কালো কফি ও কালো মেয়ে
অমিতা মজুমদার
সকালের কফিটা একটু বেশিই ব্লাক করে কৌশিকি, আজ সেই কফির মগে একটুকরো মিষ্টি নরম কেক চুবিয়ে দিলো কৌশিকি, মনটা কোথায় ছিল তার! কেকের টুকরোটা টুপ করে জলে পানকৌড়ি ডুব দেওয়ার মতো মগের কফিতে পড়ে গেল। আর তখনই খেয়াল হলো সে-তো ঘন করে জ্বালানো গোরুর দুধে বেশি চিনি দেওয়া চায়ে খাস্তাটোস্ট ভিজিয়ে খাচ্ছে না। তাহলে স্বাদটা সে-রকম মনে হলো কেন? এটা কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা চলছিল! তা কেমন করে হয়?
সে-তো পষ্ট দেখল মুষলধারে বর্ষা নেমেছে, সাথে ছাতা ছিল না, কলেজ ছুটির পরে তারা হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল।শুধু সায়েন্সের ছেলে মেয়েরা ছিল। বৃষ্টি আসায় সবাই দৌড়ে পুলিনকাকুর চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ে। কিছু বলার আগেই পুলিনকাকু সবাইকে চা আর খাস্তাটোস্ট দেয়। তখন বুঝি এমনই ছিল। ছেলেমেয়েগুলো দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে কলেজে আসে। হয়তো বাড়ি থেকে ঠিকমতো খেয়েও আসে না। কাছে পিঠে কিছু খাওয়ার দোকান বলতে পুলিনকাকুর এই চা টোস্টের দোকান। কাকু যেন ইচ্ছে করেই দোকানখানা এখানে দিয়েছে।ব্যাবসা তো দূর ট্যাঁকের টাকা খরচ করে যেন এই কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েগুলোর খেয়াল রেখে নিজের শান্তি খোঁজে। তাই এখানে চা- বিস্কুট খেতে কারও কোনো অস্বস্তি হয় না। এটা তো তাদের পুলিনকাকুর দোকান!
ভোররাতে আসা বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় কৌশিকির।তারপরেই যত অনর্থ। আধো আলো আঁধারিতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল আর বৃষ্টির জল এসে ওর মুখে চোখে লাগছিল। সেই জলের ছাঁটই যেন কালো তেতো কফিটাকে কেমন ঘন গোরুর দুধের আহ্লাদী রূপসি চা’য়ে বদলে দিল।
ঘন করে জ্বালানো গোরুর দুধের চা’য়ে বর্ষাভরা হিম বাতাসের পরশ পেয়ে কেমন মোটা একটা চাদরের মতো সর পড়ে যেত পলকেই। চা’য়ের বুঝি ঠান্ডা বাতাসে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করত। খাস্তাটোস্ট দিয়ে সরটা সরিয়ে চায়ে ডুবিয়ে একটু অসতর্ক হলেই অমন মুচমুচে টোস্ট সেই চা’য়ে ডুবে একেবারে তলিয়ে যেত। তাই এই চা’য়ে ভিজিয়ে টোস্ট খাওয়াটায় সকলকেই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হতো।
এক খাস্তাটোস্ট আর চা’য়ের সাথে সাথে কৌশিকির মনে আরও কত কী আসা শুরু করল।
ছেলে-মেয়ে’র যৌথ কলেজ জীবন দু-বছরের ! আজকের সময়ে যেটা খুব স্বাভাবিক তখন সেটা সকলের কাছে সভ্যতার পরিপন্থি ছিল অনেক ক্ষেত্রে। তাই কৌশিকিদের প্রতিটা পা ফেলতে হতো খুব সতর্ক আর সচেতন ভাবে। একটু উনিশ বিশ হলেই লেখাপড়ার যে স্বপ্ন দেখত কৌশিকির মতো মেয়েরা তার অপমৃত্যু ঘটত অনায়াসেই। সোজা ছাদনাতলায় পৌঁছাতে হতো বিচারের রায়ে।
