বাসনে একমুঠো পান্তাভাতে লবন কাঁচা মরিচ গুলে এক গ্রাস মুখে দিতেই কেমন গা গুলিয়ে উঠল মুনমুনের। মনে হলো খাবারটা গলা থেকে না নেমে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দৌড়ে ওপাশে নদীর পাড়ে গেল মুনমুন। অনেকটা বমি করে ফেলল নদীর জলে। একটু দূরে এসে চোখে মুখে জল দিয়ে ফিরে এ্লো। এখন বেশ ভালো লাগছে।
মুনমুন এবারে এস এস সি পাশ করেছে জি পি এ ৫ পেয়ে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি। মুনমুনের বাবা একজন তাঁত শিল্পী। কাশেম খন্দকারের কারখানায় তাঁতীর কাজ করে। ওরা দুই ভাই বোন। বাবার মাস মাইনে, মা বাড়িতে হাঁস মুরগী, ছাগল পোষে, সব্জি চাষ করে ভিঁটেমাটিতে, সব মিলিয়ে ওদের ভালোই চলে। ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। মুনমুন লেখা পড়ায় বরাবরই ভালো। সরকারি বৃত্তি,মেধা বৃত্তি পেয়ে এসেছে মাসে মাসে। পড়াশুনা তাই নির্বিঘ্নেই চলত। এ ছাড়া মুনমুন নিজেও তিন চারটি টিউশন করাতো। কিছু টাকা সঞ্চয় করত ভবিষ্যতে কলেজে পড়ার খরচের জন্য। ওর ইচ্ছা ছিল জেলা শহরের ভালো কলেজে পড়ার।
করোনা সংক্রমন গ্রামে তেমন না থাকলেও শহরের দোকানে কাপড়ের চালান বন্ধ হয়ে যায়। তাই কাশেম চাচার কারখানাও আস্তে আস্তে বন্ধের উপক্রম হয়। প্রথম মাস দুয়েক কাশেম চাচা অর্ধেক বেতন দেয়, তারপরে একদিন বাবা সহ সব কর্মীকে ডেকে বলে আর বেতন দিতে পারবে না। তার নিজেরই চলছে না। ঋণ নিয়ে সুতা,রঙ সহ অন্যান্য জিনিস কিনেছিল। এখন নতুন কোনো অর্ডার পাচ্ছে না,তাই ঋণের বোঝাই তাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। যদি সুদিন আসে তখন আবার সবাইকে কাজে ডেকে নেবে। এখন যেন সবাই তাকে মাফ করে দেয়। সকলে ভেবেছিল দুই এক মাসে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। সেই আশায় বুক বেঁধে সবাই সাময়িক কষ্ট মানিয়ে চলতে চেষ্টা করে।
এক বেলা আধ বেলা করে খেয়ে কিছুদিন তাদের চলে। কিন্তু এরপরই শুরু হয় লাগাতার বৃষ্টি আর বন্যা। জলে ঘরবন্দি জীবন আরো দূর্বিসহ হয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন গ্রামরক্ষা বাঁধ ভেঙে সব ভাসিয়ে নেয়। সকলের সাথে মুনমুনেরাও বাঁধের উপরেই আশ্রয় নিল। দুই চার দিন গায়ে গা লাগিয়ে সবাই থাকল। সেখানে মুনমুনের অন্য বন্ধুরাও আছে। আছে পিউ, রিমা, মমতা, বিলকিস সবাই। দু’তিন দিন রান্না করা খাবার নিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় মানুষ আসত। তারপরে বলা হলো এভাবে নয় আমরা তোমাদের শুকনো খাবার দেব তোমারা নিজেদের মতো করে খাবে। সকলের তালিকা করা হল। দিনের আলোর তালিকাটা রাতের আঁধারে অন্যরকম হয়ে উঠল। প্রতি রাতে মুনমুন,স্বপ্না,কাকলি,রেহানা,বাসন্তী ,রানুর ঘুম ভাঙে ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দে। কিছু ছায়া মূর্তি আসে আর মুনমুনরা নিজেদের খুঁজে পায় দূরে মাঝ নদীতে নোঙর ফেলা অনেকগুলো নৌকার কোন একটায়।
রাত শেষ হবার আগেই আবার বাঁধে ফিরে আসে ওরা। এক একদিন এক এক রকমের মানুষের দেখা মেলে ওদের। তাদের বয়সেরও কোন গাছপাথর নেই। থাকে তরুণ, যুবা, প্রৌঢ়, আবার বৃদ্ধও । এদের চাহিদাও এক একজনের এক এক রকম। মুনমুনেরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই অনাকাংখিত জীবনে। ওরা জেনে গেছে স্বাভাবিক জীবনে ওদের আর ফেরা হবে না। তাই এই জীবনটাকেই নিজেদের মতো করে উপভোগ করে। একসাথে নদীতে যখন স্নান করে তখন ওদের আলাপের বিষয় হয় গতকাল রাতে কার ভাগ্যে কেমন লোক জুটেছে। মুনমুন বলে এরা নাকি শহরের ভদ্রলোক! অথচ দেখ কেমন ভিখিরির মতো একটা মেয়ের শরীরের জন্য ছুটে আসে। এই দূর্যোগে রাতের অন্ধকারে দূর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে পৈশাচিক আনন্দ করে। পিউ বলে কাল তো আমার জন্য আবার বিরিয়ানি নিয়ে এসেছিল, আগে হলে খেতে পারতাম না কিন্তু এখন ! দিব্যি খেয়েছি। সাথে কোকও ছিল। অবশ্য লোকগুলো মদ খেয়েছে। কাল তো একটা না তিন চারটে জানোয়ার আমাকে ছিঁড়ে খুড়ে খেয়েছে। আমিও মনে মনে বলেছি খা তোরা যত পারিস খা নরখাদক রাক্ষসের দল!
