কায়েস আহমেদঃ এক স্বপ্নবাজ পুরুষের আত্মহনন
দেবাশিস ভট্টাচার্য
বিরানব্বই এর পনেরই জুন, সকালে আমি প্রথম জানতে পারি, অন্ধ তীরন্দাজ আর লাশ কাটা ঘরের কায়েস আহমেদ আর নেই।
আসলে তো আমরা কেউ অবিনশ্বর নই। মৃত্যুও তাই কোনো নিয়মের পরোয়া করে না। সময়ে-অসময়ে এসে সে হানা দিয়ে বসে ঘাতকের বেশে। তাই হয়তো এত সময় সংক্ষিপ্ত করে চলে যেতে হল তাকে। আমি জানিনা মৃত্যুর সে ভয়াল হিমস্রোত ঠিক কতটা মানুষকে নিঃসাড় আর নিস্তব্ধ করে দেয়।
এই মুহূর্তে আমি এটিও জানিনা একজন প্রাণ সমৃদ্ধ কথাশিল্পী পোস্তাগোলার কবরস্থানে কিভাবে ঘুমিয়ে আছেন পাণ্ডুর কফিনে।
তিনি আমাদের বিরলপ্রজ লেখক ছিলেন। ১৪ জুনের তারা আকস্মিক এই পরিকল্পিত আত্মহনের সংবাদ পরদিন আমাকে হতবাক করে দেয়। এক ধরনের শীতলতা আমাকে গ্রাস করে। ভয় করতে থাকে খুউব….
সূর্যের আলো এসে পড়েছে বুকের হাঁ করে থাকা পাঁজরের কাঠামোর ভেতরকার কলজে ইত্যাদির ওপর। সবচেয়ে দারুণ দেখাচ্ছে মুণ্ডহীন গলাটা, থকথকে চর্বির সঙ্গে লালের ছোপ তার ওপর সূর্যের কটকটে আলো মানুষগুলোকে একবারে অভিভূত করে দিয়েছে।
সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে মাথা ও মুখমণ্ডলের এতসব পরিবর্তন হয়ে গেলেও একটি চোখ অক্ষত হয়ে রেললাইনের গায়ে থ্যাঁতলানো চামড়ার সঙ্গে ঝুলে রয়েছে। যেন লোকগুলোর কান্ড দেখছে অবাক হয়ে। সেদিকে চেয়ে ছোকরার মত একজন জিজ্ঞেস করে কাউকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু লোকটার এভাবে মরার কারণ কি? (খন্ড রোদে শালিক ফড়িং)
এমন প্রখর জীবনী শক্তি সম্পন্ন তুখোড় স্বপ্নবাজ একজন পুরুষের স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা আমাকে এখনো ভাবায়, যার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আমি এখনো খুঁজে পাইনি। আমাদের বেদনা ও উচ্ছ্বাস স্থায়ী নয়। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে স্মৃতির পিঠে জমে ওঠে ধুলো। মৃত্যুর পর কায়েস ভাইকে নিয়ে এমন আলোচনার ঝড় উঠেছিল যে তাই অনেকটা নিঃশব্দ ছিলাম। সত্যিকার অন্তঃ দৃষ্টিসম্পন্ন জীবন ঘনিষ্ঠ কথক ছিলেন তিনি। তাঁর এ মহাপ্রয়াণে ক্ষতি হলো গল্পের।
শূন্যতার সৃষ্টি হলো গল্পের সুস্থধারার আঙিনায়। তাঁর স্থানে আর কেউ পিঁড়ি নিয়ে বসতে অনেক সময় লাগবে। এ শূন্যতা সৃষ্টি করলো ক্ষতের, যা সহজে পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের চারপাশের ছককাটা পঙ্কিলতার ভেতর থেকে আরেকজন কায়েস তাই বেরিয়ে আসা সহজ কথা নয়। সে অনেক সময়ের ব্যাপার। তাঁর মত পরিশ্রমী, সৎ রাজনীতি সচেতন কথা শিল্পীর অভাব থেকেই আমার কথাকটি বলা। এ বছর অনেক নীরবেই অতিক্রান্ত হল তার মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর ওপর কোনো অনুসন্ধানমূলক লেখা কিংবা অনুষ্ঠানের খবর পেলাম না কাগজে। এটাই অমূলক বলে মেনে নেয়া যায়। তিনি কখনো নিজেকে বিশিষ্ট লেখক বলে দাবি করেন নি। কিংবা জনপ্রিয়তার জন্য লেখেননি। তাই সিরিয়াস পাঠক অনেকে তাঁর নামও জানেন না। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে আলোচনার যে ঝড় বইতে শুরু করেছিল, তা অনেক আগেই থেমে গেছে। সে আলোচনায় কিছু কিছু ধারণ করে সুশান্ত মজুমদার ‘নিরাবেগ বোঝাপড়া’ নামে একটি স্মারক গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। এর আগে সে রয়েছে কায়েস সমগ্রও। আলোচনার ভেতর অনেকেই তাঁর লেখার একটা শেকড়হীনতা, মাওবাদী নকশানী তৎপরতা উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা চিহ্নিত করেছেন। ‘জতুগৃহে দিনযাপন’ প্রবন্ধে ইলিয়াস ভাই বলেছেন, তিনি আধুনিক লেখক ছিলেন, তাছাড়া প্রখর সমাজ মনস্কতা, মানুষের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ, গভীর শিল্পবোধ তাঁর গল্পে আমাকেও সমান অবাক করেছে বারবার।
দুই
লোকটা কোনো কথা না বলে নির্জন কালো জল কেটে কেটে তাকে কাঁধে নিয়ে খাদ পেরুতে থাকলে ভয় প্রবল ঝাপটে ধরে, খাদের পানির গভীরতা বেশি নেই। কিন্তু তার বারবার মনে হতে থাকে লোকটা খুন করে তাকে এই খাদে পুঁতে রেখে যাবে। ছটফট করতে থাকে সে। সমস্ত অস্তিত্ব থেকে ভালোবাসা চিৎকার করে উঠতে চাইছে। আর লোকটা কোন কথা না বলে সেই নির্জন চরাচরে জলের ওপর শব্দ তুলে সামনের কুয়াশা ঢাকা বিশাল অন্ধকার শূন্যতার দিকে তাঁকে কাঁধে নিয়ে এগুতে থাকে। (যাত্রা)
একজন লেখকের তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে বড় বিচারক সময়। কালের নিরিখে তার গল্প বাঁচবে কি বাঁচবে না, তার লেখা একালের লেখকদের ভাবার মত কিছু বিষয়ের জন্ম দেবে কি না, কিংবা তার গঠন বিন্যাস দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ বর্তমান প্রজন্মকে স্পর্শ করবে কিনা তার উপর নির্ভর করবে। তবে তার লেখায় মৃত্যু চিন্তার পাশাপাশি অবিস্মরণীয় কিছু গল্পের রেখা ছিল, যা তাকে পরিণত করেছিল অন্যদের চেয়ে বিশিষ্ট করে। সুশান্ত মজুমদার তার ‘খঞ্জিত জীবন ও মৃত্যুর উৎসব’ মূলপ্রবন্ধ ৩০ মার্চ ৯৩।
একদিকে মূল্যবোধ হারানো বিষণ্ণ মানুষ আরেকদিকে বিনাশকারীর অবস্থা তার সাহিত্যে সনাক্ত করা যায়। ষাটের দশকে লেখকদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক, আহমদ ছফা, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হকের কথাসাহিত্যিকদের আমরা পেয়েছিলাম।
