You are currently viewing ঢেউয়ের বুকে রক্তের দাগ || রাজিয়া নাজমী

ঢেউয়ের বুকে রক্তের দাগ || রাজিয়া নাজমী

ঢেউয়ের বুকে রক্তের দাগ

রাজিয়া নাজমী

ছয় সাত বছর বয়সের পোলাপান থাকলেও কানকথা শুনে তার একটা অর্থ করার বুদ্ধি সেই অল্প বয়সে ঠিকই হয়ে যায়। ছোটবেলার সেই কানকথা বোধ হয়ে সবারই আমরণ মনে থেকে যায়। তবে বড় হতে হতে অস্পষ্ট কথাগুলো একসময় স্পষ্ট হয়ে যায়। জামানের কাছেও একসময় অল্প বয়সের অস্পষ্ট বিষয়গুলির কারণ এবং ফলাফলগুলি স্পষ্ট হয়ে গেছে।

কত বয়স ছিল তার? সাত আটের মাঝামাঝি? বড়দের জটলা দেখলে কৌতহলি হয়ে ওঠার জন্য একদম মোক্ষম বয়স তখন। জামানের মনে আছে সেই সময় কারো আলাপেই জমিজমা , মামলা মোকদ্দমা, এমনি কী কোনো বাড়ির মেয়ের এখনই বিয়ে হওয়া দরকার সেসব ছিলো না। ১৯৭১ সনে শীতের মৌসুম পার হতে না হতেই, যুদ্ধ শুরু অইছে, এই কথাটাই কেবল কানে আসত।
বাড়িতে থমথম ভাব। বাবার চিন্তিত মুখ। মা এমন চুপচাপ হয়ে গেলো যে কাছে যেতেও তার ভয় লাগতো। চারপাশের সবকিছুতেই কেমন অজানা ভয় ভয় ।

কিছু একটা মারাত্মক ঘটবে এটা বুঝে গেলো যখন মা আঁচলচাপা দিয়ে তাঁর বড়ছেলের নাম নিয়ে চোখ মুছতে শুরু করলো। সবকিছু না বুঝতে পারলেও এইটুকু বুঝেছে, তার ভাইজান আর যুদ্ধের মধ্যে একটা কোন ব্যাপার আছে।

স্কুলেও যুদ্ধ যুদ্ধ – ঢাকা শহর, এসবই স্যারদের আলাপের বিষয় থাকলেও যুদ্ধের কারণে স্কুল ছুটি দেওয়ার কোন খবর ছিল না। তাতেও কিছুটা অবাক লাগতো – তাহলে যুদ্ধ কি শুধু শহরেই হয়?

জামান আর ওর বন্ধুরা বাড়ির পুকুরের পানিতে চাড়া ছুড়ে ব্যাঙ লাফানো খেলা খেলতো আর যুদ্ধ নিয়ে যে যার শোনা কথা নিয়ে আলাপ করতো। বড়দের মত তাদেরও একটা জটলার দল হয়ে গেলো। কারো যুদ্ধ দেখার ইচ্ছা হতো। কেউ কানকথা শুনে তার অর্থ না বুঝেই বুক ফুলিয়ে বলতো, গ্রামেও যুদ্ধ লাগবে আনে।
পোলাপান ছিলো বলেই হয়তো যুদ্ধের ফলাফলের আতঙ্ক ওদের হতো না।
জামান বড়দের মুখের শোনা কথা – শহরের ব্যাবাক মানসেরা নাহি পায় আইড্ডা গ্রামে আইতাসে- এই খবরটা বন্ধুদের জানালেও মনে মনেই বললো, তাইলে ভাইজান কেন গ্রামে আইসসা পড়ে না।

জামান পরিষ্কার কারণ না বুঝলেও, বুঝতো -ভাইজানরে নিয়ে বাবা মায়ের ফিসফিস কথা স্কুলের কাউকে বলা যেমন যাবে না, খেলার সাথিদের কাছেও না।
মায়ের কান্নায় বাবার একটা কথাই কানে গেছে, তোমার পোলা এলহা মুক্তি না। মুক্তিফৌজে সে এলহা যায় নাই। আরো বাপমায়ের পোলারা গেছে। কাইন্দ না। দোয়া করো জানি ফিররা আয়।

জামান তখন ক্লাস টু-তে পড়ে – মেঘনা নদীর পাড়ে তাদের ডাহুকডাঙা গ্রামের স্কুলে। ক্লাসে তারও যেমন মন বসতো না , স্যারদেরও তেমন পড়াবার আগ্রহ নেই না। শুধু যাওয়া আসার নিয়মের মধ্যেই আটক সবাই। যেন এক ভয়াবহ অবধারিত দিনের অপেক্ষায় বসে থাকা।

তবে জামানের অপেক্ষা ছিল একটাই, একজনের জন্য। তার চিন্তার কথা বড়রা টের না পেলেও; স্কুলে, মাঠে, নদীর পারে বাড়িতে – সারাদিন তার মাথায় খালি একটা কথাই বাজতো – ‘যেন ফিররা আসে’।

পাঁচ বছর বয়স হতেই সে জানতো আল্লাহ্‌ আসমানে থাকে- তাই সকাল সন্ধ্যা সে উপরে তাকায়ে বলতো ‘ আল্লাহ আমার ভাইজান যেন ফিররা আয়। আর সেই সাথে মুক্তিফৌজ দেখতে কেমন তার একটি চিত্র আঁকার চেষ্টা করতো।

মাস গেলো না ভাইজানের মুক্তিফৌজে যাওয়ার, বরিশালের এই ডাহুকডাঙা গ্রামেও মুক্তিযুদ্ধের আগুনের হল্কা আসতে লাগলো।
বাবা ভাইজানের সকল নিশানা স্যুটকেসে তালা-চাবি দিয়ে মানুষের কবরের মত কবর দিলো উঠানের একপাশে। বাবার শুকনো মুখ দেখে অজানা ভয় হতো। ভাইজান ফিররা আইবে তো !

কেন এই যুদ্ধ তা না বুঝতে পারলেও মাঝরাতে দূর থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে শুনতে মায়ের আফসোসের কথা সে নিজেও বলতো – এ ক্যামন যুদ্ধ নিজের দ্যাশের মানুগো নিজেরাই মারে।

দিন যায় আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়া কথা কেবল বারে আর বারে। দিনের বেলায় বারান্দায় মুরুব্বীদের গোলবৈঠক হলেও সবাই যেন চট জলদি বৈঠক ছেড়ে যাবার জন্য তৈরি থাকে । আলাপের মধ্যে থাকে চারটি কথা – শেখ মুজিব আটক, ইন্ডিয়া যাওয়া , মুক্তিবাহিনী, রাজাকার। কদিন পরে আলাপে আরো একটা কথা বাড়লো -মাইয়াগো ইজ্জত!

মা ছাড়া তাদের বাড়িতে আর কোন মেয়ে না থাকায়, বাবা মেয়েছেলের ইজ্জত কথা শোনা মাত্র বলে উঠলো – আল্লাহ্‌ একদিকে বাঁচাইছে। কথাটা বলেই বাবা চারদিকে তাকায়ে মাথা নিচু করে ছিলো। বাবার এই কথার পিঠেই কে একজন বলে উঠলো, কেয়ামত নজদিক। মোরাও এহন এয়ানাফছি শুরু হরুম। হে যে এই কতা কইলো, ভাইডি এয়া হেইডারি আলামত । আমনেরা মনে কলম কিছু ধইরেন না। দোয়া করেন মোগো হক্কলের মাইয়াগো ইজ্জত ঠিক থাহে।

বারান্দায় বসে জামান লাটিম ছুঁড়তে ছুড়তে মাইয়াগো ইজ্জত কথাটা আবার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখে তার করুণা বুবু স্যুটকেসে কাপড় রাখতে রাখতে চোখ মুছছে। তাকে দেখেই কোলের মধ্যে নিয়ে বললো, এই চিডিহান তোর ভাইজান ফিররা আইলে দিস। আমরা ইন্ডিয়া চইল্লা যাইতাছি । কবে আইতে পারমু জানি না ।
অনেকক্ষণ করুণাবুবুর কোমর ধরে থেকে পকেটে চিঠিটা ঢুকাতে ঢুকাতে বলেছিলো, ভাইজান ফিররা আইব। তুমিও আবা।

জামান এখনও ভাবে, অতটুকু বয়সে কি করে বলেছিলো এমন আশ্বাসের কথা। বুবু তার মাথায় চুমু দিয়ে বলেছিল – আল্লাহ্‌ যেন তোর কতাডাই ফলায়।

সেদিন মাথায় করুনাবুবুর চোখের পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাড়ি ফিরে আসতে আসতে মনে একটা কথাই ছিলো – মাইয়াগো ইজ্জত – করুনাবুবুর ইজ্জত । ইজ্জত কি তা সে জানতো না। থাকলে ভালো না গেল ভালো তাও সঠিক ছিলো না । যা শুনেছিলো সেই অতটুকু আল্লাহ্‌র কাছে চেয়েছিলো – আল্লাহ্‌ করুণাবুবুর ইজ্জত!

চারদিক দিয়ে মেঘনা নদী ঘেরা ডাহুকডাঙ্গা গ্রাম – প্রথমদিকে আর্মিদের জন্য ঘাঁটি করা খুব সুবিধা ছিল না। ফলে খুব সহজেই মুক্তিবাহিনীর আখড়া হয়ে গেলো। আখড়া হলেও এদের দেখা যেতে না। জানতে চাইলেও কেউ তাদের ঠাঁই ঠিকানা বলতো না।
বাবা নামাজে বসে দুইহাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে দোয়া করতেন, আল্লাহ্‌ মুক্তিদের হেফাজতে রাইকখো।
যে কারণেই হোক মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মুক্তি বলা চল ছিলো।
বাবার সাথে মনে মনে সেও বলতো, আল্লাহ্‌ মুক্তিদের হেফাজতে রাইকখো। । কিন্তু ঠিক কাদের জন্য বলতো বুঝতো না।

মা উঠতে বসতে নামতা পড়ার সুরেই বলতো, মাবুদ মোগো গ্রামে আর্মি মানু জানি না আহে-মাবুদ মোর ছাওয়াল জানি ফিররা আহে।

মায়ের দোয়ায় হোক আর যে কারণেই হোক গ্রামে আর্মিদের ক্যাম্প হলো না। তবে তা না হলেও -রাজাকার- নাম ছড়ায়ে গেলো রাতারাতি।
জামানের অবাক লাগতো নিজেদের চাচামামাদের এমনকি তার ভাইজানের কাছের বন্ধুদের দেখলে মা-বাবা চুপ হয়ে যেত।

রাজাকার মানে কি? একদিন সাহস করে মা’কে জিজ্ঞাসা করতেই মা শুধু বলল, অরা খারাপ কাম হরে । জামান, বাবা অরা বোলাইলে ধারে যায়িও,তয় কিছু কইও না।

সেদিন মাথা নেড়ে না করলেও ,ওদের দেখলে কেমন রাগ লাগতো। মনে মনে গালি দিতো –কুত্তা

গ্রামের স্কুলে রাজাকার ক্যাম্পে বন্ধুক নিয়ে বসে থাকা চেনামুখ তার কাছেও যেন অচেনা লাগতে লাগলো।
বাড়ি বাড়ি থেকে মুরগী,ডিম, সবজী নিয়ে যেত, দিতে না চাইলেও। সে ভাবতো ওটাই শুধু ওদের খারাপ কাজ। জোর করে লোকের ঘরের খাবার নিয়ে যাওয়া। তখন সে বোঝে নাই আরও কতকিছু ওরা নিয়ে গেছে।

দিনে দিনে রাজাকারদের ব্যস্ততা বাড়লো, স্কুল বলতে গেলে ছুটি হয়ে গেলো। পোলাপানের তখন সারাদিন টোটো করা ছাড়া কাজ নাই। জামান গুলাইল হাতে ধানক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটের কাছে দাঁড়ায় একাই অপেক্ষা করতো লঞ্চ থেকে নামা মানুষের মধ্যে একজনকে দেখার জন্য – তার ভাইজান। গুলাইল দিয়ে পাখি আর মারা হত না। ৭১ এর পরে সে আর কোনদিন একটা পাখি মারতে পারে নাই।
ধানক্ষেতের পার হয়ে নদীর ঘাটের পাশ দিয়ে রাস্তা সোজা চলে গেছে বাজারে। সেখানেই রাজাকারদের আড্ডা বেশি থাকায় বাজারের আশেপাশেও পোলাপান যাওয়া বারণ ছিল। বড়রাও তেমন কাজ না থাকলে যাইত না।

জামানের একটা ছোট্ট বাইনোকুলার ছিল। ভাইজান ঢাকা থেকে কিনে আনছিল। সেটা প্যান্টের ভিতরে লুকায়ে নিয়ে গিয়ে ধানক্ষেতের আড়ালে বসে যতদূর দেখা যায় সে দেখতো । মাঝে মাঝে একদুজন বন্ধু সংগে থাকতো। তেমনই একদিন ওরা বসে ছিলো আর তখনই তার চোখেই মনে হয় প্রথম ধরা পড়লো নদীর কিনার থেকে অনেক দূরে আর্মিদের ষ্টীমার – সেদিন একবারও না থেমে একদমে বাড়ি গিয়ে হাঁপাতে -হাঁপাতে বাবাকে বললো । তারপর সবাই এই খবর জানলো। বুঝলো তাদের গ্রামও এখন আর নিরাপদ না। সেদিন থেকে এটাই ছিল নতুন আলোচনা, আর্মিরা এই আইলো কইলম ।

জামানের তখন ধারণা হলো মা বোধহয় আর্মি না আসার জন্য দোয়া করতে ভুলে গেছে।

তবে আর্মি আসার খবরে মুক্তিরা গ্রাম তো ছাড়েই নাই বরং যেন অপেক্ষায় ছিলো এদের আসার। শত্রুদের কেন তারা হাতের নাগালে চাইতেছে সেটা বুঝতে জামানের অনেক সময় লাগলেও এই যুদ্ধে শত্রু কারা সেটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। তখন সে অপেক্ষায় থাকে মুক্তিদের জন্য।
রাত বাড়লে তারা ওদের বাড়ি আসে – খাবার খায়। বিশ্রাম নেয়। আলো ফোটার আগে চলে যায়। জামান এখন জানে মুক্তি কারা।
ওদের দেখার পর, জামান দরোজার পাল্লায় দাঁড়ায়ে নিজের মাপ নিতো। যুদ্ধ তো নাকি অনেকদিন চলবে। এর মধ্যেই আরো একটু লম্বা হলে সেও মুক্তি হতে পারবো।

যে মুক্তিসেনার কথা সবাই বেশি বলে সেই মফিজ ভাইও তো অত বেশি লম্বা না। বয়স বেশি না কিন্তু তারই নাকি সাঙ্ঘাতিক সাহস। কদিন আগে একজন রাজাকার উধাও হয়ে গেছে। পাশের গ্রামে কয়েকজন আর্মি লঞ্চ থেকে নেমে নৌকায় করে ঘাটের কিনারায় আসার আগেই নৌকা ডুবে মেঘনার জোয়ারে তলিয়ে গেলো। কানাঘুষায় চলে -এসবই নাকি মফিজ ভাইয়ের কাজ।

এই ঘটনার পর অনেকদিন মুক্তিদের কেউ গ্রামে দেখে নাই। বাড়ি-বাড়ি অনেক তল্লাসি চলে। তবে সন্দেহ করার মত কাজ মফিজ মুক্তি করতো না। মেঘনার পেট থেকে নৌকা, লাশ কোনকিছু উদ্ধার করা যায় নাই।
কিছুদিন চুপচাপ থাকার পরে, একদিন ডিসেম্বরের শুরুতে ভরা কুয়াশার মধ্যে সকালবেলা মফিজ মুক্তি বাড়ির দরোজায় টোকা দেয়। ঘরে ঢুকেই বলে মা একটু খাওন দেও।

মা তার ছেলের পছন্দের নাস্তা চালের গুরার ছিটারুটি বানায়, ছেলের জন্য তুলে রাখা কোরবানির শুকিয়ে রাখা গোশত ভুনা করে। মা হাতে থালা নিয়ে চামচে ভুনা গোস্ত তুলতেই দেখে
দরজায় হঠাৎ কারো টোকা শুনে ছেলে বের হয়ে গেলো। ফিসফিস করে কিছুক্ষন কথা বলে ছেলে দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে মায়েরে কয়- মা মোর খায়নডা চুলার তাপে রাহো , মুই যামু আর আমু ।

হাঁড়ির খাবার হাঁড়িতেই থেকে যায়। যাব আর আসবো বলে মুক্তিসেনা মফিজ বাড়ির মাটির রাস্তা পার হয়ে গ্রামের দক্ষিণ মাথায় পাকা রোডের মুখে বহু পুরানো বটগাছে উঠে বসে, সম্পূর্ণ একা মফিজ । তার ইনফরমার জানিয়ে গেছে এই কুয়াশামাখা সকালে দক্ষিণ সড়ক দিয়ে রিক্সাভ্যানে অস্ত্র নিয়ে মাত্র দুজন রাজাকার আর দুইজন আর্মি যাবে আরেক গ্রামে ।

ইনফরমার আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিতে গিয়েছিলো -কিন্তু কোন কারণে তারা যেখানে থাকার সেখানে ছিলো না। মফিজ একাই যাওয়া ঠিক করলো কারণ এমন সুযোগ ছাড়া যাবে না। তাদের অস্ত্র চাই। আর তিনজনকে মোকাবেলা করার ঝুঁকি নেওয়া তার জন্য কোন ব্যাপার না।

সেদিন মফিজ মুক্তির সময় নির্ধারণে কোন ভুল হয় নাই। ঠিক সময় মতই সে গাছের সবচেয়ে নিচু ডালে নেমে গুলি ছোড়ে। ঠিক তখনই রিকশাভ্যানের একটি চাকা বাঁকা হয়ে হেলে পড়ে আর তাতেই মফিজ মুক্তির প্রথম গুলি ভ্যানের পাশ দিয়ে চলে যায়। মফিজ আবার গুলি ছোঁরে একের পর এক, কিন্তু কুয়াশার পানির কারণে হোক বা দুর্ভাগ্যের কারণেই হোক, যে ডালে মফিজ বসে ছিলো সেখানে থেকে তার পা পিছলে যাওয়ায় তার কোন একটা গুলিও নিশানা মত লাগলো না।
বরং দুইজন পাক আর্মির পরপর কয়েক রাউন্ড গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে পানির স্রোতের মত লাল রক্তে ভেসে মফিজের লাশ পড়ে যায় বটগাছের ছড়ানো পায়ের গোরায়। যেখানে এক সময় মফিজ বন্ধুদের সাথে আয়েস করে বসে স্বপ্ন বুনতো – কৈশোর কাল পেরিয়ে যৌবনের গল্পে তাদের মনের মানুষের গল্পই ছিলো বেশি । সেইখানে শহীদ হন মফিজ মুক্তিযোদ্ধা – নিজেদের লোকের অত্যাচার থেকে নিজেদের স্বাধীনতা আনার জন্য।

মফিজ মুক্তির লাশ তার স্বজনদের কাছে নেওয়া যায় নাই। তার লাশ রাজাকার আর্মিরা নেয় নাই সে ব্যাপারে সকলে নিশ্চিত ছিল। কারণ সেই রাজাকার আর্মির ভ্যানও গুলি ছুড়তে ছুড়তে চলে গেছে।

কানাঘুষায় জানা গেছে, ঘাটের কিনারে বাধা নৌকায় করে তার লাশ দূরে নিয়ে গেছে। রাজাকারদের কানে দেওয়া হলো লাশ তারা মেঘনায় ফেলে দিছে। এই মিথ্যাচারের কারণ সবাই জানতো। কারণ এবার যে আগুন জ্বলবে তা সহজে নেভানো যাবে না। মেয়েদের ইজ্জত বাঁচানো দায় হয়ে যাবে।

ডাহুকডাঙা গ্রামের মুল রক্ষক ছিল ভয়াল মেঘনা নদী। আর্মি আসলেও গিজগিজ করার মত আসে নাই। তারা রাজাকার বাহিনী বানাইতে আসছে। চেয়ারম্যানকে ঘরবন্দি করে রেখে রাজাকারদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। তারা আসছে আবার চলে গেছে।
যা কিছু আর্মিঘাটি ছিল তা ছিলো হরিণহাটি থানায় –ডাহুকডাঙা থেকে কয়েক মাইল দূরে।

তারপরেও আগুন ঠেকানো যায় নাই । মফিজ মুক্তির বাবার অসম্মান হইলো তারই এতকালের চেনা মানুষ – রাজাকারদের হাতে । তারা তাঁর ঘরবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলো। মফিজ মুক্তির ফেলে যাওয়া সার্ট লুঙ্গি আর কিছু বই ছাড়া কিছুই পায় নাই।

