You are currently viewing কালো আগস্ট, কালো কাক || শাহাব আহমেদ

কালো আগস্ট, কালো কাক || শাহাব আহমেদ

কালো আগস্ট, কালো কাক

শাহাব আহমেদ

 

“Little neighbors, I said, 

where is my grave 

In my tail said the sun 

On my throat, said the moon.”

 

সূর্য মলিন হয়ে আছে, তার হাসিমুখ রোরুদ্যমান। এবং চাঁদ কাঁদছে। কাঁদছে কারণ তার গলা-ব্যথা। গলা-ব্যথার কারণ একজন বিশাল মানুষের কবর তার গলায় ঠেকে আছে, সে তাকে গিলতে পারছে না, উগরেও দিতে 

পারছে না।

খৃষ্টপূর্ব ৪৪ সালে ব্রুটাস যখন সিজারকে ছুরিবিদ্ধ করেছিল বা তারও ১৯ শতাব্দী পরে বুয়েনোস আইরেসের কোনো এক গ্রামে কোনো এক সম্মানিত অশ্বারোহী বা গাউচো তার হন্তাদের দলে তারই পালকপুত্রের মুখ দেখে বিস্ময়ে চিৎকার করে বলেছিল, “তুমিও! পুত্র আমার!” অথচ তারই মাত্র ৮ বছর পরে বিশাল বুকের একজন মানুষ, “তুমিও মোশতাক!” কথাগুলো বলার আগেই বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েছিলেন……

“আজাইরা কথা কইছো তোমরা, আজাইরা কথা!” কাউ কাউ করে ওঠে কালা কাউয়া। ডানা ঝাঁপটায়, ঠোঁটে ঠোকরায়, রাগে তার চোখ লাল হয়ে ওঠে পাকা গোল মরিচের মত। 

“বড় মানুষ মরলে মানুষ কান্দে, তার লাইগ্যা কেউ কান্দে নাই।”

কদর্য কণ্ঠটা চাপা পড়ে যায়, শোনা যায় অন্য কণ্ঠ, শান্ত ও সৌম্য; এই কণ্ঠের কোনো উঁচু তর্জনি নেই, গর্জন নেই, আছে আদি ও অকৃত্রিম শান্তির স্বর, “একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালির সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।”

না, এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে আর হয়নি, এমন নিষ্ঠুরভাবে পরিবার-পরিজন, শিশু ও সন্তানসম্ভবা সহ মানুষ মানুষকে বিনাশ করেনি।

করেছে। 

ইতিহাসের ঘটনাগুলো ফিরে ফিরে আসে।

শুধু তাই নয়, সময়ে স্থান পরিবর্তন করে ভুক্তভোগীরাও ঘাতকে পরিণত হয়, যারা অন্যায়কে অতীতে অন্যায় বলে ধিক্কার দিয়েছিলো, তারাই হাসিমুখে নির্দ্বিধায় অন্যায়ের পিঠ চাপড়ায় এবং পালাক্রমে তাদের করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পবিত্র লড়াইয়ে সামিল যারা, তাদের খাঁচাবদ্ধ করে হত্যা করাতে বিতৃষ্ণা বোধ করে না। 

কিন্তু যা হয় বা হয়েছে অন্যদেশে, অন্যকালে, তা আমাদের স্পর্শ করে না। আমাদের স্পর্শ করে তা-ই যা ঘটে আমাদের জীবনে। আমাদের জীবনেও রক্তের হোলিখেলা হয়, রুচির বিকৃতি ঘটে, রাজপথের নেতা-নেত্রী ক্ষমতায় গিয়ে পূর্বতনের চেয়েও বেশি অন্যায় ও নিপীড়ন করে। আমাদের সয়ে গেছে এসব। আমরা মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নিতে শিখেছি। আমরা কদর্যকে “কী সুন্দর!” বলে 

বিস্ময় প্রকাশ করতে শিখেছি এবং অবস্থা বুঝে, সিলেকটিভভাবে মুখ খুলতে, মুখ বন্ধ করতে এত পারদর্শী হয়ে গেছি যে আমাদের চিনতে এখন আর কারুরই ভুল হয় না। 

কিন্তু লোর্কার কবিতার সূর্য়ের সাথে, চাঁদের সাথে আমার মন ভারী হয়ে আসে যে মানুষটির জন্য এবং দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে বুক চিরে, আমি তাকে কাছে থেকে দেখিনি। এবং বর্হেসের “ষড়যন্ত্র” গল্পের সিজার বা গাউচোর মত নিকটতম মানুষদের হাতে নিহত মানুষটি বেঁচে ছিলেন আমার কৈশোরের কাল পর্যন্ত। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং আমরা স্বপ্নচারী হয়েছিলাম। স্বপ্নদ্রষ্টারা সচরাচর অপঘাতে মারা যান। তাই হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে। তাই হচ্ছে এখনও। 

তিনি বলতেন “আমি শোষিতের পক্ষে।” এ কথা অনেকেই বলে, কিন্তু যেহেতু তাদের হত্যা করা হয় না, এক বিন্দুও সন্দেহ হয় না যে অন্তর থেকেই তিনি কথাটি বলতেন।

এবং সাহসী ছিলেন তিনি, ১৯৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গায় মারা যেতে পারতেন অথচ জীবন হাতে নিয়ে মাঠে ছিলেন।

কেন? 

অন্যের জন্য।

ঠেলা গাড়িতে ঠেলে চাল পৌঁছে দিয়েছেন দুর্গতদের, যখন দাঙ্গাবাজরা লাঠি-সোটা তলোয়ার হাতে তাড়া করছে।

কেন?

মানুষকে ভালোবাসতেন, মুখে নয়, কাজে।

১৯৭১ সালেও তো ফাঁসির দড়ি ঝুলছিল তার সেলের সামনে।

কেন মরেননি মৃত্যুহীন বীরের মর্যাদা ও 

১০০ % বাঙালির চোখে অশ্রু নিয়ে?

ঈশ্বর প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে বাঙালির গায়ে মিরজাফরের রক্ত।

ঈশ্বর গ্রীক দেবতাদের মত তার জনপ্রিয়তায় হিংসায় জ্বলে উঠেছিলেন, চেয়েছিলেন বাঙালির বুকের সিংহাসন থেকে টেনে হিঁচড়ে ধূলোয় লুটিয়ে একজন বিধ্বস্থ ও ব্যর্থ বীরের মৃতু দেখতে। 

ঈশ্বর চায়নি তাঁর সাথে আমার দেখা হোক এবং তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“মানুষ তো অনেক দেখলাম, তুই বাঙালী হ, কবিগুরুর সপ্ত কোটির একজন নয়, আমার মত একজন!”

দেখা হলে কী হতো?

হয়তো আমি তার ব্যক্তিত্ব ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কোমল স্পর্শে সত্যই অন্য মানুষ হতাম।

কিন্তু মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর…… কত কত ছিল তার ভক্ত…. দিনে কতবার তাদের দেখা হয়েছে, কত বছর ধরে, তারা কেন হয়নি?

ঠিক আছে! ঠিক আছে! কালো কাক।

হ্যাঁ, আমি ভয় পাই। 

হ্যাঁ, আমি চুপ থাকি যখন ব্যাংকের টাকা পাচার হয়ে যায়, শেয়ার বাজারে ধ্বস নামানো হয়, কৃত্রিমভাবে নুন, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দাম বাড়িয়ে ডিজিটাল আইন প্রণেতারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামায়।

হ্যাঁ, আমি ভয় পাই আমার মুখের কথা অপহরণ করার অবৈধ আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে।

ভয় পাই, শুধুমাত্র সত্যকথা বলার কারণে ক্ষমতার দুর্বৃত্ত ও অক্ষমতার নপংসুক বুদ্ধিজীবিরা আমার গায়ে রাজাকারের 

তকমা লাগিয়ে ঢল ঢল ঢোল পিটিয়ে

প্রতিষ্ঠা করে আমার প্রাপ্য ঝকঝকে পুরস্কারগুলো ড্রেনে ফেলে দেবে।

তারপরেও তর্ক করো না কালো! 

কালো কাক! 

তোমার তর্ক করার কিছু নেই, আমি ভীতু কিন্তু ক্রিমিনাল নই।

আমি তাঁর মত সাহসী ও বিশাল-হৃদয় নই, 

যে দরিদ্র গাওয়ালদের অধিকারের দাবীতে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় বা যে মাঝি দিনে এক বা দুই টাকা কামাই করে, তার থেকে পাঁচ টাকা চাঁদা আদায়ের “জিন্নাহ ফান্ডের” রাষ্ট্রীয় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবরোধ করে।

আমাকে রাজপথে পথ দেখানোর মত তাঁর 

মত নেতাও নেই। 

আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না, তুমি পারবে না আমাকে বোঝাতে। অথচ তিনি তোমাকে, আমাকে সবাইকে ভালোবাসতেন। 

বাঙালির মধ্যে তিনি শত্রু-মিত্র দেখতে চাননি। “তোরা এক হয়ে কাজ কর, দেশ গড়!”

তিনি চেয়েছেন, “অক্ষয় ভালোবাসা” বিতরণ করেছেন। তুমি সেই ভালোবাসা পেয়ে তুমি হয়েছো, আমি সেই ভালোবাসা পেয়ে আমি হয়েছি। 

এবং তোমরাই তাঁকে হত্যা করার জন্য নাশকতা ও অরাজকতার নরক তৈরি করে

তার ভাবমূর্তি ধ্বংস করেছো, দেখিয়েছো যে তিনি একজন ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক, তিনি স্বজন প্রীতি করেন, চারিদিকে এত সোনার মানুষ, পীর, ফেরেশতা থাকতে তিনি নিজেকে চোর ডাকাত দিয়ে ঘিরে রাখেন, ঘুষখোরের বদলে সৎ মানুষের নিয়োগ দেন না, তিনি রক্ষীবাহিনী দিয়ে সন্ত্রাস শুরু করেন, তাঁর ছেলে ব্যাংক ডাকাতি করছে, দেশ বন্যায় ভেসে যাচ্ছে তিনি মানুষকে খাদ্য দিচ্ছেন না বরং জাঁকজমক করে ছেলেদের বিয়ে দিচ্ছেন…. 

অর্থাৎ প্রচার প্রপাগাণ্ডা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র যা যা করা দরকার ছিল, তার মৃত্যুতে মানুষ যাতে কান্নায় ও প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, তার সবগুলো শর্ত পরিপূর্ণ করেছো লাইন বাই লাইন।

কিন্তু কারা ছিলো তোমাদের পেছনে, তাদের

কি আমরা চিনি?

না।

চিনি শুধু ডালিম, রশিদ, ফারুক ইত্যাদি যারা ঘাতকের ঘৃণ্যতম কাজটি সম্পন্ন করেছে, তাদের। তাদের কেউ শাস্তি পেয়েছে, কেউ মারা গেছে, কেউ আত্মগোপনে রয়েছে, কিন্তু মূলে ছিল যারা তারা রয়ে গেছে অনস্পর্শ। বঙ্গবন্ধু এদের কথাই বলেছিলেন, বলেছিলেন তার দলের ভেতরেই একটি শ্রেণির সৃষ্টি হবে, যারা ক্ষমতা দখল করবে এবং তা-ই হবে তার দ্বিতীয় মৃত্যু এবং তিনি দীর্ঘ দিনের জন্য হারিয়ে যাবেন। 

তিনি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু সেই শক্তিগুলো হারায়নি বরং অপরিসীম শক্তিশালী হয়েছে এবং যে কাজ তাদের এজেন্ডায় ছিল, স্বাধীনতার অর্জনকে খর্ব করে ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে বিচ্যুত করে একটি লুটেরা ও দুর্বৃত্তশাসিত, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করা, সেই কাজটি একদিনের জন্যও থামেনি। 

তারপরে তিনি ফিরে এসেছেন বা ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তার নাম নিয়ে ভুল-ভাল ও স্থুল বানিজ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ওরা যায়নি কোথাও, ওই দুর্বৃত্তরা, ওরা কাজ বন্ধ করেনি এক দিনের জন্যও। ওরা জলের মত তরল এবং পাত্র ও দল বুঝে ওদের কায়া বদলায়, ওদের শক্তি অতি সংহত, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে ওদের “নিউ কন”, “নিউ লিবেরলাল” মিত্র অথচ বাংলার কৃষক আজও কাঁদে ক্ষুধায়, বাংলার শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, নিম্ন মধ্যবিত্ত আজও বেঁচে থাকার মিনিমামটুকু থেকে বঞ্চিত, বাংলার নারী আজও গৃহে গৃহে নিপীড়িত, ধর্ষক ও ধর্মচাষীদের লালা ও বীর্যে সিক্ত।

তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুর ভয়টা কি কেটে গেছে?

ভয় হয়, কাটেনি। তার দুহিতা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও না। জবরদস্তির ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জবরদস্তির ভালোবাসার বিষে আমরা চীরঞ্জীব লেনিনকে মরে যেতে দেখেছি।

কাইফা যীশুকে হত্যা করিয়েছে কিন্তু যীশু বেঁচে আছেন। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ক’জন কাইফার নাম জানে?

মন বলে, যুগ যুগ কেটে যাবে, যাবে শতাব্দী কিন্তু শেখ মুজিব থাকবেন। তোমরা  যতই কা কা করো না কেন কালো, তার কণ্ঠ মলিন হবে না।

 

আগস্ট ৮, ২০২৩

গেইন্সভিল, ফ্লোরিডা।

=====================