কথা বলতে বলতে ওরা নদীতে ডুব দেয়, হয়ত চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ার আগেই নোনাজলটুকু নদীর জলে মিশিয়ে দেবে বলে।
এইতো গত পরশু স্বপ্নাটা মরে গেল সকলের সামনেই কেমন জ্বর আর শ্বাস কষ্ট নিয়ে। ও বলেছিল সাত আট দিন আগে যে নৌকায় ওকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানের মানুষটার কেমন গায়ে জ্বর ছিল, সর্দি কাশিও ছিল। ওর ভয় করছিল কিন্তু ওকে তো নৌকায় ঐ লোকটার সাথেই থাকতে হয়েছিল।
দিনের বেলা ওরা যখন একসাথে নদীতে স্নান করতে যায় তখন নিজেদের স্বপ্নগুলো একটু একটু করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় প্রতিদিন। রেহানা এবারে উচ্চ মাধ্যমিক দিত। ওর স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। এখন আর লেখাপড়ার কথা ভাবে না। মমতার বিয়ে ঠিক হয়েছিল পাশের গ্রামের শফিকের সাথে। শুনেছে শফিকের চাকরিটা নাকি চলে গেছে, তাই এখন বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। বাসন্তীর আবার মন দেয়া নেয়া চলছিল পাশের গ্রামের দিপুর সাথে। দিপু ঢাকায় ছোটখাট ব্যবসা করে। আসার কথা ছিল গত মাসে কিন্তু লক ডাউনের কারণে আসতে পারেনি। কোনো যোগাযোগও করতে পারছে না। এমনও হতে পারে সে জেনেছে বাসন্তী আর আগের মতো নেই তাই ইচ্ছা করেই আর যোগাযোগ করছে না। মুনমুন ও স্বপ্ন দেখত ডাক্তার হবার। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে পড়াশুনা করত সে। বইখাতাগুলো যে কোথায় ভেসে গেছে তাও আজ আর মনে করতে চায় না মুনমুন। ছোট ভাইটাও কেমন হয়ে গেছে। হঠাৎ কেমন বড়দের মতো কথা বলে। এখানে আসার পরে লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেতেও দেখেছে মুনমুন। আর বাবা মা ! বাবা কেমন উদাস চোখে তাকে দেখে মাঝে মাঝে। মা যেন কেমন বদলে গেছে। মুনমুনের মনে হয় সকলের মুখে খাবার তুলে দেয়ার আনন্দে মা মুনমুনের কষ্টটা ইচ্ছে করে দেখতে চাইছে না।
দুপুর বেলায় ডাল চালের খিঁচুড়ি রেধেছে মুনমুনের মা। খেতে বসেছিল মুনমুন কিন্তু সেই গা গুলিয়ে বমি আসা ভাবটা আবার ফিরে আসে। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে। দিন কয়েক এভাবেই কাটে মুনমুনের।
একদিন রাতে মা ঝাল ঝাল করে একটু ডালের চচ্চড়ি করে দুপুরের বেঁচে যাওয়া ভাত থেকে মুনমুনকে খেতে দেয়। বলে এটা খা ভালো লাগবে। সত্যি ডাল চচ্চড়ি দিয়ে সবটুকু ভাত খেয়ে ফেলে মুনমুন । সেই গা গোলানো ভাবটা আসে না। যাক বাবা বাঁচা গেল। নানা দুঃশ্চিন্তা মাথায় আসছিল। কি আবার হলো ? এখন তো ডাক্তার দেখাতেও পারবে না।
এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো মুনমুন। আজ আর কানে নৌকার ইঞ্জিনের শব্দটা এলো না। সকালে সবাই দেখে মুনমুনের মুখ দিয়ে কেমন সাদা ফেনা বেরিয়ে গাল বেয়ে নেমে গেছে। শরীরটাও কেমন নিথর হয়ে আছে। সকলে ধরাধরি করে বাঁধে থাকা আজমত ফকিরের কাছে নিয়ে গেলে সে বলে আল্লায় অরে মুক্তি দিছে। যাও অহন তো মাডি পাইবা না ,গাঙের পানিতে ভাসাইয়া দাও।
মুনমুনের মা গোপনে শাড়ির আঁচলে চোখ মোছে আর মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস ইঁদুরমারা পাউডারের প্যাকেটটা আইয়া পড়ছিল, যেটুকু যা মাল-সামান আনছিল হেয়ার লগে। লোক জানাজানি হওয়ার আগে মাইয়াডা মুক্তি পাইলো। এই সমাজ তো ওরে চাইলেও ভালো থাকতে দিত না।