You are currently viewing ত্রিমোহনীঃ তিন কবির কাব্যবিস্তার

ত্রিমোহনীঃ তিন কবির কাব্যবিস্তার

ইয়ার ইগনিয়াসের একগুচ্ছ কবিতা

সুর, অসুর ও বেসুরো গান

কখনো কখনো সুরেও অসুর ভর করে। বেসুরো করে দেয় বহুল গীত ললিত লিরিক। বিধি-বিরুদ্ধ স্থাপনার মতন ভেঙে দেয় সম্পর্কের সবুজ হাঁড়। চকিতে চোখের কার্ণিশে গুজে দিলে পরগাছা সর্ষে ফুলের; রেটিনায় রেজু নদী বয়ে যায় ধীরে, ততদূর ভূকম্পন পরবর্তী ধ্বস্ত গ্রাম, বজ্রতুলি দিয়ে আঁকা বৈরী-বৈশাখ।

আসলে কি নিভে যায় আশার আলো সকল?

তুমুল তিমিরও পারে না জাগাতে বিচ্ছেদের বিপন্ন সুর; নাগাসাকি কি ভুলেনি যুদ্ধের স্মৃতি? হিরোশিমায় ফুল হয়ে ফুটছে জয়শ্রী জীবন। মোপালি, এসো আমরাও পুড়াই দূরত্বের খড় আকাঙ্খার আগুনে, আর প্রহর গুনি সম্ভাব্য সাক্ষাতের। জানোই তো ‘সম্ভাবনা’ শব্দটি বিচ্ছেদে বিদ্রোহী বরং ‘ম্ভ’ এরূপ পাশাপাশি বর্ণের বন্ধনে বিশ্বাসী। আর আত্মার আনন্তর্যে…

মোপালি, এখনি গুটিয়ে নিও না নিজেকে অ্যামিবার অবিকলে। শোনো, পুনর্মিলনের কোনো পূর্বলক্ষণ থাকে না।

বৃষ্টি

১.
বৃষ্টির ইল্শেগুড়ি প্রহারে পাখিটি
মেহগনির মগডালে স্থির -যেনবা মেইয়ারের মনুমেন্ট ।
ভীষণ ক্লেশে ককিয়ে ককিয়ে
আওড়াচ্ছে অতীত পাখনার সমৃদ্ধ ইতিহাস

শূন্যে বিচরণের কুশলতা
আর প্রথম মেঘ রমণের গল্প।

২.
বৃষ্টিকে ডাকিনি সেইদিন।
গন্তব্যের ফিতে জুড়ে সাথী ছিলো মেঘা
মলিন মুখবিবর! অনুতাপের অনু অনু তাপে

চেয়েছে আমারে ছুঁতে
কান্নার কলায় চেয়েছে ভাসাতে
প্রেমজ প্লাবনে।
পৃথক কাদায় না-জড়ায়ে
কৌশলে বাঁচায়ে নিয়েছি নিজেকে

চাহিদায় চাহিবামাত্র সমর্পিত নই আর …

সারাটা পথে মেঘার চাপাকান্না
আমিও ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাই
টলোমলো মনোবলে
হাঁটি কাছিমের ভঙ্গিমায়।

পথের পাঁচিলে কত শোকে জমাট হয়েছে

আরক্তিম কংক্রীট
তা-কি কোনো রিখটারে মাপা যায়?
কিংবা অন্যকোনো স্কেলে?
আমিও তেমন জমে যাই
প্রত্যাখ্যানের মতো অবহেলায়
হৃদয়ের হিমাঙ্কে জমে যায় বোহেমীয় ভাষা

মেঘার মায়াশ্রু
কিংবা বৃষ্টির কদর্যহীন কদমবুচি
কোনকিছুতেই ফেরে না সম্বিৎ
শুধু সম্মান ভেজার ভয়ে
প্রধান ফটক রুদ্ধ করি আঙিনার
তবু ওঠোন অবধি এসে
টানা চুরাশি মিনিট কান্নাধারা শেষে
একরকম অভিমান করেই ফিরে গেল
বৃশ্চিকা বৃষ্টি।।

