You are currently viewing গল্প ক্যারোলিনা || জাকিয়া শিমু

গল্প ক্যারোলিনা || জাকিয়া শিমু

গল্প ক্যারোলিনা

জাকিয়া শিমু

ভেনেজুয়েলার শান্ত শ্যামল ছোট্ট গ্রাম-কঙ্গো মিরাডর। পটে আঁকা ছবির মতো ছিমছাম গুছানো একটি গ্রাম। গ্রামের একপাশে বয়ে চলেছে শান্তধারার জলাধার, কাতাতুম্বা। উত্তরদক্ষিণ পাশ ঢেকে আছে গগন বেধ-করা সুউচ্চ শৈল গিরিতে। বাকি দিকটায় দিগন্ত ছুঁয়া সবুজপ্রান্তর, জঙ্গল,ঝোপঝাড়। উন্মুক্ত খোলা আসমানজুড়ে ক্ষণে ক্ষণে মেঘমালাদের রঙ বদলের হিরিক। গ্রামের মানুষগুলোও সহজসরল, শান্তস্নিগ্ধ বয়ে চলা কাতাতুম্বা নদীটির মতোই।
সেই ছবির মতো গাঁয়ে আমার জন্ম। বাবা আদর করে নাম রাখলেন- ক্যারোলিনা’। আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম সবপ্নের সেই গ্রাম- কঙ্গো মিরাডরে। শান্ত জলেরধারে প্রকৃতির আদরকোলে কাটছিল আমাদের সহজাত গ্রামীণজীবন। আমার বয়স তখন মাত্র ছয় পড়েছে, হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করল জলের মতো স্নিগ্ধসুন্দর ভ্যানিসখ্যাত’ আমাদের কঙ্গো মিরাডর। ধীর গতিতে সবুজ সোনার গ্রামটি তলিয়ে যেতে শুরু করল কাদামাটির গহীন গহ্বরে !

ধীরে ধীরে পাহাড়ভেঙ্গে কাতাতুম্বা নদীর স্রোতের সাথে বয়ে আসা কাদামাটিতে ঢাকা পড়ে যায় গ্রামের প্রায় অর্ধাংশ! তলিয়ে যায় বসতবাড়ি,স্কুল-কলেজ, সরকারি দপ্তর এবং এধারা চলতেই থাকে- বিরামহীনভাবে। আজ এর বাড়ি কাদার-তলে, তো কাল ওর বাড়ির পালা।
একান্নবর্তী পরিবারের মতো বিশাল একবৃক্ষ হয়ে বাস করা একেকটি পরিবার, বৃক্ষশাখা ছিন্ন করে গ্রাম ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তারপরও আমরা মাত্র গোটাদশেক পরিবার মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম – চোখেমুখে একপাহাড় আতঙ্ক নিয়ে। একবুক-আশা স্বপ্ন দেখায়- একসময় আবার ফিরে পাবো আমাদের সবুজগ্রাম, গ্রামের প্রাণচাঞ্চল্য, স্বচ্ছ জলধারা-সবুজ সমুদ্রে বসত গড়বে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কিন্তু ধীরে ধীরে সে স্বপ্ন ক্ষয়ে যায়। দূর পাহাড়ের কাদামাটি উপচে পরে নদীর পরে এবং স্রোতেরধারার তীব্রতা বাড়ে বহুগুনে। চলে যায় গ্যাস, বিদ্যুত ব্যবস্থা এমনকি একমাত্র স্বাস্থ্যসেবার ক্লিনিকটিও অনিশ্চয়তায় তলিয়ে যায়।

