদের জাগাতেই চাই।এটাই আমার উদ্দেশ্য। আমি চাই, সবার চোখ খুলুক।“
নকশাল ও মাওবাদী বিদ্রোহীদের ওপর সরকারের সশস্ত্র আক্রমণেরও তিনি সমালোচনা করেন।তিনি একে ভারতের সবচেয়ে গরিব মানুষদের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন। ২০০৬ এর আগস্টে দ্য গার্ডিয়ানে নোয়াম চমস্কি, হাওয়ার্ড জিনসহ প্রায় ১০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে অরুন্ধতী রায়ও একটি খোলাচিঠিতে স্বাক্ষর প্রদান করেন। এই চিঠিতে ২০০৬ এর লেবানন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্যকরা হয়।
প্রথম উপন্যাস প্রকাশের দীর্ঘ ২০ বছর পর ২০১৭ সালে এসে অরুন্ধতী তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ প্রকাশ করেন।সে বছরই বইটি ছিল ম্যানবুকার পুরস্কারের মনোনয়নের তালিকায়।
যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, সেটা জাতীয় হোক বা আন্তর্জাতিক, সেখানেই তিনি উচ্চকিত কণ্ঠে চিৎকার দিয়েছেন অসাম্যের বিরুদ্ধে।অরুন্ধতী রায় বলেন, তার মতো একজনের প্রচেষ্টায় হয়তো পৃথিবী জুড়ে চলমান সার্বিক মানবাধিকার লঙ্ঘনে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে না, কিন্তু তার মতো অনেকে এখনো আছেন বলেই হয়তো মানুষ এখনো সাহস করে বাঁচার, স্বপ্ন দেখে সাম্যের, সৌহার্দ্যের। একজন অরুন্ধতী রায় আমাদের সেই অনুপ্রেরণাই দান করে যান।
মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস উপন্যাসটির নামকরণ, প্রচ্ছদ, কাহিনির বিস্তার আর এরদূর প্রক্ষেপণের অনেকগুলো বিষয়ই বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত আলোড়িত উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম। যেকোনো পাঠকেরই মনে হতে পারে, উপন্যাসটির নাম দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস কেন বা এর কী বিশেষত্ব যা একটা উপন্যাসকে ঐন্দ্রজালিক উচ্চতায় নিয়ে যায়। অরুন্ধতী রায়ের ভাষ্য হলো, মানুষ যে সব সময় তার প্রত্যাশিত জায়গাগুলো থেকেই আনন্দ পেয়ে থাকে, সব ক্ষেত্রে এটি ঠিক নয়। অনেক সময় অনেক অপ্রত্যাশিত জায়গাও মানুষকে আনন্দ দেয়। এটিতো ঔপন্যাসিকের ভাষ্য।কিন্তু পাঠকের মনে বার বার মনে হতে থাকে মিনিস্ট্রি বা মন্ত্রণালয় কেন? সেখানে আমার কেবলই মনে হয়, এটি রাষ্ট্রীয় পারিভাষিক জায়গা থেকে যেমন সর্বোচ্চ স্থান মিনিস্ট্রি, তেমনি অপ্রত্যাশিত জায়গাও তেমনি।
অরুন্ধতী রায় প্রখ্যাত আলোকচিত্রী মায়াঙ্ক অসটিনকে অনুরোধ করেন, উপন্যাসের প্রচ্ছদের জন্য সুফি দিল্লির পুরোনো একটি সমাধিক্ষেত্রের কিছু ছবি তুলে পাঠাতে। ডিজাইনার ডেভিড এলড্রিজের কাছে সে সব আলোকচিত্রের বেশ কয়েকটি তিনি পাঠান।এরপর ওই ছবির সঙ্গে ডেভিড তাঁর নিজের পছন্দের কিছু সমাধিক্ষেত্রের ছবির মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেন বইয়ের প্রচ্ছদ। ডেভিডের মতে, ‘প্রচ্ছদটি কাছ থেকে দেখলেএকরকম অনুভূতি হয়, আবার একটু দূরে সরালেই মনে হয় অন্যরকম ‘আর ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ‘ক্ষয়িষ্ণুতারও যে একটি সৌন্দর্য আছে, প্রচ্ছদ দেখলে তা বোঝা যায়।’
