দহন পথে
পলি শাহীনা
ভোরের কমলারঙ আলো গোলাপের মতো তিরতির বাতাসে দুলছে। এ সময়টায় সুরাইয়া প্রতিদিন পার্কে হাঁটাহাঁটির জন্য বেরিয়ে পড়ে। প্রথম ভোরের আলো যেন ওর প্রিয়জন। প্রিয়জনের পরশ শরীরে, মনে মেখে ওর দিনের সূচনা হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত সহ প্রকৃতির সবকটি ঋতুতে এ নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটে না। এ ষাটোর্ধ্ব বয়সেও সুরাইয়া পার্কের সবুজ ঘাসের উপর পিঠ পেতে সূর্যের দিকে মুখ করে শিশুর মতো শুয়ে থাকে। ওর হেডফোনে তখন শুধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা লতা মঙ্গেশকরের গান নয়, হালের বাপ্পা মজুমদার অথবা লিজার গানও বেজে চলে। সুরের বিষয়ে ও সর্বভুক। সুর ওকে বড় টানে। গনগনে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ও প্রিয় মহাদেব সাহা কিংবা জীবনানন্দের কবিতা আওড়াতে আওড়াতে মাঝেমধ্যে ব্যাকপ্যাক হতে কাগজ, কলম বের করে নিজেও কবিতা লেখে। দুর্দান্ত আলোচনায় ভিনদেশীদের মনোযোগও ধরে রাখতে পারে। এমনকি পার্কের নাম না জানা অসংখ্য পাখিদের সঙ্গেও কখনো সখনো ও আড্ডায় মেতে উঠে। পথে-ঘাটে, মাঠে-প্রান্তরে, গহীন অরণ্যের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে দিনের যে কোন সময় ও প্রায়শই বেরিয়ে পড়ে। প্রকৃতির যে কোন তাপমাত্রায় ওর প্রতিদিনের এ নিয়মের কোনরকম হেরফের হয় না। ও নিজেকে প্রকৃতির অংশ মনে করে। বেঁচে থাকার তরে হাসি-আনন্দের রসদ প্রকৃতি হতে ও নিংড়ে নিংড়ে গ্রহণ করে।
নিউইয়র্কের যে বাড়িটিতে ও থাকে সে বাড়িটিতে দক্ষিন মুখী রেলিং ঘেরা মনোমুগ্ধকর এক চিলতে ঝুল বারান্দা রয়েছে। সে বারান্দাটিকেও নানান ফুল, ফল, সব্জীর সমাহারে সবুজ অরণ্য বানিয়ে রেখেছে। কী নেই সে বাগানে? কাঁচামরিচ, টমেটো, ক্যাপসিকাম, পুঁইশাক থেকে শুরু করে টিউলিপ, বেলি, ড্যাফোডিল, ড্যান্ডিলাইওন, মানিপ্লেন্ট, অপরাজিতা সহ সব রয়েছে। দূর হতে বারান্দাটিকে দেখলে মনে হবে ছোট্ট একটি বাগান। সে বাগানের পাশেই রয়েছে একটি টেবিল ও দু’টো চেয়ার। আধো আলো আধো অন্ধকারে ঘুম ভেঙে কিছু সময় ও এই বারান্দাতেই কাটায়। সাইফুলের চেয়ারটা খালি পড়ে থাকে। পাশের চেয়ারে বসে ও চা খায় আর আপনমনে সাইফুলের সঙ্গে গল্প করে। একদা এ বাগান করার সময় সাইফুল ওকে সাহায্য করতো। সকালে উঠেই টবে পানি দিতো, আগাছা পরিষ্কার করতো, কীটনাশক ওষুধ দিতো। সুরাইয়া বিছানা থেকে সেসব দৃশ্য দেখতো। মাঝেমধ্যে ওকে গাছের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে সুরাইয়া মিটিমিটি হাসতো।
এখনো নিয়ম করে খুব ভোরে উঠে ফয়সালের মতো সুরাইয়া এ বারান্দায় এসে বসে, আকাশ দেখে, গাছের পরিচর্যা করে। পার্থক্য শুধু তখন সুরাইয়া এসে বিড়ালের মত সাইফুলের গা ঘেঁষে পায়চারি করতো, পেছন হতে জড়িয়ে ধরতো, কিন্তু আজ সাইফুল এসে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়ায় না, জড়িয়ে ধরে না। গত অনেকগুলো বছর হতে সুরাইয়া একাকী বাঁচতে শিখে গেছে, কিংবা একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মানুষের মন কাঁচের মতো। একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। যে কোন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে মানুষ দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখে যায়। এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোন বিকল্পও নেই যে।
তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও ঠান্ডার আধিপত্য এখনো আছে। ড্যান্ডিলাইওনের মুগ্ধ চাহনি আর রবিন, কার্ডিনাল পাখীর কন্ঠের গান বলছে এ শহরে বসন্ত এসে গেছে। এমন দিনে সুরাইয়ার খুব সাইফুলের কথা মনে পড়ছে। একই আকাশের নিচে একই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ও আছে – এ বলে নিজের মনকে বুঝ দিয়ে শোবার ঘরের দেয়ালজুড়ে স্লাইডের বিশাল পর্দাটি সরিয়ে বাইরের পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় সুরাইয়া। বাইরের পৃথিবী সবটুকু আলো নিয়ে যেন ওকে বুকের ওমে জড়িয়ে ধরে। রোদেলা সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে ও বেরিয়ে পড়ে। স্কুলগামী শিশুদের কলকাকুলি, কাজ অভিমুখে দ্রুতগামী মানুষদের ছাড়িয়ে ও পার্ক অভিমুখে হাঁটতে থাকে। ধীরলয়ে পথ চলতে চলতে ও মানুষ দেখে, মানুষের গল্প শোনে।
এ এলাকাটিতে গত দু’যুগ ধরে সুরাইয়া বসবাস করছে। এ এলাকার রাস্তাঘাট হাতের রেখার মত ওর মুখস্থ বলা চলে। দোকানপাট, মানুষজনও বেশ চেনাজানা। তবুও আজকাল এ রাস্তা ধরে চলতে কিছুটা ভয় ভয় লাগে। এ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গৃহহীন মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। গৃহহীন এ মানুষগুলো রাতে দোকানের সামনে, গ্যারেজে কিংবা রাস্তার উপর শুয়ে থাকে। এদেরকে চাল-চুলোহীন ও দেখতে নিরীহ মনে হলেও তলে তলে এরা চুরি-চামারির সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের ধারণা। স্থানীয় প্রিসেন্টের সূত্রমতে এরা নাকি রাতে এমনকি দিনের বেলায়ও নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে চলা পথচারীদের ছুরি ধরে অর্থ নিয়ে যায়। এসব খবর গত কয়েকমাস ধরে গণমাধ্যমে এবং পুলিশের মুখে শুনে শুনে ইদানীং পার্কে যাওয়ার সময় মনে মনে সুরাইয়া বিচলিত বোধ করে। গৃহহীন এ মানুষগুলোকে ভয় পেলেও এদের প্রতি ওর একটা মমত্ববোধও কাজ করে। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে এদের শুয়ে, বসে থাকতে দেখলে ওর প্রাণ কাঁদে। চোর হয়ে কেউ তো জন্মায় না, প্রতিকূল পরিবেশ মানুষকে কখনো কখনো মন্দ পথে ঠেলে দেয়। একদিন ওর বাড়ির গেটের সামনে তীব্র শীতে এক গৃহহীনকে বসে ঠকঠক কাঁপতে দেখে ও নিজের একটা কম্বল সঙ্গে চা-বিস্কুট দিয়ে আসে। এটি আরো আগের ঘটনা হলেও আজো লোকটার তৃপ্ত চাহনি চোখে ভাসছে। কে যে কোন কারণে জীবনের সঠিক পথ হতে কক্ষচ্যুত হয়, বলা কঠিন। প্রতিটি মানুষ যেমন স্বতন্ত্র, তেমন তাঁদের গল্পগুলোও আলাদা। কোন আগুনে পুড়ে কে কীভাবে ছাই হয়েছে, কিংবা বিপথগামী হয়েছে, কে জানে। বৈষম্যের এ দুনিয়ায় কারো জীবনের গল্প না জেনে, না বুঝে, কাউকে মন্দ বলতে নারাজ সুরাইয়া। ভাবনার সরোবরে হাবুডুবু খেতে খেতে ওর কানে আচম্বিত এসে একটা শব্দ লাগে – ‘পানি’। শব্দটির উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখে একজন গৃহহীন উল্টানো তেলাপোকার মত শূন্যে হাত-পা ছুঁড়ছে আর ‘পানি পানি’ করছে। সুরাইয়া তার মাথার কাছে বসে ব্যাকপ্যাক হতে পানির বোতল বের করে পানি খাওয়ায় তাকে। পানি খেয়ে