আমার জীবনের সবচাইতে কষ্টের দিন ২০১৬ সালের ২১ জুন। আমরা আমাদের গাঁয়ের সাথে নাড়ির বাঁধন ছিন্ন করে চলে আসি পুয়েত্রো কোঞ্চায়, আমার নানার বাড়ি। আমার ৬২ বছর বয়সী দাদু কোনোভাবেই বাস্তুভিটা ছেড়ে আসতে রাজি হননি। তাঁর সাতপুরুষের পদচিহ্ন পড়ে আছে এই গাঁয়ে। রাস্তাঘাট কাদার তলে ডুবে আছে। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এখন নদীপথ, সেটাও ডুবল বলে। দাদু, রাতদিন পরিশ্রম করে কাদামাটি সরিয়ে নদীতে ছোট্ট একটা সরু পথ তৈরি করেন, যাতে কোনোমতে সালতি নৌকো দিয়ে যাতায়াত করা যায়। মৃত্যুর শেষক্ষণ পর্যন্ত দাদু নিজ-গ্রামকে নিশ্চিহ্ন হতে দিবেন না বলে পণ করেছেন। আমিও দাদুর সাথে আমার গাঁয়ে থেকে যেতে জেদ ধরে বসে থাকি। বাবা-মায়ের কাছে অবশ্য সেই আপত্তি টেকে না। আমি বাধ্য হয়ে দাদুকে ছেড়ে নানাবাড়ি চলে আসি।

নানাবাড়ির দিনগুলো আমার জন্যে আকাশ-ভাঙ্গা কষ্ট বয়ে নিয়ে আসে। লোকে বলে কুয়োর ব্যাঙ বেশি পানিতে পড়লে নাকি বাড়বাড়ন্ত হয়, ছলবল করে- আমার বেলায় হয় উল্টো! নানাবাড়ির আধঃশহুরে অনভ্যস্ত পরিবেশ, নতুন স্কুল, দাম্ভিক লোকজন এসবে খাপ খাওয়ানো আমার মতো গাঁও-গেরামে বেড়ে উঠা মেয়ের জন্যে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে ! ওদিকে বাবার হাতে টাকাকড়ি নেই। আমরা অনিকেট হয়ে নানাবাড়ি আশ্রয় নিয়েছি। বাবা কিছুকাল হন্যে হয়ে কাজের খোঁজ করেন এবং ব্যর্থ হয়ে অবৈধপথে চলে যান- উত্তর আমেরিকা।
দাদুর সাথে আমাদের আর যোগাযোগ হয় না। জলপথে মাত্র ঘণ্টা চারেকের পথ- নানাবাড়ি থেকে আমার দাদাবাড়ির দূরত্ব। তারপরও আমার দাদুর সাথে আমাদের আর সাক্ষাত হয় নাই!
কঙ্গো মিরাডর ছেড়ে চলে আসার সময় দাদুর চোখে কোনোরকম স্বপ্নভঙ্গের কিংবা নিরাশার আধিক্য দেখিনি- চোখভরা এক আসমান সমান দৃঢ়চেতা মনোবল এবং অসম্ভবকে সম্ভবে রূপান্তরের স্বপ্নে বিভোর হওয়া চোখজোড়াই শুধু দেখেছি।
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলেছেন,ভরসা দিয়েছেন- শীঘ্রই আবার আমাদের মিলন হবে, আমাদের প্রাণের স্নিগ্ধ শ্যামল কঙ্গো মিরাডরে। দাদা শেষপর্যন্ত হেরে যাননি। কঙ্গো-মিরাডরে তাঁর এক বন্ধুর সাথে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে সংগ্রাম করে গেছেন। শেষমেশ অবশ্য সান্নিপাতিক রোগে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তারও কিছুদিন পর, আমাদের গ্রামটি পুরোপুরি কাদার অতলে হারিয়ে যায়!

বাবা চলে আসার বছর দু’য়েক পর মা, আমি আর আমার ছোটোভাই অবৈধভাবে উত্তর আমেরিকার পথ ধরি। ভেনেজুয়েলা থেকে আমরা মৃত্যুপথে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে টেক্সাসে, বাবার নিকটে ফিরি। বাবা, আমার জীবনের প্রায় পুরোঅংশটাই জুড়ে আছেন। দু’বছর বাবা-ছাড়া বেঁচে থাকা আমার জন্যে আসলেই ভীষণ কষ্টের অভিজ্ঞতা ছিল। আমার জীবনে দু’জন মানুষের ছায়া কিংবা প্রভাব খুব বেশি মাত্রার- বাবা এবং দাদা।
গত দু’বছর সমস্ত ঝঞ্ঝাট ছেঁকে ফেলে একবুক স্বপ্ন নিজের মধ্যে ধরে রেখেছি। বাবাকে আবার খুব কাছের করে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার মতো আপন করে পাবো- এমন কতশত ভাবনা আর অনুরণে এতদিন বুঁদ হয়ে থেকেছি। সারাক্ষণ বাবার গায়ের গন্ধ পেতাম। বাবা কিংবা দাদুর ভাবনায় আমি যখন মত্ত হয়ে থাকি তখন তাদের শরীরের গন্ধ আমার চারপাশের হাওয়ায় ভেসে বেরায়। আমি চোখ বুজে দীর্ঘনিঃশ্বাসে সে-আপনগন্ধ নিজের ভেতরে টেনে নিয়ে বাঁচার শক্তি খুঁজে পাই।

