চিন্ময় গুহের “আয়না ভাঙতে ভাঙতে” গ্রন্থের নিবিড় পাঠ || পারমিতা ভৌমিক
অসাধারণ বই। আয়না ভাঙতে ভাঙতে। মানুষ মূলতঃ multiple personality….একই সঙ্গে ব্যক্তিমানুষ অখণ্ড এবং খণ্ড। অখণ্ডে ফুটে ওঠে তার দূরাগত সার্বিক রহস্যময় বিভাস আর খণ্ডে তারই ভিন্ন ভিন্ন বিভাস জমে থাকে। পরিপ্রশ্নে সেইসব ভিন্নতার বিভাসকে জাগানোর একটা বিজ্ঞান আছে। অধ্যাত্মপথে গুরুশিষ্য সংবাদের মতো। সেই বিজ্ঞানটিই চিন্ময় গুহর আয়না ভাঙতে ভাঙতে গ্রন্থখানির আকর সত্য। আধুনিক সাহিত্যে চিরন্তনের প্রমুখন।
ধরুন আমাদের কবিগুরু শঙ্খ ঘোষের কথা। শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই একটা ধারণার অধিকারী। কারো ধারণা শঙ্খ-সমগ্রের শতকরা ৩০ ভাগে সীমাবদ্ধ, কারো বা ৪৫ ভাগ। কেননা আমরা প্রচলিত একখানি অখণ্ড আয়নায় দেখে চলেছি। আয়নাটি কখনও লোকালমেড কখনও বেলজিয়াম গ্লাসের। ছবির তারতম্য ঘটেই। যে যার আয়নাটিকে আগলে রাখি আমরা, তা ভেঙে যাবার ভয়ে। কীইই দুঃসাহসিক বলিষ্ঠতা চিন্ময় প্রজ্ঞায় প্রোথিত!!! আয়নাগুলো সব ভাঙছেন। নিজের আয়নাটিকে আগে ভাঙছেন। এই ভাঙচুরের প্রতিস্পর্ধা কজনের হয়???
আমরা তো আমাদের মতো করে গড়ে তোলা শঙ্খ–ইমেজকে ভাঙতেই পারবনা। চিন্ময় ভাঙছেন। মেফিস্টোফেলিসের মতো কখনওবা ভাঙছেন। কখনও চিন্ময় স্বয়ং ত্বস্টা। গড়বার জন্য ভাঙছেন। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভাঙছেন আয়না। আয়না ভাঙতে ভাঙতেই কুড়োচ্ছেন টুকরো টুকরো দর্পণ। দেখছেন। বের করে আনছেন নতুন নতুন টুকরো টুকরো ছবিগুলোও। প্রশ্নের চিজেল হাতে কার্ভিং চলছে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে ফ্রোজেন মিউজিক। রামকিংকরীয় স্থপতি-নির্মাণে। এখানেই দেখা শেষ নয়। চিন্ময় আগ্রহে আদরে ,নিজস্ব রঞ্জনচেতনার আলোয় সেসব আবার বিনির্মিত করছেন। সে বিনির্মাণ জ্যাক দারিদার নয় , সে নবনির্মাণ ভারতীয় মগ্ন চৈতন্যের সত্যবিলাস!!!
তাইইই “আয়না ভাঙতে ভাঙতে”–গ্রন্থটি আমার কাছে অলৌকিক রাজ্যের সিংহদুয়ার খুলে দিয়েছে। সাহিত্যের ঝরোকায় বিন্দু বিন্দু অমৃতনিঃস্যন্দী হয়ে উঠেছে এই গ্রন্থখানি……
চিন্ময় গুহর সদ্য প্রকাশিত “আয়না ভাঙতে ভাঙতে” গ্রন্থটি “কথোপকথন সাহিত্যধারা”—নামে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা পরিচয়ের অধিকারী হতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। আধুনিকতার মেরুকরণের চতুর্থ বাঁকে এই ধারাটি ঋজুরেখায় লিপিত হয়ে থাকবে। আধুনিকতার প্রথম বাঁকে ছিলেন মধুসূদন।দ্বিতীয় বাঁকে রবীন্দ্রনাথ। দুজনেই অসপত্ন সাহিত্য ক্ষেত্রে যে যাঁর মতো। তৃতীয়বাঁকে ছিলেন একদল নক্ষত্র—-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু , জীবনানন্দ দাশ…..এঁরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে অসপত্ন। তারপর অনেকেই এসেছেন ভাঙচুরের মল্লভূমিতে, যে যার মতো। কিন্তু চতুর্থ বাঁকটি নিলেন চিন্ময় গুহ। কি কি পেলাম তাঁর কাছে যা আগে ছিলনা?কেনই বা তাঁর সাহিত্য কৃতিকে চতুর্থ বাঁক বলছি? (এ নিয়ে কবিচিত্রী শ্যামল জানার সঙ্গে কথা হয়েছে একাধিক বার)
( ১) চিন্ময় গুহর নিজস্ব কাব্যিক গদ্য পেলাম। কাব্যিক গদ্য আগেও ছিল। (উদাহরণ–৭ম থেকে ১০ম শতকে প্রচলিত ছিল চম্পূকাব্য।গদ্যপ্যময় রচনা)
কিন্তু চিন্ময় গুহর কাব্যভাষা অসাধারণ ও স্বতন্ত্র, এটি আজ স্বীকৃত সত্য। বোধকরি বুদ্ধদেব বসুর পরে এমন ভাষাসৌকর্য আর পড়া হয়নি। তবে সেখানেও পার্থক্য আছে।
চিন্ময় গুহর ভাষায় পাশাপাশি চলেছে ――
১) পশ্চিমের হার্মনি
২) এবং একই সঙ্গে প্রাচ্যের মেলডি।
রেজোনেন্স এর তফাৎ সত্ত্বেও দুটোই জড়োয়া গহনার মতো গেঁথে দিয়েছেন চিন্ময়।কেউ কারো সঙ্গে মিশে যায় নি বরং হার্মনি আর মেলডি পাশাপাশি থেকে তৈরি করেছে প্রাচ্য প্রেক্ষিতের মধ্যে একটি বিদেশি শিল্পের ধাঁচ। বলাবাহুল্য আমাদের আকর্ষণ এখানেই। আয়না ভাঙতে ভাঙতে এখন আমরা খুঁজতে এসেছি শঙ্খ ঘোষকে। আয়নাতে আমরা প্রতিবিম্ব দেখি।সত্যের প্রতিবিম্ব। গম+ক্বিপ্=জগৎ।অর্থাৎ যা চলমান। জগৎ সত্য তাহলে চলমান। তাই আয়না ভাঙতে ভাঙতেই বৃত্ত সরাতে সরাতেই বিন্দু সত্যের সন্ধান করতে হয়। চিন্ময় গুহও তাই বুঝি আয়না ভাঙতে ভাঙতে সত্যে পৌঁছনোর কথা ভেবেছেন।
