You are currently viewing জাকিয়া শিমু || জব্বার বেপারীর আমবাগান

জাকিয়া শিমু || জব্বার বেপারীর আমবাগান

জাকিয়া শিমু || জব্বার বেপারীর আমবাগান

হিজলতলা গাঁয়ে আজঅবধি এমনতরো ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে বলে প্রমান পাওয়া যায় না। গাঁয়ে শতায়ু নিয়ে এখনো দু’চারজন যারা ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন তারাও এঘটনায় তাজ্জব বনে গেছেন। বটবৃক্ষের ছায়ার মতো শান্ত-শীতল, অসংঘাতপূর্ণ এক গ্রাম, হিজল তলা। কিন্তু সহসা সেই গাঁয়ে ঘটল এক অভূতপূর্ব অঘটন ! গাঁয়ের সেই কতকাল আগেকার আমবাগানের শতবর্ষী গাছগুলো অতিমারীর মতো করে একত্রে মরা পড়ল। মরল না কেউ মারল,তা অবশ্য এখন আর বিবেচ্য বিষয় নয় ! মোদ্দাকথা গাছগুলো আর জীবিত নাই। গাছগুলো মরে ডালপালা খুইয়ে নরকঙ্কালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

সাদেক বেপারি হাতপা ছড়ায়ছিটায়ে ঘর লাগোয়া রোয়াকে বসে গাঁও-গেরামের বউ ঝিদের মতো বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন! তিনি গত কয়েকদিন হয় গাঁয়ে ছিলেন না, শহরে আত্নীয়বাড়ি বেড়াতে যান। গতকাল তাও বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে এমন অপ্রত্যাশিত সংবাদটা শুনেছেন যদিও নিজচোখে না দেখাঅবধি মূল-ঘটনায় তার মনজুড়ে ভ্রান্তি বেশ ভালোই ছিল! বোবাজাতের সাথে মানুষের শত্রুতা আদতে হতে পারে এমনটা বিশ্বাস করা অন্তত তার মতো মানুষের জন্যে সহজ বিষয় নয়। নিজ বউয়ের-মুখে শোনা-ঘটনায় রাতের ঘুম উবে যেতে তিনি বাকিরাত হাতপা গুঁটিয়ে জড়োবস্তুর মতো অনড় হয়ে বসে থাকেন। ভোর-বিয়ানে আমবাগানে ছুটে যান, স্বচক্ষে এমন বর্বর-দৃশ্য দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়েন। সাদেক বেপারীর কাছে বংশপরম্পরায় বয়ে চলা এক কঠিনসত্য গচ্ছিত ছিল, কিন্তু তিনি তা রক্ষা করতে পারলেন না। এই আফসোস তাকে দিশেহারা করে তোলে। সামিয়কভাবে হলেও যা ঘটে গেল তা যেন গাঁয়েরলোকের কুসংস্কারের পক্ষে রায় দিল।

পুরুষমানুষের কান্নায় এ-সমাজ অভ্যস্ত নয়, তারওপর সাদেক বেপারীর মতো মানুষ যখন কাঁদে তখন ঘটনা হালকাপাতলা বলে উড়িয়ে দেওয়ায় ফুসরত নাই। মাঝবয়সী বুঝদার,সজ্জন মানুষ তিনি। গাঁয়েরলোকের মাথা। সকলের বালা মুসিবতে যিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য করেন,মানসিক অশান্তিতে তাদের মনেপ্রাণে মনোবল ফিরিয়ে দেওয়া সেই মানুষটা এভাবে কষ্টের প্রকাশ করছেন, সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি খটকা লাগে বটে। একটা সরলহিসেব কিছুতেই তাদের কাছে খোলাসা হয় না, নিউরনে জট বেঁধে থাকে- বাগানের গাছ ধ্বংস হয়েছে তাতে সাদেক বেপারীর মোটাদাগের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কিন্তু টাকাকড়ি গেছে তাতে তার কোনো আফসোস নাকি নেই। এবং তা তিনি নিজমুখেই স্বীকার করছেন। তিনি কুসংস্কার’ বিষয়ে কীসব বলছেন! হিসেবের গড়মিলটা এখানেই। সহজ বিষয় খামোখা জটিল করে তুলছেন। হিজলতলা গাঁয়ের বেশিরভাগ লোক সেই রহস্যের নাগাল পায় না !

সাদেক বেপারীর আমবাগানের সংক্ষিপ্ত অতীত বৃত্তান্ত বলা না হলে বিষয়ের জট ভাঙ্গা সহজ হবার নয়। সেই গত শতকের গোঁড়ার দিককার কথা। সাদেক বেপারির বড়দাদা- জব্বার বেপারি,পদ্মাপাড়ের কোনএক পাড়ভাঙ্গা-গ্রাম থেকে এসে এএলাকায় বসত করতে উদ্যত হোন। অত্রঅঞ্চলে তখন ছিলো হিন্দু সম্পদায়ের দুর্দান্ত প্রতাপ। তো গোঁড়াতে সবেমাত্র জব্বার বেপারীর একঘর মুসলমান হয়ে বসত শুরু হয় ! স্বাভাবিকভাবে স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকাটা তার জন্যে ছিল কঠিন সংগ্রামের। এরপর অবশ্য একঘর দু’ঘর করে মুসলমান দূরদুরান্ত থেকে আসতে শুরু করল। নিচু অঞ্চল, ঘন বনজঙ্গলে ঠাঁসা। উঁচু অঞ্চলের মানুষ এএলাকাকে অবজ্ঞা করে বলত- বাইছা বনের আঁকড়া। বর্ষাকালে জলেরতলে বেশিরভাগ জায়গাজমি ডুবে থাকত। উন্নাকালেও সামান্য মেঘ-বৃষটিতে প্যাঁক-কাদায় রাস্তাঘাট মাখামাখি করত। তারপরও জলেরদামে জায়গা-জিরত পাওয়া যেত বলে ধীরে ধীরে মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপায়ন্ত না-পেয়ে এঅঞ্চলের দিকে ঝুকে পড়তে শুরু করল।

জব্বার বেপারি দূরদর্শী মানুষ ছিলেন বটে। একসময়ে এমন বাইছা-বনের দাম, সোনার চেয়েও অতি-দরের হবে, সেযুগে বাস করেও তিনি স্পষ্ট টের পান। তিনি সেসময়ে ঝিলেরপাড়ে একদাগের ওপর বিঘা সাতেক জায়গা অল্পদামে বলতে গেলে জলেরদরে খরিদ করেন। মূল বসতবাড়ি থেকে সে-জায়গার অবস্থান- বলতে গেলে মাইলখানেকের ওপর তো হবেই। এবং বনজঙ্গল পেরিয়ে আকসার যাওয়া কিংবা ফসলাদি করা সম্ভব না হলেও তিনি ভবিষ্যত বিবেচনায় তা খরিদ করে রাখেন।

জমির অবস্থান মাঝ- ঝিলেরপাড়ে,সমতলভূমি থেকে বেশ উঁচুতে একটা ডিবির মতো জায়গাবিশেষ। সহজেই ধান-পাটের মতো ফসল হওয়ার ফসলী জমি নয়। বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে ছিল।

জনশূন্য ঝিলপাড়ে ক্ষেতে-খাটা মানুষজন মাঝদুপুরে রোদের প্রতাপ থেকে খানিকক্ষণের বিশ্রাম নিতে গাছেরছায়ায় বসে জিরোয়। এছাড়া তেমন বিপদে না পড়লে ওজায়গা কেউ খুব একটা মাড়ায় না। এমন অভয়ারণ্য পেয়ে পশুপাখি-গাছপালা মনেরসুখে বংশবৃদ্ধি করে নিজেদের একটা স্বাধীন রাজ্য গড়ে তুলেছে। নানান শ্রেনির গাছ গাছড়ায় ভরে আছে ঘন-বনজঙ্গল হয়ে। জব্বার বেপারী বুদ্ধিকরে সেসব গাছের ফাঁক ফোকরে ভালো জাতের কিছু আমের চারা পুঁতে দেন। সেই বাগানের মধ্যিখানে আপনাআপনি একপায়ে ভর করে তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে এক তালগাছ। দ্রুত সময়ে তা তেড়ে-ফুঁড়ে বেশ লম্বা হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে। বহুদূর থেকে বাতিঘরের মতো সে-তালগাছের দেখা মিলে। একসময়ে দূরঅঞ্চলের মানুষ দূর থেকে এই তালগাছ দেখে এ গাঁয়ে আসা-যাওয়া করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমে সে তালগাছ এতোটাই পরিচিত হয়ে উঠল যে, হিজলতলা’ গাঁয়ের নামের আগে তালগাছের নাম চলে আসে। এবং তালগাছের সাথে জব্বার বেপারীর’ নামটাও দূরদূরান্তে আলো-হাওয়ার মতো করে ছড়িয়ে পড়ল। লোকে হিজলতলা গাঁয়ের নামের বদলে বলত- জব্বার বেপারীর তালগাছের গ্রাম’।

ঘটনার সূত্রপাত আসলে এখান থেকেই। এঅঞ্চলে পাল’দের আধিপত্য বহুুকাল পূর্ব থেকেই ছিল। জনমুখের ইতিহাস বলে পাল’রাই এঅঞ্চলে সবার আগে এসে বসত গড়ে। তো পালবংশের সুশিক্ষিত ছেলে, সুবোধ পালের সেসময়ে বেশ নামডাক-যশখ্যাতি এমনকি সেসময়ে কলিকাতার বাবুদের মুখেও গর্ব ভরে তার নাম শোনা যায়। তিনি আইনের লোক। জেলাকোর্টের বিশিষ্ট উকিল। তিনি শহরে বাস করলেও এলাকায় তার একছত্র আধিপত্য বজায় থাকে। তিনি এলাকার মুরব্বী, হিজলতলা গাঁয়ের তাবৎ মানুষের বিশ্বকোষ। কিন্তু সুবোধ পালের এতসব পরিচিতি সামান্য একখানা তালগাছের বদান্যতায় ঢাকা পড়তে শুরু করল। এবং সুবোধ পালের নাম উঁচিয়ে কোথাকার কোন জব্বার বেপারির নাম লোকমুখে চাউর হতে শুরু করল। বুদ্ধিমান একইসাথে চতুর সুবোধ পাল হাঁটুভাঁজ করে বসে থাকার লোক নন। তিনি এর একটা বিহিত করতে কৌশলী-ওকালতি চাল চালতে শুরু করলেন।

গাঁয়েরলোক সহজ-সরল এবং অন্ধবিশ্বাসী ! সারাদিন ক্ষেত-খামারে কাজ করে। সেসময়ে গাঁয়ের লোকের শিক্ষাদীক্ষার কোনোরকম সুযোগ ছিল না। অন্ধকুসংস্কারে প্রায় সবাই একটু বেশিই ডুবে ছিল। যদিও অবস্থা যে এ-কালে খুব একটা এগিয়েছে তাও হলফ করে বলা যায় না। তবে তফাৎ একটা ছিল তা হল- তখনকার মানুষের মনে বিশ্বাসের ভীতটা ছিল বেশ পাকাপোক্ত। একবার কিছু একটা মাথায় ঢুকে গেলে চিতায়-ওঠা অবধি তা বের করা সম্ভব হত না। এসুযোগটা সুবোধ পাল কাজে লাগালেন।

