চাঁদের অমাবস্যাঃ অস্তিত্ব সংকট, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও পরাবাস্তব ঘোর
শিল্পী নাজনীন
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা কথাসাহিত্যের এক শক্তিমান লেখক। পূর্ব বাংলার কথাসাহিত্যকে বিশ্বমানে উত্তীর্ণ করায় এবং আধুনিক রূপদানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একটি শক্তিশালী নাম। মাত্র তিনটি উপন্যাস লিখে যিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে এক অনন্য উ”চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সৃষ্টিশীলতায় ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য, পেয়েছে নতুনতর বাঁক। চাঁদের অমাবস্যা ষাটের দশকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হওয়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দ্বিতীয় উপন্যাস। উপন্যাসটি আগাগোড়া একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, যেখানে আছে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর অস্তিত্ব সংকটের দারুণ উপস্থাপন এবং তাদের মধ্যে বিদ্যমান জটিল সব মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। উপন্যাসটির প্রতি পরতে লেখক তার স্বভাবসুলভ ভাষার ইন্দ্রজালে এমন এক ঘোর তৈরি করতে সক্ষম হন যে, পাঠক উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে একটি পরাবাস্তব ঘোরে ডুবে যায়।
চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে প্রথমেই পাঠকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে দরিদ্র স্কুল শিক্ষক আরেফ আলীর। উপন্যাসজুড়ে যার নামটি লেখককে খুব কম বারই উ”চারণ করতে দেখা যায়। লেখক যাকে বারবার পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন যুবক শিক্ষক হিসেবে। মূলত সামাজিক অবস্থান বিচারে আরেফ আলী এমনই গুরুত্বহীন একজন ব্যক্তি যার নামটি না নিলেও চলে, যুবক শিক্ষক বলে যাকে উদ্ধৃত করলেই কাজ চলে যায়, এমনই একটি সনাতন ধারণার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই আলোচ্য উপন্যাসের শুরুতেই। ঘটনাক্রমে এই যুবক শিক্ষক আরেফ আলীই হয়ে ওঠে চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের মূল চরিত্র, যাকে কেন্দ্র করেই গড়িয়ে যায় উপন্যাসের কাহিনি।
ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে সদ্য বের হয়ে আসা গ্রামীন সামন্ততান্ত্রিক যে সমাজব্যবস্থা, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির শেকলে শৃঙ্খলিত, অবরুদ্ধ যে সমাজ, সেই সমাজের মানুষের ভেতরকার নানা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও সংকটকে লেখক এই উপন্যাসে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে এনেছেন।
যুবক শিক্ষক তথা আরেফ আলী সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে। অতিশয় দরিদ্র আরেফ আলী শহরে খেয়ে না খেয়ে এইচএসসি পাস করে দূরের গ্রামের অবস্থাপন্ন জোতদার পরিবার প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলে সামান্য বেতনে চাকরি নিয়েছে। সে বাড়িতে সে থাকে, খায়, বাড়ির বাচ্চাদের দুবেলা পড়ায় আর মাসশেষে স্কুলের সামান্য বেতনটুকুর পুরোটাই সে তুলে দেয় তার বিধবা মায়ের হাতে, যাতে তার মায়ের গ্রাসাচ্ছাদান চলে। হাতের তালুর মত সামান্য জমিটুকু বিক্রি করে নিজের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করাটা যার কাছে নিতান্তই বিলাসিতা মনে হওয়ায় সেদিকে আর না এগিয়ে স্কুল শিক্ষকের সামান্য চাকরিটি বেছে নিতে বাধ্য হয় এই যুবক শিক্ষক।
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা এই যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর দেখা পাই। যে কোনো এক পূর্ণিমা রাতে বড় বাড়ির পেছন সংলগ্ন ঝোপের পাশের জামগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। হঠাৎ বড় বাড়ির মালিক দাদাসাহেবের ছোটভাই কাদের মিয়াকে ভরা জোছনার ভেতর দিয়ে একা হেঁটে যেতে দেখে সে, দাদা সাহেব যাকে দরবেশ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত করিয়ে দিয়ে আনন্দ পান। ঘুম এবং জোছনা দুইয়ের প্রভাবে যুবক শিক্ষকের মধ্যে হঠাৎ বিভ্রম তৈরি হয়। রাতের ভরা জোছনার আলোয় কাদের দরবেশকে হেঁটে যেতে দেখে তার মধ্যে তৈরি হয় প্রবল কৌতূহল। সে কাদেরকে অনুসরণ করতে থাকে এবং এই অনুসরণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি গতি পায়। যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর সঙ্গে পাঠকও অনুসরণ করে চলে কাদেরকে, ভরা পূর্ণিমার জোছনায়, গ্রামের আলো-ছায়ার মায়ারী জগত পাঠককেও পুরোপুরি গ্রাস করে নেয়, তার মধ্যে তৈরি করে এক পরাবাস্তব ঘোর। জোছনার রূপালি আলোয় ডুবে যাওয়া প্রকৃতির ভেতর দিয়ে কাদেরকে অনুসরণ করতে গিয়ে যুবকটি একসময় কাদেরকে হারিয়ে ফেলে এবং তাকে ভুলেও যায়। জোছনা রাতের প্রকৃতি তাকে মোহগ্রস্ত করে, সে গ্রামের চষা খেত, বসতবাড়ি পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে এক বাঁশঝাড়ের সামনে আসে। বাঁশবনের ভেতর থেকে সে কারো চাপা, ভারী কণ্ঠের কথার আওয়াজ পায়। সহসা তার আবার কাদের মিয়াকে মনে পড়ে। সে সজোরে বলে ওঠে, ‘কাদের মিঞা! বাঁশঝাড়ে কাদের মিঞা!’
