You are currently viewing দেশি খাদ্য আর বহুজাতিক চোয়াল || দেবাশিস  সরকার

দেশি খাদ্য আর বহুজাতিক চোয়াল || দেবাশিস  সরকার

দেশি খাদ্য আর বহুজাতিক চোয়াল

দেবাশিস  সরকার

 

।। এক ।।
আমাদের আজকের গল্পটি এভাবে শুরু করার কথা ছিল না

ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার যে সম্পর্ক, বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের সেই সম্পর্ক । এইরকমই ভাবে অতীন। আর ‘বাড়ি ‘ শব্দটির যে ব্যাপ্তি, তাতে এক চিলতে উঠোন , একটা দুটো নারকেল গাছ ,আমগাছ,তুলসীমঞ্চ – এতো কিছু অনুসঙ্গের সঙ্গে ‘ফ্ল্যাট ‘ শব্দটা ঠিকঠাক খাপ খায় না। যদিও তুলসীমঞ্চ, ঠাকুর দেবতা নিয়ে অতীনের বিশেষ মাথাব্যথা নেই তবুও সন্ধ্যেবেলায় তুলসীমঞ্চের সামনে একটি পেতলের প্রদীপ জ্বালাবে গৃহস্থের কোনো একজন মহিলা , প্রেফারেবলি বাড়ির পুত্রবধূ , এ ভারী আকাঙ্খার বিষয় অতীনের কাছে। আসলে এও একরকমের আবহমানতা বা ঐতিহ্যর সঙ্গে লগ্ন থাকার অভিপ্রায় বা নিজস্বতা আর কি ! এটুকু বিসর্জন দিতে সে রাজি নয় । অতীনের স্ত্রী হাসির বরং ফ্ল্যাট পছন্দ । ঠাকুর দেবতাকে অগেরাহ্যি করার কথা সে ভাবেই না, শাশুড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপোস কাপাস সবই করে , তবে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে সুন্দর টাইলস দিয়ে ঘিরে কি তুলসীমঞ্চ বানিয়ে রাখা যায় না ! মাসিদেরই তো রয়েছে ! ” শোন ! মাসিদের পাড়ায় মাত্র বাইশ লাখে তিন বেডরুমের দুখানা ফ্ল্যাট এখনও খালি পড়ে আছে ! আমাদের বাড়িটা বিক্রি করলে তিরিশ চল্লিশ লাখ পাবে সেদিনই বলছিলে না ? চলো ! এতো বড় বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে সারাদিনে আমার কালঘাম ছুটে যায় বাপু ! তাড়াতাড়ি ডিসিশন নাও ! নাহলে আবার এই ফ্ল্যাটগুলো না হাতছাড়া হয়ে যায়!”অতীন বাঁকা হাসি হেসে স্ত্রীকে বলে , “একই ছাদের তলায় আমি আর একজন কোল মাফিয়া বাস করবো ? হাঃ! হয়তো দেখা গেল, ওই ফ্ল্যাটের যে কমিটি , তার প্রেসিডেন্ট ঘুষখোর একজন ইঞ্জিনিয়ার নয়তো নার্সিংহোমের দালাল একজন ডাক্তার ! ছো :! তাছাড়া তিনটে মাত্র শোবার ঘরে কেন যাবো ? আমাদের বাড়িতে ওপর নিচ মিলিয়ে পাঁচটা শোবার ঘর , বড় ডাইনিং, পায়খানা, বাথরুম দু খানা করে! আমি ওই খুপরি ঘরে কেন ঢুকতে যাবো ? সবচেয়ে বড় কথা , এখানে আমি স্বাধীন !”
– কি কাজে লাগে বলো তো ? আমরা, বাবা – মা আর বুবুন । তিনখানা ঘরই তো যথেষ্ট আমাদের ! এতো বড় বাড়িতে –
– হুঁ :! একেই বলে মেয়েদের বুদ্ধি! আমি মারা গেলে এ বাড়ির মালিক তো তুমিই হবে । তখন না হয় এ বাড়ি বিক্রি করে মাসিদের পাড়ায় চলে যেও ।
– তোমার মরণ পর্যন্ত এখানে পড়ে থাকতে আমার বয়েই গেছে ! মা-বাবা যদ্দিন আছেন তদ্দিন , ওদিকে বুবুনের কোনো একটা চাকরি বাকরি হওয়া অব্দি আমি আছি এ বাড়িতে । তারপর দেখবে তুমি আমি কোথায় যাই !
অতীন হাসে । তার পছন্দ করে কিনে রাখা সিডিগুলি যেমন মাসে একবার করে বাজিয়ে গান শোনা হয় , তেমনই এই দাম্পত্য নাটিকাটিও গড়ে মাসে একবার করেই বেজে ওঠে । তার নিজস্ব যৎসামান্য সঞ্চিত অর্থ ও প্রাপ্য সমস্ত রকম লোন নিয়ে এ বাড়ি অর্জিত । বাবার জমি ও ভিটে বিক্রির টাকায় ভাগ্যিস হাত পড়ে নি তখন , নাহলে বাবার চিকিৎসার এখন যে বিশাল খরচ সে টানতে পারত না। তৃপ্তি যেটা , তা হল প্রতিবেশীরা সহৃদয় , আলাপী। সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে এক কাপ চা পান শেষে খালি গায়ে ব্যালকনিতে বসে আয়েশ করে একটি সিগারেটে সুখটান দেওয়ার সময়টায় এই তৃপ্তির চারাগাছটিতে তিরতির করে হাওয়া বয়ে যায় !
তো, সেদিন ঘটল অদ্ভুত ঘটনাটা ! চামচিকের মতো কি একটা তার কানের পাশ দিয়ে ভোঁ শব্দ করে উড়ে গেল ! হাতে মোবাইল নিয়ে সে কাকে যেন ফোন করতে বসেছিল । ‘ ব্যালকনির খোলা জানালা গলে চামচিকেটা ঘরে ঢুকেছে , পরে ঝাঁটা মেরে তাড়ালেই হবে ‘ , ভেবে গুরুত্ব দিল না সে । মোবাইলের বোতাম টিপল অতীন । কথা শুরু করেছে কি করেনি , ভোঁ শব্দে আর একটা উড়ে এসে তার বুকে থপাস করে ধাক্কা মারল এবং ওখানেই লেপ্টে রইল ! তড়াক করে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল সে । ভয় না , বুকের ওপর কি একটা লেপ্টে রয়েছে তা পরিষ্কার আলোয় দেখবার জন্যে ব্যালকনি থেকে ঘরের ভেতরে এসে ঘাড় নিচু করতেই প্রাণীটিকে দেখতে পেয়ে শিউরে উঠল গা ! চারটে ছড়ানো ঠ্যাঙে বুকের লোমগুলিকে খামচে ধরে আছে একটা ছোট সাইজের ব্যাঙ ! ব্যাঙই কি ? অন্য কিছু না তো ? নীচের থেকে কিংবা আকাশ থেকে উড়েই তো এলো একটু আগে !কেমন অজানা আশঙ্কায় চিৎকার করেই হাসিকে ডাকল সে , ” হাসি ! তুমি কি রান্নাঘরে ? গ্যাসটা নিভিয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এসো একবার ! কুইক ! হাসি ? ” হাসির আগেই ব্যালকনি লাগোয়া ঘর থেকে টিভি বন্ধ করে মা এল ধড়ফড় করে , ” কি হয়েছে ? “অতীন ব্যাকুল ভঙ্গিতে মাকে বলল,” মা ! দ্যাখো তো আমার বুকে কি একটা লেপ্টে রয়েছে ? দেখলে ? এটা ব্যাঙ কি ? নাকি অন্য কিছু ? ” মা ভীষণ অবাক প্রাণীটিকে দেখতে পেয়ে ! ” একি! কি এটা ? তাড়াতাড়ি গা থেকে ঝেড়ে ফ্যাল ! কামড়ায় যদি !”
– দাঁড়াও ! হাসিও আসুক। ওকেও দেখাই ! ঝেড়ে ফেললেই তো উড়ে যাবে! কই হাসি? শুনতে পাও নি ?
হাসি ধড়ফড় করে উঠছিলই , ওপরে উঠে এসে নির্দেশিত জায়গায় তাকিয়েই হতভম্ব ! চিৎকার করে উঠলো সে , ” ম্যাগো ! কি ওটা? কামড়ে ধরে আছে না কি? ঝেড়ে ফেলতে পারছো না ? মারো ওটাকে । “
– কামড়ায় নি। তবে কিভাবে মারা যায় একটা বুদ্ধি দিতে পারো ? আরো একটা ঢুকেছে এ ঘরে। ওটাও নিশ্চয় ঝুলছে কিছু থেকে ।ওটাকেও মারতে হবে।
– তোমার গা থেকে ঝুলছে , ঝাঁটা বা কোনো কিছু দিয়ে তো জোরে মারা যাবে না , আগে ওটাকে ঝেড়ে মেঝেতে ফেলতে হবে , তিনটে ঝাঁটা আনি , ঝেড়ে ফেলার পর তিনজনেই ঝাঁটা চালাবো ।
ডান হাতে ঝাঁটা নিয়ে বাঁ হাতের চেটো দিয়ে ব্যাঙটাকে ঝেড়ে ফেলতেই ব্যাঙটা ছিটকে মেঝেতে পড়তে পড়তে হঠাৎ ভোঁ শব্দে ছাদের দিকে উঠতে লাগল , সিলিংয়ে ধাক্কা খেল এবং কি আশ্চর্য! মাথা নীচের দিকে করে সিলিংয়েই লেপ্টে রইল ! এখন উপায় ! ব্যাঙটাকে দেখার জন্যে ওপরের দিকে ভালো করে তাকাতেই সিলিং ফ্যানের ব্লেডে এবং টিউব লাইটের ওপরে অন্য দুটি ব্যাঙকে লেপ্টে থাকতে দেখল ওরা । এরা ব্যাঙই তো ? পোকার মতো উড়তে পারে ? ডানা কই ? বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই ওদের চোখের সামনে দিয়ে উড়ে আর একটা এসে ক্যালেন্ডারের গায়ে বসতেই হুঁশ হোল অতীনের । “তাড়াতাড়ি ব্যালকনির দরজা আর ঘরের জানালাগুলো বন্ধ কর ! আমি ততক্ষণে হাতের নাগালের ক্যালেন্ডারের এটাকে মারি !” অতীন ঝাঁটা চালাতে উদ্যত হলে মা আর্ত চিৎকারে জানায় ,” ওটা মা কালীর ক্যালেন্ডার রে তুতুল ! ঝাঁটা চালাবি না । ” থমকে গেল অতীন , একটু ভেবে নিয়ে ঝুলঝাড়ুর পেছনটা দিয়ে প্রাণীটাকে খোঁচা মারল সে । ওটা উড়ে গিয়ে দরজার গায়ে বসল । ব্যস ! এবার আর পরোয়া কি ! গায়ের জোরে ঝাঁটা চালাতেই চিৎপটাং হয়ে চার পা ছড়িয়ে পড়ে গেল প্রাণীটা! অন্য তিনটিকে ঝাঁটার নাগালে আনতে বিছানার ওপর উঠে ঝুলঝাড়ু দিয়ে খোঁচানো , ঝাঁটা চালানো, ফস্কে যাওয়া –বাঁচার জন্যে দু পক্ষের লড়াই শুরু হোল ! আধঘন্টা বাদে অবসন্ন হয়ে বিছানায় বসে পড়ল ওরা । তিনটিকে খতম করা গেছে , একটি এখনও সিলিংয়ের সামান্য নীচের দেওয়ালে লেপ্টে আছে । চব্বিশ ঘন্টার জন্যে দরজা জানালা বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত হল সর্বসম্মত । হাসি ছুটল রান্নাঘরে , মা নীচের ঘরে । রক্ষা , নীচের তলায় এমনকি মাঝের ঘরেও প্রাণীগুলো আসে নি । মৃত প্রাণী তিনটিকে ঝাঁটা দিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল ওগুলো ব্যাঙই ! কোথা থেকে আসছে ! দেওয়ালি পোকার মতো লাইট দেখলেই কি এসে কিলবিল করে ! তারা তো এ বাড়িতে এসেছে সাত মাসের মতন ! এতদিন তো কই আসেনি !এখন তো বর্ষাকালও নয় , গ্রীষ্মকাল। অন্য বাড়িগুলোতেও আসে নিশ্চয় । এইসব ভাবনার মাঝে অতীন বললো , ” আমি একবার পাড়ার প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে জেনে আসি । ওরা কি করে তাড়ায়! দিনের বেলাতেও আসে কি ! সবসময় কি দরজা জানালা বন্ধ করে থাকা যায় নাকি ? জেনে আসি । একটা দুটো যদি এরকম এখানে সেখানে ঢুকে পড়েছে আজকের মতো থাক ! কাল সকালে ওগুলোর ব্যবস্থা হবে । “
আশেপাশের সাতটা বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল , তারাও বেশ ক’বছর আগে একটা দুটো দেখেছেন বটে তবে হালফিলে কিছু দেখেননি বা শোনেন নি । চড়ুই পাখির মতোই এগুলোও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলেই ধারণা হয়েছিল । তাদের বাড়িতেও যদি এ উপদ্রব শুরু হয় তাহলে দরজা জানালা বন্ধ করে রাখা ছাড়া উপায় কি !
“জানালাগুলোতে তারের জাল লাগান! কোনো ঘরে ঢুকতে আর বেরোতেই খালি দরজা খুলুন ,নাহলে সবসময়ই বন্ধ রাখুন !”
– কেবল আমার বাড়িতেই ঢুকছে কেন ? আপনাদের জানালায় তো কই তারের জাল লাগানো নেই !
– বাঃ মশাই ! আমাদের বাড়িতে ঢুকছে না বলে আপনি দুঃখ পাচ্ছেন ! একি ! কেমন প্রতিবেশী আপনি ? বাঃ!

পরদিন সকালেই অতীন ঝাঁটা হাতে ব্যাঙের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে পড়ল । বুবুনকে স্কুলে রওনা করিয়ে দিয়ে হাসি ব্যস্ত রান্নাঘরে । অতীনকে বলল , ” আমি তোমার কোনো কাজে হাত লাগাতে পারবো না । চারজনের রান্না , তোমাকে অফিস পাঠানোর জোগাড় তো আমাকে করতে হবে ।” হাসির অসহযোগকে পাত্তা না দিয়ে অতীন ব্যাঙগুলোকে ফুলঝাড়ু দিয়ে খোঁচা মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল , অফিস রওনা দেওয়ার আগে যে ক’টাকে খতম করা যায় ! শালাদের কি ব্রেণ আছে ? ফুলঝাড়ুর খোঁচা খেলেও উড়ে গিয়ে অন্য দেওয়ালে বসছে কিন্তু ঝাঁটার নাগালে নয় ! খাট , ড্রেসিং টেবিল , আলমারি , পড়ার টেবিল এসবের ফাঁক ফোকরে তো দৌড়ানোও যায় না ! আধঘন্টাটাক হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করার পর কোনোরকমে একটা মাত্র ব্যাঙকে মারতে সক্ষম হল সে ।
ঝাঁটা দিয়ে দরজার কাছে টেনে এনে বাঁ হাত দিয়ে তুলে প্রাণীটিকে ভালো করে লক্ষ করল অতীন । ব্যাঙ -ই ! তবে ছোট্ট সাইজের । চোখদুটো বেশ বড় বড় ! সামনের পা দুটো ছোট তবে পেছনের পা দুটো বেশ লম্বা । ছড়ালে দুপায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা চামড়া বিস্তার পেয়ে একটা ঝিল্লির মতন ডানা হয় বটে তবে মাঝখানটা তো ফাঁকা ! পাখির পাখনার মতন একটানা তো নয় ! এতে ওড়া যায় ! চারটে পায়ের ডগায় স্পঞ্জের মতন বাটি যা দিয়ে কোনো কিছুর গায়ে লেপ্টে থাকা যায় ।
কাজের মেয়েটি এসে ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময় ওটাকে ডাস্টবিনের অন্য আবর্জনার সঙ্গে ফেলে আসবে এরকম ভেবে অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করল সে ।

সকাল এগারোটা নাগাদ অতীনের মোবাইলে হাসির ফোন ! অফিসে কাজকম্ম করার সময়ে সিরিয়াস ব্যাপার ছাড়া ফোনাফুনি পছন্দ করে না অতীন-হাসি দুজনেই । তাই বেশ ঘাবড়ে গিয়েই কল রিসিভ করে অতীন । “কি হয়েছে ? বুবুন কোনো বিপদ ঘটিয়েছে নাকি ? তাড়াতাড়ি বলো !” হাসি বলে, ” না না অত সিরিয়াস কিছু নয় । তুমি কি এখন খুবই ব্যস্ত ? “
– তাড়াতাড়ি বলো তো কি ঘটেছে?
হাসি বলে, ” না না! বললাম না অত সিরিয়াস কিছু নয় ! শোনো তাহলে ! আমাদের বাতাসীকে তো তুমি জানো । দেমাকি। একদিন বাসন মাজতে মাজতে ‘ বিড়ি জ্বালাইলে’ গান ধরেছিল বলে তুমি ধমকেছিলে মনে আছে ? “
–ওঃ! মাইরি ! তোমাদের নিয়ে আর পারা হায় না ! সামারি করে বল !
– ও তো সেই থেকে পারতপক্ষে আমার সঙ্গে কোনো কথাই বলে না । ঘরে ঢুকে প্রথমে ওপরে ঝাড়পোঁছ করে নিচে বাসন মাজতে শুরু করে । কি কারণে জানি না , আমার মনে হয়েছিল ঘরের দরজা জানালা যে খোলা চলবে না সেটা ও জানে । মানে আমারই ভুল আর কি !আমি ওকে কিছুই বলি নি । মা বাথরুমে তাই মা -ও ওকে কিছু বলার সুযোগ পান নি ! মেয়েটা ওপরে কাজ করে l নিচে এসে বলল, ” তোমরা ওপরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে রেখেছিলে কেন ? বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছো নাকি ? ” আমি আঁতকে উঠে ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম , ও ওপরের সমস্ত দরজা জানালা খুলে কাজ করেছে! দৌড়ে ওপরে গিয়ে দেখি যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে ! আমাদের ঘরটাতে চার- পাঁচটা, মায়ের ঘরটাতেও দুটো , এমনকি রান্নাঘর আর বাথরুমের সামনের ফাঁকা জায়গাটার সিলিংয়েও একটা ঢুকে পড়েছে ! বাড়িতে ফিরে তো আমাকে উস্তুম কুস্তুম করে ছাড়বে ! তাই অসময়ে ফোন করলাম । ” প্রচন্ড রেগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বউকে গালাগালি দিতে গিয়ে থমকে যায় অতীন। লোকহাসি করে লাভ নেই । সে অফিসে বসে আছে । অনুচ্চ স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে , ” গর্দভ ! রান্নাবান্না বন্ধ করে ব্যাঙ মারো! আমি বাড়িতে গিয়ে একটাকেও যেন না দেখি !” ফোন কেটে দিল সে তারপর ।
বাড়িতে ফিরে শুধু হাসি নয় , বুবুন এবং মায়েরও ভয়ার্ত মুখ দেখে তার রাগ উবে যায় । প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে, ” একটাকেও মারতে পেরেছো কি ? “
হাসি গোমড়া মুখে জানায় , সে তিনটেকে মারতে পেরেছে সারা দুপুরের চেষ্টায় ।
” ঠিক আছে । দেখছি আমি। বুবুন , তুই নিচে তোর পড়ার ঘরে গিয়ে পড়তে বোস ! কাল সন্ধ্যে থেকে তোর পড়া হয় নি । ব্যাঙের জন্যে তো আর দিনের পর দিন পড়াশোনা বন্ধ করে বসে থাকা চলে না । ঠিক আছে , চা – ফা খেয়ে তারের জাল আর মিস্ত্রি খুঁজতে যাবো । নাঃ ! এভাবে তো বাস করা যায় না । ধূর! খবরের কাগজ , বই পত্তর , টিভি নেই , আড্ডা দিতে যাওয়া নেই , দিনরাত শুধু ব্যাঙ , ব্যাঙ , আর ব্যাঙ ! ছ্যাঃ ! ভাবা যায় ! নাঃ! বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাটেই চলে যেতে হবে দেখছি ! “অতীন ভেবেছিল , তার কথা শুনে হাসির মুখের কাঠিন্য উবে যাবে । তার বদলে তার নিরাসক্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল ,” তোমার চা করছি ।”
হাসি রান্নাঘরে ঢুকতেই কলিং বেল বেজে ওঠে । পাড়ার কোন মাল মজা দেখতে এল নাকি ? উঠে গিয়ে দরজা খুলে দাঁত বের করার মতন মনের অবস্থা নেই অতীনের। বুবুন তো আছেই ফাই ফরমাশ খাটার জন্যে । তাকেই অর্ডার দিল সে , “একটু ফাঁক করে আগে দেখে নিবি । পুরোটা খুলবি না ! ব্যাঙ ঢুকে পড়বে। ” খানিক পরেই বুবুন এসে ফিসফিস করে বলে , ” বাবা! ঠাম্মা তোমায় ‘ তুতুল ‘ বলে ডাকে তো ? ” অতীন অবাক ! হ্যাঁ ! তুই তো দিনরাতই শুনছিস ! কেন ? কি হোল ?”
— একটা ভিখিরি বা সন্নাসী টাইপের লোক ! দরজা ফাঁক করতেই বলে উঠল ,’তুই তুতুলের ব্যাটা তো ? কাকীকে গিয়ে বল গাঁ থেকে ল্যাটা ভোঁদু এসেছে !’ অতীন যেন হেঁচকি তুলে বলল, ” অ্যা ? সেকি !”
অতীনের মায়ের চোখেও একঝুড়ি বিস্ময় ঝুলে রইল !