তাদের লেখার ভেতরেও অসঙ্গতি নিপীড়ন বৈষম্য এসব বাদ দিয়েও একটা ঋজু সাহসী জীবন ঘনিষ্ঠ গল্পের ধারাকে তারা তুলে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন গল্পে, এ সময় ছোটগল্প পত্রিকাকে ঘিরে কায়েস আহমেদ, শাকের চৌধুরী, বুলবুল চৌধুরী, পূরবী দাশ তাঁরা তাঁদের গল্পে একটা ভিন্নতর যোজনার সৃষ্টি করতেন। মানুষের জীবনে একইসঙ্গে ভালো-মন্দের যে বৈপরীত্য আশা-হতাশা প্রতিরোধ বিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মূর্ত হয়ে উঠলো গল্প।
জগন্নাথ অন্ধ আর হরিদাস চাক্ষুসমান। গান গেয়ে ওরা ভিক্ষে করতো ট্রেন থেকে ট্রেনে, একদিন ফেরার পথে হরিদাস নকশাল ফাইটের মাঝখানে পড়ে গুলি খেলে পর জগন্নাথ মাও তত্ত্ব না পড়েও শত্রুদের ঠিক চিনে নেয়। তাই হয়তো সে হারমোনিয়ামটা হ্যামারের মত তুলে পুলিশের জ্বলন্ত জিপের দিকে লাফ মেরে তেড়ে যায়।
‘আয় শালারা আয়’ এই অন্ধকার ফাটানো চিৎকার দিয়েই সে মাটি থেকে উপরে উঠে যায়। দু’হাতে উত্তোলিত হারমোনিয়াম ছুটে যায় সামনে। জগন্নাথ সমস্ত শক্তি দিয়ে পৃথিবীকে বিদ্ধ করে।
সবার পুরোভাগে থাকার সম্ভাবনা ও ক্ষমতা যার দুইই ছিল সে কেন আত্মহত্যা করবে? প্রথমত ‘যাত্রার’ সেই লোকটির মত তাকে কেউ খুন করে রেখে যায়নি তো? তবে কেন এই আত্মহনন? ব্যক্তিগত জীবনে ঢাকার কাঁকরাইলের উইলিয়ম লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এর শিক্ষকতা আর লেখাই ছিল উনার প্রাণ জুড়ে। ঘরে অভাব থাকা সত্ত্বেও প্রাইভেট টিউশ্যানকে জীবনের এ পর্যায়ে এসে পছন্দ করতেন না তিনি।
গণকণ্ঠ, সংবাদে শ্রম দিয়েছিলেন কিছু সময়। হুগলির বড় তাজপুর গ্রামে ছিল তাঁর আদিবাস। জন্মেছিলেন ১৯৪৮ এর মার্চে। বাবা তো আগেই মারা গিয়েছিলেন। মার কাছে তার মৃত্যুসংবাদ হয়তো পৌঁছে গেছে এতদিনে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় মা হয়তো আজও অপেক্ষা করছেন উঠানের ছায়ায় তাঁর প্রিয় সন্তানের জন্য।
তিন
তবুও দৃষ্টির বাইরেই ছিলেন যেন তিনি। বড় কেউকেটা ছিলেন না কখনো। হওয়ার ইচ্ছেও ছিল না। সভা-সমিতিতে পুরোভাগে থাকতে প্রবল আপত্তি ছিল তাঁর। তারপরও এদেশের ছোটগল্পের আঙিনায় সুস্থধারার সর্বাত্বক কারিগর হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল বেশ অনন্য অথচ তার মৃত্যু সংবাদটি পেলাম না কোনো কাগজে। ক্রুদ্ধ হলেও বিস্মিত হইনি এ কারণে যে সত্যিকারের শিল্পী তো বরাবরই অগোচরে জন্মায়। আত্মপ্রচার বিমুখ সাদামাটা হালকা-পাতলা গোছের কায়েস ভাইকে তাই ওরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলো না। যাক সে কথা…।
