তাঁরা মনে হয় হেঁটে ঘোরেন না: ঢাকার লেখকদের নিয়ে সমরেশের মূল্যায়ন
শেখ সাইফুর রহমান
যা হোক, তাঁর দীর্ঘ ভ্রমণের দিনলিপি, টুকরো টাকরা ঘটনাগুলো যেন ছিল কোনো অলংকারে বসানো মুক্তার মতোই মনোগ্রাহী। কোনো জায়গায় বাস থামা। মানুষের ওঠানামা। দুজন অচেনা তরুণ–তরুণীর পাশাপাশি বসে তাদের হঠাৎ পরিচিতির চরম অন্তরঙ্গতায় পৌঁছানো; আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যে যার গন্তব্যে চলে যাওয়া—লেখকের দৃষ্টি এড়ায় না কিছুই। মার্কিনদের জীবনের নানা দিকও উঠে আসে তাঁর এই লেখায়। এই বইটা পড়ে আমার আমেরিকা ভ্রমণের ইচ্ছে জাগে। না অন্য কিছু নয়, গ্রে হাউন্ডে সফর করা। গ্রে হাউন্ডে সফরের সে ইচ্ছে যে মিইয়ে গেছে তা অন্তত বলব না।
নানা সময়ে দেশ পত্রিকার অফিস বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুবার গেছি সঞ্জীবদার কাছে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারসহ অনেককেই দেখেছি। যাকে বলে দূর থেকে দেখা।
তবে ২০১২ সালের কথা। সেবার ঢাকায় এলেন সমরেশ মজুমদার। আমি তখন ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল বিষয়ক সামিয়কপত্র ক্যানভাস–এ কাজ করি। তো এক সন্ধ্যায় আমাদের সম্পাদক তথা বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান ঢাকা ক্লাবে সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। আমাকে তাঁর সঙ্গে যেতে বলায় দ্বিমত করিনি। ফলে দেখা হয়ে যায় তাঁর সঙ্গে। কানিজ আপা মূলত গিয়েছিলেন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। টুকিটাকি কথা হয়। সেসব আর আজ মনেও নেই। কেবল একটা বিষয় ছাড়া। কারণ সেটা বেশ দাগ কেটে আছে। বলেছিলেন, ‘তোমাদের লেখকেরা মনে হয় ঢাকা শহরে পায়ে হেঁটে ঘোরে না। সেই ছাপ তো দেখি না তাদের লেখায়।’ সেদিন কিছুক্ষণ ছিলাম আমরা।
এরপর আর দেখা হয়নি। যদিও ঢাকায় তিনি এসেছেন মা মাঝে।
এরই মধ্যে বছর দুয়েক আগে আবার হঠাৎ করে তাঁর একটা উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বেরোতে শুরু করে দেশ পত্রিকায়। ভুল না হলে গর্ভধারিণীর পর এটাই ছিল দেশে তাঁর কোনো ধারাবাহিক। চমৎকার নাম। আলোকরেখা। চা বাগানের গল্প। ব্রিটিশ আমলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোতে চা বাগান তৈরির ইতিহাসই মূলত এই উপন্যাসের উপজীব্য। কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন শহুরে ছেলে। অজ জঙ্গলে চা বাগানে কাজ নিয়ে যাওয়া। কুলি–কামিন থেকে চা বাগানের কাজে নিয়োজিত শ্রমিক, নানা শ্রেণির কর্মকর্তা–কর্মচারী ও ব্রিটিশ সাহেবদের জীবন উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
কিন্তু উপন্যাসটা দানা বাঁধতে বাঁধতেই যেন শেষ হয়ে গেল। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের যে অবয়ব তার সঙ্গে এটাকে মেলানো যায় না। আমার কাছে এটা একটা বড় গল্পই বোধকরি। তবে এটাই সম্ভবত তাঁর শেষ কোনো ধারাবাহিক উপন্যাস।
চা বাগান, ডুয়ার্স তাঁর যাকে বলে নখদর্পণে। তাই তো তাঁর পক্ষেই এমন প্রাঞ্জল বর্ণনায় তুলে ধরা সম্ভব জনজীবনের নানা ঘাত–প্রতিঘাত। নির্যাতন–নিপীড়ন–বঞ্চনার ইতিহাস এই চা শিল্পে নতুন নয়। কিন্তু তাঁর কলমের আঁচড়ে নতুন আঙ্গিকে উঠে এসেছে জীবননিষ্ঠ সব ঘটনা।
চারপাশকে যথার্থ অবলোকন ও সেসব শব্দের ঠাসবুনোটে সাজানোর নিপূণতা সমরেশ মজুমদারকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তাঁর মতো অনবদ্য গল্পকথকের মৃত্যু বস্তুত একটি উজ্জ্বল অধ্যায়েরই পরিসমাপ্তি।
(সংগৃহীত)
আজকের পত্রিকা