জীবনশিল্পী শওকত ওসমান: প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি
ক্রীতদাসের হাসি, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, জননী ও জাহান্নাম থেকে বিদায় নামক আলোড়িত উপন্যাসগুলোর জনক শওকত ওসমান। বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় একটি নাম যার লেখার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র জুড়ে বিরাজমান বাঙালি জাতির মুক্তির লড়াইয়ের প্রস্তুতি, প্রায় উপনিবেশিক পাকশাসনের বিরুদ্ধে বারুদজ্বলা ঘৃণা ও প্রতিরোধ সংগ্রামে অকুতোভয় বাঙালি জাতির অদম্য স্পৃহা উঠে এসেছে। তাঁর লেখনী ছিলো বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। জন্মসূত্রে তাঁর নাম শেখ আজিজুর রহমান। শওকত ওসমান একাধারে নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক লেখা ও শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন। মুক্তচিন্তা ও মুক্তমানুষের স্বাধীনতার অন্বেষায় তাঁর লেখনী ছিলো প্রবল সোচ্চার এবং তির্যক শব্দের মারণাস্ত্রে তিনি দেশ ও জাতির শত্রুদের বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকন্ঠ।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া, মাতা গুলজান বেগম। পড়াশোনা করেছেন মক্তব, মাদ্রাসা, কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা শুরু করলেও পরবর্তীকালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও অর্থনীতি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কিন্তু একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। আইএ পাস করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে প্রভাষক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্সে (বর্তমানে সরকারি কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম) যোগ দেন এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছা অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে কিছুকাল তিনি ‘কৃষক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ শওকত ওসমানকে বলতেন ‘অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ’। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তিনি চলে আসেন পূর্ববঙ্গে।
গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, কবিতা, আত্মজীবনী, স্মৃতিখণ্ড, শিশুতোষ ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন অনেক। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ওসমানের কবিতা বুলবুল পত্রিকায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন। ”ক্রীতদাসের হাসি” তাঁর প্রসিদ্ধ উপন্যাস। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৭), ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ইত্যাদি সম্মানজনক পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন। তাঁর সৃষ্টির বিশাল ভান্ডার বাংলাসাহিত্যকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
উপন্যাস
- জননী (১৯৫৮) (প্রথম উপন্যাস)
- ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২)
- সমাগম (১৯৬৭)
- চৌরসন্ধি (১৯৬৮)
- রাজা উপাখ্যান (১৯৭১)
- জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১)[মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক]
- দুই সৈনিক (১৯৭৩)[মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক]
- নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩)[মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক]
- পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩)
- আর্তনাদ (১৯৮৫)
- রাজপুরুষ (১৯৯২)
- জলাঙ্গী (১৯৭৬)[মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক]
- তোলপাড়
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস
- জাহান্নম হইতে বিদায়
- দুই সৈনিক
- নেকড়ে অরণ্য
- জলাঙ্গী
গল্পগ্রন্থ
- জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২)
- মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬)
- ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০)
- প্রস্তর ফলক
- সাবেক কাহিনী
- জন্ম যদি তব বঙ্গে[মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক]
- পুরাতন খঞ্জর
- বিগত কালের গল্প
- নেত্রপথ
- উভশৃঙ্গ
- পিজরাপোল
- উপলক্ষ
প্রবন্ধগ্রন্থ
- ভাব ভাষা ভাবনা (১৯৭৪)
- সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৫)
- মুসলিম মানসের রূপান্তর (১৯৮8)
নাটক
- আমলার মামলা (১৯৪৯)
- পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০)
- তস্কর ও লস্কর
- কাঁকর মনি
- বাগদাদের কবি (১৯৫৩)
শিশুতোষ গ্রন্থ
- ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪)
- মস্কুইটো ফোন (১৯৫৭)
- ক্ষুদে সোশালিস্ট (১৯৭৩)
- পঞ্চসঙ্গী (১৯৮৭)
রম্যরচনা
- নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত (১৯৮২)
স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ
- স্বজন সংগ্রাম (১৯৮৬)
- কালরাত্রি খ-চিত্র (১৯৮৬)
- অনেক কথন (১৯৯১)
- গুড বাই জাস্টিস মাসুদ (১৯৯৩)
- মুজিবনগর (১৯৯৩)
- অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ (১৯৯৪)
- সোদরের খোঁজে স্বদেশের সন্ধানে (১৯৯৫)
- মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা (১৯৯৬)
- আর এক ধারাভাষ্য (১৯৯৬)
অনূদিত গ্রন্থ
- নিশো (১৯৪৮-৪৯)
- লুকনিতশি (১৯৪৮)
- বাগদাদের কবি (১৯৫৩) (নাটক)
- টাইম মেশিন (১৯৫৯)
- পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়, ১৯৫৯)
- স্পেনের ছোটগল্প (১৯৬৫)
- পাঁচটি নাটক (মলিয়ার, ১৯৭২)
- ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা (১৯৭৩)
- পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ (১৯৮৫)
- সন্তানের স্বীকারোক্তি (১৯৮৫)
অন্যান্য গ্রন্থসমূহ
- মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমগ্র
- উপন্যাসসমগ্র ১
- উপন্যাসসমগ্র ২
- উপন্যাসসমগ্র ৩
- গল্পসমগ্র
- কিশোরসমগ্র ১
- কিশোরসমগ্র ২
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। বাংলাসাহিত্যের অন্যতম বরপুত্র শওকত ওসমানকে তাঁর প্রয়াণ দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
===============
নিচে বদিউর রহমান রচিত “শওকত ওসমানের লেখায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ” প্রবন্ধটি পুনঃপাঠের উদ্দেশ্যে এখানে সন্নিবেশ করা হলো।
শওকত ওসমানের লেখায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
বদিউর রহমান
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অন্যতম প্রধান পুরুষ শওকত ওসমান। সমাজচেতনা, শিল্পভাবনা আর জীবনচিত্র অঙ্কনে শওকত ওসমানের রচনা বৈশিষ্ট্যময়। মুক্তবুদ্ধি আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক শওকত ওসমান সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধারার লেখকদের অন্যতম। ষাটের দশকে তার রচিত ক্রীতদাসের হাসি, জননী, সমাগম, চৌরসন্ধি প্রভৃতি উপন্যাস সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহজেই।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন শওকত ওসমান সচেতন লেখকদের সারিতে পরিপূর্ণভাবে অবস্থানরত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন সচেতন লেখক হিসেবে। সত্তর দশকে প্রকাশিত তার রচনাবলির মধ্যে এর সচেতনতার ছাপ সুস্পষ্ট।