মৃত্যুর মাসখানেক আগে থেকেই তিনি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে কোন কোন বন্ধু-বান্ধব স্বীকার করেছেন। তাঁর এ ডিপ্রেশনের কারণ কিন্তু কেউ বলতে পারেননি। একটু শুশ্রূষা হলেই হয়তো জলের মতো টুংটাং শব্দে বেজে উঠতেন তিনি জলতরঙ্গের মত। সাদা পাঞ্জাবি আর কালো কোট ঢাকার কি একটা অনুষ্ঠানে সর্বশেষ আমি তাকে দেখি, নিলুফা আপা অনীকও ছিল যেন।
যতদূর মনে পড়ে আবুল হাসনাত সম্পাদিত গণসাহিত্যের একটি মলিন সংখ্যায় আমি সে অন্ধতীরন্দাজকে প্রথম জানার সুযোগ পাই, গল্পটির উপস্থাপনা বক্তব্য আর বর্ণনার সূক্ষ্ণতায় নিমিষেই আমাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়।
যার অব্যর্থ নিশানার কথা আমি এখনো ভাবি। যার পরিশ্রমী কুশলী হাতের স্পর্শে সবকিছু কেন অপার বিশ্বস্ততায় জীবন্ত হয়ে ওঠে সহজে সে থেকেই ভালো লাগে একজন কায়েস ভাইকে…… কায়েস ভাইয়ের সম্পর্কে,’সারা মাঠ জুড়ে সবুজ সোনালী ধান গাছ একটু নুয়ে জ্যোস্না পিঠে নিয়ে যেন ছেলেকে দুধ দিচ্ছে।’ ‘পঁচা দেখতে পায় একটা ময়লার স্তুপ গর্তের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে,’
‘অন্ধ তীরন্দাজ’
তবে একটা ব্যাপার আমি নিশ্চিত, যতদিন বেঁচে থাকব লিখে যেতে হবে আমাকে, না লিখলে জীবনের এত যে চাপ, প্রতিমুহূর্তে এত লাঞ্চনা, এত অপমান, ঘৃণা, হতাশা, ভালোবাসা, সাধ, স্বপ্ন এসব ধারণ করবো কিভাবে? কাজেই লিখতে হবে আমাকে’।
নচিকেতাগণ, পৃ:১৯৭
কায়েস সমগ্র
অন্ধ তীরন্দাজ বই আকারে বের হয় ১৯৭৮ সালে। সর্বমোট আটটি গল্পের সংকলন ছিল এটি। অন্তর্লীন, চখাচখি, যাত্রা, বন্দি দুঃখময়, খঞ্জরোদে শালিক ফড়িং, বিরমিষা, অন্ধতীরন্দাজ, সম্পর্ক – প্রতিটি গল্পই ছিল পড়ার মতো ধারালো। অন্ধতীরন্দাজের প্রায় প্রতিটি গল্পে এক বিস্ফোরণোন্মুখ জ্বালা আছে যা স্পর্শ করতে একশ্রেণীর পাঠক বিব্রত হবেন। তার লেখা সবসময় মনোযোগদাবী করে বৈকি? খুব মনোযোগ দিয়ে না পড়লে গল্পের ভিতরে যেতে কষ্ট হবে অনেকেরই। রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁর গল্পের মেরুদন্ড। এমনিতেই তিনি সময়ের পোকা। তাই হুগলির বড়তাজপুরের কায়েস আহমেদ লেখায় অবলীলায় উঠে আসে বাংলাদেশের গ্রাম। ভুখা নাঙা হাজারো হতদরিদ্র বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত মানুষগুলো যেন কথা বলে ওঠে তাঁর গল্পে। অন্ধতীরন্দাজ তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থ হলেও তা মোটেই ফ্যালনা গোছের নয় বরং অনেক সরস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর এ বঙ্গে সত্যিকারের জীবন ঘনিষ্ঠ গুটিকয়েক গল্পকারের ভেতর একজন কায়েসের জোনাকির আলো অনেক বেশি আলোকিত এ কথা বলতে আমি মোটেও কুণ্ঠিত নই। যা বলছিলাম তিনি সময়ের পোকা। কেমন অনায়াসে কেটেকুটে ঢুকে যেতে পারেন নষ্ট সময়ের দুষ্ট কূটনোলের ভেতর, যা তাঁর গল্পের বুনট আর গতিকে করে তোলে সাপের মত ঋজু ও উদ্যত।
