লোকটা বার কয়েক নাক কুঁচকে গন্ধ নেবার চেষ্টা করল। কোথা থেকে যেন একটা
আবছায়া গন্ধ এলো ভেসে। একবার মনে হলো তার নাকের ভুল, গন্ধবিভ্রম। এ রকম
অস্পষ্টতায় তার বিরক্তি বাড়ল। সে কয়েকবার বাড়িটার এ প্রান্ত ও প্রান্ত হাঁটল,
জোরে শ্বাস টানল। নিশ্চিত হলো না। নাকি বাইরে থেকে গন্ধ বহন করে এনেছে সে।
বাড়িতে তার তেলাপোকা আছে সে জানে। কোথাও কি তেলা পোকা মরে পড়ে আছে?
শোবার ঘরে তার বিছানার মাথার দিকের জানালা দিলো খুলে। জানালার কালো পর্দা আধো
দুলে উঠল মেঘ পূর্ববর্তী বাতাসে। বাইরের ঘন গাছপালার মার্চপাস্ট। বাতাসে গাছের
পাতা দোলে। পাতা দোলার এই দৃশ্য তার প্রিয়। বাতাসের কাজই হলো গাছের পাতার সাথে
লীলা। বাতাস বইবে, পাতা দুলবে।
বাতাসের প্রাবল্যে তবু গন্ধটা গেল না। মনে হলো ঘরে সেফটিপিনে গন্ধটা কেউ গেঁথে
রেখেছে। গন্ধটা কিসের? তেলাপোকার?
সে গুগল করল। খুব অবাক হলো জেনে যে তেলাপোকার মৃতদেহ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায় না।
আরো একটা তথ্য জেনে অবাক হলো যে তেলাপোকার মাথা কেটে ফেললেও কয়েকদিন
বাঁচে।
তাহলে?
নিজের প্রিয় সোফায় বসে। একটা অবসাদ, নি:সঙ্গতা, একাকীত্ব, মুক্তির পূরবী তার
ভেতরে খেলে যায়। জানালার পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটার স্ত্রী প্রথম এই
বাসায় এসে অবাক হয়ে গিয়েছিল যে কোন বাসায় কালো পর্দা থাকতে পারে! ভয় পাচ্ছিল।
লোকটা ব্যাখ্যা করছিল যে প্রাইভেসি। শুধু দুজনের টোনাটুনি সংসার।
সে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। ফ্রিজ খুলে দেখল খাবার কী কী আছে! ফ্রিজ খোলার আগে
মনে হচ্ছিল খিদে আছে। ফ্রিজ খুলে রাশি রাশি খাবার দেখে আর খেতে ইচ্ছা করল না।
এক গেলাশ পানি পান করল। বিনা কারণে বাথরুমে গেল। ঝকঝকে তকতকে বাথরুম।
স্ত্রীর অস্তিত্ব টের পেলো।
বাইরে বাতাসের জোয়ার বাড়ছে পর্দার দুলুনি বেড়েছে। রাধারমণের গান শুনতে ইচ্ছা
করল; সে কাউকে এই জীবনে নিরলে পেলো না। ফুলের আসন ফুলের বসন ফুলের বিছানায়
সে। তাকে হৃৎকমলের শুয়া চন্দন ছিটিয়ে দেয়া হলো না। দুই হাতে ঐ চাঁদমুখানি তুলে ধরা
হলো না।
ফোনটা ভাইব্রেট করছে। তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করল না কে ফোন করেছে। বাইরে বৃষ্টির
ঢল নেমেছে। কালো পর্দা সরিয়ে অনেক ক্ষণ বৃষ্টি দেখল। গাছের সবুজ পাতায় বৃষ্টির
লাবণ্য নেমেছে। পাতাগুলো চিকচিক করছে। আকাশের দিকে তাকালে বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে
না। জমিনের বৃষ্টির ফোটা ফোটা দাপুটে আহ্লাদ। সে কালো পর্দাগুলো খুলে ফেলল
জানালা থেকে।
বৃষ্টির কোমল চাবুক লাগল মুখের চামড়ায়। ভাইবে লোকটা বলে; মনের এই বাসনা, ও
সঙ্গিনী তোমার পিরীতে আমাকে নিরাশ করো না।
গলার কাছে কান্নাটা আটকে আছে যেন। নাকে আর গন্ধটা লাগছে না। সে তার সমস্ত
পোশাক খুলে মেঝেতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। যেন মাতৃগর্ভে সে শিশু, ভ্রুণ।
তার স্ত্রী আজ সকালে মারা গেছে।