You are currently viewing তিনটি কবিতা/ কামরুজ্জামান কামু

তিনটি কবিতা/ কামরুজ্জামান কামু

তিনটি কবিতা

কামরুজ্জামান কামু

নিখিলসুন্দরী

আমি কি ধানক্ষেত মাড়িয়ে চলে যাবো

হলুদ ঠ্যাং তুলে দুইটি শাদা বক

ডানার শব্দের আবেগে উড়ে যাবে

ডাকবে ব্যা ব্যা করে ছাগল ছানাটিও

আমি কি মূলধন হারিয়ে চলে যাবো

নিখিলসুন্দরী, তোমার সন্ধ্যায়

আমি কি আপ্লুত একটি কবুতর

বাকুম রব তুলে তোমাকে ডাকবো না

বাংলাদেশ বলে তোমাকে ডাকবো না

পদ্মফুল হয়ে পুকুরে ভাসবো না

আমি কি হাসবো না আহা রে হা হা করে

আমি কি দুপুরের ফড়িং ধরবো না

বলো তো হে নিগার, তোমার আকাশের

কিনারে ঘন হয়ে প্রকৃতিসম হয়ে

আমরা দুইজন বর্তমানকালে

জন্ম নিয়ে কেন জন্মদান করি

 

এ কার হৃদয়ের কাজল গ’লে যায়

আমাকে হত্যার তিমির আয়োজন চলছে। উন্মাদ

কাতেল তলোয়ার উঁচিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে। রক্তের

কণিকা-পানকারী পশুরা উল্লাসে চাটছে ব্যক্তিকে

ব্যক্তি-নির্যাস, ব্যক্তি-কল্পনা, ব্যক্তি-ছন্দের

প্রস্ফুটন। যেন ফুলের বিকাশের মুহূর্তকে আজ

শোণিতে ভরে দিতে সীমার প্রস্তুত। ধারালো তলোয়ারে

ঝিলিক-মারা রোদ ঠিকরে পড়ে ওই। এখানে এই নিচে

কণ্ঠনালীটার পাশে চুমার দাগ রয়েছে জননীর।

ছোরায় শান দেওয়ার শব্দে সচকিত বলগা হরিণেরা

ছুটছে। যেন এই ত্রস্ত বনতল ডাকাত-কবলিত

রাতের বুক থেকে আমাকে লুকাইতে চাইছে প্রাণপণে।

হত্যা-হাহাকার-হর্ষ-উৎসব! ঝালর-ঝাড়বাতি

শোভিত পৃথিবীতে সবুজ ধানক্ষেত, কবি ও কাকাতুয়া

এ বুকে দোল খায় ! হাত দে’ ধরে দেখি পিণ্ড কাঁপছে!

এ কার হৃদয়ের কাজল গলে যায় অন্ধ আর্তির

মতন। লাশকাটা ঘরের দরজায় আব্বা বসে আছে

আমার বয়সের চাইতে দীর্ঘ এ দুপুরে। শব্দের

ভিতরে শূন্যতা নীরব। নিরবধি নদীর কান্নার

শব্দ নাই যেন শঙ্খ বাজে নাই আযান শোনে নাই

মানুষ কোনোদিন আবেগে আপ্লুত হইতে পারে নাই

রক্ত খায় নাই নিজের শরীরের বীর্য অন্যকে

প্রদান করে নাই জাপটে ধরে। এই শাণিত তলোয়ার

আমাকে ফালি ফালি করবে কেটে কেটে এখানে এই নিচে

কণ্ঠনালীটার পাশে চুমার দাগ রয়েছে জননীর।

এই যে গোধূলির মোষের পাল যায় লালচে সূর্যের

সামনে দিয়ে আজ হত্যাকাণ্ডের প্রাগমুহূর্তের

যেনবা একবার একটু-জ্বলে-ওঠা ছোট্ট আর্তির

মত। কে যেন হুঙ্কারের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যাওয়া

দুমড়ে দেশকাল মুচড়ে ফেলে দেওয়া মানব কঙ্কাল

দু’হাতে বুকে নিয়ে কাঁদছে। হৃদয়ের কাজল গলে যায়

বঙ্গোপসাগরে লবণ-ঢেউ উঠে আস্তে নেমে যায়

নিজেরই গহ্বরে। টিনের কৌটার মতন ভেসে থাকে

আমারই কল্পনা-প্রসূত আবেগের তীব্র ঘূর্ণিতে

জন্ম নেওয়া ওই মুক্তা। ঝিনুকের উষ্ণ গহবরে

জন্ম নিতে নিতে গলিত মরে-যাওয়া মুক্তা। উজ্জ্বল

পারদ-বিগলিত-রাতের কিনারায় বেহালা বাজানোর

করুণ প্রস্তাবে তুমি কি জাগো নাই, বলো তো, অব্যয়?

তোমাকে শেষবার দেখেই মরে যাব। গলায় তলোয়ার

বসাবে জল্লাদ, আখেরি ইচ্ছার অপারগতা হয়ে

মৌন লতাগুলি গড়িয়ে পড়ে যাবে মাটিতে। জামপাতা

নীরবে ঝরে যাবে। আর্ত কলরব থামিয়ে ভোরবেলা

বাঁশের বাগানের পাখি ও গুঁইসাপ তাকাবে বিস্ময়ে

হত্যাদৃশ্যের বরফ-হিম-ছায়া সরিয়ে রক্তের

ধারায় মিশে যাবে অর্ধবাক হয়ে অন্ধ জন্মের

আর্তনাদ। তবু আমাকে মনে রেখো। দু’চোখে কাজলের

আবার টান দিও। আবারও গলে যাবে। আবেগে থরথর

মদিরা-বিজড়িত নিনাদে ফেটে-যাওয়া রাতের তারাগুলি

অধীর পৃথিবীকে আলিঙ্গন দিতে নামবে ধীরে ধীরে।

আদরে ভরে দিয়ো কাজল-কালো রাত। দূরের যাত্রীকে

বাহুর বাহানায় দু’দিন ধরে রেখো। বসন্তের গান

ক্ষণিক ভুলে যাওয়া কোকিল পাখিটাকে কেউ তো দেখে নাই

পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির মাটিতে তির্যক

নামার দৃশ্য তো মানুষ দেখে নাই হত্যা-উত্তর

জৈব-ধর্মের উত্তেজনাগুলি মলিন হয়ে যেতে

কেউ কি দেখে নাই লোহা ও মানুষের যুদ্ধে পরাজিত

লাশের পাহাড়ের উপরে শেয়ালের খিদায় কাতরানো

করুণ চোখ দুটি! তবুও হত্যার তিমির আয়োজন

তবুও রক্তের পিপাসা-জাগ্রত-শাণিত-লোহা দিয়ে

তৈরি তলোয়ার আমাকে কোরবানি করবে উল্লাসে

হঠাৎ থমকানো ঘূর্ণি-বাতাসের বুকের ধূলিকণা

পড়বে ঝরে। এই সুরত মুছে দিয়ে সূর্য ডুবে যাবে

তুলসিতলে জ্বেলে নীরব মোমবাতি আম্মা কোরানের

আয়াত তেলাওয়াত করবে। মর্মের অশ্রুবিন্দুর

মতন টুপটাপ ঝরবে দুনিয়ায় বেহেস্তের ফুল

দেবতা দরবেশ করবে কোলাকুলি। কণ্ঠনালীটায়

আম্মা চুমা খাবে। আমার দুই চোখে কাজল টেনে দিয়ে

নিজের আয়নায় নিজেরই মুখ দেখে পারদে গলে যাবে

মানবজন্মের দীর্ণ দুই পার। একটু পরে তার

কোলের শিশুটিকে জবাই করা হবে। মাংস রান্নার

মশলা বাতাসের লুব্ধকারী ঘ্রাণ জাগাবে মানুষের

ভিতরে মানুষের হত্যাকারী প্রাণ, হিংসা, রৌরব

রক্ত-কণিকার গন্ধে মানুষের মাতাল তলোয়ার

তুলবে ঝঙ্কার। পথের মাঝখানে হারানো সন্তান

আবার তুলে নিতে মায়ের বুকটান ছিটকে পড়ে যাবে

মানুষ দৌড়াবে নিহত মানুষের চামড়া ছেদ করে

মাংস ভেদ করে রক্ত পান করে অশ্বারোহীদের

চাবুকে চিৎকার করতে করতেই পাহাড়চূড়া থেকে

ধাবিত পাথরের ধাক্কা খেয়ে তবু মানুষ দৌড়াবে

প্রেমের পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে তপ্ত পৃথিবীর

আগুনে পোড়া হৃৎপিণ্ড ছুঁড়ে ফেলে ধ্বস্ত মানুষেরা

তবুও দৌড়াবে। সকালে সূর্যের সামনে ফেলে দিয়ে

কাতেল তলোয়ার আমাকে কোরবানী করবে। রক্তের

ফিনকি-লাগা-মেঘ কিছুটা উড়ে গিয়ে ঈষৎ থমকাবে

শুভ্র শরীরের রক্ত ফেলে দিয়ে আবারও উড়ে যাবে

আকাশে আপনার আকার বদলাতে। মাটির পৃথিবীতে

মহিষ ভেড়া আর গরুর পাল যায় লম্বা সার বেঁধে

রক্তমাখা ঘাস তারা তো খায় নাই। বুলেট বিঁধে যাওয়া

বাঘের গোঙানির মতন মিনতির সামনে শিকারীর

চোখের দুই কোলে রক্ত লাল হয়ে কখনো ওঠে নাই

পাতা ও বাতাসের নিবিড় সংলাপ সীমার শোনে নাই

গলায় তলোয়ার চালানোর উল্লাসে রজনী চৌচির

ব্যথায় ফেটে গেছে। গড়িয়ে পড়ে গিয়ে কে যেন মরে গেছে

সুরত মুছে দিয়ে কে যেন চলে গেল কী যেন চলে গেল

কখনো আসে নাই তবু সে মরীচিকা সুদূরে চলে গেল

দিগন্তের কালো গ্রামের ওইপারে দিনের অন্তিম

আলোর রেশটুকু ডানায় তুলে নিয়ে যে পাখি উড়ে যায়

তার এই চরাচরে কখনো খুলে-পড়া ছোট্ট পালকের

স্মৃতি কি মনে থাকে! গোপন হত্যার ছোরায় হাতছাপ

নিজেরই অগোচরে কেউ কি রেখে যায় একটু কেঁপে-ওঠা

আবেগে থরথর নিনাদে ফেটে-যাওয়া রাতের কিনারায়!

 

আমাকে এবার পিছমোড়া করো

আমাকে এবার পিছমোড়া করো

চোখ বেঁধে ফেল প্রভু

আমি কোনোখানে কোনো মানুষের

হৃদয় দেখিনি কভু

আমি শুনি নাই কম্পিত রাতে

কোনো প্রহরীর হাঁক

আজি বসন্তে কালো কোকিলের

তীক্ষ্ণ মধুর ডাক

অন্ধকারের বুক থেকে এনে

চয়িত শব্দমালা

বসিয়েছি শুধু কবিতার দেহে

উদ্গীরনের জ্বালা

আমাকে এবার গুলি করো প্রভু

পাহাড়ে ও সমতলে

আমার শরীর লুটায়ে পড়ুক

কালো যমুনার জলে

আমিই সালাম আমি বরকত

আমি রফিকের ভাই

লেখামাত্রই আমার কবিতা

লাল হয়ে গেল তাই

এই মাঠঘাট এই বন্দর

এই মানুষের সারি

হে অবদমিত পৃথিবীর বুকে

উন্মুল নরনারী

এই বুকফাটা কান্নার রোল

আকাশপাতাল ধ্বনি

নিজ হাতে আমি খুবলে তুলছি

নিজের চোখের মনি

শত গোয়েন্দা দৃষ্টির ফাঁদ

সহস্র বন্দুক

নস্যাৎ করে সম্মুখে এসে

পেতে দিয়েছি এ বুক

আমিই সালাম আমি বরকত

আমি রফিকের ভাই

লেখামাত্রই আমার কবিতা

লাল হয়ে গেল তাই

পৃথিবীর বুকে আমি সেই কবি

আমি সেই চন্ডাল

আমি সেই লোক কালো ও বধির

আমার রক্ত লাল

আমি সন্ত্রাসী আমি ধর্ষক

আমি ধর্ষিত নারী

আমি তোরই ছেলে বুকে তুলে নে মা

ফিরেছি নিজের বাড়ি

হৃৎপিণ্ডের ঢিপঢিপ ধ্বনি

চঞ্চল রক্তের

ফিনকির মত ছিটকে বেরিয়ে

দেহে ফিরে আসি ফের

করি লেফটরাইট গুম করি আর

গুম হয়ে যাই নিজে

শুষ্ক রজনী কাষ্ঠ দিবস

ঘেমে উঠে যায় ভিজে

নিজের রক্ত নিজে পান করি

নিজ দংশনে নীল

নেশায় মত্ত মদের পাত্র

হয়েছে আমার দিল

আমাকে তোমার মনোরঞ্জনে

রঞ্জিত রাত্রির

কিনারায় নিয়ে ধর্ষণ করো

ধ্বস্ত করো হে নীড়

তনুর মায়ের শূন্য বুকের

মহাশুন্যতা হয়ে

বোবা পৃথিবীর বায়ুসম আমি

চিরকাল যাব বয়ে

কালোত্তীর্ণ কালের কান্না

হে মহাকালের মাটি

আমি রবীন্দ্র আমি নজরুল

ধরণীর বুকে হাঁটি

কেঁপে কেঁপে উঠি শিহরিত হই

পায়ের তলার ঘাসে

মরা কোষগুলি জৈবপ্রেষণে

চিৎকার করে হাসে

সংক্ষুব্ধের সংহার সম

শঙ্কিত এই রাতে

জন্ম দিয়েছি কোরবানি তোকে

করব রে নিজ হাতে

আজানের ধ্বনি ভেসে এলো ওই

পাখিদের কলরবে

একটিমাত্র গুলির আঘাতে

আমার মৃত্যু হবে

একটিমাত্র চিৎকার আজ

করব ভূমণ্ডলে

আমি বরকত সালাম রফিক

মরব মায়ের কোলে

আমাকে এবার পিছমোড়া করো

চোখ বেঁধে ফেল প্রভু

আমি কোনোখানে কোনো মানুষের

হৃদয় দেখিনি কভু

শুধু যুদ্ধের গোলা-বারুদের

শুধু হিংসার বাণী

প্রলয়ঙ্করী পৃথিবীতে কাঁপে

বেদনা-লতিকাখানি

শেষ নিশ্বাস এতো ভারী কেন

অসহ জগদ্দল

চারিদিকে মম ঘোরাফেরা করে

নায়কের মত খল

চারদিক কেন চেপে আসে আরও

চারিদিকে বন্দুক

গুলির শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে

বাংলাদেশের বুক