তার লোকবল লাগিয়ে রটিয়ে দিলেন এই তালগাছ ভূতপ্রেতের আখড়া। এবং এই ভূতপ্রেত’ এলাকার সকল অনিষ্টের মূলহোতা। এ গাঁয়ের এই তালগাছ না-কাটা পর্যন্ত এলাকার বালাই কাটবে না। এই শুরুটা চতুর সুবোধ পাল করে দিলেন তারপর থেকে তা সকলের মুখে মুখে রটে যেয়ে একসময়ে দেশাচারে রূপ নেয়। গাঁয়ের সকল অঘটনের মূলে এসে দাঁড়িয়ে যায়- তালগাছ। কেউ সন্ন্যাসরোগে মরে গেল, কারো কলেরা-সান্নিপাতিক হলো, কারো বাচ্চা জলে পড়ে মরল কিংবা কারো বিয়ের দুই দুইটা বছর গড়িয়ে গেল তারপরও ছেলেপুলের মা হল না এমনকি মঙ্গল রায়ের বউটার মরা বাচ্চা প্রসব হওয়া কিংবা তার ভাইয়ের পরপর পাঁচপাঁচটা মেয়ে হওয়া সেটাও তালগাছে বাসাবাঁধা ভূতের ওপর দোষ চাপল। এতদিনের আদৃত লালিত তালগাছ’ এখন এক সর্বনাশা ভূতের নাম। একসময় ঝিলপাড়ের ক্ষেতে-খাটা মানুষগুলো যারা তাল গাছতলার ছায়ায় বসে ঘাম ঝরিয়ে জিরিয়ে নিত এখন তারাও ভয়ে ওদিকে ফিরে তাকায় না। শিশুদের মনেও তালগাছের ভয় কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রাত্রিকালে মায়েরা কোলেরশিশুকে তালগাছের ভূতপ্রেতের গল্প বলে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়।

ক্রমেই জব্বার বেপারির তালগাছসমেত আমবাগান পরিণত হলো ভূতের বাগানে। মানুষ কুসংস্কারে এমন মাত্রায় তলিয়ে গেল যে তালগাছের নামটা পর্যন্ত মুখে আনতে ভয়আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। ও-নাম মুখে নিলে সাক্ষাত কালি’র তান্ডব পড়বে তার সংসারের ওপর, মানুষ হবে নির্বংশ!

পটু শিকারির গুলতির গূলির নিশানা যেমন ঠিকঠাক শিকার বশ করে সেরূপে চতুর সুবোধ পালের ষড়যন্ত্রের প্রথমধাপ নিঝঞ্ঝাটে সম্পন্ন হয়। এরপর তিনি তার পরবর্তী ধাপ – সমূলে তালগাছের অস্তিত্ব উপড়ে ফেলতে টোপ ফেলেন। এখানেও তিনি নির্বোধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিন্তু শান্ত নদীর মতো সহজসরল মানুষগুলোকে কৌশলে কাজে লাগালেন। গাঁয়ের কিছু লোক ওরা অবশ্য সুবোধ পালের পালা লোক, উমেদারি লোক এবং তার পরিকল্পনা মতো তালগাছ সমূলে উপড়ে ফেলার আর্জি নিয়ে জনসম্মুখে সুবোধ পালের কাছে গেল। তিনি গাঁয়ের মাথা। তার যেকোন সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিতে বাধ্য থাকে। এবং সে-দৌলতে সুবোধ পাল তড়িঘড়ি করে সদলবলে নিজে উপস্থিত হয়ে তালগাছটি কেটে নিজের বাড়িতে নিয়ে তুললেন।

সুবোধ পাল আইনের লোক হওয়া সত্বেও বেশ বড়সড় একটা ভুল করে বসলেন। অবশ্য শীঘ্রই তিনি তা টের পেলেন এবং তিনি জব্বার বেপারিকে ডেকে পাঠিয়ে মৌখিক মীমাংসায় ভ্রান্তি মেটাতে বেজায় আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু জব্বার বেপারিও কম যায় না। সেই শুরু থেকে ভেতরে ভেতরে ফুঁসলে-ওঠা ক্রোধের দাবানলটা চেপেচুপে নীরবে সব দেখছিলেন এবং এমন একটা মোক্ষম সুযোগের যেন অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি সুবোধ পালের সাথে কোনরকম মীমাংসায় না যেয়ে পরদিন ভোরবেলায় সোজা ডিসট্রিক্ট কোর্টে যেয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা টুকে দিলেন। সুবোধ পাল সেই কোর্টের-ই জাঁদরেল উঁকিল। এবং তাকে ঠেকাতে এবং তার বিরুদ্ধে যুতসই উকিল সেই কোর্টে পাওয়া সহজ কাজ নয়। তারপরও জব্বার বেপারি একজন উকিল ধরলেন। খেলা সেরূপ জমজমাটে জমে উঠল। সেসময়ে চারদিকে শোরগোল ফেলা এবং সেইরকম চাঞ্চল্যকর মামলা- দেশে তো বটেই কলিকাতার বিখ্যাতসব কাগজে এখবর বেশ ঘটা করে ছাপা হলো। মামলা চলল টানা চার বছর পাঁচমাস। এইদীর্ঘ সময়ে মামলায় দু’পক্ষের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াল বেশ মোটা অংকে। বিশেষ করে জব্বার বেপারির বিষয়সম্পদের পুরোটাই প্রায় চলে গেল এই দীর্ঘমেয়াদে চলা মামলা সামাল দিতে। শেষমেশ শুধু ভিটেটা পড়ে রইল আর সেই আমবাগান। বাদবাকি জমাজমি যা ছিল সবই মামলা টানতে চলে গেল।

দেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছিল। সত্যের পক্ষে তখনও জয় হত। বলাবাহুল্য মামলার রায় জব্বার বেপারির পক্ষে যায়। রায়-এ জব্বার বেপারির ইচ্ছানুযায়ী কাটা তালগাছ, সুবোধ পাল নিজে বয়ে এনে জব্বার বেপারির বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে। এবং আদতে তাই হল। পুরোদেশ এবং এলাকার মানুষ স্বচোখে এমন নজিরবিহীন ঘটনা দেখল। পরদিন ব্রিটিশভারতের প্রায় খবরের কাগজে এ সংবাদ বেশ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেল। এখনো সেইঘটনা হিজলতলা গাঁয়ের ময়-মুরব্বীর মুখে মুখে লোকগাঁথা হয়ে ঘুরেফেরে।

এরপর দীর্ঘসময় পার হয়। শুধু ভারতবর্ষ নয় গোটা পৃথিবীজুড়ে ঘটে যায় নানান পরিবর্তন। এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। বহুবছর পর নিজেদের দখলে দেশ আসে। এরপর ভাইয়ে ভাইয়ে শুরু করে দাঙ্গা- হাঙ্গামা, খুনোখুনি। বিচ্ছিন্নভাবে ভারতবর্ষ ভেঙ্গেচূড়ে কয়েক টুকরো হয়ে প্রাণহীন কয়েকটি নতুন নামের দেশে পরিণত হয়। বর্ষাকালের ডলকের মতো লোক নিজভূমি থেকে বিছিন্ন হয়ে এপার-ওপার অদলবদল হয়ে ভিনদেশি হতে বাধ্য হয়। মানুষ সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু নামে কোনোমতে জান বাঁচিয়ে প্রাণহীন হয়ে বেঁচে থাকে। সেসময়ে সুবোধ পালরাও শতসহস্র বছরের শিকড়বাঁকর ছেড়ে ওপারের দেশে বসত গড়ে।

প্রকৃতিরও ঢের পরিবর্তন ঘটল। বনাঞ্চল কেটেছেঁটে সাফ করে নতুন লোকালয় গড়ে ওঠল। পুরনো বাড়িঘর-ঐতিহ্য ভেঙ্গেচূড়ে নিশ্চিহ্ণ করা হল। জব্বার বেপারীর সেই তালগাছের গোঁড়াফুঁড়ে আস্ত একটা আমগাছ বের হয়ে এল এবং তা-ও ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহিরুহের আকার নিল। সুবোধ পাল কিংবা জব্বার বেপারিরা তাদের বংশধর রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল!

