গত ২০ বছরে ঢাকার থিয়েটার
বিপ্লব বালা
‘আমার স্বপ্নে কোনো বাস্তব ছিল না
তাই বাস্তবে নেই কোনো স্বপ্ন’
– শঙ্খ ঘোষ
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার শুরু। দল বা গ্রুপ গঠন করে তা হয়। তার আগে গত শতকের ৭২ সালে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় তার বীজতলা রোপিত হয়। ‘ব্যতিক্রমী’, ‘নিরীক্ষাধর্মী’ অভীধায় ভূষিত নাটক ও নাট্য রূপায়ণ হয়। তাকে বলা যায় তারুণ্যের এক বিস্ফার! নাটকের খোলনলচের বদল তাতে ঘটে। বিষয়, রূপ-রীতি, প্রয়োগ অভিনব হয়ে ওঠে। নতুন দেশ-সমাজের টাটকা স্বপ্ন, সজীব তাকদ যুদ্ধফেরত তরুণদের মনে। মঞ্চে তা বিবিধ-বিচিত্র রূপ নেয়। দল গঠন করে নাটক হতে থাকে নানা ধরনের- দৈনন্দিন বাস্তবতার নানা সংকট সামাজিক দায় হিসেবে মে আসে; বাংলা ভালো নাটকের অভাব হেতু নানা ভাষার অনুবাদ-রূপান্তর করা হয়- সেখানে বর্তমান জীবনেরই প্রকাশ ঘটে; রঙ্গ-ব্যঙ্গ-কার্টুন চালেও দিনানুদৈনিক ধরা পড়ে। শ্রেণিসংগ্রামের ডাকও দেয়া হয় মে । বিচিত্র বিষয়ের সঙ্গে মে তার রূপায়ণের নানা প্রয়োগ-নিরীক্ষা চলতে থাকে গত শতকের শেষ তিনটি দশক। বিশেষত দিল্লির নাট্যবিদ্যালয় থেকে স্নাতকগণের হাতে বাংলাদেশের মঞ্চের চেহারাসুরত, হালহকিকত বদল ঘটে। আশির দশকে ঢাকা থিয়েটার ও সেলিম আল দীন দেশজ বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির নানা ধরনের প্রয়োগ করে চলে। নিজস্ব থিয়েটার রূপায়ণের ঘোষণা দিয়ে। তাতে করে আখ্যান ও তার প্রকাশের নানা রীতির প্রবর্তনা। বিষয়ের সঙ্গে ক্রমে প্রয়োগের শিল্পনন্দন থিয়েটারে অধিক লক্ষ্যগোচর হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চকিত রাজনীতি ও সমাজভাবনা ক্রমে অবসিত হয়। ম ভাষার এক সৃজন মাহাত্ম্য অধিক গ্রাহ্য হয়, মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। থিয়েটারের শিল্প হয়ে ওঠার আদি দায়ের কথা মান্যতা পায়।
গত শতকেই বাংলাদেশের থিয়েটার তার চারিত্র্যের অভিমুখ খুঁজে নেয়। গুণী সব নাট্যকার-অভিনেতৃ-নির্দেশক-দর্শকের সৃজনকল্পনা রূপায়ণে।
বাংলাদেশের থিয়েটারে বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশী বীরনায়কগণ মে নানা অভিভবে হাজির হযেছে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ‘থিয়েটার’ প্রযোজনায় মুক্তিযুদ্ধের পথিকৃৎ নাট্যরূপায়ণ। সেই ধারা আজও বহমান। দুইশত বছর পূর্বকালের কৃষকবিদ্রোহী ‘নূরলদীন’ উঠে আসেন। ব্রিটিশ লাইব্রেরির দস্তাবেজ ফুঁড়ে, সৈয়দ শামসুল হকেরই রচনায়। তাঁকে আশির দশকে বাংলাদেশি মুক্তিযুদ্ধ-হনন বাস্তবতায় অন্বিত করে ঘোষিত হয়- জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়। সে ডাক হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা’রই পূর্বসূরী রণনির্ঘোষ- যখন কিনা ‘জয় বাংলা’রও সমূহ পর্যুদস্তু-দশা। সেলিম আল দীনের ‘কেরামতমঙ্গল’ নাটকে বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী ও মনি সিংহ বঙ্গনায়ক বেশে উপস্থিত হন। এছাড়া বরিশালের অখ্যাত গ্রামের স্বশিক্ষিত অভীক সত্যসন্ধানী আরজ আলী মাতুব্বর নাট্যকেন্দ্র প্রযোজিত নাটকে দৃশ্যকাব্যের নায়ক হয়ে ওঠেন। এছাড়া চিরকালের সত্যসন্ধিৎসার আর্কেটাইপ ‘সক্রেটিস’ শিশিরকুমার দাস মারফত এবং বিজ্ঞানীপ্রবর ‘গ্যালিলিও’ ব্রেশট মারফত মে অবতীর্ণ হন-সমাজবাস্তবতার নিহিত নাট্যদায়ের চারিত্র্য মেনে। বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন’ও রূপায়িত হয়।
গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপও গত শতকে শুরু হয়- রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বোন’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘তোতা কাহিনী’, সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ নামে, হুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বা হাওয়ার্ড ফাস্টের ‘স্পার্টাকাস’ বা মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’। রবীন্দ্রনাট্য‘অচলায়তন’ই রবীন্দ্রনাটকের প্রথম সমর্থ প্রযোজনা বাংলাদেশে; বর্ণনাত্মক আখ্যাননাট্য অভিধায় সেলিম আল দীন এ ধারার সূচনা করেন গত শতকের আশির দশকে- যার অনুবর্তন আজও মে চলছে।
গত ২০ বছরের নাট্যপ্রবণতা বলতে- ১. অনুবাদ ও রূপান্তর, ২. বর্ণনাত্মক আখ্যান, ৩. নায়কোচিতজনের জীবনী, ৪. উপন্যাসের নাট্যরূপায়ণ, ৫. মুক্তিযুদ্ধ, ৬. প্রান্তজন নাট্য আর সবশেষে ৭. সমাজবাস্তবতা বা বিশ্বরাজনীতি- বিষয় হিসেবে অনুস্যুত; প্রকাশরীতি-প্রবণতার দিক থেকে বাস্তবসম্মত, চরিত্রানুগ অভিনয় প্রায় অবসিত; তার বদলে বর্ণনাত্মক আখ্যাননাট্য হিসেবে বিচিত্র রূপারোপের প্রাধান্য। বিষয় তত নয়, রূপায়ণ বা টেকনিকের নানা রীতির উদ্ভাবন; বর্তমান সমাজবাস্তবতা ও রাজনৈতিক কোনো প্রবণতার ক্রমহ্রাসমানতা; রাজনীতির সরল ছক থেকে নিষ্ক্রমণ যেমন ক্রূর, জটিল-কুটিল বাস্তবতায় মানব অস্তিত্বের সত্তাসংকট থেকে বিমুখতা বা স্বেচ্ছানির্বাসন নান্দনিকতার আড়াালে আত্মরক্ষা- তাতে করে থিয়েটার আর তেমন সামাজিক ক্রিয়া হয়ে ওঠে না বা ব্যক্তিসত্তার গহন আত্মনাট্যও নয়, যাতে অভিনেতৃ-দর্শক সনাক্তিকরণ বা সাক্ষাৎ করতে পারে নিজেদের ভয়াবহ টালমাটাল দশা- নিজেদের তেমন খুঁজে পাওয়ার, প্রকাশ করার চির নাট্যনন্দন অধরা হয়ে পড়ে- বাজারের অনুরূপ নানা রূপের, রীতির মায়ায় বিভোর হয়ে। কঠিন কোনো সত্যের মুখোমুখি যাতে না হতে হয়। দৈনন্দিন জীবনে নিজের থেকে পলাতকদশা যেমন আমাদের নিয়তি, শিল্পেও তার অনুগমন চলে, সত্যসন্ধিৎসার কঠিন নন্দনদায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
