১। ঢাকা টু ক্যালকাটা
আশরাফ আহমেদ
এয়ার ইন্ডিয়ার ছোট একটি বিমান ঢাকার কুর্মিটোলা বিমান বন্দর ছেড়ে আকাশে উঠে গেছে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটায়। রানওয়েতে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আকাশে উঠেই বিমানটি কাত হয়ে খাড়া উঠে গেলে আমার হৃদপিণ্ড ও পাকস্থলীতে এক বিজাতীয় অনুভুতি টের পেলাম।একবারমনে হলো খিদে পাচ্ছে, পরক্ষণে মনে হলো বমি বমি লাগছে। একই সাথে জানালা দিয়ে বিমান বন্দর এবং শহরের ল্যাম্পপোস্টের আলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো ভারসাম্য হারিয়ে পৃথিবীটা একদিকে হেলে পড়েছে। কয়েক মূহূর্ত পরেই পৃথিবীটা অন্য দিকে হেলে গেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমার শরীরে এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেল যা জীবনে এই প্রথম অনুভব করলাম। যাক, শেষ পর্যন্ত আমি ঢাকার মাটি ত্যাগ করতে পেরেছি। কিছুদিন পরেই আমি ‘জাপান ফেরত’ বলে নতুন একটি পরিচিতি পাব।
বছর দুই থেকে চেষ্টা করেও বিদেশ যাত্রাটি আমার কাছে ধরা দিচ্ছিল না। এর মাঝে বেশ কয়েকবার স্বপ্নে দেখেছি স্কলারশিপ নিয়ে ইউরোপ বা জাপানে চলে যাচ্ছি বা গেছি। স্বপ্নভঙ্গের ঘুম থেকে উঠে দুঃখও পেয়েছি প্রতিবার। মনে হয়েছে উচ্চশিক্ষা নিতে পারছি না বলে চারিপাশের মানুষ আমার দিকে করুণার চোখে তাকাচ্ছে।
এবারের জাপান যাত্রাটিও কি স্বপ্নের মাঝেই ঘটছে? হাতে চিমটি কাটলাম। নড়েচড়ে বসলাম। ভয়ে ভয়ে পাশের যাত্রীর দিকে তাকিয়ে নিজেকে অভয় দেয়ার মত করে হাসলাম, প্রত্যুত্তরও পেলাম। নাহ এবার মনে হচ্ছে এটি কোন স্বপ্ন নয়। খুব সম্ভব সত্যি সত্যিই আমার বিদেশ যাওয়া হচ্ছে। এই যাওয়া উপলক্ষে তো কয়েক মাস ধরে কম ঘটনা ঘটলো না। প্রতিটি ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বিমান বন্দরে নিজের মা ও সব ভাইবোন ছাড়াও ঢাকার সব আত্মীয় স্বজন, কিছু ছাত্র, এবং অন্ততঃ চারজন বন্ধুও এসেছিলেন। প্রতিটি লোক কী বলে, এবং কীভাবে কোলাকুলি অথবা হাত মিলিয়ে আমাকে বিদায় জানালো তার প্রতিটি আমার চোখে ভাসছে। আমি চাইছিলাম ওদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কত তাড়াতাড়ি বিমানে গিয়ে উঠবো। কারণ কখন কী অঘটন ঘটে যায় তা তো বলা যায় না। কাজেই এটি আমার ঘুমের স্বপ্ন নয়, দিবাস্বপ্নও নয়।
১৯৭৪ সালের জুন মাসে এমএসসি শেষ পরীক্ষাটির পর বেকার হয়ে ঘুরেছিলাম। অক্টোবরে ফল বেরোলে প্রথমে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি শিক্ষকতার সুজোগ হাতছাড়া করেছি ওপরের ক্লাশের এক ছাত্র এবং এক সহপাঠীকে সুজোগ করে দেয়ার জন্য। জানুয়ারির এক তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েই শিক্ষকতাকে গ্রহণ করেছিলাম কায়মনোপ্রাণে। উদ্দেশ্য ছিল আমি আদর্শ এক শিক্ষক হব। হয়েও ছিলাম। বন্ধু বান্ধবদের মাঝে বিদেশ চলে যাওয়ার ঝোঁক, আমার তা নেই মোটেই। আমার পুরোপুরি মনযোগ আদর্শ শিক্ষকতার দিকে। হঠাত লক্ষ করলাম আমার ব্যাচমেট তো বটেই