পরিবর্তনের জোয়ার বয়ে গেল সবখানে। একমাত্র হিজলতলা’ গাঁয়ের মানুষের মনের কোন পরিবর্তন হলো না। অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার, পূর্বপুরুষদের ন্যায় তাদেরও আঁকশিগাছের মতো অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখল। এগাঁয়ের লোকের বিশ্বাস- তালগাছ নতুন করে জন্ম নিয়ে আমগাছের রূপ ধরেছে। তারা আগের মতো আমবাগানের আশপাশ তো ঘেঁষেই না জব্বার বেপারির বর্তমান বংশধর, সাদেক বেপারির পরিবারকে গ্রামছাড়া করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। তাদের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যানের কাছে আমগাছসহ সে-বাগানের সমস্ত গাছগাছড়া কেটে পরিষ্কার করে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

ওদিকে সেই আগের মতো কাকতালিয়ভাবে হলেও দিনে-দুপুরে আমবাগানে একের পর এক অঘটন ঘটতে শুরু করল। যদিও ঘটনার চেয়ে রটনা রটল আরও কয়েকগুণে।

দেশের আর দশটা গাঁয়ের মতো হিজলতলা গাঁয়েও দ্রুতলয়ে জনবসতি ঘন হতে শুরু করে। বনজঙ্গল কেটেছেঁটে সাফ করে বসতবাড়ি করা হয়। গাঁয়ের আশেপাশে বলতে গেলে ঘনজঙ্গল নাই- ই, একমাত্র জব্বার বেপারির আমবাগান ছাড়া। সাদেক বেপারির রক্তে আছে গাছপ্রেম। গত কয়েকবছর আগে বজ্রপাতে দাদারকালের বেশকটা আমগাছ মারা পড়লে সে আবার নতুন করে সেখানে আমের চারা পুঁতে দেয়। পুরনো শতবর্ষীগাছের সাথে পাল্লা দিয়ে এরাও তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে। তাছাড়া বাগানের চারপাশঘেঁষে বাঁশঝার, বেতঝার বাগানটাকে সবসময় মধ্যরাতের অমাবস্যা রাতের মতো আঁধারে ঢেকে রাখে।

তো একরাতে পাশেরগাঁয়ের একগৃহস্থের গরু হারানো গেল। ভোরসকালে গরুর খোঁজ করতে গৃহস্থ আমবাগানের কাছাকাছি এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গৃহস্থের বউও স্বামীর সাথে গরু খুঁজতে বের হয়। জ্ঞান হারানো স্বামীকে বউটা বহুকষ্টে টেনেহেঁচড়ে কোনোমতে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে ফিরে। জ্ঞান ফিরলে সে জানায়- বাগানের গভীরে সে কাউকে লালকাপড় গায়ে হেঁটে বেড়াতে দেখেছে। মানুষের বেশে দেখলেও আদতে সে মানুষ নয়। তার নাকের দু’পাশের চোখগহ্বরে সাঁতরে বেড়ানো চোখজোড়া থেকে নাকি জমাটবাঁধা কালচে-লাল রঙের আলোকরশ্মি এসে তার চোখ ঝলসে দিয়েছিল। সেচোখের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

তারও সপ্তাহখানেক পরে সত্যি সত্যি লালবসনের সেই আগন্তুককে আমগাছের ডালের সাথে দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হল। এরপর বহু ধকল টেনে থানা-পুলিশের ঝক্কিঝামেলা সামলে ওঠে লাশ সৎকারের একটা ব্যবস্থা করা হলেও সেই লোকের সঠিক কোন নাম পরিচয় পাওয়া গেল না।। তাতে অবশ্য হিজলতলা গাঁয়ে নতুন করে গুজব রটানোর সুযোগ তৈরি হল। লোকমুখে চাউর হল- লালকাপড়ের সঙ্গীসাথীরা আমবাগানের গভীরে বাসা বেঁধেছে। অনেকে নাকি স্বচক্ষে তাদের দেখেছে এমন গল্পও শোনা যেতে লাগল।

ঘটনা একটার পর একটা ঘটতে লাগল !