নিঃসঙ্গ কবরখানায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের মত হিজড়া আনজুমকে দিয়ে এই ঘটনার সূত্রপাত। অরুন্ধতী রায়ের যে নিজস্ব স্টাইল আছে, যেটা দ্য গড অব স্মল থিংসে দেখেছি। সুতরাং কোনো ঘটনার আবর্তন কাকে ঘিরে হবে তা বলা দুরূহ। শুধু তাই নয়,এমনকি বুদ্ধিমান পাঠককেও প্রেডিক্ট করবার ক্ষমতাহীন করে দেন। মূলত তার নিজস্ব জগতেই তার উপন্যাসের পাঠককেই আত্মীকরণ করেন।দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস পড়ার সময় পাঠকের একটা সচেতন ভাব থাকে যে, তিনি ঘটনাটিকে একটা রাজনৈতিক প্যারাডাইমে রূপ দেবেন, শুধু একজন ক্লীব বা হিজড়া আনজুমের জীবন সংগ্রামে আটকে না থেকে ওটাকে কেমনকরে, কখন কীভাবে আরও বেশি গণমানুষের সংগ্রামের দিকে নিয়ে যাবেন।
অরুন্ধতী রায়ের জীবনকে দেখারভঙ্গি সেটা যাপিত জীবনের নির্যাস থেকে আহরিত, বহুমাত্রিক জীবনাভিজ্ঞতা তাঁকে আলোড়িত–আন্দোলিত করেছে, নিজের উপন্যাসের উপাদান সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন। অরুন্ধতীর প্রথম উপন্যাসটি ছিল একটি ব্যক্তিগত কাহিনি, একটি পরিবারের গোপন লজ্জার ভেতরের গল্প। কিন্তু দ্বিতীয় উপন্যাসে তিনি বিষয় নির্ধারণ করেছেন নাগরিক জীবনের বলয় থেকে। দুটি সমান্তরালগল্প—একদিকে দিল্লির একটি ‘হিজড়া’মেয়ে আনজুমের আত্ম–আবিষ্কার, অন্যদিকে স্থাপত্যকলার ছাত্রী তিলোত্তমা ও পুলিশি নজর থেকে পালিয়ে বেড়ানো তার কাশ্মীরি প্রেমিকের কাহিনি। এই দুইকাহিনির অপূর্ব মেলবন্ধন থেকে আধুনিক ভারতের এক নির্মম, অসহনীয় বিষাদগাথা নির্মাণ করেছেন ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায়, যেখানে নারী তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত, নিম্নবর্ণের মানুষ নিপীড়নদগ্ধ হয় ক্রমাগত, মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলে অহর্নিশি, অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা মুসলমানদের নিত্যসঙ্গী, অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইরত যুবককে পালিয়ে বেড়াতে হয় পুলিশ ও সমাজের রক্তচক্ষু থেকে। এই দুইয়ের মধ্যে ভেদরেখা নির্ধারণ অসম্ভব।বস্তুত, অরুন্ধতীর এই উপন্যাস সমকালীন ভারতের এক বর্ণাঢ্য মানচিত্র। গুজরাটের দাঙ্গা, ভূপালের গ্যাসবিস্ফোরণ, দিল্লির যন্তরমন্তরে ছাত্রবিক্ষোভ সবকিছুই যেন একটা ভীষণ প্রতিবাদের শব্দাবলি হয়ে ওঠে। সামন্ততান্ত্রিক, শ্রেণিবিভক্ত, দুর্নীতিনির্ভর ও নিবর্তনবাদী হিসেবে সমকালীন ভারতকে হাজির করেন, যেখানে ধর্মের নামে ক্ষমতা দখল একটা মামুলি বিষয়। আবার এই দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়েও ভালোবাসা, প্রেম, প্রকৃতি, বিচ্ছিন্নতা সব ওঠে আসে।অপূর্ব সে বয়ান!
অরুন্ধতী ভিন্ন এক ভারতের জন্য লড়াই করছেন গত আড়াই দশক ধরে। এজন্য তাঁকে পুলিশি জুলুম– নির্যাতন, নজরদারি সহ্য করতে হয়েছে, জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস যেন তার প্রামাণ্য, তাঁর লড়াইয়েরই গল্প।তিলোত্তমা নামের মেয়েটি সে মূলত অরুন্ধতী রায়েরই এক প্রতিচ্ছবি, যে অরুন্ধতীর মতো একজন স্থপতি। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের বিভাজন টানা সত্যিই অসম্ভব, যে ভারতের ফিকশন লিখতে চান অরুন্ধতী রায়।
পুরোনো দিল্লির খোয়াব গাঁর হিজড়াপট্টি ত্যাগী এবং গৃহত্যাগী আনজুম; যে ছিল উপন্যাসটির প্রথম চরিত্র, জন্মের পরই যার পরিচয় হয় আফতাব।আফতাব একটি প্রচলিত পুরুষ নাম। অথচ আনজুমের লিঙ্গ ছিল অনির্ধারিত।তার মা জাহানারা বেগম এই ধ্রুব সত্য লুকিয়ে রাখার জন্য সদাতৎপর ছিল কিন্তু সময় অবধারিতভাবেই সে সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। আফতাব বয়সন্ধিকালে এসে স্বেচ্ছায় আনজুম হয়ে ওঠে।অজ্ঞাতনামা ইংরেজি জানা লোকটাকে সে নিজের নাম বলেছিল আনজুমান।
