You are currently viewing চালকুমড়ার ফুল || ঊর্মি চৌধুরী

চালকুমড়ার ফুল || ঊর্মি চৌধুরী

চালকুমড়ার ফুল

ঊর্মি চৌধুরী

রানুর চিৎকার সোরগোলে দাদী বের হয়ে আসলো ঘর থেকে,এমনিতেই চোখে দেখেনা,তার উপর লাঠিতে ভর দিয়ে ঘরের চৌকাঠ পার হতে তার কষ্টই হয়। পুরোনো টিনের চালাটা দরজার পাশে একটু কাত হয়ে ঝুলে আছে,বেহিসেবে মাথা ঘুরালেই কেটে যেতে পারে। এমন কেউ নাই ঐটা তুলে ঠিক করে দিবে,এ বাড়ীতে কোনো পুরুষ লোক নাই।আর মিস্ত্রী ডাকার সামর্থ্যও নাই।তাও ওই বাড়ির রতন রে দেখলে ডেকে বলা যেতো। সেই গায়ে পইড়া কাজ কাম কইরে দেয়।

কী হইছে এত চিক্কুর পারোস ক্যান? দামড়ি মাইয়া গলা ছোডো কইরা কথা কইতে কইছি না তোরে। এমনিতেই সাত গাঁওয়ের মানুষ তোর নাম শুইনতে পারে না,মুখে যা নয় তাই কয়। বাড়ির উঠোন থেইকা পা দিলেই থু থু ছিটায়,অভিশাপ দেয় তাও তোর শিক্ষা হয় না ক্যান?

রানুর মুখ দিয়ে কথা সরে না আর। চুপ করে মাথাটা নিচু কইরা দাঁড়াইয়া আছে।হাসি,লাফানি সব পালিয়ে গেল নিমিষেই। চোখ ছল ছল করছে।

দাদী আবার জিজ্ঞেস করে,ঐ মাইয়া কী হইছে কস না ক্যান?এতক্ষণ কী লাফানিটা লাফাইলি,আমি তো বুঝলাম বর্গী হানা দিছে বাড়ীতে।

না কইলাম ঐ যে চালার উপর সাদা সাদা ফুল দেখা যায়,চরম উচ্ছ্বাসে আবারও বলতে লাগলো কইছিলাম না দাদী,দেইখো এবার মেলা চালকুমড়ো ধরবো। আমার লাগানো গাছ,বুড়ি কেমনে বৃথা যায়!!

ঐ,আগে তো ফল ধরুক,তারপর এত খুশি হইবি।

আরে দাদী,নিজের লাগানো গাছে ফল হইবো আমার যে কীরকম খুশি লাগতাছে তুমি কেমনে বুঝবা। আমি ঠেলা জাল দিয়া পুকুর থেইকা ইচাগুড়া আর ছোডোমাছ তুইলা দিমু, মা রাঁধবো আমি আর তুমি মিইল্যা মজা কইরা খামু।

আর মজা! জীবন থেইকা মজা চলে গেলে খানার স্বাদও চলে যায়রে ছেমরি, তোর মারে দেইখা বুঝোস না।বয়স তো কম হইলো না,কখন বুঝবি কউ গো নাতিন!

তুমি সব কথাই প্যাঁচাল পারো দাদী।ভাল্লাগেনা কইলাম।আর মারেও কত চাইলাম একটু হাসাবার লাইগা,হাসে তো না,আবার মুখটা সারাজীবন আন্ধার কইরা রাখে,কথা কইবার পারেনা।আমি কই যাই কও তো দাদী? তুমি চক্ষে দেখো না,মা বোবার মতো চাইয়া থাকে আমি একখান মানুষ কেমনে বাঁচি!!

