কেবলই গল্প
পিওনা আফরোজ
বড় রাস্তার পাশে এত সুন্দর সাত তলা বাড়ি নীলা এর আগে কখনো দেখেনি। নীলার ভেবে ভালো লাগে যে এত সুন্দর বাড়িটি তার নানুর। এর আগেও কয়েকবার নীলা বাবা-মায়ের সাথে এ বাড়িতে এসেছিলো। তখন এটি একতলা সাধারণ একটা বাড়ি ছিলো। লোনা-ধরা দেয়ালের বাইরের দিকটাতে কোথাও কোথাও বালি ধসে গিয়েছিলো। সিঁড়িগুলো ছিলো শ্যাওলা ধরা। সেই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে খোলা আকাশ দেখতো নীলা। ওর নানুই নিয়ে যেতো ওকে। ছাদের সাথে লাগোয়া একটা বরই গাছ ছিলো। নানু নিজেই সেই গাছ থেকে বরই পেড়ে দিতো। সেই বাড়িটির জায়গায় এখন চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আর আভিজাত্যে ঘেরা এই সাততলা বাড়িটি গড়ে উঠেছে।
দারোয়ানের কাছে পরিচয় দিয়ে বড় লোহার গেটটা পেরিয়ে যায় নীলা। চোখে পড়ে বাড়ির ভেতরের সাজসজ্জা। ঝকঝকে তকতকে চওড়া সিড়ি! প্রতিটি ফ্লোরে কাঠের কারুকাজ করা বিশাল দরজা ! বাড়ির করিডোর দেখে বোঝার উপায় নেই এটি শুধুমাত্র সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যই সাজানো হয়েছে। এছাড়া এর আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে নীলা! এরপরই দরজার বাঁ পাশের দেয়ালে ডোরবেলটিতে সুইচ দিতেই সতেরো-আঠারো বছরের একটি মেয়ে এসে দরজা খুলে দিলো। মেয়েটিকে দেখে এ বাড়ির গৃহপরিচারিকা বলে মনে হলো নীলার।
মেয়েটি নীলাকে দেখে বললো, ‘ আপনে নীলা?’
নীলা হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে মেয়েটি বললো,
‘খালাম্মা আপনার কথা কইছে। আপনে বসেন, আমি খালাম্মারে যাইয়া আপনের কথা কইতাছি।’
এর আগে এ বাড়িতে নীলা যে ক’বারই এসেছিলো, মায়ের সাথে এসেছিলো। এবারই প্রথম নীলা একা এসেছে। তাও মাকে না জানিয়ে। আগে তার বাবার সাথে মায়ের টুকটাক কথা কাটাকাটি হলেই তার মা এই বাড়িতে এসে উঠতো। রাগ কমলে আবার ঘরের বউ ঘরে ফিরে যেতো। বাড়িটি নীলার আপন নানুর বাড়ি নয়। নীলার মায়ের মামার বাড়ি। ঠিক মামার বাড়িও বলা যাবে না। মামার স্ত্রীর বাবার বাড়ি। অর্থাৎ পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া মায়ের মামির বাড়ি। যা পরবর্তীতে নীলার নানুর ভাইদের টাকায় একতলা বাড়িটি ভেঙে সাততলা করা হয়। যদিও নানু ফেরদৌসি রহমান তা স্বীকার করেন না , তিনি বলেন, এ বাড়িটি তার স্বামীর টাকায় করা। এলাকায় সামান্য একটা টেইলার্সের দোকান ভাড়া দিয়ে আর কত টাকাই বা পাওয়া যায় তা সহজেই যে কেউ ধারণা করতে পারবে! তার থেকে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে আর যাই হোক, এতো সুন্দর বাড়ি করা কখনোই সম্ভব নয়। বিদেশে নীলার নানু ফেরদৌসি রহমানের ভাইদের নিজেদের ব্যবসা রয়েছে। আয়-উপার্জন বেশ ভালো। দেশেও বড় বড় শপিংমলে বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। তার থেকে যা আয় হয় কিছু অংশ ভাইদের বুঝিয়ে দেয় বাকিটা নিজের কাছেই রাখে। ভাইরা যেহেতু দেশে থাকেন না তাই তাদের বোনের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
গৃহপরিচারিকা রাশেদার কথায় বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসে নীলা। ভাবে, আজ যে এখানে মাকে না জানিয়ে আসতে হবে, তা কখনো ভাবেনি সে। কয়েক মাস আগে বাবা হঠাৎ করেই সবাইকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে। মা ও বাবার দু’জনের দিক থেকেই আত্মীয়-স্বজন বলতে শুধু মালিবাগের এই নানু ছাড়া আর কেউ নেই নীলার।
সামনে রমযানের ঈদ। বাসার পরিবেশটা কিছুদিন ধরেই ভারী হয়ে আছে। বাবা যে নেই এই সত্যটাই এখনো কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। রমযানের সময়ে বিশেষ করে ইফতারের সময়টাতে বাবার শূন্যতাটা খুব করে আঁকড়ে ধরে নীলাকে। বাবার চেয়ার, তার পানি খাওয়ার গøাস, আলাদা করে রাখা ইফতারের প্লেট ! সবকিছুই যেন বারবার মনে করিয়ে দেয় স্বজন হারানোর কষ্ট। খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে নীলার চারপাশটা। সবকিছু কেমন শূন্য মনে হয়!
প্রতিদিনই ইফতারের টেবিলে বাবার কথা মনে করে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একটু পানি মুখে দিয়ে কোনোভাবে রোযাটা ভেঙে মা টেবিল থেকে উঠে নামায পড়তে চলে যায়। অস্পষ্ট একটা গুঞ্জনধ্বনি ওঠে। নীলা বুঝতে পারে মা নামাযের বিছানায় কাঁদছে আর দোয়া-দরুদ পড়ছে। তখন একদিকে বাবার শূন্যতা আর অন্যদিকে মায়ের বিষন্নতা দেখে আর কারোরই ইফতার করার ইচ্ছে থাকে না। অবশ্য ইফতারে প্রতিদিনকার সেই একই শুকনো মুড়ি আর পানি কেউ আগ্রহ নিয়ে খেতেও চায় না। তাই টেবিল থেকে দুই বোনসহ উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে নীলা।
রাতে শুয়ে শুয়ে নীলা ভাবে- তার বাবার যদি অনেক টাকা থাকতো, তা হলে হয়তো এতোটা ভাবতে হতো না। মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ঘরের সবকিছুতেই কত পরিবর্তন এসেছে! আগে যেখানে মাসের এক তারিখেই বাড়িওয়ালার হাতে পৌঁছে যেতো বাড়ি ভাড়ার টাকা এখন বাড়িওয়ালা বারবার তাগিদ দিয়েও পাওনা টাকা আদায় করতে পারেন না। এইতো আজ সন্ধ্যায় খুব ঝাঁঝালো গলায় মাকে বলে গেলেন, ‘এই বাসার ভাড়ার টাকা যেহেতু যোগাতে পারবেন না, তাইলে বস্তিতে গিয়া উঠেন। আমি আশ্রয়কেন্দ্র খুইলা বসি নাই- যে ফ্রি ফ্রি আপনাদের থাকতে দিব।’ তাছাড়া ঘরে ঠিকমতো চাল- ডালও থাকে না। রুনা সেদিন স্কুলে যাবার আগে ভাত খেতে গিয়ে দ্যাখে সাথে তরকারি নেই, গলা চেঁচিয়ে মাকে বললো, ‘ মা ও মা,খালি ভাত কীভাবে খাবো? কিছু না থাকলে অন্তত একটা ডিম ভাইজা দাও।’
মা বারান্দায় কাপড় নাড়ছিলো। রুনার কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বললো, ‘ডিম থাকলে তো দিব! খালি ভাত যে জোটে তাই তো অনেক! খাইলে খা, না খাইলে নাই।’ রুনা না খেয়েই স্কুলে চলে যায়। স্কুল থেকে ফিরে কারো সাথে কোনো কথা না বলে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। নীলা ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে কাঁদতেছিস কেন? কি হইছে?’
নীলার কথা শুনে সে উঠে বসে। কিন্তু তখন আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নয়, শব্দ করেই কাঁদে রুনা।
‘আরে কি হইছি বলবি তো!’
‘আপা,আজকে লতা মিস স্কুেেলর এ্যানুয়াল প্রোগ্রাম থেকে আমাকে বাদ দিয়ে দিছে।’
নীলা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,‘ক্যান?’
মিস বলেছে সবার নাকি একরকম শাড়ি পরতে হবে। সবুজ শাড়ি লাল পাড়। আমি মিসকে বলেছিলাম যে আমার সবুজ শাড়ি নাই। মিস তখন বলেছে ,না থাকলে কিনে ফেলেতে! কিন্তু আপা শাড়ি কেনার টাকাতো এখন নেই।
মিসকে এই কথাটা বুঝিয়ে বলেছিলি?
হ্যাঁ আপা বলেছিলাম। মিস আমার কথা শুনে সবার সামনে খুব বিরক্ত হয়ে বলেছে, ‘শাড়ি কিনতে পারবা না, তাইলে অনুষ্ঠান করার এতো সখ ক্যান। শাড়ি না কিনতে পারলে তোমার অনুষ্ঠানে থাকার দরকার নাই।’
রুনার কথা শুনে নীলা তখন কিছু বলতে পারেনি। কিইবা বলার ছিলো তার! সে তো নিরুপায়! অর্থের কাছে জীবনের সব প্রয়োজন, সব ইচ্ছে যেন দাসত্ব বরণ করেছে।
সামনেই এস. এস. সি পরীক্ষার ফর্মফিলাপ করতে হবে। তাই মা কত জায়গায় বাবার পাওনা টাকাগুলো চেয়েছেন- কিন্তু কেউ মাকে টাকা ফেরত দেয় নি, এমনকি কোনো আশার বাণীও শোনায় নি। কিছু হালকা ওজনের সোনার গয়না ছিলো মায়ের, তাও তো বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে। পড়াশোনার কথা নীলা এখন আর ভাবে না, ভাবনা শুধু দু-বেলা দু মুঠো ভাত খেয়ে মা আর বোনদের নিয়ে দিন কাটাতে পারলেই হলো! তার যে ব্যবস্থা কীভাবে হবে নীলা ভেবে পায় না! এমন অনেক ভাবনা ভাবতে ভাবতে বন্ধ করা বইয়ের পাতার মতো দু’চোখের পাতা এক হয়ে যাচ্ছিলো নীলার। ঘুম নয়, জাগরণ আর তন্দ্রামেশানো একটা আবেশ জড়িয়ে ছিলো তার দু’চোখের পাতায়। চোখ খুলে দেখে মা তার পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার কোমর জড়িয়ে। মায়ের এমন মমতায় নীলার কান্না পায়। অবোধ শিশুর মতো ভাবতে থাকে-এতো তাড়াতাড়ি বিধাতা তাদের কাছ থেকে বাবাকে না নিলে কী এমন ক্ষতি হতো! একজনের অভাবে পুরো পরিবারটা শূন্যতায় ঘিরে রয়েছে। সারাক্ষণ সবার মুখে বিষন্নতার গাঢ় অন্ধকার। নীলার পাশে শুয়ে থেকে তার মা ধীর গলায় নীলাকে ডাকে।
‘ঘুমিয়ে পড়েছিস মা?’
‘না, মা।’
‘সামনে তো ঈদ। ভাবছি, তোদের ঈদের কাপড়, ঈদের বাজার এগুলোর ব্যবস্থা কোত্থেকে হবে। তোর বাবা থাকতে তো কখনো এগুলো নিয়া আমারে ভাবতে হয় নাই। কিন্তু এখন যে কীভাবে কী করি…।’ বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মা। নীলা মায়ের হাতে আলতো করে হাত রেখে বলে,
‘এতো ভাইবো না তো মা, ব্যবস্থা একটা হবেই।’
‘কীভাবে হবে? আমাদের কি কেউ আছে, যে আমাদের দায়িত্ব নিবে? আর থাকলেও কার কাছে হাত পাতবি? আমাদের প্রয়োজন এখন অন্যদের কাছে বাড়তি ঝামেলা।’
‘মা, মালিবাগের নানুর কাছে একবার চাইলে হয় না? উনাদের তো টাকা পয়সার অভাব নাই। তাছাড়া বাবা বেঁচে থাকতে তো উনাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালোই ছিলো।’
‘না রে মা, তা হয় না। সে সময় তোর বাবা ছিলো, তখনকার ব্যাপার আলাদা।’
নীলা তার কোমর থেকে মায়ের হাত সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,‘কিন্তু মা ,আমার কথা না হয় বাদ দিলাম, মিলি আর শোভার কথা একবার ভাবো,ওদের বয়সী আশেপাশের সব বাচ্চারা যখন ঈদের দিন নতুন জামা পরে ঘুরবে, আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবে তখন রুনা,শোভা ওদের দেখে মন খারাপ করবে না! তাছাড়া সবাই বাসায় এলে তাদেরকেও তো ভালো মন্দ কিছু খাবার সামনে দিতে হবে।’
মা মুখ ভার করে বললো,‘সবই বুঝি। কিন্তু কী করবো, বল।’ নীলা প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য খাট থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো, ‘আচ্ছা এখন এসব বাদ দাও তো মা। ক্ষুধা লাগছে। আস ভাত খাই।’
খাওয়া শেষে রাতে শুয়ে শুয়ে নীলা ভাবে কাল একবার মালিবাগ যাবে। সন্ধ্যায় মায়ের সাথে বলা কথাগুলো নীলার মাথায় বারবার ঘুরতে থাকে। পাশে শুয়ে থাকা মায়ের মলিন মুখখানি দেখে তার খুব মায়া হয়। ভাবে- সে যদি এখন আরেকটু বড় থাকতো! ক্লাস টেনে না পড়ে যদি এখন তার একটা চাকরী থাকতো, তাহলে মাকে এতোটা চিন্তা করতে হতো না।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে নীলার নানু তার ঠিক সামনের সোফায় মুখোমুখি এসে বসেছেন- তা টের পায়নি নীলা। ফর্সা, গোলগাল মুখ, পরনে শিফনের শাড়ি। গলায় ভারী ওজনের সোনার চেইন। হাতে হীরের আংটিগুলো যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে! হয়তো কিছুক্ষণ আগেই বাইরে থেকে ফিরেছেন। নীলা উনাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। তিনি হাসি মুখে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
‘বসো, বসো। অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম! তোমার মা,ছোট বোনগুলা ওরা সবাই কেমন আছে?’
‘ওরা ভালো আছে নানু।’
তিনি মাথা নেড়ে বললেন,‘হুম। তোমার মায়ের এতো সুন্দর সাজানো গোছানো সংসারটা হঠাৎ কইরা এলোমেলো হইয়া গেলো। সবই আল্লার ইচ্ছা, বুঝলা ..’
‘ হ্যাঁ। মা সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকে। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমায় না ।’
‘কী করবে বল! একা মহিলা মানুষ, তার মাথার উপর এখন পুরো সংসারটা! সাধ করে তো আর কেউ দুশ্চিন্তা করে না। তবুও ওরে বুঝাবা । তুমি তো বড় মেয়ে। তোমার কথা ঠিকই শুনবে।’
‘জ্বী, নানু।’ সোফায় বসে হাত কচলাতে কচলাতে বলে নীলা।
‘তোমাদের সংসার এখন ক্যামনে চলতেছে? রমযানের মাস । বাজার-টাজার করছো তো?’
নীলা নানুর দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনছিল। নানুর কথার উত্তর দেয়ার আগেই তিনি আবারো বলতে লাগলেন,
তোমার বাবাতো খুব ভোজন রসিক মানুষ আছিলো। নিজেও খাইতো ,অন্যেরেও খাওয়াইতে পছন্দ করতো। এইতো গত রমযানে তোমাদের বাসায় তোমার বাবা দাওয়াত করছিলো, কত পদ দিয়া যে ইফতার করাইছে! আর তোমার মায়ের রান্নার হাত চমৎকার! এই দেখো,আমি একা একা কথা বইলাই যাইতেছি। ভালো কথা, তোমার মা আসলোনা ক্যান?’ কপাল কুঁচকে বেশ উৎসুক ভরা দৃষ্টি নিয়ে জানতে চাইলেন নানু ফেরদৌসি রহমান।
‘আমি যে আজ এখানে আসবো , মাকে বলি নাই।’ বলল নীলা।
নানু ফেরদৌসি রহমান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ক্যান?’
নীলা কীভাবে বলবে-সে এখানে যে জন্য যে এসেছে তাতে মায়ের সমর্থন ছিলো না। এই প্রথম কারো কাছে কিছু চাইতে এসেছে নীলা। এ যে লজ্জার, এ যে বড় কষ্টের! মা জানলে আরো কষ্ট পেতো! তবু সে ভাবে,তার ছোট হওয়াতে যদি মায়ের একটু দুশ্চিন্তা কমে, ছোট বোনগুলো যদি ঈদের আনন্দটুকু পায়, তাতেই সে খুশি!
নীলাকে নিরুত্তর আর তার মলিন, দ্বিধাগ্রস্ত মুখ দেখে ফেরদৌসি রহমান নিজ থেকেই বললেন, ‘তোমার কি টাকা পয়সা কিছু লাগবো?’
নীলা তখন ক্ষীণ গলায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘কিছু দিলে ভালো হতো।’
‘আরে, এটা নিয়া এতো লজ্জা পাইতাছো ক্যান? তোমরা না আসলেও তোমার নানারে দিয়া আমি হাজার দেড়েক টাকা পাঠাইয়া দিতাম। তোমাগো প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না! আমি তোমাগো লাইগা টাকাটা আগেই আলাদা কইরা রাখছিলাম। জানো তো আমার দুই ভাই বিদেশ থাকে। সব টাকা তাগোই। আল্লায় ওগো হাত ভইরা দিছে। ওরা আমারে খুব সম্মান করে , তাই ওগো সম্পত্তির ওপর যে যাকাত হয়, ওইটা আমিই যারে যা দেওনের দেই। এই নিয়া ওরা কোনো সময় আমার ওপর কথা কয় না।’ বলতে বলতেই তিনি সোফা থেকে উঠে এসে নীলার হাতে পাঁচশ টাকার তিনটা নোট গুঁজে দেন।
নীলা নির্বাক হয়ে নানুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাথার ভেতর বারবার শুধু দুটি শব্দই ঘুরপাক খেতে থাকে। এক সময় অস্ফূট স্বরে বলে,
‘যাকাতের টাকা!’
আর কিছু বলে না নীলা। তার সব কথারা যেন হারিয়ে গেছে! কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে আসে! তখন মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে নীলার। আজ আসি শুধু এটুকু বলেই নানুকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আরেকবার বাড়িটির দিকে তাকায়। ভাবে, সময় মানুষকে কত বদলে দেয়! বাইরে থেকে এখন বাড়িটির চাকচিক্যই শুধু দেখা যায়। প্রয়োজনের বেশি টাকা মানুষকে অহংকারী করে তোলে আবার টাকার অভাবেই মানুষ ভিখারী হয়। তার মনে হয়- এই আভিজাত্যপূণ্য বাড়ির ভেতরের মানুষগুলো আজ আর সেই পুরনো হৃদয়ের মানুষের মতো নেই। সেই একতলা সাধারণ বাড়ির সাধারণ মানুষ নেই। তারা শুধুই ছিলো । তারা এখন কেবলই গল্প।