You are currently viewing চশমা/ লতিফুল কবির

চশমা/ লতিফুল কবির

চশমা

তিফুল কবির

মতিঝিল শাপলা চত্ত্বরে সিএনজিতে চড়ে বসার কিছুক্ষণ পরেই আব্দুল মতিন বুঝতে পারে যে প্রকৃতির বড় ডাকটি তলপেটের কোনা থেকে উঁকি মারতে শুরু করেছে। দুপুরে হাসপাতাল থেকে হাঁটার দূরত্বে একটা রেঁস্তোরায় বিরিয়ানি খেয়েছিল, তখন বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয় নি, কিন্তু এখন সেটার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়াতে সে ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করে। পাকস্থলির অনেক গভীরে ভুট-ভুট আর গুড়-গুড় শব্দগুলো পরষ্পরের হাত ধরে চারুকলা শিল্পীদের মতো বৃত্তাবন্ধ ছন্দে খেলা শুরু করে দিয়েছে এবং সহসা এই শব্দমালা যে তাদের তরঙ্গদৈর্ঘকে প্রসারিত করে প্রলয় নাচে রূপান্তরিত হবে, সে বিষয়ে আব্দুল মতিন মোটামুটি নিশ্চিত।  সিএনজি থেকে গলা বের করে আসেপাশের ভবনগুলোর দিকে তাকালো সে। সিএনজি তখন বায়তুল মোকাররম পার হয়ে তোপখানার দিকে ছুটছে। বিকালের এই সময়টাতে রাস্তায় ট্রাফিক একটু বেশিই থাকে। কিন্তু, যে কোনো কারণেই হোক রাস্তায় ট্রাফিক বেশ কম, ফলে মুক্ত বিহঙ্গের মতো সিএনজি ছুটছে তো ছুটছেই। মুক্ত রাস্তা পেয়ে সিএনজি-চালক তার গাড়ির গতি বাড়াতে যাবে, হঠাৎ প্রেসক্লাবের দিক থেকে মাঝবয়সী একজন নারী রাস্তা পার হওয়ার উদ্দেশ্যে দৌড় দেয়, আর তাকে রক্ষা করতে সিএনচি-চালক সজোরে ব্রেকে পা দিলে আব্দুল মতিনের কর্ম সারা হবার জোগাড় হয়। প্রবল নিম্নচাপে তাঁর শরীরে ঘাম চলে আসে এবং কোনোরকমে সে বলে, ‘এই যে ভাই, আশে-পাশে কোনো টয়লেট আছে?’

নির্বিকার সিএনজি চালক তার দৃষ্টিকে রাস্তার উপর রেখে উত্তর দেয়, ‘বড়ডা না ছোডডা?’

‘বড়। বড়। কোনো টয়লেট আছে কি না বল, সহ্য করতে পারতেছি না।’

‘বায়তুল মোকাররমের আগে কইতে পারলেন না! যত্তসব ঝামেলা।’

দম বন্ধ করে সিএনজি-চালকের হম্বিতম্বি সহ্য করে যায় আব্দুল মতিন।  এছাড়া কী করারই-বা আছে? ঠিক তখন কিছু বুঝে উঠার আগেই ডানে সেগুনবাগিচার গলিতে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয় সিএনজি-চালক এবং কিছুক্ষণ চলার পরে একটা ভবনের সামনে গাড়ি থামিয়ে বলে, ‘এইহানে একখান জাদুঘর আছে। টয়লেট পাইবার পারেন। জলদি করেন।’

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভবনের সামনের নামফলকটি ভালো করে দেখা হয় না আব্দুল মতিনের। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে টয়লেট কোথায় জিজ্ঞেস করলে তার দেখিয়ে দেয়া পথে ত্রস্ত পায়ে টয়লেটে প্রবেশ করে সে। তারপর খাঁচা ছাড়া পাখির মতো সুখের আনন্দে ভাসতে ভাসতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে খানিকটা বেশী সময় ধরে কমোডের সিটে বসে থাকে সে।  এমন সময় বরাবর যা হয়, আব্দুল মতিনের বেলায় সেটাই ঘটলো। হারানো দিনগুলোর সাথে মিলেমিশে গত কয়েকদিনের স্মৃতি তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। একসাথে পাঁচটা মক্কেল ধরে আনা এবং সকলকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা না; কিন্তু সেটা সে করতে পেরেছে এবং আনন্দের আতিশয্যে ভরপেট বিরিয়ানি খেয়ে ফেলেছে। সাথে দুই গ্লাস বোরহানি।

সাফেল্যের চুড়ায় ওঠার সময় বড়-বড় গাছগুলো যেমন আসেপাশের গাছগুলোর দিকে করুণাভরে তাকায়, আব্দুল মতিনও তার বন্ধুদের দিকে সারাক্ষণ তেমন একটা করুণার দৃষ্টি প্রসারিত করে রাখে। বন্ধুরা ইদানিং বাঁকা চোখে তাকায়, তাদের কেউ-কেউ আড়ালে-আবডালে তাকে নিয়ে কথা বলে এবং তারা যা বলে তার সাথে রঙ মিশিয়ে অনেক কথা আব্দুল মতিনের কানে ভেসে আসে। ওসব কথায় কান দেয়ার মতো সময় আব্দুল মতিনের নাই, প্রয়োজনও বোধ করে না। এখন সুখের ঠেলায় টয়লেটে বসে থাকতে থাকতে বন্ধুদের কথায় কেন জানি তার মনে ভেসে উঠলে আব্দুল মতিনের গান গাইতে ইচ্ছে করল। হোস্টেল জীবনে টয়লেটে বসে গুন-গুনিয়ে গান গাওয়ার অভ্যাস ছিল, বাসার টয়লেটে সেই অভ্যাস অদ্যাবধি ধরে রেখেছে সে। অচেনা-অজানা জায়গায় গান গাওয়া ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগই পেল না সে, তার আগেই মুখ দিয়ে গজল বের হয়ে এল, ‘মুঝে তুম নাজারসে গিরাতো রাহে হো মুঝে তুম কাভিভি ভুলানা সাকোগে।’

কিন্তু আব্দুল মতিনের সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। হঠাৎ করেই তার গজল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কী, এরপর কী― মনে ভাবতে থাকে সে; কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও গজলের পরের লাইনগুলো মনে করতে পারলো না। এমন তো হওয়ার কথা না, মনে মনে ভাবে আব্দুল মতিন। শুধু এই গজল তো না, ওই গায়কের সব গজল তার মুখস্ত এবং অনন্তকাল ধরে মগজের স্তরে স্তরে সেগুলোকে সাজিয়ে রেখেছে সে ওয়াড্রোবে কাপড় সাজিয়ে রাখার মতো করে। সেখানে কোনো কারণ ছাড়াই সেই সাজানো ওয়ার্ডড্রোব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে! ঝড়ের তাণ্ডবের পরে স্বজন খুঁজে বেড়ানোর মতো করে গজলের লাইনগুলো খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে আব্দুল মতিন; কিন্তু পণ্ডশ্রম! কী মনে করে ডান হাত দিয়ে মাথার একপাশে আলতো করে বারি মারে সে, দেখে মনে হবে মগজের কোথাও ওটা আটকে আছে এবং ঝাঁকি দিলে গাছে কুল পড়ার মতো তা পড়তে শুরু করবে। তো ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। আব্দুল মতিন বুঝতে পারে তার মগজ থেকে কিছু একটা গল-গল করে নেমে যাচ্ছে। তার মনে হল যেন গজলগুলোই নেমে যাচ্ছে; কিন্তু নিষ্কৃত মলের মতো মাথা থেকে গজলও যে নেমে যেতে পারে এটা তার বিশ্বাস হল না। সেজন্য আবারও চেষ্টা করল সে। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও যখন একটা গজলও মনে করতে সক্ষম হলো না, তখন আব্দুল মতিন এই ভেবে সান্তনা লাভ করল যে অনাবিল প্রশান্তি লাভের কারণে মস্তিষ্কের কোষে সাময়িক স্মৃতিভ্রম হয়েছে এবং স্বাভাবিক সুখের সময় আবার গানগুলো ফিরে আসবে।

স্বস্তি আর অস্বস্তির মাঝামাঝি একটা অনুভূতি নিয়ে টয়লেট থেকে বের হয় আব্দুল মতিন। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে তার মধ্যে বিভ্রম জাগে― এ কোথায় এসেছি? জায়গাটা যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অভ্যর্থনাকক্ষ, সেটা বুঝতে একটুও বিলম্ব হয় না তার। মুহূর্তে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত নামতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা শব্দসমূহের প্রতি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিতৃষ্ণার অনুভূতিগুলো তখন তার মস্তিষ্কের কোষ থেকে শরীরময় ছড়িয়ে পড়ত শুরু করে।

এমনিতে আব্দুল মতিন সাবধানী মানুষ। স্থান, কাল ও পাত্রের যে সচেতনতা তাকে এতটা পথ টেনে এনেছে তা তাকে সাবধান করে দেয়, বলে― মাথা গরম করলে চলবে না। ঠাণ্ডা মাথায় চারপাশের সবকিছু ভালো করে বুঝে নিতে চেষ্টা করে সে। সামান্য ভুলের জন্য মহা বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে― ভাবে আব্দুল মতিন এবং খুব সন্তর্পনে বাইরে বেরুবার জন্য পা ফেলতে যাবে, হঠাৎ কোত্থেকে কেউ ডেকে ওঠে, ‘মতিন সাহেব!’

আব্দুল মতিন এদিক-ওদিক তাকায়; কিন্তু ডাকটি কোত্থেকে এসেছে সেটা বুঝে উঠতে পারে না সে। সামনে এগুবার জন্য আবারও পা বাড়াতে যাবে, সেই একই ডাক আবারও ভেসে আসে, ‘আব্দুল মতিন সাহেব!’

আব্দুল মতিন আবারও চারিদিকে তাকায়; কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। এবার তাই সাপ-বেজি খেলার মতো একটু কৌশলী হয়ে ওঠে সে, অদৃশ্য মানুষটিকে দেখতে পেয়েছে তেমন একটা ভাব নিয়ে বলে, ‘জ্বি বলুন!’

‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’

‘দেখুন। আমি মহাবিপদে পড়ে এখানে এসেছিলাম।’

‘বিপদে পড়লেই মানুষ এখানে আসে।’

‘কিন্তু আপনি কে?’

‘আমি ডাক্তার মতিন!’

‘দেখুন, আপনি হেঁয়ালি করছেন। আমিই ডাক্তার মতিন। আপনি আমার নাম জানেন সেটা ভালো কথা, কিন্তু আপনি সামনে আসছেন না কেন?’

‘আপনি ডাক্তার! শুনে ভালো লাগল। কীভাবে ডাক্তারি করেন মতিন সাহেব?’

‘কেন সবাই যেভাবে করে আমিও সেভাবে করি। মফস্বল শহরে থাকি, সেখানে আমার অনেক নাম-ডাক। রুগি আসে, তাদের ব্যবস্থাপত্র লিখে দেই।’

‘গতকাল পাঁচজনকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। ঠিক?’

‘হ্যাঁ ঠিক।’

‘যাদের এনেছেন, তাদের কারও অপারেশন করার দরকার নাই, এটা জেনেও আপনি এনেছেন। ঠিক?’

এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকা এবং অদৃশ্য মানুষটিকে না দেখেও কথা বলে কী হবে, আব্দুল মতিন এবার সত্যি-সত্যি ঘাবড়ে যায়। ঢাকায় সরকারের গোয়েন্দারা অলি-গলি পাহারা দিয়ে রাখে, সেটা সে শুনেছে; কিন্তু অদৃশ্য লোকটি যা বলছে তা-তো একেবারে হাঁড়ির খবর এবং সেটা কারও জানার কথা না। স্নায়ুর উপর একটা চাপ পড়ছে, সেটা বুঝতে তার অসুবিধে হয় না। অন্ধকারে ভূত দেখার পরেও কিছু মানুষ যেমন সাহসী হয়, সাহসী কথা বলে স্নায়ুর চাপকে হালকা করতে চেষ্টা করে, তেমন একটা চেষ্টায় সে বলে,  ‘দেখুন, আপনি অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে আড়ালে রেখে যাচ্ছে-তাই বলে যাচ্ছেন। আপনার কিছু বলার থাকলে সামনে এসে বলুন।’

অদৃশ্য কণ্ঠ কিছু বলল না।

এভাবে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আব্দুল মতিন অনেককিছু ভাবে। তার মনে হয় যে গোয়েন্দা প্রকৃতির হলেও অদৃশ্য লোকটি আসলে সাহসী না। এই ভাবনা থেকে  চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা ফেলতে যাবে, তক্ষুণি অদৃশ্য কণ্ঠ বলে বসে, ‘সামনে পা বাড়ানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না।’