ইন্দিরা গান্ধীর গুপ্তহত্যার পর শুরু হল নিরন্তর শিখ নিধনযজ্ঞ—আহমেদাবাদের দাঙ্গা।রাষ্ট্রের আদর্শগত অসংবেদনশীলতার পরিচয় প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছিল। আফতাব কিংবা আনজুম হিন্দুর ছদ্মবেশে দাঙ্গা থেকে পালাতে চাইল। পালাতে গিয়ে সেই দিল্লির কবরখানায় এসে নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ে নামল। তারপর এক সময় এক ছোট্ট আশ্রয়কেন্দ্র খুলে বসলো ওই কবরখানাতেই। তার নাম দিল জান্নাত।
অরুন্ধতীর গোরস্থানে জান্নাত বানানোর কনসেপ্ট পাঠককে ভাবতে বসায়। হোঁচট খেতে বাধ্য করে, চমকে দেয়। যেন এক বাস্তবতার নির্মম জাদু।এই জান্নাতে ঠাঁই হয় দলিতের, ঠাঁই হয় পালানো মুক্তিকামীর, ঠাঁই হয় জাতি–বর্ণ অস্বীকারের, বিকলাঙ্গ–আশ্রয়হীনের কখনো বা বাস্তুহারা প্রাণীরও।এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরও আরও চরিত্র নিয়ে, আরও আরও প্রেক্ষাপট নিয়ে, খণ্ড খণ্ড–ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প নিয়ে ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’র কাহিনির বিস্তার ধীরে ধীরে এগোয়।
আনজুমের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার ক্লীবত্ব আবিষ্কার আর নানা রকমের প্রতিক্রিয়ার ঘূর্ণিপাকে পড়ে যাওয়া মা, পিতা হাকিম মুলাকাত আলী; যিনি আপ্রাণ বিশ্বাস করতেন যে, কবিতা আরোগ্য দিতে পারে– উপশমের ক্ষমতা কবিতার আছে অথবা পুলিশবাহিনীর হাতে নিহত পিতার ছেলে সাদ্দাম যাকে আনজুম অচ্ছুত দলিতের বদলে বরং মর্গে কাজ করা চামার ডাকতেই পছন্দ করত। চামার সাদ্দাম আবার জয়নবকে পছন্দ করে।এই জয়নাবকে কুড়িয়ে বুকে তুলে নিয়েছিল আনজুম।
আনজুম তৎকালীন দিল্লিতে চলমান দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে থমকে যায়। সে উপলব্ধি করে এ আন্দোলনে গণমানুষের ভাগ নেই।সাম্যের অস্তিত্বের সংকট সেখানে। সেখানে অসংখ্য মানুষের অনেকের অংশগ্রহণ নেই। রাষ্ট্রের হাতে নিপীড়িতরা নেই, তার মত ক্লীবেরা নেই।ভারত মাতাকে মিডিয়ার দেখানো অস্পষ্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়।সেই আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ যেন খুব খুব গৌণ করে দেয়।সে আন্দোলনে ভূপাল গ্যাস লিক ভিকটিম গৌণ থাকে। কাশ্মীরে নিহত– অপহৃত মানুষগুলোর স্বজনদের হাতের স্বজন হারানোর সেই সংখ্যাতত্ত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রকে উন্মত্ত দানব আখ্যা দেওয়া ব্যানার–প্ল্যাকার্ডের জায়গা অবাঞ্চিত। ভারতীয় মিডিয়ায় চকচকে ক্যামেরায় সেটা বড় অস্পষ্টও ধোয়াশাপূর্ণমনেহয়।
আন্দোলন, মিছিল–মিটিংয়ের ভেতর ‘জেবিন দ্য সেকেন্ড’কে পাওয়া যায়। জেবিন দ্য সেকেন্ড হচ্ছে কমরেড রিভাথির শিশুকন্যা। শিশুর পিতা কে, তা নির্দিষ্ট নয় কারণ কমরেড রিভাথি একটা গুপ্তদলের সদস্য থাকার অপরাধে ছয়জন পুলিশের দ্বারা ধর্ষিতহয়েছিল।অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলকমরেড রিভাথি। দিল্লিতে প্রতিবাদে জড়ো হওয়া প্রতিবাদমুখরিত জনতার মাঝে শিশুটির আশ্রয়স্থল দেখতে পেয়েছিলেন অনশনরত ড. আজাদ ভারতীয়া।জন্তরমন্তর প্রসঙ্গ এই নামগুলো আর ঘটনাগুলোর সঙ্গে প্রবলভা বেজড়িত।