লোকটি চুপচাপ বাম পাশে ফিরে মাথা হেলিয়ে পুনরায় চোখ বুঁজে ফেলে। কিছু সময় সুরাইয়া তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ও ঠিক বুঝতে পারে না লোকটা সুস্থ না কি অসুস্থ, অথবা তার কী হয়েছে? উঠে কয়েক পা এগুতে আরো কিছু গৃহহীন ওর চোখে পড়ে। ওরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে কেউবা গুটিশুটি হয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে, কেউবা ক্লান্ত শরীরে হাত-পা মেলে নির্মোহ উদ্দেশ্যহীন আকাশের দিকে পলকহীন চেয়ে আছে। মাথার উপর ট্রেনের শব্দ, শরীরের পাশে গাড়ির শব্দ, এম্বুলেন্সের বিকট সাইরেন, কোন কিছুই ওদের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। ওরা রাস্তার এত কিনার ঘেঁষে ঘুমাচ্ছে যে রাস্তার কোন দ্রুত ধাবমান গাড়ির চাকা যদি বেগতিক ওদের উপরে উঠে যায়, এমন ভাবনায় সুরাইয়ার বুক ধুকপুক কেঁপে উঠে। অথচ নিদ্রিত লোকগুলোর বিন্দুমাত্র ভয় তো দূরের কথা, উপরন্তু ওদের মুখে তৃপ্তির একটা ছায়া ঝুলে আছে। ওদের ঘুমন্ত মুখের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিরুদ্বিগ্ন গভীর সুখি মানুষ এরা।
পথের নানান গল্প, বাঁক পেরিয়ে সুরাইয়া ওর গন্তব্যস্থল পার্কে এসে পৌঁছে। পার্কের প্রবেশমুখে লাইন ধরে বসানো ফোয়ারার পানির নাচ চলছে, প্রজাপতি উড়ছে শাখে শাখে। খানিকটা সময় ও অন্যদিনের মত প্রজাপতিদের সঙ্গে প্রাণভরে কথা বলে, হাসে। এ সময়টায় ও শৈশবে ফিরে যায়। শৈশবের রঙিন আদর ওকে মাথাভর্তি কাচা পাকা চুলের কথা ভুলিয়ে দেয়। জীবনের যত পরাজয় সব ভুলে ও যেন শিশু হয়ে উঠে। শিশুর মত হাসে, খেলে। নিজের ইচ্ছেমতো খেয়ালখুশিতে প্রজাপতিদের সঙ্গে উড়াউড়ি করে, পানির ভেতর লুটিয়ে পড়ে। পার্কের সাজানো – গোছানো গাছ, লাইন ধরে ইঞ্চি মেপে ফুলের গাছ দেখতে ওর ভালো লাগে না। ফেলে আসা শৈশবের কামিনী ঝাড়, বাঁশ ঝাড়, বুনোফুল, এলোমেলো কলমির একটা বুনোগন্ধ ওকে জাপ্টে ধরে। পার্কের নিঁখুত এসব সাজানো-গোছানো বিষয়গুলো তখন ওর ভালো লাগে না। মনে হয় এসব মেকি, এখানে কোন আনন্দ নেই। আনন্দ হবে মুক্ত, আনন্দের পায়ে কোন নিয়মের শেকল থাকবে না। অথচ, এ গাছগুলোর চারপাশ কম্পাসের হিসেবে বেঁধে দেয়া। সুরাইয়ার ইচ্ছে করছে ছোটবেলার মতো অগোছালো শুকনো বাঁশপাতা মাড়িয়ে, শরীরে ভাঁট ফুলের গন্ধ মেখে ধান ক্ষেতের আইল ধরে দিক ভুল করে মাঠ পেরিয়ে বন পেরিয়ে ধুলো উড়িয়ে ধু ধু প্রান্তে ঘুরঘুর করতে। মানুষের বয়স যত বাড়ে বোধহয় শিশুকাল পুনরায় তত কাছে আসে। সুরাইয়ার বুড়ো মস্তিষ্ক বলের ধাক্কা খেয়ে অনেক সময় পর বাস্তবে ফিরে আসে। একজন মা, শিশু নিয়ে পার্কে এসেছেন। শিশুটির বল হাত ফসকে সুরাইয়ার ঘাড়ে এসে পড়ে। বলটি হাসিমুখে শিশুটির হাতে ফেরত দিয়ে ও পার্কের ভেতর একটি সিমেন্টের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। পার্কের সতেজ বাতাসে টেনে টেনে শ্বাস নিতে থাকে। ইতিমধ্যে পার্কে আরো মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। মানুষের গলার স্বর সূর্যের মত ক্রমশ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে।
