কুকুর কাব্য
মোখলেস মুকুল
শহরের কেন্দ্রস্থলে মুক্তমে র ফাঁকা এবং নিরিবিলি মাঠে কিম্ভুতকিমাকার এক লোক আচমকা উদয় হয়। তার পরনে আসমানি রঙের ওভারকোট। সে কোথা থেকে দৃশ্যমান হয় কেউ বলতে পারে না। কোনো ভাবান্তর ছাড়াই চত্বরে একটা বিস্ফোরণ ঘটায়- বুম!
কানফাটা শব্দে এলাকার ঘুমিয়ে থাকা অসংখ্য নারী পুরুষের মধ্যে কেবলমাত্র পাঁচ পুরুষ অপর্যাপ্ত ঘুমের পোশাক পরেই চোখ মুছতে মুছতে মাঠে আসে এবং লোকটিকে ঘিরে দাঁড়ায়। তাদের গতি ছিলো অলস ভঙ্গির, চোখগুলো স্ফিত ও রক্তিম এবং দেখতে উষ্কোখুশকো। দেখে যে কেউ বলবে, তারা অজ্ঞাত কাল ঘুমিয়ে ছিলো।
গগনচুম্বি প্রাচুর্যতায় শহরের আকাশ প্রায় ঢেকে যেতে বসেছে, তার ফাঁক ফোকড় গলিয়ে যতোটুকু দেখা যায় তাতে ঘোলা পুরুষ্ট মেঘ থাকায় লোকেরা বুঝতে পারে না- এখন সকাল দুপুর না বিকেল। কোন ঋতু চলছে সে সম্বন্ধেও তারা জ্ঞাত ছিলো না। কেননা তারা ক্ষণে গরমে ঘামছিলো, ক্ষণে শীতে কাঁপছিলো।
অই অর্ধঅবচেতন মানুষগুলো রহস্যময় লোকটির মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর ভাবেÑ পরনে আসমানী রঙের ওভারকোটটি আসলে কী নির্দেশ করে? আকাশ না সাগরের প্রতিচ্ছবি।
আগত লোকটির দৃষ্টি প্রখর, হাত দুটি চ ল, অথচ পদচারণা ধীর গতির। তার হাতে সাদা দস্তানা এবং পায়ে ভারি গামবুট। ফলে অই লোকগুলি বর্ষাকাল না শীতকাল তা নিয়েও পুনরায় দ্বিধান্বিত হয়।
ঘোরের ভেতরে থাকা ঘুমকাতুরে লোকগুলো চোখ রগরে খেয়াল করে উদীয়মান লোকটির মাথায় হান্টিং ক্যাপ। ঠোঁটে হাভানা চুরুট। তারা ধরে নেয় লোকটি শিকারী এবং শিকারের কাহিনী শোনাবে বলে ডেকে এনেছে। ফলত তারা দাঁড়িয়ে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং চলে যেতে উদ্যত হয়।
খাড়ান। সহসা ধমকে ওঠে সে এবং পরক্ষণেই হাসে। ঘন কালো আর ছড়িয়ে পড়া গোঁফের কারণে সে যখন হাসে তখন পান খাওয়া দাঁতের মতো বিশ্রিরকম দু একটা দেখা যায়। সাপের জিভের মতো লকলকে খয়েরী জিভ বের করে খ্যাকখ্যাক করে কথা বলে। সম্মহিত করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক পলে সবাইকে উদ্ভ্রান্ত করে এবং বলে- আজ জাদু দেখাবো।
অতঃপর পুরুষগুলো প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে হা করে তাকিয়ে নতুন কিছু দেখে এবং ভাবেÑ তাহলে এই লোক কি জাদুকর!