অদৃশ্য লোকটি পুলিশের কেউ হবে― দেখতে না পেলেও সেটাই অনুমান করে আব্দুল মতিন। অদৃশ্য লোকটির শেষ বাক্যগুলোকে নিছক পুলিশী-হুমকি বলে মনে হয় তার এবং হুমকিটিকে পাত্তা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মনে-মনে হিসাব কষার কাজটিও করে ফেলে সে― গ্যাটে মালকড়ি যা আছে, তার একটা ভগ্নাংশ খরচ করলে এসব পুলিশি ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা অসম্ভব না। এমন ভাবনা থেকে পুণরায় সামনে এগুতে যাবে, আব্দুল মতিনে পা দুটো তার সাথে বেঈমানি করে বসে।

আব্দুল মতিন হাঁটতে ব্যর্থ হয়।

কোমড়ের নিচ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শরীরের অংশটি কীভাবে যেন নিশ্চল হয়ে গেছে। বিষয়টা আব্দুল মতিনের ডাক্তারি বিদ্যার সাথে মিলছে না। চলৎশক্তিহীন এমন অবস্থায় যেকোনো মানুষ ধপাস করে পড়ে যেতে বাধ্য; কিন্তু আব্দুল মতিন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তখন একটা ভয় শিরদাঁড়া বেয়ে তার শরীরের উর্দ্ধদিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। মানুষের পাথর হয়ে যাওয়ার গল্প রূপকথায় আছে, তেমন আজগুবি কাণ্ড একবিংশ-শতাব্দিতে এসে তার বেলায় ঘটবে এটা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সাহায্যের জন্য আশে-পাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হয় আব্দুল মতিন। হুমকি দেয়ার পর থেকে অদৃশ্য মানুষটিও চুপচাপ।

আব্দুল মতিন ভাবতে থাকে― অদৃশ্য মানুষটি নিজেকে ডাক্তার মতিন বলেছে। ডাক্তার হোক কি পুলিশ হোক কি আর যাই হোক, এখন এই মহাদূর্যোগে সেই অদৃশ্য মানুষটির শরণাপন্ন না হয়ে তো উপায় নেই। বিনয়ের সুরে সে ডাক দেয়, ‘মতিন ভাই!’

দেয়ালের গায়ে সেই শব্দমালা প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছে ফিরে আসে। তখন আব্দুল মতিনের মনে হল যে এতক্ষণ ধরে সে আসলে নিজের সাথেই কথা বলছে। কিন্তু পাথর হয়ে যাওয়া? সেটাও কি তাহলে স্বপ্নে ঘটছে? মহাবিপদে পড়ে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের জন্য সে এখানে এসেছে। নিঃসন্দেহে জায়গটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, কাজেই এখানে যা ঘটছে তা যে স্বপ্ন না, সেটা নিয়ে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ নেই।

এমন সময় অদৃশ্য কণ্ঠটি বলে ওঠে, ‘কী ভাবছেন?’

আব্দুল মতিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যে অদৃশ্য কণ্ঠটিকে এতক্ষণধরে সে শত্রু ভাবছিল, এবার তাকেই তার বন্ধু বলে মনে হল। অদৃশ্য কণ্ঠের উদ্দেশ্যে সে বলে, ‘আমার নিম্নাংশ পাথর হয়ে গেল কেন?’

‘আপনি নিজে ডাক্তার হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন?’ জবাবে অদৃশ্যকন্ঠ পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে। ’মানুষের শরীর পাথর হয়ে যায় এমন রোগের কথা শুনেছেন কখনও?’

‘না শুনি নি। সেজন্যই তো জানতে চাচ্ছি।’

‘আপনি অনুমাননির্ভন কথা বলছেন।’ বলে অদৃশ্য কন্ঠ। তারপর বেশ খানিকটা সময় নিশ্চুপ থাকার পর তার মন্তব্য পেশ করে। ’আপনার নিম্নাংশ পাথর হয়ে গেছে এটা একটা অনুমান মাত্র। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই ল্যাব-এ পাঠাতে হবে। তারা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে বলবে যে সত্যিই আপনার পা পাথর হয়ে গেছে কি না।’

আব্দুল মতিন একটু বিচলিত হয়ে বললেন, ‘দেখুন। ল্যাব-এ যে কী হয় সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!’

‘ল্যাব-এ কী হয়?’

‘কত কিছুই তো হয়। ধরুন আমরা যদি চাই যে, কারও গল-ব্লাডারে পাথর ধরা পড়ুক, তবে ল্যাব রিপোর্টে সেটাই আসবে।’

‘আর কিছু?’

‘আছে। যেমন ব্রেনে টিউমার, কিডনিতে পাথর…।’

অদৃশ্য কণ্ঠ একটু বিরক্ত হয়ে বলে, ‘মতিন সাহেব! আপনি চুপ করুন! আমার এসব শুনতে ইচ্ছে করছে না।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আব্দুল মতিন জিজ্ঞেস করে, ‘আমার পায়ের কী হবে?’

অদৃশ্য কণ্ঠ জবাব দেয়, ‘আপনি পেছন দিকে হাঁটার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’

শোনামাত্রই আব্দুল মতিন পেছন দিকে তার বাম পা ফেলে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখে যে পেছনে পা ফেলে হাঁটতে পারছে সে। এভাবে দুই কদম হাঁটার পরে কী মনে করে সামনে পা ফেলার চেষ্টা করে আব্দুল মতিন এবং ব্যর্থ হয়। তখন পেছনে পা ফেলতে চেষ্টা করলে সে সফল হয়। ভূতেরা পেছন দিকে হাঁটে― এমনটা সে শুনেছে; সেজন্য মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেলেও হাঁটার আনন্দে সে আত্মহারা হয়ে গেল। অনেকটা সময় এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটি ঘরে গিয়ে ঢোকে সে। জনমানবশূণ্য জাদুঘরে সে একা আর তার সাথে অদৃশ্য এক কণ্ঠ, কাজেই সামনে হাঁটছে না পেছনে তাতে কার কী যায় আসে? অদৃশ্য কণ্ঠের কাছে আব্দুল মতিন জানতে চায় ‘আমার এই রোগের কোনো নাম আছে?’

‘এই রোগের নাম সম্মুখোচল রোগ, ইংরেজিতে বলে ফ্রণ্টওয়াক ডিজঅর্ডার।’ জবাব দেয় অদৃশ্যকন্ঠ।

অনেক বেদনার মধ্যেও আব্দুল মতিনের হাসি পায়। মৃদু হেসে সে বলে, ‘এমন আজব অসুখের নাম জীবনেও শুনিনি।’

‘আপনার জীবন কত দিনের?’

’একাত্তর সালে জন্ম। এই মার্চ মাসে বিয়াল্লিশে পা দিয়েছি।’

‘আপনার বয়সি অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত। হয়তো আপনাদের ল্যাব-এ এসব ধরা পড়ে না।’

‘সেটাই হবে। কিন্তু হঠাৎ করে এই রোগ আমাকে পেয়ে বসলো কেন?’

‘দখুন। হঠাৎ করে কোনো রোগ হয় না, এই রোগও হয় নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। সকল রোগের মতো জন্মের সময় এই রোগের সম্ভাবনাও আপনার জিনের সাথেই যুক্ত ছিল। সময়মতো পরীক্ষা করেন নি, তাই ধরাও পড়ে নি।’

অদৃশ্যকণ্ঠের মানুষটি যে পুলিশ অথবা গোয়েন্দা বিভাগের কেউ না, আব্দুল মতিন এখন নিশ্চিত। তবে তার দাবি মতো তিনি একজন ডাক্তার কি না সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে জিজ্ঞেস করে, ‘এই রোগের কি কোনো চিকিৎসা নেই?’

‘রোগ যখন আছে, চিকিৎসাও আছে।’

‘আপনি বলছেন যে বিশ্বে যত ধরণের রোগ আছে তাদের সকলের চিকিৎসা আছে?’

‘অবশ্যই। রোগের কারণ যেখানে রোগের চিকিৎসাও সেখানে।’

আব্দুল মতিন বেশ অবাকই হয়। চিকিৎসকরা এভাবে কথা বলে না। পরের প্রশ্নে চলে যায় সে, জানতে চায়, ‘আপনি কি দার্শনিক?’

‘আপনার প্রশ্নটি বড়ই অদ্ভুত।’ বলে অদৃশ্য কণ্ঠ। ’দর্শন ছাড়া কোনোকিছুর ব্যবস্থাপত্র দেয়া যায় বলে আমাদের জানা নেই।’

‘তাহলে আমার যে রোগ, যাকে আপনি ফ্রণ্টওয়াকডিজঅর্ডার বলছেন, সেটার কারণ কী বলে আপনার ধারণা?’

‘ধারণার উপর আমরা কথা বলি না বা ব্যবস্থাপত্রও দেই না।’

অদৃশ্য কণ্ঠটি যে বহুবচনে কথা বলছে সেটা আব্দুল মতিনের নজর এড়ায় না। অনেক সময় বড়-বড় ব্যক্তিরা নিজেদের মহত্ত্ব প্রকাশের জন্য এমন করে থাকে, তেমন একটা ভাবনায় বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না সে। তবে অদৃশ্য কণ্ঠটি যে তাকে মাকড়শার জালের মতো আষ্ঠেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলছে সেটা সে ভালোমতই অনুধাবন করতে পারে। উপায়ন্তর না দেখে এবার সে বলেই বসে, ‘পরীক্ষা যা লাগে করুন, তবু এই রোগ থেকে আমাকে উদ্ধার করুন।’

‘মতিন সাহেব। গুনে গুনে বিয়াল্লিশ কদম হেঁটে এই ঘরে আসুন।’

বাধ্য ছেলের মতো আব্দুল মতিন গুনে গুনে বিয়াল্লিশ কদম পেছন দিকে হাঁটে। সেই সময় অদৃশ্যকণ্ঠের আর কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। পেছন দিকে হাঁটার পুরো পথজুড়ে আশা-নিরাশার একটা দোলাচলে দুলেছে সে। নতুন আবিষ্কৃত রোগটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকে আব্দুল মতিন, চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার সময় এমন রোগের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাকে কোনো ধারণাই দেয়া হয় নি। হয়তো এই রোগটি তখন ছিলই না। ডাক্তারি পাশ করার পরে এই রোগের অস্তিত্ব ধরা পড়ে থাকলে তা জানতে বাইরের জগতে যতটা যোগাযোগ রাখা দরকার সেটা সে করে উঠতে পারেন নি। সময় কোথায়?

উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগে চাকুরি পাওয়ার পরে কাছাকছি জেলা শহরে নিজ উদ্যোগে দোকান খুলে বসে সে। অনেক আগের কথা। খ্যাতির সিঁড়িতে পা দিতে তাকে কত খাটতে হয়েছে তার খবর কেউ নেয় নি। এমনও দিন গেছে যখন একজন রোগির জন্য চাতক পাখির মতো বসে থেকেছে, তারপর সেই কাঙ্খিত রোগি এলে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হয়ে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। তারপর কীভাবে জানি নাম-ডাক হতে শুরু করল, আর তার সাথে তাল রেখে আসতে থাকলো কাঁচা টাকার হাতছানি। ল্যাব আর ওষুধ কোম্পানির ছেলেগুলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বারবণিতাদের মতো প্রলোভিত করতে থাকল। তাদের মিষ্টি কথা, তাদের প্রেম-কাতর চাহনি বিবি হাওয়ার প্ররোচনায় আদমের আপেল ভক্ষণের মতো তাকে টেনে নিয়ে গেল টাকা-কড়ির প্রশস্ত রাস্তায়। চাতক পাখির অপেক্ষার দিন শেষ হয়ে গেলে শুরু হল সময়কে জয় করার অভিযান। ঘণ্টা থেকে কমতে কমতে রোগি-প্রতি সময় যখন পাঁচ মিনিটে নেমে এল, তখনও একধরণের অতৃপ্তি তার মনকে বিষন্ন করে রাখতো। ঢাকার প্রাইভেট হাসপাতালে রোগি নেওয়ার ধারণাটা তখনই কীভাবে জানি তার মাথায় চলে আসে।

বছর কয়েক আগে ডাক্তার বন্ধুদের মহাসম্মেলনে দেখা কলেজ-জীবনের বন্ধু ডাক্তার সিজারের সাথে। রোগিদের শরীর কাঁটাছেঁড়া করে ডাক্তার সিজার তখন অনেক নাম কামিয়েছে। অভিজাত এলাকায় লেকের ধারে আলিশান বাড়ি। অনুষ্ঠান শেষে বলা যায় একরকম জোড় করেই আব্দুল মতিনকে তিনি নিয়ে গেলেন তার প্রাসাদে। আলোয় ঝলমল করা প্রাসাদের বিস্তৃত বৈঠকখানার এক কোণায় চামড়া মোড়ানো সোফায় বসে আব্দুল মতিনের সেদিন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। মনের এই ভাবনাটাকে চকিতে ধরে ফেলে ডাক্তার সিজার কানের কাছে মুখ এনে বলেছিলেন, ‘কী অবস্থা তোর! জরাজীর্ণ কুটির আশা করেছিলি?’

‘না, তা হবে কেন?’

‘দ্যাখ,’ বলে নিজের ডান হাত দেখিয়ে ডাক্তার সিজার বলেছিলেন, ‘এই হাত দিয়ে। ঘ্যাচাং।’

‘ঘ্যাচাং! মানে কী?’

‘টাকা বানানোর একমাত্র রাস্তা। তুই যত প্রাসাদ দেখবি, সবার পেছনে একটাই সত্য, আর সেটা হল ঘ্যাচাং।’

‘এমনকি সে যদি সাংবাদিক হয়? শুনেছি তারা একেবারেই গোবেচারা।’

‘সব পেশাতেই গোবেচারাদের আধিক্য। তারমধ্যে যে ঘ্যাচাং মারতে পারে সে-ই উঠে যায় উপরে। যেমন আমি।’

দুই বন্ধুর মাঝে কথাবার্তা চলার কোন এক ফাঁকে ডাক্তার সিজারের বউ চলন্ত ট্রে-তে করে একবাটি বরফ, একবাটি বাদাম, দুটা গ্লাস আর এক বোতল হুইস্কি নিয়ে সেখানে আসে। পরনে আজানুলম্বিত গাঢ় নীল আবায়্যার, সেটার বুক আর হাতজুড়ে জরির কাজ আর তার সাথে মানানসই চমৎকার হিজাবে তাকে খাঁটি আরবদের মতো লাগছিল। সেদিকে তাকিয়ে আব্দুল মতিন আরও বেশী করে সঙ্কুচিত হয়ে যায়। আরবদের মতো লাগলেও ভদ্রমহিলা চমৎকার বাংলায় বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম মতিন ভাই। ভাবীকে ছাড়াই এসেছেন? কাজটা ভালো করেন নি।’

আব্দুল মতিন ঢোক গিলে কোনোরকমে বললেন, ‘উনি ঢাকা শহরে আসতে চান না।’

ভদ্রমহিলা আব্দুল মতিনের কথা ঠিকমতো শুনলেন বলে মনে হল না, গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘রাতে আমাদের সাথে ডিনার করে তারপর যাবেন। আটলাণ্টিক শ্যামন বেক করতে দিয়েছি। ফিসে আপনার এলার্জি নেই তো?’

‘ঢাকায় শ্যামন ফিস পাওয়া যায়?’ বিস্ময়ে আব্দুল মতিনের কপালে চোখ উঠে গিয়েছিল।

আব্দুল মতিনকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে সিজারের বউ তার নাকে মৃদু টোকা দিয়ে বললেন, ‘আপনি এখনও চাইল্ডই রয়ে গেলেন।’ তারপর দুই বন্ধুর হাতে হুইস্কির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। যাবার বেলায় পারফিউমের মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, অচেনা সেই গন্ধ আব্দুল মতিনের নাসিকা দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে তাকে আবেশিত করে ফেলে। ডাক্তার সিজার বললেন, ‘শ্যানেল ফাইভ!’

‘সেটা কী?’ বোকার মতো প্রশ্ন করে আব্দুল মতিন।

‘যে গন্ধে তুই এখন মাতোয়ারা,’ তারপর নিজের হাতের হুইস্কির গ্লাস দিয়ে আব্দুল মতিনের হুইস্কির গ্লাসে টোকা দিয়ে বললেন, ‘চিয়ার্স ফর দ্যা টাইগারস।’

‘আমি এখনও বাংলাদেশের খেলায় তেমন জোশ পাই না দোস্ত। তারা ফিনিশিংটা করতে পারছে না।’

‘আমিও পাই না। বাট ডু ইউ হ্যাভ অ্যা চয়েজ? পাকিস্তান ইজ ডেড, অ্যাই ক্যাণ্ট হ্যাং অন উইথ অ্যা ডেড ফর লং। আই উইল শো ইউ হাউ টু ফিনিশ।’

বাদাম আর বরফকুচির মিশেলে কয়েক গ্লাস তরল শেষ হয়ে গেলে ডাক্তার সিজারের বউ এসে সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘একটার বেশী কিন্তু পাবেন না।’

আব্দুল মতিনের মাথা ধরে এসেছিল, ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি খাবেন না?’

ডাক্তার সিজারই উত্তর দিলেন, ‘তোর ভাবী আর খায় না। হজ করার পরে এই একটা উন্নতি হয়েছে।’

ভদ্রমহিলা মনে হয় রাগ করলেন। বললেন, ‘কেন? ক্লাবে যাওয়াও তো বন্ধ করে দিয়েছি। ছেলেটা বড় হচ্ছে, আপনার বন্ধুর তো সেদিকে খেয়াল নেই।’

‘তোর ভাবী এখনও মিডলক্লাসই থেকে গেল,’ বলে গ্লাসের বাকীটা শেষ করে ফেলল সিজার।

গলাধঃকরণের প্রান্তসীমা দেখিয়ে দিয়ে সিজারের বউ চলে গিয়েছিলেন ডিনার সাজাতে। এই ফাঁকে ডাক্তার সিজার আব্দুল মতিনের কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘ডিনারের পরে এক জায়গায় নিয়ে যাবো। লেবানন থেকে ব্যালে-নর্তকী এসেছে। প্রাইভেট অ্যাণ্ড টপ সিক্রেট। একেবারে তোর কোলের কাছে এসে নাচবে। এমন চকচকে তলপেট জীবনেও দেখিস নি।’

সিজারের কথায় আব্দুল মতিন চোখের মণি চক-চক করে উঠল। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গ্লাসে কোনো তরল না থাকাতে অসহায়ের মতো বরফকুচির দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে বরফের একটা টুকরা তুলে মুখে পুরে দিলেন।

এমন সময় সিজারের বউ এসে খবর দিল ডিনার প্রস্তুত।

ডিনারের পরে সিজার যে বাসায় নিয়ে গেল সেটাকে প্রাসাদোত্তম বলাই ভালো। রাতের বিজলী-বাতির আলোয় গাছ, ঘাস অথবা ফুলের রঙ তেমন করে বোঝা না গেলেও ভবনটিকে দেখাচ্ছিল শ্বেতশুভ্র। কৃত্রিম জোছনার একটা আলো ভবনটিকে আলোকিত করে রেখেছে, পোর্টকিওতে গাড়ি থেকে নেমে ভবনটিতে প্রবেশ করে পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে তারা দুই বন্ধু দোতলায় বড় একটা কক্ষে প্রবেশ করে। হালকা অন্ধকারে কয়েকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। তাতে উপস্থিত অতিথিদের ভালো করে চেনা যায় না। মেঝের উপর নরম গালিচার মতো আসন পাতা, সেখানে জনাদশেক লোক আগেই এসে বসে আছে। চোখের উপর অন্ধকারের প্রলেপ সহ্য হয়ে গেলে সেই আলো-আঁধারিতে আব্দুল মতিন তার ডানপাশে বসা অতিথিদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। একাত্তরে অগ্নিঝরা মার্চে যাদের হাত দিয়ে জাতীয় পতাকা তরতর করে উপরের দিকে উঠে গিয়েছিল তাদের একজন সেখানে। আব্দুল মতিনের বিস্ময় যেন শেষ হয় না।  বহুদিন ধরে কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব বিক্রি করা বহুল প্রচারিত দৈনিক শপথের সম্পাদক সাহেবকেও সেখানে দেখতে পায় সে। মোটা করে গোঁফ রাখেন সরকারের একমন্ত্রীকে যেমন দেখা গেল, তেমনি সরকারের পিণ্ডি উদ্ধার করে বিরোধীদের এক বড় নেতাকেও দেখা গেল সেখানে।

ভালো করে মানুষগুলোকে চিনে নেবার আগেই ঘরের মাঝ বরাবর তীব্র আলোর একটা বিম্ব ছাদের উপর থেকে বৃত্তাকারে মেঝের উপর নেমে এল। সেই আলোতে জমকালো পোশাকে অনন্যা সুন্দরী এক রমণী এসে ঘোষণা দিলেন, ‘জেণ্টলম্যান! লেট মি ইণ্ট্রুডিউস মায়া নাসরি ফ্রম দ্যা লেবানন।’

ভদ্রমহিলা চলে গেলে সেই আলোর বিম্বের মাঝে এসে দাঁড়ায় মায়া নাসরি। স্বল্প বসনে তার দেহ মোম দিয়ে গড়া মূর্তির মতো দেখায়। তার দেহবল্লভ থেকে সোনালী রঙ বিচ্ছুরিত হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে, হালকা পরশের পারফিউমের একটা গন্ধ বাতাসে মিশে সবার নাশিকায় প্রবেশ করছে। পাথরের সেই মূর্তিটিকে নাড়িয়ে দিতেই বোধহয় মৃদুলয়ে আরবিয় সঙ্গীত বেজে ওঠল। সঙ্গীতের তালের সাথে তাল রেখে ধীরে ধীরে হাত দুটাকে দুপাশে প্রসারিত করে শরীরের ভর ডান পায়ের আঙুলের উপর রেখে পুরো শরীরকে সাপের মতো করে বাঁকিয়ে ফেলল মায়া নাসরি। কয়েক পলক পরে ব্যালে সঙ্গীত বেজে উঠলে সেই সঙ্গীতের সাথে তাল রেখে পুরো শরীরকে দুলিয়ে দুলিয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগলো সে। নাচতে নাচতে একবার সে আব্দুল মতিনের কাছে চলে আসে। আব্দুল মতিনের মনে হল মোমের মূর্তিটি যেকোনো সময় গলে গিয়ে তার কোলের উপর আছড়ে পড়বে। তার ইচ্ছে করছিল আরব সুন্দরীকে কোলে বসিয়ে রাঙা ঠোটে আলতো করে চুমু দিতে, কিন্তু সাহসে কুলায় না। হঠাৎ সে দেখল, পাশে বসা বন্ধু সিজার উঠে গিয়ে আরব সুন্দরীর সাথে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। তাল ও ছন্দে কোনো মিল না থাকলেও এক অপূর্ব সুন্দরীর সাথে নাচার যে সাহস তার বন্ধু দেখাতে পেরেছে সেটা দেখে সে অবাক হয়ে গেল।

একসময় নাচ শেষ হল।

ফেরার পথে আব্দুল মতিন ডাক্তার সিজারের হাত ধরে বলল, ‘আমাকে তুই ঘ্যাচাং শিখাবি?’

‘ঘ্যাচাং কাউকে শেখানো যায় না।’ বলে সিজার। ’মায়াকে কেমন লাগল সেটা বল। ইচ্ছে করছিল?’

বন্ধুর কাছে মনের কথা গোপন করল না আব্দুল মতিন। বলল, ‘ইচ্ছে করলেই কী আর না করলেই কী?’

‘ধর রাতে মায়া যদি তোর কাছে চলে আসে সামলাতে পারবি?’

‘বন্ধু, লোভ দেখাস না। আর যা হবে না তার কথা আমি ভাবিও না।’

‘মায়ারা কিন্তু তৈরীই থাকে। দরকার শুধু সাহস।’

হঠাৎ করেই আব্দুল মতিনের মনে হল যে, বন্ধু সিজার তাকে ঘ্যাচাং শিখিয়ে ফেলেছে। দরকার শুধু সাহস। মায়াকে কাছে পাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে না পারলেও নিজ বাড়িতে ফিরে আসার কয়েক মাস পরে একদিন সিজারকে ফোন করল আব্দুল মতিন, ‘বন্ধু একটা অপারেশন করতে হবে।’

‘কিসের অপারেশন?’

‘রিপোর্ট রেডি। লিভার সিরোসিস।’

‘পুরো লিভার ফেলে দিতে হবে?’

‘কিছুই ফেলতে হবেনা। শুধু চামড়ায় একটা দাগ থাকলেই…।’

ফোনের ওপাশ থেকে লাফ দিয়ে উঠে সিজার। বলে, ‘তুই ঘ্যাচাং শিখে ফেলেছিস দোস্ত!’

কোত্থেকে স্যাঁত-স্যাঁতে একটা গন্ধ ভেসে আসছে আর তার সাথে ঝিঁঝিপোকার ডাক। বিলের জলে কাঁচা পাট ভিজিয়ে রাখলে তার চারপাশ জুড়ে যেমন এক গন্ধ ও শব্দের দ্যোতনা তৈরী হয়, অনেকটা তেমন আবহ। কী হল কে জানে, অতীত ভাবনার সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিয়াল্লিশ কদম হাঁটার পরে আব্দুল মতিন প্রায়ান্ধকার একটা ঘরের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করল। ঢাকা শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে এমন গ্রামীন পরিবেশ থাকতে পারে, এটা আব্দুল মতিন বিশ্বাস হল না। অনেক পুরানো হারিয়ে যাওয়া কোনো স্মৃতি দৃশ্যপটে আসি-আসি করেও আসছে না। হঠাৎ করে সাইকেলের বেলের টুং-টাং শব্দও শোনা গেল। ঢাকা শহরে এখনও সাইকেল চলে? এমন সময় অদৃশ্য কণ্ঠটি বলে ওঠ, ‘মতিন! ল্যাব টেস্টের ফলাফল আমরা পেয়ে গিয়েছি।’

‘কখন টেস্ট হল? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘তোমার স্মৃতি স্ক্যান করা হয়েছে। তোমার মনের পর্দায় যা ভাসছিল তার সবকিছু আমরা ধারণ করতে সক্ষম হয়েছি।’

আব্দুল মতিনের ফর্সা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। স্ক্যানিং এর পর থেকে অদৃশ্য কণ্ঠটি তাকে তুমি করে সম্বোধন করছে, এটাতে মনে-মনে অপমানিত বোধ করল সে। বলল, ‘আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আমি একজন ডাক্তার। সমাজে আমার একটা মান সম্মান আছে!’

‘তুই তো শয়তানকে হার মানিয়েছিস আব্দুল মতিন!’

কী বলছে এসব! ভাবে আব্দুল মতিন। ছাত্রজীবনে ট্রেনের মধ্যে এক পকেটমারকে মারার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে হঠাৎ করেই। চারপাশ থেকে বৃষ্টির মতো গালি আর প্রবল বর্ষণের মতো চড়-থাপ্পড়ে সেদিন তাকে যেমন অসহায় লাগছিল, তেমনি একটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠে আব্দুল মতিনের চেহারায়। প্রতিরোধের যে চেষ্টা একটু আগে করেছে, সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তার পরিবর্তে সেই পকেটমারের মতো হাত জোড় করে আব্দুল মতিন বলে, ‘স্মৃতি-স্ক্যান নামে কোনো টেস্ট আছে বলে শুনি নি। আপনি আমায় ধোঁকার মধ্যে ফেলে কথা বের করার চেষ্টা করছেন। কোনো লাভ হবে না।’

‘মায়া নাসরিকে নিয়ে তোর মনের যে গোপন ভাবনা, সেটা আমরা জেনে গিয়েছি।’

‘যদি জেনেই থাকেন তবে প্রকাশ করুন।’

‘তুই তাকে একান্ত আপন করে কাছে পেতে চেয়েছিলি!’

আব্দুল মতিন এবার সত্যি-সত্যি ঘাবড়ে গেল। অদৃশ্য কণ্ঠটি যে পুলিশ, গোয়েন্দা অথবা ডাক্তারের না বরং সেটা যে পীর-ফকির জাতীয় কারও হবে সে সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল সে। ফলে ভয়টাও সেখানেই দাঁনা বাঁধলো। চেনা মানুষদের অর্থ অথবা নারীর মতো পার্থিব কোনো কিছু দিয়ে সন্তুষ্টু করা যায়, কিন্তু পীর-ফকিরদের সন্তুষ্টু করার জন্য কী উপঢৌকন দিতে হয় সেটা তার জানা নেই। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো তাই সে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি আসলে চান কী?’

‘আমাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।’

‘আমাকে তাহলে কী করতে হবে?’ আব্দুল মতিনের কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঝরে পড়ে।

‘তুই এই ঘরে প্রবেশ কর।’ বলে অদৃশ্যকন্ঠ। ’এখানে অনেকগুলো চশমা আছে। তার মধ্যে মাত্র একটি চশমা তোর মাপে বানানো। সেটা চোখে দিয়ে এখান থেকে চলে যা।’

‘চশমা!’

‘হ্যাঁ চশমা। ওই চশমা যতক্ষণ পরে থাকবি, ততক্ষণ তুই মানুষ থাকবি।’

বিলের জলের উপর দিয়ে একটা ডাহুক পাখির উড়ে যাওয়ার মতো একটা শব্দ ভেসে আসে। আব্দুল মতিনের মনে হল অদৃশ্য কণ্ঠটি আড়াল থেকে দূরে কোথাও চলে গেল। অদৃশ্য হলেও এতক্ষণ ধরে তার সাথে কথা বলতে বলতে কেমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। হারিয়ে যাওয়ার বেদনায় মনের অনেক গভীরে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করে সে।

শরীরটাকে বামে ঘুরিয়ে দুই কদম পিছনে হাঁটতেই কথিত ঘরটিতে প্রবেশ করে আব্দুল মতিন। আলো-আঁধারিতে খেলা করা ঘরটিতে অনেকগুলো নরকঙ্কাল, শূণ্যতায় ভর করে তারা ভাসছে। বেশ খানিকটা দূরে সাদাচাদরে মোড়া টেবিলের উপরে করোটি রাখা। কাছে এগিয়ে যেতে আব্দুল মতিন দেখতে পেল করোটিগুলোর সামনে ঘড়ি, চশমা, জুতার মতো অতি সাধারণ জিনিষ। আর কাগজে কিছু মানুষের নাম। একটা টেবিলে ‘ডাক্তার আব্দুল মতিন’ লেখা একটা কাগজ দেখে আব্দুল মতিন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। এর আগে অদৃশ্য কণ্ঠটি নিজের পরিচয় ‘ডাক্তার আব্দুল মতিন’ বলেছিল, এখন এক করোটির সামনে ‘ডাক্তার আব্দুল মতিন’ লেখা দেখে আব্দুল মতিনের মনে হল যে, অদৃশ্য কণ্ঠ, করোটি এবং তার নিজের মধ্যে কোথাও একটা মিল আছে।