আমার পরের বছরে কনিষ্ঠ এক শিক্ষকও কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেল। তাতেও বিচলিত হই নি। কিন্তু ক্লাশে বকা খাওয়া এক ছাত্র একদিন এসে বললো ‘স্যার আপনি বরং আরবে চলে যান’। শুনে মনে হলো বিদেশে যেতে পারছি না ভেবে ছাত্রছাত্রীরা হয়তো আমাকে করুণা করছে। আরবে কি আমার মত শিক্ষকরা যায়? সেখানে যারা যায় তাদের উদ্দেশ্য থাকে পয়সা উপার্জনের। আমি কি টাকা উপার্জনের জন্য শিক্ষকতা করছি? তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ না দিয়ে লেকচারের চেয়ে চারগুণ বেতনে একটি ওষুধের কোম্পানিতে কি আমি চাকুরি পেতাম না? সেদিনই আদাজল খেয়ে লেগেছিলাম বিদেশে পড়াশোনা করার স্কলারশিপ জোগাড় করতে।
জাপানের এক বছরের ইউনেস্কো স্কলারশিপে গত বছরেই দরখাস্ত করেছিলাম। কিন্তু সেবার আমার না হয়ে দুই বছরের সিনিয়র যে ভাইটির পক্ষে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিটি ছেড়ে দিয়েছিলাম তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার তাই আর কোন চান্স নিলাম না। দুই শিক্ষককে ধরে জাপানে ব্যক্তিগত সুপারিশ পত্র লিখালাম। সময়মত স্কলারশিপও পেলাম। পাসপোর্ট পেতে ঘুষের লোভে পুলিশের লোক ঘোরালো অনেকদিন – না, ঘুষ আমি দেই নি। ভিসাও পেলাম। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘বাংলাদেশ কমিশন ফর ইউনেস্কো’ কোনমতেই ছাড়পত্র ইস্যু করছে না। প্রথমত বড় কর্তার রাগ আমি তাদের ডিঙিয়ে নিজে কেন সরাসরি জাপানে দরখাস্ত করেছিলাম। এরপর আজ-কাল করতে করতে কাটিয়ে দিলেন সপ্তাহ তিনেক। বড়ভাইয়ের বন্ধু ব্রাহমণবাড়িয়ার বামপন্থী নেতা হুমায়ূন কবির ভাই নিয়ে গেলেন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফরের অপিসে। তার হস্তক্ষেপে মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রটি পেয়েছিলাম। নিউ মার্কেট থেকে নতুন জোড়া জুতা কিনলাম। আরো কিনলাম পাঁচটি করে গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া। পাসপোর্টে সিল দেয়া বাংলাদেশ ব্যংকের অনুমোদন নিয়ে মতিঝিলের কোন ব্যংক থেকে চব্বিশ টাকা দরে কিনলাম পঞ্চাশটি ডলার। তা থেকে আমার মামাত ভাই তাকী আবার রেখে দিল কুড়ি ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা আমার বিদায় আনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমি উপস্থিত থাকিনি কারণ যদি কোন কারণে আমার যাওয়া না হয় কীভাবে আমি আবার তাদের ক্লাশে গিয়ে হাজির হব? বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে অনুজ-প্রতিম সহকর্মী-বন্ধু মোসাদ্দেক ও ইফফাত এসেছিল। ওরা বললো ছাত্রছাত্রীরা নির্ধারিতবিদায়অনুষ্ঠানেআমাকে না দেখে নিরাশহয়ে ফিরে গেছে। এর সবই আমার মনে আছে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। ঘুমের মাঝে মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। সেই কয়েক সেকেন্ডে কি প্রায় ছয় সাত মাসের অগণিত ঘটনা এবং দৃশ্য হয়ে স্বপ্নে দেখা দিতে পারে? নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেই, সম্ভবত না। কাজেই আমার এবারের বিদেশ যাত্রাটি ঠিকই হচ্ছে।