।। দুই ।।

আমাদের গল্পটা তো এখান থেকেও শুরু হতে পারে !

একটা গুবরে পোকার খুবই শখ হয়েছিল বড় হবার । সে দিনরাত ঠাকুরের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতো এই বলে , ” ঠাকুর আমাকে বড় করে দাও ! আমাকে কতদিন এভাবে কষ্ট দেবে ঠাকুর ! ঠাকুর আমাকে বড় করে দাও ! ” ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে ঠাকুর একদিন তাকে ভোঁদড় বানিয়ে দিলেন ! পরে দেখা গেল সেও বড় হতে চায় । আবার ভোঁদড়ের ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত ঠাকুর এবার তাকে ভালুক বানিয়ে দিলেন । তবু ভালুকও আরও বড় হতে চায় ! এবার ভালুকের ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত ঠাকুর তাকে মানুষ বানিয়ে দিলেন ! ব্যস! ঠাকুর এবার নিশ্চিন্ত! মানুষ হবার পর সে আরও বড় হবার জন্যে আর ঘ্যান ঘ্যান করে না ! মানুষ আরও বড় হতে চায় না ।
ঠাকুরের গল্পের ‘বড় ‘ অর্থাৎ মহৎ না , বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সে যাতে রোজগারের টাকায় নিজের ও পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারে সেরকম ‘বড় ‘ হতে চেয়েছিল তুতুল । তার বাবা -মাও তাই-ই চেয়েছিলেন । তুতুলের বাবা ছিলেন মাঝারি মাপের চাষী ও ইস্কুল শিক্ষক । ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলানো যেত , তাই বলে ফেলে ছড়িয়ে খাওয়ার মানসিকতা শোভা পেত না এমন অর্থনৈতিক অবস্থানের মানুষ । একমাত্র পুত্রের মঙ্গল কামনার আশা আকাঙ্খার সোনালী ডিমে তা দিতে দিতে দিনাতিপাত করতেন ।
ছেলের মুখে ‘তুতুলের ‘ সাক্ষাৎপ্রার্থী এক আগন্তুক আগত, এই সংবাদ শোনামাত্র অতীনের শরীর থেকে ‘তুতুল ‘ নামক এক বালকের সত্তা নির্গত হয়ে জাগরুক হতে থাকল । তুতুল তার মাকে সঙ্গে নিয়ে এসে দরজা খোলে । পিছন পিছন হাসি আর বুবুনও আসে কৌতূহলে । দরজার ওপারে যে রোগা , লম্বা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে তার কাঁধে লম্বাটে এবং তাপ্পিমারা অথচ জিনিসপত্রে ঠাসা একটা কাপড়ের ব্যাগ । লোকটি অচেনা । তাদের কুঞ্চিত ভুরু পাত্তা না দিয়ে আগন্তুক বলে ওঠে , ” অ! তুই -ই তুতুল ? ম’টা গোঁফ , চুলে পাক ধরেছে! ই বাবা ! অকালে বুড়া হঁই গেলি ৱ্যা ! অ কাকী ! তবে তুমি দেখছি বিশেষ বদলাও নাই ! দাও , পায়ের ধুলা দাও !”
কাঁধের ভারী ঝোলাটি সিঁড়ির ধাপে নামিয়ে লোকটি মাকে প্রণাম করতে উদ্যত হয় । মা ‘থাক, থাক ‘ বলে পিছিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই আগন্তুক একরকম দ্রুতগতিতেই মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে করতেই বলে , ” উটি হব্যাক নাই কাকী! আমার দেশ গাঁয়ের শিক্ষা এটিই । ‘ মানুষ বুজে কইবে কথা , দ্যাবতা দেখে নুয়াবে মাথা !’ বলতে গেলে পেরাই দু -যুগ বাদে দ্যাখা কইরতে আলম আর গড় কইরব নাই ? উ শিক্ষা নাই আমার । মনে লিছে আমাকে চিনতে লারছ ! আমি ভোঁদু । জয়রামপুরের ল্যাটা ভোঁদু । চিনলে কি নাই চিনলে বল!” একগাল হেসে তাদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সে ।
খানিক আগের দুর্ভাবনা উবে গিয়ে মায়ের চোখে যেন খুশির ঝিলিক উঁকি মারতে শুরু করে । নাগরিক অভ্যাস জনিত অর্জিত সংশয় তাঁকে নির্দ্বিধ হতে বাধা দেয় বোধহয় ! ব্যাপারটা উপলব্ধি করে নিঃসংশয় হতে অতীন এগিয়ে আসে , ” তোমার নামটা কি বললে যেন ? “
– দুবার বলেছি । আর বলতে লারবো। খুব ক্যাদ্দানি মারচিস লয় ?
–এরকম বিদঘুটে নাম কেন ?
– ই বাবা ! তু কি সবঅই ভুলে গেছু নাকি ? ইটা ত আমাদের দেশ গাঁয়ের চল রে খ্যাপা ! তেলিপাড়ায় একজন ভোঁদু , কায়েত পাড়ায় আমি । ভিন্ন কিভাবে বুজা যাবেক ? আমি ল্যাটা, ক্যানে কিনা বাঁ হাতে সবোই করি ! লেখা তককো ! তাথেই ই নামে ডাকতো লোকে । আমাদের পাড়ায় বেঁটে শ্যাম আর বামুন পাড়ার ঢ্যাঙা শ্যামকেও ভুলে গেছু নাকি ? ই বাবা ! আমি বকাসকা লোক, আমি কিন্তুক কিছু ভুলি নাই কাকী ! “
অতীনের চোখে মুখে স্বস্তি নেমে আসে । লোকটা জাল নয় । তবু তার একটা খটকা দূর হচ্ছে না লোকটার চেহারা দেখে ! ল্যাটা ভোঁদুর বয়েস তো কম করে পঞ্চাশ হওয়া উচিত । তিরিশ বছরেরও বেশি তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল । এ লোকটার বয়েস তো কুড়িতেই থমকে আছে মনে হচ্ছে ! নাঃ! এ ল্যাটা ভোঁদু নয় । ওর ছেলে হতে পারে বড়জোর । অনেক ছেলেই তো হুবহু বাবার মতন দেখতে হয় । অতীন জেরা করার ভঙ্গিতে বলে , “তুমি জয়রামপুরে কি করতে ? আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে তোমার কিভাবে জানাশোনা ? মনে পড়ছে না । বলো তো দেখি ?” ল্যাটা ভোঁদু বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে । কাঁধের ভারী বোঝাটি অথবা তাপ্পি মারা ঢাউস কাপড়ের ব্যাগটি কাঁধে তুলতে তুলতে বলে ,” অ কাকী ! তুতুলের যা মতিগতি বুজচি তাথে দুয়ার থেকেই বিদায় লিতে হব্যাক । ঘরে ঢুকে টুকচেক জিরোতে দিবে কি নাই দিবে ? “
মা অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে বলে , ” ছি ছি বাবা ! ঘরে আয় ! ও বৌমা ! ভোঁদু আমাদের ঘরেরই লোক ।পরে বলছি সব ! আগে চা জলখাবার কিছু দাও ! হাসি শশব্যস্ত হয়ে ঘরের ভেতরে ঢোকার উপক্রম করতেই ভোঁদু বলে ওঠে , ” ইটিই আমাদের বৌমণি ! বাঃ ! কাকী ! তুমার বৌমাটি বেশ লক্ষীমন্ত গো! আর আহাহা ! এই সোনার চাঁদটি বুঝি তুমার লাতি ? বাঃ ! ত কাকী ! তুমার তুতুল ই বয়েসে যেমন খ্যাঙরা কাঠি আলুরদম মার্কা ছিল লাতিসায়েব তুমার সেরকম লয়গো ! গণেশ কাকা আজ যদি আজ শুয়ে না থাকতো তাহলে তুমার ষোলো আনা সুখ গো ! ” নিজের স্বগত সংলাপ ল্যাটা ভোঁদুর মুখে উচ্চারিত হতে শুনে মায়ের দুচোখের কোণা ভিজে ওঠে, চোখে আঁচল চাপা দিয়ে অবরুদ্ধ গলায় বলে ওঠে ,” আয় ভোঁদু ! ঘরে আয় !বৌমা ! প্রণাম করো । তোমার ভাসুর হয় ও । দাদুভাই ! জেঠুকে প্রণাম কর !
–আহাহা ! পেন্নাম করার দরকার নাই ! হেঁটে আইসচি । পায়ে ধূলা। কাকী ! কাকা কুন ঘরে ? লাঠি ধরে চান পায়খানা যেতে পারে ত এখনও ? চল কাকী ! তুমাদের দুজনকে গড় কইরব বলেই বত্রিশ বছর পার করে আজ এলম ইখেনে । “
মা করুণ মুখে জানায় , ” ঘরে নাইরে ভোঁদু ! তোর কাকা নার্সিংহোমে । “
ভোঁদু আর্তনাদ করে ওঠে , ” সেকি! ক্যানে ? কি হঁয়েছে ? “
মা কিছু বলতে গিয়ে ইতস্তত করে । বিপন্ন মুখে বলে , ” ওরে তুতুল ! ভোঁদুকে বুঝিয়ে বল । সবই বল ! ও তো ঘরের লোক । “
অতীন বোঝে ভোঁদুর যা ব্যাকগ্রাউন্ড তাতে ও ঘোড়ার ডিম বুঝবে । তাই বলে , ” আই সি ইউ মানে কাঁচের ঘরের ভিতর বাবাকে রাখা হয়েছে । সামনাসামনি দেখা করার কোনো উপায় নেই । দূর থেকে আমি আর মা গিয়ে একবার দেখে আসি । ডাক্তার, নার্সদের কাছে খোঁজ খবর নিই । চিন্তা নেই , বাবা আরো মাস দেড়েক বাদে সুস্থ হয়েই ফিরবে।
–তাহলেও দূর থেকেই একবার দেখব । কাল সকালে একবার লিয়ে যাবি ?
আগন্তুকের আগ্রহকে পাত্তা না দিয়ে আগে এ বাড়িতে তার গ্রহণযোগ্যতা পরখ করে নিতে চায় অতীন, বলে, ” সে নায় হবে । তার আগে তোমাকে যা জিজ্ঞেস করছি তার ঠিকঠাক জবাব দাও তো ? ছোটবেলায় তোমার সঙ্গে একবার মারামারি হয়েছিল । সত্যিই যদি তুমি ল্যাটা ভোঁদু হও , তোমার মনে থাকা উচিত কেন মারপিট হয়েছিল ! ভেবে বল , কি জন্যে মারপিট –”
ল্যাটা ভোঁদুকে যেন জোর করে কথা বোলানো হচ্ছে এমন মুখভঙ্গি করে বলল , ” তাহলে শুন ! কলেরা না কিসে জানি মা-বাবা সগ্গে গেলে গণেশকাকা আমাকে লিয়ে এলেক তোদের ঘরে । বৈঠকখানা ঘরটায় থাকতম । তু ত্যাখন কেলাস উয়ান, আমি ফাইব। গণেশ কাকা ত্যাখন তাগড়া জুয়ান। চাষে মোষের মতন খাটত । হঠাৎ একদিন হার্ট এটাক হোল মানুষটার । হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানি চলতে প্রাণে বাঁচল্যাক বঠে তবে বাঁদিকটা পঙ্গু । কাকীর মাথায় দুনিয়ার বোঝা । এইটের পরীক্ষায় আমি ফেল করলম । তুই ত্যাখন ফোর। ফাইব থেকে এইট তিন বছর তোদের ঘরে ছিলম । হঠাৎ একদিন উধাও হলম , কাকীর বোঝাটা একটু কমলো।
– তোমার জীবনী আমি শুনতে চাইছি না । আমি জিজ্ঞেস করছি মারপিটের কথা –
–খেলার মাঠে । উধাও হবার একবছর আগে । তুই ব্যাকে খেলছিলি । বল লিয়ে তুয়াকে কাটিয়ে ফাঁকা গোলকিপারের সামনে আমি । গোলে শট লিতে যাব , তুই দৌড়ে এসে পেছন থেকে ল্যাং মারলি ! পড়ে যাবার আগে গোলে শট লিলম বঠে তবে বারের উপর দিয়ে বল বেঁরাই গেল ! রাগের চোটে তোকে ঠাস করে এক চড় মারলম । তারপর তুই কাঁদতে কাঁদতে অনেক মেরেছিলি আমাকে , আমিও দু চার চড়…হুঁশ করি নাই কি তুই বাচ্চা ছেলা । এখন লজ্জা হয় । কুয়েতে থাকার সময় মাঝে মাঝে মনে পড়তো। খারাপ লাগতো । একদিন কান্নাও পেয়েছিল রে !
–কোথায় থাকার সময় ?
– কই ? অ ! না – কু -কুথাও কুথাও থাকার সময়ে –। ছাড়ান দে ! আর কি জিগাবি বল ! কাকাকে গড় করেই আমি বিদায় লুব । দূর থেকেই কাচের দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আসবো কাল । কাকা ঘরকে এলে আমার কথা বলবে কাকী ! এখনও দিন সাতেক আমি ইন্ডিয়ায় আছি । সামনের বছর আবার আসবো কাকার কাছে ।
মা এতক্ষণে গর্জন করে ওঠে, ” ওঃ! বকিয়ে বকিয়ে ছেলেটার মুখের ফেনা বার করে দিলি ! ভোঁদু চ ! উপরে আমার ঘরে বসবি চ ! “
হাসি চায়ের কাপ হাতে ঢুকতে ঢুকতে বলে , ” ধন্যি আপনার ছেলে মা ! একটা সরল সাধাসিধে ক্ষুধার্ত মানুষকে বকিয়ে বকিয়ে আধমরা করে দিল । ছিঃ ! দাদা! আপনি আর একটা কথাও বলবেন না । চা খান , চানে ঢুকুন । বাথরুমে গরম জলের সুইচ অন করেছি , চা খেতে খেতে জল রেডি হয়ে যাবে । কথা বলতেই যদি ইচ্ছা হয় খালি মায়ের সঙ্গেই কথা বলবেন । “
ভোঁদু একচামচ চা খেয়ে তৃপ্তির আওয়াজ তুলে বলে , ” আঃ! বৌমা ! তুমার চায়ের হাতটি বড় উস্তাদের মতন ফাটাফাটি গো ! দাঁড়াও বাবা ! তুতুলের সন্দ দূর করি আগে । নাইলে রাতটা আমার শান্তিতে কাটব্যাক নাই । বল , আর কি জিগাবি ? “
অতীন বলে , ” তোমার চেহারা নিয়ে খটকাটা আমার যাচ্ছে না ! বলো তো তোমার বয়েস কত ? আমার ? বাবা মায়েরও বয়েস আন্দাজ করে বলা উচিত । বল !”
” জয়রামপুরের প্রাইমারি ইস্কুলের খাতায় এখনো কি আমার বয়েসের কুনো রেকর্ড থাকব্যাক ? আনজাদে বলতে পারি বারো চোদ্দ বছর বয়েসে তোদের ঘর থেকে পলাইছি । সে হিসাবে আমার বয়েস এখন চুয়াল্লিশ–ছেচল্লিশ হব্যাক । পঞ্চাশ হতেও পারে। তোর বছর চল্লিশ , কাকীর ষাট হব্যাক । ঠিক বললম কি ?
–ঠিকই আছে । তোমার বয়সটা তাহলে থমকে আছে কি করে ?
অধৈর্য হয়ে হাসি বলল , ” ওঃ ! দোহাই তোমাকে ! দাদা , চানে ঢুকুন তো !”
ভোঁদু অথবা আগন্তুক হাসে , বলে, ” শুন খ্যাপা ! চা -টি কতক্ষণে শেষ করলম ? পাঁচ মিনিট , লয় ? আবার, আধঘন্টা ধরেও তো খাওয়া যায় ! বঠে কিনা ? যে খাচ্ছে তার মর্জিমাফিক ত শেষ হব্যাক । বঠে ত ? জীবনটাও তেমনি ! তাড়াতাড়ি খরচা করলে তাড়াতাড়ি বুড়া হবি ! বুইলি কিছু ? হঃ হঃ হঃ !
– কিছুই বুঝলাম না ।
– বুঝাব । কাল বা পরশু । ঘরটি বেশ কাকী ! চমৎকার ! তা ঘরগুলির দরজা – জানালা সব বনদো ক্যানে ? দমচাপা , গুমোট ! ই কি বেবস্তা গো ! তুমরা গাঁয়ের লোক , খুলা মেলা থাকা ওইভ্যাস , ইখানে ইভাবে থাকো কি করে ?
মা কিছু বলতে গিয়ে সামলে নেয় । বলে , ” আগে চা খা । চান কর। ধীরে সুস্থে সব বলব । বাথরুম বা ঘরের কোনো জানালা খুলবি না। “
–ক্যানে গো ?
মা অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। গাঁয়ের লোকের কাছে কথা তো খালি কইবার জন্যে , থামবার জন্যে তো নয় ! কথা গড়িয়েই চলে। অনেক পুরনো শিশির ভেজা গল্পের পর ল্যাটা ভোঁদু চানে গেল । হাসি খোঁটা দিল , ” মা ! আপনার ছেলে বুঝতে পেরেছে তো উনি জাল লোক নন ? ” মা বলল , ” বুঝতে না পারে তো বয়েই গেল ! তোমার শ্বশুরমশাই শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ার পরও ভোঁদুর সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করিনি কখনো । তবুও ও উধাও হয়ে গেসল । মনে মনে গাঁয়ের সবার কাছে , নিজের কাছেও অপরাধী ছিলামই । আজ জানতে পারলাম , কেন গেসল ! নাড়ির টান না হোক, ভেতরের টানটা যাবে কোথায় ! আমি বেঁচে থাকতে থাকতে যে ফিরে এসেছে এটাই যথেষ্ট । ওকে আমি ছাড়বো না !”
অতীন আঁতকে ওঠে, ” সংসারে একটা বাড়তি লোক পুষতে হবে নাকি? অসম্ভব !”
মা গোমড়া মুখে বলে , ” অ ! আমি বা তোর বাবা তাহলে এ সংসারে বাড়তি লোক ? ” অতীন তেতে উঠে মাথার চুল খামচে ধরে বলে , ” মূর্খদের প্রশ্নের জবাব আমি দিই না। ” মা তাতে পাত্তা না দিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার ঢংয়ে বলে , ” ঠিক আছে । আমি আধপেটা খাবো । ভোঁদু আধপেটা খাবে । “
হাসি বলে ওঠে , ” না মা ! উনি ভরপেটই খাবেন। আমিও আধপেটা খাবো । দুজনের আধপেটা খাবারে ওঁর ভরপেট হবে না ? ” হাসির চোখমুখ কঠিন, দু চোখে আগুন ।
পারিবারিক সিদ্ধান্ত যখন অর্ধাহার , তখন কনিষ্ঠতম সদস্য বুবুন তাতে সমর্থন জানাতে ভীত নয় । প্রচন্ড তেতে উঠে বুবুন বলল , ” আমিও হাফ মিল খাবো । বাবা ওয়ান এন্ড হাফ মিল একা খাবে । “
অতীন হেসে ফ্যালে, বলে, ” ঠিক আছে বাবা , ঠিক আছে ! তোমরা বোকার মতো কেন খেয়াল করছো না একটা চল্লিশ ক্রশ করা লোকের চেহারা কুড়ি , পঁচিশে থমকে থাকতে পারে না। “
মা দমস্যার সমাধান করে দেয় এক মুহূর্তে । ” এতগুলো বছর ধরে ও কোথায় ছিল , কি করছিল, ধীরে সুস্থে জানতে পারবো আমরা। প্রাচীনকালে মুনি ঋষিরা পাঁচশো বছর বাঁচতেন । কি একটা যোগ আছে , কুম্ভক না কি যেন , তাতে বয়েসেটাকে থামিয়ে রাখা যায় । সেদিন একটা সিনেমা টিভিতে দিয়েছিল , তোরাই জোর করে দেখালি, সবাই মিলে বসে দেখলাম না ? সেই যে রে ! একটা বয়েসের পরে লোকটার চেহারা সেই বাচ্চা ছেলের মতোই রয়ে গেছে ! মনে পড়ছে ? তোরা বললি কি একটা রোগ , মনে পড়ছে ? তাহলে ? “
অতীন হতাশ হয়ে কিছু বলতে যাবার আগেই বাথরুমের দরজা সামান্য ফাঁক করে ভোঁদু বলে , “বৌমণি! বেশ খানিকটা
ছেঁড়া গামছা বা ছেঁড়া কাপড় জোগাড় করেন ত ! কুইক !”
সবাই খুবই অবাক হয় ! মা বলে,”তোকে তো চান করার জন্যে ভালো গামছা দেওয়া হোল ! ছেঁড়া গামছা কি করবি ?”
– একটা ফ্লাইং ফ্রগ দেওয়ালে লেপ্টে আছে । ধরবো উটাকে ।
হাসি সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে ছেঁড়া কাপড় আনতে যায় । সবাই খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়ে একথা ভেবে যে তাদের গেরস্ত জীবনে এ এক বেশ উটকো উৎপাত এসে হাজির হোল বাবা ! যখন তখন রাস্তা অবরোধ বা মিছিলের মতন । শান্তিতে টিকতে দেবে না ! হাসির এনে দেওয়া কাপড় হাতে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা মারে অতীন । একটা হাত বেরিয়ে এসে কাপড়টা নেয় । একটু পরেই আবার ভোঁদুর মাথাটি উঁকি মারে , বলে , ” ইবার একটি মুখ বনদো কাঁচের বোতল , চওড়া , পোস্কার- পোচ্ছন্ন দ্যান ত বৌমণি ! ছোট লয় , মাঝারি। “
অতীন রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করে , ” কেন ? “
– আট দশটা ফ্লাইং ফ্রগ আমার লাগব্যাক । জমাবো ।
দরজা বন্ধ হয়ে যায় । সবাই হতভম্ব ! অতীন ক্রুদ্ধ চোখেমুখে তার পরিবারের বাকি সদস্যদের দিকে তাকায় । যেন বলতে চায় , ” জেদ করে ঘরে পাগল পুষতে চাইছিলে না ? বেশ ! ঠ্যালা সামলাও এবার !”