এমন সময় করোটির পাশে রাখা কালো ফ্রেমের একটা চশমার দিকে নজর গেল তার।  কাঁপা হাতে সেই চশমাটি নিয়ে চোখে দিতেই চারপাশের দৃশ্যপট নিমিষেই বদলে গেল। মনুষ্য কঙ্কাল, করোটির জায়গায় পুষ্প-শোভিত গাছ এবং তাদের শাখায় শুভ্র একঝাঁক শঙ্খচিল দেখতে পেল সে। বিলের জলে পচে যাওয়া পাটের গন্ধ দূর হয়ে সেখানে শরতের সকালে বাতাসে মিশে থাকা শিউলি ফুলের গন্ধ তার নাকে এসে ঢোকে। অপূর্ব সেই দৃশ্য ও সুগন্ধের প্রতিক্রিয়ায় আব্দুল মতিনের মনে হল যে এটি এক অবাস্তব কল্পনা অথবা স্বপ্নে দেখা কোনো দৃশ্য। ভাবনার সপক্ষে যুক্তি হাজির করতে তখন তার মনে হল যে সন্মুখোচল বা ফ্রণ্টওয়াকডিজঅর্ডার নামক এক রোগে আক্রান্ত হয়ে সে এখানে এসেছেন এবং সেকারণে সামনের দিকে পা ফেলে হাঁটতে পারেনি। সাহস করে এবার ডান পাকে সামনে ফেলার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো যে সামনে চলার যে রোগে সে আক্রান্ত হয়েছিল তা বিদায় হয়েছে। মহানান্দের একটা রেশ তার চোখে মুখে। তাকে সাথে করেই সে বের হয়ে আসে।

সিএনজি চালক আব্দুল মতিনের দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকায়, ‘স্যার একখান কথা জিগামু?’

‘বলেন।’

‘হেই কামে এতক্ষণ লাগে? আপনে কই গেছিলেন কন ত?’

আব্দুল মতিন চেপে যেতে চায়; কিন্তু তার মনে হল যে, সত্য গোপন করতে যে শক্তি লাগে সেই শক্তি কোথায় যেন লোপ পেয়েছে। সে বলে, ‘আমি সামনের দিকে হাঁটতে পারছিলাম না। সেটার চিকিৎসা হতে একটু সময় লেগে গেল। আপনার কি অনেক কষ্ট হয়েছে?’

আব্দুল মতিনের কথায় সিএনজি চালক অবাক হয়।  হবারই কথা। ভদ্রলোক টয়লেটের কথা বলে ভেতরে গিয়েছিল আর ফিরে এসে কি না বলছে যে সামনে হাঁটতে পারছিল না, সেজন্য দেরি হয়েছে। ইদানিং ভদ্রলোকেরা বানিয়ে বানিয়ে এত কথা বলে! আবার তাকে আপনি বলে সম্বোধন করা শুরু করেছে, এটাও তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। কথা না বাড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘স্টেডিয়ামে অহনও যামু? খেলা কি বইসা রইছে?’

সেদিন ঢাকায় ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা। ঢাকায় আসার কারণে মাঠে গিয়ে সেই খেলা দেখার পরিকল্পনা ছিল আব্দুল মতিনের। পাকিস্তান ক্রিকেট বলে কথা! এই দলটির হাত দিয়ে মুসলমানেরা প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল, সেই গর্ব ও উত্তেজনা আজও তাকে জাগিয়ে রাখে। আব্দুল মতিন কেবল যে দলটির ভক্ত তা না, সেই ওই দেশটিরও ভক্ত। মুসলমান বল কথা! সেই মুসলমানের দেশ যখন ক্রিকেট খেলায় ভারতকে হারায় তখন আব্দুল মতিনের কী যে ভালো লাগে! আনন্দের আতিশয্যে তখন কয়েকটা গরু জবাই করে শহরের সমস্ত মানুষকে নেমন্তন করে খাওয়াতে ইচ্ছে করে তার। সামর্থে কুলালে সেটা সে অবশ্যই করত। সেই দল ঢাকার মাঠে খেলছে তাও আবার চিরশত্রু ভারতের বিরুদ্ধে, সেটা না দেখে থাকা যায়?

তো জাদুঘর থেকে বের হওয়ার পরে সবকিছু উলোট-পালট হয়ে যায়। খেলা দেখার বিষয়টি আব্দুল মতিনের মাথা থেকে একদম হারিয়ে যায়। সিএনজি চালক মনে করিয়ে না দিলে হয়তো অন্য গন্তব্যে চলে যেত সে। ঘড়ির দিকে তাকায় সে। প্রথমার্ধের অর্ধেক খেলা হয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে যে সময় লাগবে তাতে দ্বিতীয়ার্ধের খেলা নিশ্চিতভাবে দেখা যাবে। আব্দুল মতিনের সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। তার মন ভাবছে রোগিদের কথা। গতকাল যে পাঁচজনকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে, তাদের অপারেশন হবে আজ সন্ধ্যায়। অপারেশনের পুরো বিষয়টি এমনভাবে সাজানো যে রোগিদের পক্ষে অপারেশনে রাজি না হয়ে কোনো উপায় ছিল না। এই অপারেশনে কেবল চামড়ার উপরে সেলাইয়ের একটা দাগ থাকবে, যা দেখে রোগিরা আত্মপ্রসাদে ভুগবে।

আব্দুল মতিন সিএনজি-চালককে হাসপাতালের ঠিকানা জানিয়ে দিয়ে বলে, ‘ধানমণ্ডি চলুন।’

সিএনজি পথ ঘুরে ধানমণ্ডির দিকে এগিয়ে চলে। সেখানে পাঁচজন রোগি অপারেশনের প্রতীক্ষায় বসে আছে। অপারেশনটি থামাতে হবে। আব্দুল মতিন হাত ঘড়ির দিকে তাকায়, হাতে যা সময় আছে তাতে সময়ের আগেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব। হঠাৎ সিএনজির দরজার গ্রিল গলিয়ে বাইরের আকাশের দিকে দৃষ্টি যায় তার, সেখানে নিল আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো সাদা সাদা মেঘের নিচে একঝাঁক শঙ্খচিল উড়ে চলেছে। আব্দুল মতিনের মনে হলো, তারা তাকে অনুসরণ করছে।