আইচ্ছা দাদী কও তো হাঁছা কইরে,আমার মা’রে তুমি শেষবার হাসতে দেইখছো কোন সময়?আর একখান কথা,এই গ্রামের মানুষ আমারে দেইখলে নাক ছিটায় ক্যান দাদী? তারা আমার মারে লইয়া আজেবাজে কথা কয়,কয় আমার বাপের ঠিক নাই।তাইলে তুমি আমার মাঝে আমার বাপের ছবি দেইখো কেমনে?তুমি তো আবছা দেইখো,ভালা কইরে দেখবারও পারো না।

তুই এত কথা কস! কোনটা রাইখে কোনটার উত্তর দিই আমি!
রানুর মা দুয়ারে বসে বেতের ঝুড়ি বানাতে লাগছিলো।দাদী বলতে শুরু করলো।

হে দিন ছিল শুক্কুরবার। আমি গোসল কইরা কাপড় শুকাইতেছিলাম উঠানে। তোর বাপ বাইরে থেইকা আসি তোর মা’রে ঘর থেইকা লুঙ্গি আনতে কইলো,কইলো গোসল কইরা ভাত খাইবো,তারাতাড়ি রান্না শেষ করতে।দেশের পরিস্থিতি ভালা না। কখন কোনদিকে যাওন লাগে! চোখেমুখে আগুনের লাহান রক্ত উঠতে ছিল। আমি কইলাম,কী হইছে বাপজান তোরে এমুন দেখায় ক্যান! খারাপ কিছু?

আমারে কইলো,মা তুই তো বহুত সাহসী,সহজে ডরাস না কিছুতেই।তাই তোরে কই,বাজারে পাকিস্তানি মিলিটারি নামছে মা। এইবার বুঝি আর রক্ষা নাই। ইয়া বড় গাড়ী লইয়া আইসা পড়ছে,গাড়ী ভরতি গোলা বারুদ। পশ্চিমের গ্রামে হানা দিছে। বহুত বেটা ছেলে ধইরা লইয়া গেছে। মারছেও কম না। আগুন দিছে বহু বসত বাড়ীতে। আমরা গাঙের এই পাড়ে দেখে এখনও খবর অয় নাই। তা গো এত সাহস অইতো না কইলাম মা,যদি আমাগো দেশের হারামীরা তাদের সঙ্গ না দিতো।

আমাগো দেশের মানুষ ঐ শয়তানগো লগ লইছে ক্যান?হুনলাম তারা নাকি মুক্তি বাহিনীর পোলাগো ঘর চিনাইয়া দিতেছে,ধইরা নিতে সাহায্য করতাছে?

হ,আমগো গ্রামেও আছে মা এমন হারামী। ঐ যে মোল্লার পুত হায়দার সেও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিছে। আলেমের ঘরে জালেম হইছে। শালার পুত গো এমন শিক্ষা দিমু না মা,আমগো বাপ দাদার ভিটাতে খালি একবার পাও রাখুক।

আবার কইলো,মা আরেকখান কথা,তোগো বউ বেশি ডরাইল্যা। কিছু শুনবার আগেই মূর্ছা যাইতে চায়। আমি যদি কোনো কারণে বাড়ীর বাইরে গিয়া থাকতে অয়,তারে দেইখা রাখিস,রাত্তিরে তোর লগে ঘুমাইতে কইস। এমুন সময় ডরান ঠিক হইবো না।

এমুন সময় মানে কী? তুই কই যাবি বাপ?

মা,তোগো বউ হয়তো পোয়াতি। এখনও বেশি সময় হয় নাই তাই তোরে কিছু কয় নাই। তখন বউ দরজায় দাঁড়াইয়া লাজুক হাসিতে মুখ ঢাকতে ছিল। এইডাই তার শেষ হাসি রে নাতিন।

আমি তোর বাপরে আরও কইলাম,হে আমি তার চোখ দেইখাই বুঝবার পারছি,খাইতেও পারে না,আবার বমি কইরা লজ্জা পায় দেইখা আমি দূরে সইরা থাকি।কিন্তু তুই কী কস,কোথায় যাবি?

মারে,আমি, ফরিদ,রতনের বাপ সহ দশ বারোজন আইজ রাইতে বর্ডার পার হইতে হইবো,যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আনতে ভারত যামু। কদিন অস্ত্রের কৌশল লইয়া ফিরে আসবো আমরা।ততদিন তুই দেইখা রাখিস মা।পাশের বাড়ীর বকশিদার পোলা রতনটাও ছোডো, সে আর তার মা’র ও খবর রাখিস পাইরলে।

তখন আমার হাত,পাও ঠাণ্ডা হইয়া যাইতাছে।তোর মা হাত থেকে লুঙ্গিটা ফেলে চক্ষের পানি ছাইড়া দিছে, ঘরে ঢুকে কাঁদতে ছিলো।
তোর বাপ ভাতটা খাইয়া শুইতে গেছে,আমি কিছু চিড়া,মুড়ি পুটলা বাঁধতেছিলাম। পোলাটা কই যাইবো,কতদিনে পৌঁছায়বো মনটা কূ ডাকতেছিল।মানাও করতে পারিনা তারে। তোর দাদার লাহান রক্ত গরম তার। যে কথা একবার কইছে ঐডাই কইরা ছাড়ছে,কেউ ফিরাবার পারতো না। আর দেশের লাইগা মনডা আমারও তো কান্দে,এমুন বিপদের সময় জোয়ান মরদ একটাও ঘরে থাকবার পারে!!
মিলিটারি রাইত দিন পাখির লাহান গুলি কইরে মানুষ মারতাছে,তাগো সামনে কিছু লইয়া তো দাঁড়াইতে হইবো।

এই করতে করতে আসরের শেষ পড়তাছিলো,আমি ভেতর ভেতর মইরা গেলেও উপরে শক্ত থাকবার চাইলাম,তোর মা জানি কান্দে না ভাসায়। হঠাৎ উঠানে কার গলা শুনতে পাইলাম,ভয়ে আমি শক্ত হইতে আছি।

মানিক বাড়ীত আছোস নি,তোর লগে কথা আছিলো থোরা। হায়দার আলীর গলা শুনলাম। আমি মুখে কাপড় গুজে তোর বাপের ঘরে ঢুইকা তারে পেছনের দরজা দিয়া বাইর করে দিলাম,হাতে পুটলিটা দিতে ভুল করলাম না। আর বেড়া থেকে কাস্তে টাও তুলে দিলাম হাতে। একহাতে তোর মায়ের মুখ চেপে ধরলাম যাতে আওয়াজ কইরতে না পারে। মানিক আমার আর পেছনে ফিরে চাইলো না। এক দৌড়ে পাটি বেতের ঝোপের ভেতর দিয়া পলাই গেলো। তখনও হায়দর আলী ডাক পারতেছিল মানিক মানিক কইয়া।

রানু দাদীরে জড়াই ধরে বসে,দাদীর শুকনো চোখে পানি নাই,কিন্তু কণ্ঠ বন্ধ হয়ে আসতাছিলো। তারপর,তারপর কী হইলো দাদী?

কোন বিচক্ষণে হায়দার আলী দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকলো,সাথে হেই লম্বা খাঁকি কাপড় পিন্দনে এক বেটা। যেমন লম্বা তেমুনই শরীর বেডার। কথা কী কয় একটাও বুঝার আগেই তোর মারে টাইনা হেঁচড়াইয়া উঠানে নিয়ে গেলো। আমারে কোমড়ে লাথি মাইরা মাজা ভাঙা কইরে দিলো। হায়দার আলীর চোখে মুখে বিষের রক্ত দেখা যায়। আমি পাও খোড়াইয়া আঁচলে দাওখান লইয়া উঠানে গেলাম,ঐ কুত্তার পিঠে দাও বসাইয়া তোর মায়েরে উদ্ধার করলাম।হায়দার আলী দৌড়ে পলাইতে গেলে কুত্তার শরীর থেইকা দাও বাইর কইরা ছুঁড়ে মারলাম তারদিকে।তার হাতের কব্জিতে গিয়া পড়লো,ঐ হাত লুলা লইয়াই বাঁইচা আছে এখনও। মনে হইলো বাঘের শক্তি আইছিলো আমার গায়ে। সারা শরীর আমার রক্তে ভাইসা গেলো।

তারপর দাদী?রানুর চোখ বড় হয়ে উঠলো।

তারপর তোর মার মুখে পানি ছিটাইলাম,কলস কইরা পানি আইন্যা গোসল দিলাম। ফ্যাল,ফ্যাল কইরা চাইয়া রইলো আমার দিকে,মুখে কথা নাই,চোখে পানিও নাই। হেই যে বোবা হইলো আর তার মুখে কথা ফুটলো না। আশপাশের বাড়ি থেকে শুধু কাঁন্দনের আওয়াজ আসে।গ্রামের বাতাস কাঁন্দনের আওয়াজে ভারী হইয়া উঠলো কয়দিন।

রানুর মুখে শব্দ নাই,চোখ ভিজে উঠলো অশ্রুজলে। আমার বাবার আর কোনো খবর পাইছিলা দাদী?

এইবার গোঙানীর শব্দে দাদীর কণ্ঠও ধরে আসে।তারপরও বলে যায়….। তারপরদিন ই মাইনষের মুখে মুখে ছড়ায় গেছিলো,আমাগো থেইকে কিছুদূরে উত্তরদিকের গাঙের পাড়ে বালুচরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়া বেবাক মরদকে হাত দুইখান পিছমোড়া বাঁইধা শোয়ায় দিছিলো। তারপর কেউরে গুলি কইরা ঐখানেই মাইরা ফেলছে আর বেশিরভাগ সাথে লইয়া গেছে যেখানে তারা অত্যাচার করে মানুষ মারে সেইখানে। বকশি মিয়া মানে রতনের বাপের লাশ পাওয়া গেছিলো আরও দুইদিন পর গাঙের পানিতে। হে নাকি তাগো লগে বেশি বাড়াবাড়ি করছিলো। রতনের মা বুকে পাথর বাইন্ধা তার পোলারে নিয়ে বাঁইচা আছে।

আর আমার বাপের কথা! তার কথা কিছু শুনলানা?

আমার মানিকের খোঁজ আইজও পাইলাম নারে বুবু। তয় আমার দেয়া চিড়া,মুড়ির পুটলাটা পাওয়া গেছিলো। ঐ পাড়ার শরীফুল, যে লুকাইয়া বাঁচছিলো কোনোরকম হে আইন্যা দিয়ে গেছে,কইলো তাগো সবাইরে পাকিস্তানি মিলিটারি ধইরা লয়ে গেছে।

চারদিকে যুদ্ধ আর যুদ্ধের তেজ,কোনোদিকে ভালা খবর নাই।শুধু মানুষ মারার খবর। এপাড়ার হিন্দুগুলো যারা এতদিন একলগে সুখে দুঃখে বাঁচি আছিলাম সবই বর্ডার পার হয়ে যাইতেছিল। সুনীলের মা সুন্দর মুড়ি ভাজতো,কত মুড়ি কিইন্যা খাইছি,কোনোদিন টেকার লাইগা বইসা থাকতো না,তারও যখন যা লাগতো লইয়া যাইতো আমাগো থেইকা।গৌতমের বাপ বাজারে দোকান আছিলো। দই,মিষ্টি বেঁচতো। তোর বাপে ছোডোবেলাই কয়তো মিষ্টি কাকু। যেন কত আপনার,
ক’দিন বাদে বাদে খবর লইয়া যাইতো বৌঠান কইয়া ডাকতো আমারে। কারো বিপদে সে কাজে লাগে নাই এমন নজির নাই। তোর বাপরে নিয়া যাওয়ার পর সেই কী কাঁন্দন তাদের। গোপনে এসে খাবার, কিছু সদাইপাতি, টাকাও দিয়ে যাইতো। কিন্তু বেশিদিন না। জীবনের মায়ায় সবাই দেশ ছাড়া হইয়া গেলো। আমি তোর মা রে লইয়া আরো একা হয়ে গেলাম।

এইদিকে তোর মার মুখে কোনো কথা ফুটে না। তার শরীর এত খারাপ হইলো কোনো ডাক্তর/বৈদ্য পাই না আমি। যেই একখান ডাক্তার এ গ্রামে আছে বহুত কষ্টে তারে খবর পাঠাই,আমিও তো কোমড় ভাইঙ্গা ঘর বসা হইয়া ছিলাম। ঐ ডাক্তার কইলো,ঐ পাপের শরীরে সে চিকিৎসা করতে পারতো না।শুরু হইলো তোর মায়ের নামে অপবাদ,তোর জন্মের আগেই তোরে লইয়া নানান খারাপ কথা। পুরা গাঁও জুড়ে রটাই দিলো তুই পাকিস্তানি মিলিটারির সন্তান। আমি তো জানি তুই আমার মানিকের রক্ত।আমার কথা ঠুনকোতে উড়াই দিলো ঐ লুলা হায়দার আলী।কোনো চিকিৎসা ছাড়াই তোর জন্ম হইলো। পাশে পাইলাম শুধু ঐ রতনের মা’রে। তোর মায়ের খাইয়া,না খাইয়া থাইকা এক্কেবারে রোগা হইয়া তুই জন্মাইলি।
ক্যান তখন গলা টিপ্পা মারলা না দাদী? অখন এত কথা হুইনা বাঁচনের চাইতে মরণও যে ভালা আছিলো দাদী। আমার মাও মইরা বাঁচতো এই সমাজ থেইকা। রানুর কান্দন থামে না আর।

আইজ এত বছর পর ক্যান আবার পুরান স্মৃতি উতলাই দিলি নাতিন, আমি তো বুকের ভেতর রক্তচোষা পোকা পালতেছিলাম,ভেতর ভেতর খাইয়া চুষে ফেলছে,তয় তোর কথা,আওয়াজ শুইনা শান্তি খুঁজি আমি। ঠাণ্ডা বাতাসের লাহান বুকটা শীতল হয় আমার।তোর লাইগাই বাইচ্যা আছি আমি।

তারও মাস খানেক পরের কথা,রতন আসে এক দুপুর বেলা,রানুর লগে দেখা করে। এই সময়টাতে দাদী,মা ঘুমাই থাকে,নইলে এমনিতেই বিছনাতে গড়াগড়ি করে। রতন বলতে থাকে,চল রানু আমরা পলাইয়া বিয়া করি। নইলে এই গাঁওয়ের মানুষ আমাগোরে কোনোদিন এক হইতে দিবো না।

রানু অবাক হয়,কী কইলা? মা,দাদী এদের ছাইড়া কই যামু কও?

তুই শুনলিনা,সেইদিন মজলিসে মাতব্বর কী কইলো আমার মা’রে। কইলো তোরে বিয়া করলে একঘরে করবো আমাগো। তোরে লইয়া,চাচীরে লইয়া নানান খারাপ কথা কয়,মা প্রতিবাদ করতে লইলে শেষ পর্যন্ত তারে বাইর করে দেয় মাতব্বর। আর ঐ মাতব্বরের চেলা হায়দার আলী,সে আরও কইলো চাচী নেহাৎ বোবা, নইলে হুঁশে থাকলে তারেও গাঁও ছাড়া করতো।
এখন তুইই ক আমগো কী করার আছে?

চল পলাই। চিন্তা কর রানু,এই গ্রামে থাকলে তুই,আমি কোনোদিন এক হইতে পারুম না,তুই ও কোনোদিন স্বাভাবিক হইতে পারবি না। তয়,কইলাম এমনে যামু না।একটা বিহীত কইরাই যামু। আমারে জানাইস তুই,আমি গেলাম।

সেদিন রাতে রানুর ঘুম হইলো না,মাথাটা শুধু আউলা লাগে।রতনের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।

ক’দিন পর খুব ভোরে বাড়ীর কিছুটা দূরে সোরগোল শোনা যায়,গাঙের পাড়ে হায়দার আলীর রক্তাক্ত দেহ পইড়া আছে,তারও দূরে পাওয়া গেছে ঐ ডাক্তারের লাশ। পুরো গাঁও উত্তাল হইয়া পড়ছে। যুদ্ধের পর এতদিন বাদে কে জানি এই আবার নতুন যুদ্ধের ঢাক পিটাইলো।

রতনের মা আইসা ধপাস কইরা দুয়ারে বসে গেলো, রানুর দাদী খুঁজে দেখলো বেড়ার খাঁজে তার দাও খান নাই,যেটা দিয়ে হায়দার আলীরে লুলা করছিল,ঐ মিলিটারিরে মারছিলো।

রানুর মা ভেজা শাড়ী পইড়া আছে,তার একখানই ভালা শাড়ী।রাইতে ছেড়া তালির শাড়ীর একখান টুকরো পড়ে শোয়,দিনে এইডা পিন্দে। অনেকদিন পর খুশি খুশি মুখ করে আছে সে,চাল কুমড়া পাড়তেছিল চালা থেকে। কেউ জিজ্ঞেস করেনি এই সাত সকালে তার শাড়ীডা ভেজা ক্যান,রানুরে খুঁজে না পাইয়া কাঁদে না ক্যান! কারণ সে তো বোবা,উত্তর দেয়ার ক্ষেমতা নাই।

এরপর থেকে রানু,আর রতনের নাম ঐ গ্রামের বাতাসে জপতেছিলো,সেই গায়ে তাদের আর দেখা যায়নি।

========================