রিভাইভ অফ রেভ্যুলেশন

স্মৃতির জলছাপে অনুবাদ হয় না আর বাঘের অবয়ব। ব্যাঘ্রচোলক পরে নিজেই হই কৃত্তিবাস। সমূহ শঙ্কায় টলিনি কখনও, বাধা-বাকশালে স্থির স্ট্যাচু। সতত বরণ করি সমুখ সমর। কোবিদ কৃষাণের মতো কর্ষণ করি মননের পলল দ্রোণ। রিভাইভ অফ রেভ্যুলেশনে চে’ হাসে, দিকপাশ দ্যুতি ছড়ায় তার শিরস্ত্রাণের ফুল।

অদম্য আষাঢ়

স্নিগ্ধ হাওয়ায় বাজে পাতার পিয়ানো। মিকাঈলের বিপরীতে পাল বেঁধে উড়ে কৃষ্ণমেঘ। উড়ন্ত মেঘের শার্সিতে সূর্যসত্ত্বা মুছে গেলে, অসম্ভব অস্থৈর্যে কাঁদে আকাশ। বেহুলার ভানে ভেজায় মৃণ্ময়-মাদুর। উর্বশীর কামার্ত বুকের ঢেউ নিয়ে জেগে ওঠে মুমূর্ষু নদী। স্মৃতিঘরে যুগপৎ জাগে বৃশ্চিকা বৃষ্টি। চোখ তার চিরসুপ্ত নদী, বিরহে বেজে ওঠে তুমুল। অনবদ্য আষাঢ়ে ভেসে যায় অতীত পৃথিবী আমার। কদম্বের দম্ভে দাঁড়িয়ে ঠায়, ভিজে যাই, সর্বস্ব ভাসাতে

ভাবি – অদম্য আষাঢ় কতটাই বা ভেজাতে পারে, যতোটা ভিজি চোখের জলে!

বোবা ভিখিরির গান

পা-হারা লোকটা পাহারা দেয় একজোড়া পাদুকা
রোজ দেখি এই শিল্পদৃশ্য, অফিস পাড়ায়
সমুখে থালার শূন্য, টাকাকড়ি নেই
হাত-পাও ছেড়ে দিয়ে পড়ে আছে কিছু হাহাকার
কিছু হা হা-ও ভেসে আসে পাশের ভিখিরির
তাহার স্বরবোধে
কৌতুহলের কাতুকুতুতে একদিন তার কাছে যাই
শুধাই কাহিনী, কিন্তু;
ঠোঁটস্য কারার কপাট ভাঙতে পারেনা বোবা ভাষা
আলজিব অন্ধকারে আটকে সমস্ত স্বর
ইশারাবনে হারাই, কংফুমান ভাষার
কিছুই বুঝিনি , জানাও হয় না কখনও–
লোকটা কী ভিক্ষা চায়?
টাকা? না-কি হারিয়ে যাওয়া পা?

পরিচিতিঃ 

ইয়ার ইগনিয়াস। কবি ও গদ্যকার। জন্ম ১৯৯০ইং  কক্সবাজারে। বর্তমান নিবাস মধ্যপ্রাচ্যে (সৌদি আরব)। প্রকাশিত বই: হারমিসের  বাঁশি (কবিতা)২০১৯ইং।

সম্পাদনা: ‘আদিঅন্ত’ ওয়েবম্যাগ।

 

এলিজা খাতুন-এর গুচ্ছকবিতা 

নিরাকার ব্যাধি

চতুর্পাশে ব্যাধির সাম্রাজ্য-বিস্তার;

সজনে গাছের বাকলে দলবদ্ধভাবে লেপ্টে থাকা

অজস্র সুয়োপোকার মতো বানিজ্য আর সুসজ্জিত-

বিছানা আকড়ে থাকা জীবেরা সামনে হাত বাড়িয়ে

পাঁচ আঙুলের বৈষম্য দেখায় –এ আর নতুন কী !

পাতা ঝরার মতো অপরিমেয় মৃত্যু, যাপনের নিদারুণ-

বিরুদ্ধ সময়- যাদের আবশ্যিক পুঁজি,

জীবনের আনাচে কানাচে যারা ছড়ায় বিদ্বেষ-বিষ

তাদের নাম-উচ্চারণ কই ?

তাদের নামে যুথবদ্ধতা কোথায় !

সমঝোতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে ভীষণ ভদ্রতায়

নিরুদ্বিগ্নতা উঠে যাচ্ছে সভ্যতার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে

অতিব নিরবে… নিরাকারে…

প্রতীক্ষা

নিস্তব্ধতা জুড়ে শুধু মেঘ ; নিঃশব্দ-গহীন জলে

দিনমান ভাসাই ছিন্নমূল নিজেকে

সময় এসে কখন বুনে গেছে

নিজের চতুর্পাশে শূন্যতার সংসার জানিনা

কথা না বলার মাঝে এত কথা থাকে

জানা হলো- একখানা জানালা, মেঘ, ফুল

আর প্রতীক্ষা আছে বলে। মৃত্যু থামার প্রতীক্ষা

এখনো কি আসেনি  সেই মহার্ঘ সময়-

অনভিপ্রেত মর্মঘাতী করুণ বিনাশ থামার !

কঙ্কাল

পাতা পচে গেলে মাটিতে তার শিরা উপশিরা

থাকে কিছুদিন কঙ্কালের মতো

আমাদের অতীত শীর্ণ ডাটার মতো জেগে আছে

কেবল পড়ে আছে বিগত দিনের স্মৃতিকথা হয়ে

হৃদয় কি কঙ্কাল হয় ! নাকি পুরোটা নিশ্চিহ্ন থাকে !

উত্তাপ খুঁজতে খুঁজতে হৃদয়  কেন পৌঁছে যায়-

দীর্ণ কোন পাঁজরাকাটিতে ?

কীসের দেনাপাওনায় গুঁড়িয়ে যায় স্বপ্নের কঙ্কাল !

যাপন 

জীবনের জোয়ার ভাটায় পতনে উত্থানে শীতল উল্লাসে

অনিশ্চয়তা ঘোরাফেরা করে ঘরের আনাচে কানাচে,

জানালায় দেখি-

বাইরে অদূরে সূর্যোদয়ের রং বদলানো মেঘ

সময়ের যাদুঘরে লড়াইয়ের অতীত আছে, ভূমি আছে

খুলি নিভৃত কবাট। স্বপ্নরা উঠোনে নামুক, সড়কে হাঁটুক

শেকড় ছুঁয়ে শিখর আঁকুক ; অথচ-

কবরের সুবিশাল নিশব্দতা, শ্মশানের থমথমে নির্জনতা

নেমে আসছে পাড়ায়…নগরে…

সংকুচিত হচ্ছে রক্ত প্রবাহিনী নালিগুলো

মুছে যাচ্ছে দিনের শরীর থেকে রৌদ্রের ভূমিকা

ফেরাতে পারিনা, ঠেকাতে পারিনা মহামারী

খাঁচার ভেতর দিন যায়, রাত যায়, সব যায়

লাউয়ের ডগা যত্নে যেমন ফেরানো হয় মাচার দিকে

আমার মগ্নতা দিয়েছি ইতিহাসের দিকে

চোখে শৈশবের স্বচ্ছ নদী, তীর্থ জেনেছি শস্যের ক্ষেত

বোধ রেখেছি মানচিত্রে, প্রণয় চেয়েছি-

ভাষার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ক্ষমতা দিয়ে

সঙ্গ চেয়েছি পূর্ণ মেধার সূক্ষতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে

নিষেধ মাড়িয়ে দুর্যোগে দুর্দিনে হাঁটতে শিখেছি

বৃষ্টির পরে ফসল বুনেছি বিরান প্রান্তরে

কিছু কিছু না-পাওয়া ফসল, না-পাওয়া ব্যথা

জমেছে বছরান্তে ; তবু নীরব থাকি পৃথিবীর বয়সে তাকিয়ে

ইদানিং ভেসে আসা শ্বাসকষ্টের কাতরধ্বনি-

দাঁড় করিয়েছে নিজস্ব উদাসীনতার বিরুদ্ধে

এখন প্রায়শ ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখাই

পিরামিডের মমির মতো স্মৃতির গায়ে

আমার এখন সবটুকু ক্ষণ স্মৃতিস্তম্ভে

প্রতিদিন তা স্পষ্ট হয় সূর্যের মতো

মৃত্যুর আগে জেগে ওঠে বুঝি বিস্মৃত সব স্মৃতি !

এখন রোজ কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকে সকালের দিকে

যে সকাল চাই- ‘নিশ্চিত শ্বাস নেবার সকাল’

প্রত্যাশাগ্রস্ত

এমন দিন আগে কখনো দেখিনি

বিষাক্ত কামোট কাটে জীবনের শেকড় বাকড়

বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি ; তবু একা গৃহবাসী

বন্দী মন অতীতে-স্মৃতিতে  ছুটে বেড়ায় অবাধ

এমন দিন আগে দেখিনি

পরস্পরের বাঁধন খোলার  মাতম

হাট-বাজারে আনাজপাতি উজাড় হওয়া খেলা

এমন দেখিনি- দিনের গভীরে অন্ধকারের পীড়াপীড়ি

মেঘ বিহীন আকাশ জুড়ে অবসাদের বাদল

দেখিনি- তীরে বাঁধা নৌকোর পাটাতন মাঝিহীন শুকায়

ঝুপড়ি-কোণে জেলের হাঁটুভাঁজে অপেক্ষা-প্রহর

শুকায় না তার দুর্দিনে ভেজা হাড়

দেখিনি কখনো প্রার্থনাগৃহে শূন্যের বিচরণ

কোনদিন আসেনি একলা থাকার বৈশ্বিক-সমন

দেখা বাকি আছে বাদাবনে মধুভরা চাক হাতে মৌয়ালের হাসি,

হৃদয়ের কার্নিশে জিরায়ে নেয়া চৈত্রের পাখি

শোনা বাকি আছে তুষের আগুন ভরা শানকির পাশে

নবজাতকের জন্মকান্না, সিঁকেয় ঝোলা হাঁড়ির গভীরে

স্বপ্নের দোলাচল।

পৃথিবীর সব ‘একা’ ফোঁড়ে ফোঁড়ে জড় হলে

একদিন শোনা যেতে পারে খাঁচা ভাঙা কোলাহল।

 

পরিচিতি

এলিজা খাতুন, ১৯৮১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অরুণবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মহানন্দা নদীতীরে বেহুলা গ্রামে পৈত্রিক বাড়ি, বাবা- মো: মাসদুল হক, মা- মোসা: মাসকুরা বেগম। খুলনা ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রথম লেখাপড়া শুরু। সর্বশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এসসি গণিত বিষয়ে পড়াশোনা। সাতক্ষীরা জেলা সদরে বসবাস। মানব-সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ঋশিল্পী’র হস্তশিল্প বিভাগে এক্সিকিউটিভ-এইচ.আর পদে কর্মরত।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :

নৈঃশব্দ্য ছোঁয়া জল, মধ্যরাতের খাম, ভাঙনকাল, শ্রাবণ জানালা, আরাধ্য পথের দিক, গহীনে দাহ, রোদমাখা চিঠি।

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ :

বর্গামাটি, ভাটির টানে, আগুনগোঁজা মাটি।

ইমেইল : alizasat335@gmail.com

 