তাদের বলিরেখার পরিবর্তন দেখে বোঝা যায় ক্রমশ তাদের ভাবান্তর হচ্ছে এবং এখন দাঁড়িয়ে থাকার আগ্রহ বাড়ছে।
অনাড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতায় জাদুকর হাতের বাঁকা লাঠি দিয়ে একটি বৃত্ত আঁকে এবং বলে- কেউ দাগের ভেতর আসার চেষ্টা করবেন না। এলে যে ক্ষতি হবে তার দায়িত্ব আমার না।
কিন্তু জাদুকর খেলা না দেখিয়ে গল্প বলতে শুরু করে- শুনুন, এই গল্প জাতক কাহিনির মতো হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। বহু কোটি বছর পূর্বে এক কন্যা শিশুর জন্ম হয়। একদা সে যুবতী হয় এবং অদ্যাবধি অমনি আছে। যুগে যুগে নেফারতিতি, ক্লিওপেট্রা, আরতেমিশিয়া, তামারা, জুডিথ, এলিজাবেথ এবং আরও কতো বিশ্বসেরা সুন্দরীর আবির্ভাব ঘটেছে; তাদের রূপ ও গুণ থেকেও বহুগুণে রূপান্বিতা গুণান্বিতা অই যুবতী।
ঘোরের ভেতরে থাকা লোকগুলো একে অপরের দিকে তাকায় এবং তাদের মনে প্রশ্ন উদয় হয়- কে এই যুবতী?
জাদুকর বলে- যুবতীর উদর থেকে চার পুরুষের জন্ম। শোনা যায় এদের লাগামহীন মিশ্রণে নাকি পরম জনের জন্ম। এরা বেড়ে ওঠে তিন ধাপে। প্রথম ধাপের সন্ধান পাওয়া যায় মানুষ যখন বন্য প্রাণির মতো বনে জঙ্গলে এবং পাহাড়ের গুহায় বাস করতো।
বৃত্তের ভেতর জাদুকর বিক্ষিপ্ত ঘোরে এদিক ওদিক চায়, ঘাড় কাত করে উৎকর্ণ হয় এবং চোখ পাকিয়ে বলে-দেখছেন বা শুনছেন কিছু? লোকটি উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পুনরায় বলতে শুরু করে- নগরের কেন্দ্রের সরোবরে পদ্মফুল ফুটেছে। তার শান বাঁধানো পাড়ে এক পাগল কম্বল গায়ে ঘুমায়। গাছে কদমফুল ফুটেছে এবং সেই গাছেই কোকিল ডেকে চলেছে। দুনিয়ায় গজব পড়তে বাকি নাই। মানুষ যা শুরু করেছে ঋতু বলে কিছু থাকবে না। একই সিজনে মাটি ফাটা রোদ হবে এবং বরফ পড়বে। সুমেরু এবং কুমেরু অঞ্চল মরুভূমি হবে। বিষুবীয় অঞ্চলে বরফের চাঁই ধ্বসে মানুষ মারা যাবে।
থাক এসব আমার বিষয় না। জাদুকর এই কথার পর বন- খেলা দেখেন চলে যান। কিন্তু সে খেলা না দেখিয়ে আবারো গল্পের বাকি অংশ বলতে শুরু করে। দ্বিতীয় ধাপটা শুরু হয় এভাবে- প্রস্তর দিয়ে প্রাণি শিকার করতে করতে একদিন তারা অগ্নিদেবতাকে আবিস্কার করে এবং এক পর্যায়ে তারা চাষাবাদের পদ্ধতিও আয়ত্বে আনে। চাষাবাদ করার কারণে তারা থিতু হতে বাধ্য হয়। তারা পদার্পন করে বর্বর সমাজে। তখন থেকেই শুরু হয় দখলবজি। টোটেম সমাজ ভেঙে সৃষ্টি হয় মালিক শ্রমিকের শ্রেণি সংগ্রাম।
জাদুকর এবার লম্বা দম নিয়ে এক বা দুই মিনিট চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং আর্দ্র কণ্ঠে বলে- হায় জগৎ! তয় শোনেন- তৃতীয় ধাপে এইসব বর্বর লোকগুলো লিপি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক জগৎ থেকে ঐতিহাসিক হয়ে সভ্য সমাজে প্রবেশ করে। এই সভ্য জগৎ মানুষকে সত্যিকার সভ্য না-করে লোভী ও হিংস্র করেছে। মালিক ও শ্রমিকের ব্যবধান বেড়ে হয়েছে রাজা ও প্রজা।
হঠাৎ জাদুকর কথা থামিয়ে ঝোলার ভেতর থেকে রাহুচন্ডালের হাড় বের করে এবং ঘুরিয়ে দর্শকদের চক্ষু নাকাল করে। এইবার লেকগুলির মনে হয়- সে সত্যি সত্যিই জাদুকর এবং এখন জাদু দেখাবে।
অতঃপর জাদুকর ঝুলি থেকে বের করে একটি মৃত মানবশিশুর অর্ধাংশ এবং মাটিতে শুইয়ে এক পলে সেটাকে একটা কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়। জাদুকর বিভ্রান্তকর হাসি হাসতে হাসতে বলে- ভাইসব, ভয় পাবেন না, খেলা শুরু হয়ে গেছে।
এই আচানাক কান্ড দেখে পাঁচ পুরুষের চক্ষু চড়কগাছ! তারা একে অপরের দিকে তাকাতেও ভুলে যায়। পালাতেও পারে না, যেন জাদুবিদ্যার প্রভাবে তাদের পা পুরাই অসাড় হয়ে গেছে।
এবার জাদুকর কালো রঙের ঝোলা থেকে একটা কমলালেবু বের করে এবং তর্জনীর উপর বনবন করে ঘোরাতে থাকে। তাকে ঘিরে অবাক দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ পুরুষকে জিজ্ঞাসা করেÑ আচ্ছা বলেন তো, এটা কী এবং কিসের সাথে এর মিল আছে?
পাঁচ পুরুষ স্পষ্ট বুঝতে পারে ওটা কমলালেবু এবং পৃথিবীর সাথে মিল আছে। তবুও তারা মুখ ফুটে বলতে পারে না। বস্তুত মৃতদেহের অর্ধাংশ তাদের এতোটাই ভূতগ্রস্ত করে যে, তারা সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতেও ভুলে যায়। তারা উল্টে জাদুকরকেই বলে- জানি না তো, আপনিই বলুন।
জাদুকর অনুচ্চারিত কণ্ঠে বলে- গাধা! এবং উচ্চারিত কণ্ঠে বলে- যা ভাবছেন তাও না।
যদিও লোকগুলোর যাবার কোনো ইচ্ছা ছিলো না, তথাপি জাদুকর ভাবাবেগ চেপে না রেখে সোল্লাশ চিৎকার করে- চলে যাবেন না, খেলা দেখেন, খেলা শেষে আপনারাই বলতে পারবেন এটা আসলে কী।
জাদুকর বারবার পুরুষগুলোকে থেকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও এই ক্ষণে তারা এতোটাই মজে গিয়েছিলো যে, খেলা না দেখে চলে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না।
এই দেখেন। বলেই জাদুকর সবাইকে অবাক করে কমলালেবুটাকে উপরে ছুঁড়ে মারে। মুহূর্তে সেটা কোথায় হাওয়া হয়ে যায় অনুমান করা যায় না। লোকগুলো এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট করে।
জাদুকর এবার বলে- এই কালো কাপড়ের নিচে যে মৃত অর্ধেক মানবশিশু আছে তাকে আমি কী করি দেখেন। এইটা হ্যাপলয়েড নাম্বার এবং এটার মান এক্স (ঈ)। এর মানে- এটা না-পুরুষ, না-নারী। এর সাথে এক্স (ঈ) লাগলে নারী আর ওয়াই (উ) লাগলে পুরুষ।
লোকগুলো জাদুকরের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারে না। সে রাহুচন্ডালের হাড় সবার সামনে উঁচু করে ধরে আর বলে- এটা আপনাদের যে কোনো একজনের বিউটিবোনের সাথে স্পর্শ করবো। যার দেহে স্পর্শ করবো সে হবে ভাগ্যবান। বলেন কে সুযোগ দেবেন?