জীবন ও বাস্তবতার কঠিনের মুখোমুখি হবার সেই সাহস-শক্তি-সামর্থ কেবল নাট্যজনের নয়, অন্য কোনো মাধ্যমেরও যেন তেমন নেই আজ- একমাত্র চিত্রকলাই হয়তো যথাসাধ্য সম্পন্ন করছে নান্দনিক সে বীর্যবত্তা- মাধ্যমগত সমর্থন তার সহায়ক হয়েছে বোধকরি।
দেশজোড়া এক নির্বীর্য, নপুংশক বন্ধ্যাদশা চলছেÑ ক্ষমতার লাগামছাড়া যথেচ্ছাচার এক আতঙ্কপান্ডুর অন্ধ-মূক-বধিরদশায় এনে ফেলেছে মানুষজনকে- বিপন্ন-বিষন্নতায় দিশেহারা, অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ছেড়েছে-বাজার-উন্নয়নের রণডঙ্কা সহযোগে। ভয়ের এতটা পঙ্গু, বিকলাঙ্গদশায় মানুষ ইতিহাসে আগে কখনো পড়ে নি বুঝি। তবে এ হয়তো এক বিশ্ববাস্তবতা, সভ্যতার একটা পর্যায় ধ্বংসপ্রায়। কোনো আশা-বিশ্বাস-স্বপ্ন-আদর্শনীতির সমূহ অবসিতি বুঝি-বা। ‘মানুষের উপায় কী বলো- এই আর্ত সংকটানুভব তো শিল্পনন্দন-মননে প্রথমে অনুভূত হয়- সেই লক্ষণও যেন কোথাও মিলছে না- অন্তত এদেশে নাট্যজনের চেতনবিশ্বে।
তবু গত ২০ বছরে মোটের উপর সমর্থ, দায়সম্পন্ন প্রযোজনার কিছু সুলুকসন্ধান করা যাক।
অনুবাদনাট্যে বিশ্ব ক্ষমতা-রাজনীতির বীভৎস, ভয়াল তান্ডবদশা ‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’ (সিএটি)-এর বেশকিছু প্রযোজনায় সমর্থ নাট্য-ইডিয়মে ধরা পড়েছে। ‘ম্যাকাব্রে’, ‘অ্যাম্পিউটেশ’, ‘দি মিশন’ তেমনি বিশ্বকুরূপনাট্য হয়ে উঠেছে। যদিও তাদের বৈদেশি স্পন্সর এতে লাগসই প্রণোদনা হয়েছে। তবুও কামালউদ্দিন নীলুর সৃজন-সামর্থ্য তারিফযোগ্য।
‘ঢাকা থিয়েটারে’র সেলিম আল দীনকৃত ‘নিমজ্জন’ সভ্যতাজোড়া বিশ্ব গণহত্যার নাট্যদলিল হতে পেরেছে নাসির উদ্দিন ইউসুফের সৃজনমাহাত্ম্যে- যদিও তাদের এযাবৎকালের বর্ণনাত্মক আখ্যানরীতির ঘোষিত নীতির বিপরীত নাট্যমুদ্রায় তার রূপায়ণ। এছাড়া প্রাচ্যনাটের রবীন্দ্রনাট্য ‘রাজা’র নবভাষ্য প্রয়োগ বিশ্বরাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা রূপায়ণ করেছে, রবীন্দ্রনাথের ভিন্ন বোধ-অভিভব তাতে হয়তো অতিরেক ব্যাখ্যান আরোপণ হয়ে উঠেছে- তবে কালের উদ্বর্তনে রবীন্দ্রনাট্যের এক সম্প্রসারণ হয়ে উঠেছে ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ প্রযোজনা। নির্দেশক আজাদ আবুল কালামের সৃজন-স্পর্ধা কুর্ণিশ করতে হয়। একালের এক বিশ্বরণননাট্য হয়ে উঠতে চেয়েছে অভিনব নাট্যমুদ্রায়- মূলের আন্তর-সংহতি তাতে ব্যাহত হলেও।
‘থিয়েটারে’র রবীন্দ্রনাটক ‘মুক্তধারা’ও নায়লা আজাদ নুপুরের ব্যাখ্যান-প্রয়োগে একালের বিশ্ব প্রতিবেশ-পরিস্থিতির ক্ষমতাচরিত্র নবরূপারোপে ধারণ করতে চেয়েছে- নির্দেশকের মননভাষ্য অভিনব নাট্যমুদ্রায় লাগসই হয়ে উঠেছে। ‘বটতলা’র অনুবাদ নাটক ‘দ্য ট্রায়াল অব মাল্লাম ইলিয়া’ মোহাম্মদ আলী হায়দারের নির্দেশনায় ক্ষমতাকাঠামোর এক নৃশংস নাট্যরূপায়ণ করেছে। ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’র শাহজাদ ফেরদাউসের উপন্যাসকৃত নাট্য ‘শাইলক এন্ড সিকোফ্যান্টস’ বিশ্ব বাজার সাম্রাজ্যের সম্প্রসারিত মানস-আগ্রাসন নব আখ্যান-নাট্য- নির্দেশক আজাদ আবুল কালামের সমর্থ নির্দেশনায় দৃশ্যকাব্যরূপ পেয়েছে। ‘প্রাচ্যনাট’ প্রযোজিত তৌফিকুল ইসলাম ইমন নির্দেশিত আয়নেস্কোর ‘গন্ডার’ রূপায়ণও অভিনয়গুণে লক্ষ্যভেদি হয়ে ওঠে।
‘নাটবাঙলা’র ‘রিজওয়ান’, সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় উপমহাদেশ-জোড়া ক্রূর কুটিল ক্ষমতা-রাজনীতির বলি এক ব্যক্তিমানুষের মরণান্তিক অস্তিত্ব-সংকটকে নাট্যের বিবিধ, বিচিত্র ক্যারিশমাটিক মুদ্রাবলীতে ধারণ করেছে- যার অতিরেক প্রয়োগ-কারিগরি দর্শককে বিস্মিত হতবুদ্ধিতে অভিভূত করে ছেড়েছে- রূপায়ণের সৃজন-বাহাদুরিতে নাট্য ও ব্যক্তির সংকট তাতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে যেন।
অনুবাদ নাটক হিসেবে শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর অন্তত তিনটি প্রযোজনা হয়েছে- ঢাকা পদাতিক, শিল্পকলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের পক্ষ থেকে। বিশ্বনাট্যের চিরকালীন সম্পদ হিসেবে গণ্য এই নাট্য ক্ষমতার রণ-রঙ্গভূমে নানা দেশে প্রাসঙ্গিক করে প্রযোজিত হয়। অথচ বাংলাদেশে কোনো রূপায়ণে সেই সামর্থ্য লক্ষ্যগোচর হয় না- যদিও সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদ রূপান্তর-সম্প্রসারিত ‘হ্যামলেট’ স্বদেশের ক্ষমতারাজনীতি যুক্ত করে, প্রয়োগে রবীন্দ্র-গান ও সুরও, তবু তা ঠিক লক্ষ্যভেদি হয়ে ওঠে না- আলগা প্রক্ষিপ্তই ঠেকে।
‘সিএটি’র নাট্য ইবসেনের ‘ব্র্যান্ড’- এক ধর্মসাধকের জীবনবাস্তবতা ও অধ্যাত্ম্য-দ্বৈরথের চিরকালের সংকটনাট্যÑচড়াই-উৎরাইয়ে মানবিক স্বভাবসঙ্গত। ম সজ্জা জমকালো সিএটি-সুলভ- তার মধ্যেই ব্যক্তির স্বাভাবিক টানাপোড়েনে নাটকীয় হয়ে ওঠে। পেশাদার খন্ডকালীন অভিনেতৃ তাতে আপ্রাণ অভিনয় করেন বলা যায়। নাটকটির নিদের্শনায় কামালউদ্দিন নীলু।
