গোধূলির রঙ || সেতারা হাসান
দস্তখৎ দিয়ে ফেডেক্সের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে প্রেরক খোঁজেন রাশিদা। মিঠু! ফেড এক্স পাঠিয়েছে! কি পাঠিয়েছে মিঠু ফেড এক্সে! রাশিদা তো মিঠুর সংবাদ পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। মিঠুর সংবাদের জন্য একমাস ধরে বড় অস্থির হয়ে আছেন রাশিদা। এক সপ্তাহ আগেই মিঠুর এখানে এসে পৌঁছোবার কথা। অথচ গত একমাস ধরে মিঠুর কোনো খবরই নেই। রাশিদা চিঠির পর চিঠি লিখেছেন। ফোনের পর ফোন করেছেন। তবু মিঠুকে ধরা যায় নি। এর মধ্যে তিনি প্রথমে বিচলিত, রাগান্বিত ,অধৈর্য এবং শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। রাশিদা স্বভাবতই শান্ত মানুষ। তাঁর সব কাজ সুপরিকল্পিত। সব কিছুই তিনি সুচারু ভাবে সম্পন্ন করেন। এহেন মানুষের অস্থিরতা দেখে তারিক এবং দুই মেয়েও ভড়কে গেছে। কয়দিন আগেও ওরা রাশিদার ছুটোছুটি দেখে হাসি ঠাট্টা করছিলো । মুখ কাটা ছোটো মেয়ে তো বলেই ফেলল
“মাম, স্লো ডাউন, ইউ আর কিলিং ইয়োরসেলফ! উই নো মিঠু ভাই, হে উইল বি ওকে । আমাদের জন্য তো কখনো এমন কর নি। তুমি তো মিঠু ভাইকে বেশি ভালবাসো।“
শেষের কথাটা অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই শুনছেন রাশিদা, তাই সেটা নিয়ে ভাবছেন না। কিন্তু তিনি কি সত্যিই বাড়াবাড়ি করছেন? শেষ পর্যন্ত স্বল্পভাষী তারিকও বলেছেন,
“অস্থির হয়ো না। মিঠু স্মার্ট ছেলে, ও ঠিকই ম্যানেজ করতে পারবে।“
তবে এক সপ্তাহ আগে মিঠু এখানে না পৌঁছাতে সেই তারিক ও চিন্তিত হয়েছেন ।
মিঠুর চিঠিই বটে। বেশ লম্বা। অনেক গুলো পাতা।রাশিদা চিন্তিত মনেই চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করেন। ভর দুপুরে বাসায় কেউ নেই। তারিক কাজে। দুই মেয়ে কলেজে। ধীরে ধীরে শোবার ঘরে ঢুকে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেন। চিঠিতে কোনো সম্বোধন নেই। ঢাকা থেকে লেখা। এক সপ্তাহ আগের তারিখ।
—“আমি জানি আপনি আমার চিঠির অপেক্ষা করছেন বেশ কিছুদিন থেকে। ফোন করেছেন অনেকবার জানি আমি। পরপর চিঠিও লিখেছেন অনেক গুলো। পেয়েছি সব গুলোই। উত্তর দেই নি কেন সে কথাই বলব। আজকে সব কথাই বলব আপনাকে।“
রাশিদার বুক দুরু দুরু করে ওঠে। সামান্য কাঁপুনি!
“প্রথম আপনাকে দেখি ৩ বছর বয়সে, মনে আছে আমার। আপনি আমেরিকা থেকে নীলফামারিতে এসেছিলেন। অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলেন আমাদের জন্য। আমার অবশ্য চকোলেটএর কথাটাই বেশি করে মনে আছে বলাই বাহুল্য। অনেক আদর করেছিলেন। একদিন আমরা দল বেঁধে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম, পিকনিক করেছিলাম আরেক দিন। মনে আছে। তারপর আবার এসেছিলেন তিন বছর পর। তখন আমি সব কথা মনে রাখার মতো বড়। তিন বছরের রিমিও ছিলো । এবারও এনেছিলেন অনেক কিছু। চকোলেট তো ছিলোই। ছয় বছরের আমি কি দারুণ উত্তেজিত হয়েছিলাম চমৎকার সব শার্ট, প্যান্ট পেয়ে। সবচেয়ে খুশি হয়েছিলাম স্কুলে যাবার ‘ব্যাক প্যাক’ পেয়ে। সেদিন নিজেকে আমার রাজা মনে হচ্ছিল। কতদিন যে সেই ব্যাগ পেছনে বেঁধে সগর্বে সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে হেলে দুলে স্কুলে গিয়েছি! সেবার অনেক দিন ছিলেন বাংলাদেশে। বোধহয় ৪ মাসের মতো। পরে কথা বার্তায় বুঝেছিলাম তখন ঝিমিকে নিয়ে আপনি অন্তঃস্বত্বা। আপনি বাপের বাড়িতে কিছুদিন ‘আরাম’ করতে এসেছেন।
কি ভীষণ সুন্দর ছিলেন আপনি। ঝকঝকে সোনার বরন, আমার তাই মনে হতো। আর কি নরম, মসৃণ। যখন আদর করতেন কোলের মধ্যে রেখে, বুকের মধ্যে ধরে! কি যে ভালো লাগত আমার। আমাকে আপনার এত আদর করা কিন্তু আম্মা পছন্দ করতেন না। না, আপনি জানতেন না সেকথা। জানবার কথা নয় কারন আম্মা আপনাকে খুব যত্ন করতেন। আপনি আসার কথা আম্মা জানতে পারতেন আগে থেকেই, আপনার চিঠি পেয়ে। আর তখন থেকেই দৌড়া দৌড়ী শুরু হয়ে যেত। বেচারা আব্বা! কি যে ছুটাছুটি করতেন। আম্মা নিজে কত কিছু খাবার বানিয়ে রাখতেন আপনার জন্য। এবার দেখেছিলাম অনেক আঁচার বানাতে। আব্বা ছোটাছূটি করলে আবার খোঁচা দিতেন বেশ। তখন একটু একটু অনুমান করতে পারতাম, কিছু একটা খটকা লাগার ব্যাপার ছিলো। তিন বছরের রিমিকে নিয়ে আমি খেলার মাঠে যেতাম। এবাড়ি, ওবাড়ি যাওয়া আসা, এখানে ওখানে বেড়াতে যাওয়া, পিকনিক করা সব কিছু মিলে মনে হয় সেবার চার মাস ধরেই ঈদ চলেছিলো আমাদের।
আপনি চলে গেলে কেমন ঝিমিয়ে পড়তাম আমরা। পরের বার আসলেন ৪ বছর পর। তখন আমি এগারোয় পা দিয়েছি। অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। বয়সের তুলনায় বোধহয় একটু বেশিই বুঝে ফেলেছিলাম। বুঝেছিলাম আপনার আর আমাদের বা আরো খোলাসা করে বললে বলতে হয় আপনার এবং আম্মা, আব্বার সম্পর্কের মধ্যে একটা রহস্য ছিলো। কিছু টানা পোড়েন। আবেগ, অভিমান, অভিযোগ আবার ভালো লাগাও। এক কথায় উপন্যাসের মতোই অম্ল মধুর। আপনার আসার কথা শুনলেই আব্বার অস্থিরতা বেড়ে যেত। সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আম্মাকে চাপা গলায় বলতে শুনেছি,
“পাগল হয়ে যাচ্ছ যে , দেখো আবার হার্ট ফেল করে বসো না—“। বেচারা আব্বা! কি করুন মুখে নিভে যেতেন দপ করে। তার পরের কয়েক দিন মলিন মুখে ঝিমুতে থাকতেন। সব উৎসাহ হারিয়ে চুপ চাপ বসে থাকতেন। তখন আবার আম্মাই জোর করে কাজে লাগাতেন। আদর করা বাড়িয়ে দিতেন, আড়ালে থেকে আমি দেখে ফেলেছি। আমার বুঝতে দেরি হয় নি যে আপনার সঙ্গে আব্বার সম্পর্ক ছিলো। প্রেমের সম্পর্ক। খুব গভীর ছিলো কি? আমি জানি ছিলো। আমি তো নিজেই তখন আব্বার চোখে দেখছি আপনাকে। হ্যাঁ ১১ বছর বয়স থেকেই। তখন আমার শরীরে ভিন্ন এক জগতের সাড়া শুরু হয়েছে। আমি একদিকে নিজেকে চিনতে চাইছি আর অন্যদিকে বিভোর হয়ে ডুবে যাচ্ছি আপনাতে–!”
রাশিদা পড়া থামান। সামনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। জোরে নিঃশ্বাস নেন। তারপর আবার চিঠির পাতায় চোখ রাখেন।
“আমার সেই কৈশোর উত্তীর্ণর সময়ে আর আসন্ন যৌবনের যুগ সন্ধিক্ষণে আপনি আসতে থাকলেন প্রায় প্রত্যেক বছরেই। আমার ১১ থেকে ১৫, না ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত আপনি এলেন প্রতি বছর। সেই চার বছর ছিলো আমার জীবনের আলোড়ন তোলা ব্যস্ত সময়। ঘটনা বহুল। মানসিক যন্ত্রনা! বোধ আর বুদ্ধির সংঘর্ষ আর আপনি! আমি লেখা পড়ায় ভালো ছিলাম। সবাই বলতো ‘ভালো ছাত্র’। আপনি ওখানে থেমে থাকলেন না, বললেন “তুখোড়” ছাত্র।বললেন আমি অনেক বড় হবো। বললেন আমি জীবনে সবকিছু করতে পারি যদি চাই। আমার জন্য কত কিছু যে আনতেন! পছন্দের চকলেটের সঙ্গে কাজু বাদাম, আখরোট, কাপড় তো ছিলোই, বই খাতা, কলম কত কি? উৎসাহ দিতেন। আর আমি? আমি লেখাপড়ার চাইতে অন্য সব কিছুতেই বেশি উৎসাহী ছিলাম। ডিবেট, স্কুল পত্রিকা, বিশেষ করে খেলাধুলা। ফূটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টেন। ফুটবলে তো জেলা টিমেই খেলতে যাচ্ছিলাম। আপনি বাদ সাধলেন। সেদিনটার কথা মনে আছে আজও। আব্বা ফূটবলের কোচ ছিলেন। বাসায় কথা হচ্ছিল টিমে থাকব কিনা। আমি ক্লাস টেন এ। সে বছরই এস এস সি দেবো। আপনি বাসায় এলেন। আব্বা বরাবরের মতো আমতা আমতা করছেন। আম্মা বার বার বলছেন
“আমি জানি তোকে বেশি পড়তে হয় না মিঠু, কিন্তু খেলার জন্য তো সময় দিতে হয়। প্র্যাক্টিস করতে হয়। তারপর টায়ারড হয়ে গেলে কি আর পড়ায় মন দিতে পারবি?”
আপনি কি শান্ত, দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“মিঠু আমাদের তুখোড় ছেলে, ও ঠিকই খেলা, পড়া দুটাই সামলাতে পারবে।কথা সেটা নয়, কথা হচ্ছে ও কি শেষ পর্যন্ত খেলোয়াড় হবে না অন্য কোনো প্রফেসনে যাবে। ফাইনাল ডিসিশান নেবার আগে আমরা নাহয় আরেকটু আলোচনা করি কি বল মিঠু?”
ব্যাস হয়ে গেল। আমরা তিন জনই জানতাম এর পরিনতি কি। জানতাম ঐ এক বাক্যে অনেক কথা বলা হয়ে গেল। আব্বাকে মৃদু তিরস্কার, সরে গিয়ে আম্মাকে জিতিয়ে দেয়া এবং তাকে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত জীবনে ফেরাবার উৎসাহ ইত্যাদি আপনার সব মহৎ উদ্দেশ্য আর সীমাহীন উদারতা! আমার তারস্বরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিলো “না কোনো আলোচনা করতে হবে না। আমি অন্য কোনো প্রফেসন চাই না। আমি খেলোয়াড়ই হবো, আব্বার মতো খেলোয়াড় হবো—“ । বলা হয় নি। চিৎকার তো নয়ই। বরাবরের মতোই ঐ সোনা ঝরা, আলোভরা মুখ আর গভীর আয়ত, প্রত্যাশায় জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হেরে গেছি, তলিয়ে গেছি। আপনি জিতে গেছেন। আমার ষোলোতে পরা উদ্ভিন্ন যৌবন থরথর করে কেঁপে উঠেছে। আমি জানতাম এরপর আপনি আমায় ডেকে পাঠাবেন আপনার ছিমছাম করে সাজানো বাপের বাড়িতে। দুপুরে নিজহাতে রান্না করবেন আমার প্রিয় খাবার গুলো। নিজে বসে খাওয়াবেন আমাকে। তারপর বসাবেন আপনার বিছানায়। নিজে বসবেন চেয়ারটা টেনে নিয়ে। খাটের পাশে থাকা টেবিলের উপরে থাকবে ফল, মিষ্টি, বাদাম। আপনি একবারও তুলবেন না প্রফেশন বা খেলার কথা। জানতে চাইবেন আমার কি ভালো লাগে। বন্ধুদের কথা। কি ধরনের বই পড়ছি আজকাল। এর মধ্যে ফ্যানের স্পীড বাড়াবেন। রিমিকে ডাকবেন বার দুয়েক। ফল, বাদাম এগিয়ে দেবেন “ গরম পড়েছে ভালোই, ঠান্ডা খাবে কিছু—কোক না ডাবের পানি ?” কাছে আসবেন, আঙ্গুল দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দেবেন। কপালে ঠোঁট চেপে ধরবেন, আপনার স্তন, আপনার নিঃশ্বাস আমাকে স্পর্শ করে যাবে। আমার শরীরে উঠবে ঝড়ের মাতম। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়বে ভুমিকম্পের তান্ডব! কোথায় হারিয়ে যাবে আমার প্রতিবাদ! তলিয়ে যাবে আমার ন্যুনতম প্রতিবাদের স্পৃহা!
এই শিহরন আমার নতুন নয়। যেমন নতুন নয় আপনার অপত্য স্নেহের নিরঙ্কুশ প্রকাশ। আমার শিহরনের শুরু সেই এগারো, বারো বছর থেকেই। হয়তোবা আরো আগে থেকে, আমার অজান্তেই। আমি ঠিক কবে থেকে অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম আপনার জন্য জানিনা, তবে ১২, ১৩ বয়স থেকেই বিরহে ভুগতাম। বছরের ১০ মাস ধরে আকুল হয়ে থাকতাম বাকী দুই মাসের জন্য। আপনিও তখন থেকে প্রতি বছর আসতে শুরু করলেন আমার আকাঙ্খাকে আকাশ ছোঁয়া করে দিয়ে। আমার সেই কৈশোরের আকুল করা ভালো লাগা ১৫ তে পরিপূর্ণ প্রেমে এসে পৌঁছল। না এটা বিপরীত লিঙ্গের শরীর জাগানো আকর্ষণ নয়। এ ছিলো মনকে নিঃস্ব করে দেয়া, শরীর অবশ করে দেয়া আকর্ষণ। সর্বনাশা! আপনিই বা অত মোহিত ছিলেন কেনো আমাতে? কাকে দেখতেন অমন মুগ্ধ হয়ে আমার মুখে? আব্বাকে? হ্যাঁ আমি নিজেকে দিয়েই বুঝে ফেলেছিলাম আপনি আব্বাকে ভালোবাসতেন। আপনারা, আপনি আর আম্মা এক স্কুলে পড়তেন। দুজনেই ভালো ছাত্রী ছিলেন, তবে আম্মা ছিলেন তুখোড়। আর দুজনেই প্রেমে পড়লেন শহরের সবচেয়ে সুদর্শন, স্মার্ট, ফুটবল ক্যাপ্টেন শামিমের। কেমন ছিলো আপনাদের সেই দিনগুলো? আপনাদের কি ঝগড়া হতো আব্বাকে নিয়ে? না বোধহয়, আপনারা দুজনই বড্ড আত্নসচেতন। অভিমান? মন কষাকষি? হার জিতের মোকাবিলা? যতদুর আম্মা আব্বার কথা থেকে বুঝি মনে হয় আপনি স্বেচ্ছায় সরে গিয়েছিলেন। মাকে বলতে শুনেছি,
“পাওনি তো, ইচ্ছা করে ছেড়ে দিয়েছিলো, তাই বিয়ে করেছিলে —“
বেচারা আব্বা! দু দুটো জলন্ত বহুকাঙ্ক্ষিত তরুণী, কাকে ছেড়ে কাকে নেবেন। এদিকে আবার সামাজিক মাপকাঠিতে তেমন যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। টেনেটুনে বি এ পাশ, খেলোয়াড়। স্কুলে খেলার মাস্টার, বিয়ের বাজারে তেমন লোভনীয় কিছু নন। তবু সরকারী চাকুরে বাবার সুন্দরী, তুখোড় ছাত্রী আম্মা, বাড়ির সবার অমতে বিয়ে করে বসলেন আব্বাকে। আম্মার মা, বাবা অনেকদিন পর্যন্ত আম্মার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন নি। আব্বা আর্থিক দিক দিয়ে অসচ্ছলই থেকে গেছেন। গরীবই বলতাম, কিন্তু দাদার রেখে যওয়া বাড়ি আর কিছু ধানী জমি থাকায় দারিদ্র অসহনীয় হয় নি। মার যন্ত্রনা কিন্তু আর্থিক কারনে ছিলো না, ছিলো অন্য খানে। বাবার সীমিত শিক্ষা, আর তাঁর নিজের অসময়ে পড়াশোনার বিরতিই ছিলো অসন্তোষের মুল কারন। আপনি সেটা কত সহজেই বুঝতে পারলেন আর মাকে পড়তে উৎসাহ দিলেন বরং বলা চলে এক রকম বাধ্যই করলেন। যেমন আমাকে করতেন। আপনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সব ব্যবস্থা করলেন। আম্মা তাই আমার সঙ্গেই মানে আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিলাম, তখন বি এ পরীক্ষা দিলেন। আর বেচারা আব্বা চিরকাল গিল্টি ফিলিং নিয়ে কাটালেন।
কিন্তু আপনার আমাদের পরিবারের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হবারই বা কারন কি? আম্মাকে পড়ানোর জন্য অত উতলা হওয়া কি আম্মার জন্যই নাকি আব্বাকে দোষমুক্ত করার জন্য! সেই ছেলেবেলা থেকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনি কাকে দেখতেন মুগ্ধ হয়ে, আব্বাকে? কাকে আদর করতেন, বুকে জড়িয়ে ধরতে্ন আমাকে না আব্বাকে? কিন্তু অতি বুদ্ধিমতি, অতি দয়াবতী রাশিদা, আপনি এক জায়গায় বড় ভুল করলেন। আমিও যে আপনাকে আব্বার চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম তা কি আপনি বুঝতে পারেন নি? নাকি বুঝতে চান নি? রিমিকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাওয়া কি সেই ভয় থেকে বাঁচবার জন্য?”
রাশিদার চিঠি ধরা হাত একটু একটু কাঁপে। শরীর সিরসির করে ওঠে।
“আমার এস এস সি পরীক্ষার ৪ মাস আগে আব্বা মারা গেলেন। শেষের দিকের আপনার ঘন ঘন দেশে আসা কি আব্বার জন্য অতিরিক্ত উত্তেজনার কারন হয়ে উঠেছিলো? না পাওয়ার কষ্ট বেড়েছিলো, নাকি উপরি পাওয়ার মাত্রা টুকু বেড়ে গিয়েছিলো! না আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। ভাগ্য! আব্বা মারা যাবার খবর পেয়ে আপনি একা চলে আসলেন আমেরিকা থেকে। আসবেনই আমি জানতাম। যদিও সবাই অবাক হয়েছিলো কারন আপনি মাস কয়েক আগেই ঘুরে গিয়েছিলেন। আপনি শক্ত হাতে হাল ধরলেন, অলিখিত অভিভাবক হয়ে গেলেন আমার আর আম্মার। আব্বা মারা যাওয়ার পর আম্মা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেলেন। অথচ শেষের দিকে আব্বার সঙ্গে বেশ ঝগড়া হচ্ছিল, বরং ঝগড়ার চেয়ে বেশি। আম্মা আব্বাকে সহ্য করতে পারছিলেন না। আপনার সামনে আম্মা তা দেখাতেন না বরং উল্টাটাই দেখাতেন। তাঁর এই গর্ব টুকুর দরকার ছিলো।
আব্বার মৃত্যুর পর আমাকে বুকে চেপে ধরে হু হু করে কেঁদেছিলেন। আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য না নিজের জন্য? আমার চরম্ পাওয়া আর পরম হারানোর তুমুলতার মধ্যে আপনি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে আম্মা আর আমি মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করব আর পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করব। মিথ্যে বলব না আমি সেবার আপনার বুকে মুখ গুঁজে নিজের জন্যই কেঁদেছিলাম আব্বার জন্য নয়।
আমাদের দুজনের রেজাল্টই ভালো হলো। কলেজে কোথায় পড়ব তাও আপনি ওখান থেকে পরামর্শ দিতে থাকলেন। মাঝে মাঝে আমার বিদ্রোহ করতে ইচ্ছা করত। আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যই যা করতে বলতেন তার উল্টোটা করতে চাইতাম। আপনি বললেন ঢাকায় ভর্তি হতে আই এস সি পড়বার জন্য, আমি ভর্তি হলাম গিয়ে রাজশাহী কলেজে। আর আপনি অমনি বললেন,
“সেই ভালো, বাড়ির কাছেই থাকলে। শানুর জন্য ও সুবিধা হবে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি তে এম এ তে ভর্তি হবে।“
সঙ্গে সঙ্গেই আপনি ব্যবস্থা করে দিলেন। আপনার মামাতো ভাই, রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে। আপনার পরামর্শ ছিলো আমরা রাজশাহীতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব আর মা , ছেলে ‘গভীর মনোযোগের সহিত বিদ্যা চর্চায় নিমগ্ন থাকিব।‘ এবার কিন্তু আম্মা আপত্তি করলেন। বি এ পাশ করে আম্মা নীলফামারী মেয়েদের স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। আম্মা আত্নবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। বললেন, এম এ তিনি প্রাইভেটেই দেবেন। রাজশাহীতে খরচ বেশি আবার আয় কম, স্কুলে চাকুরি নাও পেতে পারেন। তাছাড়া নিজের শহর ছাড়তে রাজী নন। আপনি বললেন টাকার ব্যবস্থা করা যাবে, নাহয় ধার হিসাবেই দেবেন। আম্মা রাজী হলেন না। আমার ইচ্ছা করছিলো পড়া শোনা গোল্লায় দিয়ে ফল খুব খারাপ করে আপনাকে আচ্ছা শিক্ষা দিতে। আপনার কষ্ট মাখা মুখ কল্পনায় দেখে নিজে তৃপ্তি পেতে চাইতাম। কলেজের প্রথম বছরের ফল খারাপ হলো। এবার আম্মা খুব ভেঙ্গে পড়লেন, ভাবলেন তাঁর ওপর অভিমান করে লেখাপড়ায় অবহেলা করছি। ঠিক আছে তাহলে তিনি আর পড়বেন না। এম এ করার দরকার নেই। আমার বড্ড মায়া হলো আম্মার জন্য। এই প্রথম। ইদানিং আম্মাকে নিয়ে কিছু গুঞ্জন শুরু হয়েছিলো। আমি সেসব উপেক্ষা করতে চাইলেও বিচলিত হতাম। আমি বরাবর আব্বার পক্ষে, মনে করে এসেছি আম্মা আব্বার প্রতি অহেতুক নিষ্ঠুর ছিলেন।এই সময় নতুন করে আব্বার কথা মনে করে ভীষন খারাপ লাগত।
আপনিও বললেন,
“তোমার আব্বার কিন্তু তোমাকে নিয়ে অনেক আশা ছিলো। নিজে তিনি যা করতে পারেন নি তোমাকে দিয়ে সে স্বপ্ন সফল করতে চেয়েছিলেন। পারবে না?“
ব্যাস আমার সব অভিমান কোথায় উবে গেলো। দ্বিগুণ উৎসাহে লেগে পড়লাম। এইচ এস সি তে স্ট্যান্ড করলাম। আম্মা পেলেন ফার্স্ট ক্লাস এবং সেটা নিয়ে কথা উঠল। তার প্রফেসরের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে, আবার অনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও।
রেজাল্ট বের হবার সঙ্গে সঙ্গে আপনি উড়তে উড়তে এলেন। আমার রেজাল্টে কে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে চাপা থাকল না। আপনার ইচ্ছা আমি ডাক্তারি পড়ি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়লেই ভালো, না হলে রাজশাহি মেডিক্যাল কলেজও চলবে। আমেরিকায় নাকি ডাক্তারদের খুব কদর। অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্মান ইত্যাদি প্রায় গ্যরান্টিড। আমি ভর্তি পরীক্ষা দিলাম শুধু মাত্র বুয়েটে। প্রচুর পরিশ্রম করেছিলাম ভর্তির জন্য কারন আর কোথাও চেষ্টাই করিনি। আমার বুয়েটে ভর্তির কথা শুনে আপনি কিন্তু আবারও বিরক্তির বদলে মধুর হেসে কংগ্রেচুলেট করলেন,
“খুব ভালো করেছ। বাংলাদেশের সব চাইতে তুখোড় ছেলেরাই তো বুয়েটে যায়। খুব খুশি হলাম।“
তারপর মধুরতম হেসে বললেন,
“তোমার আম্মা’র ব্যাপারে বিব্রত হয়ো না। শানুর মতো একজন মেধাবী, সফিস্টিকিটেক এবং সুন্দরী বিধবাকে নিয়ে কথা না উঠলেই বরঞ্চ ভাবতাম বাংলাদেশের মানুষের কল্পনা খুব সীমিত হয়ে গেছে।“
আরো একবার জানতে দিলেন আমি এখন বড় হয়ে গেছি, আমার ইচ্ছার দাম আছে আর আম্মাকে নিয়ে আমার ম্যাচিওর ভাবে ভাবতে হবে। এবার তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। একটু কি মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন? অজুহাত দিলেন রিমি, ঝিমিরা ফিরে যেতে চাইছে, আঙ্কলের ছুটি ফুরিয়ে গেছে।
আমি কিছুটা প্রতিশোধ নিতে পেরেছি মনে করে যখন খুশি হবার চেষ্টা করছি তখন খুশির বদলে কেমন যেন ভয় হতে লাগলো। সত্যিই যদি আপনি আমার ওপর বিরক্ত হন, যদি আমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক না রাখেন! আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইতে শুরু করলো। কি যে সেই অসহায় অনুভুতি! আপনি কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক ভাবেই লিখলেন,
“তোমার সিন্ধান্ত সঠিক হয়েছে। সারা জীবন যে কাজ করতে হবে সে কাজ অবশ্যই ভালো লাগতে হবে। যা করতে ভালো লাগে না জোর করে তা করা বোকামী। টাকাই তো সব নয়। তুমি বরং এখানে আসতে চেষ্টা কর, এখানেই ইঞ্জিয়ারিং পড়। কোনো কিছুর দরকার হলে নিঃসঙ্কোচে জানিও। এখানকার ইউনিভার্সিটির খবর জানতে চাও ?”
“জানিনা কোন সম্ভাবনায় আমি আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠলাম, আপনাকে ফিরে পাবার নাকি আমেরিকায়, স্বপ্ন রাজ্যে পড়তে যাবার। ওখানে পড়তে যাওয়া মানে আপনার আরও কাছে থাকা, আর আমেরিকায় পড়ার গর্ব। আম্মা খুব একটা উৎসাহী হলেন না। ওখানে আন্ডারগ্রাজুএট পড়া, খরচ সাপেক্ষ। আমি সহজেই আঙ্কেলের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারব কিন্তু টুইশনে কোনো ছাড় পাবনা, আমি তো সত্যিই তার পরিবার নই। আমরা প্রথম বারের মতো আর্থিক স্বচ্ছলতার স্বাদ পাচ্ছিলাম। আম্মার নিজের যোগ্যতায় পাওয়া। আম্মা কারো কাছ থেকে কিছু নিতে রাজী নন। আম্মা নিশ্চয়ই আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন। আপনি জানালেন, কোনো অসুবিধা নেই বুয়েট থেকে পাশ করলে যে কোনো ভালো ভার্সিটিতেই (বিদেশে) পড়া যায়। আর বাংলাদেশে বুয়েটে পড়া তো ধরতে গেলে একরকম বিনে পয়সাতেই। যা খরচ তা শুধু থাকা খাওয়ার। এখানে অত খরচ করে পড়া আসলে বোকামীই হবে।
বছর ঘুরতেই আপনি আসলেন শুধু রিমিকে নিয়ে। দামী কম্পিউটার দিলেন। অন্যান্য জিনিসও প্রচুর। আপনি বরাবরই আমাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতেন, সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। আমরাও কেমন যেনো অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। অপেক্ষা করতাম কবে আপনি এসে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। সেদিন গুলো আমাদের সবচেয়ে আনন্দের ছিলো। আপনাকে ছাড়া কোথাও বেড়াতে যাবার কথা আমি ভাবতেও পারতাম না। এবার কিন্তু আপনি রিমিকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে আশে পাশে থেকে বেড়িয়ে আসতে বললেন। ভুল করেছিলেন। রিমির সতেরো, আমার বিশ যা ঘটবার তা ঘটল না। আমার আকর্ষণ তো অন্য জায়গায়! রিমির ও পছন্দ ছিলো ক্লাসের একটা ছেলেকে, বলেছিলো আমাকে। যদিও জানে না সেইই ‘সোলমেট’ হবে কিনা। রিমি একটা সরল মিষ্টি মেয়ে। আমার কাছে একটা নিষ্পাপ শিশুর মতো। না ওর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় আপনি আসলেন না। খুব খারাপ হয় নি তবু। আগের বার আপনি মোবাইল ফোন দিয়ে গিয়েছেন। অবশ্য না দিলে, কিনতাম। তখন অনেকেরই মোবাইল এসেছে। কথা হতো প্রতি সপ্তাহে। মন্দ লাগতো না। ইমেইলেও কথার আদান প্রদান হতো। আমার কেমন নেশার মতো হয়ে গিয়েছিলো কথা বলাটা। তারপর ফেসবুক। ফেসবুকে তেমন কিছু নয় তবে মেসেঞ্জারে আদান প্রদান চলত দুই একদিন পরপরই। সেগূলো ছিলো মিনিট কয়েকের ব্যাপার কিন্তু তার প্রভাব অপরিসীম। সীমা ছাড়িয়ে ভালো লাগা! মন থাকত উৎফুল্ল। পড়াশোনা ভালো হচ্ছিল। আম্মাকে নিয়ে গন্ডগোল বেঁধে উঠছিল। যার সঙ্গে আম্মাকে নিয়ে এত কথা তিনি বিবাহিত। ততদিনে সম্পর্ক নিয়ে আর সন্দেহ ছিলো না। আম্মা চুপচাপ ছিলেন। আপনি কি আম্মাকে ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন? আমার সঙ্গে অত কথা কি আমাকে অন্য দিকে ব্যস্ত রাখার জন্য? আমার মনকে ভরপুর রাখা?
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি বাংলাদেশে আসলেন। একা। আমার হাতে অফুরন্ত সময়। মনটাও হালকা। পরীক্ষা ভালো হয়েছে। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরির কথা চলছে। আপনি অবশ্য ক্রমাগত তাগাদা দিতে থাকলেন, আমেরিকায় এপ্পলাই করতে ভর্তির জন্য, এসিস্টেন্টশিপ, স্কলারশিপের জন্য। আঙ্কেলের ভার্সিটিতে ভর্তি আর এসিস্টেন্টশিপ দুটোই হবে জানতাম। পরের সেমেস্টারের জন্য সময় ছিলো। আমি গড়িমসি করছিলাম, আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাগজ পত্রের কাজ সম্পন্ন করলেন। আমি আপনার সান্নিদ্ধের জন্যই বস্তুত সব কথা মেনে চলছিলাম। আপনি আমাকে নিয়ে সব জায়গায় যেতে থাকলেন। কাপড়ের দোকান থেকে দর্জির দোকান, জুতার দোকান থেকে সুটকেসের দোকান কিছুই বাদ থাকলো না। এর মধ্যে নতুন নতুন রেস্টুরেন্টে খাওয়া। আমি তখন অনির্বচনীয় আনন্দ স্রোতে ভেসে চলেছি। এর মধ্যে আম্মা বিয়ে করলেন তার ভালো বাসার মানুষকে, রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের তার বিবাহিত প্রেমিককে। চারিদিক ধিক্কারে ছেয়ে গেলো। আপনি হঠাত করে দার্জিলিং বেড়াবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। আমরা চার জন। আপনি কি আগে থেকেই জানতেন যে আম্মা বিয়ে করবেন? আমাকে অত কাছে কাছে রাখা কি সেজন্যই? আমি যত দেখি আপনাকে তত বিস্মিত হই। আর আপনি ততই জড়িয়ে যান আমার স্বত্বায়।“
আরও একবার থামতে হয় রাশিদাকে। উঠে দাঁড়ান। পানি খেয়ে আসেন। বিছানায় বসে চিঠিটা তুলে নেন। এখন আর হাত কাঁপছে না। বুকটাও শান্ত হয়ে এসেছে। কিন্তু মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে —!
“আমি আপনাকে দেখি আর দেখি আমার আম্মাকে। আপনি দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের মতো জলন্ত সুন্দর। গোলাপি রঙ্গে, কোকরানো চুলে আর তরুণীর মতো সুঠাম দেহে। অথচ ভেতরে আপনি অতি শান্ত, স্থির মনের ধীর গতিীর এক নদী, যেখানে অবগাহন করা চলে নিশ্চিতে। আর আম্মা? শ্যামল রঙ্গে অদ্ভুত মায়াবী চেহারা্য, গভীর কালো আয়ত চোখে, আর লোভনীয় শরীর নিয়ে মনে হতো অরন্যের শীতল ছায়া। কিন্তু আম্মার মন ছিলো এক অশান্ত, অস্থির, আবেগে উচ্ছসিত সমুদ্রের মতো। যাকে সংযত করে রাখা বোধহয় আম্মার পক্ষেও সম্ভব ছিলো না। তাই আম্মা আরও একবার সহজের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নিলেন। আপনি আমাকে বোঝালেন সুখি হবার অধিকার সবারই আছে। জীবন্ তো একটাই! এবার আপনি পুরো ৪ মাস থাকলেন। আমাকে কাছে কাছে রাখলেন। আমরা ঝরনার ধারে, পাহাড়ের চূড়ায় ঘুরে বেড়ালাম। সিলেটের চা বাগানে, সুন্দরবনে গেলাম ঘুরতে। রেলে, গাড়িতে, জাহাজে, নৌকায় আপনার কাছাকাছি, গা ঘেঁষে বসে অনেক সময় কাটালাম। আমার দিনরাত্রি একাকার হয়ে গেল আনন্দ আর বেদনায়। দিনের সাহচর্যে রিমঝিম আনন্দের বন্যা আর রাতে্র একাকীত্বে অসহনীয় যন্ত্রনা। কত রাতে মনে হয়েছে সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে ছূটে যাই আপনার কাছে, জড়িয়ে ধরি। শুষে নেই জীবনের সব সুধা!
আপনি কি জানেন আমার বন্ধুরা পেছনে আপনাকে নিয়ে অনেক কথা বলত, আপনার বয়স লুকানো রূপ, আর আমার ব্যাপারে আপনার আধিখ্যেতা দেখে। এবার সবাই সামনা সামনি বলতে লাগলো। আমার বিশিষ্ট দুই বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে সাবধান করে দিলো যে আমি অত্যন্ত জটিল পথে চলেছি, নিজের সর্বনাশ ডেকে আনব। আমার ফেরার কোনো উপায় ছিলো না। পরিনতি নিয়ে আমিও বিভ্রান্ত ছিলাম। আপনার কাছ থেকে দূরে থাকা আমার কল্পনাতীত। কিন্তু আপনি কি ভাবে নিজেকে জড়ালেন। কি পেতেন আপনি আমার কাছে থেকে? আপনি কি শুধু রিমির জন্য আমাকে তৈরি করছিলেন? ছেলেবেলার বান্ধবী্কে, বান্ধবীর ছেলেকে সাহায্য করছিলেন না আরও কিছু ছিলো!”
রাশিদার মাথার মধ্যে প্রশ্ন গুলো ঝঙ্কার তুলল, আর কি ছিলো আর কি ছিলো ? মাথাটা ভারী হয়ে আসছে ! উদাসী মনে আবার পড়তে শুরু করেন।
“আমার দুর্দান্ত দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো। আপনি চলে গেলেন। আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এক মুহূর্তে আমার পৃথিবী চুরমার হয়ে গেলো। আপনি ফোনের পর ফোন করতে থাকলেন আমি নিথর শুয়ে, অবশ চেয়ে থাকলাম ফোনের দিকে। ফোন ধরে আমি কি বলব? প্রায় মাস খানেক অন্ধকার ঘরে কাটিয়ে, বন্ধুদের দয়ায় ওপর নির্ভর করে সবে উঠেছি। এখনও যন্ত্রনা আছে, তবে তীব্রতা কমেছে। আপনার একগাদা চিঠি জমে আছে। কয়েকটা পড়েছি, বাকিগুলো পড়তে ইচ্ছা করছে না। আপনি উতলা হয়ে আছেন কবে যাচ্ছি ওখানে। কিন্তু আমি কেনো যাবো, কার কাছে যা্বো বলতে পারেন? কি আছে ওখানে আমার জন্য? আপনার চমৎকার সাজানো সংসার। কি নিপুন ভাবে সামলিয়েছেন সব। স্বামী, সন্তান! সন্তানেরা চমৎকার মানুষ হয়েছে। সরল, বিনয়ী। পড়াশোনায় মনোযোগী। স্বামী কর্ম ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সজ্জন, সহানুভুতিশীল মানুষ। আপনি তাঁর শরীর, মনের তদারকি করেন, মেয়েদের তাঁর খুব কাছের মানুষ করেছেন। তাঁর জীবন পূর্ণ! আর আমি? আমার জন্য কি রেখেছেন? আপনার জীবনের পরিপাটী করে সাজানো পরিকল্পনায় আমার স্থানটা ঠিক কোথায় বলতে পারেন? পারবেন আমি যা চাই তাই দিতে? এতদিন আমাকে দুহাত ভরে দিয়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত আমাকে সর্বশান্ত করবেন বলেই কি? আমার এত ভালো চান, পারবেন আমার সঙ্গে প্রেম করতে? এত উৎকণ্ঠা আমার জন্য! স্বামী, সন্তান ছেড়ে পারবেন আমার কাছে আসতে? পারবেন আমাকে প্রেমিক করে নিতে?”
চিঠি হাতে রাশিদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকেন শুন্য দৃষ্টিতে, শুন্য মনে!
*************************