চিন্ময় গুহর এই “কথোপকথন সাহিত্য” দিকনির্দেশনাকে আমি “দ্বিরালাপ সাহিত্য” বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছি। এখানেই পেয়ে যাব শঙ্খসমগ্র।
চিন্ময় যেমন বলেছেন ―
(শঙ্খ ঘোষ ১৯৩২-২০২১সম্পর্কে…)
“সব রকম শীৎকার ও ভাঙচুরময় হট্টগোলের মধ্যে তিনি এককভাবে অনন্য। তাঁর পরিমিত কথা (‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/শব্দহীন হও’) হয়ে ওঠে এক সতীর্থের ভাষায় ‘ব্যাপ্তির দিশারী’।
নিভৃতে নিজের মূর্তি তিনি ভেঙে চলেছেন। গভীরতার এক স্নায়ব স্রোতে তিনি পাঠককে টেনে নিতে চান, আর তৈরি হয়ে ওঠে ভিন্নতর এক ‘স্পেস’।”—- এটিই আসলে শঙ্খ ঘোষের রচনাপাঠে আমাদের গাইডলাইন।
সব কবিকেই আমরা দুভাবে বুঝতে চেষ্টা করি――
১) তাঁর ব্যক্তিগত যাপন থেকে
২) তাঁর সাহিত্যিক অর্ষণের ক্ষেত্র থেকে।
যদিও আমার ধারণায় একটি অপরটির পরিপূরক। ব্যক্তিকবির পরিচয় প্রায়শই লিপিত থাকে তাঁর লেখায় আর তাঁর লেখার অবয়ব থেকেই আবার আমরা পেয়ে যাই তাঁর ব্যক্তিক ভাবসম্পদ। আমাদের প্রচেষ্টা হোক দুভাবেই কবিকে দেখার। চিন্ময় আমাদের জানিয়েছেন শঙ্খ ঘোষের জন্ম তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের চাঁদপুরে। বেশ কয়েকটি কলেজে পড়ানোর পর ১৯৬৫ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন। গদ্য যখন লেখেন তাও যেন পাঠকের সঙ্গে এক সংবেদনময় কথোপকথন, যেখানে সমস্যাটির প্রতিটি তলকে বুঝে নিতে চান তিনি। বহু পুরস্কারের সঙ্গে পেয়েছেন সরস্বতী সম্মান, যার সম্পূর্ণ অর্থ তিনি দান করে দিয়েছেন। পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ সম্মান।
চিন্ময় গুহ এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ২০০০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। সেই সব কথোপকথন মূলক সাক্ষাৎকার এই বইখানিতে স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা হয়ে উঠেছে। আমাদের পাঠ ও নিবিষ্টপাঠ পাশাপাশি চলতে থাকুক এই চিরপ্রণম্য কবিব্যক্তিত্বকে ঘিরে। এই দ্বিরালাপ সাহিত্যে আমাদের অতিরিক্ত পাওনা হলেও চিন্ময় গুহ…… আমরা দেখবো কীইই ভাবে একজন মণীষার প্রশ্নে প্রশ্নে উঠে আসবেন আর একজন মণীষার সামগ্রিক সাহিত্য পর্বগুলো। বস্তুত এই কথোপকথন গুলো পড়তে গিয়ে বিশেষতঃ শঙ্খ ঘোষ ও চিন্ময় গুহর দ্বিরালাপে যেন আস্তে আস্তে জমে উঠতে লাগলো একটা আত্মজীবনীমূলক গল্পিকা।গল্পরসের আস্বাদন অনির্বচনীয় করে তুলল একে।
■এখন সরাসরি
“আয়না ভাঙতে ভাঙতে”―থেকে শঙ্খ ঘোষ ও চিন্ময় গুহর
কথোপকথন পড়বো―――
■ “চিন্ময়: আপনার প্রথম কবিতার বই “দিনগুলি রাতগুলি” ১৯৫৬–তে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলির রচনাকাল ১৯৪৯-৫৪। ১৯৪৬ সালে যুগান্তর-এ প্রথম কবিতা ছাপা হয়।
তারও আগে কবিতার জগতে দরজা খুলে গেল কবে?
মনে হল আপনিও স্বতন্ত্র কিছু লিখতে পারবেন?”
■ “শঙ্খ :: স্বতন্ত্র কিছু লিখতে পারব, অর্থাৎ লেখার মধ্যে কোথাও একটা স্বাতন্ত্র্য থাকতে হবে, এরকম কখনও ভেবেছি তা নয়। পনেরো বছর বয়সের আগে পর্যন্ত যা লিখেছি তা ছিল নিছক পদচর্চা। কিন্তু কবিতা যে কেবল মিল মেলানোর খেলা নয়, সময় কাটানোর উপকরণমাত্র নয়, তার হদিশ পেতে শুরু করেছিলাম সেই পনেরো বছর বয়সেরই একটা অভিজ্ঞতায়। তিনজন বন্ধু তখন ঘুরে বেড়াতাম একসঙ্গে। কখন একবার মনে হল আমাকে যেন উপেক্ষা করে অন্য দু’জন অনেক দূরের হয়ে গেছে। খুবই একটা কষ্টের বোধ হল। আর লিখবার কথা কিছুমাত্র না ভেবেও কবিতার লাইন উঠে আসা, সেটাও ঘটল সেই প্রথম।”
■চিন্ময় গুহর প্রশ্ন ::
“জার্নাল- এ আপনি লিখেছেন, আঘাত আপনাকে প্রথমে বিবশ করে দিলেও নিজের শক্তি ও প্রত্যাশাকে নিয়ে পুনর্বিবেচনার একটা সম্ভাবনা গড়ে তোলে। আপনার সেই কবিতাটিও আঘাত থেকে উঠে এসেছিল?”
■উ: “বলতে পারেন, কবিতাই সে আঘাত সহ্য করে নেবার, তার থেকে উঠে পাঁড়াবার একটা পথ।”
◆—–আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি কী অসাধারণ প্রশ্ন রচনায় পারদর্শিতা রয়েছে চিন্ময় গুহর। কত অনায়াসে শঙ্খ ঘোষের মিতকথন থেকেও বার করে আনছেন শঙ্খ ঘোষের সাহিত্যিক অনন্যতার আস্বাদন ।
■প্র: “পদ্মাপারের গ্রামের বালকটির ছন্দ মেলানোর খেলা কখন হয়ে উঠল সিরিয়াস?'”
■উ:――” ঠিক গ্রাম কিন্তু নয়। পদ্মার ধারে যে-জায়গাটায় আমরা থাকতাম তখন, সে ছিল ছোটখাট একটা রেলওয়ে কলোনি। গ্রাম-শহরের দুইয়েরই ভাল দিকটা তার মধ্যে ছিল। লেখা যে ‘সিরিয়াস’ হয়ে উঠল কখন তার কোনও হিসেব বলা মুশকিল। এইটুকু শুধু বলা যায় যে আমার কবিতা বইতে যেসব লেখা ছাপতে পেরেছি, সময়ের দিক থেকে তার আদিতম টি, “কবর”, লেখা হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে, কলকাতায়।”
■প্র: ―’আমার জন্য একটা কবর খোঁড়ো সর্বংসহা, যা পূর্ববর্তী বা সমকালীনদের কথা মনে করায় না, যা একেবারে নতুন ও পরিণত।”
■উ: ――”পরিণত বললে অবশ্য একটু বেশিই বলা হয়।”
■প্র: ――”খুব ছেলেবেলায় কাদের প্রভাব পড়েছিল আপনার মনে?
আপনার বাবার তো নিশ্চয়ই। ইস্কুল শিক্ষকদের মধ্যে কার কথা বিশেষ করে মনে পড়ে আজ ? “
■উ:――
” শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে নির্মলচন্দ্র বর্ধন নামে একজন চিরকুমারের কথা।”
■প্র: ――”সেটা কি পাবনা জেলার পাকশীর ‘চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ’-এর কথা?”
■উ: ――”চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠেরই কথা। ওই একটা মাত্র স্কুলেই আমি পড়েছি ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত, তারপরই তো কলকাতার কলেজ। সিক্সের আগে কোনও স্কুলে পড়িনি। কেন পড়িনি, কী ভেবেছিলেন বাবা, পরে আর ভেবে পাইনি সেটা। যাই হোক, কয়েক বছর আগেও নির্মলচন্দ্র বেঁচে ছিলেন, শেষ জীবনটায় থাকতেন অম্বিকা কালনায়। আমরা সহপাঠীরা দল বেঁধে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি এই সেদিনও। ওঁর কাছে আমরা ইংরেজি পড়েছি, অঙ্কও করেছি। সে আমলে এটা হত। এক সঙ্গে অনেক কিছুই পড়াতেন, পড়াতে পারতেন একজন মাস্টারমশাই। কিন্তু সেই ইংরেজি-অঙ্কের জন্য নয়, তাঁকে কেবলই মনে পড়ে আমার ভিন্ন দুই কারণে। ক্লাস এইটে পড়ি তখন, বিকেলের দিকে যাঁর ক্লাস তিনি আসেননি সেদিন, খয়েরি রঙের রেক্সিনে বাঁধাই লম্বা মতো একখানা বই নিয়ে ঢুকলেন নির্মলবাবু। বললেন: একটা গল্প পড়ি, তোমরা শুধু শোনো। থমথমে গলায় তারপর পড়ে শোনালেন এক রাজার কথা, নির্জন অরণ্যমধ্যে যিনি তাঁর ভাইকে নিয়ে এসে বলছেন: ‘আমাকে কেন মারিবে ভাই?’ পরে জেনেছি এ হল রাজর্ষি উপন্যাসের একটা অংশ। পড়ন্ত সেই দুপুর, ভাষার সেই জাদু, নির্মলবাবুর সেই আলতো করে পড়ে যাওয়া; সব মিলে গিয়ে একটা কল্পলোকের দুয়ার যেন খুলে যাচ্ছিল সেদিন। আর এই রকমই আর একদিন অনুপস্থিত আর একজনের ক্লাসে, ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে লিখে নির্মলবাবু শিখিয়েছিলেন কীভাবে কবিতার ছন্দ তৈরি হয়, মিল তৈরি হয়।”
◆–―এই কথোপকথনেও শঙ্খ ঘোষ একটা ঘোর তৈরি করেছেন আর সেই প্রেক্ষিত রচনায় সাহায্য করেছেন চিন্ময় গুহ।একটা গল্পরসের সূক্ষ্ম পরিবেশনে শঙ্খের নস্টালজিয়া পাঠকদের কাছে উপভোগ্য হয়েছে। একটা যাপন থেকে কিভাবে পূর্ণ সাহিত্যদুয়ার খুলে যায় তার দিকচিহ্ন আছে “আয়না ভাঙতে ভাঙতে”—বইখানিতে।
প্রশ্নোত্তরে ফিরছি আবার। এবার প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ। শঙ্খ ঘোষের বাবার রবীন্দ্রানুরাগ—–
■প্র: ―”তাঁর একটা প্রভাব পড়ল আপনার ওপর।
ঠিক কী ছিল সেই রবীন্দ্রানুরাগের ধরন। কোথায় তাঁর রবীন্দ্রনাথের পাঠ অন্য রকম হবে বলে মনে হচ্ছিল?”
■উ: ― “অনুরাগের এই কথাটা বোঝাতে গেলে বড়ই বেশি বলতে হয়। বুঝিয়ে বলাও মুশকিল। দেখতাম যে-কোনও প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথে পৌঁছে যাবার একটা প্রবণতা বাবার মধ্যে ছিল। আর্থিক অসুবিধের জন্য আমাদের বাড়িতে বইপত্র ছিল অল্পই। যে-ক’খানাও ছিল তা প্রধানত রবীন্দ্রনাথের, বা রবীন্দ্রপ্রসঙ্গের। গোল্ডেন বুক অব টেগোর তো ছাপা হয়েছিল একেবারে গোনাগুনতি, বাবার সুবাদে তারও একখানা কপি আমাদের অল্পবয়সের সঙ্গী হতে পেরেছিল। আর রবীন্দ্র পঠনটা অন্য রকম কোথায়? দুটো মাত্র তার উদাহরণ বলি।
নিত্যপ্রিয়র একটা দুরারোগ্য অসুখ হয়েছিল ছোটবেলায়। কলকাতার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা জবাব দিয়েছিলেন। পাকশীতে যে ক’জন ডাক্তার ছিলেন অগত্যা তাঁরাই তখন সবাই মিলে দেখছেন। আমি সবে ক্লাস টেনে উঠেছি—বাবা আমাদের ইংরেজি আর বাংলার ক্লাস নেন—টিফিন পিরিয়ডের আগের ক্লাসটায় বললেন: ‘বই থাক। কয়েকটা কবিতা শোনো আজ।’ বলে একটার পর একটা পড়ে গেলেন নৈবেদ্য-র কবিতা। আমার একটু চমক লাগল। হঠাৎ এসব কেন পড়ছেন বাবা?
স্কুলের প্রায় সঙ্গেই আমাদের বাড়ি। টিফিন পিরিয়ডে দৌড়ে যাই বাড়িতে। গিয়ে দেখি বাইরের ঘরে বিমর্ষ বসে আছেন একসঙ্গে সব ক’জন ডাক্তার। ভিতরে গিয়ে শুনি ওঁরা বলে দিয়েছেন এখন যে-কোনও মুহূর্তের ব্যাপার। বাবার নৈবেদ্য পড়ানোটা বুঝতে পারলাম তখন।”
―― এই অংশটি পড়ে শঙ্খ ঘোষের পরিণত সংহত সংযত অধি–আত্মিক বোধের আন্দাজ মেলে। বুঝতে পারি রবীন্দ্রধারা ও মনন তাঁর উত্তরাধিকার। আমরা চিন্ময় গুহর কাছে ঋণী এইজন্য যে, যাপন থেকে এমন সাহিত্যরস কীভাবে চুঁইয়ে পড়ে ,ভিজিয়ে দেয় সত্তা, তার হদিশ তিনি দিয়েছেন। বোধকরি শঙ্খ ঘোষের জীবনে এই রবীন্দ্রায়নই তাঁর শ্রেষ্ঠ ইষ্টাপত্তি।
আবার পড়ে নেব চিন্ময় গুহর প্রশ্ন আর শঙ্খ ঘোষের উত্তরমালা যা থেকে পেয়ে যাব শঙ্খসাহিত্যের একটা সহজ মেডিসি।
বলাবাহুল্য শঙ্খ–চিন্ময়—এর কথোপকথনের সঙ্গেই উঠে এসেছে কবির সমসময়ের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক রাষ্ট্রনৈতিক আন্তর্জাতিক সমস্যার ছবিগুলো।
■প্র: ――” চল্লিশের ঘটনাপ্রবাহ, ঘাত-প্রতিঘাত কীভাবে অনুরণিত হল মনে? নাকি অস্পষ্ট একটা অনুভূতিই হয়ে থাকছিল শুধু?
■উ: অস্পষ্ট অনুভূতিই বলা উচিত তাকে। দশ থেকে পনেরো বছর বয়স যখন, পরপর কত-না বড় ঘটনার মধ্যে দিয়ে সময় তখন চলছে: যুদ্ধ, বিয়াল্লিশের আন্দোলন, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, পঁয়তাল্লিশের নেতাজি-উন্মাদনা, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, সাতচল্লিশের দেশভাগ আর স্বাধীনতা। ছিলাম দূরের এক মফঃস্বলে, স্বাধীন আর খণ্ডিত দেশের কলকাতায় এসে পৌঁছলাম সেই পনেরো বছর বয়সে। মফস্বলে, বড়দের আলোচনা শুনে কিংবা খবরের কাগজের মোটা মোটা হরফ পড়ে কোনও কোনও ঘটনা মগজের মধ্যে আবছা হয়ে পৌঁছত। কিন্তু চিরকালের সম্বল হয়ে রইল শুধু টুকরো টুকরো কয়েকটা ছবি। রেশনের দোকানে লাইন দিতে শিখছি; যুদ্ধ চলছে বলে ব্রিজে ওঠা বারণ (বিখ্যাত সারা ব্রিজের ওপারে আমাদের বসবাস); চালের অভাবে বাবার নির্দেশে তরকারি সেদ্ধ খাচ্ছি কদিন; পুলিশ আসবে গুজব শুনে লুকিয়ে ফেলছি ফ্যাশনদুরস্ত গান্ধী টুপি কিংবা নেতাজির ছবি; ভোরের বেলায় খোলা মাঠে চক্কর দিয়ে প্রাণভয়ে দৌড়োদৌড়ি করছেন এক দারোগা আর চারদিকে ঘিরে ধরে লাঠিতে লাঠিতে তাকে রক্তাক্ত করছে কয়েকজন। সার বেঁধে অসাড় অন্যেরা ভয়ার্ত ভাবে তা দেখছেন; বিপদ-সম্ভাবনায় পাড়া ছেড়ে তুলনায় নিরাপদ পাড়ার দিকে গভীর রাতের মাঠ পেরিয়ে চুপিচুপি চলেছি আমরা লণ্ঠন হাতে; কলকাতা থেকে অজানা এক মানুষ এসে দু-চারজনের সঙ্গে গল্পচ্ছলে বুঝিয়ে চলেছেন কাকে বলে সাম্যবাদ। এর কোনওটারই পুরো তাৎপর্য আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না তখন, কিন্তু আলোড়ন তবু একটা ছিলই।”
――এরপরই চিন্ময় গুহ একটা অত্যন্ত ভাইটাল প্রশ্ন করলেন যার উত্তরে বাঁকবদল হল শঙ্খ ঘোষের সাহিত্য ভূমির অন্য আর এক ভূমিকার।
প্র:―― “কাদের কবিতা পড়ছিলেন কৈশোরের শেষ প্রহরে? ধরুন চারের দশকের শেষে পাঁচের দশকের গোড়ায় একজন তরুণ কবির একদিকে রবীন্দ্রনাথ (যাঁর সাথে আপনার অনুসন্ধানী একাত্মতা),
অন্য দিকে জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ, পঞ্চাশের ভিন্নমুখী
সতীর্থেরা”
■――এ এক অনন্য অনুসন্ধান। অদ্ভুত একটা প্রকটপ্রচ্ছন্নের যাতায়াত চলছিল শঙ্খ ঘোষের সত্তায় ও মনে। যাপনের সঙ্গে সম্পর্ক থেকেই প্রশ্নের মালা গাঁথতে গাঁথতে চিন্ময় তুলে আনছিলেন শঙ্খ–দ্বীপের রত্নরাজি।
শুনবো শঙ্খ ঘোষের কথা।
■উ: ―”কৈশোরের শেষ প্রহর’ যাকে বলা যায়, সেই সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক যুগের সঙ্গে আমার তেমন কোনও পরিচয় হয়নি। চল্লিশের দশকের একেবারে শেষ দিকে কলকাতায় এসে কলেজে তখন যাতায়াত।”
প্র: ― “এই প্রেক্ষাপটে ভাষাটা আপনার নিজস্ব ভাষাটা তৈরি হয়ে উঠল কীভাবে?”
◆――আশ্চর্য হতেই হয় যখন দেখি দিনযাপনের ভালোমন্দ থেকেই চিন্ময় গুহ তুলে আনছেন একের পর এক শঙ্খ ঘোষের লিখন কৌশলগাথা বা প্রকরণশিল্পবৈভব। অলৌকিক অবলীলায় তৈরী হয়ে যাচ্ছিল একটা Saga of life…. তার ভাষিক সৌন্দর্য, তার গাঠনিক তাৎপর্য, এবং সর্বোপরি শঙ্খ ঘোষের লেখার সাংগঠনিক ধর্ম, বিশেষ ভাব ও বিশ্বাস।
উত্তরের প্রণিধানযোগ্যতায় আমাদের আস্থাই রচনা করে চলেছে বৃত্তের পর বৃত্ত। প্রাশ্নিক লোষ্ট্রপাতে প্রতিবৃত্তের ভাঁজ খুলে যাচ্ছে পাঠকদের সামনে….
■উ:――”নিজস্ব কোনও ভাষা যে আজও তৈরি হয়ে উঠেছে, তা ঠিক মনে হয় না, দ্বিধা একটা থেকেই যায়। তবে এটা ঠিক যে বিশেষ একটা সময়ে নিজের আর চারপাশের কবিদের শব্দবাহুল্যকে বেশ অতৃপ্তিকর লাগছিল, সাময়িকভাবে থামিয়েও দিয়েছিলাম লেখা। এ হল “দিনগুলি রাতগুলি” আর “নিহিত পাতালছায়া”-র মধ্যবর্তী সময়টার কথা।
নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে, হালকা অনায়াস শব্দে মুখের কথার স্পন্দে লিখতে শুরু করেছিলাম ছোট ছোট কবিতা, প্রায় যেন কবিতা নয় – এরকম ভাবে। ছাপাতামও না বেশি। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে কবিতা আর লিখছিই না আমি। এই গোপনতায় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার খানিকটা সুবিধেই হয়েছিল মনে হয়। হতে পারে যে কম বলার একটা ধাঁচ হয়তো তৈরি হয়ে উঠেছিল এ ভাবে।”
◆―― সৃজনশিল্পের গোপন কথায় উঠে এল অন্তরঙ্গ কবির কাব্যভাবনার হালচাল।
এরপরে চিন্ময় গুহর প্রশ্ন পড়ছি…
■প্র: ――”ছড়ার সুর—যেমন ‘যমুনাবতী’-তে—সেটাকেই কি কাব্যিক হাতিয়ার বলে মনে হচ্ছিল আপনার?
উ: ――”না, না, তা কিন্তু একেবারেই মনে হয়নি। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে যে সব কবিতা লিখছি তাতে এই ছড়ার সুর বা লোকছড়ার ব্যবহার আরও দু-চারবার হয়তো দেখা গেছে, কিন্তু কেবলমাত্র এইভাবেই লিখব বা প্রধানত এইটেই হবে আমার লেখার প্রধান অবলম্বন, মনের মধ্যে এমন কোনও ভাবনা ছিলই না মোটে। যমুনাবতী প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা খুব খুশি হয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য ভেবেছিলেন যে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগের এই ধরনটা যেন বাংলা কবিতার একটা মুক্তিপথ। আমার তা মনে হয়নি। আর সত্যি বলতে কী, যমুনাবতী-তে উৎসাহীরা আমার পরের কবিতার নমুনাগুলো দেখে একটু হতাশই হয়েছিলেন।
■ প্র: কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু পাথেয় কবিতাটিতে কিছু অদলবদল করার পর বারো বছর আপনি তাঁর সঙ্গে আর দেখা করেননি। বারো বছর যে অনেকটা সময়। আমার সন্দেহ, আসল কারণটা বুদ্ধদেবের নন্দনবীক্ষায় সায় দিতে পারছিলেন না আর
■উ: এ সন্দেহ বোধ হয় ঠিক নয়। বুদ্ধদেব বসুর ‘নন্দনবীক্ষায় খুব একটা সায় দিতে যে পারছিলাম না, এটা অবশ্য সত্যি। এ নিয়ে ছেলেমানুষি কাণ্ডও করেছিলাম একটা। উনিশ বছর বয়স হবে তখন। পুরনো পত্রিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে বুদ্ধদেব বসুর তীব্র একটা লেখা চোখে পড়ল ফ্যাসিইজমের বিপক্ষে। এ-রকম উনি লিখতেন? সেটা পড়ছি, আর ভাবছি পরবর্তী বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর স্বরের কী দুস্তর অমিল। কী করে সেই বুদ্ধদেব এই বুদ্ধদেব হলেন, কেন হলেন, এ নিয়ে অভিমানময় বেশ লম্বা একখানা চিঠি লিখে বসলাম ওঁকে, প্রায় কৈফিয়ত চাইবার ধরনেই। চিঠিতে সম্ভবত তীক্ষ্ণতাই কিছু ছিল, তার আর উত্তর পাইনি কিছু।
কিন্তু বুদ্ধদেবের সঙ্গে বারো বছর দেখা না করবার সেটা কোনও কারণ নয়। পাথেয় কবিতায় কয়েকটা শব্দবদলের ফলে যেটুকু ঘটেছিল তা হল আর-কোনওদিন কবিতা পত্রিকায় লেখা হল না আমার। কিন্তু ওই শব্দবদল যদি নাও ঘটত, কবিতা-র সঙ্গে লেখার সংযোগও যদি থাকত, তাহলেও আমাদের দেখা হবার সম্ভাবনা ছিল খুব কম। কেননা প্রসিদ্ধ কবিদের (বা অন্য কোনও লেখকদের, শিল্পীদের) সঙ্গে মেলামেশা করবার অভ্যাসটাই গড়ে ওঠেনি।
■ প্র: ১৩৫৯-এর ফাল্গুনে শান্তিনিকেতনের সাহিত্যমেলায় সহসা উত্তেজিত বুদ্ধদেব বসু যমুনাবতী’র ওপর যেটি পুরো পড়েন শুনি ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে ভাবে আক্রমণ করেছিলেন তা সঠিক মনে হয় না। অবিশ্যি সুভাষবাবুও প্রগতি শিবিরের তকমা লাগিয়ে একপেশেভাবে দেখতে চাইছিলেন কবিতাটিকে। আজ পেছন ফিরে তাকিয়ে কেমন লাগছে ওই আকস্মিক দ্বৈরথ মনে হয়, তাঁদের দুই মেরুর মধ্যে কোনো সুস্থিত স্থানাঙ্ক আপনি সেই উনিশ-কুড়ির বছর বয়সেই খুঁজে নিচ্ছিলেন হয়তো।
■ উ: আক্রমণটা একেবারে যমুনাবতী-র ওপর, এভাবে বললে একটু ভুল বুঝবার সম্ভাবনা থাকে। আক্রমণটা ছিল মূলত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সে-সময়কার কাব্যদর্শনের ওপর। দৈবাৎ এটা ঘটেছিল যে যমুনাবতী-রই কয়েকটা লাইন দিয়ে শেষ হয়েছিল লেখাটা, বুদ্ধদেব তাঁর আচমকা ভাষণের ধরতাই পেয়ে গিয়েছিলেন ওই কয়েকটা শব্দে। এই মাত্র। অপ্রত্যাশিত সেই দ্বৈরথে সেদিন বেশ মজাই লাগছিল আমার। এঁদের কাব্যাদর্শের ভিন্নতার কথা জানাই ছিল ততদিনে, আর আমিও আমার মতো করে লেখার বিষয়ে একটা ধারণা করে নিয়েছি। কিন্তু তখনও যেটা শিক্ষণীয় লেগেছিল আর আজও ভাবলে ভাল লাগে, সেটা হল এই এক দৃশ্য: সভাশেষে একই রিকশায় কবিতা নিয়ে কথা বলতে বলতে চলেছেন দু-জন।
◆―――চিন্ময় শঙ্খ আলাপ শুনতে শুনতে আমরা মুগ্ধ পাঠকরাও জাদুবলে পৌঁছে গিয়েছিলাম অকুস্থলে।
■প্র: প্রেসিডেন্সি বা বিশ্ববিদ্যালয় কতটা সাহায্য করল আপনার হয়ে ওঠাকে? প্রেসিডেন্সির অভিজাত পরিবেশে অসহ্য, পরিত্যক্ত’ শঙ্খ ঘোষ আর কী পেলেন? সেই নক্ষত্রখচিত চত্বরে? শিশিরকুমার দাশ লিখেছেন দেয়াল-পত্রিকায় আপনার কবিতার শিহরন।
■উ: যে-কোনও হয়ে ওঠার ভিতরেই তো তার চারপাশের অবস্থান কিছু-না-কিছু কাজ করেই যায়, প্রেসিডেন্সিরও কিছু ভূমিকা নিশ্চয় ছিল। প্রথম দিকে আমার পক্ষে এ-কলেজ ছিল একটা সাংস্কৃতিক ধাক্কা। উত্তর বাংলার ছোট্ট এক মফস্বল স্কুল থেকে ওই ‘নক্ষত্রখচিত চত্বর’-এ পৌঁছে সব সময়েই থাকতে হত ভয়ে ভয়ে, নিজেকে কেবলই মনে হত নিঃসম্বল, পরিত্যক্ত। এত গুণী মানুষ, এত রকমের কথাবার্তা, এত সব জানে সবাই। একটা হীনতার বোধ দিয়েই শুরু হল। চার বছর থাকতে থাকতে বাইরের দিক থেকে সে-মনোভাবটা কাটিয়ে উঠেছিলাম কিছুটা, কিন্তু অবচেতনের জড়তাটা থেকেই গিয়েছিল, আজও আছে মনে হয়।
■প্রশ্ন:: কৃত্তিবাস আপনাকে প্রথম থেকেই বিশেষ সম্মান দিয়েছিল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো লিখেইছেন ‘কৃত্তিবাসের পাতায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি শঙ্খ ঘোষ।’ তবু কৃত্তিবাস আন্দোলনের (যদি আন্দোলন বলা যায় সেটাকে) সঙ্গে আপনার অন্তরের অমিলও তো কম ছিল না। একটা সেন্সরও কি কাজ করছিল আপনার মনে?
■উ: কৃত্তিবাস থেকে সব সময়েই প্রাপ্যের চেয়ে বেশি পেয়েছি, তবে সুনীলের এই কথাটা ছিল একেবারেই প্রথম বছরের কৃত্তিবাস বিষয়ে, ১৯৫৩-৫৪ সালের।
■ প্রশ্ন :: ‘বাড়ি তো পেয়েছি আমি বহুদিন / মনে মনে / বাড়ি চাই বাহির ভুবনে’। এটাই কি বীজমন্ত্র? আপনার প্রায় প্রতিটি কবিতার বইতেই দেখি আপনি কবিতাগুলিকে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা নামে ভাগ করে দিয়েছেন …। সেটা কি এই যৌথ আর্তিকে -আপনার লতাগুল্মময় মগ্নতা, প্রেম, নিঃসঙ্গতা; অন্য দিকে বাইরের সমাজের অভিজ্ঞতা—একই করতাল অথচ ভিন্ন অনুভব-বিন্দু থেকে ধরার চেষ্টা?
■ উ: এটা আপনি ঠিকই লক্ষ করেছেন, “দিনগুলি রাতগুলি” থেকে “ধুম লেগেছে হৃৎকমলে” পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি বইতেই কবিতাগুলি তিন ভাগে সাজানো। কেউ যদি তা লক্ষ করেন, ভাল। না করলেও ক্ষতি নেই। ভাগটার কারণ যে আপনি বুঝতে চেষ্টা করেছেন, এটা জেনে ভাল লাগল। ব্যাপারটা সামান্যই। বাইরের দিকে মুখ ভিতরের দিকে মুখ, এই দুই নিয়ে আমাদের দৈনন্দিন, আর এ-দুয়ের মধ্যে একটা সংঘর্ষও চলছে নিরন্তর। সংঘর্ষ থেকে জেগে উঠছে তৃতীয় এক সত্তা। সেটাই আবার হয়ে ওঠে প্রথম, দেখা দেয় আবার তার বিরোধী কোনও দ্বিতীয় সত্তা আবারও তার থেকে তৃতীয়ের জন্ম। এইভাবেই চলতে থাকে জীবন। অথবা কবিতা। ফলে স্থায়ী কোনও বীজমন্ত্র হয়ে ওঠা কিন্তু মুশকিল। ওটাও পালটাতে থাকে জীবনের সঙ্গে সঙ্গে। দিনগুলি রাতগুলি আর তার পরের নিহিত পাতালছায়া-র মধ্যে কোনও প্রভেদ কি নেই
বাইরের দিকে, না ভেতরের দিকেও? আঙ্গিকের দিক থেকে কি সংহত হতে চাইলেন
আরও ?
■উ: সংহতির কথাটা ঠিকই। আগে একবার বলেছি এই সংহতির কথাটা, যথা সম্ভব অল্পকথায় ছোট ছোট কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করতে চাইবার ব্যাপারটা। বাঁকটাকে অবশ্য—শব্দ দুটোর আক্ষরিক অর্থে ভাবলে—বিপুলা পৃথিবী-র দিকে বলা ঠিক হবে না, বরং তার উলটো। ভিতরের দিকে। একলার দিকে। বিপুলা পৃথিবীকে সইতে পারবার প্রস্তুতির দিকে, ‘তুমি’র দিকে। ভিতরের এই পথটা পাবার জন্যই সংহতিরও দরকার হয়ে পড়েছিল।
■ প্র: হয়তো ভুল বলছি আমি, আপনার ছয়ের দশকের আত্মীয় বলে অলোকরঞ্জনের যৌবন-বাউল-কেই মনে আমার। আপনার কবিতা সম্পর্কে তাঁর লেখা, ভালবাসা….. এগুলো তাৎপর্যময়।
■উঃ “যৌবনবাউল-এর আত্মীয়? ও-রকম ভাবার তো সাহসই পাইনি কখনও। আমার মনে হত যৌবনবাউল-এর শব্দ, ছবি, মন সবই ছিল উদ্ভাসনের মতো, ছড়িয়ে পড়বার মতো। তার বিশ্বাস, পরম্পরা, ভালবাসা। সবেরই ছিল একটা ইতিবাচক টান। নিহিত পাতালছায়া-কে তো সর্বার্থে এর উলটোই মনে হত আমার।”
◆―――বিস্ময়কর ভাবে লক্ষ্যণীয় যে চিন্ময় আমাদের শঙ্খ ও অলোকরঞ্জনের কবিতার কম্পারেটিভ স্টাডি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।এখানে চিন্ময় শঙ্খকে তাঁর ও অলোকরঞ্জনের কবিতার একরূপতার কথাও চিহ্নিত করলেন।
■প্র: আমি একটা সুক্ষ্ম, রুচিমান sensibility-র কথা বলছিলাম যেটা আপনাদের দু’জনকে মিলিয়ে দিচ্ছিল কোথাও।
■উ: এটা ঠিক যে সেই সময়টায় গোটা ষাটের দশক জুড়ে আমাদের সম্পর্কটা ছিল খুবই প্রতিস্পর্শী, অলোকের সান্নিধ্যে আমি অবিরাম উপকৃত হয়েছি তখন। সেই অর্থে, ভিতরকার একটা আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিল। আর আত্মীয়তায় বা ভালবাসায় সব কিছুকে বাড়িয়ে দেখা অলোকের আবাল্য অভ্যাস, আমার বিষয়ে ওর লেখায় তারই কিছু চিহ্ন থেকে গেছে।
■প্র: আয়ওয়ার পোয়েট্রি ওয়ার্কশপের অভিজ্ঞতা কতটা প্রভাবিত করেছিল আপনাকে? ওকাম্পোর বইটা আবিষ্কার করার কথা বলছি না শুধু…
■ উ: এ-ব্যাপারে বেশ-একটা সমস্যা তৈরি হয় আমার মনে। খুব-যে-কিছু প্রভাবিত করল ওই অভিজ্ঞতা, পিছন ফিরে তা তো আর মনে হয় না আজ। প্রভাব গ্রহণ করার জন্যেও একটা যে ধারণক্ষমতা লাগে, সজীবতা লাগে, তারই কি কোনও অভাব আছে আমার মনে? এই প্রশ্ন নিজেকে করেছি কখনও কখনও ।
■প্রশ্ন :: আপনি আপনার বলার কথাকে একই ছন্দে আঙ্গিকে আটকে না রেখে সর্বদাই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। “বিপুলা পৃথিবী’ বা ‘এখন সময় নয়’ ধরনের কবিতায় যে টানা গদ্য, তাকে আর একটু এগিয়ে অরুণ মিত্রের মতো ভাঙচুর করে দেওয়ার ইচ্ছে হয়নি আপনার কখনও? যা ধরুন, লোরোয়ান, র্যাঁবো, স্যাঁ-জন পের্স, অঁরি মিশো, ফ্রাঁসিস পঁজ-রা করেছেন?
■ উ :: পিছুটানের সমস্যা বোধহয় নয়, সমস্যা ওই নামগুলি নিয়ে। যে নামগুলি বলছেন, তার মধ্যে স্যা-জন পের্স বিশেষ ভাবেই আমার প্রিয়। কিন্তু তাই বলে তাঁর ধরনে লিখব কেন? হয় কি, কোনও কোনও লেখার ধাঁচ কারও কারও নামে বড় বেশি চিহ্নিত হয়ে যায়। এই যে অরুণ মিত্রের নামের সঙ্গে সঙ্গেই অবধারিত ভাবে কিছু ফরাসি কবির নাম উঠে এল, এতে প্রায় একটা গোত্রভাগ তৈরি হয়ে যায় না? সমস্যা এই গোত্র নিয়ে। অবশ্য, বিপুলা পৃথিবী, এখন সময় নয় ছাড়াও কখনও কখনও টানা গদ্যে লিখেছি,যা ধুম লেগেছে হৃৎকমল-এর মধ্যে আছে বেশ কয়েকটি।
■প্র: প্রায় একটা ক্লোদেলেীয় incantatory গদ্যের সম্ভাবনা ওই কবিতাগুলোয় খুঁজে পাই আমি। এমনকী একেবারে গোড়ায়, দিনগুলি
রাতগুলি-র নাম কবিতায়।
■ উঃ ওই তো, incantatory হলেই কেন ক্লোসেলীয় হবে?
■প্র: বেশ, ক্রোদেলীয় বলব না, কিন্তু incantatory –
■উ: যাই হোক, ওই নাম-কবিতাটা লিখতে শুরু করেছিলাম বেশ ভরাট একটা আবেগে, আঘাত পাওয়া একটা ঘোরের মধ্যে, নিতান্তই এক ডায়েরি হিসেবে। কয়েক লাইন লেখা হয়ে যাবার পর অবশ্য বুঝতে পেরেছি যে ডায়েরি নয়, কবিতার দিকেই এগোচ্ছে ওটা, এমনকী ছন্দোবদ্ধ। বাইরেটা গদ্যের চেহারায়, অথচ আগাগোড়াই ছন্দে বাধা: এর ফলে হয়তো ওই সুরটা আপনি পেয়ে গেছেন।
■ প্র: আপনি কি বহুদেববাদী নন? রবীন্দ্রনাথ কি আপনাকে মন্ত্রিত করে রাখলেন না সবচেয়ে বেশি? সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত বা বহুদেবতা বহু সুর-এর কথা বলছি না আমি!
■ উ: আমি বহুদেববাদী নই, আমি একেশ্বরবাদীও নই। বাধ্য হয়ে, চাপে পড়ে মাঝেমাঝেই গদ্য লিখতে হয়। আর তখন, লিখবার বিষয় হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নির্বাচন করে নিই কেবল এই একটিমাত্র কারণে যে ওইটুকুই আমি পড়েছি। এটাকে যেন বিনয়কথা বলে ভাববেন না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে হলে যতটুকু জানা দরকার, অন্য কোনও বিষয়েই ততটা আমি জানি না। রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই জানেন, অনেকের মতো আমিও খানিকটা জানি, সেইটুকুই শুধু বলতে পারি, বলতেই যদি হয়। কিন্তু আমি যে পূজার্থী, তা নয়। দেবপ্রসঙ্গ তাই ওঠে না। কীভাবে আমি পড়েছি, সেইটুকু শুধু বলি।
■ প্র: রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা ‘জটিল গহ্বর বা দুর্গ’ করে তোলেন তাঁদের থেকে দুরে দাঁড়িয়ে আপনি সব সময়ই সচল জীবনযাপনের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁকে বুঝতে চেয়েছেন, বোঝাতেও। এটাকে কি সচেতন বিদ্রোহ বলব? আপনি তো ‘বিশীর ছাত্র’ নন!
■ উঃ সব সময়েই যে নিজেদের জীবনযাপনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি, এতটা হয়তো বলা চলে না। তবে অনেক সময়েই তো চেয়েছি। একে কি একেবারে বিদ্রোহ বলা যাবে। বিদ্রোহের চেহারাটা বোধহয় আমার লেখার মধ্যে নেই।
■প্র: কিন্তু শাদা, বিদ্রোহ তো সব সময় বিদ্রোহের চেহারা নিয়ে আসে না। তবু তা বিদ্রোহ।
■ প্র: ‘রুচির সমগ্রতা’– যেটার ওপর আপনি জোর দিয়েছেন, সেটা কি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মে, একটা অশ্রদ্ধা, একটা ঔৎসুক্যের অভাব, প্রায় বিদ্বেষ অন্যের প্রতি। শিবিরপনা আগেও ছিল, কিন্তু তা কি এক বন্ধ্যা রুক্ষতায় পৌঁছে যায়নি?
■ উ: পুরনো দিনের শিবিরভাগের সঙ্গে এখনকার দলীয়তার একটা প্রভেদ আছে বলেই মনে হয়। একটা সময় ছিল যখন কবিতাদর্শের ভিন্নতায় একটা দূরত্ব তৈরি হত। আমার দাদা সত্যপ্রিয় ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রায় আমাদের পারিবারিক সদস্য যেন। ১৯৬২ সালে শক্তি-সুনীলের কবিতাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম বলে জীবনের শেষ তেইশ বছর আমার সঙ্গে আর কথাই বলতেন না বীরেনদা। আমি যাকে রুচির সমগ্রতা ভাবি, এ অবশ্য তার বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু তবু এর মধ্যে একটা স্বাস্থ্য আছে। ভুল হলেও এর একটা তত্ত্বাশ্রয় আছে। এখনকার অজস্র ছোট ছোট শিবিরবিভাজনে কাব্যাদর্শের বিশেষ ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না। আর। তা ছাড়া, আগে বলা ওই চটজলদির ঝোঁকের ফলে অধীরতা অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে অনেক বেশি, অনেকে বেড়ে গেছে কটূক্তি বা কুৎসা-প্রবণতা।
■প্র: আপনাকে সেদিন বলেছিলাম একটা কথা। আমাদের সব বড় কবিদের মধ্যেই একটা কেন্দ্র ছিল, একটা centre: রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে থেকে ধরা যাক অলোকরঞ্জন বা আপনি। অরুণ মিত্রের ভাষায়, ‘আমার বিশ্বাস ন্যস্ত ছিল পাথরে / এক অনমনীয় পাথরে। বেশ কিছুদিন হল সেই কেন্দ্রকোরকটাই হারিয়ে গেছে।
■উ: এর মধ্যে আমার নামটা এনে ফেলায় একটু মুশকিল হল। অরুণ মিত্র যেভাবে বললেন ‘এক অনমনীয় পাথরে’ বিশ্বাস ন্যস্ত করবার কথা, আমি কি আর সে ভাবে বলতে পারি? সেই অর্থে আমারও কি কোনও সেন্টার আছে? মনে তো হয় না। আর, কেবলই সেন্টার খুঁজে বেড়ানোটাকেই যদি একটা সেন্টার বলা যায়, তাহলে এখনকারও কোনও কোনও কবির লেখায় তার কিছু চিহ্ন পাওয়া অসম্ভব নয়। পাঠকের কাছে এই মুহূর্তে সেটা হয়তো তত স্পষ্ট হয় না, তার কারণ চারদিকের কলরোল। যে-কোনও একটা সময়ে এত রকম লেখা—এত অজস্ৰ লেখা—চারপাশে ঝরতে থাকে যে যথার্থ কবিতাগুলি তার মধ্য থেকে তার ঠিক ঠিক মুখ দেখাবার অবকাশই পায় না। কিছুদিন গড়িয়ে গেলে সে-মুখের আদল একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
************************************