সকলের ভাগ্যে বেগম রোকেয়া,বেগম সুফিয়া কামালে বা কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর মতো বন্ধুতুল্য স্বামী মিলত না।ফলে বই-পত্রের সাথে সখ্যতার ইতি ঘটিয়ে সংসার ধর্মে পারদর্শী হয়ে ওঠার পরীক্ষা পাশের প্রস্তুতি চলত আজীবন।
তাই কৌশিকীর মতো জনা’দশেক মেয়েকে চলতে হতো দুটো চোখ দিয়ে সামনের পথ দেখে নয়, মাথা জুড়ে চোখ নিয়ে।কারও সাথে যেমন যেচে কথা বলাও বারণ আবার কারও প্রশ্নের উত্তরও দিতে হবে বুঝেশুনে।হাসির কথায় মন খুলে হাসতে যেমন মানা, আবার আরোপিত গাম্ভীর্যও অনেকের বিদ্রুপের কারণ।এরই মাঝে যে-জন্য কলেজে আসা সেই পড়াশুনা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে মনে হতো, এর চেয়ে যারা পড়ালেখা না করে তারাই শান্তিতে আছে।তাদের এত হ্যাপা সামলাতে হয় না।সকাল সন্ধ্যা ঘর সংসারের খুঁটিনাটি কাজ আর অবসরে সেলাই ফোঁড়াই করার মধ্য দিয়ে তাদের দিন কাটে অনেক শান্তিতে। দিব্যি দিনের বেলা ভাত ঘুম নয়তো তাস নিয়ে বসে যাওয়া আর পরনিন্দা পরচর্চার মাঝে কিছু আদি রসাত্মক গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে দেওয়ার আপাতঃ স্বস্তির জীবন। তারপর একসময় ছাদনাতলা ঘুরে নিজের সংসারে যাওয়া। নিজের সংসার এই ভাবনায় কাটে প্রায় সব মেয়ের জীবন।সেটা পেলেই জীবন সার্থক মনে করে তারা। সেখানে কৌশিকিদের নিয়ম করে পড়া করা, কলেজ যাওয়া আবার কলেজ যাওয়ার জন্য রাস্তাঘাটে নানারকম উড়োকথা শোনা সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে মনে হতো ছেড়ে দেওয়াই ভালো। আবার যখন রাস্তা থেকে মাথা উচু করে হেঁটে যাওয়া স্কুলের হেড দিদিমণিকে দেখত তখন আপনা থেকেই মেরুদন্ড সোজা হয়ে যেত। সকল প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ মনে করে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে পথে পা বাড়াত।
এত সতর্কতার পরেও প্রজাপতি মন উড়তে চাইত ডানা মেলে। এবারে কৌশিকীর বিরক্ত লাগে এমন কী হলো যাতে এতসব মনে পড়ে যাচ্ছে।সে-তো পল্লবের কথা মনে করতে চাইছে না। যত নষ্টের গোড়া সকালের সেই অঝোর ধারার বর্ষা সাথে ব্লাক কফির মগে কেক ডুবে যাওয়া।
মোবাইলের সেলফি মোডে গিয়ে নিজেকে দেখে একবার কৌশিকী। সদ্য অবসর প্রাপ্ত কৌশিকীর গায়ের রঙ চাপা বলে পল্লব তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের নিয়মতান্ত্রিক সুখী জলবায়ুতে কখন যে কৌশিকির শ্যামবর্ণকে গৌরবর্ণ না করলেও চাপা বলার মতো আর নেই সেটা টের পায়নি। একটা উজ্জ্বল আলোকপ্রভা এই ষাটোর্ধ কৌশিকিকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে।তার ব্যক্তিত্বকে ঘিরে আছে এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানবিক ঔজ্জ্বল্য।
কৌশিকী একটার পর একটা লেখাপড়ার ধাপ পেরিয়ে এখন বিদেশের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করে। নিজেকে একজন সফল মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশে বিদেশে সর্বত্র তার সমাদর।
কফির তেতো স্বাদটা হঠাৎ আর তেতো থাকে না, ভাগ্যিস পল্লব প্রত্যাখ্যান করেছিল। বছর দশেক আগে দেশে গিয়ে পল্লবের সাথে দেখা হয়েছিল। অহংকারী আর উদ্ধ্বত পল্লবকে কোথাও খুঁজে পায়নি। ভাঙাচোরা চেহারার পল্লবকে দেখে কৌশিকির মনে হয়েছিল তাকে দয়া করা যায় কিন্তু বন্ধুভেবে সাহায্য করা যায় না।যদিও পল্লব তাকে দেখে তার স্ত্রী,পুত্র কন্যাকে বলছিল তোমাদের বলেছিলাম না, আমার কলেজের বন্ধু,বিদেশে থাকে।খুব নাম-ডাক হয়েছে।কৌশিকি জেনেছিল পল্লব একটা ব্যাংকে ভালো চাকরি করত, কিন্তু তহবিল তসরুফের দায়ে চাকরি খুইয়ে জেল খেটে এখন ঘরে বসে বউ ছেলে মেয়ের উপরে খবরদারি করে। পল্লবের বউ খুব করে বলায় এক কাপ চা খেয়েছিল খুব কষ্ট করে,ফেরার সময় ছেলে-মেয়ের হাতে বেশ কিছু ডলার গুঁজে দিয়ে এসেছিল। অদ্ভুত এক প্রশান্তি নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল কৌশিকি।
দোহারা গড়নের পল্লবের মাথায় ছিল একরাশ ঝাকড়া চুল,গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল যাকে গৌরবর্ণ বলে। কৌশিকিদের এক বছরের সিনিয়র। লেখাপড়া,গান-বাজনা,খেলাধূলায় সকলের আইডল বলা যায় পল্লব। কলেজের প্রায় সব মেয়েই পল্লবের প্রতি একধরণের দুর্বলতা পোষণ করত।পরে জেনেছে সেটারই সুযোগ নিয়ে পল্লব অনেক মেয়েকে প্রতারণা করেছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে সে। মেয়েরা তাদের স্বভাবজাত অন্তরমুখীনতা আর নিজেকে অপরাধী ভাবার সহজাত প্রবণতায় লুকিয়ে গেছে নিজের দুর্ভোগ আর অপমানের কথা।আর পল্লব রয়ে গেছে অনাঘ্রাত পুষ্পসম সকলের আকাঙ্খার পাত্র হয়ে।কৌশিকিও একই ভুল করতে বসেছিল,কেবল সে সরাসরি পল্লবকে ভালোবাসার কথা যেমন বলেছে আবার তার অন্যায় আবদারকে উপেক্ষা করেছে। আর তখনই পল্লব তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে কালো মেয়ে বলে। তার মতো কালো মেয়েকে নিজের পাশে না-কি ভাবতে পারে না পল্লব।
অপমানটা চাবুকের তীব্র আঘাতের মতো লেগেছিল কৌশিকির।আজ তাই পল্লবের প্রতি কৃতজ্ঞও কৌশিকি। সেই অপমানটাই হয়তো আজকের কৌশিকির পরিচয়ের প্রথম সোপান। তারপরে আর পেছন ফিরে চায়নি সে। এক সময় ধীমানের সাথে পরিচয় হয়। সেই পরিচয়,প্রেম গড়িয়ে শেষ হয় বিয়েতে । দুজনে একসাথে আছে প্রায় তিন যুগ। একমাত্র ছেলে সেও প্রতিষ্ঠিত।
সুন্দর,স্বচ্ছ জীবনে ছোটোখাটো টানাপোড়েন এসেছে আবার মিলিয়েও গেছে। তাই কৌশিকির কোনো অভিযোগ বা ক্ষোভ নেই। কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গছে অনেক আগেই।না হওয়ার কোনো কারণও তো নেই।এক কাপ গরম কফি নিয়ে তিন যুগ ঘুরে এলে কফি কী করে গরম থাকে !অগত্যা কফির মগটা নিয়ে পা বাড়ায় কফি মেকারের দিকে।কফির মগে ডুবে যাওয়া কেক্টুকু কফিতেই মিলেমিশে একাকার। ঠাণ্ডা কফিটা ফেলে দিয়ে দ্বিতীয়বার কফিতে চুমুক দিতে দিতে কৌশিকি সারাদিনের কর্মসূচি ঠিক করে নেয়।