You are currently viewing গল্পে তাঁর সমাজ বাস্তবতা > লাবণী মণ্ডল

গল্পে তাঁর সমাজ বাস্তবতা > লাবণী মণ্ডল

 

গল্পে তাঁর সমাজ বাস্তবতা

লাবণী মণ্ডল

 

কথাশিল্পী নাসরীন জাহান। ছোটগল্পে তাঁর পথচলা শুরু আশির দশকে। যে যাত্রা অব্যাহত চলছে। গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। ভাষাশৈলী-শব্দশৈলীতে এসেছে নতুনত্ব; লেখালেখিতে রেখেছেন সব্যসাচী ভূমিকা। কবি হিসেবেও তাঁর অবদান প্রশ্নাতীত। পাঁচটি গল্পগ্রন্থের পর তিনি লিখতে শুরু করেন উপন্যাস। ধ্রুপদী কথাবস্তুর নৈপুণ্যে স্থৈর্য আবার নেরেটিভ-অ্যান্টি নেরেটিভের দ্বন্দ্ব সমন্বয়ে নিজেকে তিনি ক্রমাগত ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এটা নাসরীন জাহানের কথাসাহিত্যের অন্যতম একটি দিক। 

নাসরীন জাহানের গল্পের এ বিশাল ভাণ্ডার জলধি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে গল্পসমগ্র-১ প্রকাশিত হয়েছে। গল্পের ভেতর কাব্যিকতার ঢঙ ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। সেখানে তাঁর কবিসত্তার দেখা পাওয়া যায়। এ ছন্দময়, গতিময় গল্পবলার মধ্য দিয়ে পাঠক সহজেই গল্পের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারে। মানুষ মানুষকে পাঠ করতে চায়, জানতে চায়; এর অন্যতম মাধ্যম গল্প। আদিকাল থেকেই আমরা ইতিহাস জানার জন্য গল্পের দারস্থ হয়েছি। 

আলোচ্য বইটিতে দাহ গল্পে তিনি হাফিজের অদ্ভুত জীবনের চিত্রপট তুলে ধরেছেন। যেখানে হাফিজের রয়েছে মানুষফোবিয়া। মানুষ দেখলে তার ঘুম পায়; কিন্তু কুকুর-বিড়ালের যাতায়াত তাকে ভাবিত করে, পলকহীনভাবে তাদের চলাফেরা অবলোকন করেন। যেখানে আঞ্চলিকতার টান প্রয়োজন, সেখানে সেটি প্রয়োগ করেছেন। কথোপকথনে রয়েছে সাবলীলতা। অতিরঞ্জন চোখে পড়েনি, যা পাঠককে বিব্রত করে তুলবে।

ওই গল্পে তালুকদার আর খাঁ বাড়ির দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন। যেখানে তালুকদারের সঙ্গে শত্রুতার প্রেক্ষিতে সবাই খাঁ বাড়িকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় লিপ্ত থাকে। হাফিজ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। গোলাঘরে কে আগুন লাগাল, কেন লাগাল- হাফিজ শুধু নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকে। মানুষগুলোর ফিসফাস শুনে। কখনও ইচ্ছে জাগে হুঁকো খাওয়ার। 

হাফিজ কিছু বোঝার আগেই এই চক্রে পড়ে যায়। ফেঁসে যায়। দুবির্ষহ হয়ে পড়ে জীবনচক্র। দুবির্ষহ এক ফাঁদে নিজের জীবন অসহনীয় হয়ে পড়ে। শুরু হয় রাজনীতির খেলা। যা আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র। এ চিত্রপটে আমাদের পথচলা। আমরা দেখি দোষীরা পার পেয়ে যায়, নির্দোষেরা যুগের পর যুগ জেলে পচে-গলে মরে। গল্পে পাঠকের সামনে সেই বাস্তবতাই উপস্থাপন করেছেন লেখক।

গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে হয় অল্প কথায় লক্ষ্য স্থির বা বক্তব্য ঠিক রেখে ঘটনা পরম্পরা তুলে ধরা, আর এর মধ্য দিয়ে পাঠকের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। আমাদের গল্পসাহিত্যে পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারার বড়ই অভাব! পাঠকি তখনই আকৃষ্ট হবেন, যখন তিনি ওই গল্পে নিজেকে বা নিজের বাস্তবতা খুঁজে পাবেন। নাসরীন জাহান ঠিক সে কাজটিই করেছেন। অল্প কথার ভেতর দিয়ে সমাজ বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন। পাঠকের ভেতরের বোধকে জাগ্রত করেছেন।

পরগাছা গল্পে তিনি দেখিয়েছেন, গৃহকর্ত্রীর আদেশমতো বাজার থেকে এক বস্তা চাল এনে বারান্দায় রেখে যখন নাদের আলী হাঁপাচ্ছে, তখনই এক ঝলক আলোর মতো বারান্দায় আসে নীলা। একরাশ প্রশান্তিতে ভরে যায় নাদের আলীর বুকটা। নীলা ভেজা চুল আঁচড়ে বলে, কী হে প্যারাসাইট! খুব কষ্ট হচ্ছে? নাদের আলী দাঁত বের করে ফিক করে হেসে দেন। যেন এ প্রশ্নটির জন্যই অপেক্ষা। এ দৃশ্যপটটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন টিভি স্ক্রিনের সামনে বসে দেখার অনুভূতি! শব্দ-বাক্য-ভাষা মিলিয়ে এক মেলবন্ধন তৈরি হয়। 

পুরুষ গল্পে নাসরীন জাহান গ্রামীণ সমাজকে তুলে ধরেছেন। মেঘের ছায়া। উঠোনে নরম রোদের মায়া। উঠোনভরা প্রকৃতিঘেরার বর্ণনা। যেখানে রয়েছে ডালিমগাছ। যে গাছের ছায়া রোদের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। ছায়ার সঙ্গে রোদের গভীর মিতালী। এভাবে বুলু নামে একটি চরিত্র দাঁড় করানো হয়েছে। বুলু-শেলীর চরিত্র নিয়ে গল্পটি এগিয়েছে। একলা বাড়িতে শেলীর যৌবনদীপ্ত চেহারা বুলুকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু বুলু নির্বাক। বুলু আকাশপানে তাকিয়ে দেখে, চিল উড়ছে। মেঘরা ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি নেই। 

বুলুর মা রান্না করছে। লাকড়িতে ফু দিচ্ছে। ফুঁত ফুঁত শব্দ হচ্ছে। শেলী পায়জামার ফিতে কামিজ উঠিয়ে শক্ত করে বাঁধছে। বুলু অবলা প্রাণীর মতো দেখছে। বুলু নির্বাক হয়ে ভাবে, আমি কি পুরুষ? এমন অবশ অনুভূতি হচ্ছে কেন? এই বর্ণনাভঙ্গি অভিভূত হওয়ার মতো! গ্রামে বাস করা এই উঠতি যুবক-যুবতীর বেড়ে ওঠার যে চিত্র দেওয়া হয়েছে, তা থেকে পাঠক সহজেই গ্রামীণ সমাজের একটা চিত্র পাবেন। নারীর ভেতর পরিবর্তন। পুরুষের শরীরের বিভিন্ন অদল-বদল; এ যেন প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া। যে বর্ণনা প্রাঞ্জলভাবেই দিয়েছেন লেখক।

বালিকা রমণী গল্পে রয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির বর্ণনা। একটি বিষপিঁপড়ে যে গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে কিংবা তেলাপোকা। তা এ রকম বই পাঠ করলে উপলব্ধি করা যায়। তার বর্ণনার ভঙ্গিতে প্রাণের সঙ্গে প্রকৃতির অপূর্ব সম্পর্ক উপলব্ধি করা যায়। 

দুপুর-খটখটে আকাশ। গনগনে সূর্য। উষ্ণ রাস্তা। ঝুল বারান্দা। চৈত্রের দুপুরের বর্ণনা টানতে গিয়ে তিনি খটখটে আকাশকে দেখিয়েছেন। এটি তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। ভেতর থেকে উপলব্ধি করার বিষয়। যেখানে প্রাণহীন পৃথিবী গড়ে উঠার প্রচেষ্টা চলছে, সেখানে এ রকম প্রাণের প্রতি দরদ দিয়ে লেখাটাও প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা। 

শহরের রাস্তা। ময়লার স্তূপ। এক টুকরো আশ্রয়ের জন্য মানুষের ফেরা। চড়চড়ে ময়লার আস্তর পড়া কাঁথার নিচে পথশিশুদের আশ্রয়। কত যেন শান্তির ঘুম… আহা! এগুলো তো আমরা এ শহরে প্রতিনিয়ত দেখে থাকি, সেটিই লেখক তুলে ধরেছেন। যেখানে সুখের সঙ্গে ক্লান্তিবোধ। অবসন্নতা। চোখ বুঝে আসা। নিরবচ্ছিন্নতার চিত্র। এসব চিত্রপটকে শব্দভাণ্ডার দিয়ে যেভাবে সাজিয়েছেন, তা যে কোনো গল্পপ্রেমী পাঠকের মনে ছাপ ফেলবে। 

চরিত্রের খাতিরে কখনও মানুষকে বেছে নিয়েছেন। কখনওবা পিঁপড়ে-গাছগাছালি-শহরের ফুটপাত এবং গ্রামের ওই পুকুর-খালবিল। একটি চরিত্রকে দিয়ে অনেকগুলো চরিত্র দাঁড় করিয়েছেন। যাতে পাঠক সাবলীলভাবে শেষঅব্দি এগিয়ে যেতে পারবেন। গল্পে কল্পনার বেগ থাকে; কিন্তু সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা জরুরি। তা না হলে গল্প ডালপালা মেলে মূল বিষয় থেকে সরে যাবে। এখানেই গল্পকারের বিশিষ্টতা। 

এ বইয়ের গল্পগুলো মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা, তার উত্থান-পতনকে চিত্রিত করে। হয়ত মনে হবে, গল্পকার আমার জীবন লিখে ফেলল না তো! মানব জীবনের নানা রকম ছোটখাট সংঘাত ও ভালোলাগা, ভালোবাসার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায় এসব গল্পে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় সমাজের হাহাকার, মানুষের হৃদয় স্পন্দনের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আঁচ করা যায়।

গল্পকার সংলাপের ভঙ্গি, বর্ণনার ঔজ্জ্বল্য এবং কখনো ইঙ্গিতময়তার বৈশিষ্ট্যে কাহিনিকে পাঠকের অন্তরে স্থাপন করেন। কথাশিল্পী নাসরীন জাহান গল্পসমগ্র-১ বইয়ের গল্পগুলোতে সেটিই দেখিয়েছেন। সমাজের অবক্ষয়, প্রাণের প্রতি অবিচার, প্রকৃতিকে ধ্বংসলীলায় মত্ত হওয়ার যে চিত্র তিনি উপস্থাপন করেছেন সেটিও এক প্রতিবাদের ভাষা। এ প্রতিবাদ কখনও এক কলমের খোঁচায়, কখনওবা মিছিলে-স্লোগানে।কখনো সরব, কখনো নীরব। লেখক এখানে গল্পের ঢঙে সমাজ-রাষ্ট্রের চিত্রকে উন্মোচন করেছেন। প্রাণ-প্রকৃতির সম্মিলন ঘটানোর প্রয়াস পেয়েছেন।

৩৭৪ পৃষ্ঠার এ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী আইয়ুব আল আমিন। বইটির গায়ের মূল্য ৬৫০ টাকা। 

 

লেখক পরিচিতি :

লাবণী মণ্ডল, জন্ম টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। সবুজের মাঝে বেড়ে ওঠা এ লেখক ভালোবাসেন প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের গল্প বলতে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রকাশনা শিল্পে। তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে সাহিত্য ও বই আলোচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যে তাঁর সম্পাদনায় পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

**************************