You are currently viewing চক্রান্তের শিকার মুক্তিযুদ্ধ এবং পদদলিত বিজয় || আলী সিদ্দিকী

চক্রান্তের শিকার মুক্তিযুদ্ধ এবং পদদলিত বিজয় || আলী সিদ্দিকী

চক্রান্তের শিকার মুক্তিযুদ্ধ এবং পদদলিত বিজয়
আলী সিদ্দিকী

চব্বিশের বিজয় দিবস জাতির সামনে উপস্থিত হয়েছে এক বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। একাত্তরের সকল অর্জন চব্বিশে এসে একাত্তরের পরাজিত শক্তির হাতে পরাভূত হয়েছে। এখন তারা রিসেট বাটন টিপে একাত্তরকে মুছে ফেলার সুক্ষ্ম কৌশল গ্রহন করে ধীরগতিতে সামগ্রিক ভাবে স্বাধীনতাবিরোধী বয়ান তৈরির পথে এগুচ্ছে। জাতি আজ এক মহাসন্ধিক্ষণে এসে দাড়িয়েছে। হয় তাকে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে ঘুরে দাড়াতে হবে নয়তো পরাজয়ের কলঙ্ক তিলক পরে নিজের সকল অর্জনকে বিসর্জন দিতে হবে।

কোটা বনাম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন

সরকারী চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য নির্ধারিত ৭০% কোটা প্রত্যাহারের দাবীতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন দেশের আপামর মানুষের সমর্থন অর্জন করেছিলো। নিরপেক্ষভাবে সকলের অভিমত ছিলো স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এই কোটা অযৌক্তিক এবং সেটাকে সর্বোচ্চ ৭% এ নামিয়ে আনা উচিত। এই প্রেক্ষিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন জনসমর্থন লাভ করে। আঠারো সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মুখে সরকার কোটাপদ্ধতি স্থগিত করলে আন্দোলন প্রশমিত হয়। কিন্তু সরকার চব্বিশে এসে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নিলে ছাত্ররা রেজপথে নেমে আসে। এবার তারা কোটাবিরোধী আন্দোলনকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফরম গড়ে তুলে ছাত্রসংগঠন সমূহের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। সেখানে সকল প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোও শরিক হয়।
কিন্তু এটা ছিলো একটি সুক্ষ্ম ফাঁদ যা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি-জামাতসহ সকল মৌলবাদী দলগুলো অরাজনৈতিক ইস্যু দিয়ে সরকারকে ঘায়েল করার সুপরিকল্পিত কর্মসূচী। যা সাধারণ বিক্ষুব্ধ ছাত্ররাও বুঝতে পারেনি। তারা শুধু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে আন্দোলনে সামিল হয়েছে।
তার জানে না বৈষম্যের বিরোধিতা কোনো রোমান্টিকতা নয়। বৈষম্য হলো আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ফল। তাই বৈষম্য দূর করতে হলে ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে হবে। রাষ্ট্রের উপরিভাগে মুখ পরিবর্তন করলেই সিস্টেম বদল হয় না। সিস্টেম যারা নিয়ন্ত্রণ করে -সমাজের ধনীক গোষ্ঠী- তারা চাপে পড়লে বড়জোর প্রলেপ দেবে, মাথা মুতা বদলাবে কিন্তু সিস্টেম নয়। সিস্টেম হলো তাদের দুধেলা গাই। ধুয়ে ধুয়ে-বেগুনতোলার মতো- তারা খায়।সুতরাং, সিস্টেম তারা বদলাবে না। জোর করে বদলাতে চাইলে সংঘাত হবে। রক্তক্ষয়ী সংঘাত। সেখানে রোমান্টিকতার অবকাশ নেই। তাই বৈষম্যের বিরোধিতা শুধু ভাসা ভাসা হলে অল্পদিনেই ইউটোপিয়ান স্বপ্নগুলো আকাশে উড়ে যাবে। এটাই হয়ে এসেছে, এটাই হয়। সামাজিক ব্যবস্থা না বদলালে বৈষম্য কখনোই দূর হবে না। ভিন্ন ভিন্নরূপে তার আগমন ঘটবে।

ম্যাট্রিকুলেশলি প্লানড স্বাধীনতা বিরোধীদের সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র

গত ১৬ বছরের আওয়ামী রেজিম ছিলো একটা ফ্যাসিস্ট রেজিম। আমার প্রচুর লেখনী তাদের সমালোচনা ও নিন্দা দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে দলীয়করণ করার মাধ্যমে তারা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলো। নিজেদের চতুর্দিকে গড়ে তুলেছিলো দুর্বৃত্তদের ভয়ানক বৃত্ত। এদের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছি। ২০১৮ সালে বাতিলকৃত কোটা আইনকে পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়াটাই ছিলো শেখ হাসিনার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ফলে কোটা বিরোধী আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক ছাত্র-জনতার সম্পৃক্ততায় কোটা আন্দোলন ব্যাপক গণঅভ্যূত্থানে রূপ নিতে থাকে। বামগণতান্ত্রিক জোট এবং তাদের সংগঠনসমূহ আন্দোলনে সামিল হয়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্রোহযাত্রায় জোরালো ভুমিকা রাখেন এবং সরকারকে পদত্যাগের দাবী জানান। আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে।
জনরোষের মুখে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ৫ই আগস্টে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। দৃশ্যপটে অবতীর্ণ হন আমেরিকার দালালখ্যাত ড. মুহম্মদ ইউনুস।সেনাপ্রধান আলোচনার জন্য প্রথমেই জামাতকে আহবান জানায়। ৮ই আগস্ট ড. ইউনুসসহ একদল উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ পাঠ করান।
উপদেষ্টা মন্ডলীতে অন্তর্ভুক্তদের ব্যাকগ্রাউন্ড প্রকাশিত হবার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করে। বাম গণতান্ত্রিক জোট পুরো আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকলেও একজন সমন্বয়কও উপদেষ্টা মন্ডলীতে স্থান পায় নি। দেশব্যাপী যতো সন্বয়ক সক্রিয় এবং লাইম লাইটে আছে সেখানে কোনো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কোন নেতাকেই দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি ক্রমশঃ জামাত ও হিজবুত তাহরীরের মুখোশ উন্মোচন হতে থাকায় গণঅভ্যূত্থানের চালকের আসনে যারা বসেছে তাদের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির অংশ হিসেবে প্রতিভাত হতে লাগলো।
সারাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, মাজার মন্দিরে হামলা, মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা ও মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন, মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মারক ধ্বংস করা, জাতীয় সঙ্গীত বাতিলের ষড়যন্ত্র, জাতীয় পতাকা বদলানো, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহকে ছুঁড়ে ফেলার প্রবণতা দেখে মানুষের চোখে গণঅভ্যূত্থান হাতছাড়া হয়ে গেছে বলে প্রতীয়মান হতে লাগলো। তাছাড়া রাষ্ট্রপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে জামাতঘেঁষা, হিজবুত তাহরীর ও বিএনপি সমর্থিতদের নিয়োগ দেখে জনগণের বদ্ধধারণা হতে লাগলো কোটা ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির কব্জায় চলে গেছে। তারা ধাপ্পাবাজির আশ্রয় নিয়ে গণঅভ্যূত্থানে সম্পৃক্ত হওয়া ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে তারা মরিয়া হয়ে গেছে।
এই যে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রের মুখোশ দিন দিন খুলে যাচ্ছে তা আন্দোলনে যুক্ত হওয়া বাম প্রগতিশীলরা এখনো হজম করতে পারছে না। তারা এখনো নিজেদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য নিজেদের মতো করে গণঅভ্যূত্থানের বয়ান তৈরি করছে। কিছু চীনপন্থী বাম সরকারের বিভিন্ন পদে পদায়িত হওয়ায় (আলী রিয়াজ, সৈয়দ জামিল আহমেদ, আবুল কাশেম ফজলুল হকসহ আরো কয়েকজন) বোঝা যায় স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির সাথে স্বাধীনতা বিরোধী চীনপন্থীরাও
আওয়ামী রেজিমকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে সামিল ছিলো। এটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, এই পুরো ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ক্রীড়নকের ভুমিকা পালন করেছে আমেরিকার আই আর আই (IRI)। যারা কিউবা ও ভেনিজুয়েলায় ব্যর্থ হলেও হাসিনা রেজিমের সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারীতার কারণে সৃষ্ট জনরোষকে “মেট্রিকুলাসলি প্ল্যানড” কাজে লাগিয়ে সফল হয়ে গেছে।
বাম প্রগতিশীলরা আরো কিছুদিন আত্মতুষ্টির জন্যে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি গণঅভ্যূত্থানকে কুক্ষিগত করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ডিরেকশনে দেশকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে যাবে। অধিকাংশ কোটা আইনের বিরোধী প্রগতিশীলরা বিষয়টি ধাপ্পাবাজি হিসেবে স্বীকার করলেও চীনপন্থী স্বাধীনতা বিরোধীরা কথার ফুলঝুরি ছড়াবেন।

বামবিচ্যূতি, ফ্যাসিস্ট বনাম ফ্যাসিস্ট

বামপন্থীরা কি একটি বিপ্লবী সরকারের আহবানে জাতীয় ঐক্য গড়তে যোগ দিয়েছিলো যখন দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে? বাঙালী জাতির মুক্তির সংগ্রামকে অসম্প্রদায়িক আন্দোলনে পরিণত করতে কমিউনিস্টদের অবদান ছিলো অতুলনীয়। সেই কমিউনিস্টরা কোন বিপ্লবী জোশে চরম প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মাস্টারমাইন্ডে গঠিত সরকারের নেতৃত্বে আস্থা রাখতে বৈঠকে সামিল হয়েছিলো? ভারতবিরোধীতার জুজু দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বরাবরই ফায়দা লুটেছে এবার কমিউনিস্টরাও সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। এসত্য উচ্চারণ করলে ভারতের দালাল ট্যাগ দেয়া সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পুরনো টেকনিক।
এটা প্রমাণিত সত্য যে আমাদের কমিউনিস্টদের ইতিহাস রণকৌশলগত ভুলের ইতিহাস। তা তারা স্বীকার করে তবে পদ্মা মেঘনায় বহু জল গড়ানোর পর।
এবারও তাদের ভুল হয়ে গেছে হিসাবে। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বিতাড়িত করা গেলে তারা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে তেমন প্রত্যাশা ছিলো। কিন্তু শক্তিমত্তার কারনে আন্দোলনের অভিমুখ যে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির কব্জায় চলে যাবে তা আঁচ করতে পারেনি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের তাড়াতে গিয়ে ঐক্য হলো প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্টদের সাথে! এখানেই তাদের বিভ্রম। লুটেরা ফ্যাসিস্টদের তাড়িয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্টদের জায়গা করে পৃথিবীর বহুদেশেই কমিউনিস্টরা ধোঁকা খেয়েছে কিন্তু আমাদের কমিউনিস্টরা কোনো শিক্ষা নেয় নি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা মৌলবাদী ফ্যাসিস্টদের সাথে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে যে আঁতাত করেছিলো, একই কায়দায় কি কমিউনিস্টরা ক্ষমতার পথ প্রশস্ত করতে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্টদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে নাকি “ভুল” হয়ে গেছে?
প্রতিপক্ষের রণকৌশল বুঝতে ব্যর্থ হওয়া মানে অপরিপক্কতা, অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা। আজকের রণকৌশলগত ভুলটাও হয়তো একদিন তারা স্বীকার করবে। হয়তো ততোদিন পর তাদের মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।

মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান বনাম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা

স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো তাদের ম্যাটিকুলাস ষড়যন্ত্র সফল হবার পর রাষ্ট্রপ্রশাসনে স্বমতাদর্শের লোকজন বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে অবস্থান ছিলো তার পক্ষে বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এবার ‘বিজয় দিবস’ হয়ে গেছে “ডিসেম্বর উৎসব”। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে প্রধান উপদেষ্টা মাল্যদান করেন জুতো পায়ে। যাদের রক্তে দেশ হলো তাদের স্মৃতির প্রতি এমন অপমান বলে দেয় তারা একাত্তরকে কি চোখে দেখে।
স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীদের সাথে যুক্ত হয়েছে বিচ্যুত বামপন্থীরা। যে সব বামেরা একাত্তরের মুক্তযুদ্ধকে “দুই কুকুরের লড়াই” বলে বিরোধিতা করেছিলো তারা এখন পুরনো সখা মৌলবাদীদের সাথে সুর মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নতুন করে লেখার জন্য সোৎসাহে মাঠে নেমে পড়েছে। এরা হলো বাম বজ্জাত।

সে যে বয়ানই তৈরি করা হোক না কেন ২৪ দিয়ে ৭১ মুছে ফেলার বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। এতে হয়তো বন্ধুদের অনেককেই হারাতে হবে কিন্তু ৭১ কে মহীয়ান রাখতে ততোটুকু ত্যাগ সহজেই স্বীকার করা যায়।

**********************************