অনুবাদনাটক ‘মুক্তি’ ‘থিয়েটার’ প্রযোজনা। নারী নির্দেশক ত্রপা মজুমদার নারীর প্রজন্ম-ব্যাবধি ভালোই রূপায়ণ করেন, নারী-অভিনেতৃ সহযোগে। প্রবীণা ফেরদৌসী মজুমদার তাতে স্মরণীয় অভিনয় করেন। বহু বছর ধরে চলছে নারীর এই পারস্পরিক সম্পর্ক-জটিল একাল-নাট্য- একটি পরিবারের মা-মেয়েদের বিবিধ, বাস্তব আত্মসংকট আততিতে। শিল্পকলা একাডেমির রূপান্তরিত জাপানি নাটক ‘এক’শ বস্তা চাল- বাংলাদেশি নির্দেশক গোলাম সারোয়ার জাপানি নির্দেশক সহযোগে বিশেষ এক সংস্কৃতিমুদ্রা বাংলাদেশি অভিনেতৃ ভালোই আয়ত্ত করেছেন। নানা দেশে এই নাট্যের অভিনয় এর রূপায়ণ-সামর্থ্যই জানান দেয়। শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনা হিসেবে এটি যথা-মান অর্জন করেছে- নানা দলের বাছাইকৃত অভিনেতৃগণ দীর্ঘ অনুশীলনে তা সম্ভব করেছেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের শেক্সপীয়র রচিত ‘ট্রয়লাস ও ক্রেসিদা’ আতাউর রহমানের নির্দেশনায়, সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদে রূপায়িত। এতে সংলাপের ভার বহন কঠিন হয়ে ওঠে। ‘আগন্তুক’ রেপাটরির ‘অন্ধকারে মিথেন’ ইডিপাসের আমেরিকা-প্রতিবেশে রূপান্তরিত। রচনা ও নির্দেশনায় পান্থ শাহরিয়ার। যদিও মূল নাটকের নাম স্পষ্ট করে বলা হয় নি। ত্রপা মজুমদার এ নাট্যে সমর্থ অভিনয় করেন। বরিশালের ‘শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার’-এর ‘এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ শেক্সপীয়রের নবভাষ্য। বর্ণনাত্মক আখ্যান-ব্যাখানে তা তত একালে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে নি- তরুণসুলভ চটজলদি আরোপণই ঠেকে- ভাষার পরিচিত কাব্যিকতায়। এ নাট্য রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন যথাক্রমে সাইমন জাকারিয়া ও সাইদুর রহমান লিপন।
অনুবাদনাটকের অভিনয়ে বেকেটের ‘হ্যাপি ডেজ’ ‘মণিপুরি থিয়েটারে’র ভিন্ন ঘরানার বিস্তারসম্ভব করে তোলে। শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় একালের সবচেয়ে কীর্তিময়ী অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহার আরেক বিস্ময়কর কৃতি। সংগীত-নৃত্যময় তার অভিনয় পারঙ্গমতা উত্তীর্ণ হয়ে অভিনেত্রী একালের একান্ত আত্মবাচন প্রকাশে সমর্থ হয়েছে। রূপান্তর নাট্য হয়েও মানবের নিঃসঙ্গদশার এই অভিনব রূপায়ণে, সংলাপে বাংলা-ইংরেজির সমন্বয়ে বৈদেশি মুদ্রা সহযোগেও ব্যক্তির আত্ম উদঘাটনে সমর্থ হয় অভিনেত্রীর সত্য হয়ে ওঠা অভিনয়গুণে। দেশি-বিদেশি মিশ্রিত ধ্বনি-আবহ অঙ্গাঙ্গী কুশীলব হয়ে ওঠে- নাট্যকার আরোপিত মঞ্চ দৃশ্যকল্পটি বরং বিরোধাভাস তৈরি করে এই আত্ম উন্মোচন নাট্যে।ন
‘প্রাচ্যনাট’ প্রযোজিত অনূদিত নাটক ‘বনমানুষ’ বৈদেশি আবহেও অভিনয়গুণে অভিভাব সঞ্চার করে। ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’র ‘জবর আজব ভালোবাসা’ বাংলাদেশের মে দুর্লভ এক কমেডি নাটক। আন্তন চেকভের ‘দ্য বিয়ার’ অবলম্বনে সাইফ সুমন রচিত-নির্দেশিত এ নাট্যে অভিনেতৃগণ আখ্যানরীতি অনুগত সক্ষম চরিত্রাভিনয় করেন- গোমরামুখো নাগরিক দর্শকের মুখেও হাসি ফোটে।
সেলিম আল দীনের নানা নাট্য ও তার রূপায়ণ ও সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রযোজনা থেকে বাংলাদেশে বর্ণনাত্মক আখ্যান নাট্যের জয়জয়কার- চলতি লাগসই অনুসৃত ফ্যাশন হয়ে উঠেছে বলা যায়। তরুণ-প্রবীণ নির্দেশকগণকে একযোগে প্রলুব্ধ করে চলেছে- হয়তো বা কারো কারো অজ্ঞাতসারে- দেশীয় একমাত্র নাট্যরীতির বাগাড়ম্বরে। কেউ কেউ তো ঘোষিত আখ্যান বর্ণনাত্মকপন্থী- তার বাইরে সব ত্যজ্য, বৈদেশি অনুকরণনাট্য- উত্তর-উপনিবেশি বুলিতে- যদিও তাদের বিষয়, ভাষা, প্রকাশরীতির মিশ্র জটিলতা সে সাক্ষ্য দেয় না।
বর্ণনাত্মক আখ্যাননাট্যের পথিকৃৎ ‘ঢাকা থিয়েটার’ই এ রীতির সমর্থ রূপকার। সেলিম আল দীনের রচনায়, নাসির উদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় ‘প্রাচ্য’ ও শিমূল ইউসুফ নির্দেশিত ‘ধাবমান’ গত ২০ বছরে তাদের উচ্চমানের রূপায়ণ। ‘পুত্র’ সেই মান অর্জন করে নি এটুকু বলাই যায়। বরং কিসসা কাহিনী’ প্রযোজিত মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন নির্দেশিত তরুণতর দুই অভিনেতৃ সহযোগে ‘পুত্র’ নাট্যের রূপায়ণ আন্তরিক অভিভবে তারিফযোগ্য।
এর বাইরে সুবচন নাট্য সংসদ প্রযোজনা সামিনা লুৎফা নিত্রা রচিত ও ফয়েজ জহির নির্দেশিত ‘তীর্থঙ্কর’ এ রীতির সমর্থ এক নাট্য- যা কেবল ভঙ্গী-অনুগত হয়ে থাকে নি- বিষয়-রূপায়ণের নাট্যমুদ্রা অর্জন করেছে। গুণী নট ও নির্দেশক খালেদ খান নির্দেশিত একই দলের আরেক প্রযোজনা ‘রূপবতী- তাঁর ঘরানার বাইরেও ভিন্ন রীতির রূপায়ণে সমর্থ হয়েছে। অভিনয়েও গুণী নটের প্রযত্ন দৃশ্যমান- মূল চরিত্রাভিনেত্রী তো আলাদা করে দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠেন। নাটকটি রচনা করেছেন নাসরিন জাহান। তবে, সামিনা লুৎফা নিত্রা রচিত মোহাম্মদ আলী হায়দার নির্দেশিত ‘খনা’ এ রীতির লাগসই যথানাট্য হয়ে উঠেছে সৃজনসামর্থ্য। মঞ্চে দীর্ঘদিন তাই বুঝি অভিনয় হয়ে চলেছে, বিভক্ত দল ‘বটতলা’র প্রযোজনা হবার পরও। সেটাও এ নাট্যের সক্ষমতার এক মানদন্ড বলা চলে- অভিনেতৃ পরিবর্তন সত্ত্বেও যা সম্পন্ন হয়েছে।
‘থিয়েটার আর্ট ইউনিটে’র ‘আমিনা সুন্দরী’, নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী-দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় সম্ভোগ করছে দুই বাংলার দর্শককুল। প্রাচ্যনাট প্রযোজিত আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত ‘কইন্যা’ও এ রীতির সমর্থ এক রূপায়ণ- যদিও তারা নানা রীতি রূপায়ণে আজও সদাসৃজনশীল।
তবে মণিপুরী থিয়েটারের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বা ‘ইঙাল আঁধার পালা’ কোনো আরোপিত বর্ণনাত্মক আখ্যাননাট্য নয়, বরং তাদের দীর্ঘ পরম্পরানুগ একালের নাট্যরূপায়ণ বা ভাষ্য। তার ফলে শুভাশিস সিনহা নির্দেশিত তাদের প্রযোজনা সত্যতর, সহজ এক নাট্যবাচন হয়ে ওঠে- ভঙ্গীময় কোনো প্রচলিত ঘোষণা ব্যতিরেকে। তাই বুঝি তাদের নাট্যসকল তাদের নিজস্ব মে বা ঢাকা কী কলকাতায় এতটাই দর্শক-অভিভব সঞ্চার করে। জ্যোতি সিনহা তো বর্তমানকার বাংলাদেশের মঞ্চে উজ্জ্বল আবির্ভাব বলা চলে।
‘জন্মসূত্র’-এর ‘অহরকন্ডল’ বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত, কামালউদ্দিন কবির নির্দেশিত- এ রীতির ভিন্নতর রূপায়ণ। প্রথাগত অনুসরণ তাতে আরোপিত লাগে না, বিষয়ের জটিল সমাজ-মনস্তত্ত্বের জটিলতর ভাষায়ও দর্শকগ্রাহ্য হয়ে ওঠে ত্রয়ী অভিনেতার মনন-বাচন সামর্থ্য। মঞ্চে নির্দেশকের আতীব্র অভিনিবেশও তাতে সঞ্চারিত হয়। রচনাকারের জটিল ভাষাও বিষয় হয়ে ওঠে। ‘লোক নাট্যদলে’র ‘সোনাই মাধব’ লিয়াকত আলী লাকীর নির্দেশনায় ঐতিহ্যানুগ বিষয়-রীতিতে একালের নাট্য হয়ে ওঠেÑ দীর্ঘকাল তার রূপায়ণ তারই সাক্ষ্য বটে।
‘স্বপ্নদল’ নির্দেশক জাহিদ রিপন এ রীতির এক ঘোষিত প্রয়োগকর্তা। তাদের রবীন্দ্রনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ যাত্রারীতির অনুসরণে সমর্থ নাট্য বলা চলে। জটিলতম ‘হরগজ’-এর বেলা তা বলা যাবে না। ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ প্রযোজিত ‘গহর বাদশা ও বানেছা পরী’ হৃদি হকের নির্দেশিত আরব্য লোকআাখ্যান- নৃত্য-গীত-অভিনয়ে রংবাহার প্রযোজনা।
সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘বেহুলার ভাসান’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ প্রযোজনা। তাঁর পূর্ববর্তী ‘বিষাদসিন্ধু’র কিংবদন্তীপ্রতিম রূপায়ণের পরে এ নাট্যে বর্ণনাত্মক আখ্যানরীতির ভিন্নতর মেধাবী-বাচন যোগে দৃশ্যকাব্য-রূপায়ণ হয়েছে- তাঁর সৃজনসামর্থ্য তাতে অটুট, অভিনব লাগে। এই ধীমান নির্দেশক বাংলাদেশের মে র এক নিঃসঙ্গ শেরপাতুল্য গরিমায় অনেকান্ত সৃজ্যমান।
স্বদেশীয় মহাজনদের নিয়ে নাট্যরূপায়ণও অন্যতম এক প্রবণতা গত ২০ বছরের মঞ্চে ।
‘নাট্যকেন্দ্র’ প্রযোজিত তারিক আনাম খান নির্দেশিত ‘আরজ চরিতামৃত’ তেমনি এক নাট্য। বরিশালের গন্ডগ্রামের বাসিন্দা স্বশিক্ষিত এক সত্যসন্ধ্যিৎসু আরজ আলী। সরল জিজ্ঞাসায় তিনি মুখোমুখি হন ধর্মীয় প্রচলিত আখ্যানের-যুক্তিবুদ্ধি, ন্যায়ের আয়ুধ সম্বল করে। গ্রামে গড়ে তোলেন এক পাঠাগার, যাতে শিক্ষিত সাধারণে জ্ঞানবিজ্ঞানের নাগাল পায়। পাকিস্তান আমল থেকে তাঁর এক একক অভিযান চলছে। গত শতকের আশির দশকে প্রকাশিত হলে ‘সত্যের সন্ধানে’ তিনি নাগরিক-গোচরে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককুল লিখতে আরম্ভ করেন তাঁকে নিয়ে। স্বদেশে চলছে তখন প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা বিরুদ্ধ জঙ্গী রোখ। জনমনে, নগর-গ্রাম নির্বিশেষে তার সংক্রমণ ক্রমস্ফীত। লাগাতার এহেন প্রতিবেশে নাগরিক মে মাসুম রেজা রচিত ‘আরজ চরিতামৃত’ একটি প্রাসঙ্গিক প্রযোজনা হয়ে ওঠে। যদিও রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় আখ্যান অধিকতর সাবধানীÑ তবু এ নাট্য এক অভিভাব সঞ্চার করে নাগরিক জনমনে।
আরণ্যক নাট্যদল প্রযোজিত, মান্নান হীরা রচিত, মামুনুর রশীদ নির্দেশিত ‘এবং বিদ্যাসাগর’ রূপায়ণ, বাঙালি এই চির নায়ক ও তৎকালীন সময়ের নাট্যভাষ্য। যদিও এ নাটকে তথ্য-বিভ্রম নিয়ে কথা ওঠে। মহাজনের ঋজু শিরদাঁড়ার দার্ঢ আখ্যান ও অভিনয়ে তত লাগসই হয় না বলেও মনে করা হয়। তবু এ নাটক যুক্তিবিরুদ্ধ বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, ধর্মীয় উন্মাদন যখন বিশ্বজোড়া মরিয়ামত্ত।
‘প্রাঙ্গণেমোর’ প্রযোজনা অনন্ত হিরা রচিত-নির্দেশিত ‘লোকনায়ক’ চারণকবি মুকুন্দদাসের জীবনচরিত-নাট্য। বৃটিশ আমলে বরিশালের এই কালীভক্ত গানে গানে, যাত্রাপালায় একদিন উদ্বোধিত করেছিল স্বদেশী বাংলামন। এহেন এক মহাজন এতদিনে নাগরিকমে এনে একাল-প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয়সাধন একটি ঐতিহাসিক দায় পালন বটে। বাংলাদেশের থিয়েটারে তাই এ নাট্য আলাদা সম্ভ্রম আদায় করেছে বলা যায়। এছাড়া এ দল ও নির্দেশকের ‘দাঁড়াও… জন্ম যদি তব বঙ্গে’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনের উপান্ত দিনকয়েকের করুণ, ট্র্যাজিকভাষ্য, যা পাঠকমনে কিংবদন্তী হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যে এই মহানায়কের তাবৎ কৃতি ও কীর্তি জনমনে সদাজাগ্রত- অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও সনেট প্রবর্তন, বাংলা ট্র্যাজিক ও রঙ্গব্যাঙ্গ নাটক, মহাকাব্য ও কাব্যরচনায় এবং তার অতিনাটকীয় জীবনযাপনও মিথতুল্য হয়ে আছে জনমনে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তার শেষ ক’দিনের অন্তিমনাট্য করুণতর হয়ে ওঠে- এতে তাঁর চরিত্রের দার্ঢ ও বীরত্ব কোথাও তরলতর হয়ে ওঠে। প্রেমজীবনের একপেশে বয়ানও মর্যাদাহানিকর বটে- যেখানে তাঁর জীবনের তথ্যসম্পূর্ণ বয়ান আমাদের হাতে এসে গেছে- ‘আশার ছলনে ভুলি’। তবে অভিনয় ও নাট্যপ্রয়োগ দর্শকসমর্থন পায়। নাটকটির রচয়িতা অপূর্ব কুমার কুন্ডু।