জাহান্নাম হইতে বিদায় শওকত ওসমানের এ দশকে রচিত প্রথম উপন্যাস। প্রকাশিত হয় একাত্তরের নভেম্বরে, প্রকাশক কলকাতার আন্নদ পাবলিশার্স। বইটি রচিতও হয়েছে পশ্চিম বাংলায়, যখন লেখক স্বয়ং শরণার্থী হিসেবে পরভূমে আশ্রিত। সেখানে বন্ধুদের উৎসাহেই এ উপন্যাস রচনা। উপন্যাসের ভূমিকায় লেখকের বক্তব্য, ‘অল্প পরিসরে ওই সামাজিক ঘূর্ণিঝড়ের সম্যক পরিচয় দান কঠিন। বক্ষমান উপন্যাস একটি মাত্র মানসলোকে বিচরণ।’ লেখক একাত্তরের বাংলাদেশ’ বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ। সমস্ত পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সে পরিস্থিতি। সে এক নারকীয় অবস্থা। একটি মাত্র উপন্যাসে তার সব দিক তুলে ধরা অসম্ভব। তাই শওকত ওসমান আশ্রয় নিয়েছেন একাধিক রচনার।
জাহান্নাম হইতে বিদায় বইয়ের নামই বিষয়বস্তুর ইঙ্গিতবাহী। বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানিদের অত্যাচারে এক জাহান্নামের রূপ ধারণ করেছে। সে জাহান্নাম থেকে বিদায় কে না চায়? এ কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র মাস্টার সাহেব গাজী রহমান একজন সচেতন বাঙালি। দেশ ও দেশের মানুষ আর সে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা সম্পর্কে সচেতন। সচেতন দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কেও। এ মাস্টার সাহেবের শরণার্থী হিসেবে দেশত্যাগের কাহিনিই উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। এ পথে চলতে হাজারো অভিজ্ঞতার বর্ণনা ফুটে উঠেছে কাহিনির সর্বত্র। জাহান্নাম হতে বিদায় ঊনিশশ একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের বাস্তব চিত্রের একটি দিক। লেখকের অন্যান্য রচনায় সে সময়ের আরো নানা দিকের পরিচয় পাওয়া যাবে।
এ দশকে লেখকের পরের বই দুই সৈনিক। এ কাহিনির দুই প্রধান চরিত্র মখদুম মৃধা ও সয়ীদ মাতুব্বর। মখদুম মৃধা ঝানু মুসলিম লীগার। পাকিস্তানের জন্য তার আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। মৃধা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান; একে ধ্বংস করতে উদ্ধত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও হিন্দুরা যৌথভাবে। তাই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোক গ্রামে এলে আনন্দ ধরে না। সয়ীদ মাতুব্বর মৃধারই খয়ের খাঁ ব্যক্তি।
মৃধার দুই মেয়ে। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। যুদ্ধাবস্থার কারণে বাবার কাছে বাড়িতে অবস্থানরত। মৃধার পরিবারে আর আছে মৃধার স্ত্রী ও মা। মেয়েরা এ যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে। গোপনে আকাশবাণী শোনে। তাদের সহায়তা করে দাদিমা। বাবার সঙ্গে মেয়েরা থাকে চুপচাপ।
একদিন সত্যি সত্যিই গ্রামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকরা আসে। একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন সাধারণ সৈনিক। মৃধা রাস্তার কাছে এগিয়ে স্বাগত জানায় সৈনিকদের, তখন পড়ন্ত বেলা। অতিথিদের জন্য বৈকালিক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। সবই করে মেয়েরা আর তাদের মা। আপ্যায়নে দারুণ খুশি হয় সৈনিকরা। মৃধা তাতে গদগদ হয়ে সৈন্যদের রাতের খাবার ব্যবস্থা করে। মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দেয়। চলতে থাকে রাতের আয়োজন। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খোলা বাতাসে একটু চাঙা হওয়ার জন্য মেজর ও ক্যাপ্টেন মদ পান করে। তারা নেশার ঝোঁকে সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে মিলে খটক নাচ নাচে। একসময়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়। মৃধাও খায় তাদের সঙ্গে। মৃধাকে যথেষ্ট খাতির করে সেনারা।
রাতের খাবার পরই কাহিনি অন্য খাতে মোড় নেয়। দুই সৈনিক মেজর ও ক্যাপ্টেন হিংস্র হয়ে ওঠে। তারা মৃধাকে ডেকে সরাসরি প্রস্তাব দেয় তাই দুই মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়ার। মৃধা তাতে অসম্মতি জানালে তারা মৃধাকে আটকে রেখে দুই মেয়েকে কাঁধে তুলে বিদায় হয়। মৃধা কিছুটা বেশামাল হয়ে যায়। মাতুব্বর আগেই সটকে পড়েছিল অবস্থা বেগতিক দেখে।