আমাদের সমাজে রাজনৈতিক চিরায়ত বৈষম্যের খড়গে দ্বিখণ্ডিত অনিয়ম আর অত্যাচারের বেষ্টনীতে যে জীবন প্রতিনিয়ত আঁকুপাঁকু করে নরক যন্ত্রণার কামড়ে। কায়েস ভাই সে মানুষগুলোকে তুলে আনেন গল্পে সহজাত মুন্সিয়ানায় অপরিসীম মমতার। বিচিত্র সে মানুষের খেলা। পাপপুণ্য বাদ দিয়ে জাহান্নামে আগুন উত্তাপ জোগায় তার গল্পে।
উপস্থাপন ভঙ্গি আধুনিক সম্পূর্ণ একালের। ভাষায় কখনো অমৃত কখনো কালকূট বিষের ছোঁয়া, যেন পরিণত শিল্পময় দ্রোহ। কোন কোন জায়গায় কাব্যময়তা সুদর্শন মেদ নিয়ে গল্পকে ব্যাহত করতে এলেও কাহিনীর মোচড়ে শব্দ আর বর্ণনার ঝাড়পোঁচে তার মুহূর্তেই অন্তর্হিত হয়ে পড়ে।
চার
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর অন্ধতীরন্দাজের কায়েস আহমেদ, মাঝখানে প্রচুর জল গড়িয়েছে, বদলে গেছে সমাজ-সংসার প্রেক্ষাপট তথা গল্পের জমিন। কোনো কিছুই যেন আজ আর এক জায়গায় থেমে নেই। এ বঙ্গে শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বুলবুল চৌধুরী, মাহমুদুল হক, মঞ্জু সরকারের হাত ঘুরে ছোটগল্পও আজ তাই বহু অবয়বিক বহুমাত্রিক।
চলমান সময়ের মত ছোটগল্পের পায়েও যেন টাকা, যা এক জায়গায় থামে না কখনো। বক্তব্য প্রকরণে তা কিছুতেই আর এঁদো কুয়োয় বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। তাই সে অজস্র সত্যের বাজ বুকে নিয়ে এগোয় সামনের দিকে, সত্য আর সুন্দরের দিকে। আমাদের হাটে মঞ্জু সরকারের অবিনাশী আয়োজন কিংবা মৃত্যুবাণ নিয়ে যতটা হইচই হয় ততটা কিন্তু অন্ধতীরন্দাজ কিংবা লাশকাটা ঘর নিয়ে হয়নি। যা হওয়া উচিত ছিল। তাই হয়তো ইলিয়াস ভাই এক ধরনের খেদ থেকে বললেনঃ এমন একজন জীবন ঘনিষ্ঠ লেখক পুরস্কৃত করতে পারলেন না বাঙাল একাডেমি, যার গ্লানি প্রতিষ্ঠানটিকে বহন করতে হবে সারাজীবন।
১৯৮৬ তে বেরোয় তার ‘দিনযাপন’ উপন্যাসটি। এ দেশের বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের স্নায়ুবিক সমস্যার মানবিক দলিল এটি। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির গভীরে গিয়ে সুক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িকতার উৎসে হাত রেখেছেন তিনি। ঢাকা শহরের পুরোনো এলাকার একটি পুরনো বাড়িই আসলে এর প্রধান চরিত্র। বাড়িটিতে অনেকগুলো পরিবারের বাস, নিবারণ উত্তরাধিকার সূত্রে এ বাড়ির মালিক, তার ঠাকুরদাদা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সম্পদশালী হয়েছিল। পূর্বপুরুষের উপার্জিত বাড়ির ভাড়া থেকে নিবারণ সংসার চালায় এবং