কালের কলস
রাশিদুল হৃদয়
ছোট ডিঙি নৌকা গুলো ছটফটিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগে পদ্মার একুল হতে ওকুল আর ঢেউয়ের চাঙর ভেঙে ভেঙে বৈঠা চালাতে ব্যস্ত এবং ক্লান্ত মাঝি কিনারায় পৌছানোর তাগাদা অনুভব করে যখন দেখে তার শুন্য পকেট উত্তরি হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে যায়। কিছু পয়সা পাওয়া গেলে হাঁটে যাওয়ার ফন্দি আঁটে মনে মনে। একটা বড় রুই কিংবা ভাগ খানেক শুকনো বাসি পুঁটি —নিদেনপক্ষে গুঁড়ো চিংড়ি—যার ঘিলু মুছে ফাকাশে হয়ে গেছে তাও—যাতি লাউয়ের সাথে হালকা ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। মাঝ নদী থেকে একবার কিনারায় চোখ তুলে তাকায় মজনু আর দেখে বাতাসে কেমন রি রি করছে রোদ। বৈঠায় মন দেয় আবার আর গান আসে না শুকনো গলায়। দু-হাত ঘেমে পিছলে যেতে চায় বৈঠা—তখন তার গালি দিতে মন চায়। বউরে মনগালি শোনায় মজনু —থুথু ফেলে জলে আর অজস্র স্রোতের ফেনায় কোথায় নিমেষে দ্রবিভুত হয়ে যায় চোখের ধাঁধায়।
—হারামজাদীর সুহাগি গতর—শালি বেলই।
মজনুর পেট চুচু করে খিদায় আরও বকুনি এসে থেমে যায় তখন। যখন ঘর থেকে বেরোয় মজনু তার বউ ঘুমায়। না খেয়ে প্রায় আসতে হয় মজনুর। একবেলা খালি পেটে নৌকা বেয়ে আবার ঘরে যায় আর গরম ভাতের আমন্ত্রণে তার রাগ জল হয়ে নদীতেই ঢেউ খায় যেন। মজনুর ছোট নৌকায় তিনজন গোমড়ামুখো। মোল্লাটা পেট মোটা গোয়াড় সে জানে —মোস্তাক বসেছে পাটাতনে যেখানে টিনের সাদা পাত কড়া রোদে চোখ টাটায় আর ফরু উঠেছে ছাগল সমেত —বসেছে নৌকার পেটে। দূরের আর ফাঁকা জলীয় ময়দানের গমগম স্তব্ধতা ভেঙে কেবল ছাগলটাই ম্যা ম্যা করে গলা ঝারে আর নদীর এপার ধাক্কা খেয়ে ওপারে গিয়ে ভিড়ে। চারদিকে অগাধ জলরাশি দেখে চুনায় ছাগলটা আর মোল্লা নাক শিটকায়—একটু চেপে বসতে গিয়ে দোলাও খায় নৌকা—তরপর আবার সামলে নেয়। মজনু ভাবে মোস্তাক কতদিন পর ফিরছে গায়ে—কেমন অচেনা আবেগ নিয়ে মোস্তাকও দেখে জলের খেলা আর ঘোলা চোখে আশেপাশের এলাকায় —নদীর বুকে পরিচিত চোখ বুলায়। ক্ষাপলা জালে কতদিন আগে নেমেছিল নদীতে — মাছ প্রাপ্তির উজ্জল আলো টুকু তার মুখে ফুটে ওঠে তখন। বিভিশিকাও ফুটে চাঙা হয় তার চোখে। বাতাসের তীব্রতায় হাজতবাসের দিনগুলোতে জমে ওঠা বড় বড় চুল আর দাঁড়ি সাতার কাটে অথবা ঝোড়ো হাওয়ায় শিশু ধানগাছ যেভাবে নুইয়ে মাটির সাথে লেপ্টে যায়। তখনি আবার ধূসর ছাগলটা ম্যা করে ডাকে আর মোল্লা তার আহাম্মকি কে অভিশাপ জানায়।
—জবর এক কানি লায়ে উটিচি।
মজনু তাকায় —কিছু বলতে গিয়ে যেন বিরক্তি অনুভব করে। মোস্তাক নিরব—অসাড় ভাবে বসে থাকে আর ভাবতে থাকে ডিমওয়ালা ইলিশ সেদিন না ধরলেও হত। মহাজনের হুকুমের সেদিন অবাধ্য হলেও এমন কিছু ক্ষতি হতো না —আর না তার মাস দেড়েক ঘর ছাড়া হাজতবাস করা লাগতো। মাইরের কথাও ভাবে ও—ভাবে তাগড়া তাগড়া পুলিশের পালিশ করা তেল চকচকে লাঠি আর তার অসহায় কান্নার প্রতিধ্বনি। দেড় মাসে তার গাল ভেঙেছে —ডান পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে —সামান্য উচ্চবাচ্যে হৃৎপিণ্ড চার্চের ঘন্টাধ্বনির মত খাবি খায়—আর তখনি আবার ম্যা করে ওঠে ছাগলটা।
—শালা একুন চেচাও ক্যা? জিলিক মারাবু তো শালা এক লাথে পানিত ফালাবো।
ফরু অনর্গল বকাঝকা করে আর মোল্লা ক্ষেপে যায় —তাতানো বালির মত ফোটে।
— জবর এক কানি লায়ে উটিচি বাপু।
তারপর মুখ তুলে কপালে হাত ঠেকিয়ে সূর্যের তীর্যক রোদের দিকে তাকিয়ে যোহর নামাজের সময় অতিবাহিত হয়—আশংকা করে। মজনু আবার কুল হাতরায় — চোখে মাপে— গলা শুকায়। একবার ভাবে কথা বল্লে সময় যাবে —তাই ফরুকে জিগ্যেস করে ছাগলটার কথা। ফরু বলে,
—বিহানা থিকি পাক পারিচি গো—এক কানি খোঁয়াড় তেবু মিলিলো লায়। দ্যাশ থিকে খোঁয়াড় উঠি গিয়ে গেরস্তর ব্যাদনা হয়েচে।
ফরুর পরে আবার দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকে মজনু—ফুরায় না অগাধ জলের পথ। উশখুশ করতে করতে মোল্লা এক সময় ক্ষীর রঙের জোব্বার হাতা গুছিয়ে ওযুর প্রস্তুতি নিতে লাগে আর তখনি কলসিটা ভাসতে দেখা যায়। পদ্মায় স্নান ক্ষনে প্রথম কলসি টা দেখেছিলো বিষ্ণুপদ শাস্ত্রী আর মায়ের কারিশমা ভেবে টেনে নিয়েছিল—দেখেছিলো তার ঢ্যাপা পেটের বাহারি কারুকাজ —তবে খালি। মায়ের ইশারা ভেবে নিয়েছিল তৎক্ষণাৎ তাই বেল পাতায় পূজো দিয়ে কি যেন মনঃ কামনা চেয়ে জয় মা জয় মা বলে ভাসিয়ে দিয়েছিলো আবার। সেইতো ভাসছে কতকাল—বোধকরি কত যুগ যুগান্তর এই পদ্মার পথে। কেউ ভাঙেনি—তোলেনি—ঝরে উল্টায় নি কখনো —কি প্রচন্ড প্রতাপে চলমান তার যাত্রা —অদ্ভুত? নৌকার সবাই এক ঝলক দেখে চোখ ফেরালো যার যার —তবে মোল্লার ওযু করা হলো না। ফরু কারন জিগ্যেস করলে মোল্লা বলে,
—জবর এক কান লায়ে উটিচি বাপু —উপুরে বরকির চুনা আর পানিত—
কলসির দিকে আবার তাকায় মোল্লা।
—পানিত ভাসে শুশানের মরা পুড়ানি হাঁড়ি। একুন এই পানিত ওজু চলপে না লায়ে নুমাজ চলপে কবা?
কেউ কিছু বলে না। মোল্লা পেট মোটা গোঁয়াড়—হাদিস কোরআনে পটু তার উপর আর অন্য কারো বিবেচনা কেন? এতক্ষন যাত্রা যেন তাদের অনন্তকাল মনে হয়েছিল তবে কুলের ঘাটে কালো কালো নৌকার ভিড় তাদের গুমোট পরিস্থিতির ইতি টানলো। নৌকা এসে তখন ঘাটে ঠেকলো আর মজনুও গলায় শুকনো কঠিন ভাবটা টের পেল না। দশ টাকার লাল নেতানো ভেজা নোট টা মজনু কে দিতে দিতে মোল্লা বিড়বিড় করে,
— জবর লায়ে উটিচি বাপু।নুমাজ টা কাজা গিলো। খোদা মাপ করো।
তারপর নামলো ফরু ছাগল সমেত—খোঁয়াড় খুজে না পাওয়ার যন্ত্রনায় কাতর দেখাচ্ছে তাকে আর ছাগল টা ম্যা ম্যা করে চলছেই। মোস্তাক আরও খানিকক্ষণ পরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে নেমে এলো এবং জানালো টাকা নেই তার। মজনু তখন আবার ভাবে কতদিন পর ফিরছে মোস্তাক?
— খুউব মারিচে তুমারে লা?
— শালার কাফের।
একইসাথে আবেগ এবং নির্দয়তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ হলো মজনুর কথায়—আর বললো,
— ছাড়ি দেলো শ্যাষম্যাষ—?
মোস্তাক বলে,
— দিবি লায়? ছুটোখাটো দুষে রাকপি না কি—হাজতে জাগা লাফাচ্চে যি বছর বছর ধরি রাকপি। আসামি রা গিজগিজ করতিচে শইলের পুনার মতুন— আটেনা। ওকেনে আমরা বাড়তি লায় ক?
মজনুর পেট টনটনায়। তারপর চলে যায় যে যার গন্তব্যের উদ্দেশে।
কলসিটাও তেমনি ছোটবড় ঢেউয়ের তালে তালে এগোয় যেদিকটায় ক্ষেপলা জালে মাছ ধরছিল তুরাপ। তুরাপের নৌকা নাই তাই কিনারায় বুক পানিতে জাল ফেলে মাছের আশায়। শেষ কবে একটা মাঝারি ইলিশ ধরে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে আয়েশ করে এক সাঝ আধপেটা খেয়েছে—মনে পড়ে না। প্রতিদিন জাল ফেলার পূর্বে সে ভাবে একটা খাজানা জুটে গেলে কেমন হয়? থাকুক ভয়ংকর দৈত্য -দানব তাও তো কপালের অভাগা দোষটা ঘুচবে। অথবা একটা বাহারী ইলিশ —যার পেট কেটে তুরাপের বউ বাদশাহি অংগুরি উদ্ধার করবে। তখনি সে কলসি টা দুরে ভেসে আসতে দেখে আর জাল গুটায়। ওটার কাছে যেতে হলে তার সাঁতরে বেশ খানিকটা—বলা যায় উতলা পদ্মার সাথে পাঞ্জা দিতে হবে। তুরাপ আকর্ষণ যতটা অনুভব করেছিল তা যেন ততটাই নিমজ্জিত হয়ে গেল আর সে হাল ছেড়ে নিজের কাজে মন দিবে ভেবে নিলো। এতটা বেহদিস—এতটা খেয়ালি বোধ হয় তুরাপের পক্ষেই খাটে কিংবা তুরাপদের পক্ষে —যারা সহজে পেতে উৎসুক কুমিরের মত হা করে থাকে। আবার কাঁধে গোটানো জাল পাঁক খেয়ে পদ্মায় ঝপ করে পড়ে যেটা তুরাপের কাছে ললাট সমুদ্রের উপমা। খোলা মুখে বিশাল নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দুলে দুলে ভেসে যায় কলসিটা—”কেউ কেউ বলে ভাসুক না— ওতে আমাদের দায় পড়েছে ঠেকাবার”। আর ওই কথাতেই নদীগুলোর —নদীপাড়ের লোক গুলোর বুকের ওপর দিয়ে—তাদের বিশ্বাস আর সংস্কারের ওপর দিয়ে কি নিরব কর্তৃত্য ফলিয়ে—কি অসাধারণ সম্ভাবনার দ্যুতি ছড়িয়ে ভেসে ভেসে এতদূর —এই সময়ে এসেছে। কলসিটা তুরাব কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার বেলায় ঢুলে ঢুলে নৃত্য করে আর চোখ টিপে হাসে মনে হয়। অগাধ জলে তার আধিপত্য যেন মানচিত্রের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চায়। ভেসে ভেসে যায়—কখনো নিতান্ত অনিচ্ছায় কোনো খড়কুটো তাকে ঠেকাতে চাইলে; উত্তাল—তবে মূর্খ স্রোতের কাছে নিঃস্ব মনে হয় তাকে। ভেজা কালো মরা খড়কুটো তাকে ঠেকাতে গিয়ে পটপট শব্দে ভেঙে পড়ে— নিজেকেই বাঁচাতে হিমশিম খায় তখন। এত শক্তি কোথায় —যে স্রোতের বিপরীতে ওটাকে বাঁধা দিতে পারে অথবা টুঁটি চেপে হত্যা করতে পারে মুহুর্তের ব্যবধানে? তুরাপ ঘাড়ায় না আর কলসি টা তাকে কটাক্ষ করে যেতে লাগে।
এ সময় চর জেগে পুকুরের মত ছোট ছোট ডোবা তৈরি হয় নদীর কুলে। জোয়ারের পানিতে সে সব ডোবা গুলো টইটম্বুর হয়ে উঠে —যৌবনবিকশিত হলে নারীর অঙ্গে যেমন লাবন্য উঁকি দেয় অথবা তপ্ত ভাতের ফ্যান যেমন উথলে পড়ে। দুপুরের আগুন রোদে খেলা কোরে ছেলেরা ডোবায় গা ভাসায় আর ঝাঁপাঝাপি করে নেয়। পদ্মার পাগলা স্রোত তাঁদের অদম্য জ্যোতি দমাতে পারে না। এ যেন তাঁদের আত্মিক অধিকার —যে কোনো মুল্যে জিতিয়ে নিবে ওরা। খরস্রোতা, রুদ্রমূর্তি – ক্রুদ্ধ -ক্ষিপ্ত পদ্মা পরাজিত ওদের দীপ্তির কাছে -ওদের প্রফুল্ল সবল চিত্তের কাছে। কলসিটা ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনা —ওদের কৌতুহলী চোখে ধরা খায়। রোল পরে যায় ওদের মাঝে। কে বলে,
— ওডি কি যায় রে? ভাসতিচে লায়?
সবাই তাকায় আর বিষম ধাঁধা লাগে- দুইটা ছোকরা; সাঁতরে গিয়ে তীরে আনে পলকে। হাপায় তবু জেদ দমে না— এক এক করে উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখে নেয়। খালি কলসি দেখে ওঁরা হাসে—ওটাকে ঘিরে হৈ-হুল্লোড় করার তোরজোড় সাজায়— নরম তবে বিদ্রূপাত্মক ফন্দি আঁটে। কে বলে,
— ফুঁকচি মারেক। ভিতুরে কি রে? প্যালু কিচু?
—কিচু লা। এক্কেবারে খালি।
শুধুমাত্র খালি এবং ফাঁকা; এটা যেন তাদের কাছে অনন্তকাল ধরে বেড়ে ওঠা মিথ্যা মনে হয়। মনে হয় এর ডালপালায় ছেয়ে গেছে নথিবদ্ধ নগরী। ওসব তারা মানতে চায় না হঠাৎ। কে বলে,
— শুদুই কি খালি এডির প্যাট? নাই কো কিচু?
— ভাবেক আমারে প্যাট মুটা হুজুর। উযে খালি দাওয়াত খ্যায়া বেরায়।
আর কে বলে,
— আর উই যে গোপুর কোবরেজ— যেতি ছপুরা ফুপুক জ্বিন খ্যাদানির নাম ক্যোরি ম্যারি ফেলালো।
— আর ভাবেক কুসোংকার যেগুনি আচে সগ এডির ফুলা প্যাটে।
— এইডিক একুন কি করবু?
তাঁরা একমনে ভাবে- একমনে ফয়সালা করে এটাকে—কলসিটাকে গলায় দড়ি বেধে ঘোরাতে থাকে সঙ্গে সঙ্গে। আনন্দে উল্লাসে ততই গর্জে ওঠে— ফিকরে ওঠে আর তখন তাদের মনে হয় আঁধার কাটলো। নতুন দিগন্তের রেখা ওঁদের চোখের কূলে নাচানাচি লাগায়। অসহায় কলসিটা আরও নিরুপায় হয় নাকি? তার দিন ফুরিয়ে আসে নাকি?তার প্রভাবশালী গৌরবের নিশান— চতুর শৃগালের মত বিস্তৃত এলাকায় দাপাদাপি —মুখ থুবড়ে পড়লো নাকি? কলসিটার প্রাচীন দর্প ওঁরা অতগুলো মুষ্টির এক আছাড়ে লন্ডভন্ড কোরে তবেই তার শতাব্দীর যাত্রা প্রখর মাটিতে গুড়িয়ে ফেলবে নাকি?
*****************************