You are currently viewing খোলা কবিতা: মুহম্মদ ইমদাদ  >  ঋতো আহমেদ

খোলা কবিতা: মুহম্মদ ইমদাদ > ঋতো আহমেদ

খোলা কবিতা: মুহম্মদ ইমদাদ

ঋতো আহমেদ

‘কোথাও রয়েছে তোমার প্রতি-নৈঃশব্দ্যের ভাষা।/কোথাও রয়েছে তোমার আদিত্য পৌরুষের ভিত।/কোথাও না-গিয়ে তাই, খুঁড়ে দ্যাখো, খোঁজো এখানেও /তারে; শিহরণ-সুষুপ্ত মাটির জলজ অঙ্গারে।’… এইরকম একটা জ্বলজ্যান্ত কবিতাও নাকি লিখে দিতে পারে ChatGPT; কেবল তার সাথে কথোপকথন প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। বলতে হবে কী চাই আমার। সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি নিয়ে মুহূর্তেই হাজির হবে সে। কী ভয়াবহ কথা! এখন যদি বলি কবিতাটা রবীন্দ্রনাথের স্টাইলে লিখে দিতে— তাও নাকি লিখে দেবে কয়েক মুহূর্তের ভেতর। কবি-সাহিত্যকের দিন তাহলে শেষ। কারা এরা? কী সব করে ফেলছে পৃথিবীতে! এমদাদ বলছিল, মানববিধ্বংসী কাজ-কারবার। এগুলো থেকে দূরে থাকাই ভাল। সত্যি কি মানববিধ্বংসী? নাকি যুগান্তকারী আরও একটি মহাধাপ এগিয়ে গেলাম আমরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা [AI] নিয়ে কাজ হচ্ছে বহু বছর ধরে। তারই একটা ফসল এই ChatGPT. এখন এর ব্যবহারকে করা হয়েছে উন্মুক্ত। কোম্পানির নামই রাখা হয়েছে OpenAI, অর্থাৎ সকলের জন্য উন্মুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যেন মানব জগতের সকলেই এর ব্যবহারে উপকৃত হয়। এখন আর আপনার কম্পিউটারের কোড ল্যাংগুয়েজ জানতে হবে না। কারও কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে বানিয়েও নিতে হবে না আপনার কাঙ্ক্ষিত ওয়েবসাইট। এখন এই সবই আপনার জন্য খোলা। দ্বার উন্মুক্ত। শুধু বলতে হবে কী চাই আর কেমন চাই। আপনার হয়ে সব করে দেবে OpenAI.

তাই বলে সাহিত্য? হ্যাঁ, হতে পারে। তবে তা পূর্ববর্তী সাহিত্য-তথ্যের উপর ভিত্তি করেই হতে পারে। নতুন কিছু সৃষ্ট হবার সে নয়। সে হতে পারে তথ্য নির্ভর কোনও রচনা। প্রাণময় সৃষ্টিশীল আর নতুন ভঙ্গির তা কিছুতেই নয়। মানব হৃদয়ে উদ্ভূত অনুভূতি ও তার প্রকাশের ভাষা একেক লেখকের ক্ষেত্রে হয় একেক রকম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী করে অনুভব করবে সেই অনুভূতি? ‘মাথার ভিতরে /স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে’…কী করে জন্মাবে তার মধ্যে সেই বোধ? আসলে ব্যাপারটা ওরকম না-ও। শুধুশুধুই বিচলিত হচ্ছি কেউ কেউ। মানবীয় সম্ভাবনার বিকল্প এ নয়। এর উদ্দেশ্যও তা না। এ শুধু আমাদের কাজকে সহজ করে দেয়ার একটা মাধ্যম মাত্র। একটা টুল। স্বপ্নের অগ্রযাত্রা।

উন্মুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথায় উন্মুক্ত শব্দটি আরও একটা দিকে ইঙ্গিত করছে আমাকে। কবিতার সঙ্গে সম্পর্কিত সেই ইঙ্গিত। যার কথা শুনেছিলাম বেশ ক’বছর আগে এক কবি বন্ধুর কাছে। উন্মুক্ত বা খোলা কবিতা হতে পারে কি? যদি হয়, তো কেমন হয় সেটা? কবিতায় উদ্দীপিত বাস্তবতার [Augmented Reality] ভাবনা নিয়ে কথা বলেছিলাম কোনও এক গদ্যে। শামশের আনোয়ার আমাদের অনেকটা সেইরকম কবিতাই উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু না, সে বিষয়ে কথা বলছি না আজ। বলতে চাচ্ছি খোলা কবিতার কথা। তার আগে বলছি গতকাল সন্ধ্যার কথা। সন্ধ্যার পরপর হঠাৎ করেই বইমেলায় দীন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। চৈতন্য থেকে একটা বই কিনে ফিরতে যেতেই দেখি স্টলের সামনে বসে আছেন কবি মোস্তাক আহমাদ দীন। যথারীতি মাথায় নেরুদা-টুপি। প্রায় ১৯ বছর পর অপ্রত্যাশিত মোলাকাত। জলধি থেকে তাঁর সদ্য প্রকাশিত গদ্যের বই ‘কবিতা পড়ার পরে’ আমার সঙ্গেই ছিল। লিখে দিলেন শুভেচ্ছা বার্তা। এই দীন ভাই একবার ‘মঈনুস সুলতানকে লেখা চিঠি’ শিরনামে একটা কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোয়। আসুন পড়ি সেই কবিতা—

আপনার ক্যামেরায় তোলা গাছে ঝোলানো

কাঠের মুখোশটি দেখে

আমার মাণিক চামারের মুখের কথা মনে পড়ল

সেই একই দাড়ি, লোকে বলত মাণিক্যা চামার,

যে পাশ দিয়ে গেলে পায়ের চামড়ার স্যান্ডেলের দিকে

তাকিয়ে বলত; ‘সিলাই লাগবনি বা মলবির পুত?’

আমি মনে মনে শ্যানানডোয়ায় ঐ মুখোশটির

কাছে চলে গেলাম

অবিকল মাণিক্যা চামার, আমার ভয় হয়,

মাণিক্যা কাকা সত্যি সত্যি যদি তাকায় তো নির্ঘাতই বলবে

‘এ তো বেটা রাবারের বুট, আমি ইতা সিলাই করি না’;

গত ১৩ মে মধ্যরাতে আমাদের গ্রামে

আমি আর শেখ লুৎফর, যার গল্পে আপনারই মতো

খাঁটি মৈমনসিংগের শব্দের সঙ্গে পেহলভি শব্দ একাকার

মাণিক্যা চামারের বাড়ি খুঁজতে গিয়েছিলাম

দেখি ৪৭টি ঘাসের ওপর থেকে ৭১টি জোঁক

আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে

আমরা এক দৌড়ে মতিলাল ডাক্তারের বাড়ি পার হয়ে

সোনাওর ডাক্তারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম

আমাদের গন্তব্য আর দূরে নয়

আলজান্নাত এডুকেশন ইন্সটিটিউট

যেখানে মুহম্মদ ইমদাদ সেই রাত ১২টার পর থেকে

তার রাগী মুক্ত কবিতা শোনানোর জন্য অপেক্ষা করছে

সে’রাতে কোন কোন কবিতা শুনিয়েছিল ইমদাদ, জানা নেই। তবে তাঁর মুক্ত কবিতা [তাঁর ভাষায় ‘খোলা কবিতা’] ফেসবুকের কল্যাণে মাঝেমধ্যেই পড়তে পারি আমরা। পড়তে পড়তেই মনে হয়, তাঁর লেখার আঙ্গিক খুবই স্পষ্ট। কোনও আড়াল নেই। তাঁর এই লেখার স্টাইলটা আমাদের জন্য বিপুল বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার মতো। যে কোনও পাঠককে প্রবলভাবে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। কবিতার একটি কাজ হচ্ছে সত্য বলা। পাঠক পড়তে পড়তে সেই সত্যের উপলব্ধিতে পৌঁছান। একই সত্য একেক জন কবি একেক আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন আমাদের সামনে। আমরা বিস্মিত হই। ভাবি, কীভাবে সত্যকে খুঁজতে হয় তবে? একজন কবির সেই সত্যকে খুঁজে পাওয়ার পথটা কেমন? মাঝে মাঝেই তো কবিকে নিষ্ফলাও দেখা যায়। দিনের পর দিন চলে যায়, একটাও কবিতা লিখতে পারেন না কবি। কেন এমন হয়? কোনও সত্যকে খুঁজে পান না কি তখন? নাকি নতুন কোনও আঙ্গিকের অপেক্ষায় থাকেন? আমরা অবশ্য জানি বেশিরভাগ লেখকই লিখে থাকেন তাদের ভিতরকার বিশেষ কোনও অভিপ্রায়ে কিংবা শক্তির তাড়নায়। সেই শক্তিটাও হয়তো কাজ করে না। আবার লেখকের কাছে বা একজন কবির কাছে কবিতা রচনা তাহলে কেমন? আনন্দহীন, বেদনাময়? কী হয় আসলে লেখায়?

এক সাক্ষাৎকারে গ্রাস [গ্যুন্টার] বলেছিলেন, লেখায় কী হয়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মিলে একটা সমগ্র তৈরি হয়, ঠিক যেভাবে পাথর খোদাই করতে করতে পূর্ণতা পায় সম্পূর্ণ একটি ভাস্কর্য। ভাস্কর্য গড়তে গেলে আপনাকে চারপাশে কাজ করতে হবে, আপনি যদি এদিকের একটুখানি বদলান তো ওদিকেরও একটুখানি বদলাতে হবে। তো, আপনি পাথরটিতে এমন এক পরিবর্তন ঘটালেন, ফলে একটি মূর্তি দেখা দিল, বিমূর্ত থেকে জেগে উঠল মর্মর এক মূর্তি এবং একটি বিশেষ কিছু সে প্রকাশ করতে লাগল। সে যেন শিল্পীর হাতে বিশেষ কিছু হয়ে উঠল। টের পাওয়া গেল এই মূর্তির ভেতর সংগীত আছে, জমাট বাঁধা সংগীত। লেখার ক্ষেত্রেও আসলে একই ব্যাপার। … সারাদিন হয়তো একটি লাইন নিয়ে বসে আছি, এগোতে পারছি না, পরের লাইন মাথায় আসছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে লেখাটা প্রবহমান।

আমরা ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করেছি ঠিকই, করে চলেছিও, কিন্তু আমাদের যাতনা বাড়ছে, দুঃখবোধ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতির অবসানের কোনও লক্ষণও নেই। বরং প্রতিদিনই আরও নতুন নতুন যন্ত্রণা আর বেদনার জন্ম দিয়ে চলেছি। যে জীবনকে যাপন করছি আমরা তা নিত্যদিনের জীবন। আর এই জীবনে রয়েছে প্রচুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় যেগুলো আমাদের প্রতিমুহূর্তে নাড়া দিয়ে যায়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই আমাদের সামনে অদ্ভুত এক পৃথিবী। আমাদেরই তৈরি আজব এক সমাজ, আশ্চর্যের তার রীতিনীতি, উদ্ভট তার কার্যকলাপ। না চাইলেও আমরা এর অংশ। মুহম্মদ ইমদাদের খোলা কবিতাগুলো আমাদের উপলব্ধি করায় এইরকমই এক পৃথিবীর ফাঁদে আটকে পড়া ব্যক্তিমানুষের ক্ষোভ ও আর্তচিৎকার। আসুন একটি খোলা কবিতা পড়ি—

          মুহম্মদ ইমদাদ

অনেক জ্ঞান সঞ্চয় করা হলে

আমি সেই জ্ঞান বিক্রির জন্য

বাজারে যাই।

আমাকে কিনে নেয় কারা

আমি তাদের চিনতে পারি না

তবু আমি হাসিমুখে বিক্রি হই

যেহেতু আমিই আমার মালিক

আমিই আমার জ্ঞান

তাই জ্ঞান ও টাকাসহ

আমি চলে যাই ওদের দেশে

টাকা দিয়ে আমি একটা ঘর ইত্যাদি কিনি

টাকা দিয়ে ভাত ইত্যাদি খাই

টাকা দিয়ে বিয়ে ও শৌচ ইত্যাদি করি

আর জ্ঞান দিয়ে ওদের ইচ্ছা পূরণ করি

পূরণ করতে করতে গান গাই

ওরা আমাকে বলে তোমার জ্ঞান দিয়ে

এমন একটা বন্দুক বানাও

যে-বন্দুকটি নিজেই নিজেই গুলি বানাতে পারে

যে-বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছা করা মাত্র

বেরিয়ে যাবে তিনকোটি বিরাশি লাখ গুলি

আর গুলিরা যেদিকে মানুষের গন্ধ পাবে

সেদিকেই ছুটে যাবে হত্যা করতে থাকবে

হত্যা করতে করতে ক্লান্ত হলে

ফিরে আসবে আবার বন্দুকের পেটে

আমি তাদের বললাম, আপনারও তো মানুষ

আপনাদের গায়েও তো মানুষের গন্ধ

যদি ছুটে আসে আর হত্যা করে ফেলে

আপনাদেরকেও

তারা চিন্তায় পড়ে যায়

আর বলে, তাহলে আগে আমাদের অন্যকিছু বানাও

অর্থাৎ আমাদের সিংহ বানিয়ে দাও

অথবা কুমির

সব মানুষ মারা শেষ হলে

আবার আমাদের মানুষ বানিয়ে দিও

আমার জ্ঞান তা পারবে না বললে

ওরা আমাকে মেরে ফেলবে

অর্থাৎ কেড়ে নেবে ভাত, বউ, ঘর

আমি তাই বলি ‘আচ্ছা।’

আর ওদের সিংহ বা কুমির বানাতে লাগি

কিন্তু কোথাও একটু ভুল হয়

আর ওরা হয়ে যায় সাপ ও শূকর

আর তাদের আমি বনের পথ দেখিয়ে

বন্দুকের পরিবর্তে গান বানাতে থাকি

গানের মধুর স্বরে একদির ওরা বন ছেড়ে এসে

আমাকে ঘিরে ধরে আর চোবল মারতে থাকে সাপ

আর দাঁত দিয়ে আমার মাংস ও হাড় খুলে নেয় শূকর

[জ্ঞান/মুহম্মদ ইমদাদ]

কাকে কবি বলব আমরা? কুণ্ডেরার মতে আনুমানিক সেই মানুষটি, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য যার মা তাঁকে এমন এক পৃথিবীর পথ দেখিয়ে দিয়েছে, যে পৃথিবীতে সে প্রবেশ করতে পারছে না। নান্দনিক বা মনস্তাত্ত্বিক নয়। কবির সংজ্ঞা এখানে সমাজতাত্ত্বিক। কারণ আমরা কেউই সমাজ ও রাষ্ট্রের বাইরের নই। আমাদের কাজ, আমাদের অন্তর্জগৎ, নন্দন—সবকিছুই প্রভাবিত হয় সমাজের দ্বারা। মানুষকে ধরা যায় তার নিজস্ব অস্তিত্বের সংকটের নির্যাসের মাধ্যমে। মুহম্মদ ইমদাদের কবিতা সেই নির্যাসকে দারুণভাবে অনুভব করায়। বিমূর্ত গল্পের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে সত্যানুভূতি। উপলব্ধ সত্যটুকু নিয়ে যে কোনও পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতে পারে সে। এখানেই তাঁর কবিতার শক্তি। তাই হয়তো লুত্‌ফর ভাইয়ের[শেখ লুত্‌ফর] স্কুল পড়ুয়া মেয়েটিও বলতে পারে ইমদাদ আঙ্কেলের কবিতা আমার ভালো লাগে। সহজেই বুঝতে পারি। আবার কৌতুক করে পলাশ ভাই [পলাশ দত্ত] বলেন, তুমি তো কবিতার হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠছ দিনদিন। সহজ, কিন্তু তরল নয়। মর্মস্পর্শী। প্রচলিত কবিতার সংজ্ঞা এখানে বদলে গেছে। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত কিংবা চেনা/পরিচিত কোনও কবিতা-ছন্দ নেই। নেই কোনও পরিচিত কবিতা-গঠনও। যারা বলে থাকেন কবিতা লিখতে হলে ছন্দ শেখো আগে। ছন্দ না জানলে কবি হওয়া যায় না, কবিতা লেখা যায় না— কেন বলেন আমার বোধগম্য হয় না।

জীবনরে ভাবছিলাম পাখির পালক

কবে থেকে ভারি লাগছে মনে নাই

তবে দিনদিন ভারি লাগতেই থাকবে এমনটা ভাবি নাই

ভাবছি এই ভার থাকবে না

জীবন পাখির পালকের মতোই হালকা থাকবে

আর আমি তারে নিয়া যাবো নদীর পারে

দেখব সূর্য অস্ত যাচ্ছে ওপারে, অন্যকোনো দেশে

কিন্তু না, জীবন দিনদিন ভারিই হলো

এখন আর চলতে পারি না

মাটির সাথে চেপে ধরছে

মনে হয় কবরে না পুঁতে ছাড়বে না।

[জীবন/মুহম্মদ ইমদাদ]

আমাদের জীবন আরও বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত হবে বাহ্যিক পরিস্থিতি দিয়ে। এই পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যাবার কোনও পথ নেই, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া। এই যে একটা উপলব্ধি, এটা সমাজে উপস্থিত এক ব্যক্তিমানুষের উপলব্ধি। আমরা ভাবি একরকম কিন্তু ঘটে আরেকরকম। জীবনকে ভারি লাগে। জীবন আমাদের ক্লান্ত করে। জীবনের রহস্যগুলো একে একে উন্মোচিত হতে থাকে আর আমরা স্বপ্নহীন হয়ে পড়ি। বিষাদ আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে। মনে হয় ‘আমি স্বর্গ হতে ভ্রষ্ট বর্ণহীন ব্যথিত গোলাপ/ অশান্ত অতৃপ্ত এক দেবশিশু পরম সুন্দর/ কোথায় এলাম…’ [পবিত্র মুখোপাধ্যায়]।

আবার এইরকম কবিতার একটা বিপদও রয়েছে। তাৎক্ষণিকতার বিপদ। লিখতে লিখতে এই গদ্যের কিছু অংশ ফেসবুকে পোষ্ট করেছিলেম। সেখানে গদ্যকার, বন্ধু, এমদাদ রহমান এক মন্তব্যে লিখেছে, ‘কাজ থেকে ঘরে ফিরছি [সে প্যারিসে থাকে], আর নিজের মুদ্রাদোষে সেই একই ভুল! যে-স্টেশনে নামার কথা, তোমার পোস্ট পড়তে পড়তে, কখন পার হয়ে গেছি, বলতে পারি না; আবার প্ল্যাটফর্ম বদলে অন্য ট্রেন… এই নামতে ভুলে যাওয়ার কারণ তোমার পোস্টের ইমদাদের কবিতাটি। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল এই রকমের কবিতা পড়তে চাই না। যা সত্য হতে চলেছে—তা কেন পড়তে হবে? ভাবছিলাম কবিতাটি কেন শুধু আমাকেই ছুঁয়ে গেল না!?’ মন্তব্যটি ভাবনায় ফেলে দিল আমাকে। যে বিপদের কথা ভাবছিলাম আমি, এমদাদও কি সেটাই অনুভব করতে পারছিল? কবিতা তাহলে কী? কেমন হতে হয় একে?

সম্প্রতি হাসান রোবায়েত তাঁর এক বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখেছেন, ‘কে যেন বলেছিলেন, ‘রুটিই সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা যা মানুষকে ক্ষুধা থেকে মুক্তি দেয়—’ যে কথা মানুষের মর্মে গিয়ে বিঁধে থাকে যেমন উড়ন্ত হরিণের শরীরে বর্শা বেঁধে, তেমন, তাই হয়তো কবিতা বা তা-ও নয়—

যে বাক্য আপনার সাথে কেবল প্রতারণা করতে পারে খালি তাই কি কবিতা?’

হ্যাঁ, প্রতারণা কবিতা নয় ঠিকই, তবে সত্যি কি সেটা প্রতারণা? নাকি আমারই অপারগতা। কবিতা মাঝেমধ্যেই যে অনির্বচনীয় অনুভবে পৌঁছায় আমাদের, তার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতারণা কেন মনে হবে আমার! আবেগ আমাদের বিদ্ধ করে ঠিকই, কিন্তু নিছক আবেগ কবিতা নয়, এ আমরা সবাই বুঝি। ওর সঙ্গে থাকতে হয় কাব্যগুণ। সংকেত। আর সেই সংকেতটুকু ধরতে না পেরে, কেউ কেউ ভাবছি প্রতারণা।

সমুদ্রকে ঘরে আনবে

এমন প্রেমিক কোথায়?

তাই গ্লাসে, কলসে

তোমাকে তারা পায়

ভাবে সমুদ্র পেলাম।

কিন্তু গ্লাস-কলসের তুমিতে

জোয়ার নাই।

অসীমতা নাই।

সম্পদ নাই। বিপদ নাই।

সুদূরের পিয়াস জাগে না মনে।

সবাই তবু জোর করে

সম্পদ খোঁজে, বিপদ খোঁজে

জোয়ার খোঁজে

সুদূরের অসীমতা খোঁজে

কিন্তু তখন তুমি সমুদ্র না

সমুদ্রের শব

শবের অন্তর ভেঙে তারা

বের করে আনতে চায়

ডুবে যাওয়া জাহাজ

হীরা রত্ন মানিক

কিছুই পায় না বলে

তোমার সঙ্গে ঘটে

বিবাদ

আর তুমি বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাও

মেঘ হয়ে

পুনরায় মিলিত হও তোমার

সমুদ্র রূপের সঙ্গে

তখন কী

অসম্ভব সুন্দর, কী ভয়াল বিউটি

তুমি

কী সম্পদ আর বিপদে ভরা তোমার

গর্ভ  

তুমি দেখার চাঁদ

তুমি নিঃশরীর সুবাস

তুমি হাওয়া

তুমি শ্বাস

[বিবাহ/মুহম্মদ ইমদাদ]

এমদাদ আরও লিখেছিল পরে, ইনবক্সে, ‘কবিতার ভঙ্গি এ’ নয়। এই ভঙ্গি বানী চিরন্তনীর। আমার কথা ভুল হতে পারে। তবে, একটা কবিতায়—পাঠের পর— দীর্ঘক্ষণ থাকার মতো কিছু নেই এই ধারায়। চমক আছে। কিন্তু, কিছুই মনে থাকে না পরে। আমি তো কবিতা পড়ার পর দীর্ঘক্ষণ এর আবেশে থাকতে চাই।’ এই প্রসঙ্গে একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, ‘যে কবিতা স্মৃতিতে ধারণ করা যায় না, সে কবিতা বেশি দিন বাঁচে না।’ শুধু শক্তি নয়, এ রকম ধারণা অনেকেই পোষণ করেন। তবে সব কবিতাই যে তাৎক্ষণিকের, তা কিন্তু নয়। আবার সব কবিতাই স্মরণযোগ্য, তাও না। পার্থ শর্মা লিখেছিলেন, ‘কবিতার কোনও হার হয় না। ভালো মন্দের লড়াইয়ে একমাত্র জয় কবিতার। কারণ, কবিতাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। জীবনের সমস্ত লড়াই, তুচ্ছতা, ক্ষিন্নতাকে অনায়াসে অতিক্রম করে সে এবং বাস্তব, যুক্তি, বুদ্ধি, অবাস্তব, কল্পনা আর যন্ত্রণার যাঁতাকলে প্রকৃতপক্ষে কবিতারই জন্ম হয়। বেড়ে চলে কবিতা, বয়ে চলে কবিতা।’ পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ‘কবিতার বাস্তবতা’ থেকে আমরা জানতে পারি, “কবিতা মানুষের হৃদয়ের গভীরের কথা। এ থেকেই তৈরি হয়েছে উপাসনা, সংগীত ও ধর্মের উপাদান। প্রকৃতির মুখোমুখি হয়েছিল একদিন কবি… প্রাচীনকালে তার সন্ধি ছিল অন্ধকারের সঙ্গে, আজ তাকে আলোকের ব্যাখ্যাতা হতেই হবে। আসলে বাস্তব বা অবাস্তব বলে প্রকৃত কবিতার বিভাজন সম্ভবই নয়। কবিতা হৃদয়ের অনুভূতি সঞ্জাত এক প্রখর উপলব্ধি, প্রজ্ঞাজারিত, কল্পনা বিসারিত।” কিন্তু যে আবেশের কথা বলেছিল এমদাদ—

কীভাবে উদ্ভব হয় সেই আবেশের? বিভ্রম নয়, তবে কি আবেগ ও মায়া, সংকেত ও রহস্য, গূঢ় সত্য বা কবিতার সত্য, কাব্যগুণ ও বাকভঙ্গি—এই সবগুলোর উপস্থিতিই কবিতার কবিতা হয়ে ওঠার পথ।

২৩.০২.২০২৩; উত্তরা, ঢাকা।

=================