ভোরবেলা মাতুব্বর মৃধার খোঁজ নিতে এসে দেখে মৃধার স্পন্দনহীন জড় দেহটা একটা কাঁঠালগাছের সঙ্গে ঝুলছে। তার পকেটে হাত দিয়ে দেখে একটা খামে কিছু টাকা। মাতুব্বর খাম থেকে টাকাগুলো হাতড়ে খালি খামটা আবার পকেটে রেখে সটকে পড়ে। কাহিনির এখানে শেষ।
কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে সচেতন লেখক শওকত ওসমান সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনীতি, সামাজিক পরিবেশ বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা এবং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের কথা বলতে ভোলেননি।
নেকড়ে অরণ্য প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। এটাও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের পটভূমিতে রচিত কাহিনি। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি বন্দি শিবিরেই আবর্তিত হয়েছে এ কাহিনি। একটি চালের গুদামকে হানাদার বাহিনী ব্যবহার করছে বন্দি শিবির হিসেবে। সে শিবিরে আশ্রয় পেয়েছে বিভিন্ন বয়সের বিপুলসংখ্যক নারীবন্দি। তাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের বিবরণই এ বইয়ের মুখ্য বিষয়। নেকড়ে অরণ্যকে উপন্যাস বলা যায় না, কারণ এর মধ্যে কাহিনির বিস্তৃতি নেই, নেই চরিত্রসমূহের বিকাশ। শুধু আছে ডায়েরির মতো স্মৃতিচিত্র বর্ণনা।
এ দেশের শতাধিক অসহায়-নির্যাতিতা নারী আশ্রয় পেয়েছে একটি বন্দি শিবিরে। সেখানে তারা প্রতিদিন শিকার হচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশবিক অত্যাচারের। সব নারীই এখানে উদোম শরীর। প্রায় অন্ধকারে একটি গুদাম ঘরে তাদের বাস। তাদের শরীর ও মনের ওপর কয়েকজন সৈন্য কী দুঃসহ অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তারই বর্ণনা পাওয়া যায় এ বইয়ে। এসব রমণীর মধ্যে যারা তেজস্বী তারা আত্মহত্যা করে নানা কৌশলে। এদের মধ্যেই একসময় একজন বাঙালি তেজদীপ্ত যুবক মুক্তিযোদ্ধাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এ বন্দি শিবিরে, তাকে দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করার মানসে। নিজের দেশের মা-বোনদের দেখে স্থির থাকতে পারে না। সে মুখ খুলতে সম্মত হয়। তবু এ পরিবেশ থেকে মুক্তি চায়। একসময় ক্যাপ্টেনের গুলিতে খুনও হয় দুজন রমণী এ শিবিরে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটি বিশেষ দিকের উদ্ঘাটন হয়েছে এই গ্রন্থে। নেকড়ে অরণ্যের বিধ্বস্ত বাঙালি রমণীরা পাকিস্তানি সেনাদের নির্দয় পাশবিকতার নীরব সাক্ষী হয়েই থাকল ইতিহাসে।
শওকত ওসমানের এ দশকে অন্য উপন্যাস রাজা উপাখ্যান। রাজা উপাখ্যান রূপকথাধর্মী রচনা। কিন্তু সে রূপকথার মাধ্যমে লেখক তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। স্বাধীনতা আর মুক্তির আস্বাদ গ্রহণে সহায়ক এই কল্পকাহিনি। মহাকবি ফেরদৌসী গজনী ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন বেরীস্থানের উদ্দেশে। শাহনামার অসমাপ্ত অংশ সমাপ্ত করাই তার ইচ্ছা। লেখক শওকত ওসমান তার কল্পনার সে অসমাপ্ত কাহিনিই তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেনÑতাই-ই রাজা উপাখ্যান সম্রাট জাহুকের কাহিনি। সম্রাট জাহুক নিজ প্রাসাদে বন্দি। দেববাণীর নির্দেশে জাহুকের দুই কাঁধে দুই বিষধর গোখরো অবস্থান নিয়েছে। তারা সম্রাটকে দংশন করে না, তবে তাদের প্রতিদিনের আহার জোগাতে হয় সম্রাটকে। সে রসদ হলো যুবক অথবা জ্ঞানী বৃদ্ধের বিশ-ত্রিশটি টাটকা মগজ। যত দিন রাজা এ রসদ জোগান দিতে পারবে তত দিনই তার প্রাণ। যেদিন ব্যর্থ হবে সেদিন তারা রাজার মগজই আহার করবে তার খুলি ভেঙে। দারিয়ুস এবং জার্জিস এ মগজ সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছে। একসময় দেশে মগজের অভাব পড়লে দারিয়ুস আর জার্জিসকেও প্রাণ দিতে হয়। এক সুদর্শন গ্রাম্য যুবক হরমুজকেও আনা হয় মগজ আহরণের উদ্দেশ্যে। রাজকুমারী গুলশান এ যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হরমুজকে মুক্তি দিতে চায়। হরমুজসহ বন্দিদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে রেখে নিজ মুক্তি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। বরং সে সংকল্প করে সম্রাটকে অভিশাপমুক্ত করার। হরমুজ নিজে গ্রহণ করে গোখরোদের মধ্যে খাদ্য বণ্টনের দায়িত্ব। হরমুজ দুই গোখরোর মধ্যে খাদ্য প্রদানে বৈষম্য সৃষ্টি করলে গোখরোদ্বয় আত্মকলহে লিপ্ত হয়। পরিণতিতে দুই গোখরোই মৃত্যুবরণ করে। সম্রাট জাহুক রাহুমুক্ত হন। নতুন জীবন লাভ করেন।
সম্রাট হরমুজকে রাজকন্যা আর রাজ্য সমর্পণের প্রস্তাব করেন। হরমুজ সে প্রলোভন সহজেই প্রত্যাখ্যান করে এবং তার সহবন্দিনী রূদকে পাওয়ার বাসনা প্রকাশ করে। সম্রাটের আদেশে হরমুজের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়। হরমুজ তার সহবন্দিদেরও মুক্ত করিয়ে নেয়। মুক্ত মানুষের দল সম্রাট জাহুকের প্রাসাদ ছেড়ে চলে যায়। কাফেলা এগিয়ে যায় পাহাড়ি পথে। এভাবেই কাহিনির সমাপ্তি। কাহিনির তাৎপর্য অনুধাবনে বেগ পেতে হয় না। স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যর্থ হওয়ার নয়Ñওই আশাই ব্যক্ত হয়েছে কাহিনিতে।
লেখক এ রূপকথাধর্মী কাহিনি বিন্যাসে বহুবিধ মানবিক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। রাজবন্দিদের জীবনের বেদনা-সংশয়, জিজ্ঞাসা-সহানুভূতি, একাকিত্ব-কৌতূহল, সম্রাট জাহুকের বন্দি জীবনের কারুণ্য, মুক্ত জীবনের মানস পরিবর্তন, হরমুজ চরিত্রের দৃঢ়তা-সাফল্য, নির্লোভতা-প্রেম, প্রতিজ্ঞা-প্রতিজ্ঞাপালন, স্বদেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব ইত্যাদি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন শওকত ওসমান তার রাজা উপাখ্যানে। আবার এসব কল্পকাহিনীকে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন সার্থকতার সঙ্গে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বাবস্তা, দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন। সে শাসনের জাঁতাকলে বন্দি সমগ্র জাতি। শাসনের নামে শোষক শ্রেণি যেন বিষধর নাগিণীর মতো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে সব যুবক আর বুদ্ধিজীবীদের মগজ। এ বন্দিত্ব থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা সবাইর। কিন্তু কে দায়িত্ব নেয়? অবশেষে এলো হরমুজ এবং সার্থকও হলো সে। তারপর বন্দি মুক্তির আনন্দ। ত্যাগী হরমুজের নির্লোভ অভিব্যক্তি। সবকিছুই যেন লেখক প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন, নিয়ে এসেছেন বাস্তবতার কাছাকাছি। সমাজসচেতন লেখক শওকত ওসমান রূপকথাকে গ্রহণ করেছেন প্রতীক হিসেবে। এ প্রতীকের মধ্য দিয়েই তিনি তার কথা প্রকাশ করেছেন। এখানেই সমাজসচেতন লেখকের সার্থকতা।
এ দশকে শওকত ওসমানের সর্বশেষ এগারোটি গল্পের সংকলনÑজন্ম যদি তব বঙ্গে। পঁচাত্তরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হলেও গল্পগুলোর রচনাকাল আরো আগে। লেখকের জবানীতে ‘এই বইয়ের সব গল্প স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকায় ১৯৭১-৭২ সালে লিখিত ও প্রকাশিত। মনের তাগিদে রচনা। কিন্তু বাকি কাজ অর্থাৎ প্রকাশনার ব্যাপারে আমার আঠারো মাসে বছর।’ (শওকত ওসমান : জন্ম যদি হয় তব বঙ্গে : ভূমিকা)
এর মধ্যে জন্ম যদি তব বঙ্গে গল্পটি ২০-০৯-৭১-এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত।
স্বাধীনতার পর লেখক অধিকতর আত্মনিয়োগ করেছেন গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচনায়। যেখানে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূলনীতি চতুষ্ঠয়ের পক্ষে রচনা করেছেন অসংখ্য যুক্তিবাদী ইতিহাসভিত্তিক প্রবন্ধ। সব মিলিয়ে শওকত ওসমান এক অসাধারণ জীবনবাদী সাহিত্যস্রষ্টা।
==========================================