You are currently viewing জীবনের হালখাতায় || আঞ্জুমান রোজী

জীবনের হালখাতায় || আঞ্জুমান রোজী

জীবনের হালখাতায় || আঞ্জুমান রোজী

 

ক’দিন ধরে গল্পের একটা প্লট মাথায় ঘুরছে। কাহিনিটা থরে থরে সাজানো আছে। তারপরও কোথায় যেন একটা বাধা পাচ্ছি। আনমনে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখি কেয়া এক কাপ চা হাতে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, কি ভাবছিস এতো?

চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে বলি, একটা গল্পের প্লট মাথায় ঘুরছে অনেকদিন ধরে। শুরুটা কিভাবে করবো বুঝতে পারছি না। শুরু করতে না-পারার কারণে আমার আজকাল লেখাই হচ্ছে না।

কেয়া তখনই উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, এই যে আমার সাথে কথা বলছিস এখান থেকে শুরু কর। তারপর আসল কাহিনির কাছে চলে যা।

আমি চিন্তিত মুখে বলি, তা করা যায়। তবে কাহিনির জট খুবই স্পর্শকাতর। এর থরে থরে ভাঁজ খুলতে গেলে নিজেই কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ি! আবার আরেকটা বিষয় আমাকে ভীষণভাবে কুরে কুরে কষ্ট দিচ্ছে।
কথাগুলো বলেই ভাবলাম, কেয়াকে কি অতুনুর কথা বলবো?

ততক্ষণে কেয়া উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে, সেটা কেমন?
আমি একটু গম্ভীর ভাব নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যালকনির দিকে যেতে যেতে বললাম, একটা সুস্থ ছেলে হঠাৎ করে কিভাবে যে মারা গেল!
বলেই কেয়ার দিকে ফিরে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে চেয়ে থাকি।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলি,
এ ভাবনাটা আমার মাথায় পেরেক ঠোকাচ্ছে। যদিও ছেলেটা অপ্রকৃতস্থ ছিল। জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে ছেলেটা তার স্বাভাবিকত্ব হারাতে শুরু করে। তারপর ধরা পড়ে ছেলেটা প্রতিবন্ধী। বয়স হয়েছিল ষোল কি সতেরো! হঠাৎ করে একদিন সকালে শুনি অতুনু আর নেই!

বলতে বলতে আমার কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিলো। চোখও বোধ হয় একটু ঝাপসা হচ্ছিলো। কেয়া সেটা লক্ষ্য করে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, কিভাবে তাদেরকে চিনিস?

-ওরা আমার পাশের ফ্লাটে থাকে। প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো ওদের সাথে। অতুনু আমাকে দেখলে হাতপা ছুঁড়ে হাসতো। ওর পাশে গিয়ে বসলে আমার হাতটা ধরে বসে থাকতো। কি মায়াবী মুখ যে ছিল তার! অথচ দেখ, প্রকৃতির কি এক খেলা ছেলেটাকে অপ্রকৃতস্থ করে রাখে। আমি জানি, অতুনুর মা’র খুব কষ্ট হতো ওকে দেখভাল করতে। দিনে দিনে ছেলেটা বড় হচ্ছে, অথচ মাকেই সবকিছু করে দিতে হতো। নাওয়াখাওয়া, ওয়াসরুম সবকিছু। কি করবে বল, শত হলেও তার নিজের ছেলে তো! প্রায়ই সময় দেখতাম অতুনুর মা খুব ক্লান্ত হয়ে আছে। কথাও কম বলতেন। বাবাও সবসময় নির্লিপ্ত থাকেন।

কথাগুলো বলতে বলতে আমার চোখের সামনে অতুনুর মুখটা দেখতে পাই। সেই হাসি, সেই চোখ। কেয়া আমাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলে, কি হলো? সাথে সাথে আমি সম্বিত ফিরে পাই।

কেয়া আবার জিজ্ঞেস করে, ছেলেটাকে নিয়ে এতো ভাবছিস কেন?
আমার উদাস দৃষ্টি বাইরে রোদ ঝলমল আলোয় স্থির হয়ে যায়। কেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলি, জানিস, যখন যেতাম অতুনুর কাছে তখন ওর হাসিমাখা মুখ আমাকে দুর্বল করে দিতো। কি যে মায়া ছিল ছেলেটার মধ্যে! একদম মন থেকে সরাতে পারছি না। বলতে বলতে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

কেয়া বেগতিক অস্থির হয়ে উঠে। আমাকে জড়িয়ে ধরে। বললো, চল বাইরে কোথাও যাই। তারপর তোর কথা শুনবো।
আমিও সুবোধ বালিকার মতো কোনো কথা না-বলে কেয়ার পিছু নিলাম৷

কেয়া ড্রাইভিং সিটে বসে আমাকে বেল্ট লাগাতে বললো। গাড়ি ছুটছে। কোথায় যাচ্ছে জানি না। তবে চুপচাপ বসে বাইরে সবুজ প্রকৃতির আলোছায়া দেখতে ভালো লাগছিল। কিছুটা আরাম বোধ করছি।