বেঞ্চিতে বসে সুরাইয়ার চোখে গৃহহীন মানুষগুলোর সুখনিদ্রার দৃশ্য ভাসছে। আজ ঘুরেফিরে সাইফুলের কথা মনে পড়ছে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও রাতে ও ঘুমাতে পারতো না। খুব ভোরে পাখিরা যখন নীড় ছেড়ে বের হতো তখনো নির্ঘুম ও এপাশ-ওপাশ করতো। শোবার ঘরটিকে বাইরের শব্দের উৎপাত হতে মুক্ত রেখেও ওর ঘুম আসতো না। গ্রীষ্মের দিনে শোবার ঘরটিকে সাইবেরিয়ার তুষারাবৃত অঞ্চল বানিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ও ঘুমের জন্য হাসফাঁস করতো। একই খাটে পাশাপাশি শুয়ে দিনের পর দিন ওর এমন নির্ঘুম রাত্রিযাপন দেখে সুরাইয়ার মন বড় খারাপ হতো। এমন নয় যে মা হতে না পারার কষ্ট সুরাইকেও বিষন্ন করে তোলে নি। তবে ও নিজেকে সামলে নিয়েছে, কিংবা সাইফুলকে ভেঙে পড়তে দেখে নিজেকে সবসময় হাসিখুশি রেখেছে।
নিউইয়র্কে আসার আট মাসের মাথায় সাইফুল রোড এক্সিডেন্ট করে দু’বছর বেড রেস্টে থাকে। এ সময় সন্তানের চিন্তা ওদের মাথায় আসে নি। সুরাইয়া একনিষ্ঠভাবে সপ্তাহে সাত দিন কাজ করে সংসার সামলেছে। জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত শরীরে দিনশেষে ঘরে ফিরে হাসিমুখে সাইফুলকে মনোবল যুগিয়েছে। সংসার এবং সাইফুলের প্রতি দায়িত্ব পালনে কোথাও এতটুকু খামতি রাখে নি। দুই বছর পর যেদিন কাজে যোগ দিবে সাইফুল, সেদিন সকালে ঘুম ভেঙেই সুরাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘এবার তোমার ছুটি। আমাদের একটা পুতুল হবে। ওকে নিয়ে তুমি রাতদিন হাসবে, খেলবে, সময় কাটাবে। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব আজ হতে আমার।’ আনন্দে সুরাইয়ার চোখ তখন রুপালি রোদের মত চকচক করছিল। সাইফুলের বাহুবন্ধন হতে মুক্ত হয়ে ও হরিণ শাবকের মতো লাফাতে লাফাতে রান্নাঘরে চলে যায়। দৈনন্দিন অভ্যাসমতো চা বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় এসে বসে। দক্ষিণা বাতাসে দোল খেতে খেতে অনেকক্ষণ ওরা গল্প করে। গল্প শেষে ইস্ত্রি করা শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে সাইফুল বেরিয়ে পড়ে কাজে। সুরাইয়া কিছুসময় মন দিয়ে বারান্দার গাছগুলোর যত্ন নেয়। দাবার ছকের মতো ঘরের মেঝের টাইলসগুলোর দিকে তাকিয়ে, কল্পনায় সন্তানের সঙ্গে খেলাদুলার কথা ভেবে বুকের অন্দরে অন্যরকম প্রশান্তি বোধ করে।
এর মাঝে এক বছর দুই বছর সময় কেটে যায়। ওদের ঘর আলো করে কোন পুতুল আসে না আর। অতঃপর, দু’জন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। পরীক্ষা- নিরিক্ষা শেষে সাইফুলের সমস্যার কথা জানায় ডাক্তার। সমস্যার কারণ হিসেবে ভয়াবহ রোড এক্সিডেন্টের ভূমিকার কথাও ব্যাখ্যা করে। ডাক্তারের মুখে বন্ধ্যাত্বের খবর শুনে সাইফুল খুব ভেঙে পড়ে। এবং সেদিন হতেই ওর নিদ্রাহীন রাত্রি যাপনের সূচনা ঘটে। প্রথম প্রথম মাঝরাতে উঠে অন্ধকারে আলো না জ্বালিয়েই ঘরে হাঁটাহাঁটি করতো। খুব চুপচাপ হয়ে যায়। কোন কথা বলতো না সুরাইয়ার সঙ্গে। সুরাইয়া নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতো, পাছে সাইফুল কষ্ট পাবে বা নিজেকে অপরাধী ভাববে, এ ভয়ে সুরাইয়া সবসময় প্রাণবন্ত থাকতো।