বেশে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে ধর্ম চর্চা করে, ঠাকুরকে পাওয়ার জন্য লোকটা একবারে হন্যে হয়ে উঠেছে। তাছাড়া নিশিকান্ত বিপ্লবী, মদের দোকানে সামসু মিয়া, স্কুল শিক্ষক মনতোষ সবাই উপন্যাসে আলাদা আলাদা একটা বিশ্বাসে লালিত- এর বাইরেও সুকুমার। শম্ভু শাহজাহান সন্তান নান্টুর কথা আছে এরা যুদ্ধ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের বেত্তমিজ চেহারা। এরা মেয়েদের খিস্তি খেউড় করে সংখ্যালঘুত্বের সুযোগে মদের দোকানে হাম্বিতাম্বি করে। অন্ধকারে সবকিছু ছিনিয়ে নেয় ‘থাকি হ্যাতাগো দেশে, হ্যাগো মাথা গরম কুনগম কিঅয় কওন যায়? আমরা অইলাম গিয়া হিন্দু মানুষ। গোটা উপন্যাস জুড়েই একটা অস্থিরতা বিদ্যমান। মনোতোষের স্ত্রী জয়ার ভাগ্যেই তা ধরা পড়ে। ঘরে ও বাইরে সংসারে ও রাজনীতিতে আপোষ করে চলতে চলতে মনোতোষ অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটায়। শেষ দৃশ্যটি অত্যন্ত ভয়াবহ স্ত্রী সর্বানীর সাথে মাতাল বাসুদেবের যৌন সম্ভোগের আয়োজন।
শুধু বাসুদেব কিংবা সর্বানীকে নয় ওই বাড়ির সমস্ত মানুষকে এক ধরনের বিবমিষায় ঢেকে ফেলে, ওদেরকে আর মানুষ ভাবতে কষ্ট হয়।
দাঙ্গার খবর দিয়ে উপন্যাসের শুরু হয় আর শেষ হয় একটা তেতো উপলব্ধি নিয়ে। নির্বাসিত একজন, দাঙ্গাই প্রধান চরিত্রখোকাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে বইটি বেরোয় ১৯৮৬-তে ফেব্রুয়ারি মাসে, জগদ্দল নামে আরেকটি গল্পে ধৃত বইটি, লাশকাটা ঘর বেরোয় ১৯৮৭-তে, এটিও আটটি গল্পের বই, পরাণ, মহাকালের খাড়া, দুই গায়কের গল্প, লিয়াকত আলীর জাগরণ, লাশকাটা ঘর, গগনের চিকিৎসা তৎপরতা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈত্রিক ভিটে ও রমণী মুখুহ্যে, নিবাশ্রিত অগ্নি কোনো গল্পই ফ্যালনা গোছের নয়। বিশেষ করে পরাণ, মহাকালের খাড়া, গগনের চিকিৎসা তৎপরতা, লাশকাটা ঘর, নিশ্রিত অগ্নি মনে রাখার মতো গল্প। দুই গায়কের গল্প ও উজ্জ্বল সুকৃতি নিয়ে দাঁড়ায় তার পরিশ্রমী ডিটেইলস আর বর্ণনার কারণে। একজন কায়েস আহমেদ বরাবরই মাথা তুলে দাঁড়ান তাঁর সচেতন গ্রন্থনায়।
নব্বইতে বেরোয় বাংলা একাডেমির জীবনী সিরিজে রথীন্দ্র ঘটক চৌধুরীকে নিয়ে খেটেখুটে লেখা বইটি। এটিই ছিল তাঁর ছাপা আকারে শেষ কাজ।
সর্বশেষ যে কাজটি তিনি করতে চেয়েছিলেন তা কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। ইউপিএলর মহিউদ্দিন ভাই বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ৪-৫ বছর ধরে মানিকদার লেখার সাথে সম্পর্কিত উভয় বাংলার লেখকদের ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি দিয়ে লেখা তৈরি করিয়ে নিতে নিতে সময় গড়িয়ে যায়, ওপার বাংলা লেখকদের লেখা সময়মতো পেলেও এপার বাংলার লেখকদের লেখা যথাসময়ে না পাওয়ায় তিনি বইটির কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডাকঘরে কর্মকালীন সময়ে একদিন সুহৃদ গল্পকার মহীবুল আজিজ এসে আমাকে জানালেন কায়েস ভাই মানিকদার প্রথমদিককার একটি ছবি খুঁজছেন। আপনার সংগ্রহে থাকলে দেন।
মানিকদার উপর একটি বিরাট কাজে অংশগ্রহণ রীতিমতো চিত্তচাঞ্চল্যের ব্যাপার। অনেক আগে পঁচাত্তর ছিয়াত্তর এর দিকে মাহফুজ সিদ্দিকীর সম্পাদনায় চিত্রালীর কোন একটি সংখ্যায় মানিকদার ওপর এপার বাংলার একজন লেখকের একটি লেখা ও ছবি ছাপা হয়। ছবিটি ছিল মানিকদার প্রথম বয়সের ছবি। ওই লেখাটা আমি পড়েছিলাম অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে এবং ছবিটি আমি সংরক্ষণ করেছিলাম ছাত্রাবস্থায় অন্যান্য পেপার ও মূল্যবান লেখার সাথে। একটি পুরনো বাণ্ডিলের ভেতরে এটি ছিল। এদিকে কায়েস ভাইয়ের তাগিদে মহিবুল প্রায় আমাকে এসে বলত কায়েস ভাই আপনার কথা লিখেছে। ছবিটির ব্যাপারে লিখেছে। এর পরের সপ্তায় আমি বাড়িতে যাই সীতাকুণ্ডে। পুরোনো পেপার কাটিং এর সমস্ত বান্ডিল তাক থেকে নামিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজি, সমস্ত কাগজপত্র খুঁটে খুঁটে সারারাত গার্ড করি। সব আছে কিছু বৃষ্টির পানি আর পোকায় খেয়েছিল আগে, সেই কাঙ্খিত পেপার কাটিংটি আর খুঁজে পাই না। অবশেষে রাগে দুঃখে ক্লান্তিতে সকালের ট্রেনে কর্মস্থলে ফিরে আসি। দুপুরের একটু আগে মহীবুল এলে তাকে সব খুলে বলি, এবং বিষয়টি জানিয়ে অনুরোধ করি যে কায়েস ভাইকে লিখতে। চিত্রালীতে গিয়ে মাহফুজ ভাইকে বললে হয়তো পাওয়া যাবে সেই ছবিটি।পরে কায়েস ভাই চিত্রালীতে গিয়ে খোঁজ করেন ছবিটির। সুনির্দিষ্ট তারিখের অভাবে ছবিটি তিনি উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। ব্যর্থতা বড় কথা নয়।
মানিকদার ওপর আপনার অগাধ ভালোবাসায় আমাকে আপনার সাথে যুক্ত করেছিল এ অনেক বিরাট পাওয়া অন্ততঃ আমার কাছে। ধন্যবাদ মহীবুল আপনাকেও সেই অদ্ভুত সাঁকোটার জন্য। “গতকাল রাতে জ্যোৎস্না ছিল। অনেকক্ষণ ধরে, সেই জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে একটি লাল গাড়ি যাচ্ছিল কঁকিয়ে কঁকিয়ে। দক্ষিণ জলার ফসল ভরা মাঠ, গোরস্থান, ঝিম ধরে থাকা শিশির ভেজা বাগান পেরিয়ে সে শব্দ আসছিল, সেই একঘেঁয়ে ক্লান্ত শব্দটা শুনতে শুনতে তার মৃত্যুর কথা মনে আসে। ”
আত্মপ্রচার বিমুখ একজন কায়েস আহমেদ তাই এতটা বিশাল যে তার অন্তর্ধান মেনে নিতে কষ্ট হয়। সালাম কায়েস ভাই সালাম…..
আপনি না থাকলেও আপনার গল্প আপনার কথাই বলবে বারবার…