।। তিন ।।

# আমাদের আজকের গল্পটির শেষের শুরু এভাবেই হবে কি? #

আধুনিক সমাজ সভ্যতার প্রসারণশীল ধর্মের শর্তানুসারে বন উধাও হয়েছে যায় , নদীর মুখে কষে লাগাম পরানো হয় , বিশুদ্ধ প্রকৃতিও ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে নগরায়ণের দাসত্ব মেনে নেয় ! এই অবস্থায় শিকড়হীন মানুষগুলিকে নির্বাসনে যেতেই হয় । ঝাঁ চকচকে নাগরিক পরিমন্ডলে ভোঁদুর মতন মানুষেরা অবাঞ্ছিত। এইসব ভোঁদুদের জন্যে সহানুভূতি আছেই অতীনের তবে ভোঁদুর ছদ্মবেশে ঘরে কোনো আপদ ঢুকে পড়বে , এতটা কাছাখোলা অতীন নয় !
আগন্তুক , যে এখন ভোঁদু হিসাবে গৃহীত হতে চলেছে , বাথরুম থেকে বেরোল । আদুল গা , নিম্নাঙ্গে একটি গামছা বাঁ হাতে একটি মানিব্যাগ , ডান হাতে একটি মুখবন্ধ চওড়া বোতল যার ভেতরে উবু হয়ে বসে থাকা নির্বিকার চারটি ব্যাঙ! গৃহস্থ চারজনের বিস্ফারিত কিংবা ভয়ার্ত চাহনিকে আমল না দিয়ে ভোঁদু বলল , “কাকী ! নোংরা জামা প্যান্টটা চানঘরের এক কোণায় গুটিয়ে রেখে দিলম । বৌমা ! ঘিন্না কোরো নি গ ! কাল সকালে কেচে লুব। ত কাকী ! একটা পোস্কার পোচ্ছন্ন ডেরেস পরে লিই ! কুথায় পরবো সিটা দেখাই দাও আর তার আগে ই ব্যাঙগুলান কুথায় রাখা যায় ! ই টেবুলটার উপর রাখি ন কি ? টেবিলের দিকে ভোঁদু অগ্রসর হতেই অতীনের মা আর স্ত্রী নাক মুখ কুঁচকে যেন আর্তনাদ করে উঠল ,” না– না ! ওটা খাওয়ার জায়গা ! ” থমকল ভোঁদু , ” অ ! তাহলে এই সোফাটার নিচে থাকুক একটু । আমি ডেরেস পাল্টিয়ে এক্ষুনি আসছি । কুন ঘরে যাব কাকী ? বল ! ” মা কিছু বলার আগেই অতীন গর্জন করে , “তোমার মতলবখানা কি বলো তো ? তুমি কি করতে চাও ?”
ভোঁদু চোখ কপালে তুলে বলে , ” ই বাবা ! যার হানায় তুয়ার পুরা ফেমিলির ভুরুতে ভাঁজ , মেজাজ টংয়ে চড়ে আছে , সিটাকে টুকচেক ইস্টাডি কইরব নাই ? ” অতীন শসানির ভঙ্গিতে বলে , ” শোন ! বেশি ওস্তাদি করতে এসো না । তুমি যদি সত্যি সত্যিই ল্যাটা ভোঁদু হও , তোমার জানা উচিত , তোমার বিদ্যার দৌড় আমার জানা আছে । তোমাকে আমি –”
হাসি দুজনের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন । সাত তাড়াতাড়ি বলে ওঠে , “ছাড়ো তো ! ওসব পরে হবে । মানুষটা ভিজে গামছা পরে দাঁড়িয়ে আছে । বুবুন ! ওপরে তোর পড়ার ঘরের পাশের ঘরটায় জেঠুকে নিয়ে যা! দাদার ব্যাগটা –”
ভোঁদু বলে , ” উটা আমিই নিজে লিয়ে যাচ্ছি । রেতে কি উখানেই থাকব ? তাইলে ব্যাগটা লিয়ে আর নিচে নামবো নাই । “
–হ্যাঁ ! আপনি আজ থেকে ওখানেই থাকবেন ।
অতীন এই ঘোষণায় রীতিমতো অবাক এবং বিরক্তও হয় ! তার কোনো মত না নিয়ে হাসি এরকম একতরফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে কোন আক্কেলে ? এ তো কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে কোনো মুখ্যমন্ত্রীর নতুন প্রকল্প ঘোষণা করে দেওয়ার মতন ব্যাপার ! বাঁকা হাসি হেসে অতীন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে , ” আজ থেকে ? ” উত্তর দিতে গিয়ে হাসি বিড়ম্বনায় পড়ে গিয়েছে দেখে তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে ভোঁদুই । মুচকি হেসে বলে , “বৌমণি ! দুর্ভাবনা কোরো নি গো ! আমি নদীর শ্যাওলা । একদিনের বেশি কুথাও থাকতে লারি । চল ভাইপো! ঘরটা একবার আমাকে দেখাঁই দাও! হাতের বোতলটি সোফার নিচে রেখে ঢাউস কাপড়ের ব্যাগটি কাঁধে তোলে ল্যাটা ভোঁদু । বসার কাম খাবার ঘর থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি উঠেছে গেছে । ততক্ষণে সিঁড়ির দু ধাপ ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা বুবুন আহ্লাদিত ভঙ্গিতে ডাকে , ” এস জেঠু !”
ওরা ওপরে উঠে গেলে রাগে অগ্নিশর্মা অতীন বলে , ” তাহলে তোমরা ডিসিশন নিয়েই ফেলেছ ওই অজানা অচেনা লোকটাকে নিয়েই আমাকে থাকতে হবে ? “
মা যেন আকাশ থেকে পড়ে ! চোখ কপালে তুলে বলে , ” অজানা অচেনা কি বলছিস ! ও তো ভোঁদুই ! আমি বেঁচে থাকতে আর কোথায় যাবে ! তিনকুলে ওর আর কে আছে ! অবশ্য এর মাঝে বিয়ে থা করে কোথাও সংসার পেতেছে কিনা জানি না । যেভাবে বেচারিকে জেরা করতে লেগেছিস তাতে সেসব জিজ্ঞাসা করার ফুরসৎ পাচ্ছি কই ? নিচে আসুক । আমি ছাড়া ওর আর কে –”
বিরক্ত অতীন ঝাঁঝিয়েই মাকে বলে ওঠে , ” ওঃ! বেশ ! মানলাম , ও সেই ভোঁদুই । এতগুলো বছর ধরে ও কি ধান্দা করছিল , কোনো ডাকাত দলে বা কোনো উগ্রপন্থী দলে ছিল কিনা , আজ বা কাল রাতে ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে চম্পট দেবে কিনা , তাতে কোনো গ্যারান্টি আছে ? “
মা গোমড়া মুখে বলে , ” তা অবশ্য নেই । সবই সম্ভব। পেটের ছেলেই তো বাবা মাকে ফেলে আলাদা সংসার পেতে সুখেই থাকে , দেখছি কত !”
–তোমাদের মুশকিলটা কি জানো ? টিভিতে সিরিয়াল ছাড়া খবর টবর গুলোও দেখ না । বাড়িতে খবরের কাগজটা আসে সেটাও পাতা উল্টে দেখলে না একদিনও !ছোট্ট একটা গন্ডির মধ্যে জীবনটা কাটিয়ে দিলে ! কত রকমের প্রতারণা , চুরির নিত্য নতুন কায়দা বেরোচ্ছে কিচ্ছু জানলে না ! পেটের ছেলে ঘুমন্ত মায়ের, দাদার গলার নলি ফাঁক করে দিয়ে সর্বস্ব নিয়ে ভেগেছে এমন নজিরও আছে ! থাক ! তোমাদের সঙ্গে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট ! তোমরা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে ঘুমোবে । আমরাও ! ব্যালকনি যাবার দরজা আর নীচের দুটো দরজায় আমি ভেতর থেকে তালা মেরে ঘুমোতে যাবো । হাসি! চারখানা ভারী তালা লাগবে। বাড়িতে ক ‘টা পাও খুঁজে নিয়ে এস ! না পেলে আমি কিনে আনছি । হাসি বলে , “ঠিক আছে । চুপ করো ! বুবুন নামছে ! কি রে ! জেঠু নামবে না ?”
–আসছে । জেঠু বলছিল , ‘দিনে রাতে সবসময় জানালা দরজা বন্ধ রাখলে প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা হবে কি করে ? ‘ আমি বললাম,’প্রকৃতি তো অ্যাবসেন্ট করে না ! তাই স্কুলে গেলেই মেলামেশা হবে ।’ বলতে জেঠু হাসল ।
বুবুনের কথায় স্বস্তির বাতাস বয়ে গেলেও অতীন নির্বিকার । চিবিয়ে চিবিয়েই বলল , ” হুঁ হুঁ বাবা ! ব্যাঙের উৎপাত যদি বন্ধ হয়েও যায় , তাহলেও সন্ধ্যে সাতটার পর থেকে এ বাড়ির সমস্ত প্রস্থানপথ বন্ধ !”
বুবুন বলে , “মা ! প্রস্থান কি ?”
–ওটা বড়দের কথা সোনা ! যাও , পড়ো অথবা টিভি দ্যাখো গিয়ে ।
কিন্তু সোফার নিচে বোতলবদ্ধ প্রাণীগুলির চাইতে টিভি দেখার প্রলোভনও তুচ্ছ বুবুনের কাছে । বোধহয় কিছু পূর্বাভাস ছিল , তাই সতৃষ্ণ নয়নে সোফার নিচে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ।
ভোঁদু নামল । অঙ্গে পাজামা আর ফতুয়া , হাতে গুটানো গামছা । নামতে নামতেই বলল , ” ব্যালকনি যাবার দরজা ত খুলা বারণ , ঘরের ভিতরে তার ফারও কুথাও নাই , গামছা কুথায় শুকাতে দুব বল দেখি বৌমণি !”
হাসি এগিয়ে গিয়ে গামছা নিল হাসিমুখে, বলল, ” দিন দাদা ! আমি বাইরে গিয়ে মেলে আসছি । একটা তোয়ালে দেব আপনাকে মুখটুখ মোছার জন্যে । হাওয়াতে কাল সকাল নাগাদ গামছাটা শুকিয়ে যাবে । ” হাসি বেরোতে উদ্যত হলে অতীন সতর্ক করে , “দরজা সামান্য ফাঁক করে সঙ্গে সঙ্গে ভেজিয়ে দাও । মনে আছে তো ?”
মা বলল , ” সোফায় বোস ভোঁদু ! অনেক কথা জানার আছে । বৌমা ফিরে এসে চা বানাচ্ছে । তারপর বল , বিয়ে – থা করেছিস ? “
ভোঁদু বলল , ” দাঁড়াও কাকী ! তুমাকে, কাকাকে একবার চোখের দেখা দেখব বলে আর সব কথা বলবার লেগেই ইখেনে আইছি । তোর আগে আমার ই ভাইপোকে কথা দিইছি , ব্যাঙটা লেড়ে চেড়ে উয়াকে দেখাবো । তুমিও বোস চুপ করে পাঁচ মিনিট !, ” বলতে বলতেই সোফার নিচ থেকে বোতল বের করে ভোঁদু । ততক্ষণে বুবুনও এসে তার পাশে বসে পড়ে । ভোঁদু ডানহাতে বোতলটি নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে । চারটি ব্যাঙ বোতলের তলায় গা ঘেঁসাঘেঁসি করে উবু হয়ে বসে বড় বড় চোখে পরিস্থিতিটা আঁচ করার চেষ্টা করছিল বোধহয় ! মাস্টারমশাইয়ের ভঙ্গিতে ভোঁদু বুবুনকে বলে , “দ্যাখো ভাইপো ! ইগুলানকে বাংলায় বলে উড়ুক্কু ব্যাঙ , ইংরেজিতে ফ্লাইং ফ্রগ । তেবে বিজ্ঞানীরা মানে যিনারা ওই জীবজন্তু লিয়ে গবেষণা করেন তারা ইয়াকে বলেন , ‘ৱ্যাকোফেরাস ম্যালা ব্যারিকাস ‘। বুইলে কিছু ? “
বুবুন সবেগে দুপাশে মাথা নাড়ে । ভোঁদু পরিতৃপ্তির হাসি হাসে , ” হঃ হঃ হঃ ! আমিও বুঝি নাই কিছু । তবে ইটা জানি পত্যেকটি পেরানীরই ইরকম কিম্ভুত নাম আছে । তুমি এখন বসে বসে মুখস্ত কর ! কি জ্বালা বাবা ! যেমন ধর কিনা – মানুষ। মানুষকেও ইয়ারা কি নাম দিইছে জানো কি ভাইপো ?
– হিউম্যান বিয়িং ।
– উটা ত ইংরেজি হল । বিজ্ঞান বলে ,’ হোমো স্যাপিয়েন্স ‘। আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ , উসব বুঝি নাই কিছু , মুখস্থ করে লিইছি । “
অতীন বড় বড় চোখে হাঁ করে ফেলেছিল বিস্ময়ের ধাক্কায় ! এবার গর্জন করে উঠল , ” দেখেছ মা ! আমার সন্দেহ ঠিক ! এ ব্যাটা ভোঁদুর ভেক ধরে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছে ! এই ! তুমি কে? কি ধান্দায় আমাদের বাড়িতে ঢুকেছো ? ধরা পড়ে গেছ ! এবার খোলসা করো তো বাপু ! “
অতীনের উগ্রমূর্তি এবং ভোঁদুর হতবাক চাহনির মাঝে নিঃশব্দে চায়ের ট্রে হাতে এসে দাঁড়ায় হাসি । সোফার সেন্টার টেবিলে ট্রে টি নামিয়ে একটি করে কাপ তিনজনের হাতে তুলে দেয় নিঃশব্দেই । সম্ভবত ভোঁদুর বাকরীতির সঙ্গে এইমাত্র উচ্চারিত বৈজ্ঞানিক পরিভাষাগুলি সাযুজ্যহীন বলেই সে স্বামীর সন্দেহকে অমূলক ভাবতে পারছে না আর । মন চাইছিল ভোঁদুদা এমন কিছু অখণ্ডণীয় প্রমাণ দিক যাতে করে অতীনের সন্দেহ মিথ্যা প্রমাণিত হয় । নিজের চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে সে নিঃশব্দেই তার হতবাক শাশুড়ির পাশে এসে বসে পড়ল ।
অতীনকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার ভঙ্গিতে ভোঁদু বলে উঠল , “শুন খ্যাপা ! আমি গাছতলায়,জাহাজের খোলে , বিদেশ বিভূঁয়ে হোটেলের বারান্দায় , থানার লকআপে রাত কাটানো মানুষ । টুকচেক বাদে আমি ইখেন থেকে বিদায় লুব । তার আগে ই বাচ্চা ছেলেটার সঙ্গে ই ব্যাঙের চ্যাপ্টারটা শেষ করে লিই ! উয়ার শখ একটা ব্যাঙ উ নিজের হাতে ধরব্যাক একবার । হাতের বোতলটি বাড়িয়ে ভোঁদু অথবা আগন্তুক বলে ,” ধর ভাইপো ! দু হাতে ধর !”
বুবুন মুখে লজ্জা মাখানো হাসি মিশিয়ে হাত দুটি নিজের কোলে জড়ো করে রাখে । ভোঁদু হাসতে হাসতে বলে , ” ধরছ নাই ক্যানে ? ঘিন্না লাগছে কি ? “
বুবুন ঘাড় নেড়ে তা মানতে না চাইলে ভোঁদু জানতে চায় , ” তাইলে কি ? ভয় ? “
বুবুন ঘাড় নেড়ে বোঝায় , তাও না । ভোঁদু হাসিমুখেই বলে , ” তাইলে আঙুল বাড়িয়ে বতলটাকে একবার ছুঁয়ে দাও ত দেখি !”
বুবুনের দ্বিধাগ্রস্ত আঙুল বোতলের গায়ে এসে ঠেকে যায় । ভোঁদু তখন বলে , ” দ্যাখো ভাইপো ! ব্যাঙটাকে ই অবস্থায় ছুঁতে চাইলেও ছুঁবার উপায় নাই ! ক্যানে কি না , কাঁচের আড়াল । বঠে ? কি নাই বঠে ? তেমনই আমাদের মনের ভিতরেও এমন অনেক আড়াল আছে বাপ ! যেমন , অশিক্ষের আড়াল , অজ্ঞানের আড়াল কিংবা অহংকারের আড়াল । এই আড়ালগুলির জন্যে অনেক কিছুকেই ছুঁয়া যায় না বাপ ! তুমি বাবা ইটা মনে রাখবে । হিদয়ে কুনু আড়াল তোয়ের কোরো নি ! লতুন জিনিসটিকে আগে লেড়ে চেড়ে দেখে লাও , তারপর হয় ছুঁড়ে ফেলে দাও , লয়ত ধুয়ে মুছে পকেটে ঢুকাও ! লয় কি ? “
বুবুন ঘাড় নেড়েই জানায় ,কথাগুলি তার মনঃপুত হয়েছে । তার ঠাকুমা মুগ্ধ চোখে মুখে বলে , ” বাবাঃ! ভোঁদু ! তুই যে আমার গুরুদেবের মতন কথা বলছিস রে ! তুই কি করে এতো জ্ঞানী পন্ডিত হলি ? কথাও গিয়ে আবার পড়াশোনা শিখেছিলি নাকি ? হাসির চোখেমুখেও স্বস্তির ছায়া । সে বলে, ” সত্যিই কি দারুণ শেখানো ! মুখোমুখি বসে দাদার কথাগুলি শুনি একটু মা ? রাতের রান্না না হয় একটু দেরিই হবে ! কাল তো বুবুনের ছুটি ! “
ভোঁদু সহাস্যে বলে , ” বেশি টাইম লাগবে নি ! শটে বলে দিচ্ছি । জ্ঞানের কথা বলছিলে কাকী! শুখা জ্ঞানে কি হব্যাক গো ! ছোটবেলায় দেখতম, কাঁসার বাসনগুলি তুমি ডেলি অনেকক্ষণ ধরে ঘষে ঘষে মাজতে । মনে পড়ছে কি ? তবেই না চকচক করতো ! ফেলে রাখলেই ময়লায় কালো ! বি এ , এম এ পাশ করলেই কি সে জ্ঞানী হয় ? তাইলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বা রবীন্দ্রনাথ কি পাশ ? হঃ হঃ হঃ! কুয়েত ইউনিভার্সিটির এক পফেসর আমাকে কিছু বইপত্র পড়াইছেন । ” বুবুনকে বাদ দিয়ে সবাই চমকে ওঠে ! মা বলে , ” কোথাকার ? “ভোঁদু উত্তর দেয় , ” ওঃ ! বকতে বকতে মুখে ফেনা উঠে যাবেক মনে হচ্ছে কাকী ! পরে সব গুছিয়ে বলব তুমাকে । টুকচা শুনে লাও , তুমাদের ঘর থেকে পালিয়ে ইদিক উদিকে ভাসতে ভাসতে একদিন বোম্বে চলে গেলম । শিখেনেও ইধার উধার ঘুরতে ঘুরতে কুথাও কিছু সুবিধা করতে না পেরে শেষে বাইধ্য হয়ে জাহাজের খালাসির চাগরি লিলম । “
– ওঃ! কি মরণদশা তোর ! জাহাজের খালাসি !
– শুন আগে ! জাহাজে খাটালি বেদম , তাও দিনরাত জলের উপর । ভালো লাগে কি ? মাসের পর মাস ধরে ভাসতে ভাসতে কুনু বন্দরে জাহাজ পৌঁচালে সাত দশ দিন মাটির উপর হাঁটাচলার আরাম জুটে । পালাবার ফিকির খুঁজছিলমই । তক্কে তক্কে থাকা যাকে বলে । একবার কুয়েত বন্দরে নেমে পগার পার হঁই গেলম ।
– মানে ?
– মালিক কখনও পালাবার পারমিশন দেয় কি ? তাকেও ত কইফত দিতে হব্যাক লয়ত নতুন খালাসি খুঁজতে হব্যাক । কুয়েতের খালাসির রেট কি হামদের মতন সস্তা নাকি ? সব খুলে বলতে গেলে রাত কাবার হঁয়ে যাব্যাক কাকী , অনেক বিত্তান্ত ! বেশ ক’দিন ইখেনে উখেনে ঘুরে বুলবার সময় কুয়েতের পুলুশ গেপতার করলেক একদিন । দু রাত হাজত বাস করবার পর জামিনে খালাসও পেলম । জজসাহেবকে কাঁদতে কাঁদতেই হিন্দিতে বুঝালম জাহাজে কি কি কষ্ট করতে হোত ! হাঁই দ্যাখ ! আবার মহাভারত ফাঁদা হঁয়ে যাচ্ছে , ইদিকে বৌমণিকে বলেছি , শটে মেরে লুব—শেষ তককো কুয়েতেরই একটা ফাইব ইস্টার হোটেলে বাসন ধুয়া আর টেবিল মুছার কাজ পেলম পেটভাতায় । ওই হোটেলেই এক পোফেসর ডিনার খেতে আসতেন ডেলি। একদিন উনার ঘরেই রান্নার কাজে লেগে গেলম । উনিই আমাকে যত্ন করে ইংরেজি লেখা পড়া শিখালেন। আমার স্যারের বউ মারা গেছে আমি কাজে ঢুকবার আগেই , ছেলেপুলেও নাই । উনি আমাকে খুবই ভালোবাসেন।
