You are currently viewing ডাম্ব ওয়েট্রেস || গোলাম শফিক

ডাম্ব ওয়েট্রেস || গোলাম শফিক

ডাম্ব ওয়েট্রেস

গোলাম শফিক

বহুদিন পর এই রেস্তোরাঁটিতে ঢুকলাম। সবই অপরিচিত ঠেকছে। লোকজন কম। আগের চেহারা একটুও নেই। পরিবেশনকারিণীদের তো চেহারাই নেই, মুখোশে ঢাকা। শ্মশ্রুর কারণে নিজের চেহারা কিঞ্চিৎ হলেও দৃশ্যমান। আমি মনে মনে বিউটিকে খুঁজছি। কালো মেয়ের নাম বিউটি। তবে ওর চেহারা অতো কালো নয়। যারা সাধারণত পাতিলের নিচের কালি দেখেনি, তারাই এ বর্ণের ছেলেমেয়েদের কালো আখ্যায়িত করে। নিজেদের মাথার চুল সারাদিন আয়নায় দেখেও তারা রঙ কী চেনে না। 

একজনকে আন্দাজ করে কাছে ডাকলাম। বললাম, চা নিয়ে আসো। চা খাওয়ার জন্য মাস্ক খুলতেই বিউটি বিস্ময় প্রকাশ করে, স্যার আপনি?

চিনতে তো পারোনি, জানি। 

এখন কে কাকে চিনে?

তা ঠিক।

বহুদিন পর আসলেন, কী খাবেন স্যার? 

আর কিছু না, খাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে।

কেন স্যার, আপনার বয়সীরা এখনও গাপুস গুপুস খেয়ে যাচ্ছে। আপনি একটু বেশি সচেতন। 

আর তোমরা আদৌ সচেতন নও, এতো চিনি দিয়েছো কেন?

সরি স্যার, কী বলছিলেন বুঝতে পারিনি। আসলে কম চিনি দিলে লোকজন আমাদের টিটকারি দিয়ে বলে, কী, চিনির দাম কি বেড়ে গেছে? এক উসিলায় আমাদের সাথে মস্করায় মেতে উঠতে পারে। 

কিন্তু আমি তোমাকে পেছন থেকে বলেছিলাম, চিনি কম দিও। 

স্যার, এক্ষুনি চেঞ্জ করে দিচ্ছি।

সে যা-ই হোক, তুমি এখন কম শুনতে শুরু করেছো। 

কম কথা শোনাই ভালো স্যার। লোকজন এখানে বসে কেমন সব কথা যে বলে! এসব না শোনাই ভালো। ব্যবসা তো চালাতে হবে, তাই কানে তুলা দিয়ে রাখি।

কেন, বাজে কথা বলে কেন? 

বুঝেন না স্যার, মেয়েদের রেস্টুরেন্ট!

একথা বলেই সে কাজে মনোযোগ দেয়। আমি বিউটির চিনিবিহীন চা খেতে খেতে অতীতের গহ্বরে ঢুকে পড়ি। নারীচালিত এ রেস্টুরেন্টে আমার মাঝেমধ্যে যাতায়াতের কারণ ছিল এটি আবাসের খুবই নিকটে এবং এখানে এক সময় একটা ফটোস্ট্যাট মেশিন ছিল। নিজের লেখা ফ্রেশ করার সময় মূল পৃষ্ঠার নিচে কার্বন কাগজ রেখে আঙুল ব্যাথা হতে হতে যখন এক প্রকার খসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখনই বাজারে আসে জেরক্স-ফটোকপি। সেই সুযোগ আমিও নিয়েছিলাম। তার অনেক পর, বিউটি নিয়মিত আমার লেখার ফটোকপি করে দিতো, সেই ফাঁকে চা সিঙ্গারা খেতাম। প্রায় সময়ই লেখার দিকে তাকিয়ে বলতো, স্যার আপনার হাতের লেখা কী সুন্দর!

পত্রিকার লোকজনের খুব উঁচা নাক, লেখা পরিষ্কার না হলে নিতে চাইবে বলো? ছাপা তো দূরের কথা। 

একদিন একটা দলিল ফটোকপি করতে আসলে সে জিজ্ঞেস করে, স্যার আপনি দলিলও লেখতে পারেন? আমি ওর কথার কোনো উত্তর দিইনি। তবে খুব অ্যানজয় করেছিলাম। 

আর একদিন একটা বইয়ের বৃহদাংশ ফটোকপি করতে আসলে সে পৃষ্ঠাগুলোর ছবি নিয়ে আউটপুট বের হওয়ার অবসরে পাশের টেবিলের একটি চেয়ারে বসে আমার সাথে গল্প জুড়ে দেয়। ঘচ্ঘচ্ করে মেশিন চলছে, কাগজ বের হচ্ছে আর আমরা কথা বলছি। হঠাৎই সে বললো, স্যার আপনি আর কী কী লেখেন? আমি এর কী জবাব দিতে পারি? বললাম, গ্রামে থাকতে মানুষের চিঠি লিখে দিতাম। সে বললো, লেখা পর্যন্তই কষ্ট, আপনার তো আর দশ মাইল হাঁটতে হয়নি স্যার। বললাম, কী বলছো তুমি, বিষয়টি খোলাসা করো। সে তখন আমার সাথে আর এক গল্প জুড়ে দেয়। এক লোক নাকি গ্রামের আর এক বিশ্বস্ত ও প্রিয় মানুষকে প্রায়ই চিঠি লিখে দিতো। একদিন তার প্রিয় মানুষটি এসে চিঠি লেখার অনুরোধ জানালে তিনি বলেছিলেন, কয়েকদিন যাবৎ আমার পায়ে ব্যথা। তখন লোকটি চলে যায়। 

আমি বিউটিকে জিজ্ঞেস করলাম, চিঠি লেখার সাথে পা ব্যথার কী সম্পর্ক? বুঝলেন না, চিঠি লেখকের লেখা এতোই অস্পষ্ট, এমন কি ডাক্তারদের চেয়েও হিজিবিজি ছিল যে, আট-দশ মাইল দূরে প্রাপকের বাড়ি গিয়ে তার নিজের লেখা নিজেকেই পড়ে দিয়ে আসতে হতো। কিন্তু সেদিন পায়ে ব্যথা থাকায় যেতে পারবেন না বলে চিঠি লিখে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু আপনার তো এ সমস্যা ছিলো না, আপনার লেখা যে মুক্তার মতো ঝকঝকে। 

ওর গল্পের মর্মার্থ বুঝতে পেরে আমি ভয়ংকরভাবে হেসে উঠলাম। সেদিনই আমি আবিষ্কার করেছিলাম ওর মধ্যে রস আছে। এক ভিন্নমাত্রিক রসবতী সে। দেখলাম হাসি আশেপাশেও সংক্রমিত হয়েছে। 

আমি খুশি হয়ে বললাম, সব সময় তো আমাকে চা-নাস্তা খাওয়ানো হয়, আজ আমি কিছু খাওয়াই? 

না স্যার, সেটা হয় না।  

আমি বেশি পিড়াপিড়ি করলে সে বললো, স্যার আপনি যান, পরে আপনার নামে একটা কিছু খেয়ে নেবো। বলেই সে কাগজ গুলো প্যাকেটে পুরে খট করে একটা স্টেপলার পিন মেরে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। 

আমি বাসায় এসে চিন্তা করলাম ওর মতো ডাম্ব ওয়েট্রেস আমাদের চারপাশে কমবেশি আছেই। এ বয়সে কাঁচা চিনি, কাঁচা লবণ তো কন্ট্রোল করা উচিতই। কিন্তু স্ত্রী বলে, তোমার সবকিছুতেই আদিখ্যেতা। এই ‘আদিখ্যেতা’র অর্থ যে কী, নির্ধারণ করতে না পেরে আমাকে চুপই থাকতে হয়। এ জন্য হাত নোংরা করে মিষ্টি খাই। চিপা দিয়ে রস বের করে ছানার মতো চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। আসলে এটাও ঠিক যে, মধুমেহ’র মধুর পিরিতি শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমি সাবধান। সেদিন শ্যালিকার বাসায় গেলে সে বললো, তাহলে জিরোক্যাল দিই দুলাভাই? 

তার দরকার নেই, আমার তো আর ডায়বেটিস হয়নি।

‘তাহলে? আবার জিগায়’ বলেই সে আমার পেটে একটা মৃদু ঘুষি দিয়ে বললো, আপনার তো ভুড়িও তেমন দেখছি না।  

কী বলছো?

হ্যাঁ, আপনার মতো মধ্যপ্রদেশধারী কতো ইন্ডিয়ান ছেলেমেয়ে প্রতিদিন দেখছি দিব্যি অলিম্পিকে পার্টিসিপেট করছে। আপনার শুধু ফসকে যাওয়ার অজুহাত। 

শ্যালিকাদের কিলঘুষি খেতে খারাপ না লাগলেও আমি সেই মুহূর্তে ওকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম, আঁখি, তুমি আমার আঁখির সম্মুখ থেকে অন্তর্হিত হও! 

আমার উদরাময়ের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল এই ভেবে আমি আর একটা নরম ঘুষিকে সে মুহূর্তে অতোটা নরম ভাবতে পারিনি, যদিও আঘাতটিকে অলিম্পিকের তুলতুলে গ্লাভস পরিহিত বক্সিংই মনে হয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয় সে সরে গিয়েছিল ফিরে আসার জন্য। এক ঝুরি লেংড়া-খোড়া আম নিয়ে সে ফিরে এলো। বললাম, হবে না, হবে না। 

না হলে মাথায় কাঁঠাল ভাঙবো। লক্ষ্য করে দেখলাম যে, ওর বাসা আম কাঁঠালে ঠাশা। ডুরিয়নের মতো একটা সুচালো কাঁঠাল দেখে আমি ঔৎসুক্যবশত কাছে গেলাম। তখনই এক তীব্র গন্ধ আমাকে স্মৃতিকাতর করে দিলো। 

ওরা যে মিষ্টি রসালো দিনাজপুরী লিচু খেয়েছিলো তারও প্রমাণ পেয়েছিলাম দুই ভবনের ফাঁকে সবুজ-পার্পলের পাতাযুক্ত শতশত লিচুর চারা দেখে। 

কিন্তু এ রসালো ফলগুলো খাওয়ার বিষয়ে আমার ওস্তাদ ইনাম আল হক আমাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। বলেছিলেন, এখন থেকে ফল খেতে হবে আপেল, আমলকি, অ্যাভোকাডো, এপ্রিকট এসব। আর অন্ন নামের কার্বোহাইড্রেট বস্তুটি খেতে হবে এক চামচ করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? চারপাশের সবাই যদি ডাম্ব ওয়েট্রেস হয়ে যায় তবে তো বড়োই মুশকিলের কথা। মানুষের মৌলিক অধিকারের এখন অনেক শ্রেণীবিভাগ। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সাবধান হওয়ার অধিকার। তাছাড়া নৈঃশব্দে বসবাসের অধিকার, যন্ত্রণাবিহীন মরণের অধিকার, আরো কতো কী! কিন্তু শালা-শালিদের কাছে এসবের তেমন পাত্তা থাকে না। আমি এগুলোর নাম দিয়েছি ‘মধুর যন্ত্রণা’। 

করোনা অবশ্য একটি অণুজীব হলেও এর চেহারা আমরা দেখতে পাই। অণুবীক্ষণ ছাড়া দেখা না গেলেও এটির ব্যাপক সামাজিকীকরণ হয়েছে। করোনা আক্রান্ত বাসায় দরজার কাছে আত্মীয়রা খাবার রেখে যায়, এটাই করোনার চেহারা, একই বাসায় বসবাস করে বংশদণ্ড বেঁধে খাবার দেয়া হয় রোগীর বিছানায়, এটাই করোনার চেহারা, সন্তানরা কোথায় পিতামাতার লাশের সৎকার করবে, উল্টো দৌড়ে পালায়, এটাই করোনার চেহারা। করোনার চেহারা অগণন। নিজের এ সামাজিক চেহারা দেখিয়ে পৃথিবী মুখোশে ঢেকে দিয়েছে, মানুষকে করেছে অসামাজিক। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এসব ভয়ভীতি আমাদের কেটে গেছে। কঠোর লকডাউনেও কাজ হয় না। অদৃষ্টবাদীরা বলে এইসব সাবধানতা খোদার উপর খোদকারী। আমার ভয় কেটেছে অন্য কারণে। নির্মল আকাশ আর সবুজের বন্যায় চোখ না পড়লে আমার চোখ ব্যামোয় আক্রান্ত হবে, মনের মধ্যে এই রকম একটা ভাব এসে যায়। তাছাড়া হাঁটতে হাঁটতেই অনেক লেখার প্লট পেয়ে যাই। এক সময় চা স্টলে বসে ধুয়া উড়িয়ে উড়িয়ে অনেক অজানা দ্বীপ আবিষ্কার হয়ে যেতো। সে সময়কার নিরব উত্তেজনা দেখলে  কেউ কেউ ভাবতো বিড়িটা আমি চিবিয়ে খাচ্ছি। 

সরকারি নির্দেশনায় তেমন কাজ না হলেও মৃত্যুর মিছিল দেখেই মানুষ ভয়টা বেশি পেয়েছে। তাই আজ একটা স্টলও খোলা পাইনি। ইহারই নাম অতিব্যামো। হাঁটতে হাঁটতে নারীচালিত রেস্তোরাঁর দিকেই এগিয়ে যাই, সেটি অগত্যা। খোলা পেয়ে ঢুকে গেলাম। ওয়েট্রেস বললো, কী ব্যাপার স্যার, মাঝখানে দীর্ঘদিন আসেননি, কিন্তু এখন করোনার মধ্যেও ঘনঘন? 

ভাবছি তোমরা খোলা রেখেছো কী করে? 

মহিলাদের বলে সরকারের বিশেষ পারমিশন আছে আমাদের। ‘তাই বলো, ঠিক আছে’ বলেই আমি বের হয়ে যেতে চাইলে পেছনের রুম থেকে বিউটি বের হয়ে এসে বলে, স্যার একটা চা খেয়ে যান, কাস্টমার এখন খুবই কম, আমরা প্রায় বেকার। বললাম দাও, মনে রেখো চিনি ছাড়া। সে চা নিয়ে এলে মুখে দিয়ে আমি বিরক্তি প্রকাশ করি। বিউটি বললো, চিনি দেই নাই তো, কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে বানানো। 

‘তুমি আসলেই কালা হয়ে গিয়েছো।’ সে বললো, আমার গায়ের রঙ তো কালাই স্যার, নতুন কী? বুঝলাম কালাকে সে কালো বুঝেছে। এখানে শুদ্ধ বাংলাটা বলা ঠিক হয়নি, বধির বললে তো আরো বুঝবে না। আমার বন্ধু আনিস পারভেজ সাথে থাকলে হয়তো রসিকতা করে বলতো, তোর বলা উচিত ছিল শ্রবণরহিত। যা-ই হোক, বিউটির পাল্টা প্রশ্নে আমি আর এ বিষয়ে ঘাটাঘাটির সুযোগ পাইনি।

এখন বাসায় কী করেন স্যার? 

সারাদিন টাইপ করি। 

কেন, টাইপিস্ট নেই? 

আরে রিটায়ার্ড লাইফে টাইপিস্ট পাবো কোথায়?

কী, আপনি রিটায়ার্ড? 

হ্যাঁ, তাছাড়া এখন আর হাতে লেখার দিন নেই। সবাই কম্পিউটারে সরাসরি টাইপ করে ফেলে। তাই এখন কেউ লেখক নয়, টাইপিস্ট। 

ও, আপনি নিজেই কম্পিউটার চালান। 

হ্যাঁ।

তাহলে কাজ তো ভালোই শিখছিলেন। 

হ্যাঁ, খুবই ভালো শিখেছিলাম। ভাইরাস প্রটেকশন দিতেও জানি। 

এই মুহূর্তে আমি নিজেও ওর সাথে একটু মজা করার চিন্তা করি। 

ও বললো, কী রকম স্যার?

এই যেমন ধরো, প্রথম প্রথম কম্পিউটার ভাইরাসের ভয়ে খুব ভালো করে কম্পিউটার ঢেকে রাখতাম, একবারে নিশ্ছিদ্র, মনে করো পিপিই’র মতো। আঁচ করলাম, আমার রসিকতা সে বুঝতে পারেনি। উল্টো সে বললো, কিন্তু স্যার করোনায় এই সব ঢাকাঢাকিতে কোনো কাজ হবে না। আমি হাসি আড়াল করার জন্য তখনই মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলি। ভাবি এ যে কিছুটা নির্বোধও। এও হতে পারে যে, দ্বিতীয় যে কাস্টমারটি ঢুকেছে তার দিকে তাৎক্ষণিক নজর দেয়ার জন্য সে আমার কথাগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করেনি এবং দুটি ভাইরাসের তুলনামূলক চিত্র এভাবে তুলে ধরেছে। 

বাসায় এসে একান্ত নিরলে ভাবি, বিউটি না হয় কালা মেয়ে, কথা শোনে না, পৃথিবীর বাদবাকি সবাইই কি কথা শোনে? আর যারা শুনেও না শোনে? যতো প্রকার নির্দেশনা আছে, এগুলো কেউ কানেও নিচ্ছে না। বিনা প্রয়োজনে কি আমি নিজেও ঘর থেকে বের হই না? আমাদের একটি সুবিধা, যুক্তি খাড়া করতে পারি, অনেক স্ট্রং আইডি, যারা পারে না তারা কালেভদ্রে জরিমানা গুণে থাকে। তবে কমবেশি সবাইই কালা-বধির। এদিকে আমার বন্ধু গাজী হিশাম যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল সেটা খোড়াযুক্তি। সে বলেছিল, আমার সাহস আছে, আমি সাইক্লিস্ট! ভাবি সাইকেল চালানোর সময় তো মানুষের নাকমুখ বেশ উপরে থাকে, সে কারণে কি করোনা প্রবেশ করতে পারে না? করোনাও কি সীসার স্তরের মতো একটা লেভেল মেনটেইন করে চলে? যাই হোক, সেও যে কথা শুনতে রাজি নয় অন্য অনেকের মতো এ ধারণা আমার বদ্ধমূল হলো। 

 

একজন পত্রিকা প্রতিনিধির ফোন পেয়ে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে যাওয়ার মনোস্থির করলাম। লোকটি এসেছে অতিমারি সময়ে অনেক কষ্টে প্রকাশিত তাদের পত্রিকার লেখক-কপি পৌঁছে দিতে। তাকে পরিচিত ফার্মেসির সামনে দাঁড়াতে বলে আমি বেরিয়ে গেলাম, কোভিডকালে বাসায় দূরসম্পর্কের কাউকে ঢোকালে অন্যরা সহজভাবে নেয় না। তার হাত থেকে সাময়িকীর কপি গুলো নিয়ে সৌজন্যবশত চা খাওয়াতে এ রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। চা খাওয়া শেষ হলে ক্যাশের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিউটি কোথায়? 

ওর করোনা হইছে।

তাই নাকি, কেমন আছে?

কী জানি, ফোন-টোন ধরে না। 

আহা, এটাই এখন বাংলাদেশের চালচিত্র। দেশটা যে কেমন হয়ে গেল! 

ঠিকই বলেছেন স্যার। তবে আমরা সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক কম লোক দিয়েই রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছিলাম। কিন্তু রোস্টারে নাম না থাকলেও বিউটি চলে আসতো, বলতো, কাজ ছাড়া আমার ভাল্লাগে না আপা। 

খুব ভালো মেয়ে। আমাকে নম্বরটা দেবেন তো। 

ওকে স্যার, এই যে নিন। খোঁজ পেলে আমাকে জানাবেন। আমার নম্বরও দিয়ে দিলাম।

আমি পত্রিকার প্রতিনিধিকে বিদায় করে ফিরতিপথে ভাবছি, যদি ফোন ধরে তবে কিছু পরামর্শ দেবো, যদিও এখন তার পরিবার আছে, পরামর্শ দেয়ার লোকের অভাব নেই। তবে কোভিড সম্পর্কে আমাদের নতুন নতুন জ্ঞানেরও অভাব নেই, যদিও আমাদের জ্ঞানকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভাইরাসটি এর অদেখা চেহারা পাল্টে ফেলে। 

বিউটি ফোন ধরলে বলবো, বাঁচতে হলে শুনতে হবে, মানুষ মাত্রই, সর্বত্র, মারি ও মড়কে, বড়ো সম্পদ মনোবল ধরে রাখতে হয়, যারা আমাদের সচল রাখে সেই খেটে খাওয়া মানুষ হলে তো কথাই নেই। 

এখন থেকে নিশ্চয় সে আর কালা হয়ে থকবে না। কিন্তু কী করে শোনাবো তাকে আমার কথা? ফোন ধরছেই না। আবারও কাউন্টারের মহিলাকেই ফোন দিলাম।

“কী জানি স্যার, আছে, না মরছে আল্লাহ্ই জানে।”

কথাটি শোনার পর ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠলো।  

*****************************