এই বলাটা বস্তুত পাঠকেরও। পাঠকও এখানে যুবক শিক্ষকের সঙ্গে কথাটি অজান্তেই বলে ওঠে যেন।
আরেফ আলীর এ কথায় বাঁশঝাড়ের আওয়াজ থেমে যায়। হঠাৎ নামা নীরবতায় যুবক শিক্ষকের কৌতূহল বাড়ে, সে বাঁশঝাড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। গভীর রাতে তার পায়ের চাপে বাঁশঝোপের মধ্যে ঝরে পড়া পাতার দঙ্গলে সরসর শব্দ ওঠে, নীরব রাতে যা বহুগুণ তীব্র হয়ে বাজে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে নারীকণ্ঠের ভয়ার্ত এক চিৎকার শুনতে পায়। এবং সেই রাতে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী এক বিভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আরেফ আলী দেখে, ‘জন্তু-জানোয়ার নয়, সাপখোপ বা মাঠালি ইঁদুর নয়, কোনো পলাতক দুষ্টু ছাত্রও নয়। বাঁশঝাড়ের মধ্যে আলো-আঁধার। সে আলো-আঁধারের মধ্যে একটি যুবতী নারীর মৃতদেহ। অর্ধ-উলঙ্গ দেহ, পায়ের কাছে একঝলক চাঁদের আলো।’
এই দৃশ্য দেখে যুবক শিক্ষকের মধ্যে ভয়ানক তোলপাড় শুরু হয়। তার মধ্যে তৈরি হয় নিদারুণ বিভ্রম। অকুস্থলে কথিত কাদের দরবেশকে দেখে সে রুদ্ধশ্বাসে দিগি¦দিক ভুলে দৌড়াতে থাকে। তার মধ্যে তৈরি হয় নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টানাপোড়েন, সংকট।
বহুকষ্টে পড়াশোনা শেষ করে আরেফ আলী স্কুলে চাকরি নিয়ে নিজের এবং বিধবা মায়ের গ্রাসা”ছাদনের ব্যবস্থা করেছে, আশ্রয় পেয়েছে এই বড়বাড়িতে। গ্রামের জোতদার, প্রভাবশালী এই পরিবারটিই তার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, এলাকাজুড়ে যাদের সুনাম, প্রভাব-প্রতিপত্তি। গ্রামের নানান মানবিক কাজে যাদের সাড়া মেলে সবার আগে, সে পরিবারেরই ছেলে কাদের, যাকে বড় দাদাসাহেব দরবেশ বলে প্রচার করেন, সেই কাদের এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত, এমন ঘৃণ্য একটি কাজের সঙ্গে সে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত, এমন ভাবনা তাকে অ¯ি’র করে তোলে, তার বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দেয়।
সে নিজেকে প্রথমে এই বলে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করে যে, হয়তো যুবতী নারীটি আগেই খুন হয়েছিল, কেউ তাকে খুন করে রেখে গেছিল, কাদের বা সে, ঘটনাক্রমে সেখানে উপ¯ি’ত হয়েছে। কিংবা অমন কিছুই আসলে ঘটে নাই, পুরোটাই তার অনুর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। তার মধ্যে এমন ভয়ও দানা বাঁধে যে, কাদের হয়তো তাকে যুবতী নারীটির খুনী ভাবছে, হয়তো সে তাকে খুনী হিসেবে প্রচার করবে গ্রামে। কিন্তু কাদের পরের রাতে সেই মৃতদেহটিকে গুম করতে যুবক শিক্ষককে অমনি ভরা জোছনায় ডেকে নেয়, মৃতদেহটিকে সে ভাসিয়ে দেয় নদীর স্রােতে। তখন আরেফ আলীর বোধোদয় হয়। সে বুঝতে পারে, ভ্রম নয়, যুবতী নারীটি সত্যিই খুন হয়েছে এবং তাকে খুন করেছে কথিত দরবেশ কাদের। তথাপি সে কাদেরের অপরাধ ক্ষমা করতে প্র¯‘ত থাকে। তার মধ্যে এমন ধারণা জন্মায় যে, কাদের নিশ্চয়ই ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছিল মৃত, বন্ধ্যা নারীটির সঙ্গে। তাই সে রাতের অন্ধকারে বাঁশঝাড়ে দেখা করতে গেছিল সে-রাতে। তখন হঠাৎ যুবক শিক্ষকের কণ্ঠস্বরে ভয় পেয়ে নারীটি চিৎকার করে ওঠায় কা-জ্ঞানশূন্য হয়ে কাদের তার গলা টিপে ধরায় নারীটির মৃত্যু হয়, কাদেরের ভাষায় যা নিছকই একটি ‘দুর্ঘটনা’। আর মানুষ বড়ই ‘ভঙ্গুর’।
এরপর যুবক শিক্ষক প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রাত্যহিকতার স্রোতে ভাসতে, স্বাভাবিক জীবনস্রোতে মিশে যেতে। কিন্তু তার ভেতরে অদ্ভুত এক তোলপাড় শুরু হয়। সে কাদেরের পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে থাকে, একই সঙ্গে যুক্তি দাঁড় করাতে থাকে নিজের স্বপক্ষেও। সে সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু কাদের যুবতী নারীটির সঙ্গে হৃদয়াবেগে ভেসেছিল এবং যুবতী নারীটির মৃতদেহটিকে অহেতুক অপমানের হাত থেকে বাঁচাতেই সে মৃতদেহটিকে যুবক শিক্ষকের সহায়তায় নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে, সেহেতু তাকে ক্ষমা করা যায়। কাদেরের মধ্যকার প্রেমিক এবং একইসঙ্গে মানবিক সত্তাটির আবিষ্কারে মনে মনে সে খুশি হয়ে ওঠে এই বলে যে, তাকে আর এই দুঃসংবাদটি কাউকে জানানোর ক্লেশ বহন করতে হবে না যে, কাদের গ্রামের এক মাঝির বন্ধ্যা যুবতি বধুটিকে হত্যা করেছে। কেননা এই সংবাদ প্রচারে তার নিজের অস্তিত্ব প্রবল হুমকির মুখে পড়বে। প্রথমত এতে তার নিজের সম্পৃক্ততা নেই সেকথা প্রমাণ করা কঠিন হবে, দ্বিতীয়ত, তার চাকরি এবং আশ্রয় হারানোর সম্ভাবনা থাকবে, তদুপরি যে পরিবারের নিমক খেয়েছে সে এতদিন, যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সে বেঁচে আছে, সেই পরিবারের বিরুদ্ধে এমন ভয়ানক অভিযোগ তোলার, সুনামে কলঙ্ক ছিটানোর দুঃসহ কাজটি তাকে করতে হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সে কাদেরের অপরাধকে প্রেমঘটিত দুর্ঘটনা হিসেবে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কাদের তার ভুল ভাঙিয়ে দেয়। যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, প্রেম নয়, বরং বিকৃত যৌনরুচি, লালসা ও নীচতাই কাদেরকে এই হত্যায় প্রলুব্ধ করেছে। অবশেষে যুবক শিক্ষক নিজের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করে, নিজের অস্তিত্ব সংকটকে উপেক্ষা করে বড় বাড়ির দাদাসাহেবকে হত্যাকা-ের কথা জানায় এবং পুলিশের কাছে যায়।
নিরীক্ষাধর্মী এ উপন্যাসটিতে লেখক জীবনের সহজ স্বাভাবিক ছন্দ কোনো একটি ঘটনার ঘাতে কী করে বাধাগ্রস্ত হয় তা তুলে ধরেছেন দারুণ মুন্সীয়ানায়। মানবচরিত্র রহস্যময়। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সে সদা তৎপর, অতিমাত্রায় সচেতন। যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর চরিত্রে আমরা তার প্রতিফলন দেখি। নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে না ফেলায় সে যেন নিজের সঙ্গেই নিজে অন্তর্দন্দ্বে ব্যাপৃত হয়। তার ভেতরে তৈরি হওয়া এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও আলোড়নই মূলত এই উপন্যাসটিকে প্রাণ দিয়েছে, দিয়েছে দারুণ এক গতিময়তা। শেষপর্যন্ত এই অস্তিত্বসংকট, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও পরাবাস্তব ঘোর উপন্যাসটিকে দারুণ আকর্ষণীয় ও সুখপাঠ্য করে তোলে পাঠকের কাছে, করে তোলে উপভোগ্য।
***************************