বিমানটি এখন বেশ ওপরে উঠে গেছে। এখনই লক্ষ করলাম ঢাকা ছাড়ার উদবিঘ্নতা ও উত্তেজনায় ঘামে আমার সমস্ত কাপড় ভিজে চুবচুবে হয়ে আছে। আগে ঘামের কিছুই টের পাই নি। গত তিন চারদিন থেকে আমার চোখে ঘুম নেই, কখন বিদেশে রওনা হব সেই চিন্তায়। বসে থাকলে বা বিছানায় শুয়েও মাথার বা মনের ক্লান্তি দূর হয় নাই। এখন সমস্ত অবসাদ শরীরটিকে দখল করে নিয়েছে। মাথা থেকে পৃথিবীর সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম যথা সম্ভব। শীতও লাগছে। ভয় করছে। বিদেশে আমার আচরণ কীরকম হওয়া উচিৎ? আমি কি বেদেশিদের তুলনায় যথেষ্ট স্মার্ট? ওরা আমাকে কি নিচু চোখে দেখবে? আমরা যুদ্ধ করে সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছি, আমি কি বিদেশে বাংলাদেশকে গর্বিত ভাবে উপস্থাপিত করতে পারবো? পারবো অবশ্যই। কিন্তু আমার এতো জড়তা কেন? ইচ্ছা থাকলেও পাশের যাত্রীর সাথে পরিচিত হওয়ার সাহসটি সঞ্চয় করতে পারছি না কেন? আমি নিজে যদি হাত বাড়িয়ে দেই সে কি আমাকে একটি ‘ক্ষেত’ ভাববে?
আধা ঘণ্টাও পেরোয়নি। বিমানটি নিচে নামা শুরু করলো। জানালা দিয়ে তাকালে নিচে শহরের দালান কোঠাগুলোকে পানি থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। একটি চক্কর দিয়ে বিমানটি কলিকাতার দমদম বন্দরে নেমে এলে বাইরে তাকিয়ে আমার বেশ আশাভংগ হলো। গল্প উপন্যাসে এতোবার পড়া দমদম বিমান বন্দরকে মনে মনে এক বিশাল ও রাজসিক বলে ভেবে রেখেছিলাম। সেই তুলনায় সামনে যা দাঁড়িয়ে আছে তা আমাদের কুর্মিটোলা বিমানবন্দরথেকে কোন অংশেই বড় মনে হলো না।
প্রায়ান্ধকার প্রায় ২০ বাই ১৫ হাতের ট্রাঞ্জিট লাউঞ্জে আমি একা। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। প্রথম বিদেশ যাত্রার উত্তেজনায় ক’দিন থেকে কোন খাবারই গলা দিয়ে নামছিল না। বাসা থেকে রওনা হওয়ার আগে আমি যখন পোষাক বদল করছিলাম তখন আমার বিরক্তি সত্তেও কখনো আম্মা কখনো ছোটআপা পিছু পিছু হেঁটে আমার মুখে খাবার তুলে দিতে চেষ্টা করছিলেন। তখন খাই নি কিন্তু এখনকার খিদের কোন তুলনা পাচ্ছি না। দরজার ওপাশে বসে থাকা একমাত্র প্রাণী ইমিগ্রেশন অফিসারটি জানালো এখানে কোন রেস্টোরেন্টও নেই। না, আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য সে-ই একমাত্র প্রাণী ছিল না, ছিল শতশত সঙ্গীতশিল্পী মশা। সেই সঙ্গীতে মজে গিয়ে সমঝদারের মত নিজের হাত, পা, ঘাড়, ও মুখে অনবরত তাল দিয়ে যাচ্ছি। আর সেই উত্তেজনায় আমার দেহের বর্ণ লাল রং ধারণ করছে।