খোঁজাখুঁজি শেষে উপকারের মত একটাই কাজ করেছে তারা, মফিজ ভাইয়ের উঠতি বয়সী বোনদের অন্য কোথায় সরায়ে ফেলতে বলে গেছে -আর্মিরা জানার আগে। কে জানে হয়ত চাচা বলে ডাকতো বলেই ওদের সম্ভ্রম নিয়ে টানাটানি করতে চায় নাই।
চর থাপ্পড় আর গোটা কয়েক বেতের বাড়িতে গা ফুলে গেলেও তাঁর বাবা হাত জোর করে শুকরিয়া আদায় করে বাড়ি ফিরে মেয়েদের স্যুটকেসে গুছাতে বলে, কয়েকজনকে নিয়ে ঘরের মধ্যে লুকায়ে গায়েবানা নামাজে সামিল হতে চলে গেলো।

যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে এই ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে।
ভাইজানের সাথে আরও অনেকে ফিরে আসে। তাদের মধ্যে একজনের একচোখ কানা হয়ে গেছে আরেকজনের দুই পা হাঁটু থেকে কাটা।
তবু তারা জীবন নিয়ে ফিরেছে ।
ভাইজানের কিছু হয় নাই । শুধু একটু রোগা আর কালো হয়ে গেছে। কিন্তু আগের মত হাসিখুশি নাই। কথা কম বলে। যত্ন করে রাখা করুণাবুবুর চিঠি ভাইজানকে দেওয়ার পরেও আগের মত হাসল না ।
বরাবরেও মত ছোটভাইয়ের মাথায় চাটি মারলো না।

করুণাবুবুর পরিবার ফিরে আসলো আরো কিছুদিন পরে করুণাবুবু ছাড়া।
অনেকদিন বিলাপ চললো বুবুর নাম নিয়া। বিলাপের মধ্যেই বের হয়ে গেলো বুবুর ইজ্জতের কথা। ইন্ডিয়া যাওয়ার পথেই বুবুর ইজ্জত গেছে আর্মির হাতে। যাওয়ার পথে যে বাড়িতে তারা একরাত ছিল। সেই বাড়িতে আর্মিদের তল্লাসিতে কাউকে কিছু না করে শুধু বুবুরে তুইলা নিয়ে যায়।
আর্মিরা তারে মারে নাই। তবে যুদ্ধ শেষে পালাইয়া যাবার সময়ে তারে নিয়েও যায় নাই।

একদল মুক্তিসেনা বুবুরে উদ্ধার করে গাড়িতে উঠায়। কি কারণে তারা তাদের নীতি হারাইলো কেউ জানে না। বুবুর ইজ্জত খোয়া গেছে বলেই হয়ত তার আর কোন ইজ্জতের সম্মান দেওয়ার কথা ভাবে নাই। বুবু বোধহয় নিজের ভাইয়ের কাছে এই অসম্মান নিতে পারে নাই। উদ্ধারকারী মুক্তিভাইরা যখন ঘুমে তখন সে রেললাইনে গিয়ে অপেক্ষা করলো ট্রেনের – তারপর সব শেষ।