জব্বার বেপারির আমবাগানের পুবপাশে, বহুপুরনো এক-ডেঙ্গা;সেটার মালিকানা অবশ্য তার নয়, অন্যলোকের। ডেঙ্গাপাড়ঘেঁষা উঁচু জায়গাটি অত্রএলাকার হিন্দুদের চিতাখোলা। যুবক বয়সে উষ্ণরক্ত শরীরে লাফিয়ে-দাপিয়ে বেড়ায়। এবয়সে কতো কী আজগুবি অকাজ করার সাধ জাগে।

হিজলতলা গাঁয়ের সাহসী দাবিদার কয়েক যুবক বাজী ধরল- যে মাঝরাতে চিতাখোলায় যাওয়ার সাহস দেখাতে পাররে তাকে গাঁয়ের বীরবলের খেতাব দেওয়া হবে। তো অতিউৎসাহীরা নিজেকে জাহির করতে একে একে বাজীতে নাম লেখাল। ঠিক হলো অমাবস্যা-রাতে এর আয়োজন হবে। গাঁয়েরলোকের বিনোদনের রসদ কম, সামান্য উছিলায় একলহমায় বহু লোকের জড়ো হওয়া অতীব সাধারণ ঘটনা। বাজীর ঘটনা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লে গাঁয়েরলোকের মধ্যে মহোৎসবের জাগরণ শুরু হল। কিন্তু প্রথম অবস্থায় প্রতিযোগীর দল ভারি থাকলেও সময়ের সাথে সাথে ভয়ে অনেকেই সরে পড়ল। পরিশেষে সময়মতো মাত্র দু’জন প্রতিযোগী পাওয়া গেল! ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে যারা নিজেদেরকে সরিয়ে নিল, গাঁয়ে তাদের নিয়ে রীতিমতো ঠাট্টা-তামাশার শুরু হল। নিজেদের বিদ্রূপ থেকে বাঁচানোর দায়ে হলেও এদু’জন প্রতিযোগী বুকের ভেতর ডরভয় চেপে রেখে শেষপর্যন্ত প্রতিজ্ঞা ধরে রাখল।

হিজলতলা গাঁ থেকে চিতাখোলার দূরত্ব কম করে হলেও মাইলখানের পথ তো হবেই। ধু ধু করা ফসলিমাঠের মধ্যিখানে জব্বার বেপারির আমবাগান। আমবাগান পেরিয়ে তবেই চিতাখোলা। রাতের আঁধারে আমবাগান আর চিতাখোলা পৃথক করা আরও মুশকিল। একসমুদ্র ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া অন্যকিছু দেখার যোগার নেই। তো আয়োজনের রাতে আকাশ ঢেকে আছে মেঘচাদরে। নক্ষত্রের মৃদু আলোরও হদিস নেই। আয়োজকদের মনেও আতঙ্ক ভর করল। শেষমেশ ঠিক করা হলো দু’জন প্রতিযোগী একত্রে যাবে চিতাখোলায়। এবং চিতাখোলার দু’প্রান্তে দুজনকে দুটি পতাকা পুঁতে রেখে আসতে হবে তার প্রমাণস্বরূপ।

অবশেষে দোয়াদুরুদ, ঝারফোঁক বুকেমুখে মেখে, ভয়ে জমে যাওয়া চুপসে-মন নিয়ে তারা রওনা হয়। প্রতিযোগিতা সহজ করতে দুজনের হাতে দু’টি হারিকেন ধরিয়ে দেওয়া হল, যাতে দূর থেকে তাদের লক্ষ করা যায়। গাঁয়ের মাতবর-বাড়ির ঘুটঘুটে অন্ধকার-উঠোনে আয়োজকরা দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ রাখে। অর্ধপথ না যেতে হারিকেনের আলো একপা এগোয় তো দু’পা পিছু হটে। বুঝতে বাকি থাকে না, ভয় তাদের জাঁকিয়ে ধরেছে। অনেকক্ষণ হারিকেনের আলো একবিন্দুতে থেমে থাকে। এরপর দিগন্তছুঁয়ে যাওয়া অসীম আঁধার ভেদ করে জুনিপোকার আলোর মতোন হারিকেনের মৃদুআলো ধীরলয়ে আবার অগ্রসর হতে থাকে।

