You are currently viewing কালপুরুষের কুকুর / আব্দুল আজিজ

কালপুরুষের কুকুর / আব্দুল আজিজ

কালপুরুষের কুকুর

আব্দুল আজিজ

সামনের নির্জন স্টেশনটাতে পৌঁছানোর আগে একটা পুল পড়ে সেটার কাছাকাছি  যেতেই আমাকে সহ ‘কল্পনা’ নামক বগির আরো শ’খানেক যাত্রীকে নিয়ে কী কারণে ট্রেনটি থেমেছিল আমার মনে নাই। কারণ জিজ্ঞাসা করতে ভয় পাচ্ছিলাম, হাতের রেখার মধ্যে মনে হলো রক্ত নদী বইছে। তখন বগির ভেতর সবাই একে অন্যকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, এতক্ষণ যে তারা পরস্পর পরস্পরের পাশাপাশি বসেছিল কিন্তু কেউ কাউকে এখনকার মতো এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। কিন্তু কেন করেনি? আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করলোইনা বা কেন? অনেকে কথা বলেনি ঠিকই তবে চোখে চোখ পড়লে তাকিয়ে হেসে থেকেছে।

ট্রেনের ইঞ্জিনটা দুর্বল ষাঁড়ের মাছি তাড়ানো লেজের মতো নড়ে উঠল কয়েকবার, তবে হুইশেল বেশ চেঁচিয়েই বাজল, আড়ৎ এর দালালদের মতো তার চিৎকার।

জানালায় লেগে থাকা বাসি বমির গন্ধে টেকা যাচ্ছে না, যাত্রীরা সেদিকে কোন নজর দিলো না, এমনকি নাকটাও না  সিটকে তারা শুধু নিজেদের থুথু অজান্তেই গিলে ফেলল।

এরইমধ্যে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কী যুবক ছেলে ভেতরে বলদের মতো বসে না থেকে দেখগে বাইরে গিয়ে, কি সমস্যা তুমি না হবু ইঞ্জিনিয়ার!

আমি খানিকটা আশ্চর্য হই একজন অপরিচিত ব্যক্তি কীভাবে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপারটা ধরে ফেলল। আমি কৌতুহলী হয়ে তাকে লবণ দিয়ে জোঁক খোঁচাবার মতো খোঁচাতে নেমে পড়লাম।

আমার লবণ ছিটানোটি ছিল এইরকম, এই যে ভদ্রলোক আপনি যে অল্প বয়স্ক মেয়েটিকে নিজের আত্মীয় বলে  শহরে পালিয়ে যাচ্ছেন বিয়ে করবার জন্য এটা কি সত্য নাকি গুজব?

ভদ্রলোকটি অ্যাটাক আসার মতো হাত দিয়ে বুক চেপে ধরলেন, পাশের মেয়েটি তাকে  অনটাইম চায়না হাতপাখা দিয়ে বাতাস শুরু করে, সেটা তার ভ্যানিটিব্যাগেই ছিল যেন খাঁচায় বন্দি চ্যাপ্টা ডানাওয়ালা পাখি। বেরিয়েই ডানা ঝাপ্টানি শুরু করেছে।

ভদ্রলোকটি ঢোক গিলে বলল, এই যে যুবক তুমি কী করে এতটা জানলে? তুমি কি আমাকে জানো অথবা চেনো?

আমি তাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য আবার লবণ ছিটালাম। বললাম, আপনি এই শর্তে আপনার মেয়েদের রাজি করিয়েছেন যে, অল্প বয়স্ক সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ের বদলে আপনি বাড়িটা আপনার সন্তানদের উইল করে দিবেন, কিন্তু তা না করে বাড়িটি অন্য একজনের কাছে চুপচাপ বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা নিয়ে পালাচ্ছেন।
এবার সত্যি সত্যি ভদ্রলোকটির আগে আমি নিজেই ভড়কে গেলাম কারণ সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে নিশ্চয় আমি সত্য বলে ফেলেছি।

আমি আমার মুখে হাত দিয়ে চেপে রইলাম অনেক্ষণ যতক্ষণ না আমার নিজেরই ঘোর কাটে।

স্টেশনের অদূরে যেখানে ট্রেনটি থেমে আছে তার দুপাশ জুড়ে বিঘের বিঘে আখ ক্ষেত। জারুল আর শিমুলের গাছগুলো ছিল পাশাপাশি সতীনের মতো এক সংসারে। গাছে গাছে গায়, গাছে গাছে সই। শালিক পাখি সাইজের শিমুল ফুলগুলো রেললাইনের উপর থেঁতলে পড়ে থাকে। ট্রেন বুনো শুয়োরের মতো দৌড়ে এসে চলে যায়।

একজন আখ চাষীর সাথে কথা হল, সে তাড়ার উপরে ছিল বলে আমি গল্পটা বেশ জমাতে পারলাম না, দেখি তাকে ঘিরে মাছির ছা ছিমড়ি উড়ছে। ভনভন শব্দের তুড়ি আমার কানে যেতেই, আখ চাষী আমাকে বলল, এই যে যুবক ছেলে প্রেমটা ভেঙে গেল বলে মেয়েটাকে গালিগালাজ করে ফিরে যাচ্ছ শহরে?

আমি তার গুড় তৈরির বয়লারে ফুটন্ত আখের রসের মতো ফুটছিলাম, আখ চাষীর দাঁতগুলো কাস্তের মতো খচখচে। সে গামছা থেকে বিড়ি বের করে ধরিয়ে আমার সাথে গল্প জমানোর চেষ্টায় দূরের এক গ্রামের কৃষকের কথা তুলল। যে কৃষকের ঘরে দুই মেয়ে, কোন ছেলে ছিলো না। আরও অদ্ভুত শোনালো যখন শুনলাম তারা দু’জনই অন্ধ।

আমি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নেওয়ার ধান্ধা করার আগেই আখ চাষী শেকলে বাঁধা একটি শেয়াল টেনে বার করে, তারপর  দেখি শেয়ালটি আখ চিবুচ্ছে  আর তার কষা বেয়ে নামছে সাদা ফেনা। মনে হচ্ছে শেয়ালটি বমি করছে।

শেয়ালটিকে খুবই আনুগত্য মনে হল এমন কাণ্ড জীবনে এই প্রথম দেখলাম।

আখ চাষী হেসে বলল, শোনো কাঁটা দিয় কাঁটা তোলার চেষ্টা করেছি মাত্র, কত্তো বড় সাহস আমার ভেড়ার পালে একদিন দিনদুপুরে একটা ভরা পোয়াতি শেয়াল এসেছে, মতলব শিকারের। আমি বয়লারে আখের রস জ্বাল দিচ্ছি। আল্লার কি হুকুম ভেড়ার পালের কাছাকাছি শেয়ালটির প্রসব বেদনা উঠল, আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি একটা বাচ্চা পয়দা করে শেয়ালটি মারা গেছে। আমার কূটচালের মাথা, ভাবলাম শেয়াল পিটিয়ে ভেড়া বানাব। এবং এই শেয়ালকে দিয়েই জোগাবো আমার ভেড়ার পাল। তাই হচ্ছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছি, ভেড়ার পাল বাড়ছে দিনকে দিন।

-এটাও সম্ভব?

-কেন না মগজে খেলিয়েছি। শোন এখন ট্রেনে হিজড়া উঠবে, তারা পুলের নিচ থেকে আত্মপ্রকাশ করে, আত্মগোপন করবে স্টেশনের পেছনের খ্রিস্টান  সাঁওতালদের গোরস্তানে, তুমি দেখো…

সত্যি ট্রেনে উঠল একদল হিজড়া আর তাদের সবার নাম দুই অক্ষরের মধ্যে যেমন- চম্পা, নিপা, মধু, মতি, লতা এবং জয়া। তারা এখন পর্যন্ত কেউ জানেনা যে তাদের সকলের নাম দুই অক্ষরের। আদৌতে কি তারা পড়াশোনা জানে? অথবা চাঁদাবাজির পয়সাগুলোর গণনা কিংবা হিসাবনিকাশ করা তারা কি এমনি এমনি শিখে গেছে? প্রশ্ন আর প্রশংসা দু’টোই করতে মনের মধ্যে খচখচ ভাব তৈরি হতে থাকে। তাদের কায়দায় তারা তালি বাজাচ্ছিল। জয়ার কপাল থেকে চান্দির মাঝামাঝি নিয়ে টাক। ছাটা চুল। বিদঘুটে মেকাপ। এবং নকল স্তন। সে বাকি হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে লুডুর গুটির মতো।

জয়া বেশ উগ্র, বদ মেজাজি। অন্যরা নিমিষেই বগির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং টাকা তুলতে শুরু করে এটা তাদের একধরণের চাঁদাবাজি বলা যায়। আমি তাদের এসব কায়কারবার দেখে আমার ফোনের ক্যামেরাটা অন করি। সেটা জয়া দেখে আমার কাছে আসে, আর নরম ভাষায় (যদিও তার কণ্ঠস্বর নর বতকের মতো খসখসে শোনাচ্ছিল) বলল এই যে সোনা তুমি কি আমাকে পছন্দ করেছ? যদি করে থাকো তাহলে তোমার কাছ থেকে টাকা নেবো না, আর যদি ঘেন্না কর ওদের মতো যাদের স্বাভাবিক শরীর, লিঙ্গ আর উঁচু বুক আছে তাহলে কিন্তু তোমাকে টাকা দেওয়া লাগবে। আমি উত্তর না দিয়ে ক্যামেরাটা তার দিকে উঁচিয়ে ধরতেই সে বলল এতো ছবি তোলার শখ? আমরা সহজে ন্যাংটা হতে পারি আবার ন্যাংটা করেও দিতে পারি। জয়া তার কটকটে কমলা রং এর সায়া দোলাতে দোলাতে বলল তুলব নাকি – দেখবে..? দেখবে?