একটা মানুষ যখন একবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সে সম্পূর্ণ ভিন্ন-মানুষ হয়ে ফিরে আসে। আগের সে-মানুষটা চিরতরে হারিয়ে যায়। বাবার কাছে ফিরে এসে তা খুব ভালোভাবে টের পেলাম।
আমেরিকা আসার অনিশ্চিত সেই যাত্রাপথের আতঙ্ক এবং কষ্টটা, বাবাকে ছুঁতে পারবো- এই স্বপ্নটা মনে ছিল বলেই বোধহয় পাড়ি দেবার সাহস করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সবস্বপ্ন সুখের হয় না, দুঃস্বপ্নও যে হয়, তা মেনে নেওয়ার বয়স তখনও হয়ে ওঠেনি আমার। যদিও আমি খুব অল্প বয়েসে জীবনের অযাচিত ভাঙ্গাগড়ার খেলা দেখেছি। একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে আরেকটা স্বপ্ন হাতরে খুঁজে ফিরছি জীবনের আস্বাদ!

অন্ধবিশ্বাস, নিজ-বিশ্বাসকে হত্যা করে। মায়ের বরাবরই বাবার প্রতি অগাধবিশ্বাস ছিল। নিজের চেয়েও বাবার প্রতি তার বিশ্বাস এবং ভরসা ছিল বেশি। কঙ্গো মিরাড’রের দু’কামরার সেই সংসারটা, উত্তর আমেরিকায় সাঁজিয়েগুছিয়ে বাবা আমাদের জন্যে অপেক্ষায় দিন গুনছেন-মায়ের ভাবনাটা এমনতরই ছিল! শুধু মা কেন! আমাদের দু’ ভাইবোনেরও কী ভিন্ন স্বপ্ন ছিল !

সাপ যেমন পুরনো খোলস বদলে ফেলে নতুন খোলসে আবার নতুন করে জীবন শুরু করে, আমাদের বাবা সে অভিরূপ, তার পূবেরজীবনটা বদলে ফেলেছেন! আগের জীবনটা ফেলে এসেছেন- কঙ্গো মিরাডরের কাদামাটির স্তূপে। দু’বছর সময়ের ব্যবধানে আমাদের সুখের স্বপ্নগুলো শ্যাওলার মতো ভেসে ভেসে নিঃশ্বেস হয়ে গেছে !
টেক্সাসে বাবার ঘরে যখন পৌঁছি, বাবার বর্তমান সংসারের মানুষগুলো তখন ঘরে ছিল না ঠিকই কিন্তু তাদের ব্যবহার্য জিনিসপাতি দেখে আমরা নিশ্চিত হই- আমরা এখানে ভাসমান কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়ানো উদ্বাস্তু ! বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠে! আমাদের শতকোটি সুখ-ভাবনারা মুহূর্তে কাঁচের পাত্রের মতো ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়!

জলমগ্ন মানুষ যেমন জলে তলিয়ে যেতে হাতের কাছে যা পায় তা-সে খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়- আমরা সেরূপে দিশেহারা হয়ে বাবার দিকে অসহায়দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকি। মা হয়তো সেমুহূর্তে অনুধাবন করতে পারেন- সংসার টিকিয়ে রাখতে বিদ্যাবুদ্ধি, রূপগুণের চাইতে ঘ্রাণশক্তিটা বড়োবেশি প্রয়োজন ছিল! ততক্ষণে অবশ্য বড়োবেশি দেরি হয়ে গেছে। মায়ের বিষণ্ণ চেহারাটা সহ্য করার শক্তি আমার ছিল না! মাকে সেসময়ে গভীর গর্তে-পড়া নিরুপায় জন্তুর মতো সহায় সম্বলহীন মনে হয়েছিল। ঘরে ঢুকে তিনি পরাভূত মনটাকে শরীরের গভীরে মুচড়ানো কাগজের মতো গুঁটিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বসেছিলেন!

কিন্তু এসবকিছুর পরও বাবা খুব স্বাভাবিক, আয়েশি ভাবভঙ্গি বজায় রেখে চলেন। যেন কিছুই হয়নি কিংবা এমনটাই হওয়ার কথা ছিল! আমাদের মনের আকাশে তোলপাড় করা ভাবাবেগ তৈরি হলেও, বাবাকে কোনোবিষয় নিয়েই প্রশ্ন করি না। নতুন দেশ, অজানার পাহাড়, ইংরেজি ভাষা বুঝি না, পথঘাট সেও অচিন ছিল! ওদিকে দেশে ফিরে যাওয়ার পথও খোলা থাকে না। আমাদের ঠিকানা নেই,আমরা অপাংক্তেয়, আমাদের বসতঘর দখল করেছে দূরদেশের কাদামাটির স্তুপ। যিনি আমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি আমাদের বাবা। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ভিনদেশে এসে তিনিই এখন আমাদের কষ্টের মূলকেন্দ্র হয়ে উঠলেন!

বাবা খুব ভোরে কাজে বের হয়ে যান। আমি সারাদিন ছোটো ভাইকে নিয়ে বাড়ির আশেপাশে ঘুরেফিরে সময় কাটাই। মা, জানালার পাঁশে প্রস্তরমূর্তির মতো বসে সারাক্ষণ আকাশের দিকে স্থাণু-দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন। মায়ের এমন বিষণ্ণ-ম্লান চেহারা আমাদের মনখারাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আরো শতগুণে। মায়ের হরিণীর মতোন চঞ্চল চোখজোড়ায় রাজ্যের ঘনকালো মেঘের ছাইবর্ণ ভর করেছে। বড়ো বিবর্ণ অচেনা লাগে আমাদের মায়ের মুখখানা!

বাবা খুব কম সময়ের জন্যে রাতে বাড়ি ফিরেন। আমাদের সাথে দায়সারা কথাবার্তা সেরে বিছানায় চলে যান। আমি, মা এবং ছোটভাই একরুমে একসাথে ঘুমাই। আমার এবং মায়ের ঘুম হয় না যদিও দু’জন দুজনের কাছে তা গোপন করতে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি। বাবা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের থাকা-খাওয়ার অ-ব্যবস্থায় রাখেন নাই। কিন্তু আমাদের ওসবের বোধহয় খুব একটা প্রয়োজন ছিল না, যতোটা না বাবাকে ছিল। দেশে, শেষের দিকের সময়গুলোতে আমরা খাওয়া পরায় খুব কষ্টে ছিলাম। ভরপেটে একবেলা খাওয়ার যোগার ছিল না, একথা সত্য কিন্তু তাই বলে কখনো এতোটা অসহায়বোধ হয়নি !

সময়ের ঝড়কে ঠেকাবার কৌশল সৃষ্টিকর্তা হয়তো মানুষের হাতে দেননি। ঝড়ের তাণ্ডবে বাবা পুরোটাই বদলে গেছেন। কেউ বদলে গেলে তাকে আগলে রাখা যায় না, সে চেষ্টা করার ফল বৃথা হয়। মা অবশ্য সে চেষ্টা করলেন এবং ব্যর্থ হলেন। ফলাফল যা ধারণা করেছিলাম তারচেয়ে বরং বেশি হল।

বাবা-মা আলাদা হয়ে গেলেন। বাবার অবশ্য এমন পরিকল্পনা ছিল যদিও মায়ের দিক থেকে সামান্য উছিলা খুঁজছিলেন। যা হোক,আমি ভাগ হয়ে গেলাম। মা, আমাকে একলা করে আমার একমাত্র খেলারসাথী ছোটো ভাইটিকে নিয়ে নিউইয়র্ক চলে গেলেন। মায়ের কাছের পরিচিত কেউ এদেশে নেই। মায়ের দেশ- পুয়েত্রো কোঞ্চার এক প্রতিবেশী অনেককাল আগে এদেশে মাথা গুঁজেছেন। মা তার ঠিকানায় যোগাযোগ করলেন। তার সামান্য ভরসায় মা একদিন আমাকে রেখে চলে যেতে বাধ্য হলেন! নিউঁইয়র্ক-এ মা কাজের খোঁজ পেলে আমাদের জন্যে একটা নির্ভার সংসার করবেন। তখন মা, আমি আর আমার ছোট ভাই একত্রে থাকব। আমাদের সুখভরা এক সংসার হবে। সে আশ্বাসে আমি বাধ্য হয়ে থেকে গেলাম বাবার সংসারে।

