You are currently viewing তাবিজ/ সাদাত সায়েম

তাবিজ/ সাদাত সায়েম

তাবিজ

সাদাত সায়েম

ছেলে তিনটা ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত, লজ্জিত।বাসে সারারাস্তা তারা ছিল চুপচাপ,  কেউ  কোন কথা বলছিল না। তাদের ভয় ছিল যে কথা বললেই বাসের লোকজন আঁচ  করে ফেলতে পারে তারা কোথায় আর কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। তারা যে  পীর  সাহেবের কাছে যাচ্ছিল তিনি থাকতেন তাদের বাড়ী থেকে কমসে কম ত্রিশ মাইল দূরে। কিন্তু তাদের সমস্যার ভয়াবহতার কাছে ত্রিশ মাইল দূরত্ব তাদের কাছে মনে হয়েছিল তেমন কিছু না। স্থানীয় হুজুর, যাকে এলাকাবাসী মাটির মসজিদের ইমাম হিসাবে চিনতো, তাদেরকে পরামর্শটা দিয়েছিল। ছেলে তিনটা তাদের সমস্যা সমাধানে প্রথমে মাটির মসজিদের ইমামকেই ধরেছিল আর হুজুর তাদেরকে তাবিজও দিয়েছিল, কিন্তু তাদের স্বপ্নে পরিচিত-অপরিচিত  নারীদের আগমন এবং ফলশ্রুতিতে প্রায় রাতেই তাদের লুঙ্গি ভিজে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণে তারা আবার হুজুরের ধারস্থ হলো। স্থানীয় হুজুর তাদেরকে বলল: বাবারা, আপনাদের সমস্যার সমাধান আমার হাতে হোক, আল্লাহপাক মনে হয় এমনটা চান না। আপনারা বরং বড় হুজুরের কাছে চলে যান।

উনার   উছিলায় আল্লাহ্পাক আপনাদের শেফা দেবেন।তবে, বাবারা, টাকা-পয়সা একটু বেশি করে নিয়ে যাবেন; আমি তাবিজের জন্য যা নেই তার তুলনায় বড় হুজুরের হাদিয়া অনেক বেশি। তিনজনের মধ্যে রোকনের সমস্যাটা ছিল একটু জটিল। পরিচিত-অপরিচিত নারীরা স্বপ্নে আনাগোনা শুরু করার পর থেকে তারা  তিনবন্ধু নিজেদের মধ্যে এই বিষয়ে যখন প্রথম কথা বলল তখনই তারা সিদ্ধান্ত করলো   যে তারা আসলে খারাপ হয়ে গেছে।তারা আবার ভালো হতে চেষ্টা করবে। তবে উপস্থিত মুহূর্তে তাদের দরকার কোন একটা দাওয়াই যা দিয়ে রাতের উৎপাত ঠেকানো যায়। এদিকে এমন পরিস্থিতির ভেতরে রোকনের জটিলতা আরো বেড়ে যায়। জটিলতা শুরু হয় এইভাবে: রোকন একরাতে স্বপ্নে দেখে তার সামনে  এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। সে ঠাহর করতে পারে না নারীটি তার পরিচিত নাকি অপরিচিত।

নারীটির শারীরিক গঠনের মধ্যে এমন তীব্র আকর্ষণীয় কিছু ছিল যা স্বপ্নের ভেতরেই রোকনকে সন্ত্রস্ত করে তুলে। নারীটি তার ডানহাতের আঙ্গুল একত্রিত  করে করাতের মতো নাভির ঠিক উপরে ধরে জানতে চাইল রোকন তার শরীরের কোন্ অংশটুকু চায়— নাভি থেকে নিচের অংশটুকু নাকি নাভি থেকে উপরের অংশটুকু।পরপর তিনরাত সে একই স্বপ্ন দেখে।তৃতীয় দিনের স্বপ্নে সে নারীটিকে তার উত্তর জানাতে পারে।রোকন নারীটিকে জানায় যে সে আসলে নাভি থেকে নিচের অংশ কিংবা        নাভি  থেকে উপরের অংশ কোনটাই চায় না, সে তার পুরো শরীরটাকেই চায়। ঝামেলা এখানেই চুকে যেতে পারতো।কিন্তু তা আর হয় না!  কয়েকদিন পর রোকন আবার স্বপ্নে ঐ নারীটিকে দেখে। নারীটি বলল: তার পুরো শরীর সে চায় ঠিক  আছে, কিন্তু তার ঠোঁটে যে একটা মুচকি হাসি বিছানো আছে আর চোখে যে একটা বাঁকা চাহনি আছে সেসব সহ রোকন তাকে চায় কিনা।এর উত্তর রোকন নারীটিকে দিতে পারে না, কারণ ঐ রাতের পর ঐ নারী রোকনের স্বপ্নে আর আসে না, তবে  অন্যান্য  পরিচিত-অপরিচিত নারীদের আনাগোনা অব্যহত থাকে।তার দুই বন্ধুর অবস্থা  অবশ্য ততটা জটিল ছিল না। কিন্তু মনু তার বাবার কাছে একদিন ধরা পড়ে যায়। মনুর বাবা কী জানি খুঁজতে গভীর রাতে তার ছেলের রুমে ঢুকে লাইট  জ্বালায়, আর মনুর ঘুম ভেঙে যায়।জেগে উঠেই মনু বুঝতে পারে তার লুঙ্গির সামনের অংশে  অনেকটা জায়গা ভেজা। সে ঐ অংশটুকু লুকাতে চেষ্টা করে কিন্তু ততক্ষণে মনুর বাবার চোখ চলে যায় তার উঠতি বয়সের ছেলের লুঙ্গির দিকে।  তিনি মনুর দিকে  এমন এক চোখে তাকান যাকে কেবল ভয়ানক অপরাধীর দিকে কোন মানুষের দৃষ্টির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এই ঘটনার পর রোকন ও মনু তাদের তৃতীয়  বন্ধু মিজুর সাথে আলোচনা করে তৎপর হয়ে উঠে কিভাবে এই বিপদ থেকে আশু বের হয়ে আসা যায়।