‘মহাজনের নাও’ সুবচন নাট্য সংসদ প্রযোজিত, শাকুর মজিদের রচনায় ও সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় শাহ আব্দুল করিমের জীবনভাষ্য। প্রয়োগের মুন্সিয়ানায় তা জমজমাট নাট্য হয়ে ওঠে। ‘সূর্যসেন’ কে নিয়ে দু’টো প্রযোজনা- চটগ্রামের একটি, অন্যটি ঢাকা পদাতিকের। ‘এথিক’ মে এনেছে অপু শহীদের রচনা ও নির্দেশনায় ‘চন্ডীদাস’, ’মহাত্মা’ ইউনিভার্সেল থিয়েটার প্রযোজনা, রচনা ও নির্দেশনা মাজার পিন্টু- মহাত্মা গান্ধীর দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালি আগমন নিয়ে আখ্যান। ‘নাট্যধারা’ প্রযোজিত ‘অতীশ দীপঙ্কর সপর্যা’ রচনা ও নির্দেশনায় অলক বসু-প্রথম বাঙালি বিশ্বমানবকে নিয়ে এই নাটক সঙ্গতভাবেই তারিফযোগ্য। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও নাট্যরূপায়ণ হয়েছে। ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের নাট্যভাষ্য ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি- ‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজনা। রচনা আনন জামান, নির্দেশনায় আশিকুর রহমান লিয়ন। ‘উদীচী’র ‘হাফ আখড়াই’ উনিশ শতকীয় নবীন সঙ্গীতঘরানার আরোপিত ব্যাখ্যান হলেও প্রযোজনা ও অভিনয়গুণে দর্শক-সমর্থন পেয়েছে। নাটকটির রচয়িতা রতন সিদ্দিকী আর নির্দেশনায় আজাদ আবুল কালাম। পান্থ শাহরিয়ার রচিত ও ত্রপা মজুমদার নির্দেশিত, ‘থিয়েটার’ প্রযোজিত ‘বারামখানা’ লালনের ভাবধর্ম সাধনকর্মের এক আখ্যান। নাগরিক মনে ক্রমউৎসুক বাউল ঘরানার এক মিথনাট্য হয়েছে তা।
রবীন্দ্রনাটকের অভিনয় তাঁর সার্ধশত উদ্যাপনকাল থেকে বেশি হলেও নিয়মিত এক ধারাই ছিল। ‘রক্তকরবী’ ঢাকার নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, প্রাঙ্গণেমোর ও চট্টগ্রামের দুটি দল করেছে। প্রযোজনা-মানের কিছু হেরফের থাকলেও কোনোটিতেই ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যান-ভাষ্য তত দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে নায়লা আজাদ নুপূর নির্দেশিত ‘থিয়েটার’-এর ‘মুক্তধারা’, শামীম সাগর নির্দেশিত পালাকার প্রযোজিত ‘ডাকঘর’ বা স্বপ্নদলের জাহিদ রিপন-কৃত ‘চিত্রাঙ্গদা’ বরং রীতি-ব্যাখ্যান-ভাষ্যের দিক থেকে নব প্রয়োগ-সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। তবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও নাট্য রূপায়ণ হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক রচিত, আতাউর রহমান নির্দেশিত পালাকার প্রযোজনা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল- রবীন্দ্রজীবনের শিলাইদহ-পর্ব এবং বাংলাদেশে তাঁর রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার আখ্যান। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে উঠে নাটক শেষ হয়- তাতে দর্শকমনে অন্যতর অভিভাব জাগে। ছিন্নপত্রাবলীর অনুসরণে এ পর্বের নাট্যভাষ্য সৈয়দ শামসুল হকের এক অভিনব রবীন্দ্র-সম্বোধন, রূপায়ণে তার যথাসাধ্য প্রয়াস, এমনকি শামীম সাগরকৃত তরুণ রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ও অনেকখানি বিহŸল করে দর্শককে- তাদের মানসপ্রস্তুতি দীর্ঘকালের বলেও।
‘প্রাঙ্গণেমোর’ প্রযোজিত, নূনা আফরোজ রচিত ও নির্দেশিত ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ একালের দুই যুবক-যুবতীর সঙ্গে নানাবয়েসী রবীন্দ্র-সাক্ষাৎকার বিশেষ। তাতে বিচিত্র রবীন্দ্রনাথের সাধ্যমতো আন্তরিক অভিনয় ও সাজসজ্জায় দর্শক আবিষ্ট-মুগ্ধও হয়। রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্রাবলী মুখোমুখি এই কথপোকথননাট্যে।
‘বাঙলা থিয়েটার’ প্রযোজিত মামুনুর রশীদ রচিত ও ফয়েজ জহির নির্দেশিত ‘চে’র সাইকেল’-চে গুয়েভারার জীবননাট্য ও রাজনীতি এক সংলাপ-বর্ণনাত্মক আখ্যানরীতিতে রূপায়িত। তাতে রচনা, অভিনয় ও নির্দেশনাগুণে লাগসই নাট্য হয়ে ওঠে। দর্শকমনে এই বিপ্লবী নায়কের এক চির বিস্ময়মানস-মুগ্ধতা এই নাট্য-সঞ্চারণ সম্ভব করেছে। আখ্যান, বর্ণনা ও ভাষ্য, একালের সঙ্গে তার অঙ্গীকরণে প্রাসঙ্গিক নাট্য হয়ে উঠেছে। স্বল্প আয়োজনে মঞ্চ কল্পনাও তারিফযোগ্য।
সাধনা আহমেদের রচনা আর ইউসুফ হাসান অর্কের নির্দেশনা ‘ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন’ রবীন্দ্রনাথের ‘বোষ্টমী’ গল্পের একালের নাট্যভাষ্য। ‘বিবর্তন যশোর’ প্রযোজিত এ নাট্যে রবীন্দ্রদর্শন ও বাউলভাবনার এক মিথষ্ক্রিয়ার সম্প্রসারণ ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধ-প্রণোদিত নাট্যও প্রযোজিত হতে থাকে গত ২০ বছরে।
‘কথা ’৭১’ ‘ঢাকা পদাতিক’ প্রযোজিত, কুমার প্রীতীশ বল রচিত ও দেবাশীষ ঘোষ নির্দেশিত নাটক। মুক্তিযুদ্ধকালীন ও তৎপরবর্তী অকাল-দক্ষযজ্ঞের আর্তভাষ্য এ নাট্য। তবে বর্তমানকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিপন্নতা করুণ-কাতর হয়ে ওঠে। ট্র্যাজিক মহিমা স্খলিত হয়, যেন তাঁরা অসহায় মিনতি জানায় জনমনে। তবে আবেগের আন্তরিকতা তাতে স্পষ্ট। ‘উদীচী’ প্রযোজিত রতন সিদ্দিকী রচিত ও আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত ‘বৌবসন্তী’ নাট্যে প্রান্তিক মানবজনের জীবন-পরিস্থিতি ক্ষুরধার রঙ্গব্যাঙ্গে রূপায়িত। প্রযোজনার সামর্থ্যে তা দর্শকসাধারণকে উদ্বেলিত করে।
‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’-এর জহির রায়হানের গল্প অবলম্বনে মোহাম্মদ বারী রচিত ও নির্দেশিত ‘সময়ের প্রয়োজনে’ একালেও একান্ত প্রাসঙ্গিক ভাষ্য হয়ে ওঠে। এক লেখকের ডায়েরি থেকে গড়ে ওঠে আখ্যান। নির্দেশনা ও প্রযোজনার মুন্সিয়ানায় জরুরি নাট্য হয়ে ওঠে ‘সময়ের প্রয়োজনে’।