বাবার সংসারে আমার সৎ মা এবং তার দু’সন্তান যুক্ত হল। স্থানীয় স্কুলে বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্বপ্নহীন একটা জীবনকে আমি টেনেহিঁচড়ে বইয়ে নিতে শুরু করলাম। বাবা খুব ব্যস্ত থাকেন। রাতে বাড়ি ফিরলে স্কুল বিষয়ে দু’চারটে যা আলাপ হয়, এরবেশি কিছু নয়।
মায়ের সাথে আমার মাসে দু’একবার বাবার ফোনে কথা হয়। ফোনটা নিয়ে আড়ালে বসে মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় না। সকলের সামনে স্বল্প সময়ের জন্যে মায়ের সাথে কথা বলতে হয়। বাসার বাদবাকিরা খুব দরকার না হলে আমার সাথে কথা বলে না। স্কুলেও একই অবস্থা। আমি সবেমাত্র ইংরেজি শিখতে শুরু করেছি আমার উচ্চারণ মোটেও যুতসই না,অন্যান্যরা আমাকে এড়িয়ে চলে। আমাকে নিয়ে আড়ালে আবডালে হাসে, কৌতুক করে। আমি অপমানে ব্যথিত হই, ছটফট করি। আমার মনের গহীনে ফুলের স্তবকের মতো না-বলা কথারা জমা হতে থাকে!

অতিরিক্ত অবহেলা আর অবজ্ঞায় মানুষের মধ্যে নির্বাকতার সৃষ্টি হয়, যা আমার মধ্যে হয়েছে। ধীরে ধীরে আমার কাছে মানুষের উপস্থিতি অসহ্য ঠেকে, কথা বলতে একদম ইচ্ছে করে না এমনকি প্রয়োজনীয় কথাও। কোনোকিছুতে আকর্ষণবোধ করি না। ক্রমশ আমার মধ্যে নিস্পৃহ নিরাসক্তির একটা আবরণ গড়ে উঠে। আমার এসব পরিবর্তন আমার ক্লাস শিক্ষককে বেশ ভাবিয়ে তুললে সে কাউন্সিলরকে জানায়। এবং স্কুলে আমাকে বিশেষ নজরে নিয়ে কাউন্সিলিং করা হয়।
স্কুলের কাউন্সিলর, মিস পার্কলার আমার সাথে বেশ কবার মিটিং করেন। মিস পার্কলারকে অবশ্য আমি খুব পছন্দ করি। স্বল্পভাষী, যে-কারো চোখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতররের সমস্তটা পড়ে ফেলার আশ্চর্যরকম শক্তি তাঁর মধ্যে রয়েছে। তিনি খুব চমৎকার করে হাসেন। আত্নপ্রসাদপূর্ণ হাসি। যখন হাসেন শুধু মুখ নয়,সর্বাঙ্গ হেসেদুলে ওঠে।
আমার মা অবিকল তাঁর মতো করে হাসতেন। পার্কলার যখন হাসেন আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। তাঁর মধ্যে মায়ের ছায়া খুঁজি। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। তাঁর আন্তরিকতার প্রাবল্যে আমাদের মধ্যে ছাত্র – শিক্ষক সম্পর্কটা ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে দাঁড়িয়ে যায়। আমি আমাকে পুরোটাই তাঁর কাছে খুলে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। জীবনের বাস্তব টুকরো টুকরো নির্মম সত্যকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার কৌশল রপ্ত করতে আমাকে সে বিশেষভাবে সাহায্য করে। জীবনের সেই চরম ক্ষণে বাস্তবতার সাথে আমার সখ্যতা অনেকটাই সহজ হয়ে উঠে। আমি স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ফিরে পাই। জীবন আসলেই আনন্দময়’ চরম এ-সত্যের সাথে আমি নতুন করে সম্পর্ক গড়ি।

পার্কলারের মাধ্যমে আমার মায়ের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। মা, নিউইয়র্কের একটা হোটেলে হাউজ কিপিং করেন। কঠিন কষ্টের কাজ। মা, জীবন নিয়ে মহাকষ্টের যুদ্ধে নেমেছেন। আমাকে আরও বছর দু’য়েক অপেক্ষা করতে বলেন। আমি মায়ের সান্নিধ্য পেতে, ছোটো ভাইটাকে আদর করতে মুখিয়ে থাকি। কতোদিন ওদের আমি ছুঁয়ে দেখি না। মাকে ছেড়ে আমি এর আগে কখনো একা থাকিনি। ওদের কাছে চলে যেতে আমার খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু বাবাকে রেখে মায়ের কাছে চলে যাওয়ার ভাবনা মাথায় এলে স্বপ্নগুলো,বাতাসে উড়ে যাওয়া ছাইয়ের মতো কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। বাবাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া কিংবা মায়ের ভালোবাসার আঁচল উপেক্ষা করা – যেকোন একটাকে বেছে নেওয়া আমার জন্যে বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে। আমি নিজের সাথে নিজে অবিরত যুদ্ধ করি। সুতোর টানাবিহীন ঘুড়ির মতো দিকশূন্য দিশেহারা হয়ে পড়ি।

এরপর অনেকগুলো বছর কেটে যায়। আমার কষ্টগুলোর পরিধিও বেড়ে যায় বহুগুণে। আমার মনের বেলাভুমিতে সমুদ্রতরঙ্গের মতো অবিরত আছড়ে পড়ে বিশুদ্ধ একাকীত্ব!

মা, নতুন করে ঘর বেঁধেছেন, তাও বেশ ক’বছর হল। আমার সাথে মা-ভাইয়ের বারকয়েক দেখাও হয়েছে। আমার অবশ্য মায়ের কাছে আর ফিরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মা তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেন নাই। মায়ের শুধু আমাদের দু-ভাইবোনকে নিয়ে সেই স্বপ্ন-সংসার, স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে।
বাবার মতো মায়ের বর্তমান সংসারেও হরেকরকম যোগ-বিয়োগের খেলা জমে উঠেছে। মায়ের বর্তমান স্বামীর আগের ঘরের তিন সন্তান, আমার ছোট ভাই এবং মায়ের নতুন সন্তান নিয়ে তাদের মিশেল-সংসার।
বাবার সংসার এখন অবশ্য আর আগের পর্যায়ে নেই। আমার সৎ মা, কয়েক বছর বাবার কাছে থেকে একসময় বিরক্ত হয়ে বাসা ছেড়ে চলে যান। প্রথমে তারা আলাদা থাকলেও একসময় তাদের সংসার ভেঙ্গে যায়। এরপর বাবার সেই স্ত্রী অর্থাৎ আমার সৎ-মা ভিন্ন সুখের খোঁজে অন্যত্র সংসার নামের খেলা খেলছেন। অবশ্য বাবার সাথে বাবার সেঘরের দু’সন্তান রয়ে গেছে। বর্তমানে বাবার এক নতুন বান্ধবীকে প্রায়ই বাবার বাড়িতে দেখা যায়। অচিরেই হয়তো বাবা নতুন বান্ধবীকে নিয়ে আবার আরেক সংসার পেতে সুখের খোঁজ করবেন।
আর এই আমি, চূড়া-ভেঙ্গেপড়া পাহাড়ের মতো এখনো নিঃসঙ্গ একা দাঁড়িয়ে আছি। অবশ্য আমারও একার একটা চমৎকার সংসার হয়েছে। যেথায় আমি মাঝেমধ্যে ভরা-পূর্ণিমার সাদা জোসনাফুল হয়ে সুখ-সমুদ্রে অবগাহন করি, কখনো আবার সুতীব্র দহণে পুড়ে-যাওয়া বাল্যকালের অপূর্ণ-ইচ্ছের কান্নাগুলোর সাথে রাত্রি জেগে রই !
**********************