You are currently viewing “ঘুমের দরজা ঠেলে”― একটি নিবিষ্ট পাঠ > পারমিতা ভৌমিক

“ঘুমের দরজা ঠেলে”― একটি নিবিষ্ট পাঠ > পারমিতা ভৌমিক

ঘুমের দরজা ঠেলে“―চিন্ময় গুহ-র অনুপম , অলৌকিক সাগরসঙ্গীতনিবিষ্ট পাঠ
 
 
পারমিতা ভৌমিক
 
চিন্ময় গুহর “ঘুমের দরজা ঠেলে”—-বইখানির সর্বত্র রয়েছে তাঁর প্রতিভার স্পর্শ। এই প্রতিভা মানে হল, তাঁর লেখার নূতনত্ব ও মৌলিকত্ব। চিন্ময়ের প্রতিভার মধ‍্যে রয়েছে একটা অনায়াস-প্রভুত্ব। তা অনেকটা ঈশ্বরের মতো――God said, let there be light, and there was light…
 
বইখানি নিবিষ্ট পাঠ করলেই মনে হবে ,সৃষ্টি-বিভোল চিন্ময় চলেছেন যেন একটা তূরীয় শক্তির প্রেরণায়, একেবারে আত্মগত সৃজনগ্রস্ততায়। মনে হয়, কী যেন একটা গভীর কঠোর সৃষ্টি-তপস‍্যা  ঝড়ের মতো তাঁর ভেতরে বয়ে চলেছে। তাঁর সারস্বত  সাধনা যত সংহত কেন্দ্রীকৃত এবং দ্রুত হয়েছে , ততই  তাঁর বেদনাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। স্ফুট বা অস্ফুট যে ভাবেই হোক, তাঁর লেখায় আছে তপঃশক্তির একটা রৌদ্রভাব, একটা আত্মস্থ সংহত সামর্থ্য, একটা ম্যাসকুলিন দার্ঢ্য।
 
একটা অন্তর্লীন আত্মদ্বন্দ্বই তাঁর ঐ ঝোড়ো প্রতিভা-শক্তিকেও জমাট নিরেট ও একাগ্র করেছে। শাণিত তরবারি ফলকের মতো একদিকে সেই প্রতিভা যেমন নমনীয় অন্যদিকে ঠিক তেমনই নমনীয়তার সাথে সাথেই অনমনীয় কাঠিন্যে ভরা, ইস্পাতকঠিন এক লেখনী যা কেবল সত‍্য সুন্দর ও মঙ্গল কে স্পর্শ করতে চায়। এইভাবেই রচিত হয়েছে চিন্ময় গুহর মনোভূমি। বলাবাহুল্য,সেই সাহিত্যবস্তুই প্রকৃত সাহিত্য যার মধ্যে আমরা পাই একটা বৃহৎ-এর ভাব ও বিশালতা।  বস্তুতঃ সাহিত্য থেকে পাঠক উপভোগ করতে চান একটা অনন্তের, অসীমের অভিব্যঞ্জনা।
 
চিন্ময় গুহর “ঘুমের দরজা ঠেলে”–বইখানি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, প্রাণ সেখানে খুলে গেছে মুক্তবেণীর মত ,দুই ডানা মেলে দিয়ে বিশ্বকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। বৈশ্বিক আবহ যে সাহিত্যে পাইনা সে সাহিত্য-সৃষ্টিতে যতই মনোহারিত্ব ,যতই চমৎকারিত্ব থাক না কেন, যতই তা নিবিড় বা সূক্ষ্ম হোক না কেন তাকে কেমন যেন অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়, তাকে পঙ্গু বলে মনে হয়।
মূলতঃ এই বৈশ্বিকতার গুণটিই চিন্ময় সাহিত্যের অন‍্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।
 
বস্তু,  চিন্তা, ভাবুকতা, যাই বলি না কেন তাইই কেবলমাত্র মহৎ সাহিত্যবস্তুর মর্মকথা নয় ―এ সবের মধ্যে দিয়ে বা এসব কিছু ছেড়েও থাকতে হবে একটা অনন্তের বিসার, বিশ্বতোমুখী তরঙ্গোল্লাস। ঠিক এইখানেই, এই গুণেই, চিন্ময়ের “ঘুমের দরজা ঠেলে” বইখানি একেবারেই দলছুট সাহিত্য বস্তু।
চিন্ময় জানেন, জীবনে  (সাহিত্যেও) তিনটি পাশ মানুষকে বেঁধে রেখেছে―― প্রথমতঃ খণ্ডিত বোধ। এই বোধ থেকে মুক্ত হতে চাইলে, প্রয়োজন  বিসারী চেতনার জঙ্গমতা। এর অধিদেবতা ―বরুণ।
 
চিন্ময় গুহের “ঘুমের দরজা ঠেলে” পড়তে পড়তে পেয়েছি একটা বিশাল বারুণি-চেতনার স্পর্শ। সমস্ত বইখানি জুড়ে তাই শোনা গেছে সাগরসঙ্গীত। সমুদ্রপ্রসঙ্গ এসেছে ঘুরে ফিরে――”সমুদ্র ডাকছে। বালি কাঁকড়ায় কামড়ে ধরেছে আমার পা,তবু সমুদ্রের প্রবালপঞ্জর থেকে উৎসারিত আলোর গুঞ্জন আমায় ডাকছে। ঐ তীব্র আর অনন্ত প্রবাহ কি গভীর নীলাভতম স্বপ্ন মানুষের? ঘুমের মধ‍্যে টার্নারের ছবিতে আলো আর সমুদ্রঝড়ের অনুপম রূপবিভা দেখে তাইই মনে হয় আমার।
 
বোদল‍্যের-এর কবিতার পংক্তি মনে পড়ে ;
মুক্ত মানুষ,তুমি সমুদ্রের জন‍্য তৃষিত
সমুদ্র তোমার আয়না…(“মানুষ ও সমুদ্র”/অনুবাদক―চিন্ময় গুহ/পৃঃ৮৫/ ঘুমের দরজা ঠেলে।)
 
এইরকম একটি বেলাহীন মহাসমুদ্রের কোলেই দুলতে থাকে পাঠক  আজও যখন সে শুনতে পায় ―And rock his brains
 in cradle of the rude imperious surge ―(Shakespeare)।
 
 কবি ও গদ‍্যকার, চিন্ময়ের রচনাতেও দেখি ওই একই বিপুলতায় এবং বিশালতায় তাঁর সাহিত্য জগতটি  ভরপুর হয়ে রয়েছে।
 
 চিন্ময়ের আনন্ত্যবোধের কাছাকাছি এসে পড়লে আমাদেরও সমস্ত বন্ধন ছিঁড়তে থাকে ― ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থি ।পড়তে পড়তে মনে হয় বরুণদেব আমাদের মাথার ওপর থেকে কি একটা আবরণ সরিয়ে দিচ্ছেন !খুব আস্তে আস্তে… আর কোথা থেকে যেন একটা বিপুলস্রোত মুক্তি পেয়ে বানভাসি করে দিচ্ছে আমাদের খণ্ডিত প্রাণিকচেতনার  স্থলভূমিকে।
 
বরুণ হলেন অনন্ত, অসীম। ভূমা। বৈদিক-ঋষি শূনঃশেফের মন্ত্রে তাঁর বন্দনা শুনেছি। বরুণ হলেন  মুক্তির প্রতীক। মিত্র হলেন সামঞ্জস্য এবং সৌন্দর্য ও মাধুর্যের প্রতীক।অর্যমা হলেন সামর্থ্য বীর্য ও শক্তির প্রতীক। চিন্ময়ের কবি প্রতিভার মধ্যে এই তিনটি গুণ  একই সঙ্গে আছে।
 
চিন্ময় “ঘুমের দরজা ঠেলে “বইটিতে দেখালেন কিভাবে বিশেষের মধ্যে বিশ্বকে দেখানো সম্ভব ।দেখালেন, যা দেশকালে আবদ্ধ এমন জিনিসকে কি করে শাশ্বতের বস্তু করে তোলা যায়। দার্শনিকের সত্য local colour কে এড়িয়ে চলতে চায় ,কিন্তু কবি হিসেবে চিন্ময় চেয়েছেন সত্যের জাগ্রত মূর্তি ।
যা মূর্ত তা তো সীমায়িত হতেই হবে অথচ এরই মধ্যে অসীমকে জীবন্ত ,প্রাণবন্ত, গোচর, চক্ষুগ্রাহ্য করে প্রকট করতে হয়। এর নাম মহৎ সাহিত্য। চিন্ময়ের লেখা পড়লে মনে হয় যেন চোখের সামনে, বিশ্বের সামনে ,মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কি একটা জগৎজোড়া বিশাল প্রয়াসপুঞ্জ।
চসারের (Chaucer) মতোই যেন বাংলা সাহিত্যকে চিন্ময় প্রাকৃতস্তর থেকে উঠিয়ে আনতে চাইলেন একটা উচ্চতার জায়গায় যেখান থেকে ভবিষ্যতে great poetry র জন্ম হতে পারে।
মার্লোর মধ্যে প্রথম শুনতে পাওয়া গিয়েছিল মিল্টনের অপূর্ব সাগরসংগীত , চিন্ময়ের রচনাতেও  তারই নবউত্থান দেখি না কি? চিন্ময়ও বিভিন্নভাবে এই সাগরের প্রসঙ্গে বারবার ফিরে এসেছেন। সাহিত্যে খণ্ডচৈতন‍্যের পাশ সরিয়ে দিতে চেয়েছেন প্রাণপণে।প্রসঙ্গতঃ এনেছেন র‍্যাবোঁ-কে――চিন্ময় লিখছেন,
――”শহরের মালিন‍্য আর ক্লিন্নতার মধ‌্যে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর মনে হয়েছিল (‘আমার নগ্নায়িত হৃদয়’) কোনও এক সুদূর বন্দ‍রের জাহাজগুলো যেন নিঃশব্দে বলছে, “quand partons-nous Vers let Bonheur?” (কবে আমরা সুখের অভিমুখে যাব?অনুবাদক―চিন্ময় গুহ।/পৃঃ ৮৫)
 
বন্দরে বদ্ধ জাহাজগুলো “SOUL” বা বদ্ধ ও খণ্ডিত আত্মার প্রতীক যারা মুক্তি-সুখের জন‍্য ভূমার আকাঙ্খাতে মগ্ন।
 
এই সমুদ্রের মাদকতাময় আকর্ষণের কথা পেয়েছি চিন্ময়ের কলমে। আসলে মানুষের চেতনা বলয়ে সোত্তরণের এক গুণ থেকে গেছে বলেই চিন্ময় বিশ্বাস করেছেন।
 
র‍্যাবোঁর সমুদ্রমুক্তির কথা চিন্ময় জানিয়েছেন পাঠককে—“বাস্তব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত সমুদ্রযাত্রাই কি তবে নঞর্থক থেকে সদর্থকের  পূর্ণ পদরেখা?”….(পৃঃ―৮৬)
কোথাও কি তবে লেখক চিন্ময়ের মধ‍্যেও জন্ম নিচ্ছিল বাস্তব থেকে উঠে আসা কোনো যন্ত্রণা যার পরোক্ষ মুক্তির সন্ধান ছিল বিশাল সমুদ্রচেতনার মধ‍্যেই?
চিন্ময়ের কাছে সমুদ্র বোদল‍্যের-এর মতো সদর্থক ।
 
বোদল‍্যের-এর প্রসঙ্গেই গভীর মনঃশক্তি ও তপঃশক্তি সম্পন্ন চিন্ময়ের অন্তর তল আলোড়িত করে উঠে এসেছে সমুদ্রপ্রীতির সদর্থক বোধ ――” কোন সে সমুদ্র যা বোদল‍্যেরকে হাতছানি দেয়? তিনি কোলরিজের সমুদ্রকে চেনেন না যেখানে মৃত্যু আর অসহায়তা !
 
The very deep rot : O Christ!
That ever this Soul be!
Yes, slimy things did crawl with legs
Upon the slimy sea.
About, about in reel and rout
The Death-fires danced at night ;
The water, like a witch’s oils,
Burnt green, and blue and white. (‘The Rime of the Ancient Mariner’/ Coleridge…পৃঃ-৮৭)
 
বোদল‍্যের-এর মতোই মুক্তি কাঙ্খা চিন্ময়চিত্তে একটি গভীর আশাদীপের মতোই দীপিত। তাই তাঁর কলমে উঠে আসা শেলি-র শব দেখে আমরাও  শিহরিত হয়েছি। চিন্ময়ের মতোই “ঘুমের দরজা ঠেলে” অপেক্ষা করেছি কোনো জবাকুসুম ভোরের জন‍্য।
আসলে সাহিত্যই দিতে পারে আমাদের সেই মুক্তি যা যাপনের ক্লেদ থেকে তিল তিল করে জমে ওঠে অন্তর্মনে। এই প্রসঙ্গে কবি চিত্তরঞ্জন দাশের (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ) সাগরসঙ্গীত কাব‍্যের কথা মনে হল। সেও ছিল এক মুক্তির সন্ধান। আসলে সবক্ষেত্রেই মুক্তির এলাকা সমান। সমুদ্র বাস্তব প্রতীক মাত্র। আত্মার গতি প্রমুক্তির দিকে এগিয়ে চলেই…আমরা তাকেই দেখি বৈচিত্রের মধ‍্যে…।
 
 
পারমিতা ভৌমিক:  কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক