চিঠি
অমিতা মজুমদার
মিসেস নীলা রড্রিকের এই চিঠিটা নিয়ে ঢাকায় তানভিরের বাসায় এসেছে, এক নীল নয়না তরুণী। নাম লিলি। নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দা। তানভিরের সাথে তার সোস্যাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব হয়। তানভীরকে সে বলে তার নানীর লেখা একটা চিঠি নিয়ে সে বাংলাদেশে আসতে চায়। কোনো এক মারুফ রায়হানকে পেলে তার নানীর মায়ের বাড়িও সে খুঁজে পাবে হয়তো।
কাকতালীয় ভাবে তানভিরের নানার নাম মারুফ রায়হান। তিনি এখন পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে মেয়ের কাছে আছে। লিলি জানে না এই মারুফ রায়হানই তার নানীর বন্ধু কি-না !
মা,
তোমাকে চিঠি লিখছি আমি এ কথা না জেনেই, তুমি বেঁচে আছ কি বেঁচে নেই ! বেঁচে থাকলেও এখন তোমার বয়েস কম করে হলেও নব্বই হবে। কারণ আমি এখন সত্তর। একাত্তর সালে আমি ছিলাম কুড়ি।
মা, মনে আছে গ্রামের ছোটো ছো্টো ছেলে-মেয়েরা আমাকে দেখলে ছড়া কাটত কুড়িতে বুড়ি? পাড়া প্রতিবেশি কাকিমা জেঠিমারা বলত মেয়েকে দিয়ে ঘরের খুঁটি বানাবে না-কি গো। তাই মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে পণ্ডিত বানাচ্ছো। সকলের এত এত কথা শুনে তুমি বাবার উপরে রাগ করে বলতে এবার আদরের মেয়েকে বিয়ে দাও। এরপরে তো গ্রামে থাকা দায় হবে। আমার শিক্ষক বাবা মুচকি হেসে বলত খুকির মা, আমার গোলাপ ফুলের মতো মেয়ে, রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী , তার বিয়ে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আগে বি এ পাশ করুক তারপরে বিয়ের কথা ভাববো। আমি চাই না আমার মেয়ে শুধু রান্নাবান্না আর ঘর সংসার করে জীবন কাটাক। সে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। স্বাবলম্বী হবে। যতদিন মেয়েরা স্বাবলম্বী না হবে ততদিন তাদের আত্মসম্মান বোধ তৈরি হবে না। বাবার প্রশ্রয় আর ভালোবাসায় আমিও ভাবতাম আগে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়ের কথা ভাববো।
অবশ্য এর মাঝে আরও একটা কারণ ছিল। বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র মারুফ রায়হান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার পাশ করে বের হতে তখনও এক বছর বাকি। আমাদের কথা হয়েছিল সে পাশ করে একটা ভালো চাকরি পেলেই বাবার কাছে আমার কথা বলবে।
সাল’টা ১৯৭১ হঠাৎ মার্চে যুদ্ধ শুরু হলো। সবাই মামা বাড়ি গেলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। মামা তোমাকে বুঝিয়েছিল তারা পাকিস্তান সরকারের পক্ষের লোক তাই তাদের কোনো ক্ষতি করবে না মিলিটারিরা। বাবা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে তাই বাড়িতে আমাদের থাকা নিরাপদ নয়। বাবার যুদ্ধে যাওয়ায় তুমি কিছুটা দিশাহারা হয়ে পড়েছিলে। তাই মামার কথায় রাজি হয়ে মামাবাড়িতে গেলে আমাদের নিয়ে। প্রথম কিছুদিন ভালোই ছিলাম। তারপর একদিন মামা বাড়িতে ক্যাপ্টেন জোয়ারদারকে নিয়ে এলো। তোমাকে নানীকে বোঝালো যুদ্ধতো কিছুদিন পর থেমে যাবে, মেয়ের এমন পাত্র কি আর পাওয়া যাবে? বাবার অনুপস্থিতিতে আমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই তোমরা বিয়ে নামক এক প্রহসনের মাধ্যমে আমাকে তুলে দিলে ক্যাপ্টেনের হাতে। তুমি হয়তো না জেনেই মামাকে বিশ্বাস করে রাজি হয়েছিলে। আর চারিদিকে যে ঘটনা ঘটছিল তাতে মনে করেছিলে পাকিস্তানী সৈনিকের সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে তুমি মেয়েকে রক্ষা করেছ। ভাবতে অবাক লাগে বাবার সাথে এতদিন সংসার করার পরও তুমি কতটা অন্ধকারে ছিলে, না-কি তুমিও মনে মনে পাকিস্তানকেই সমর্থন করতে ? সেকথা জানার সুযোগ হয়নি। তারপরের সাত মাসের কথা তুমি আর জেনে কি করবে ? দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের উদ্ধ্বার করে একটা আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়। আমাদের কাছ থেকে বাড়ির ঠিকানা নেয়া হয়। আমি দুটো ঠিকানা দিয়েছিলাম একটা আমাদের বাড়ির আর একটা মারুফের। কিন্তু কেউ আসেনি আমার খোঁজ নিতে। তারপর আমাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করা হলো। দেখা গেল আমি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তার বলল গর্ভপাত করানো যাবে না। তখন আমার বেশ মাথার বিকৃতিও দেখা দিয়েছে। পরের মাসগুলো কিভাবে কেটেছে তা আর তোমাকে জানিয়ে লাভ নেই, আমি নিজেও ভালো জানি না। শুনেছি আমার না-কী একটা ছেলে হয়েছিল, তাকে কোনো এক ফরাসী দম্পতি দত্তক নিয়ে নেয়। আমিও ততদিনে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। আমাদের সবসময় দেখাশুনা করতেন যে দিদি আর খালাম্মা তাঁদের বলি আমি কিছু করতে চাই। তারা আমাকে নার্সের ট্রেনিং নিতে বলে। আমি নার্সের ট্রেনিং নিয়ে নিউজিল্যান্ডে চলে আসি। এখানে এসে চাকরি করেছি, হ্যাঁ বিয়েও করেছি। যাকে বিয়ে করেছি সে আমাকে কোনোদিন আমার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেনি। প্রশ্ন করেনি আমার অতীত, আমার পরিবার নিয়ে। আমার নিজের তিন ছেলে-মেয়ে। আমার নাতি নাতনিরা আমাকে নিয়ে গর্ব করে। তাদের নানী, দাদি একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে। মা আমি এখন সরকারি পেনশন, বয়স্ক ভাতা মিলিয়ে অনেক টাকা পাই। যাতে আমার খাওয়াপরার কোনো কষ্ট নাই।
মা ,এই বয়সে এসেও একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, তোমরা একবারের জন্যও আমাকে দেখতে এলে না? কেন মা ! সমাজ, সংসার কি সন্তানের চেয়েও বড়ো ! তোমরা, মারুফ সবাই কি আমাকে বাদ দিয়ে ভালো ছিলে ?
বাবার কথা খুব মনে পড়ে? বাবা কি যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছিলেন ? না-কি বাবা শহিদ হয়েছিলেন? বাবাও কি আমাকে একবারের জন্যেও ফিরিয়ে নিতে চায়নি ?
আজকাল বয়েস হয়েছে বলেই হয়তো, পুকুর পাড়ের সেই পেয়ারা গাছটার কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে তোমার হাতের দুধ পুলির কথা। বাবার হাতের স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে।
নীলা