আমার পরবর্তী ফ্লাইট রাত একটার পর। এখন বাজে রাত আটটা। এতোক্ষণ কাটাই কি করে? সাথের ব্যাগে আছে একটি করে বদলি কাপড়, ‘বিচিত্রা’, একটি গল্পের বই, একটি ডাইরি, এবং শেভ করার সরঞ্জাম। সুন্দর বিদেশি শেভিং রেজরটি দিয়েছেন মেঝভাই। বিচিত্রাটি বের করতে গিয়ে ব্যাগের নিচে শক্ত কিছুতে হাত লাগলো। বের করতে দেখি শুকনো কিছু খাবার। খাবার কোথা থেকে এলো? নিশ্চয়ই মেঝমামী আমার অগোচরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন! মেঝমামীর পরপর চারটি কন্যাসন্তান জন্মের পর আমাকে নিজের ছেলে হিসেবে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের মাকে ছেড়ে আমি কিছুতেই তার কাছে থাকতে চাইনি। পরে তিনি দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন কিন্তু আমার প্রতি তার স্নেহের কোন ঘাটতি দেখান নি। সেই মেঝমামী আজ টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে পোলাও, কোর্মা এবং মাছের তরকারী নিয়ে এসেছিলেন আমি সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁকে অপমান না করতে গিয়ে সেই খাবারের একটি দুটি কণা মুখে দিয়েছিলাম মাত্র। তখন খুব অনুনয় করছিলেন আমি যেন শুকনো খাবারগুলো সাথে নিয়ে আসি, আমি রাজি হইনি। এখনদেখছি আমার আগচরে এক সময় ঠিকই সেসব তিনি আমার ব্যগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রচণ্ড খিদেয় এক্ষণে বাক্স খুলে সেই লাড্ডু এবং নারকেলের চিড়া মুখে দিয়ে পেটের হাহাকার নিবৃত্ত করলেও মেঝমামীর স্নেহে আপ্ল্যুত হয়ে আমার দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু প্লাবিত হয়ে চললো। সে এক অভূতপূর্ব কৃতজ্ঞতার অনুভূতি!
ট্রানজিট লাউঞ্জে এক সময় ছোটখাট চাঞ্চল্য দেখা গেল। আমার বয়সের কাছাকাছি দুই ভারতীয় যাত্রী এলো, একজনের চেহারা মঙ্গোলিয়ান, মোটেই ভারতীয় নয়। কিন্তু দুজনেই বেশ বন্ধু। একাকীত্ব কাটাতে যেচে গিয়ে আলাপ করলাম। ওরাও জাপানে যাবে, তবে অন্য কোন শহরে, অন্য কোন প্রোগ্রামে। দেখলাম ওরা আমাকে বেশ সমীহ করে কথা বলছে। মনে বেশ বল পেলাম। বিদেশের মাটিতে নিজেকে এতো অসহায় ভাবার কোন কারণ নেই। আমি চাইলাম ওদের সাথে আলাপ করে মনের ভয় কাটাতে। কিন্তু লক্ষ করলাম ওরা আমার চেয়ে নিজেদের মাঝে আলাপেই বেশি স্বস্থি বোধ করছে। আমি চুপসে গিয়ে সাথে আনা বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম।
দেখতে দেখতে যাত্রীর সংখ্যা দুই চারজন আরো বাড়লো। এবার এয়ার ইন্ডিয়ার বেশ বড় একটি বিমানে উঠতে গিয়েদেখলাম ভেতরে আগে থেকেই অনেক যাত্রী বসে আছে। আমি আসন খুঁজে নিয়ে বসে ঘাড় ঘুড়িয়ে আশেপাশের যাত্রীদের দেখছি। বাঙালি কাউকে পেলে বেশ ভাল হতো কিন্তু সবই ভিনদেশি অভিব্যক্তির চেহারা, একজনকেও স্বগোত্রীয় মনে হলো না। অনেক্ষণ হয়ে গেছে, আর কোন যাত্রী বিমানে উঠছে না। আকাশে না ওড়া পর্যন্ত আমার অস্থির লাগছে। বলা তো যায় না দৈব কোন ঘটনা ঘটে গেলে আমাকে যদি আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়! মাত্র এক বছর আগেই প্রায় দুদিন ধরে ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে গেল না? আমার অধৈর্যতার অবসান ঘটিয়ে যুবা বয়সের এক দম্পতি এগিয়ে আসছে। সাথে ফুটিফুটে একটি মেয়ে। সবার চেহারা ও বেশ ভুষাতে আভিজাত্য, আধুনিকতা ও রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। বাঙালি হলেও হতে পারে। মনে মনে কামনা করছি আমার ঠিক পেছনের সারির তিনটি খালি আসনে যদি তাঁরা বসতেন!
বাহ আমার যে এই মনোভাব হবে এয়ার ইন্ডিয়া বিমান কর্তৃপক্ষ আগেভাগেই কীভাবে তা টের পেয়ে গিয়েছিল? আসন খুঁজতে খুঁজতে তিনজনের এই দলটি ঠিকই আমার পেছনের সারিতে এসে জায়গা করে নিল। মাথার ওপরে মালামাল রাখার সময় স্বগতোক্তির মত করা ভদ্রলোকের শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ শুনে বুঝতে পারলাম তাঁরা বাঙালি শুধু নন, বাংলাদেশেরই বাঙালি। কেন যেন আমার ধারণা হলো তিনি বাংলাদেশের কোনো কূটনীতিক হবেন। কিন্তু আমার সাথে ঢাকা থেকে না এসে কলিকাতা থেকে কেন উঠলেন বুঝতে পারলাম না। প্লেনটি চলা শুরু করেছে। ভাবলাম আকাশে উঠে গেলে তাদের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করবো। ভেতরের সব বাতি নিভিয়ে দেয়াতে গত কয়দিনের ক্লান্তি এসে চোখে ভর করলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাই নি।
কী কারণে এক সময় ঘুম ভেঙে গেলে পেছনের বাঙালি পরিবারটির সাথে কথা বলার ইচ্ছা হলো। মনে হলো পেছনের লোকজন নিজেদের মাঝে কী কথা বলে চলেছে। আমার দখল করা তিনটি আসনের ফাঁক দিয়ে পেছনে তাকালাম। স্বামী স্ত্রী দুজনেই হালকা পাতলা গড়নের। স্বামীটি কথা বলে চলেছে। মলিন অথচ ভাবলেশহীন চেহারার স্ত্রীলোকটি কোলে বসা ফুটফুটে মেয়েটির চুলে বিলি করে দিচ্ছে। কিন্তু লোকটিতো কথা বলছে না। শব্দগুলো বাংলায় অজস্র গালি। গলার স্বর উঁচু না করে, চেহারায় কোন কোন রাগ প্রকাশ না দেখিয়ে লোকটির গলা থেকে থেকে কুত্তার বাচ্চা, শুওরের বাচ্চা, এবং এমনি আরো অসংখ্য গালি উচ্চারিতহয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম লোকটি গালাগাল করছে পাশে বসে থাকা স্ত্রীকে। কিন্তু মূক হয়ে বসে থেকে স্ত্রীটি এসব সহ্য করে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল সন্তানের মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে প্রতিবাদ নয়, স্ত্রীটি স্বামীর অপমান হজম করে যাচ্ছিল। আচ্ছা, আমাদের দেশের বিবাহিত নারীরা কি এভাবেই স্বামীর অত্যাচারকে প্রশ্রয় দিয়ে যায়? পেছনে বসা স্ত্রীলোকটি তো গ্রামের অশিক্ষিত কেউ বলে মনে হয় না। মনে হয় সে কোন সম্ভ্রান্ত ও রুচীশীল পরিবারের কেউ। লোকটি কূটনীতিক হোক অথবা যাই হোক কিছুক্ষণ আগে তার সাথে আলাপ করার যে তীব্র বাসনা আমার জেগেছিল তা কর্পূরের মত উধাও হয়ে গেল। আর স্ত্রীটির স্থির ও শান্ত চেহারাটি প্রতিকারবিহীন অত্যাচারিতের প্রতিচ্ছবি হয়ে আমার স্মৃতিতে চিরকালের জন্য খোদিত হয়ে রইলো।
৬ই ডিসেম্বর, ২০১৮