পুলক বড়ুয়া-এর গুচ্ছকবিতা

স্বগতোক্তি
চলে যেতে পারি অনায়াসে বনবাসে
চলে যেতে পারি সন্ন্যাসে, সিদ্ধার্থ সেজে
কোন মন্ত্রমুগ্ধজাদুবলে
ফিরে আসি মুহূর্তেই
ভাবতেই চলে আসি
মনের অজান্তে
ফেরায় আমাকে ভোলায় আমাকে
ফিরিয়ে দেয় ঘুরিয়ে দেয়
কোন পিছুটান ধরে রাখে
কে সে পিছুটান ধরে ফেলে
সহসা গন্তব্যপথ থেকে ধাই
সহসা গন্তব্যপথ থেকে সরে যাই
এক লহমায় ছিনতাই করে
শূন্যতা সর্বস্ব করে
বুকে চেপে ধরে
টের পাই অমূর্ত-নির্লিপ্তি
নিঃশব্দে টানছে
কেবলি রুখছে
শূন্য পথ থেকে
নিভৃত এককে বসে ভাবছি একাকী
নির্জন-মোহন-নৈঃশব্দ-নৈঃসঙ্গ
কিছু কথা-মুখ-ছবি
ছায়া-মায়া-কায়া
নিটোল সাঁজোয়া বাহিনীর মতো
স্মৃতি-ব্যারিকেড হয়ে
কাঁটাতার হয়ে
অটল পর্বত
পারি না পেরুতে
পারি না মাড়াতে
বুকের অপর পিঠে খামচে ধরছে
চেনা ও অচেনা
জানা ও অজানা
পষ্ট ও অস্পষ্ট
সহজিয়া কথকথা
সহজাত অভ্যাস-কড়চা
ভালো-মন্দ জলহাওয়া
পরিচিত জলবায়ু …
গাছপালাতরুলতা
পথ-ঘাট-প্রান্তর—আজন্ম ঋণ
অপ্রকাশ্যে এক পা এগুই তো পিছুই দু’পা
কিছুতেই ইচ্ছে হলেই সটান পারি না বাড়াতে
আপাদমস্তক—তনু-মন
বিপুল প্রচলপন্থি
বহুধা বন্ধন-গ্রন্থি
বহুল জড়ায়
গড্ডালিকা-স্রোতকে উজিয়ে
আসতে-পেরুতে-বেরুতে সমস্যা
বাসনা হলেই
গায়েবি মায়াবী নেপথ্য-আওয়াজ
ব্যাকুল বাদন-ডাক
না-ফিরে পারি না
ফিরে দ্যাখি, ফিরে আসি
পুরনো অভ্যাসে
যদি চলে যাওয়া যেত
অথবা, যেতাম চলে
থাকতাম অন্যপ্রান্তে
অপর দূরত্বে
আসতাম অন্যরূপে, অন্যবেশে
সত্যিই এমত যদি হতো
আসিনি ফিরেও ফিরে
অধিকারহীন এ আমাকে
কোন অনধিকারে রাখতে ধরে,
তোমরা কী খুশি হতে
একটি আত্মার
এই অনাসক্ত আত্মনিবেদনে ?

প্রেম

আমি যে প্রেম করতে যাব

মূলতঃ জ্যোছনায় শূন্যে চাঁদটাকে

লটকে থাকতে দ্যাখেছিলাম …

জ্যোছনায়, পূর্ণিমায় ছাড়া অমাবস্যায়

আমি ঝুলন্ত চাঁদ দ্যাখিনি, ভাসমান চাঁদ দ্যাখিনি

দিনের বেলা বড় ম্লান, নিষ্প্রাণ, করুণ মনে হত

সে কী রাতের রানী—

এত সুন্দর ক্যানো তাকে মনে হত …

রাত যত বাড়ে তত ঘন হয়ে আসে

যেন পাশে আর পরাণে পশে

মরমে বিঁধে সুর কী সুরা লাগায় চাঁদের রোশনাই

আমি বদ হয়ে বধ হয়ে বুঁদ হয়ে যাই, পড়ে থাকি !