পরিবার, আত্মীয় – স্বজন বিহীন এ শহরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, সাইফুলের নির্লিপ্ততা সুরাইয়াকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। সুখ ভাগাভাগি করলে বাড়ে, কষ্ট ভাগাভাগিতে কমে। এ শহরে ওর আপন কেউ নেই, যার সঙ্গে কষ্ট শেয়ার করবে। দহন জ্বালা নীরবে বুকে লুকিয়ে ও খুব গুছিয়ে সংসার করে। সাইফুল কাজ শেষে ঘরে আসার আগে ওর পছন্দের এটা ওটা বানিয়ে রাখে, ওকে পরিবেশন করে। বিশেষ কারণ ছাড়া সাইফুল একদম কথা বলে না। ছুটির দিনেও বাসায় থাকে না। বাসায় ফিরলে সুরাইয়া নিজ হতে কথা বলতে চাইলেও বিরক্তি প্রকাশ করে। ও বুঝতে পারে না, কোথায় ওর ভুল হচ্ছে।
একটা সময় আসে, যখন ঘরের কাজ শেষে পাহাড়ের মত স্থবির হয়ে একাকী ভাবনায় ডুবে বসে থাকা ছাড়া সুরাইয়ার আর কিছু করার থাকে না। অথচ, একদা ও নিজের ঘরে একাকী থাকতেও ভয় পেতো। পরিবারের মানুষের উপর এতটাই নির্ভরশীল ছিল যে কোনদিন একাকী শপিং কিংবা আত্মীয়ের বাড়ি পর্যন্ত যায় নি। ভাইবোনরা ওকে কুনো ব্যাং উপাধি দিয়েছিল। সে ঘরকুনো সুরাইয়া পরিবারের সম্পূর্ণ অমতে পড়ালেখা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সাইফুলকে বিয়ে করে, সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে চলে আসে। পরিবার, দেশ ছেড়ে আসার সময় ও কান্নায় ভেঙে পড়লে সাইফুল বলেছিল- ‘ভয় নেই আমি সঙ্গে আছি তো, থাকবো আজীবন।’ সে সাইফুল আজ কেন, কী কারণে এমন অদ্ভুৎ আচরণ করছে, ভাবতেই বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে। ‘কেন এমন শাস্তি পাচ্ছি?’ নিজেকে প্রশ্ন করে সুরাইয়া। উত্তর খুঁজে পায় না। সাইফুলের এমন অপ্রত্যাশিত আচরণ, নিরুত্তাপ জীবন যাপন ওর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দেয়। ও বুঝতে পারে খুব কৌশলে সাইফুল প্রতিনিয়ত ওকে এড়িয়ে চলছে। কেন এড়িয়ে চলছে সরাসরি জানতে চেয়েও উত্তর পায় নি। একাকীত্ব যেন ওর গলা চেপে ধরেছে। খুব বাবা-মা, ভাইবোনের কথা মনে পড়ে। সাইফুলের মোহে ডুবে যেতে যেতে বহুদিন পরিবারের কোন খবর পর্যন্ত রাখে নি। যাকে নিয়ে মেতে থেকে, যার হাত ধরে পরিবারের সকলের মনে আঘাত করেছে, যার ভালোবাসায় পরিবার হতে দূরে সরে গিয়েছে, কেমন করে আজ স্বার্থপরের মত নিজের প্রয়োজনে ওদের সঙ্গ চাইবে? ক্রমাগত মানসিক চাপে নিরুপায় সুরাইয়ার শরীর, মন দিনদিন নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
হঠাৎ একদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরে সাইফুল ফ্রেশ হয়ে শান্ত স্বরে সুরাইয়াকে বলে ,
– আমরা যদি রাজি থাকি তো উকিলের দরকার কী?
-বুঝলাম না। মানে কী
– এই ভীষণ পুনরাবৃত্তির জীবন আমার ভালো লাগছে না।
– রোজকার একঘেঁয়ে জীবনে বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছ। চলো কোথাও হতে বেড়িয়ে আসি।
– ভালোবেসে আমরা একে অপরকে গ্রহণ করেছি ঠিকই, কিন্তু তোমার প্রতি এখন আমি আর কোন আকর্ষণ বোধ করছি না। এ পাতানো সম্পর্ক আর টিকিয়ে রাখতে চাইছি না।
– তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ তো কমে নি, বরঞ্চ আগের চেয়েও বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। তুমি আমার প্রাণের বন্ধু।
– তোমার প্রতি আমার তিক্ততা নেই বটে, কিন্তু যাপিত জীবনে ভালোবাসা, সুর কোনটাই আর পাই না। আমি ছুটি চাই। মুক্তি দাও।
– কী অপরাধে এমন শাস্তি দিতে চাইছো?
– পরিবারের অমতে বিয়ে করেছি, দেশ ছেড়েছি। হয়ত এ কারণে রোড এক্সিডেন্ট, ফলাফল আমার বন্ধ্যাত্ব।
– এখানে আমার দোষ কী?
– তোমার কোন দোষ নেই। তুমি কেন আমার অপূর্ণতার প্রায়শ্চিত্ত করবে? তোমারও মুক্তি দরকার।
– আমার মুক্তি চাই না।
– আমার মুক্তি চাই।
সাইফুলের এমন দৃঢ স্বরে সুরাইয়ার মাথা দপদপ করতে থাকে। হার্টবিট বেড়ে যায়। চারপাশ লাটিমের মত ঘুরতে থাকলে দাঁড়ানো হতে ও সোফায় বসে পড়ে। আপাদমস্তক অবশ হয়ে আসে। কী বলবে? কী করবে? চিন্তা করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে। বারান্দায় গিয়ে থরথর শরীরে উদ্দেশ্যবিহীন পায়চারি করতে থাকে, আর অশ্রু মোছে। এসময় ফয়সাল একবারও ওর কাছে আসে নি, খবর নেয় নি। সুরাইয়া আরো দূরে সরে যাক, ও যেন এমনটাই চাইছে। গোটা রাত ও অন্ধকারে মুখ ডুবিয়ে বারান্দায় কাটিয়ে দেয়। দু’জন মানুষ একই ছাদের নিচে হয়েও যেন অনেক আলোকবর্ষ দূরত্বে।
নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোরের প্রারম্ভে সুরাইয়া রুমে এসে দেখে শোবার বিছানা খালি পড়ে আছে। সাইফুলকে ছাড়া কক্ষটা শূন্য শূন্য লাগে। এত ভোরে ও গেলো কই? লাগোয়া বাথরুমেও নেই। খুঁজতে গিয়ে দেখে লিভিং রুমের দরজার পাশে দু’টো বড় সুটকেস দাঁড় করিয়ে রাখা, সঙ্গে ছোট্ট একটা হ্যান্ড লাগেজ। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর বুকটা কেঁপে উঠে, যেন পায়ের নিচে ভূমি নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। ও শব্দ করে কাঁদতে থাকে। মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা সাইফুলকে ও জিজ্ঞেস করে – কোথায় যাচ্ছ? প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলল – ডিভোর্সের কাগজপত্র তৈরি করে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেব। এমন কথা শুনে সুরাইয়ার ওষ্ঠদ্বয় যেন পাথর হয়ে যায়। ও দু’হাতে বুক চেপে ধরে শুধু ঢোক গিলে নেয়, কোন কথা বলতে পারে না। সাইফুলের মুখাবয়ব এতটাই স্বাভাবিক, যেন এমন দিনটির জন্য বহুদিন ধরে নিজেকে তৈরি করেছে। সাইফুল ওকে একা ঘরে ফেলে কোথায় যাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য সুরাইয়ার বুকে ঝড় বইছে, কিন্তু এমন আচমকা আঘাতে ও এতটাই বিঃধ্বস্ত যে মুখ ফুটে চেষ্টা করেও কথা বের হচ্ছে না। যেন ওকে বোবা চেপে ধরেছে।
‘ ভালো থেকো’ বলে সাইফুল ঘর ছেড়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। বোবাকালার মত সুরাইয়া ওর চলে যাওয়া পথের দিকে পাথর চোখে চেয়ে থাকে।
সে থেকে সাইফুল আজ অবধি ফিরে আসে নি। না, আজো সাইফুল, সুরাইয়ার ডিভোর্সও হয় নি। ওর পাঠানো কোন মেইলও পায় নি সুরাইয়া। কোথায় আছে, কেমন আছে সাইফুল? কিছুই ও জানে না।
যে মানুষটার জন্য সুরাইয়া ঝনঝন করে হাসতো সে মানুষটার জন্য আজ হাউমাউ করে কাঁদে। ভালোবাসা জলের মত যেমনি তৃষ্ণা মেটায় তেমনি জলে ডুবিয়ে শ্বাস রোধ করে মেরেও ফেলে। মানুষ যতটা অদ্ভূত প্রাণী, সময় তারচেয়েও বেশি অদ্ভূত। সাইফুল বলতো সুরাইয়াকে ছাড়া ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। সময়ের বিবর্তনে সুরাইয়ার সঙ্গ ছেড়ে সাইফুল আজ নিশ্চয়ই ভালো আছে। ভালো থাকার জন্যই তো ছেড়ে গেছে। এত দূরত্বের মাঝেও কিছু ভালোবাসায় কখনো ঘুনে ধরে না, ঘৃণা জন্মে না। সাইফুলের জন্য ওর প্রাণ পোড়ে অহর্নিশি। ভালোবাসা মানে বেঁধে রাখা নয়, ভালোবাসা মানে মুক্ত করে দেয়া- সুরাইয়া এটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। ভালোবাসার সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে দখলপ্রবণ মানসিকতা। তাইতো সম্পর্কের অধিকার খাটিয়ে সুরাইয়া ওকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেঁধে না রেখে উড়িয়ে দিয়েছে মুক্ত আকাশে। নিজের মনের আগুনে ধিকিধিকি জ্বলেপুড়ে নিজেই ছাই হয়েছে, তবুও সাইফুলের সুখের পথে একটাও কাঁটা বিছায় নি, কোন ঝামেলায়ও জড়ায় নি। যে সম্পর্কে সাইফুল ভালোবাসা কিংবা আকর্ষণ অনুভব করছে না, সে সম্পর্কে ওকে যেচে জোর করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করে নি। যদিও কাচা পাকা চুল, চোখের নিচে কালি নিয়ে সুরাইয়া সারাক্ষণ ঘরের দরজার দিকে কান পেতে রাখে, আবছায়া ভোরের আলোয় আচমকা চলে যাওয়ার মতো করে আবার আচমকা কোনদিন যদি সাইফুল ঘরের কড়া নাড়ে। সাইফুল এসে যদি ওকে না পেয়ে ফিরে যায় এমন শঙ্কায় ওর আজো নির্ঘুম রাত কাটে।
বেলা প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। রোদের তেমন তেজ নেই। গাছের শাখা-প্রশাখায় তাপহীন সূর্যের ম্রিয়মাণ রশ্মি খেলছে। সুরাইয়া সকালে ঘর হতে বের হওয়ার আগে নাশতা সেরে বেরিয়েছে। ওর এখন বেশ কফির তেষ্টা পায়। প্রতিদিন ও হাঁটতে হাঁটতে পার্কের অনেক গভীরে চলে যায়। বনের নির্জনতা ওর ভালো লাগে। বার্চ, পাইন, পপলার, ম্যাপল সহ নানান জাতের গাছপালা নিয়ে এ পার্কটির ভেতরে পায়ে হাঁটার রাস্তা রয়েছে। সাইকেল চালাবার এবং বাচ্চাদের স্ট্রলার ঠেলার রাস্তাও আছে। রাস্তার দু’ধারে ফুলের বাগান, বসার জন্য পরিপাটি সিমেন্ট ও কাঠের বেঞ্চি পাতা আছে। পার্কের একটু ভেতরে গেলে মনোমুগ্ধকর আঁকাবাঁকা লেক দেখা যায়। সুরাইয়া এগুলোকে খাল বলে। এগুলোতে যখন পানি থাকে না তখন সবুজ ঘাসের জঙ্গল মনে হয়। মনোযোগ সহ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হবে সবুজ ঢেউ এর পর ঢেউ এঁকেবেঁকে চলছে দূর পানে। সুরাইয়া বিহ্বল হয়ে দৃশ্যগুলো দেখে। প্রকৃতির এমন আত্মমগ্নতা, রহস্যময় নীরবতা, ওকে সুখ দেয়। আজ সুরাইয়া আর হাঁটা হয় না পার্কের গভীরে। পার্ক হতে বেরিয়ে ও কফি শপের দিকে হাঁটতে শুরু করে। দশ মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে ও কফি শপে এসে পৌঁছায়। কফি শপের এক কোণে এক পা অলা গোল টেবিলের পাশে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। এ সময় কফি শপ ভরা থাকলেও আজ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আজ অন্যদিনের চেয়েও সাইফুলকে বেশি মনে পড়ছে। পার্কে, কফি শপে, পথের বাঁকে, সর্বত্র সাইফুলের মুখটা চোখের মণিতে ভাসছে। একটা বিষন্নতার চাদর ওকে জড়িয়ে রেখেছে। আসলে বয়স বাড়লে মানুষের বন্ধু কমে যায়, মনের শক্তি হ্রাস পায়, তখন বেশি বেশি প্রিয় মানুষটার কথা মনে পড়ে। সাইফুল ওকে ভালো না বাসলেও ও তো ভালোবাসে। ওর ভালোবাসায় অন্ধ হয়েই তো পরিবার হতে দূরে ছিটকে পড়েছে। ওর মোহে অন্ধ হয়েই তো একটা জীবন নিঃসঙ্গ কাটিয়ে দিচ্ছে। ভালোবাসার এ জাদুকরী মোহ কেউবা কেটে উঠে, কেউবা বরফ জমা বুকে শীতল নদীর আরো গভীরে ডুবে যায়। ভালোবাসা কেমন করে হারিয়ে যায়, বেদখল হয়ে যায়, সুরাইয়া আজো জানে না।
মানুষ দেখা সুরাইয়ার পুরনো অভ্যাস। কফি শপের মেয়েটিকে ও নীরবে দেখছে। কম বয়সী মেয়েটি চোখ ধাঁধানো লাল জ্যাকেট পরেছে, ঠোঁটে ম্যাচ করে লাল লিপিস্টিক। মুক্তোর মত ঝলমলে দাঁতগুলো বের করে যখন ও হাসে চৌদিক আলোকিত হয়ে উঠে।
‘প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম সেদিন হতে তীর বিদ্ধ পাখির মতন তোমাকে পাওয়ার আকুলতায় ছটফট করছিলাম। তুমি আমার অক্সিজেন। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। ‘ কফি শপের কম বয়সী মেয়েটির সঙ্গে একটি ছেলের এমন আদিরসাত্মক কথোপকথন শুনে সুরাইয়া সাইফুলের কথা ভেবে আপনমনে হাসতে থাকে। কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না – এ বাক্যটি সম্ভবত পৃথিবীর বহুল চর্চিত একটি মিথ্যা কথা। ভিনদেশী মানুষের মনের পটভূমি এবং ভালোবাসার বোধও একইরকম।
ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হতেই সুরাইয়া ফোন হাতে নিয়ে দেখে তমালের ম্যাসেজ। উঠতি এ তরুণ ভালো কবিতা লেখে। কবিতার হাত ধরেই ওদের পরিচয়, পরে সখ্যতা। কবিতা – গানকে উপলক্ষ্য করে মন দেয়া – নেয়ার বিষয়টি সুরাইয়া যখন বুঝতে পারে তখনই ও সাবধান হয়ে যায়। তমালকে পরিষ্কার করে ওর অবস্থান বুঝিয়ে বলার পরও বুঝতে চাইছে না। তমাল পুনঃপুনঃ ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে। ও সিন করছে, উত্তর দিচ্ছে না। সুরাইয়া বুঝতে পারে তমাল একটা ঘোরের মধ্যে আছে৷ কারণ, এ বয়স এবং সময় ও পার করে এসেছে। মানুষ আসলে বেড়ালের মত, একটু ভালোবাসা, যত্নের ছোঁয়া পেলেই দুনিয়ার সকল বাস্তবতা ভুলে মোমের মতন গলে যায়। ভালোবাসার ঘ্রাণ পেলে সুখে মরে যেতে চায়। বয়স ষোল হোক আর ষাট হোক, পুরুষ -নারি কেউ এর বাইরে নয়। সুরাইয়ার একাকীত্ব রাতদিন যখন ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল তখন অবচেতন মনেই তমালের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে। এ সখ্যতায় প্রথম দিকে সুরাইয়ার প্রশ্রয়ও ছিল। ভালোবাসার আস্ত একটা মেঘলা আকাশ নিজের ভেতর বহন করে, ভালোবাসার যে হিসেব বিহীন মোহে অন্ধ হয়ে ও বৃদ্ধ হয়েছে, সে ভালোবাসার মোহে বেঁধে বাস্তবতা হতে দূরে সরে গিয়ে কোনভাবেই তমালকে জীবনে জড়িয়ে নেয়া উচিৎ হবে না৷
ভাবনার করিডোরে ঘুরতে ঘুরতে লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। কফি শপে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। লোকজনের ভীড় ঠেলে হাট ভ্যানিলা কপি নিয়ে ও নিজের জায়গায় পুনরায় এসে বসে। তমাল এবার ভিডিও কল দেয়। মাথা নিচু করে গরম কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে ক্লান্তি আর অবসাদ ছাওয়া ব্যথাতুর মন নিয়ে ও তমালকে ম্যাসেঞ্জারে ব্লক করে দেয়। ব্লক শেষে সুরাইয়া নিজের হাতটি নিজের কপালে, মুখে, অধরে বুলিয়ে দিতে থাকে। ওর উদাস দু’টি চোখ ফেটে তখন বের হচ্ছে একরাশ অতৃপ্তি। যদিও তমালের সঙ্গে কবিতার আদান-প্রদান, গল্প-আড্ডায় ওর একাকী সময়গুলো আনন্দে কাটছিলো, তবুও ওর ভালোর জন্য এক ফুঁয়ে আনন্দগুলোকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। ভালোবাসলে যে ছাড়তেও জানতে হয়। ভালোবাসার মায়া জালে সুরাইয়ার জীবন যেভাবে বিপন্ন হয়েছে তমালের জীবন যেন সেরকম না হয়। তমালের হৃদয় যেন সুরাইয়ার হৃদয়ের মত ভেঙে টুকরো টুকরো না হয়, ওর হৃদয়টা আস্ত থাকুক। ওর গোটা জীবন সামনে পড়ে আছে। সময় নামক মহৌষুধ তমালের মন থেকে সুরাইকে মুছে দিবে। ভালোবাসার ক্ষতটা আরো গভীর হওয়ার আগে সুরাইয়া নিজেকে সরিয়ে নেয়।
মেয়েদের দেহ যতটা পোড়ে মনটা পোড়ে এর চেয়েও অধিক।পরিপাটি ড্রেসের নিচে জমানো কান্নায় সুরাইয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এ দহন কেউ দেখে না, বোধ করি ঈশ্বরও না।
পলি শাহীনা: কথাসাহিত্যিক