উপন্যাসের নাট্যরূপায়ণ বিগত দুই দশকে একটি নতুন ধারাপাত ঘটায় বাংলাদেশের থিয়েটারে। সেলিম আল দীনই বলেন: কেবল সংলাপ-চরিত্র নির্ভর নাটক বাংলা স্বভাবমনের সঙ্গে ঠিক মেলে না- মিশ্র এক রীতিতে বর্ণনা-ব্যাখ্যান সম্বলিত আখ্যানেই চিরকাল মজেছে বাঙালি, মনের নানা ভাব-অবস্থা তাকে কথা-বর্ণনা-সংলাপ-অভিনয়-নাচেগানে বাক্সময় হয়ে স্ফূর্ত করে তোলে। সেখানে কেবল সংলাপ-চরিত্র কোথাও যেন বাদ সাধে। তিনি নাট্যতত্ত¡ বিভাগে বাংলা সাহিত্যের অতুল সম্ভার দৃশ্যকাব্য রূপায়ণে প্রণোদিত করেন। নাটকের পাশাপাশি বিবিধ আখ্যান রূপায়ণ করাতে উদ্যোগী হন। তাঁরই অনুসরণে বাংলাদেশের মে গল্প-উপন্যাস বর্ণনাত্মক নানা রীতিতে অভিনয় করার চল হয়।
রবীন্দ্র উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’ প্রথম অভিনয় করে কলকাতার ‘বহুরূপী- তাদের প্রথম রবীন্দ্র-অভিনয় হিসেবে। নির্দেশক শম্ভু মিত্র জানান: রবীন্দ্রনাট্যে প্রবেশে এটা একটা শিক্ষানবিশী প্রস্তুতি, যার থেকে রবীন্দ্র-বাচন আয়ত্ত করায় সমর্র্থ হন তাঁরা; উপযুক্ত হন ‘রক্তকরবী’ রূপায়ণে। বাংলাদেশের ‘প্রাঙ্গণেমোর’ রবীন্দ্র-উপন্যাস চার অধ্যায় নাম বদলে ‘স্বদেশী’ নামে অভিনয় করেন।
জনপ্রিয় ‘শেষের কবিতা’ দু‘টি নাট্যদল প্রায় একযোগে অভিনয় করে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ আর ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’। তাতে দু‘রকম ভাষ্য পাই আমরা উপন্যাসটির।
‘বটতলা’ প্রযোজিত, শাহাদুজ্জামান রচিত উপন্যাস অবলম্বনে রূপায়িত ‘ক্রাচের কর্নেল’। নাট্যরূপ দিয়েছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা ও সৌম্য সরকার আর নির্দেশনায় মোহাম্মদ আলী হায়দার। কর্নেল তাহেরকে নিয়ে এ নাট্য মুক্তিযুদ্ধের সামরিক বয়ান হয়ে ওঠে। মুজিবনগর সরকার পরিচালিত জনযুদ্ধ অগ্রাহ্য করে এক সেক্টর কমান্ডারের ব্যক্তিগত বীরত্বের আখ্যান তার জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু করে বীরগাথা রচনা করে। একালের অভিনেতৃদের তার সঙ্গে বোঝাপড়া সাজানো লাগে। যথাবাস্তব অভিভব তৈরি করে না- কথাচালাচালির কুটকচালি দ্বন্ধময় নাটকীয়তা তৈরি করে না- ইচ্ছাপূরণমুলক অতিকথায় অতিনাটকীয় হয়ে ওঠে। তবে নির্দেশনার মুন্সিয়ানা এ রূপায়ণ দর্শকগ্রাহ্য করেছে। কর্নেল তাহেরের ট্র্যাজিক-পরিণতিতে আবেগ সঞ্চারিত হয় দর্শকমনে।
‘মণিপুরি থিয়েটার’ শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ রূপায়ণ করেন- তাতে কবিতাটির এক নাট্যভাষ্য পাওয়া যায় নানা মঞ্চ মুদ্রায়। ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘জুতা আবিষ্কার’ মঞ্চে রূপায়ণ করে। হাসান শাহরিয়ারের রচনায় ‘মগজ সমাচার’ নামে এ নাট্য নির্দেশনা দেন সাইফ সুমন। তাতে ক্ষমতালিপ্সু চাটুকারদের বুদ্ধি-সুদ্ধির হাস্যরসউপস্থাপন উপভোগ করে দর্শক।
নাটকের দল ‘আরশীনগর’ শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ অভিনয় করে রেজা আরিফের নির্দেশনায়। তাতে হয়তো আখ্যানবাচনের অন্তর্মুখ চরিত্র বদলে যায় অনেকটাÑ উচ্চকিত বহির্মুখি হয়ে ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত¡ বিভাগ পাওলো কোহলের বিশিষ্ট রচনা ‘দ্য আলকেমিস্ট’ অভিনয় করে- নাট্যজন তাতে অভিনব এক আখ্যান-আস্বাদ লাভ করে। রেজা আরিফের নির্দেশনায় প্রযোজনার মুন্সিয়ানাও তাতে প্রত্যক্ষ হয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নাগরিক নাট্যাঙ্গন মে আনে লাকী ইনামের নির্দেশনায়। মাহমুদুল ইসলাম সেলিমের রূপান্তরে এই নাট্যে প্রান্তিকজনের ভয়াল বাস্তবের চরিত্রাভিনয় সাধ্যমতো করা হয়।
শরৎচন্দ্রের শতবর্ষ-উত্তীর্ণ বয়ঃসন্ধিকালীন ব্যর্থ প্রেমগাথা ‘দেবদাস’ অভিনয় হয় নবভাষ্যযোগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এটি মে আনে ইউসুফ হাসান অর্কের নির্দেশনায়। তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসটি তো আখ্যানের কাব্যগুণে নানাভাবে অভিনীত হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে গ্রুপ থিয়েটারের নানা দলের প্রযোজনায়। তাতে প্রযোজনার স্বভাবত বিবিধ মান প্রত্যক্ষ করা যায়।
শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা- উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বিবিধ বাস্তবতা উঠে আসে। সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় হালের ‘স্পর্ধা’ নাট্যদল প্রযোজনা। তাতে আখ্যানের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক হয়। রূপায়ণের অতিরেক কারসাজির আবশ্যকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেÑ যদিও এতে নির্দেশক অধিক আখ্যান-অনুগ থাকতে চেয়েছেন বলেও অনেকে মনে করেন, যা কিনা তাঁর আগের ‘রিজওয়ান’ নির্দেশনায় তেমনভাবে চোখে পড়ে নি।
মহাভারতের নবীনভাষ্য ‘নিত্যপুরাণ’ মাসুম রেজার রচনা ও নির্দেশনা এবং প্রয়াত দিলীপ চক্রবর্তীর সমর্থ অভিনয়ে বিপুল দর্শক সমর্থন পায়- আজও অটুট সে মুগ্ধতা ভিন্ন অভিনেতৃ সহযোগেও। ‘সুরগাঁও’ যদিও মাসুম রেজার উচ্চাভিলাষী আখ্যান ও রূপায়ণ কারসাজিও যথাসফল হয়ে ওঠে না।
সংস্কৃত নাটক ‘মৃচ্ছকটিক’, ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল’ প্রযোজিত জামালউদ্দিন হোসেন নির্দেশিত নাটক। সংস্কৃত এই নাটক মঞ্চায়ন বাংলাদেশের মঞ্চে উল্লেখ করার মতো ঘটনা। সংস্কৃত নাটক ‘মাধবী’ রামেন্দু মজুমদারের নির্দেশনায় রূপায়িত, ‘থিয়েটার’ প্রযোজিত। এতে ত্রপা মজুমদারের অভিনয়ে আন্তরিক বাচন তারিফযোগ্য।
‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট প্রযোজিত ‘না মানুষি জমিন’ আনিসুল হকের উপন্যাস থেকে সাইফ সুমনের রচনা ও নির্দেশনায়। এতে সীমান্তে দুই দেশের পারস্পরিক ক্ষমতা-সম্পর্কের এক স্পর্শকাতর বাস্তবতা উঠে আসে- স্বভাবত নানা অসঙ্গতিসহ। তবু প্রযোজনা ও অভিনয়ের আন্তরিকতা স্পষ্ট। এই দলের ‘মর্ষকাম’ নবীন নাট্যকার আনিকা মাহিন একা’র রচনায়, রোকেয়া রফিক বেবীর নির্দেশনায় স্বদেশ ও বিশ্বরাজনীতির সরল ভাষ্য হয়েও প্রয়োগের অতিরেক অপ্রয়োজনীয় কারসাজিতে ভারসাম্য হারায়।
আরণ্যক নাট্যদলের মামুনুর রশীদ রচিত নির্দেশিত ‘সঙক্রান্তি’ ও ‘রাঢ়াঙ’ প্রান্তিকজনের দলিত জীবনবাস্তবতার উপযুক্ত নাট্যভাষ্য- দর্শক-সমর্থিতও বটে।
‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ে’র ‘শিখন্ডি কথা’ রশীদ হারুণের নির্দেশনায় কিম্পুরুষসমাজের আন্তরিক ভাষ্য। আখ্যান ও অভিনয়ে তার প্রমাণ মেলে। নাটকটির রচয়িতা আনন জামান।
রাজশাহীর ‘অনুশীলন নাট্যদল’ প্রযোজিত মলয় ভৌমিক রচিত ও ফয়েজ জহির নির্দেশিত ‘বহে প্রান্তজন’ আর মলয় ভৌমিক রচিত-নির্দেশিত ‘ভূমিকন্যা’ গণনাটকের একদা প্রবলধারার এক সমর্থ উত্তরাধিকার প্রযোজনা। তাতে পথনাটক ও মঞ্চ নাটকের মেলবন্ধন ঘটে।
‘প্রাচ্যনাট’ প্রযোজিত, মনোজ মিত্র রচিত ‘কিনু কাহারের থেটার’ আখ্যান, প্রয়োগ ও অভিনয়গুণে রঙ্গব্যাঙ্গ নিপুণ প্রান্তিকজনভাষ্য হয়ে ওঠে। আজাদ আবুল কালাম রচিত ও নির্দেশিত ‘প্রাচ্যনাটে’র ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’ রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ঘটিত বিপর্যয়-ধারার এক প্রতিবাদ নাট্য দলিল হয়ে ওঠে। মঞ্চায়ন পরবর্তী স্থাপনা-দৃশ্যকল্প দর্শককে অভিভূত বেদনাহত, ধ্বংসদায়ভারে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
‘বিবর্তন যশোর’ প্রযোজিত আব্দুল্লাহেল মাহমুদ রচিত ও ফয়েজ জহির নির্দেশিত ‘কৈবর্তগাথা’ ইতিহাসের এক জনগোষ্ঠীর গাথা। একই দলের ‘মাতব্রিং’ প্রান্তজনের আন্তরিক রূপায়ণ। রচনা সাধনা আহমেদ নির্দেশনা ইউসুফ হাসান অর্ক।
‘প্রাঙ্গণেমোর’-এর ‘কনডেম সেল’ নিকট ইতিহাসের নাট্যদলিল বিশেষ। আখ্যানের সমসাময়িকতা ও অভিনয়গুণে তা লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠে। নাটকটি রচনা করেছেন অনন্ত হিরা আর নির্দেশনা দিয়েছেন আউয়াল রেজা। এই দলের ‘আওরঙ্গজেব’ অনন্ত হিরার নির্দেশনায় ইতিহাস ও সমসময় যুক্ত করে প্রয়োজনীয় নাট্য হতে পারে। ‘স্বপ্নদল’ প্রযোজিত বাদল সরকারের ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ জাহিদ রিপনের নির্দেশনায় থার্ড থিয়েটার আদলে রূপায়িত। ইতিহাসের ধ্বংস-বিপর্যয়কে অভিযুক্ত করে এ আখ্যান ক্ষুব্ধ তীক্ষèতায় আতীব্র হয়, তাতে দর্শক অভিভূত না হয়ে পারে না। ‘পালাকার’ প্রযোজিত গোলাম শফিক রচিত ও আমিনুর রহমান মুকুল নির্দেশিত ‘মানগুলা’ ইতিহাসের এক জনবিদ্রোহগাথা। নানা শারীরনাট্যমুদ্রায় তা দৃশ্যগ্রাহ্য নাট্য হয়ে ওঠে।
‘বাতিঘর’ ঢাকা প্রযোজিত তরুণ ধীমান বাকার বকুলের রচনা-নির্দেশনায় ‘ঊর্ণাজাল’। সাম্প্রতিক স্বদেশী জঙ্গীবাস্তবতার এক সুলুকসন্ধানী রূপায়ণ- সাহসীও বটে। আখ্যানের চটজলদি সরলতা এর আতীব্র জটিলতা ব্যহত করলেও এর ঐতিহাসিক মূল্যমান আছে। সৈয়দ দুলাল নির্দেশিত বরিশালের ‘শব্দবলী’র ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ তারিফযোগ্য প্রযোজনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ প্রযোজনা ‘কমলারাণীর সাগরদীঘি’ সাইদুর রহমান লিপনের একক অভিনয়ে, ইসলাম উদ্দিন পালাকারের রীতিশিক্ষায়ও সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় মুগ্ধকর প্রযোজনা। সংস্কৃত নাটক ‘উরুভঙ্গম’ ইসরাফিল শাহীনের নির্দেশনায় আর ‘মধ্যমব্যায়োগ’ ওয়াহীদা মল্লিক জলির নির্দেশানায় সমর্থ প্রযোজনা। শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ চেখভের ‘থ্রি সিস্টার্স’ ইসরাফিল শাহীনের মেধাবী নির্দেশনা। ‘অং বং চং’ সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় সঙরীতির নাগরিক বিতর্কিত ভাষ্য।
নাগরিক মঞ্চে তৃপ্তি মিত্র’র ‘অপরাজিতা’ থেকেই একক অভিনয়ের চল হয়। ৭৪-এ ঢাকায় অভিনব এ নাট্যের অভিনয় দেখে দর্শক বিহবল, আপ্লুত। শাঁওলী মিত্র’র ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নয়ের দশকে দেখি আমরা। তারপর বাংলাদেশের প্রধান নটী ফেরদৌসি মজুমদার আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘কোকিলার’ একক অভিনয় করেন। তাতে সৈয়দ শামসুল হক একটি চরিত্রে কণ্ঠও দেন। নানা শ্রেণীর নারীর একই দশা নিয়ে এর আখ্যান। গত শতকের আদি প্রধানা নটী বিনোদিনী তাঁর জীবন কথা লিখে যান। সেটি নিয়ে সাইমন জাকারিয়ার সম্পাদনায় ‘বিনোদিনী’ নাট্যে একক অভিনয় করেন শিমূল ইউসুফ। সেটা হয়ে ওঠে এক পয়মন্ত অভিজ্ঞতা। এস এম সোলায়মান নির্দেশিত থিয়েটার আর্ট প্রযোজনা ‘গোলাপজান’ নাট্যে- দলবলসহ রোকেয়া রহমান বেবী একক অভিনয় করেন। পুরনো ঢাকার এক কুট্টি রমণীর মর্মচেরা সে আখ্যান অভিভূত করে দর্শককুলকে। ‘পালাকারে’র প্রযোজনা ‘রিকোয়েস্ট কনসার্ট’ নিঃশব্দ নাট্য, একালে নারীর নিঃসঙ্গতার ক্ষমতা-চরিত্র অভিনয় ও নির্দেশনাগুণে লাগসই প্রাসঙ্গিক জীবনভাষ্য হয়ে ওঠে, কামালউদ্দিন নীলুর অভিনব মঞ্চ রূপায়ণে রোকেয়া রফিক বেবীর একক অভিনয়ে। বাংলাদেশের মঞ্চে দুর্লভ আত্মসনাক্তিকরণে, নাট্যে অভিনেত্রীর সত্তাপ্রকাশের এক দৃশ্যকাব্য হয়ে ওঠে।
