কোমলগান্ধারে ….. ভাস্কর চক্রবর্তী
পারমিতা ভৌমিক
ভাস্কর ষাটে এসেছেন, পঞ্চাশ তখন সবটুকু অমৃত নিয়ে গেছে। ফেলে গেছে আত্মজৈবনিক আস্বাদন মাত্র। ভাস্কর চক্রবর্তীতে তা অনেকটাই অনাড়ম্বর, অতীক্ষ্ণ, অবিদ্বিষ্ট, অচপল, অবসন্ন, বিমর্ষ, একটু জটিল, একটু স্বপ্নপর, একটু দূরত্বপরায়ণ এবং যথেষ্ট মমতাময়— এমন কথা মনে করেছে সমকাল। তাঁর কবিতা যদি ছবি হয়ে ওঠে কোনো অলৌকিক ছোঁয়া লেগে তবে বলতেই হয়, অনেক ছবি যেমন রেখানির্ভর তেমনি অনেক কবিতা পঙ্ক্তিনির্ভর সেখানে সরলরেখার মতো কবিত্বপূর্ণ পঙক্তিও আলাদা ঔজ্জ্বল্যে স্বাধিকার প্রকাশে প্রত্যয়ী, ভাস্করের কবিতা সে রকম রেখাচিত্র নয়, বহুবর্ণ ছবিও নয়। তবে কেমন সেসব????
শুধু সাদা-কালো জলরঙে পটের উপর রেখাহীন কোমল বিস্তার— ঘন, হালকা, গভীর, অস্পষ্ট, আচ্ছন্ন বিভিন্ন টোন।
যেমন প্রসঙ্গত তুলে আনতে পারা যায় :
” অথবা যে রাত্রিবেলার জন্যে সারাজীবন এই অপেক্ষা, সেই রাত্রিবেলার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি মনে হয়। ঝড় আসার আগের মুহূর্তে পাখিদের এখন তীক্ষ্ণ, সংক্ষিপ্ত চিৎকার। আর গাছেদের চিত্তচাঞ্চল্য – পাতা থেকে শুধুই পাতার ভেতর ছড়িয়ে পড়া। অন্ধকার ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আমি আমাদের ফাঁকা জীবনের কথা ভাবি। সেই সব বাতাসহীন রাত আর দুর্দশার কথা তোমাকে আমি লিখিনি কখনোই যা আমি একা একা কাটিয়েছি আমাদের কথা ভাবতে ভাবতে।— শুধুই পায়চারি-ভর্তি জীবন ছিল আমার। আর ছিল রাঙতায় মোড়া নতুন নতুন সব ট্যাবলেট। আমি আবার পাশাপাশি চেয়ারে আমাদের বসে থাকার কথা ভাবি। ভাবি, বিশাল কোনো রাত্রি ধুয়ে দেবে আমাদের দুঃখ, বেদনা ও অভিমান। ওগো কাঠের বাক্সে ঢাকা হারমোনিয়াম, তুমি গান গাইতে থাকো আমাদের।”
— এতটাই কোমল কবিতাদেহ কি সময়কে ছুঁতে সক্ষম???
এই রকম কোমল, উত্তেজনাহীন অনুভূতির আমাদের এখনকার ব্যস্ত হৃদয়কে ছুঁতে পারার কথা নয়। তা হলে ভাস্কর কী করে এত আকর্ষণ করছেন সমকালীনদের? মনে হয় , আসলে এই আকর্ষণের প্রধান কারণ তাঁর বাকভঙ্গি। বলার তরঙ্গে তরঙ্গে প্রতিটি অক্ষরের কোমল পর্দায় সুর সেধেছেন ভাস্কর। ভাস্করের ভাষাও নিখাদ। খাদহীন বলেই শুদ্ধ সুরে লেগে যায় প্রাণে প্রাণে টান। অলক্ষ্যেই প্রিয় হয়ে ওঠেন কবি ভাস্কর। গদ্য— সহজ, স্পষ্ট, একটু ভিজে, একটু আচম্বিত, লঘু এবং নাগরিক । কিন্তু তাঁর বলবার নির্ভার, নির্জন, শান্ত ভঙ্গিটি সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব। এই বাকভঙ্গির কারণেই তার লেখায় কবিতা উপরে ভেসে না উঠে, কাজ করে তলায় তলায়। গোপনে অঙ্কুরিত হয় মানবিক বীজ আত্মজৈবনিক জঠরে। এই নিরুচ্ছ্বাস স্নিগ্ধতা, অপ্রকটতা, আত্মীয়তা পাঠকের ভালোবাসা তো কাড়বেই।
কবিতা অনেকরকমের আছে— অনেক করণকৌশলের, অনেক প্রসঙ্গের। কিন্তু সেই কবিতাই কবিতা যা এই সমস্ত আপেক্ষিক বা ক্ষণিকের আলোড়নময় বাতাস পেরিয়ে পৌঁছতে পারে বিন্দুর মতো এক কেন্দ্রিত সত্যে। শুধু সেই কবিই তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে জানেন, ওই বিন্দুসত্যেই গোপন হয়ে আটকে আছে পুরো সৃষ্টির মূল অগণ্য জীবন যার পরিস্ফুটন। একটি গাণিতিক ধ্রুবসত্যের নির্বিঘ্ন বীজাধানে তার পরিবর্ধন। সেই সত্য বা সত্যের অনুভূতি ভয়ঙ্কর হবে কি সৌম্য হবে তা অবশ্য নির্ভর করে কবির সত্তাসারাৎসারের বিশেষ রঙের উপর। ভাস্কর সেখানে পেলব কোমল দৃঢ় ও সুন্দর !!!
কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর মতে সারা পৃথিবীটাই কবিতা দিয়ে তৈরি। তার একেকদিন নাকি ভেতরকার দরজা-জানলা গুলো সব খুলে যেত: হালকা হয়ে যেত শরীর ।পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের । সংবেদনায় সবটুকুই তাঁর কাছে অভিনব হয়ে উঠত। এভাবেই কবিতার বিস্ময়কর পৃথিবীতে তাঁর প্রথম উঁকি দেয়া।
ভাস্কর চক্রবর্তীর এইসব আর্যদর্শনে অভাবিত ‘একটা লোক’ এর দুয়ার খুলে যায়। কবি প্রায়শই দেখেছেন তাঁর জীবনের পাশেও একটা কেমন মায়াবী আলো জ্বলত। এভাবেই অলক্ষ্যে গরিব বাড়ির এক পাঠবিমুখ ছেলের কাছে কবিতা এসেছিল মুক্তির আশা হয়ে । আশ্চর্য এই যে কবিতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালোবাসার এমনই একটা অলৌকিক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে ,তারপর চাকরি বাকরি নিয়ে কখনোই তিনি আর তেমন মাথা ঘামান নি।
কবি নিজেই বলতেন, তিনি কবিতা বাদী। বাতিল অতিসাধারণ, সামান্য সব কথা ,ফেলে আসা দিন রাত তাকে সবসময় টোকা দিয়ে যেত।সেসব তিনি নতুন পোশাকেই সাজিয়ে নিন। বিশাল একটা মজা কে তিনি ধরতে চেয়েছিলেন তাঁর কবিতায়। ধরতে চেয়েছিলেন বিশাল হাসির কোনো শব্দদের কিন্তু তা সত্বেও বিষণ্নতাকে তিনি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। তাঁর নিজেরই মনে হয়েছে এ বিষন্নতা কেবল শহরকেন্দ্রিক জল্পনা নয়।
তাঁর চারপাশের যাপিত জীবনে জেগে উঠেছিল ভাঁজ করা কাগজের নৌকার মত একটা কিছু যাকে তাঁর কবিতার উপকরণ বলা যায়।কবি ভেবে ভেবে আকুল হয়েছেন, কোথা থেকে আসে এত কবিতা? শুধু কি ভাঙা জীবন আর ভাঙাচোরা চারপাশ থেকে? তবে কোন মাধুর্যে তিনি ভালোবাসার ব্যাপকতার রূপটিকে ও ধরে রাখতে চেয়েছিলেন? সৃজন রহস্যকে উপলব্ধির আলোয় খুঁজেছেন ভাস্কর। আশ্চর্য হতেন যখন দেখতেন মেঘের মতোন তাঁর মাথায় ভেসে ভেসে আসত কবিতার লাইনগুলো, কে পাঠাত এদের? এর উত্তর ছিল তাঁর ই অন্তরস্থিত আমির মধ্যে ঐ’ আমি’ পাঠাত।
ভারী অদ্ভুত চিন্তা সব প্রশ্ন হয়ে ভাসতো তাঁর মস্তিষ্কে ।কবিতা কি স্তব্ধতার ভাষা? কবিতা কি জানার মাঝে অজানাকে সন্ধান করা ?জীবন আর মৃত্যুর আলো-ছায়াময় খেলা? মিস্টিক কবির নিজেরই আবিষ্কার করা সেই জগতটিকে দেখে নিতে পারি তারঁই চোখ দিয়ে -সে জগৎ আলোয় ভর্তি একটা পাহাড়।সে আলো হাজার মোমবাতির। ঐ পাহাড়টা আস্তে আস্তে ডানা ভাসিয়ে শূন্যে উড়ছে আর ভেসে যাচ্ছে ।কবি নিজেই বলেছেন যে কবিতা তাঁর স্নায়ুকে শান্ত রাখে ।বেঁচে থাকতে হলে যে শুল্ক দিতে হয়, কবির উপলব্ধিতে তার নাম নিঃসঙ্গতা। এর বিপদজনক রূপটি কবি মানসে ধরা পড়েছে বারবার।এজন্যই কবিতা আরো বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনে।
অভ্যাসবশতঃ কবিতা তিনি কখনো লিখেননি। তাঁর সব কবিতার বইই তাঁর মতে তাঁর প্রথম কবিতার বই । এসব কারণেই কবিতার কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। কবির অধিকাংশ কবিতাই রাত্রিবেলায় লেখাতিনি স্বীকার করেন রাত্রি তার সুন্দর দুটো ডানা দিয়ে কবির সামান্য কবিতাকেও ছুঁয়ে আছে। কবির বিশ্বাস নির্দিষ্ট কোন ও শুরু নয়, কবিতার যেকোন লাইন থেকেই কবিতা শুরু হতে পারে।
গত শতকের ছয়ের দশকের কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। যদিও প্রচন্ড প্রাণশক্তির কথা তিনি নিজেই বলে গেছেন তবুও দেখেছি ,নৈরাশ্য, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার বোধ তাঁর কবিতায় সার্থকভাবেই রূপায়িত। কবি নিজেই জানিয়েছেন তিনি গরিব ঘরের ছেলে ।সেই যাপন জগৎ ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়-
“কেরোসিনের গন্ধে, আবার মনে পড়ে তোমাদের” (তোমাদের ২)।
কিম্বা অন্যত্রও দেখি
“দুপুর বারোটায়
আমি বাসন পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছি মেঝেতে– কলাপাতায় রোদ্দুর দেখে
আমি দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম একদিন -আমি কোনদিন
কোথাও যাইনি ,কোথাও যাওয়া হয়নি আমার”
(প্রীতি উপহার/ শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা) ।
অভাব সেই নিম্নবিত্ত জীবনের নিত্য সঙ্গী– এবারের শীতেও আমি টাকা পাইনি তেমন–যা দিয়ে কাঠের
চেয়ার টেবিল -কিনে ফেলতে পারি একটা– চেয়ার টেবিলের জন্য /শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা)
কবি যখন বলেছেন –
“আমার সমস্ত শরীর কর্পূরের মত, হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়ার আগে
আলমারির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে আমি আজ সারাদিন দেখতে চাই তোমাকে
( “চব্বিশ বছর, আমি/ ঐ)।
বস্তুত এই শীত ঘুমের মতই অবসাদ নিয়েই তৈরি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ” শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা”। এই কবিতায় এক ধরনের প্রতিসরণ ঘটে গেছে। কবি ও কথক ক্রমশ আশ্রয় নিয়েছেন বিছানাটুকুতে। কবির নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতাই যেন ভাষা হয়ে ফুটেছে তাঁর কবিতায়–
” আজ বিছানায়
পড়ে রয়েছে আমার সকালবেলার হাত পা আর মুখ- আমার আত্মা
আজ ভোরবেলা থেকেই সেদ্ধ হচ্ছে আমার ঘরে”
(বিছানায়/ ঐ)।
কবি সমকালের পরিস্থিতি তখন উত্তাল। দেশী এবং আন্তর্জাতিক অবস্থা ভয়াবহ । খাদ্য আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন ,নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে দেশ তখন অগ্নিগর্ভ । অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বৈরথ। ১৯৬২ তে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে কম্যুনিস্ট পার্টি তখন দ্বিধাবিভক্ত । সাধারণ মানুষ এগিয়ে চলেছে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। এই পর্বের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে নিরুচ্চার নমনীয় ও মৃদুকন্ঠ কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। কোন উপলক্ষ ছাড়াই কবিতা লেখার প্রতিভা তাঁর ছিল।
ভাস্করের কাছে কবিতারা ভেসে আসত যাপিত জীবন থেকে ।
দূরে কোথাও ভেসে যাওয়ার ইচ্ছেটুকু সম্বল করে কাব্যের গহীন গাঙে শিল্পীসত্তার ডিঙি ভাসাতেন ভাস্কর ।চিরদিনই তিনি বোধের এক অনাবিস্কৃত ভূগোলকে নিরিবিলিতে ছুঁতে চেয়েছেন।বিষাদ ,হতাশা ,মৃত্যু কিংবা সার্বিক নিরুৎসাহ- এমন যে কোন বিষাদের সুর ই বাজুক না কেন ,এক আশ্চর্য সমীকরণে ভাস্কর বেঁচে উঠতেন- তাঁর কবিতায় বাজত উজ্জীবনী সুর—
(‘শান্ত হও সুমঙ্গল ,শোনো,দুঃখ না যায় যদি বা ছাত থেকে লাফ দেবে?দুএকশো ঘুমের বড়ি খাবে?
একি একটা কথা হলো? এ কেমন তোমার হৃদয়?
ঢেউগুলো ওঠে আর আবার মিলিয়ে যায়
আরো একটু চেষ্টা করি সুমঙ্গল ,এসো বাঁচি, বেঁচে — থাকা যাক”)
ভাস্করের প্রথম কাব্যগ্রন্থের রোমান্টিকতার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে বিষন্নতা। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ”এসো সুসংবাদ এসো “–মগ্ন গদ্যে লেখা।স্বপ্ন নিষ্ট কবি প্রেমিকাকে আবিষ্কার করেন অজ্ঞাত কোন দেশের বাড়িতে নির্জন ছাতের ওপর ,একাকী। দুজনের মাঝখানে তখন কিছু দিন ও রাতের ব্যবধান । তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ,”রাস্তায় আবার”। এখানে বিছানা এসেছে –চিরন্তন মোটিফ হয়ে, ব্যথার সান্ত্বনাময় উপশম হয়ে, জীবনের সেরা পুরস্কার হয়ে। চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ,’দেবতার সঙ্গে’। দেবতা এখানে সখা, বন্ধু। নিজের খাতায় ঐ দেবতার মুখ এঁকেছেন ভাস্কর। বড় বেশি মান অভিমানে রচনা করা এক অনবদ্য সম্পর্কের কথা।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ এর কবিতা সংকলন ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে ‘।এখানে কবিতা শরীরী, অস্তিত্বময় । অলৌকিক নৈঃশব্দে সেখানে শব্দেরা কথা বলে-“ছোট এক ঘরে শুয়ে আজ/ মনে পড়ে প্রেমিক ছিলাম”( আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে।)
ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ,”স্বপ্ন দেখার মহড়া “।এখানে স্বপ্নের রং বাসন্তী ।পৃথিবী এখানে নিরুপদ্রব। ১৯৯২-১৯৯৭–পর্বের কবিতার চয়নগ্রন্থ ‘তুমি আমার ঘুম ‘। ১৯৯৭-২০০৪ পর্বের মধ্যেই রয়েছে ভাস্করের শেষ দুটি কাব্যগ্রন্থ- ‘কীরকম আছো মানুষেরা’ /ও , জিরাফের ভাষা’।
পারমিতা ভৌমিক – লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক