You are currently viewing খনিজ সম্পদ/  মোহাম্মদ কাজী মামুন

খনিজ সম্পদ/ মোহাম্মদ কাজী মামুন

খনিজ সম্পদ

মোহাম্মদ কাজী মামুন

খুড়ছিল, সর্বশক্তি দিয়ে সে খুড়ছিল। তার দেহমন ক্লান্তিতে নুয়ে এসেছিল, তবু এতটুকু বিরতি নেই। বয়ে যাচ্ছিল মিষ্টি হাওয়া, আকাশে ছিল মেঘের ভেলা, চারদিকে প্রাণের বন্যা। কিন্তু সেসবে তার খেয়াল ছিল সামান্যই, মাতালের মত বেলচা দিয়ে দিয়ে একের পর এক মাটি সরাচ্ছিল। মাঝে মাঝে হাতের আঙ্গুলগুলো সাঁড়াশির মত চালিয়ে দেখে নিচ্ছিল কিছু উঠেছে কিনা অমূল্য!

এক সময় হতাশায় মাথাটা ঝুলে পড়ে, নাহ্‌, বুঝি পাওয়া যাবে না! বাম হাতের তর্জনিটিকে চোখের নিম্নবর্তী হাড়ের উপর সেট করে বুড়ো আঙ্গুলে থুতনিকে ঠেক দিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। পরে বাকি আংগুলগুলো নাকের নীচ দিয়ে ঠোটের উর্ধ্বভাগে খোলমত বানিয়ে বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে রইল সামনের গাছটির দিকে। গাছেরও কত কাহিনী আছে, এই তো সেদিন  দেবেশ রায়ের উপন্যাসেই তো পাওয়া গেল, একটি ফরেস্টে কাঠ কাটার বিস্তারিত, বিশ্বাসযোগ্য অথচ মর্মন্তুদ এক বর্ণনা, কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়ার মত!

‘খাইতে আয় বাবা’..মায়ের ডাকটা ধ্বনিত হতে হতে ইতোমধ্যে মিইয়ে গেছে। সে একবার অবশ্য অস্ফুট গলায় বলেছে, ‘আসছি, এই আর একটু’। গাছটা ইতোমধ্যে আরো কাছে চলে এসেছে। গাছেদেরও জীবন আছে, স্বপ্ন ও সাধ আছে, বনের গাছ কাটা না হলে চাপা পড়ত প্রানীরা, গাছেরা রাজত্ব করত পৃথিবী জুড়ে। তখন ফরেস্ট থাকতো না কোথাও, অথবা পুরো পৃথিবীটাই ফরেস্ট হত। গাছের শাসনের বাড় বাড়ন্ত সবখানে, সাম্রাজ্যবাদের হুমকি সব কোণে, সেজনই এই নির্বিচার নিধন? গর্ভ যন্ত্রনার মত সারা শরীরে তার আড়মোড়া বয়ে যায়, বের হয় দুর্বোধ্য স্বরের চিৎকার। ‘বাজারে যাবি না? ফ্রিজডা খালি। মাছ-মাংস কিচ্ছু নাই।‘ – ওহ, আবার সেই আওয়াজ…. গহীন বনের স্তব্ধতা ভেঙ্গে খান্‌ খান্‌ হয়।

সে দুই হাত পেটের সামনে বেঁধে রেখে শরীরটা নিয়ে ডানে বায়ে দুলতে থাকে। বৃদ্ধাংগুল ও তর্জনির গ্যাপ দিয়ে বানানো সাময়িক ফ্রেমটি দিয়ে সে গালের মাংসকে ঠেলে উপরে তুলতে থাকে কিছুটা সময়, এরপর সেই একই উপকরণ দিয়ে  কপালের উপর আটা দলে দলে পরে  চালিয়ে দেয় রোলারের মত, ফলে  রাস্তাটি নতুন করে মিহি হতে থাকে। সেই রাস্তায় সে শুধু হাঁটছে, হাঁটছে, আর কিছুক্ষণ পর পর মানচিত্রটা খুলে খুলে দেখছে, কিছু পাওয়া যায় কিনা। হঠাৎ কোন স্পন্দন পেয়ে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে, মাটিগুলো কেমন লালচে, আর কি ভিন্নরকম, সে শাবল হাতে তুলে নেয়, উত্তেজনার বশে প্রবল বেগে চালায় হাতুড়ি, রক্তের মত বেরিয়ে আসে লাভা, ভয়ে পিছিয়ে যায় সে, দৌড়ুতে শুরু করে।

কানে আসে বাবা-মায়ের চিৎকার, একে অন্যকে বিষ ঢেলে দিচ্ছে, তাদের বয়স হয়েছে, তারা জানে একে অপরকে তারা মেরে ফেলবে না, তবু যুদ্ধ করে তারা অবিরাম, কথা বলে বলে। কখন অনুতপ্ত হবে তারা? হঠাৎ শিহরন খেলে যায় তার মধ্যে, এইতো পেয়েছে সে, পেয়েছে – মানুষ অন্যের দ্বারা কষ্ট পেয়েই শুধু আত্মহত্যা করে না, অন্যকে কষ্ট দিয়ে যে মর্মপীড়ায় ভোগে তার জন্যও আত্মহত্যা করে। শান্তি জাগে তার মনে, মুখে বিজয়ীর হাসি। ঘামে নেয়ে উঠেছিল, সামান্য হেলান দিয়ে বসে। কিন্তু সুড়ঙ্গের উপর উঁকি মারতে দেখা যায় ছোট্র সুফিয়াকে, সে হাত পেতে রয়েছে – সেও ঢুকবে সেখানে, খেলবে তার সরু দেয়াল ধরে। অগত্যা লোকটিকে উঠতে হয়, পোড়ামাটির ঢাকনাটি চাপা দিয়ে সে সুফিয়ার হাতটি নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে ফিরতি পথ ধরে।

বিশ্রামের পর আবার খোড়াখুড়ি শুরু হয় সুড়ঙ্গে, অনেক দিন কারো হাত পড়েনি সেখানে, পাথুরে জঙ্গল, ঝুলন্ত শিকড়বাকড়ে ছেয়ে গেছে সর্বত্র …প্রবলবেগে দলাইমলাই চালাতে থাকে সে। খোদাই করা মাটি, ধূলো, পাথর, উদ্ভিদের শব – সব মিলে একটি স্তুপ গড়ে উঠেছিল তার পাশেই, আর তার উপরেই বসেছিল পাখিটি। প্রথমে খেয়াল করেনি, পরে পরাণ কাড়া সুরে পাখিটি যখন ডেকে উঠে, সে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। দেখতে পায় সেজেগুজে বেরুচ্ছে তার মামি, কোথায় যাচ্ছে এই পড়ন্ত বয়সে? কিছু খুঁজতে বেরিয়েছে? আরো চোখে পড়ল কিছু চাকা, চালকের কঠোর শ্রমের পক্ষে বেশ শক্ত যুক্তি পেশ করলো তারা। এদিকে সদ্য গোঁফের রেখা জাগা ছেলেটিকে দেখে তার থেকে দু ক্লাস নীচের মেয়েটির মধ্যে বাঁকা হাসির রেখা জেগে উঠে নিমিষেই মুছে গেল। সব কিছু কেমন ব্যঞ্জনাময়! রহস্য মাখানো  ক্যানভাসটি সে উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকে! উদঘাটিত হতে শুরু করে পরম রহস্য যে লুকিয়ে থাকে মুড়ির ঠোঙ্গার মধ্যে,  উঁচু উঁচু দালানের ছাদে শুকোতে দেয়া কাপড়ে। ‘এ কি আনন্দ তরঙ্গ রে!’ – জুড়িয়ে যায় তার দেহ-মন।

সে ক্ষনিক পায়চারি করে এল, ডান পায়ের আঙ্গুল দিয়ে বাম পায়ের হাটুর নীচের মাংসে ক্রমান্বয়ে টোকা দিতে লাগলো। কিন্তু কেন জানি, ঘরটা ভীষন গরম হয়ে উঠছে। আস্তে আস্তে কালো ধোঁয়ায় ভরে গেল আকাশ-বাতাস, শুনতে পেল ছোটাছুটি, চিৎকার, সাইরেন, হাহাকার, বুক ফাটানো আহাজারি। বস্তির আড়াইশো ঘর পুড়ে ছাই, একটি তদন্ত টিম গঠন হয়েছে, বস্তিটির পাশেই ছিল মান্যি এক লোকের বিশাল প্রপারটি… কালিঝুলি মাখা শতচ্ছিন্ন এক দল পতঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে দেখছিল রয়েছে কিনা এখনো কিছু অবশিষ্ট… সুড়ঙ্গ খোঁড়ার গতি বাড়িয়ে দিল সে, গন্ধ শুঁকে বুঝতে পেরেছে অনেক অনেক খনিজ মিলবে এখানে…দিন-মাস-বছর-যুগ-শতাব্দী ধরে চলল সুড়ংগ অভিযান।

একদিন হঠাৎ  ভীষন আর্তনাদ করে বিষ্ফোরিত হল চারপাশ, জেগে উঠল স্বর্গ। খুঁড়তে খুঁড়তে মিলল সেই দেশ যেখানে বাস করেন দেবতা, যেখানে মন যা চায়, তাই হাজির হয় চোখের সামনে, সেখানে ভীড় অপরূপ হুরদের, আমন্ত্রন জানায় মনোহর উদ্যান, আর চোখ জুড়োনো সরোবর দল।

এখন আগের মত আর খুঁড়তে হয় না তাকে, অত শক্ত করে অত গভীরে ঢুকিয়ে দিতে হয় না বেলচা… অল্প কাঁচি চালালেই মিলছিল গুপধন…যেদিক চোখ যায়, যতদূর চোখ যায় – শুধু সোনা, মণি-মানিক্য। সাত রাজার ধন…সে হাতে তুলে নিতে থেকে, ফেলতে থাকে, গড়াগড়ি খায়, হাসে ,কাঁদে, চিৎকার করতে থেকে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে – তার অট্রহাসি সুড়ঙ্গের দেয়াল সব ধসিয়ে দিতে থাকে।

সে ধরে নিয়েছিল সব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু দেখে কিছুই হয়নি, প্রায় সবটুকুই যে অনাবিষ্কৃত! সোনার এই বিপুল ভান্ডার সে বাইরে নিয়ে আসবে কি করে! ভার সইতে না পেরে থরথর করে কাঁপতে থাকে! এক সময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে!

অনেক দিন বাদে কিছু লোক তাকে দেখতে পায় একটি গাছ তলায়। একটি বেলচা দিয়ে তলোয়ারের মত করে মুহুর্মুহু আক্রমণ শাণাচ্ছিল সে অনন্ত শূণ্যকে লক্ষ্য করে। সে কি মাছি মারছিল? নাকি গল্প তাড়াচ্ছিল, প্রতি মুহূর্তে যারা তার মাথায় ভর করত? সে বলত তার গল্প-পাওয়া রোগের কথা, কেউ সে কথা বিশ্বাস করেনি। একটা সময় সে সবকিছুতেই গল্প পেত, সব গল্প মিলেমিশে এমন গল্পহীন হয়ে উঠতো, সে শেষ খুঁজে পেত না আর!

সে বলতো সে খুঁড়ে খুঁড়ে স্বর্গকে খুঁজে পেয়েছিল, কেউ বিশ্বাস করতো না সে কথাও।  সবাই বলত, এ এক মস্ত গাঁজাখুরি গল্প। সবাই আরো বলতো, লোকটা একটা বদ্ধ উন্মাদ।