একসময়ে জব্বার বেপারির আমবাগানের আড়ালে হারিকেনের আলো ঢাকা পড়ে যায়। সময় বেশখানেকটা কেটে যায়। এমনকি ফিরে আসার সময়ও পেরিয়ে যায়। এবার আয়োজকদের কপালে দুশ্চিন্তার পাতলা আবরণ ভেদ করে ঘাম জমে উঠে। আকাশ ভরা মেঘ। একফোঁটা হাওয়া নেই। হারিকেনের আলো নিভে যাওয়ার কথা নয়। আয়োজকদের বুকের ভেতর ঢকঢক আওয়াজ ওঠে। মহাবিপদের আশঙ্কা কিন্তু এমন ঘোরআঁধারে এগিয়ে যাওয়ার সাহস কেউ করে না। বাকিরাত আতঙ্কে পার করে ভোরের নীলচেআলো না ফুটতে সবাই চিতাখোলায় ছুটে যায়। দু’জন দুজায়গায় মরে পড়ে আছে। একজন চিতাখোলায় অন্য জন জব্বার বেপারির আমবাগানের কাছঘেঁষে। গাঁয়ের লোক এবার শতভাগ নিশ্চিত হয়- আমবাগানের ভূতে তাদের মেরেছে।

কিন্তু পুরোঘটনা সাধারণ দৃষ্টিতে তাকালে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার বোঝা যায়- পতাকা মাটিতে পুঁততে যেয়ে গায়েরলুঙ্গি পতাকার খুঁটির সাথে মাটিতে গেঁড়ে শক্তভাবে এঁটে গেছে । ভয়, মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাচেতনার বিনাশ ঘটায়। খুঁটিটি মাটিতে পুঁততে তার পরনে ঝুলে থাকা লুঙ্গির একাংশ খুঁটির সাথে মাটিতে গেঁথে যায়। সে হয়তো ভেবেছিল ভূত তাকে টেনে ধরেছে এবং ভয়ে তার হৃদযন্ত্র থেমে যায়। বাকিজন পতাকা গেঁড়ে সামান্য এগিয়ে আমবাগানের কাছে এসে তার জন্যে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। এবং রাতের অন্ধকারে প্রকৃতঘটনা না-দেখে সেও একই কারণে মারা পড়ে। মানুষের মনে একবার অন্ধবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে সেখান থেকে তাকে বের করে আনা বড়ো কঠিন কাজ। অনেক শিক্ষিত, বিবেকবান মানুষও এমন অন্ধকুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারে না।

ওদিকে ভূত-মারা মড়া দেখতে সকাল হলে মানুষের ঢল নামে চিতাখোলার কাছে। পুবপাড়ার রহিম শেখের পোয়াতি বউ’টাকেও সেই ঢলে দেখা যায়। দিন না ফুরাতে বিকেলবেলায় সে মরা-ছেলে প্রসব করল। ভূত পেটের ছেলেটাকেও খেয়ে নিল। রহিম শেখের অল্পবয়সী কম-জোরী বউ’টা পরপর তিনবার মরা-সন্তান প্রসব করলেও এবারের কারণটা সরাসরি জব্বার বেপারীর আমবাগানের ভূতের ওপর যেয়ে পড়ল।

এরপর রাতের অন্ধকারে কে বা কারা জব্বার বেপারীর আমবাগানের গাছের গোঁড়া খুঁড়ে বিষ ঢেলে দিল। গাছগুলোসব মারা পড়ল! আদতে কী শুধুই গাছ মরল?

=======================