কেয়া আমার খুব কাছের বন্ধু। আমার মনখারাপের আশ্রয়। ওর কাছে আসলে মনটা সুস্থির হয়ে যায়। তারপরও অতুনুর বিষয়টা মাথা থেকে একেবারেই যাচ্ছে না।

প্রায় ছুটির দিন বিকেলে অতুনুর মা’র সাথে চা পান করতে করতে গল্প করতাম। তখন টের পেতাম তার বুকের ভেতর কষ্টের চাপা অনুভূতি। অসহায় নিয়তির কাছে মানুষকে কখনো কখনো সমর্পণ করতে হয়। অতুনু হলো সেই নিয়তি। ছ’বছর পাশাপাশি ফ্লাটে থেকে অতুনুর বিষয়টা দেখতে দেখতে আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ!…অতুনুর মৃত্যু আমাকে বজ্রপাতের মতে আঘাত করলো।

মনের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস চলে এলো। অতুনুর বিষয়টা মাথা থেকে সরানোর জন্য কেয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছিস?

– দেখি, দূরে কোথাও কফিশপে বসবো। না-কি লেকের কাছে যাবি?
আমি বললাম, তোর ইচ্ছে।

আবার আমাদের মাঝে নিরবতা নেমে আসে। এই শহরটা এমনই। কথা কম বলার শহর। কেয়া কোলাহল ছেড়ে কান্ট্রি সাইডে ছিমছাম ছোট্ট একটা বাড়ি কিনে। এখানে এলে প্রকৃতির ধ্যান মগ্নতা দেখি। মানুষের কথার অনুভূতি এখানের প্রকৃতি বোঝে। আগলে রাখে মানুষদের। মানুষও হাফছেড়ে বাঁচে প্রকৃতির কাছে নিজেকে তুলে দিয়ে। আজকাল মানুষ তো মানুষের কথা শোনে না! তারচেয়ে নিরব প্রকৃতির মাঝে নিজেকে সমর্পণ ঢের ভালো। তা-ই কেয়ার কাছে আসলে সেই স্বস্তির ভাবটা পেয়ে যাই। কিন্তু জীবন তো বড়ই অদ্ভুত। অনুভূতিগুলো তড়পায়।

বেশ দূরে গিয়ে ছোট্ট এক কফিশপ খুঁজে পেলো কেয়া। গাড়ি পার্ক করে আমরা কফিশপের ভেতর এক কর্ণারে খালি জায়গা দেখে বসলাম। কফির অর্ডার দিয়ে কেয়া আমার পাশে এসে বসলো। বললো, বল এখন তোর কথা। কেন এতো মনভেঙ্গে আছে? বুঝলাম ছেলেটা তোর প্রতিবেশীর ছেলে। ছেলেটাকে তুই খুব আদর করতি। কিন্তু প্রকৃতির ব্যাপারে আমাদের তো কোনো হাত নেই, তাই না! এটাকে তো মানতে হবে। কথা ক’টা বলেই উদগ্রীব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি আরো নির্লিপ্ত নিশ্চুপ হয়ে যাই। আসলে কেয়াকে বুঝাতে পারবো না। কিছু কিছু অনুভূতি আছে যা প্রকাশের ঊর্ধ্বে থাকে৷ নিজেকে পুড়ায়, কষ্ট দেয় তারপরও বলা যায় না। কিন্তু চোখেমুখে অবয়বে তাতো ফুটে ওঠে! যা দেখে কেয়া এতো অস্থির হচ্ছে!

শীতল কণ্ঠে কেয়াকে শুধু বললাম, সুস্থ ছেলেটা মারা গেলো। মারা যে গেলো সেটাও পাশে থেকে জানতে পারলাম না। পরশুদিন সকালে অতুনুদের ঘরের দরজায় নক করে যখন ভেতরে গেলাম তখন অনুভব করলাম একটা থমথমে ভাব। অতুনুর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো দুদিন আগে মারা গেছে।কিভাবে কেমন করে, জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাইনি। তার আগেই অতুনুর মা বলে, আমরা একটু বাইরে যাবো। অগত্যা সময় ক্ষেপণ না করে বের হয়ে আসি। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ঘরে আর থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। তারপরেই তোর কাছে চলে এলাম।

তখন কেয়া স্বান্তনার ভাব নিয়ে বলে, থাক আর ভাবিস না। ওদের সন্তান ওদের ব্যাপার। তুই শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছিস। আজ রাতটা আমার কাছে থেকে যা৷ দুজনে মিলে মুভি দেখবো। এখন বল, গল্পের প্লটের জট খুলতে পারছিস না কেন? না-কি অতুনুর বিষয় নিয়ে মাথা খারাপ করছিস?

আমি অবাক চোখে কেয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, আমি কি সত্যি সত্যি মাথা খারাপ করছি? এসব তো ইচ্ছেকৃত নয়, অতুনু আমার মধ্যে কেমন যেন জেঁকে বসেছে। আমি তো সত্যিই অতুনুকে ভালোবাসতাম!

নিজের মধ্যে প্রবোধ গুনে নিজেকে বুঝালাম, থাক এ বিষয়ে আর কথা বলবো না। কেয়া আমার অনুভূতি বুঝতে পারবে না। তারচেয়ে বরং অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই। এতে আমার ভেতরের অস্থিরতাও হয়তো কমবে, সেইসাথে মনখারাপের বিষয়টা যদি একটু লাঘব হয়। তাই প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য জিজ্ঞেস করি, তোর এমন নিরিবিলি একাকী জীবন কেমন লাগে? মাঝেমধ্যে তো আমার কাছে আসতে পারিস?

নিরসভাব নিয়ে কেয়া বলে, তা পারি। তবে শহরের কোলাহল ঠেলে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। এই যে তুই আসিস মাঝেমধ্যে এটাই আমার অনেক আনন্দ। তাছাড়া মানুষের ভীড় আমার আর ভালো লাগে না।

অন্টারিওর উত্তরে বেশ দূরে কেয়ার বাড়ি। এখানে কেয়ার জীবনযাপন শহরকেন্দ্রিক নয়। একেবারে সাদামাটা জৌলুষহীন জীবন। স্থানীয় একটা ক্লিনিকে সপ্তাহে দুদিন বসে। ডাক্তার মানুষ। তার উপর একাকী জীবন। স্বস্তিতেই জীবনটা পার করে দিচ্ছে। এখানে এলে আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।

এভাবে আরো কিছুক্ষণ বসে জীবনের নানা রঙের গল্প করে রাত নয়টার দিকে ফিরে আসাতে লাগলাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু গাড়ির হেডলাইটের আলোয় গন্তব্যের পথ দেখে নিচ্ছে কেয়া। গাড়ির সিডিতে বাজছে, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ…!’

রাতের ডিনার সেরে দুজনে বসে মুভি নির্বাচন করলাম। সময়গুলো গড়িয়ে যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। আমার বুকের ভেতর অনুভূতিও ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সূর্যটা জানালা দিয়ে গড়িয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ছে। বাইরে চোখ পড়তে গাছের পাতার ফাঁকে আলোর ঝিলিমিলি রূপ দেখি। বিছানা ছেড়ে বাড়ির বাইরে বেক ইয়ার্ডে গিয়ে বসি। হাতে কিছু একটার ছোঁয়া পেলাম। কেউ কি আমার হাত ধরে আছে?

হঠাৎ করে উঠে গিয়ে কেয়াকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললাম, আমি এখন যাবো। কেয়া আড়মোড়া দিয়ে উঠতে উঠতে বললো, এখুনি? দুপুরে লাঞ্চ করে যা।

আমি বললাম, না। এখুনি যাবো।

কেয়া উঠেই নাস্তার ব্যবস্থা করলো। কোনো রকম তা নাকেমুখে গুজে ওয়ান টাইম ইউজের কাপে কফি নিয়ে আমার গাড়িতে বসলাম। এভাবে তাড়াহুড়ো করে ফিরে যাচ্ছি দেখে কেয়া বোধ হয় একটু অবাক হচ্ছে। শুধু বললো, আবার আসিস কিন্তু। আমি হাত নেড়ে বললাম, আসবো।

আমার গাড়িতে অযথা স্পিড বেড়ে যাচ্ছে। গাড়ির গতি মনের গতি সমানতালে দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। তিনঘণ্টা দূরত্বের পথ হাওয়ার গতিতে শেষ হয়ে গেলো। নিজ এপার্টমেন্টে ঢুকতে গিয়ে দেখি আমার মুখোমুখি এপার্টমেন্ট অর্থাৎ অতুনুদের ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে কিছু লোক হাঁটাহাঁটি করছে। ঘরের ভেতর কোনো ফার্নিচার নেই। বলতে গেলে শূন্য ঘর। কোথায় গেলো তারা? নিজের মধ্যে প্রশ্ন রেখে ঘরের ভেতর পা দিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কোথায়?
আরেকজন বললো, দে ল্যাফট।

আমি বিস্ময় নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললাম, হোয়াট ডু ইয়ু মিন, দে ল্যাফট?

তারা আমার কথার জবাব দিলো না। শরীরটা শীতল হয়ে এলো। ধীর পায়ে অতুনুদের ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। মাথাটা ঝিম মেরে উঠলো। সকালে কার হাতের ছোঁয়া ছিল? সে কি অতুনুর? কষ্ট জর্জরিত এক অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে আড়ষ্ট করে রাখে।

অতুনু আমার জীবনে কিছুই না। তারপরও চলার পথে একটা ছন্দপতন ঘটিয়ে দিলো। বুকের ঘরে ঠাঁই করে নিলো। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, কেন অতুনুর বাবা মা এভাবে এপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে গেলেন! কেন বিদায়টুকু জানালেন না! সবকিছু মিলে আমার ভেতর এক রহস্য তৈরি হতে থাকে; সাথে থাকে একরাশ যন্ত্রণা।

অতুনু এখন আমার চিন্তার জগতে একটা দ্বীপ। জীবনের হালখাতায় সেই দ্বীপ কখনো কখনো ছবি আঁকবে।

******************************