You are currently viewing জীবন, ভালোবাসা আর বিপ্লবের অনবদ্য শৈল্পিক দলিল সংশপ্তক > নুসরাত সুলতানা

জীবন, ভালোবাসা আর বিপ্লবের অনবদ্য শৈল্পিক দলিল সংশপ্তক > নুসরাত সুলতানা

জীবন, ভালোবাসা আর বিপ্লবের অনবদ্য শৈল্পিক দলিল সংশপ্তক
নুসরাত সুলতানা  
সংশপ্তক প্রথম পড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে। পড়ে এতটাই মুগ্ধ ছিলাম পার্সি সাহিত্যে পড়া যে বন্ধুর কাছ থেকে বইটি ধার নেই, বইটি আর ফেরত দিইনি। প্রিয় সব বই আবার পড়ার তাগিদে বইটি আবার হাতে নিই ২০১৯ সালের  নভেম্বর মাসে।  দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধের সময়কালকে  উপজীব্য করে রচিত মহাকাব্যিক এ উপন্যাসে শুরুতেই দেখা যায়, হুরমতি একজন দেহ শ্রমিক যার বিচার বসিয়েছে বাকুলিয়া গ্রামের মাতবর গোছের লোকেরা। যার মধ্যে রয়েছেন বর্তমানে সর্বশান্ত এককালের নামকরা জমিদারের ছোট ছেলে ফেলু মিয়া, আছে খতীব সাহেব, আছে কাজী সাহেব, আর ফেলুমিয়ার আভিজাত্যের প্রতীক ধরে রাখা মোসাহেব  রমজান। কিন্তু হুরমতি স্থির হয়ে সমস্ত বিচার ব্যবস্থা কে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখায়। তার অপরুপ, সুন্দর দেহ সৌষ্ঠব  ব্যাক্তিত্বে মোল্লারাও বুঝি কেঁপে ওঠে।  বিচারে রায় হয়, দোররা মারতে হবে, কিন্তু ফেলুমিয়ার বাগান বাড়ি,  রমজানের লকলকে জিহবা আর অনেকের লোভাতুর দৃষ্টির যে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে,  রায় দেন খতীব সাহেব, এই প্রথম গুনাহ করেছে আওরৎ তাই ওর কপালে শ্যাকা দিয়ে ওকে একঘরে করা হোক। বেগানা আওরতের ছেলে হয়েছে এ বড় শক্ত গোনাহের কথা। সমস্ত গ্রামবাসী  যখন হুরমতির জন্য দরদ ভরা মন নিয়ে ভয়ে চুপসে আছে প্রতিবাবাদী কণ্ঠ শোনা যায় লেকু আর কসির আলীর। এক মজলিসে দুই বিচার! পাপ কি হুরমতি একা করেছে? রমজানের বিচার হবে না? দৌড়ে এসে খবর দেয় মালু, রাবু আর আরিফা কে। জ্বর গায়ে হুরমতির কপালে দগদগে ক্ষত করে দিয়েছে ফেলুমিয়ার হুকুমে কালু।
রাবু আর আরিফা মানে সৈয়দ বাড়ির মেয়েরা পর্দা নিয়েছে ইতিমধ্যেই। এরই মধ্যে রাবু আর আরিফা যাবে মালুর সহায়তায় সবার চোখা ফাঁকি দিয়ে হুরমতিকে দেখতে। পৌঁছে যায় শত বিপত্তি পেরিয়ে মালুরই দায়িত্ব পরে লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে হুরমতির বাড়িতে নিয়ে যাবার। রাবু,  আরিফা আর আম্বিয়ার সেবা শুশ্রূষায় হুরমতি কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পায়।
বাকুলিয়া আর তালতলী পাশাপাশি দুই গ্রাম। এই দুই গ্রামের দুই পরিবার মিয়া আর সৈয়দরা। শ্রেষ্ঠত্ব আর ধার্মিকতা নিয়ে লড়াই থাকলেও আছে দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তা। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কে শহীদুল্লাহ্ কায়সার নিবিড় যত্নে স্বার্থক করে তুলেছেন। চলুন চরিত্রগুলোর দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক।