বাসটা রোকনদের যেখানে নামালো সেখান থেকে বড় হুজুরের বাসস্থান কমছে কম দুই কিলোমিটার দূরে ছিল। বাস থেকে নেমে তারা ভাবছিল হেঁটেই চলে যাবে বড় হুজুরের দরবার শরিফে, তাহলে কাউকে বলতে হবে না তারা কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু রোদ উঠে গিয়েছিল চড়া আর তাদের ক্ষুধাও পেয়ে গিয়েছিল বেশ।

— বাবারা, আফনেরা কই যাইবাইন?

বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাচালক ছেলে তিনটার কাছে তাদের গন্তব্য জানতে চাইলে প্রথমে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তবে তারা রিকশাচালককে তাদের গন্তব্যের কথা জানালো।

— ও, বড় হুজুরের টাইন! কিন্তু তেনার ত আইজ তিনদিন অয় মওত অইচে।

এই দুঃসংবাদে রোকনরা থমকে গেল। এখন তাদের উপায় কী হবে!

প্রথমে তারা তিনবন্ধু ফিরে যাবার চিন্তা করেছিল, পরে তারা মত পরিবর্তন করল কারণ রিকশাচালকের পরের কথাগুলো তাদেরকে খানিকটা আশস্ত্ব করলো। তারা ভাবল হয়ত কোন একটা ব্যবস্থা হবে। রিকশাচালক জানালো যে বড় হুজুরের বড় ছেলে যিনি বড় সাহেবজাদা নামে পরিচিত তিনি গদ্দিনশীন পীর হয়েছেন, অর্থাৎ তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ছেলে তিনটা ভাবলো বড় হুজুরের ছেলের  কাছ থেকে যদি তাবিজ পাওয়া যায়, তাহলেও নিশ্চয়ই কাজ হবে যেহেতু তিনি গদ্দিনশীন হয়েছেন।তারা রিকশায় উঠে বসল।

তিনবন্ধুর মধ্যে রোকন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে স্বপ্নদোষ সংক্রান্ত নতুন এক জটিলতায়  জড়িয়ে পড়ে। না, তারা তিন বন্ধু — সে, মনু ও মিজু অনেক আগেই তাবিজ পরা ছেড়ে দিয়েছিল কারণ তারা পরে জানতে পেরেছিল যে স্বপ্নদোষ একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার! বয়ঃসন্ধিকালে কম-বেশি এই অভিজ্ঞতা শুরু হয়। আস্তে আস্তে এর প্রকোপ কমে যায়, তবে  একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না। কিন্তু একরাতে রোকনের বিশ্ববিদ্যালয় হলের রুমমেট তাকে  ফিসফিস করে বলো:  বন্ধু, জানো, আমার না স্বপ্নদোষ হয় না! রোকন অবাক  হয়ে জানতে চায়: কখনও হয় নাই? রুমমেট স্বর আরো নিচু করে জানালো— না, কখনও হয় নাই। সে রোকনকে তার গলায় ঝুলানো তাবিজ দেখায়। বলে যাতে তার স্বপ্নদোষ হয় সে জন্য এক হুজুরের কাছ থেকে তাবিজ নিয়েছে।

কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না! রোকন তার রুমমেটকে কোন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করার কথা বলল। তার পরামর্শে রুমমেট ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার কিছু  পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রুমমেটকে জানায় তার কোন যৌন সমস্যা নেই।

এইভাবে এক এক করে সবার সমস্যার সমাধান হতে থাকে, কিন্তু রোকনের  স্বপ্নসংক্রান্ত সমস্যার আর সমাধান হয় না। কারণ যে নারী তাকে প্রশ্ন করেছিল তার ঠোঁটে বিছানো হাসিআর বাঁকা চাহনিসহ তাকে রোকন চায় কিনা সে তার  স্বপ্নে আর আসে না। ফলে সে উত্তর দিতে পারে না।

রোকন তার উত্তর গুছিয়ে রাখে, উত্তর শুনতে সেই নারী আর আসে না! কিন্তু রোকনের মনে সন্দেহ ছিল দিনের বেলা গুছিয়ে রাখা উত্তর স্বপ্নে কাজ করে কিনা।এদিকে তার বয়স সন্দেহাতিত ভাবে বাড়তে থাকে। তবে আচমকা একটা ঘটনা ঘটে যা রোকনকে বহুকাল-আগে-দেখা স্বপ্নের জগৎ থেকে বের করে নিয়ে আসে।  সে স্বপ্নে-দেখা নারীর দেখা পেয়ে যায় তার অফিস বিল্ডিং-এর অপরিসর এক করিডরে। প্রায়-অপরিচিত সেই নারী তাকে দেখে বাঁকা চোখে আর তার ঠোঁটেবিছানো থাকে হাসি! রোকন এক ঝটকায় স্বপ্ন থেকে বের হয়ে যায়। তীব্র সুন্দরের সামনে এইবার সে বাস্তবে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

সে দেখে নারীটির উদ্ধত গ্রীবা থেকে সাহস সৌন্দর্য হয়ে ঝরে ।