চলচ্চিত্র সংস্কৃতি ও আমাদের প্রত্যাশা
প্রসুন রহমান
শিল্পের সবগুলো শাখা যেখানে এসে মিলিত হয় সেটি চলচ্চিত্র। দেশ, জাতি, ভাষা, শিক্ষা, মেধা ও বয়স নির্বিশেষে পৃথিবীর যে কোনে প্রান্তের যে কোনো মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম এই চলচ্চিত্র। তাই মাধ্যম হিসেবে যেমন এটি জনপ্রিয়তম, তেমনি জনপ্রিয়তম বলেই সবচেয়ে শক্তিশালী। একটি জাতির তথা একটি জনগোষ্ঠীর জীবনাচার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, মুল্যবোধ ও চলমান ঘটনাপ্রবাহের নৃতাত্ত্বিক দলিল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রাখে একেকটি চলচ্চিত্র। তাই এটি চর্চার জন্যে যেমন মেধাবী মানুষের প্রয়োজন পড়ে, তেমনি প্রয়োজন পড়ে নির্দিষ্ট বেশ কিছু বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের। একই সাথে প্রয়োজন পড়ে নির্মাতার পরিণত জীবনবোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা, সাংস্কৃতিক রুচি এবং সামাজিক সংবেদনশীলতার। যেহেতু একটি চলচ্চিত্র দেশব্যাপী সকল শ্রেনী-পেশার মানুষের কাছে এবং কখনো কখনো আর্ন্তজাতিক অঙ্গনেও পৌছে যায়, তাই দিনশেষে এটিকে কেবলমাত্র বিনোদনের একটি মাধ্যম ভাবা খুব যৌক্তিক হয়না। একটি চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে একটি জাতির সাংস্কৃতিক বোধের পরিচায়ক, রুচি ও মননের মান নির্ধারক। অথচ মূলধারায় এই চিন্তার জায়গাটি সবসময় উপেক্ষিত রয়ে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে চিন্তাহীন বিনোদন নির্ভর চলচ্চিত্রের যাত্রা ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে।
এদিকে চলচ্চিত্রের মান এবং অবকাঠামোর অবস্থান যেমন নিম্নগামী হয়েছে, আরেকদিকে তেমনি বেড়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অনিয়মের বেড়াজাল। প্রায় প্রযোজক বিহিীন একটি ইন্ডাষ্ট্রীতেও দিনশেষে কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে এবং সেসব চলচ্চিত্রকে সেন্সর পেতে সবাইকেই যেমন বিভিন্ন সমিতির সদস্য হতে হচ্ছে, তেমনি সম্পূর্ণ বাইরে থেকে নির্মিত একজন স্বাধীন নির্মাতাকেও এফডিসি থেকে নির্ধারিত ফি দিয়ে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। সাথে সমিতিগুলোর সার্টিফিকেটও জমা দিতে হচ্ছে। নো অবজেকশন সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্যেও দিতে হচ্ছে, সেন্সর পাওয়ার জন্যেও দিতে হচ্ছে। আধুনিকায়ন ও অগ্রগতির ন্যূনতম কার্যকর কোনো উদ্যোগের দেখা নেই। কিন্তু জটিলতা বাড়ানোর উদ্যোগ আছে। আর সবকিছুকে ছাপিয়ে সবসময় গুরুত্ব পাচ্ছে নানা সমিতির নির্বাচন।
এসবের বাইরে, এমনিতেই অদ্ভূত বৈপরীত্য নিয়ে কোনোরকমে বেঁচেবর্তে আছে ‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রী’ নামের এই চলচ্চিত্র শিল্প। বৈপরিত্যের ব্যাপারগুলোও খুবই দৃশ্যমান এবং সত্যিই অদ্ভুত। কিন্তু কাওকেই এ বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়না।
চলচ্চিত্রকে ঘোষনা করা হয়েছে- ‘শিল্প’ (ইন্ডাষ্ট্রী অর্থে), অথচ আছে এটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে, আর আদতে এটি সংস্কৃতি। আর প্রধান ৩ টি চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টদের সংগঠন/সমিতির দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রযোজক সমিতি আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে, পরিচালক সমিতি আছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর শিল্পী সমিতি আছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে।
তো এই নগরীর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সময় যেমন ওয়াসা, ডেসা কিংবা রাজউকের মাঝে সমন্বয়হীনতার অভাব দেখা যায়, তেমনি সংগঠনগুলোরও হয় একই অবস্থা। কিন্তু প্রত্যাশার পারদ তো উর্ধ্বগামী। প্রতিবার পরিচালক সমিতির নির্বাচনের আগে নানা পদের প্রার্থীরা যখন ভোটের জন্যে ফোন করেন, তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, পাশ করে কী করবেন? তবে করা হয়না। কিন্তু কাজ করবার সুযোগ রয়েছে বলেই, প্রত্যাশাও থাকে। প্রযোজক সমিতি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত ও অকার্যকর অবস্থায় আছে। কিন্তু এটি কার্যকর অবস্থায় থাকলে, পরিচালক সমিতি ও শিল্পী সমিতিসহ ৩টি সংগঠন একসাথে হয়ে কাজ করতে পারলে পুরো ইন্ডাষ্ট্রীর চেহারা পাল্টে দেয়াও সম্ভব বলে মনে করি।
প্রেক্ষাগৃহ আধুনিকায়ন ও নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে গতবছর মার্চে ১০০০ কোটি টাকা সহজ শর্তে ঋণ বরাদ্দ হলেও কেউ সেটি নেয়নি। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার করে দেশব্যাপী অন্তত ১০০টি সিনেপ্লেক্স স্থাপন, সেন্ট্রাল সার্ভারের মাধ্যমে ডিজিটালি ডিস্ট্রিবিউশন চালু, বক্স-অফিস স্থাপন এবং ই-টিকেটের মাধ্যমে প্রযোজকের লভ্যাংশ ফেরৎ পাওয়া নিশ্চিতকরনসহ, দক্ষ কলাকুশলী তৈরীর জন্যে বছরব্যাপী কর্মশালার আয়োজন ও প্রশিক্ষণ, চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা ও নির্বাচিত সেরা চিত্রনাট্য থেকে চলচ্চিত্র প্রযোজনা, নিজস্ব ওটিটি প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠাসহ জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে। সমিতিগুলোও তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে সব সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে বাৎসরিক ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড এর আয়োজন করতে পারে।
এ সবি হয়তো সাধারণ মানের প্রস্তাবনা। কিন্তু মেধাবী ও যোগ্য নেতৃত্ব সম্মিলিতভাবে কাজ করলে নিশ্চয়ই আরো অর্থপূর্ণ কাজ করতে সমর্থ হবেন বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন- সিনেমা প্রদর্শনের জায়গা তথা, আধুনিক সিনেপ্লেক্স প্রস্তুত করা, সাথে ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন, ই-টিকেটিং এবং বক্সঅফিস। প্রযোজক তার লগ্নী ফেরত না পেলে এ জায়গার ভবিষ্যত শূন্য। প্রেক্ষাগৃহ একজনের কিন্তু প্রজেক্টর আরেকজনের, এ অবস্থা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। অগ্রীম টাকায় প্রজেক্টর ভাড়া নিয়ে অপ্রদর্শনযোগ্য প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা রিলিজ দেয়া এবং কোনো অর্থ প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করাই হচ্ছে এখনকার প্রদর্শন ব্যবস্থার মূল চেহারা।
উপসংহারে পুরনো কথাটাই আরেকবার উচ্চারণ করি, সমাজ যদি শরীর হয়, সংস্কৃতি তার মুখাবয়ব। একটি জাতির সংস্কৃতির চেহারা এবং মানটুকু দেখলেই সে সমাজের শরীরের অবস্থাটা বোঝা যায়। সেখানে শিক্ষা, রুচি এবং মূল্যবোধের মূল্য প্রকাশক সৃজনশীল কাজের যেমন ছায়া পড়ে, তেমনি অশিক্ষা, বিদ্বেষ এবং ব্যর্থতারও ছায়া পড়ে। পাশাপাশি সরকারের কাছেও প্রত্যাশা থাকবে, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণকামীতার লাগামটা যেমন একটু সীমিত রাখবেন, তেমনি সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নে আমাদের সাম্বাৎসরিক বাজেটে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দটাও নিশ্চয়ই একটু বাড়াতে সচেষ্ট হবেন।
সারা পৃথিবী জুড়েই আধুনিক প্রযুক্তির প্রবাহে নানারকম বিকল্প ও জনপ্রিয় প্লাটফর্মের এই কালে একটি মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নিমেষেই জাতীয় থেকে আর্ন্তজাতিক হয়ে ওঠার শক্তি রাখে। শক্তি রাখে সারাবিশ্বে দেশকে ইতিবাচক ভাবে তুলে ধরার। সরকারী-বেসরকারী উভয়ক্ষেত্র থেকেই এই মাধ্যমটির প্রতি আরেকটু মনোযোগ আর যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের পৌছে দিতে পারে অনন্য উচ্চতায়।
পূর্ব-পশ্চিমের কথা বাদ, উপমাহাদেশের চলচ্চিত্রও হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছে অনেক দূর। আর আমাদের ইন্ডাষ্ট্রী প্রতিষ্টার ৬৫ বছরের মাথায় এসে দেখা যায় আছে কেবল নানান সমিতি আর নির্বাচনের ঢামাডোল। আমাদেরও সামনের দিকে মুখ রেখে চলতে হবে। দিন শেষে মানুষ তার কাজের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকে। কে কোন চেয়ারে বসেছিল সে পরিচয়ে নয়। বাংলাদেশের ইন্ডাষ্ট্রী তার হারানো গৌরব ফিরে পাক প্রযুক্তি’র হাত ধরে। প্রযুক্তিকে আপন করে নিয়ে এর যথাযথ ব্যবহার করতে না পারলে আরো পিছিয়ে পড়তে হবে। শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমটির সাথে জড়িত সকলের দূরদর্শী চিন্তা, সৃজনশীল ভূমিকা এবং শিল্পিত আচরণই কেবল সে সম্মান ও গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে পারে।
সকলের জন্যে শুভকামনা।
প্রসুন রহমান
লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা