You are currently viewing গোলাপী কমলা ও জলজ গন্ধের গল্প || দেবাশিস ভট্টাচার্য

গোলাপী কমলা ও জলজ গন্ধের গল্প || দেবাশিস ভট্টাচার্য

গোলাপী কমলা ও জলজ গন্ধের গল্প

দেবাশিস ভট্টাচার্য

পুলিশের সশস্ত্র প্রহরায়—-
কমলাকে নিয়ে মাঝগাঙ্গে পড়লো নাওটা। পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা উর্দ্ধমুখী মে’মানুষটার মাথার ওপর ঝুলে আছে একটুকরা আকাশ। কটি তারার নির্লজ্জ দৃষ্টি সবকিছুতেই একটা সৌম্যতা তাকে ঘিরে রাখলেও কমলার মন থেকে, শরীরের কোষ থেকে আগুনের উত্তাপের ঝাঁঝ যেন কমতে চায় না। বিষাক্ত ছত্রাকের মত সে পাপ তার রক্ত কণিকায় এক বিশ্রী উন্মাদনা জাগিয়ে রাখে। হাত নাড়তে চায়, পারে না। হাতকড়া বাঁধা। আচ্ছা কমলা কি ইলিশ মাছ? তার মাথার ভেতর অজস্র প্রশ্ন তোলপাড় করে। শয়তানটার জালে নির্বোধের মত আটকে পড়া রূপোর মত চকচকে ইলিশগুলো যেভাবে ধরা পড়ার পর জাল থেকে খালাস হয়ে নাওয়ের পাটাতনে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। তাদের চোখগুলো একসময় ঘোলা হয়ে যায়। কানকোতে জমে রক্ত। নাও ঘাটে লাগতে দেরী হলে বাতাসে পচন ধরে মাছগুলোর গায়ে। অতিরিক্ত মাছ গুলোতে জায়গা না ধরলে ওরা-জুয়ার তাসের মত পচনধরা মাছগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে। ডিঙ্গি নাওটা হালকা হয়। ভুসভুস করে রকেটের মত পানি কেটে দ্রুত এগোয় ঘাটের দিকে। ওরা কেয়ারই করে না পঁচা মাছ গুলোর কথা।
“আচ্ছা থাকি পোষাক পড়া লোকগুলো যদি তাকে ছিড়ে খুঁড়ে খেয়ে পঁচা মাছের মত ঘূর্ণি জলের ভেতর ফেলে দ্যায়? এক দলা বুদবুদের ভেতর সে ডুবডুব করে ঢুকে যাবে স্রোতের তলায়। ফাঁদের গল্প কথার যদি সত্যতা থাকে-তাহলে সেখানে থাকবে অদ্ভুত সুন্দর কোনো মৎস্য জগত। আমাদের দেশের ঘাস বিচালির মত পানির নিচেও থাকবে এক আলাদা বাগান। কাঁচের মত মিহি কণার রাজপ্রাসাদে সোনার খাটে ঘুমিয়ে থাকবে সে। নাহ্ সেপাইগুলোর আহাম্মক চেহারা, জ্বলজ্বল করা হিংস্রতা ভরা জোড়া চোখের বিশ্রী কাতুকুতু-যা তার বমি উদ্রেক করছে তা হয়ত থাকবে না ওখানে। সে রাজা কি কমলাকে চিনতে পারবে? সেতো আগুনের তৈরি। অশরীরি তাকে দেখা যাবেতো? না অদৃশ্য হয়ে যাবে? ঠিকঠাক চিনতে পারবেতো? যে করেই হোক নাফরমানকে মাছ কাটার দা দিয়ে চার টুকরা করার বয়ান তাকে সুন্দর করে গুছিয়ে জানাতে হবে। যে দন্ড দেবে সে দন্ডই মাথা পেতে মেনে নেবে কমলা।
কি শাস্তি হতে পারে তার? যাবজ্জীবন। মৃত্যুদন্ড। না দীপান্তর—। খুন করলেতো গভরমেন্ট ফার্স লাগাইয়া মারে। ফাঁসির কথা কমলা ভাবতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে।

আচ্ছা পানির তলায় সে রাজার মুখাবয়ব,কেমন ?

সে কি তার স্বামী হার্মাদ বিলাইস্যার মত। রাগী চেহারার নাফরমানটার মনে কোনো দয়া ছিল না। কোনো দিন। একএক মৌসুম এলে তার গায়ে মোষের বল আসতো। মাঝ গাঙ্গে নাও নিয়ে ঘুরতো সারা রাত। মদ আর মাছ ভাজা নিয়ে যেত সাথে করে। ভোরে ভোরে ফিরতো। পাড়ায় কাউকে নাম ধরে ডাকতে দেখেনি সে।

কমলা হয়ত তখনও ঘুমে। দুচোখে জলের একটি শীর্ণ ধারা। লোকটা বাঘের মত তাকে খামচে ধরেছে তার মুখে বাংলা মদের উগ্র গন্ধ লালা হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। একসময় কমলা আবিষ্কার করল লোকটার মোটাসোটা আঙ্গুলগুলো খাবলে ধরেছে তার শরীরের উত্তেজক অংশের ওপর। ভয়ানক বমি আসতে থাকে তার। লোকটা তাকে সিংহের মত মাংসপিন্ড করে খাবলে খাবলে খেতে থাকে। ভয়ানক লোকটার নিষ্পেষণে কমলার প্রচন্ড কান্না আর বমির দখল যেন কোনো ঘটনা নয়। তার বিশাল দেহের ভারে পচা ইলিশের মত নিঃসার নিস্তব্দ হয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে কমলা।
যখন জ্ঞান ফিরে তার, একটা চোখে লোকটার আঁচড়ে ফুলে ওঠা মাংস দলার ভেতর কমলা যেন স্পষ্টই দেখে, কাট করে তার রেঁধে রাখা ভাত তরকারীগুলো সাবার করছে পাষন্ডটা। কোনোদিন দু’চার টাকা দিয়ে যে লোক সাহায্য করেনি? ঘরে রান্না হয়েছে কিনা জানতে চায়নি। যে লোক কমলা ক’দিন উপোষ ছিল যা তার জানার কোনো বিষয় নয়, তার এভাবে সারাদিনের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য রেঁধে রাখা ভাত তরকারীগুলো রাক্ষসের মত খেয়ে ফেলার কোনোরূপ যুক্তি কমলা দাঁড় করাতে পারেনা।

আজ থেকে আঠারো বছর আগে বিলাইস্যা তার চূড়ান্ত সর্বনাশটা করেছে। জেলে পাড়ার আর আট দশজন মেয়ের মতই সে বড় হয় বাবার সংসারে। বাপ তার মাছের কারবারই করতো। জেলেপাড়ায় কমলার সবার কাছেই সমান আদর। চুলে বেনি বেঁধে দেয়ার জন্য কালী, রমা, পান্না, আতরীরা কখনই অবহেলা করতো না তাকে। বাপ তার অন্যান্য জেলেদের চেয়ে উন্নত অবস্থা তো তাই। তাদের ঘরের পাশে যে বিগ্রহ মন্দির। শনি মঙ্গলবারে সেখানে হোত কীর্তন গান। শান্তিপুর ডুবুডুবু কেওলোরে নদীয়ার আই-যাই-যাই, রসহরি দুহাতে মৃদঙ্গ নিয়ে বাম পা ওপরের দিকে তুলে মাদলে তাল তুলে ঘুরে ঘুরে নাচছে নিমতলায়। জেলেরা যার যার কাজ কর্ম সেরে এসে গোল হয়ে বসছে সে আসবে। অমৃত কাকা হ্যাজাক এনে উচিয়ে ধরেছে আসরে।
চন্দন চর্চিত হয়ে বিধবা বেমলা মাসির হাত ধরে চুপচাপ সদ্যযৌবনের সর লাগা বুক লুকিয়ে সে আসরে উপস্থিত ছিল। আয়রে তোরা কে কে যাবি নদীয়ায় । রসহরির পান্টা টানে পানির উত্তাল স্রোতের ভেতর কমলা রসসিক্ত হতে থাকে। রাঁধা-কৃষ্ণের বিরহের মন্থন সুধা তার কন্ঠে জলের মত শরীরে এসে লাগে. সমস্ত শরীরে আধ। আনন্দ আর আধা কষ্টের এক সুখ জেগে ওঠে। রমামাসির গলা জোরকে চেপে ধরে কিশোরী কমলা সে প্রেমে সিক্ত হতে থাকে।

রাত যতবাড়ে রসহরির গলার সুর তত জোরালো হয়। চারপাশে জেগে থাকা কীর্তন রসে আরও মানুষগুলোর ঠোঁটে জাগে প্রেম পিপাসার অনল। ঘুরে ঘুরে রসহরি একের পর এক বৃন্দাবন বৈকুণ্ঠের গানে জাগিয়ে তোলে পরিবেশ। শক্ত সামর্থ বিলাস সরে আসে বিধবা মাসির কাছে। মাসি টের পায় না।

রসহরির হাতের আঙ্গুলগুলো মাদলের বোলে বৃষ্টির মত ফোটে। এসময় অহেতুক অসতর্কতায় কিষা কারো প্ররোচনায় ভাঙ্গা চেয়ার সমেত আসরের একমাত্র হ্যাজাকটি উল্টে যায়। অন্ধকারেও রসহরির গান থামে না। বিলাসের শক্ত আঙ্গুল গুলো কমলার ফ্রকের ভেতর ঢুকে যায়। গলা দিয়ে উঃ মাগো বলে একটা আর্তস্বর বেরনোর আগেই আরেকটি কালো হাত মুখের ওপর এসে লাগে। কমলার সে হাতের চাপে কন্ঠ দিয়ে একটি স্বরও বেরোতে পারে না আর। হাত পা বেঁধে ইলিশ মাছের মত নাওয়ের পাটাতনে ছুঁড়ে ফেলে কমলাকে ওরা। সিংহ কিম্বা ভয়ংকর কোনো পশুর মত ছেলেগুলোকে কমলা চিনতে পারেনা।

ততক্ষণে আসরে আলো জ্বলে ওঠে। মাসি তার পাশ থেকে দ্রুত উঠিয়ে নেয়া কমলার খোঁজ নেয়ার জন্য পধদকে জোড়ালো আবেদন জানায়। কিশোরী মেয়েটিকে কে বা কারা উঠিয়ে নিয়ে গেল সে সন্দেহ আর প্রস্তুতি যখন শেষ হয় তখন ওরা হই হই করে লাঠি, ধামা, আরো কিছু ধারালো জিনিস পত্র নিয়ে চর পেরিয়ে জল বরাবর এসে থামে। তখন ডিঙিটি ছেড়ে গেছে ঘাট। হল্লাটি দ্রুত আলো নিয়ে সমুদ্রের দিকে থামছে দেখে ওরা ডিঙি জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। তাদের মুখে জ্বলে ওঠে বিড়ির আগুন। কমলা সংজ্ঞা হারিয়ে পাটাতনে নির্লিপ্ত পড়ে থাকে। সোরগোল তুলে দাঙ্গা করতে আসা লোকগুলোর চোখের সামনেই ডিঙি নৌকাটা ধীরে ধীরে জলের তোড়ে কমলাকে নিয়ে ভেসে যেতে থাকে সমুদ্রের গভীরের দিকে। এ সময় উদ্ধারকারী দলটির অগ্রভাগে যে মানুষটি সেই কমলার বাবা।

বিলাইস্যা কুত্তার বাইচ্চা আমার মাইয়্যারে তুইল্যা নিছে। হে আমার চান্দের মত মাইয়্যাডারে নষ্ট করছে।
দাঙ্গা করতে আসা মানুষগুলোর দু’চোখে আগুন আর দূর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা কমলার আর্তস্বরে কান রেখে কমলার বাবা বালির ভেতর দাঁত কপাটি লেগে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। নিবারণ কাকা আর রসহরি খপকরে শক্ত হাতে তার ভূপতিত শরীর বালি লাগার আগেই চাঙদোলা করে কাধে তুলে নেয়। দলটি পূর্ববৎ ডিমের মত আলো নিয়ে জেলে পাড়ায় ফিরে থামতে থাকে।
দুই

সেপাই গুলো পাটাতনে শুয়ে থাকা নিঃস্বার নিস্তব্ধ মেয়েটির কথা ভাবে। ক্রমশঃ অন্ধকার ঘনীভূত হয়। নাও থেকে জলের ওপর আঁকিবুকি আকাশটাকে অনেক কাছের মনে হয়।

সেপাই আর থানার আই ও টা দূরত্ব নিয়ে বসেছে। একজন গলুইয়ে আর একজন পেছনের পাটাতনে। পলকা হাড় জিরজিরে ঢ্যাঙ্গা মাঝিটা ঝপূজপাৎ দাঁড় ফেলে এগিয়ে নিচ্ছে নাও। উজান ঠেলে আগানো সহজ কাজ নয়। জোয়ার থাকতে নাওটা ছাড়া গেলে এত বেগ পেতে হতো না। জেলে পাড়ার মানুষগুলোর প্রতিরোধ ঠেকাতে গিয়ে বিলাইস্যার লাশ গুম করে দেয়ার বিশ্রী ঘটনার আলামত সংগ্রহ সাক্ষী সাবুদ এর বিবরণ। কমলাকে ঘর থেকে জনসমক্ষে স্বীকারোক্তি নিয়ে দোষী সাব্যস্ত করে নৌকায় তুলতে তুলতে বেলা ভাঙলো বেশি। বিলাইস্যার লাশটা এ মেয়ে গুম করেনি, করেছে মানুষ। হত্যার মোটিভ যতটা না প্যাঁচানো তার চেয়ে লাশ উদ্ধারই ছিল জরুরী। হেডকোয়াটারের বড় সাহেবের খ্যাচানি, নির্মম ব্যবহার সবকিছু ব্যর্থতা তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা ঘটবে আই ও টার ওপর। তবুও আসামীটাকে তো অন্ততঃ পাওয়া গেল, স্বীকারোক্তি সমেত এই যা। হারামজাদারা বিলাসকে কোথায় গুম করলো কে জানে। একটা টুশব্দ করলোনা কেও। ইচ্ছে হয়েছিল গ্রামের সবকটি মানুষকে বেদম পেটাতে। সাক্ষী মাবুদ হাজার থাকলেও লাশ নিয়ে কথা, সেটি পাওয়া না গেলে পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে কুপিয়ে হত্যার মোটিভ এর ডাক্তারী কাগজ পত্র পাওয়া না গেলে যে মেয়েটিকে প্যাঁচানো যাবে না কিছুতেই আইনে-তা আইও বেশ ভালোই বোঝে। এ সময় পাটাতনে কনকন ঝনঝন। সেপাইটা বিড়ি ধরিয়েছে। নাওটার গায়ে ইলিশমাছ পচা চটকা গন্ধ, বমি আসতে চায় আইও আহসান উল্লাহ সেপাইকে দেখে। সে হয়তো মেয়েটির পায়ের কাছে ঝিমুচ্ছে।
পকেট থেকে তুলা আটা চুরুট ঠোঁটে লাগায় আই ও ম্যাচ লাইট জ্বালিয়ে মুখে আগুন ধরিয়ে গলগল করে ধোয়া ছাড়ে সে। জলে আর তেমন কড়া স্রোত নেই। দু’একটা মরাস্রোত পাক খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পূব থেকে পশ্চিমে। মেয়েটি মরে গেল নাতো? কালসাপের মত ফোঁস করে উঠবেনাতো আবার।

অন্ধকার ক্রমশঃ ঘন হয়ে আসে। একজন আরেকজনকে দেখতে পায় না। কমলার পায়ের কাছে বসে থাকা লিকলিকে সেপাইটার চোখ বাঘের মত জ্বলে ওঠে। রক্তে শির শির করে জাগে ঘুমন্ত সিংহ। তার ডানহাতটা কমলার পা ছুঁয়ে আস্তে আস্তে আঁধারের ভেতর হাঁটু বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। কমলা প্রথম বুঝতে পারে না। একবার দুবার তিনবারের সময় খাকিটার হাত তার গোপনতায় খামচি কাটলে সে ওয়াক করে বমি করে দেয়। বমিতে একটা বিশ্রী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে নাওয়ে। আই ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেপাইটা স্যাতস্যাতে কিছু হাতের ভাঁজ থেকে মুছে ফেলে নিরাপদে সরে বসে।

আই ও আহসান উল্লাহ খানিক ঠাহর করেই চিৎকার দিয়ে ওঠে- সেপাই কি করস ওখানে?

না স্যার, মাগিটা বমি করছে, গন্ধ, দুর্গন্ধ স্যার।

মুইছা ফালা। দূরে সইরা বয়। হাত দিবিনা গায়ে, হালা আঁধারে ও দেহে নাহি, গজগজ করতে করতে রাগে দূরে সরে বসে সেপাই। মাঝি বিড়ি ধরায়, সে আগুনে কমলার চিড়িক দ্যায় বুকে। বাতাসের কামড় লাগে গায়ে। অল্প অল্প শীত যেন কমলার পাতলা শাড়ীটার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে গায়ে। কমলা আবার শান্ত হয়ে যায় বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে।

ভাতও দিবানা, পিন্দনও দিবানা, খালি মারবা আর রাইতে সিংহের মত চিবাইয়া চিবাইয়া খাইবা শরীর তা সইবো না। একদিন দুইদিন তিনমাস আঠারো বছর একই নিয়ম। তোমার লাথি মারপিট সব আমি হজম করছি। বিলাইস্যা তুই একটা ডাকাইত, জুলুমবাজ, নাফরমান।

সোহাগ কইরা কইছিলি তরে বিয়া করুম। তোরে সাঙাত যাও তোর কথায় সুর মিলাইছিল। কুত্তার বাচ্চা কত কথা কইয়া পাড়ায় পরের কাম কইরা সোমত্ত শরীর নিয়া বাজারে পরের মাছ বেইচ্যা আঠারো বছরে শরীল কইরলাম কালা, আর নয় হারাম জাদা—।

মৃতসঞ্জীবনের রসে কামক্রিয়া সেরে দজ্জালটা ঘুমিয়ে পড়ার পরই মনে হয়েছিল আজ সে ইলিশ মাছের লাল ঝোল দিয়ে চারটে ভাত খাবে পেটভরে।

সে সুযোগও দিল না কুত্তাটা

সব ভাত খাইয়া ঝাপাইয়া পড়লো সে অভুক্ত দেহটার ওপর। চটকারা চটকারা খাইলো নাংশ হাড়গোড়। আগুনটা জ্বালাইলে মনে। তারপর কমলা তৈরি হলো। শাড়িটা প্যাঁচিয়ে বাঁধলো সত্য-মিথ্যা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মুখোমুখি হতে। ইলিশ কাটার দা’টা মাথায় তুলে প্রবল বিতৃষ্ণায় মোষের মত হার্মাদটার গলায় মারলো প্রথম কোপটা। শ্বাসনালীসহ ঘরময় ফিনকি দিয়ে রক্তের ছিটা লাগলো মুখে, রক্তগুলো লোনা। পাপরক্ত। গলাটা দুভাগ হোল পরপর, দা উঠলো নামলো। চারটুকরো তার স্বামী ডাকাতের সাঙাত বিলাইস্যা তখন।

হারানের মা বললো : আর কত সইবি মা। ঠিকই করছস। আমিই সামলামু সবকিছু। হারান পুতেছে সে লাশ। রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া ঘরের মেঝে শাড়ি পালটে দিয়ে কিছুই হয়নি এমন কান্ডটি করেছে নাকি। সবাই জানতো বিলাইস্যা একটা ডাকাত। গ্রামে যখন পুলিশ আসে তখন হারানের মা ভারে বলছিল পালাতে। সে যায়নি। কেনো যাবে একটা ডাকাত যদি প্রতিদিন তাকে খুন করতে পারে, সে একদিন পারবে না কেনো? নাফরমানটাকে বাড়তে দেয়া আর ঠিক হবে না।
জেলে পাড়ার কেউ বিশ্বাস করেনি ঘটনাটা কমলা করেছে। তবুও খুনের কথাতো কানে কানে রাষ্ট্র হয়ে যায়”।

পুলিশকে অকপটে নিজেই সবকিছু দায়-দায়িত্ব নিয়ে কমলা খুনের কথা স্বীকার করেছে। হারানের মা একদঙ্গল লোক নৌকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে গেল তাকে। কমলার চোখে জল ছিল না। সে শুধু চিৎকার দিয়ে সবাইকে জানিয়ে ছিল।

তোরা শুইন্যা রাখ কমলা আবার আসবো। কেও তারে আটকাইয়া রাখতে পারবো না।

কমলার কোনো দোষ নাই ৷

ডাকাইতরে মারলে কোনো দোষ নাই–

তবুও ওরা হাতকড়া লাগিয়ে কমলাকে পাটাতনে শুইয়ে নেয়। চিৎ হয়ে কমলা পাটতনে শুয়ে থাকে। ডিঙি নাওটা তির তির করে উজান কেটে এগুতে শুরু করলে হারানের মার বিচ্ছেদের কান্না কেঁদে ওঠে।

তিন

কমলা ওঠে বসতে চায়। মাথার দুপাশের রগদুটো যেন ছিঁড়ে যাবে। এক অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে শরীরে। এভাবে আর শুয়ে থাকা যায় না। যন্ত্রণাগুলো রক্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষ। কমলা অনুনয় করে বলে;

সায়েব আমারে হাতকড়াটা একটু খুইল্যা দেন; আমি পালামু না—- আপনার কাছেই থাকুম— -। আই ও টা নূতন। তার মন গলে যায় কমলার আহাদী কথায়। সেপাই কড়া খুইল্যা দাও—।

কমলা হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে আইওর দিকে। হাতিয়ে, হাতিয়ে একসময় আই ওর শরীরে গিয়ে লাগে কমলা। নরম শরীরে আঙ্গুল রেখে আই ও ভাবে মেয়েটাকে বাঁচালে ভাল হোত।

হঠাৎ ডিঙিটা একটু কাত হয়। জলের ভেতর ঝপাৎ করে কিছু পড়ে যাবার শব্দ হয়। নাওটা দুলে ওঠে। এক পলক জলের ঘূর্ণির ভেতর কমলা তলিয়ে যেতে থাকে জলের তোড়ে। বুদবুদগুলো ভুসতুস করে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। আই ও র কোমরে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটার কথা মনেই পড়েনা।

কমলার লাশ কানকো পর্চা ইলিশ মাছের মত ভাসে না। সে তলিয়ে যেতে থাকে তার গন্তব্য ডাকাত

স্বামীর সুখানপুর গ্রাম নয় কেরামগুলির দিকে—-।

চারপাশের জলগুলোতে যেন দুধের গন্ধ। অনেকদিনের তৃষ্ণার্ত কমলা পেট পুড়ে দুধের স্বাধ নেয়। আকাশে বাতাসে কমলার বেঁচে যাওয়ার আর্তস্বর কম্পমান হতে থাকে জলজ গন্ধের জেলেপাড়ার প্রতিটি আর্তমানুষের মনে–।

****************************