#মালু সৈয়দ বাড়ির খতীব সাহেবের ছেলে। সৈয়দ বাড়ির মেয়ে রাবু আর আরিফার সব কাজের চেলা। গাছে চড়ে পাকা ডাসা জাম খাওয়া, দুপুরে সৈয়দ গিন্নির চোখ ফাঁকি দিয়ে অসুস্থ হুরমতিকে দেখতে যাওয়া, বিলে মাছ ধরতে যেয়ে শিং মাছের কাঁটা খাওয়া। সবকিছুতেই মালু ই যেন একান্ত সহচর।  দীর্ঘ সময় ধরে সুরা আর কিরাত পড়া মালু পাশের গ্রাম তালতলী তে যাত্রা দেখতে যেয়েই পেয়ে যায় সুরের সন্ধান। এই সুরের হাত ধরেই জুটে যায় মালুর আশ্রয় প্রতিষ্ঠা সব। আবার নতুনের জোরে ভেসে যায় মালুর যশ প্রতিষ্ঠা সব। কিন্তু মালু কখনো আপোষ করেনি অসুন্দর, লোভ, পরনির্ভরশীলতা আর অর্থহীন প্রতিষ্ঠার কাছে।
#রাবু সৈয়দ বাড়ির এক মেয়ে  যার জন্মের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মা মারা যায়। বাবা ধর্মের নামে দেশান্তরি হয়। রাবু যেন এক পদ্ম সরোবর। সেই ছোট বয়স থেকেই মাতৃত্ব আর স্থিরতা তার চলা, বলা আর অসহায়ের সেবায়। মালুকে সবসময়ই মায়ের মারের হাত থেকে বাঁচিয়ে এসেছে রাবু।
হঠাৎ করে কোন একদিন রাবুর দরবেশ বাবা ফিরে এসে বিয়ে দিয়ে দেয় ষাট বছরের বহু বিবাহিত পীরের সাথে। সেদিন নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে মায়ের শাড়ি আর গয়না পরে বাসর ঘরে ঢুকে যায় ষাট বছরের বহু বিবাহিত পীরের সাথে। পরের দিন বাড়ি আসে বিপ্লবী প্রেমিক চাচাত ভাই জাহেদ। সেকান্দর মাষ্টার, লেকু, কসির, সবাইকে নিয়ে ভাগিয়ে দেয় পীর আর তার দলবল কে।  দরবেশ বাবার পা ধরে প্রাণপণে আটকাতে চায় স্নেহের কাঙাল রাবু। দরবেশ বাবা তার কাঙালিপনার জবাব দেয় অভিশাপ দিয়ে। বাবাকে তাড়ানো, স্বামীকে তাড়ানোর দায়ে যে রাবু একদিন জাহেদকে দোষী সাব্যস্ত করতো, সেই রাবু পড়ালেখা করে ইতিহাসে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করে জাহেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে। শেষমেষ দরবেশ বৃদ্ধ বাবা আর গ্রামের মেয়েদের শিক্ষা, নাড়ীর টান আর প্রেমিক জাহেদের মূল্যবোধ আর শিক্ষাকে দৃঢ় হাতে উঁচিয়ে তুলে ধরে। রাবু হয়ে ওঠে ভালোবাসা, বিশুদ্ধ বিপ্লব আর মানবতার বিমূর্ত প্রতীক।
#জাহেদ একদিকে ভারত বর্ষের স্বাধীনতা, অন্যদিকে পশ্চাদপদ মুসলিম জাতির জাগরণ সর্বোপরি মানবাতার জয়গান ই জাহেদ চরিত্রটির অনন্য মহিমা। একদিকে নিজের প্রেমিকা রাবুর ষাট বছরের বরকে পিটিয়ে ভাগিয়ে দেয়া আবার সেই হাতেই বারবনিতা হুরমতির মৃত সন্তান কে গোসল করানো ; এই হচ্ছে জাহেদ। রাবুকে ভালোবেসেছে ধ্যানমগ্ন প্রেমিকের মতোই। তবে সেই প্রেমও তাকে বিপ্লব থেকে পিছু হটাতে পারেনি। শেষ দৃশ্যে পুলিশ যখন ধরে নিয়ে যায়; রুমাল উড়িয়ে রাবুকে চিৎকার করে জানিয়ে যায় আমি আসবো রাবু চিন্তা করিস না আমি আসবো।সেই প্রতিশ্রুতি ই রাবুর পথের আলো হয়ে থাকলো। একদিকে রাবুর নিমগ্ন প্রেমিল আর অন্যদিকে একই সাথে বিশুদ্ধ বিপ্লবী। এরকম একজন প্রেমিক পেলে লক্ষ জনম রাবু হয়ে জন্মানো যায়!
#সেকান্দর মাষ্টার  একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন ধুপ হয়ে আলো জ্বেলে। পৃথিবী আজন্ম বোকারাই টিকিয়ে রেখেছে। যারা স্বপ্ন দেখেছে বেহিসাবি, ভালোবেসেছে গনিতের ধারাপাত ছাড়া। সেকান্দর মাষ্টার তারই উজ্জ্বল মূর্তি। ভাই সুলতান কে সুশিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করবেন আর গ্রামবাসীর মুক্তি সেই লক্ষেই একটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। প্রকৃত অর্থে ই তিনি ধুপ।
#রমজান যেন মাছ ধরার প্রতীক্ষায় এক ধ্যানমগ্ন বক। যার একমাত্র সাধনা টাকা পয়সা প্রতিষ্ঠা। আছে সৈয়দ বাড়ির নীল রক্তের সুন্দরী হুরমতির শরীরেরও। আবার হুরমতির ওপর প্রতিশোধ নিতেও ছাড়েনি। যুদ্ধ, দেশ বিভাগ সবকিছুর সুবিধা কাজে লাগিয়ে কানকাটা রমজান হয়ে ওঠে কাজী রমজান।
এই পৃথিবীতে আলো আর অন্ধকার এর বিরোধ আর লড়াই চিরায়ত। অন্ধকার এর মরণ হলে আলো যে নিষ্পৃহ হয়ে যাবে। এই আলো আর অন্ধকার কে শহীদুল্লাহ্ কায়সার নিবিড় যত্নে পরম ভালোবাসায় এঁকেছেন। যতটা যত্নে তিনি জাহেদ,রাবু,  সেকান্দর মাষ্টার, মালুকে এঁকেছেন ততটা যত্নেই তিনি ফেলু মিয়া,রাম দয়াল, আর অন্ধকার এর বিমূর্ত প্রতীক রমজান কে এঁকেছেন।
একই উপন্যাসে উঠে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশ বিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ও মন্বন্তর এর আখ্যান।
যেটুকু সীমাবদ্ধতা চোখে লেগেছেঃ মালু চরিত্র টিকে তিনি এঁকেছেন অনুচ্ছেদ এর পর অনুচ্ছেদ তাও যেন চরিত্র টি ঠিক বিকশিত হয়নি।
মহাকাব্যিক এই উপন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন চমৎকার সব উপমা; শেষ রাতের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ, শিশির চেটে খেয়েছে মাটি আরও অনেক।
পরিশেষে বলতেই হয় সংশপ্তক বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল নক্ষত্র। একজন পাঠক হিসেবে, একজন উদীয়মান লেখক হিসেবে আপনার কাছে আজন্মের ঋণ শহীদুল্লাহ্ কায়সার।  একবুক ভালোবাসা ও কম হয়ে যাবে আপনার জন্য।
পাঠক আপনিও আবার পড়তে পারেন বইটি। ২৫০ টাকা মুল্যে বইটি পাওয়া যাবে পাঠক সমাবেশ ও রকমারি ডটকমে।
নুসরাত সুলতানা: কবি ও কথাসাহিত্যিক