 

ক্যাম্পে

ক্যাম্পে হারিয়ে গেল

কিশোরীবেলা, সতীসাধ্বী প্রেম

অনাঘ্রাত যৌবন

আবালবৃদ্ধবনিতা

ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-কৃষক-মজুর—ধর্মবর্ণ

ওরা ধরে নিয়ে গেল

আমাদের ঘর ও বাহির

বাসা থেকে বাড়ি থেকে

রাস্তা থেকে অফিস থেকে

বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল

—না কেউ ফেরেনি

রাস্তায়, জমিতে, খালে বিলে, এখানে সেখানে

বাঙ্কারে, ক্যাম্পে

জীবন দিল, মরে পড়ে রইলো

না,

ওরা আমাদের যুদ্ধের, যুদ্ধ জয়ের, মুক্তিযুদ্ধের শহিদ

বীর, বীরাঙ্গনা

রণাঙ্গনের লড়াকু—অমর স্মৃতি, অমর শহিদ ।

মেঘবতী

আবার আষাঢ় আবার শ্রাবণ

আকাশ মুষলধারে টগবগিয়ে

উঁচুতে দুরন্ত কেশর ঝুলিয়ে

দুলছে মেঘঋতু

উড়ছে মেঘমল্লার

জলবতী মেঘবতী বাদন

বর্ষার কলতান-খরতান

পড়ছে শপাং শপাং বিদ্যুতের বেত

বৃষ্টির বল্লম

তড়িৎ-চাবুক

মেঘ গুড় গুড় মেঘ গুড় গুড়

আমি হাওয়ার পিঠে সওদা সোয়ারী করে দিয়েছি

প্রথম কদম ফুলের জিন

ঘনকালো মেঘের খোঁপায়

সাদা কালো উত্তরীয় গায়

বিরহী ছাড়া কিংবা

আশিক ছাড়া আর কেউ

মেঘের মুখের সকাশে

বিন্দু বিন্দু জলের কাছে কান পেতে

রিমঝিম রিমঝিম রিনিঝিনি শুনবে না

 

কিংবা শুনতে চাইবে না

প্রাবৃট, তোমার কথা

 

ফি বর্ষায়

বাহ্, এসে গেছেন !

একদম ! সোনায় সোহাগা ! খাপে খাপ !

কোনো কৈফিয়ত নেই !

 

হয়তোবা, ভুলেই গিয়েছিলাম

করোনা ক্রান্তিতে, নাগরিক-যান্ত্রিক ধন্দে

আজ আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবস …

আপনারই তো আসার কথা … এমন দিনেই তো …

সেটাই তো, স্বাভাবিক—

ওই তো, হাতে কদম ফুল…

ঝিরি ঝিরি …

… ঝুম ঝুম …

‌                         … রিনি ঝিনি …

তেরছা

খাড়া

 

বৃষ্টিঋতু

সৃষ্টিঋতু

ঝর্ণাঋতু

মেঘঋতু

কিন্তু, তার আসার আসল কাল কোনটি—

কেন, কোনো কালেই এল না …

আমার প্রিয়ে, বলুন তো !

আপনার প্রদত্ত আষাঢ় শ্রাবণ : জোড়ঘুঙুর :

আমার মনের নূপুর

এই বর্ণ-গন্ধ-ছন্দময়

সহজ-সরল নিমগ্ন নির্মাণ খাটিয়ে

এ কোন বাতাবরণে

বসে আছি, তাকিয়ে আছি

 

ফি বর্ষায় !

পরিচিতি

পড়াশুনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে সক্রিয় রাজনীতিতে অনিবার্য সখ্যতা । শেষাবধি সাহিত্য-সংস্কৃতিই সঙ্গী । বিচিত্র কর্ম-অভিজ্ঞতা । নিরন্তর উন্মুখ ।  ভালো লাগে : অরণ্য, পর্বত ও সমুদ্র ।    প্রিয় পছন্দ : সৃষ্টির স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য ।

প্রকাশিত গ্রন্থ : ওই পূর্বে রাঙা সূর্যে ( নিসর্গ, ২০০১ সাল ), পাঠেরা খেলছে মাঠে ( বেঙ্গল পাবলিকেশনস, ঢাকা, ২০১৮ সাল ) ।