তারপর নাম করতে হয় মণিপুরী থিয়েটার প্রযোজিত শুভাশিস সিন্হা নির্দেশিত, মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর/পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গন কাব্য’ ‘কহে বীরাঙ্গনা’ নামে একক অভিনয় করেন হাল আমলের ধীমতী অভিনেত্রী জ্যোতি সিন্হা। পুরাণ-মহাকাব্যের জনাকয়েক নারীর মর্মন্তুদ জীবনভাষ্য নৃত্যগীত-পটিয়সী নারীকুশীলব নিয়ে দৃশ্যকাব্যে বাক্সময় হয়ে ওঠেন জ্যোতি-আখ্যান ও ভাষার দুরূহতা শারীরবিভঙ্গের অতিরেকে পূরণ করতে চান নির্দেশক, তাতে অভিনেত্রীর দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়- দুই বাংলার দর্শকও দৃশ্যশ্রাব্য অভিভবে মুগ্ধ হয়।
‘ন্যূন’ প্রযোজিত মান্নান হীরা রচিত ও সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশিত ‘লাল জমিন’ দীর্ঘ মঞ্চ -অভিজ্ঞ মোমেনা চৌধুরীর একক অভিনয়ে মুক্তিযুদ্ধের নারীর অন্তর্ভেদী বাচন উদঘাটন করেন- অভিনয়ের আন্তরিক সততায় তা শারীরমুদ্রার অতিরেক সত্ত্বেও লাগসই হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ জিয়নকাঠির প্রযোজনায়, বিপ্লব বালার নির্দেশনায় একক অভিনয় করেন ফেরদৌসী আবেদিন লীনা-ঈষৎ সম্পাদিত গল্পটিই নিজের অভিজ্ঞতায় ভর করে একালের ভাষ্য করা হয় যথাসাধ্য। দর্শক রবীন্দ্রভাষের বাচনে অভিভূতও হয়।
ষাটের দশকের প্রথম ভাস্কর নভেরার আতীব্র আততিময় জীবন বাক্সময় করেন একালের আরেক ধীমতী অভিনেত্রী দোলা। ………প্রয়োজনা, নির্দেশনা…
এছাড়া ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত ‘প নারী আখ্যান-এ……… ও নাট্যচক্র প্রযোজিত, দেবপ্রসাদ দেবনাথ নির্দেশিত, দারিও ফো রচিত ‘একাকী একজন’ নাট্যে তনিমা হামিদ একক অভিনয় করেন।
একক সব অভিনয়ে নারীর বিবিধ, বিচিত্র জীবনভাষ্য নানান আবেগাবেগে অভিনেত্রীসকল একক দৃশ্যকাব্য রচনা করেন। দেশ ও বিশ্বজুড়ে নারীর এক ক্ষমতাদাপট তাতে রূপায়িত হয়- অতিরেক আতিশয্যে সর্বদা ভারসাম্যের সামঞ্জস্য স্বভাবত অলক্ষিত- হয়তোবা প্রাথমিক উচ্চাশা মাতমে।
তবে ঢাকার মঞ্চে কলকাতার নান্দীকার প্রযোজিত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র ‘মেঘনাথবধ কাব্য’ প্রবল নট গৌতম হালদারের একক অভিনয় ঢাকার দর্শককুলের এক বিস্ময়-স্মৃতি হয়ে আছে। তাঁর ‘বড়দা বড়দা’ মুন্সী প্রেমচাঁদের গল্পের অভিনব কথকতারীতির নবীন প্রকাশ- প্রযুক্তি ধারাপাতসহ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের তত্ত্বাবধানে, স্বদেশরীতির এক কথক ইসলামউদ্দিন কিস্সাকারের শিক্ষণে, জামিল আহমেদের নির্দেশনায় সাইদুর রহমান লিপন আয়ত্ত করে এক তারিফযোগ্য অভিনয়- ‘কমলা সুন্দরীর কিস্সা’।
চট্টগ্রামের নান্দীপট প্রযোজিত অভিজিৎ চক্রবর্তী-নির্দেশিত ও রচিত……………. একক অভিনয় করেন………….
গত ২০ বছরে বাংলাদেশের থিয়েটার প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী অভ্যুদয়-উচ্ছ্বাস-উত্থানকাল পার হয়ে স্বদেশ-বিশ্বের সমূহ বাস্তবতার মুখোমুখি- সাবালকত্ব অর্জনের কঠিন পরীক্ষাকাল পার করছে। পতন-বন্ধুর-কণ্টকিত সে যাত্রাপথ। সহজ, সরল, আদর্শ-নীতি রহিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা তার। নাট্যে আত্মসন্ধিৎসার নন্দন অনায়ত্ত। জীবিকা ও সৃজনের দ্বিমুখী ষাঁড়ের শিং বাগ মানাতে পারছে না। পেশাজীবীতার বাস্তব পন্থার খোঁজ মিলছে না। ভোগের বিলাসী টানে লাগাম পরিয়ে শিল্পনন্দনের কঠিন দায় মেটাবে কী করে সে! ব্যক্তিগত ও দলীয় আবেগ আর যেন ধরে রাখা যাচ্ছে না। দল বুঝি আর সেই দল নেই। কে কার হাত ধরে নিরাময় পন্থা খুঁজে নেবে- নিজে বাঁচা আর অপরের বাঁচার সহায় হয়ে।’ শিল্পচর্চার সে-ই তো চিরকালের অন্বিষ্ট।
তাই বুঝি অনুবাদ নাটকে বিশ্ব-রাজনীতির বাস্তব উঠে এলেও স্বদেশী রাজনীতির এই ক্রমভঙ্গুর ভয়াল তান্ডব নাট্যে অধরা, ভীতসন্ত্রস্ত ক্ষমতার ঘেরাটোপে। নায়ক-মহাজনদের জীবননাট্য থেকে মিলছে কি? কোনো আত্মউত্থান শক্তি-বল, মন-মনন। বর্ণনাত্মক আখ্যাননাট্যের এক সরল অনুকরণ, সর্বরোগহর দাওয়াই হয়ে উঠেছে- নিজস্ব, দেশজ নাট্যরীতির নামে। গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপায়ণে একটা বিস্তার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে হয়তো। সেটাও তো একমাত্র নিদান হতে পারে না। সংস্কৃত নাটক কী পুরাণ-প্রাকৃতজনের নাট্য থেকেও মিলতে পারে বর্তমান বাস্তব আত্মপ্রকাশের অবলম্বন- যদি তেমন করে তোলা যায়। তবু আশা, যেন গোকুলে বাড়ে নটগোপালের দল। নতুন দল গড়ে উঠছে আজও যে, তার মানে মে নবীন প্রজন্মের এক ধারাপাত চলছে। মিডিয়ায় আত্মবিসর্জনই একমাত্র বা শেষ কথা নয়- ‘তবু কোথাও মানব রয়ে যায়।’ মঞ্চের মতো জীবন্ত মানুষজনের এই আশ্বাসক্ষেত্র ভার্চুয়াল বাস্তবতায় ক্রমে অনিবার্য আশ্রয় হয়ে না ওঠার কথা নয়। তবে সেটা আগের মতো কেবল স্বপ্ন-কল্পনায় ভর করে না- কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে আত্ম ও মানবস্বভাব রক্ষণের সাবালক দায়ে সম্পন্ন হতে হবে- ‘সব পথ হারাবার পর/ বুঝি খোঁজ মেলে আপনার।’
সভ্যতাজুড়েই এই এক নিদারুণ মানবনিয়তি। কী করে মানুষ তার স্বভাব, সম্পর্ক আর নন্দন-সামর্থ্য অর্জন করে নেবে।
ভয় আর লোভের এক বিপরীত টানের ক্ষমতামাতম দেশ-বিশ্ব জুড়ে যে। তার সব আড়াল আর অবলম্বন ভেঙে পড়েছে।
বাংলাদেশের থিয়েটার তার জাতীয় স্বভাবের তাবৎ সীমা আর সম্ভাবনা বুঝে নিয়ে নাট্য-নন্দনের বিবিধ রীতিতে আত্মপ্রকাশের অনিবার্য অবলম্বন হয়ে উঠুকÑ তাতেই নিজে বাঁচা আর অপরের বাঁচার সহায় হতে পারবে নাট্য, থিয়েটার। ‘দ্বান্দ্বিক বটে, তাই সর্বদা উত্তরণ।‘- চরৈবেতি, মাভৈঃ মাভৈঃ।
বিপ্লব বালা : নাট্যশিক্ষক