পাঁচজনের আলিস্যভাব কোথায় উবে যায়, সবাই ভাগ্যবান হবার প্রতিযোগিতায় উঠেপড়ে লাগে। এ বলে- আমি। ও বলে- আমি। হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়।
জাদুকর ধমকে ওঠে- থামেন। মল্লযুদ্ধ করেন। যে জিতবে সেই ভাগ্যবান।
এইবার দাগের বাইরে ককেশয়েড নিগ্রয়েড মঙ্গলয়েড অস্টেলয়েড এবং মিশ্র এই জাতীয় পাঁচ পুরুষ মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়।
জেতে সাদা জাতের ককেশয়েড। সে হাঁফাতে হাঁফাতে জাদুকরকে বলে- দেন, আমাকে ভাগ্যবান বানায়ে দেন।
কিন্তু জাদুকর সবাইকে অবাক করে সকল পুরুষের বাম পাশের বিউটি বোনের সাথে রাহুচন্ডালের হাড় ঠেকিয়ে বলে- আপনাদের এক্স ওয়াই (ঈউ) থেকে শুধু এক্স (ঈ) নিয়ে নিলাম। এটা আরেক হ্যাপলয়েড নাম্বার। তারপর রাহচন্ডালটাকে কালো কাপড়ের নিচে চালান করে দেয়।
জাদুকরের এইসব আধ্যাত্মিক কথার আগাপাছা এখন পর্যন্ত তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারে নাই। তারা নিরিখ করে কালো কাপড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অণুপল মাত্র! কালো কাপড়ের নিচে কী যেনো নড়ে চড়ে ওঠে।
জাদুকর আবার গল্প বলতে শুরু করে। লোকগুলো ভাবতে থাকে- লোকটা জাদুকর না ছাই। বোধ হয় এবার সে তাবিজ কবজ বা ঔষধ বিক্রি করতে শুরু করবে। তারা স্থির করে- এখনই এখান থেকে চলে যাবে। কিন্তু পারে না। তারা এটাও ভাবে- তাদের কাছে তো কোনো পয়সা-কড়ি নাই, বিধ্বংসী শব্দ শুনেই নেংটি পরে চলে এসেছে।
জাদুকর তাচ্ছিল্য কণ্ঠে বলে- শোনেন সাহেবরা। আগে ছিলো নেতা আর অনুগত, তারপর হলো রাজা আর প্রজা, এখন হয়েছে রাষ্ট্রপতি এবং নাগরিক। উন্নতি হয়েছে, বহুত উন্নতি হয়েছে। এই বলে সে বিশ্রি শব্দে হাসতে থাকে- হা হা হা।
জাদুকর হাসি থামিয়ে বলে- ও মিয়ারা যেতে চান? যান। তবে শেষ খেলা দেখে যান। এই বলে জাদুকর হ্যাঁচকা টানে কালো কাপড়টা তুলে ফেলে। সাথে সাথে বক্ষের উপর দুই হাত রাখা এক তরুণী উঠে বসে। তার পরনে পাতলা ফিনফিনে মসলিনের পোশাক। সেটা ভেদ করে তার দেহের উজ্জ্বল কমলা রং ফুটে ওঠে।
পুরুষগুলো বিস্মিত হয়- অবর্ণনীয় সুন্দরী। জাদুকরের বর্ণনাকৃত এ কি সেই রূপসী? মনে হয় তাই। এক বিপলে পাঁচ পুরুষ একরকম হামলে দাগের ভেতর প্রবেশ করে। সাথে সাথে তারা পাঁচ কুকুরে রূপান্তরিত হয়- সাদা কালো খয়েরি নীল ও লাল।
জাদুকর খ্যাক খ্যাক করে ওঠে- কী বলেছিলাম এ্যাঁহ? এখন ঠ্যালা সামলান!
অতঃপর সে কালো কাপড়টা দিয়ে যুবতীকে পুনরায় ঢেকে দেয় এবং বুম করে আর একটি বিস্ফোরণ ঘটায়। কালো ধোঁয়া পরিষ্কার হলে ওরা দেখে- জাদুকর নাই।
তৎক্ষণাৎ কুকুরগুলো দৌড়ে কালো কাপড় কামড়ে টানাটানি করতে করতে ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু সেখানে তারা কিছুই খুঁজে পায় না।
কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করতে করতে বিক্ষিপ্ত দৌড়ায়। একটা যায় অতলান্তিকের পশ্চিমে, একটা এশিয়ায় আর তিনটা ইউরোপে…