মুরুব্বীদের মতে, খাইয়া না খাইয়া জীবন বাজি রাইখখা আর্মির লগে যুদ্ধ হরতে হরতে হেগো মাথার ঠিক আছিলো না। নাইলে মা বইনের ইজ্জত নিয়ে কি কেউ খেলে!
করুণাবুবুর কাটা লাশ আনা যায় নাই। খবর শুনে গ্রামের কয়েকজন আত্মীয় গিয়ে লাশ শনাক্ত করে আসছে।
করুণা বুবুর লাশ না আনতে পারলেও বুবুর উদ্ধারকারীদের একজনের লাশ তাঁর বাড়িতে নিয়ে কবর দেওয়া হয়েছ। বুবু মারা যাওয়ার পরদিন রাতে রেললাইনের যে জায়গায় বুবু কাটা পড়েছিলো তাঁর কাছেই একটি গাছের নীচে সেই মুক্তিযোদ্ধার লাশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেলো। ধরণ দেখে মনে হয়েছে সে নিজেই তাঁর মাথায় গুলি করেছে – ঘোর কেটে যাওয়ার পরে নিজ অপরাধ কোন যুক্তিতে খন্ডাতে পারলেও বুবুর আত্মহত্যা তাকেও সাহসী করেই তুলেছিলো। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে একজনের বয়ানে জানা গেছে, সকাল থেকে সারাদিন সে কারো সাথেই কথা বলে নাই। সন্ধ্যে হতেই সে বের হয় যায়। সকালে তার বিছানায় না দেখে খুঁজতে বের হয়ে মৃতদেহ আবিষ্কার হলো। পকেটে ছিল তিন লাইনের একটি চিঠি। লেখা ছিলো, মুক্তিযোদ্ধা হলেও আমি মানুষ। অন্যায় করছি জেনেও কামনার ক্ষুধা থেকে নিজেকে নিবৃত করতে পারি নাই। করুনার কাছে ক্ষমা পাবার একটাই পথ ওর কাছে যাওয়া।
না বুবুর, না সেই মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু নিয়ে আর কথা আগে বাড়ল না। সকলের সান্ত্বনা ছিল, যে পাপ করেছে সে তাঁর শাস্তি নিজেই দিয়েছে। বুবু কোন পাপে শাস্তি পেলো তা নিয়ে কেউ কথা না বললেও জামান আকাশের তাকিয়ে ভাবতো সাত আসমান কতদূরে?

ভাইজান সব শুনে সেই যে চলে গেলো ঢাকায়, আর কোনদিন গ্রামে ফিরে আসে নাই। ঢাকার পরে সে এখন -বিদেশে, বড় চাকরী – সংসারে ভাল আছে।

জামান এখনও গ্রামে আসে। গত তিরিশ বছর ধরে সে ডিসেম্বরে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে গ্রামে আসে। কেন আসে সে জানে না। আবার না এসেও সে পারে না। মা বাবা, ভাই কেউ নেই এই গ্রামে। তবুও পুরো গ্রাম তার কাছের – এর চেয়ে নিকট আত্মীয় যে আর কেউ নেই তার। লঞ্চ থেকে নামলেই চারদিকে থেকে, জামান আইছো বাবা! এই কথাটাই যে যথেষ্ট।
সবাই জানে কেন সে এই সময়েই আসে। আসে সে ফিরে যেতে – অতীতে! ফিরে যায় একবারে শিশু বয়সে। যখন সে পোলাপান ছিল। গিয়ে বসে মফিজ মুক্তির কবরে। মফিজ ভাইয়ের লুকানো কবর এখন আর লুকানো নাই – সে সেখানে গিয়ে বসে। সেই সব দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বটগাছের নিচে এককোণায় সে বুবুর নাম লিখে রেখেছিলো -সেটাই তাঁর কবরের চিহ্ন মনে করে বসে থাকে- শেষদিনের সেই জড়িয়ে ধরা অনুভব করে।
মনে হয় করুণা বুবু কানে কানে বলে, মাসের পর মাস পাশবিক অত্যাচারের দিনশেষে প্রত্যাবর্তনের আশ্বাসের আলো দেখা দিতেই তাবৎ পৃথিবী আলোহীন হয়ে গেলো। তোর বুবুর জন্য কেউ জেগেছিলো না, না মানুষ না ঝিঁঝিঁ পোকা। সবাই ঘুমিয়ে ছিলো। আমার কান্না কাউকে জাগাবার মত ছিলো না। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কাউকে শোনাবার মত করে কাঁদতে হয় কেমন করে। আমি দুহাত জোর করার আগেই যে সকলেই…। আমার শরীর যে মানুষের না, ছিলো শুধু নারীর শরীর।জীবনের শেষরাতে সেই অন্ধকারে চিরকালের আশ্রয়ের খোঁজে দেখলাম একটি জীবন্ত গাছ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে।তোর বুবুর আর ফেরা হলো না।
করুণা বুবুর কোমল মায়াবী মুখ মনে পড়ে। জামান চোখ মুছে করুণা বুবু লেখা নামের পাশে পড়ে থাকা বটপাতা হাতে তুলে নিয়ে মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে ঘুরে বেড়ায় এক অসীম শূন্যতা বুকে নিয়ে।
সে দেখে মেঘনার ঢেউগুলো রক্তের দাগ বুকে নিয়ে বয়ে বয়ে যায়!

************************