জেবিন দ্য সেকেন্ড ও জান্নাতে ঠাঁই পাওয়া, আনজুমের ডানায় আগলে থাকা একজন ছোট্ট মানুষ। জেবিন দ্য সেকেন্ডের গল্পে তিলোত্তমার আগমন, যাকে প্রায়শই ‘তিলো’বলে ডাকা হয়। এই তিলোর ভেতর ব্যক্তি অরুন্ধতীর ছায়া দেখতে পান পাঠককুল।কাশ্মীর স্বাধিকার আন্দোলনকারী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী মুসার সঙ্গে তিলোত্তমার প্রেমহয়। তিলোত্তমা আর মুসা একসময় সহপাঠী ছিল। তাদের সঙ্গে আর্কিটেকচার পড়ার সময় সহপাঠী ছিল বিপ্লব দাশগুপ্ত, ছিল সাংবাদিক–টকশো করা নাগারাজ হারিয়ানা। এই তিন পুরুষেরই তিলোর প্রতি অনুরাগ ছিল।
মুসার স্ত্রী আরিফা, কন্যা জেবিন দ্য ফার্স্ট আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর হাতে নিহতহয়। মুসা আরও দৃঢ় আরও রহস্যময় হয়ে পড়ে।তিলোত্তমা মুসাকে মানসিকশক্তি জোগাতে কাশ্মীর যায়। এরপর ঘটনার জের ধরে কাশ্মীরের ভয়ংকর নরঘাতক আর্মি অফিসার আমরিক সিংয়ের হাতে তিলোত্তমা ধরা পড়ে, কিন্তু মুসা কোনো না কোন ভাবে পালাতে সক্ষম হয়।
তিলোত্তমা কেন আশ্রয়ের খোঁজে বাঙালি বিপ্লব দাশগুপ্তের বদলে তামিল–রাজপুত মিশ্ররক্তের নাগারাজ হারিয়ানার হাত ধরলো, সেখানে ভালোবাসা ছিল কি ছিল না সেটার এক জটিল চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে সংঘাত, খুনের পর খুন, রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ এগোতে থাকে। ঘটনার পটভূমি খোয়াব গাঁ–দিল্লী–কাশ্মীর পার করে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যায়। দেশ পালানো খুনি মেজর আমরিক সিংকে সবহারানো মুসা ছেড়ে দেবে কী দেবে না সে সংশয়ের ভেতরেও উঠে আসে।রাষ্ট্র তার পোষা খুনির প্রতিও অকৃতজ্ঞ হয়, তাকে ব্যবহারের পর কেমন নির্দয় অস্বীকারকারীহয়ে ওঠে।
অন্যদিকে জাতপাতের বাছবিচারে আক্রান্ত জনপদে নিজ দলের লোক অন্য দলের লোককে হত্যা করতে করতে এক সময় নিজে মরে গেলেও অসম্মানিতই হয়। সাউথ ইন্ডিয়ান কমবয়সী সেনাটি কাশ্মীর ইস্যুতে প্রাণ হারায় এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক ঠিকই শহীদী মর্যাদা পায়।কিন্তু তার গ্রামে তার স্মারক ভেঙে ফেলা হয় বারবার। কারণটা উঁচু নিচু জাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। অরুন্ধতী রায়ের ‘in some countries, some soldiers die twice’ কথাটি পাঠকের মননে এক গভীর ভাবনা আর ক্ষতের সৃষ্টি করে এবং অরুন্ধতী রায় সেই অসাধারণ ভাবনার খোরাক হাজির করেন স্বদর্পে।রাষ্ট্রের আদর্শিক চ্যুতি অথবা নিজের; নিজেকে কোথায় নিয়ে যায়, অথচ কোথায় তার যাওয়ার কথা ছিল, অরুন্ধতী সেটা দেখাতে চেয়েছেন।রাষ্ট্রের সামষ্টিক স্বার্থ কোথায় তার ভুল ব্যাখ্যা রাষ্ট্রই যখন অনুধাবন করে। দমন–নিপীড়ন যখন প্রধান অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে তার ডেসটিনেশন হয় অনেকটা গোরস্থানের মতো ধ্বংসস্তূপ।গণতন্ত্রের আদর্শিক মৃত্যুর পরে গোরস্থান ছাড়া আর কোনো গতি থাকেনা। ব্যক্তি, জাতিসত্তা, আদর্শ সকলেরই চ্যুতি হলে এমনটাই হতে বাধ্য।
অন্যদিকে কেউ কেউ এই আদর্শের সঠিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়েই একটা জান্নাত গড়ার স্বপ্ন দেখে, যেখানে ধর্ম–বর্ণ–গোত্র–জাতপাতহীন সাম্যের পৃথিবীর নতুন সূর্যোদয় হবে।
ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায়ের দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস বহুকালধ ধীমান পাঠকের জন্য ভাবনার জগৎকে আলোড়িত করবে।