–অ! তা আবার কি তার কাছে ফিরে যাবার মতলব আছে তোর ?
– শুনে লাও শেষ তক্কো । উনার চেষ্টায় আমি এখন কুয়েতের সিটিজেন। ত , বিনা পয়সায় উনি আমাকে খাটাবেন নাই সে কথা পথম থেকেই বলে আসছেন , আমি কান করতম নাই । গেল বছর উনার বাইপাস অপারেশন হোল , আর উনার শরীরটাও ভেঙে গেল গ কাকী ! জ্বর , কাশি লেগেই আছে । ইবার উনি দিল্লির শ্রীরাম কলেজে লেকচার দিবার ডাক পেলেন , আমাকে লিয়ে এলেন । ন দিন আগে উনার সঙ্গে দিল্লিতে নেমেছি। দিল্লিরএকটা ব্যাঙ্কে নতুন পাশবই হল আমার নামে । কুয়েতের ব্যাংক থেকে টাকা টেনেসফার –
মা বিরক্তির সঙ্গে বলে , “লোকের ঘরে চাকরগিরি করার মাইনের টাকার গল্প আমি শুনতে চাই না । তুই তাহলে আবার চলে যাবি ? “
– আমি যে ইদেশের লোক তার কুনু পমাণ ত নাই কিছু ! তুতুল যেদি এখন দু একবার পঞ্চায়েত অপিস, ডিএম অপিস দৌড়াদৌড়ি করে কাগজগুলো বার করে তবেই হয় ! কাল সন্ধ্যের রাজধানীর টিকিট কেটে আমার পকেটেই রাখা আছে। আমার সায়েব এখনও তিন দিন দিল্লিতেই আছেন । হয় আমি কাল দিল্লি চলে যাবো লয়ত উনাকে কাল ফোন করে বলে দুব কি,’থেকেই যাচ্ছি , তুতুল কথা দিইছে আমার জন্যে ঘুরাঘুরি করে কাগজ বার করবেক ।’ কাল সকালে কাকাকে দেখে লিয়েই আমি যাবো কাকী ! তুমার আর কিছু জানার আছে কি ? বল !
– বিয়ে থা কিছু করিস নি এখনও ?
মুচকি হাসে ভোঁদু , বলে, ” কাকী গো ! শ্মশান আর শুখা লোকের সঙ্গী কেউ হয় নাই । উয়ারা একাই থাকে !” মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ,”যাক গে – ভগবানের দয়ায় তোর চেহারা দেখে বয়েস বোঝার উপায় নেই ! তাহলে দেখি সেরকম কাউকে পাই কি না , তবে তার আগে তোর রোজগারের কোনো একটা উপায় –”
কিন্তু সিন্দেহপিশাচ অতীন অত সহজে মেনে নেবার পাত্র নয় , সে দুনিয়া দেখেছে , সে তার মা বা স্ত্রীর মতন অন্ত:পুরবাসিনী নয় , কত ধানে কত চাল সে বোঝে , বোঝাতেও পারে । বেশ ঝাঁঝিয়েই মাকে থামায় সে , ” মা থামো তো ! কিছু জানো বোঝো না ! আষাঢ়ে গপ্পোটি ও বেশ ভালোই ফেঁদেছে ! তা চাঁদু ! এই এতগুলি বছর ধরে তুমি তো হিন্দি আর ইংরেজি ছাড়া কোনো ভাষায় কথা বলো নি! চর্চার অভাবে আমিই বাঁকুড়ার ডায়ালেক্ট ভুলে গেছি প্রায় , তুমি এমন অবলীলায় ডায়ালেক্ট আওড়াচ্ছ কি করে চাঁদু ? “
এতক্ষণ ধরে নীরব শ্রোতার ভূমিকায় থেকে থেকে ক্লান্ত, বিরক্ত , বুবুন এবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে । সোফা থেকে উঠে দ্রুত পায়ে ঘরের মেঝেতে এসে তার বাবার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে । আঙুল উঁচিয়ে বলে , ” ওঃ ! আর পারি না ! বাপি! তুমি কাকে কি বলছো ? এই জেঠুর নাম চাঁদু নয় ভোঁদু । নামটাও ঠিক করে বলতে পারে না আবার ঝগড়া করতে আসে !”
হাসি হাসিমুখে ছেলেকে বলে , ” ছিঃ! সোনা! বড়দের সঙ্গে ঝগড়া করে না কেউ । তাদের ঝগড়া শুনতেও হয় না ! তুমি টিভি দ্যাখো গিয়ে। “ভোঁদু বিরক্ত মুখে বলে , ” পরশু গাঁয়ে গেইলম । কাল ই শহরে আইছি । ইদিক উদিকে বহু লোককে জিজ্ঞাস করে করে ই জায়গার হদিস মিলল্যাক ।দিল্লিতে হিন্দির সঙ্গে কিংবা গাঁয়ে ঢুকার পর বাংলার সঙ্গে অল্প অল্প ইংরেজি বেঁরাই যাচ্ছিল।সমইস্যায় পড়ছিলম ত বঠেই । তারপর একদিনেই সব সড়গড় ! রক্তে ই ভাষা খেলে বেড়াচ্ছে রে খ্যাপা !যাবেক কুথায় ! তুই যে শহুরে ভাষায় কথা বলচু , সে ভাষায় কথা বলতে অসুবিধা কি ? চামচ দিয়ে মাছ,ভাত খাওয়ার মতনই বেপার ! কি বল কাকী ? “
মা হাসিমুখে ভোঁদুর বক্তব্যকে মান্যতা দিলে উজ্জীবিত ভোঁদু বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে ওঠে , ” যাক গে –তুয়ার সঙ্গে কথা বলতে আমি আসি নাই ইখেনে । এলম কাকা, কাকীকে একবার দেখার লেগে। তুয়ার হুঁড়ারের মতন মুখটা দেখার লেগে আমি আসি নাই। বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা হচ্ছে আমাদের বৌমণি আর উয়ার কারণেই কাকা -কাকীর এমন সোনার চাঁদ লাতিটি!”
হাসি সশব্দে হেসে ওঠে আর অতীনের মা প্রানপণে হাসি চেপে ভোঁদুকে প্রবোধ দেয়, ” ছেড়ে দে বাবা, ছেড়ে দে ! তুতুলটা বরাবরই একটা সন্দেহ পিশাচ । ছেড়ে দে ! ” তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে অতীন । সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে সে চরম বিরক্তির সঙ্গে বলে , ” ওঃ ! একে তো ব্যাঙের উৎপাতে অস্থির হয়ে উঠেছি ! এর ওপর তোমাদের মূর্খামির জন্যে আর এক ভয়ঙ্কর উৎপাত ঢুকে পড়ছে বুঝতেই পারছো না! মূর্খ !” একটু আগেই অতীনের সঙ্গে বাকবিনিময়ে অনাগ্রহ জ্ঞাপণ করলেও পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত বদল করে ভোঁদু । তুতুলকে বোঝানোর ঢংয়ে বলে , ” ব্যাঙের উৎপাত তো সিজিনাল রে খ্যাপা ! দুদিন আগে ছিল কি ? আবার হয়তো চলেও যাবেক দুদিন বাদে। শীতকালে ত যাবেকই ! দরজা জানালা খুলে রেখেছিলি বলে যেগুলান ঢুকে পড়লেক তাদের উৎপাতেই অস্থির তুয়ারা কিন্তুক আজ তিরিশ বছর ধরে পুরা দেশটাকেই যে খুল্লমখুল্লা ওপেন করে রেখেচু , সেই লেগে যেগুলা ঢুকে পড়েছে , যেভাবে তারা শিকড় ছড়াচ্ছে , ইয়াদের কিন্তু শীতঘুম নাই! সামলাবি কি করে ভেবে দেখেছিস ? সামাইন্য ফরেনমানি লিয়ে দিল্লিতে নেমেছি আমি, এইট ফেল ভোঁদু লস্কর , সেই ফরেনমানির লেগেই কি খাতির ! ” মা আর হাসি ভোঁদুর কথাগুলি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না , আর বুঝতে চায়ও না , একজন ওপরের ঘরে , একজন রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় ।অতীনও গম্ভীর মুখে উঠে পড়ে । সে জানে , অনুপ্রবেশকারী কোথাও গিয়ে যাঁকিয়ে বসার আগে একধরণের বৈধতা তৈরী করে নেয় কনসেপ্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মাধ্যমে । ভোঁদুর ভেকধারী লোকটি আপাতত সফল কেননা মা আর হাসির কাছে তার বৈধতা স্বীকৃত হয়ে গেছে ।
তিতিবিরক্ত অতীন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে । আগন্তুকের পরিচিতি সম্পর্কে সে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলই এখন তো দিনের আলোর মতন পরিষ্কার লোকটা জাল । ভোঁদুর যা এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড তাতে ব্যাঙ তো দূরের কথা মানুষেরও বৈজ্ঞানিক নাম বলা সম্ভব নয়! বেশি কেরদানি মারতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে ! জাল প্রতাপচাঁদ বা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর গল্প তো আর বানানো নয় !, মা আর হাসি যদি হিপনোটাইজড না হোতো তাহলে লোকটার ঘাড় ধরে বা বাবা-বাছা করে…বা থানায় গিয়ে….! বাড়ির সামনে পায়চারি করতে করতেই সিগারেট ধ্বংস করে সে ! নাঃ! ঘরের বাইরে যাবার সমস্ত দরজা নিজের হাতে তালা লাগিয়ে চাবিগুলি চালের টিনের ভেতর লুকিয়ে রেখে তবে ঘুমোতে যাওয়া ! নাঃ! এছাড়া আপাতত অন্য কোনো উপায় নেই ! গম্ভীর মুখেই বাড়িতে ফিরল অতীন ।

রাত্র তৎকালে আনূমানিক তৃতীয় যাম অতিক্রম করিয়াছে । অকস্মাৎ অতীনের নিদ্রাভঙ্গ হইল । নিদ্রাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক হইলেও সে উপলব্ধি করিল, প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া দিবার নিমিত্তই এই জাগরণ । শৌচালয় হইতে প্রত্যাবর্তনকালে সহসা বিদ্যুচ্চমকের মতোই তাহার
স্মরণে আসিল, তাহাদের গৃহে এক বিপজ্জনক ব্যক্তি বিদ্যমান । উপরিতলের এক শয়নকক্ষে তাহার শয়্যা নির্ধারিত এবং ঠিক পার্শ্ববর্তী কক্ষটিতে অতীনের পুত্র এবং মাতৃদেবী শায়িত। আত্মরক্ষার সকল রকম ব্যবস্থাপণা উত্তমরূপে করিয়া তবেই সে শয়নকক্ষটি অর্গলবদ্ধ করিয়াছে । ভোঁদু নামধারী ব্যক্তিও কি তাহার জন্য নির্ধারিত শয়নকক্ষটির দ্বার ভিতর হইতে রুদ্ধ করিবার সাহস পাইবে ! সম্ভবত না । একবার দেখিলে হয় ! মার্জারের ন্যায় নিঃশব্দে সে সিঁড়ি অতিক্রম করিল । প্রথমে মাতৃ দেবীর কক্ষ , রুদ্ধ । পার্শ্ববর্তী কক্ষটির দ্বার প্রত্যাশার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ , উন্মুক্ত । কক্ষাভ্যন্তর বিদ্যুৎশক্তি দ্বারা চালিত দীপাধার কর্তৃক নীলাভ । ঔচিত্যবোধের তাড়নায় কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত হইলেও প্রবেশ করিল অতীন । শয়্যার উপরে দৃষ্টিপাত করিতেই তাহার চক্ষুস্থির হইয়া গেল ! ভোঁদুর পরিবর্তে অতিকায় এক ভেক বর্তমান !
অতীন সভয়ে আর্তনাদ করিয়া উঠিল , কিন্তু কিমাশ্চর্যম ! তাহার কণ্ঠ হইতে একটি অস্ফুট আর্তনাদ নির্গত হইল মাত্র ! চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সে শয়্যার উপরিস্থিত ভেকটিকে নিরীক্ষণ করিয়া উপলব্ধি করিল , উহা নিদ্রিত রহিয়াছে । কিঞ্চিৎ সাহসী হইয়া দুই পদ অগ্রসর হইল অতীন । দেখিল, কদাকার প্রাণীটির গাত্রচর্ম হরিদ্বর্ণের এবং মসৃণ অথচ স্থানে স্থানে অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত ! লম্বাকৃতি মুখমন্ডলের দুই পার্শ্বদেশে দুই বর্তুলাকার চক্ষুর উপর এক আচ্ছাদন নামিয়া আসিয়াছে ! দৈত্যাকৃতি কদাকার প্রাণীটির ব্যাদিত মুখগহ্বর কল্পনা করিয়া সে শিহরিত হইল । নিদ্রিত তাই রক্ষা , জাগরুক হইলে আত্মরক্ষা করিবার কোনো উপায় সে খুঁজিয়া পাইত না । তন্মুহূর্তে সে উপলব্ধি করিল , অতি দ্রুত এই গৃহ হইতে নির্গত হওয়া আশু প্রয়োজন । প্রতিবেশী সকলের বহির্দ্বরে করাঘাত এবং চিৎকার করিয়া শতাধিক মানুষকে একত্রিত করিতে হইবে । অজস্র মানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধ ব্যতীত এই প্রাণীটির বিরুদ্ধে জয় অসম্ভব ! সে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করিবার উপক্রম করিল কিন্তু কি আশ্চর্য ! অদৃশ্য এক শক্তিবলে সে স্থবির !
সহসা তাহাকে অধিকতর ভয়ার্ত করিয়া ভেকটি চক্ষু দুইটি উন্মুক্ত করিল এবং মস্তকটি তাহার দিকে ফিরাইয়া কহিল , “ঘাবড়াচ্চু ক্যানে রে ? আমার খাওয়া দাওয়া লিয়ে তুয়াকে কিছুই ভাবতে হব্যাক নাই ! আমি সবোই খাই । কার্বোহাইড্রেট , প্রোটিন , ফ্যাট থেকে শিক্ষা , সংস্কৃতি, মূল্যবোধ সবোই ! তবে গবগব করে খেলে বদহজম হয় ক্যানে রে খ্যাপা ! তাই অল্প অল্প করেই খাবো । বুইলি ?