দুইটি অণুগল্প > রুখসানা কাজল
সুর পাগল
তখন সকাল গড়িয়ে গেছে। রুম্পি সেজোর সাথে বাগানে অর্জুন গাছের ছাল তোলা দেখছিল। কেমন রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে গাছটা। আহত গাছের ক্ষত থেকে ফুটে বেরুচ্ছে লালাভ পানি। রুম্পি বোঝে গাছটা কাঁদছে। সেজোর সাদা পাঞ্জাবির ঝুল ধরে কান্নাতোলা গলায় বলে ওঠে, ওরা কি সব ছাল তুলে নেবে সেজো? গাছটা যে মরে যাচ্ছে !
সেজো কেমন বিচলিত গলায় ছাল তোলা লোকটাকে থামতে বলে, র-র রমেশ আজ থাক রে । গা-গা গাছটা নিতে পারছে না। দে-দে-দেখছিস ত কেমন কা-কাঁপছে, কা-কা-কাঁদছেও ।
রমেশকাকু গাছের গায়ে চৌকা দাগ আঁকছিল। চশমার ফাঁকে একবার তাকায়। সেজোর সঙ্কুচিত, বিব্রত মুখ দেখে হাসি চেপে বলে, গাছের আবার কাঁদন আর কাঁপন । কি যে কন আপনি। গান শুনতি শুনতি আপনার মাথাডা এক্কেরে হালুয়া হয়ি গেছে আমজুদাদা।
সেজো মুখ ভার করে রয়না গাছের গোড়ায় খেজুর পাটিতে গিয়ে বসে পড়ে। সেখানে টেপ রেকর্ডারে বেজে যাচ্ছে, রসকে ভরে তোরে নয়না – নয়ে য়ে এনা সাভেরিয়া, আ আ আ সাভেরিয়া- – তোরে নয়না —
চকচকে ছুরি দিয়ে ছাল তুলে দাঁড়িপাল্লায় মেপে নিচ্ছে রমেশকাকু, বুঝলে খুকি মানুষরে বাঁচতি, বাঁচাতি কত রকমের যে কাজ করতি হয় সারা জেবনভর। ছাল না নিলি ওষুধ হবিনে কেম্নে কও! তোমার কাকাডা বেহুল্লা মানুষ। ঘরে বসি খাতিছে ,গাতিছে, গান বান্তিছে চেরসুখি জন।
রুম্পি তাকিয়ে দেখে বেদনা সরে গিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ ভেসে উঠেছে সেজোর মুখে। চোখ বন্ধ। তিরতির করে কাঁপছে চোখের পাতা। মাথা নাড়ছে। পা দোলাচ্ছে। সুর জড়িয়ে মড়িয়ে পেড়ে ফেলেছে সেজোকে।
এখন ডাকলেও শুনবে না, তাকালেও কিচ্ছু দেখবে না । এই ঘোর ভাঙবে একমাত্র সেজোকাকির চিল চিৎকা্রে। নয়ত রুম্পির মার আদুরে ডাকে। চরম বিরক্তি নিয়ে সেজো তখন বলে উঠবে,উহ্ এ বাড়ির বউরা কেউ বউ নয়। সব টউ।
তখন কে বলবে, বছরে চার মাস সেজো পাগল হয়ে থাকে। শিকলি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় পরিত্যক্ত গোয়ালঘরের থামের সাথে।
—————————
ধর্ম সারস
কোন এক ঘন বর্ষায় মাকে খুশী করার জন্য রেনকোট পরেই আমরা কাগজের নৌকা জলে ভাসাচ্ছিলাম। বৃষ্টি ভেঙ্গে অসময়ে এলো বাপি। আমরা মহাখুশী। রেনুদি চা করতে উঠছিল। ঝলমলে মুখে মা বল্ল, তুই বস, আমি বানাচ্ছি।
মার হাত ধরে বসিয়ে দিলো বাপি, রেনু তুই ও বস এখানে। বাপির গলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা। ফাঁকা । না বাজা শঙ্খের মত কেমন নিষ্প্রাণ , ফাঁপা , শুন্য শুন্য, কাঙ্গাল আজ খ্রীষ্টান হয়ে গেল। ভারি বাতাস কেটে নরম ভেজা সুরে নিজেই যেন নিজেকে শুনিয়ে মা বলল, বেঁচে গেল । অন্তত খেতে পরতে ত পারবে। না খেয়ে মরতে হবে না ছেলেটাকে।
রেনুদি হঠাত কেঁদে ককিয়ে ওঠলো, আমাগের ধম্ম আর থাকল না গো কাকা। সবাই খিরিস্টান হয়ি যাতিছে।
কি আশ্চর্য ! এই ত সেদিন রেনুদিরাও খ্রীস্টান হয়েছে । তার বদলে পেয়েছে টিনের ঘর। সেই ঘরের দেয়ালে যিশুখ্রিষ্টের ছবি। একটা ভালো চাপকল আর চেরিফুলের বীজও পেয়েছে। রেনুদির গলায় রূপালী ক্রুশ। তবে আবার কান্না কেন ? মা বলল, শোন রেনু, যে খেতে দেয় সেই ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান। তুই ত ভালোই জানিস। জানিস না বল ?
কাঙ্গালকাকুও খুব খুব গরীব। জামা নেই, জুতা নেই, ঘর নেই, মা বাবা কেউ নাই। ছিল শুধু ছোট্ট এক বাঁশি । বাগানের ঘাস কাটতে, নারকেল পাড়তে, ইঁদারা সাফ করতে কাঙ্গালকাকুকে সবার দরকার হত। কোন কোন দিন আমাদের পাড়ার কালিমন্দিরের বারান্দায় মা মা করে মাথা ঠুকত। তাই দেখে পুরোহিত দাঠাকুর কঞ্চির লাঠি দিয়ে তাড়া করে আসত । সেই প্রথম বাপিকে চোখ গরম করতে দেখেছিলাম। সেদিন থেকে কাঙ্গালকাকু মন্দিরে ঠাই পেল ঠিকই কিন্তু সবার শেষে। সরস্বতী পুজার দিন দাঠাকুর আমাদের হাত ভরে প্রসাদ দিত। আমরা মুসলিম তা জেনেও। আর কাঙ্গালকাকুকে দিত সবার শেষে। অল্পকিছু ভাঙ্গা সন্দেশ, নাড়ুজিলাপি, মুড়ি।
কেন গো কাকু ?
সাদা দাঁতে ঝিলিক তুলে কাকু বলত, আমি যে বেজাত গো মা জননী ।
তবে কি কাঙ্গালকাকু আজ জাত পেল ?
———————————–