তাকে থামাতে আমি জিজ্ঞেস করলাম ছাত্রদের জন্য কি বিশেষ কোন ছাড় আছে?

জয়া শান্ত থাকার চেষ্টা করেও কিন্তু পারল না সে রেগে গিয়ে আমাকে তার পুরুষালী কন্ঠে খিচড়ানি শব্দে গালি দিতে গিয়েও কেন যেন থেমে গেল। তার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়।

আমি লবণ ছিটানোর পরিকল্পনা করে দিলাম ছিটিয়ে, তোমাদের দল গোরস্তানে কী করে বুঝি না বুঝি, আর পুলের নিচ থেকে কতদিন খোলস বদল করবে?
জয়া হতভম্ভ হয়ে গেল, মনে হচ্ছে সে বিশাল ভয় পেয়ে গেছে। তার টাকে ঘাম জমছে, নকল স্তনটাও  কাঁপছে।

সে আমার কাছ থেকে দূরে সরতে চেষ্টা করে এবং পরপর ডাকতে থাকে যাদের সবার নাম দুই অক্ষর দিয়ে।

হিজড়াদের দলটিকে পেছনে রেখে কয়েক সিট এগিয়ে গেলে দেখি জনৈকা এক মহিলা বুলন্দ শাহের মাজার থেকে নিয়ে আসা একটি নীতি গল্প মুখস্ত করে চলেছে, তাকে জিজ্ঞেস করতেই বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটা নিঃশ্বাসের পর ঢোক গিলে বলল, বড্ড ভুলা মন বাপ তাই মুখস্ত করছি, যা জামানা, শুইন্যা আইনু গেল বকরা ঈদের কুরবানির গোস্তে নাকি আল্লাহু আর নবিজির নাম মুহাম্মদ ল্যাখা উইঠ্যাছে এ্যার চেয়েও ভয়ানক কথা শুইন্যাছ কি?

আমি বললাম, না।

-শুনো নি? হায় খোদা এগল্যা খবর রাখে না বল্যায় দুনিয়্যা আখের হইতে চইল্যাছে।

-ঘটনা বলেন, কী হয়েছে?

-বেশি পুরানা ঘটনা লয় এই তো দশ বারো দিন আগের কথা পচ্ছিমপাড়ার এক পুয়াতির সান রাইতে ব্যথা উঠলো আর ভোররাইতে ফজর অক্তে ব্যাটা ছ্যালা হইল…

-তারপর?

-তখনই তো ঘটনাটা ঘটল ছ্যালাটা হওয়া মাত্রই আজান দিতে লাগল, দিয়া এক দৌড়ে ডাবের গাছে উইঠ্যা কহিলে যার যার একটা ব্যাটা ঘরে, সে মা যেনে পিতলের কলসি ভরা পানি ডাবের গাছের গোড়ায় ঢালে। তারপর গায়েব। সইত্য ঘটনা গো।

আমি ঘটনাটি শোনার পর সেই গল্পবলা মহিলার কাছে এমন ভঙ্গিতে বুলন্দ শাহের মাজারের ঠিকানাটা চাইলাম, মনে হল তিনি বুঝতে পেরেছেন যে আমি তার গল্পে আমল এনেছি।

তবে কেন যে ট্রেনটা থেমেছে এই প্রসঙ্গ নিয়ে কেউ কিছু বলছে না দেখে আমি আরও কয়েক সিট সামনে এগিয়ে যাই। আর দেখি এক ভিক্ষুককে যিনি লেটা মেরে বসে আছেন মাটিতে। পরে বুঝতে পারি যে ভিক্ষুকটি অন্ধ, খুব ছোটো বয়সে তার গুঁটি বসন্ত হয়েছিল গ্রামে ছিলো না ভাল চিকিৎসা ব্যবস্থা, প্রচলিত ঝাড়ফুঁক আর কবিরাজ দেখিয়ে গা থেকে গুটি বসন্ত বিদায় হলেও, রেখে গেছে তার চিহ্ন।  গোটা মুখে ফুটি ফুটি দাগ আর দৃষ্টিহীন কানা  দুই চোখ।

ভিক্ষুকের কথাটা ভাবতে গিয়ে আখ চাষীর গল্পের সেই কৃষকের দুই অন্ধ মেয়ের গল্পটা শুনতে ইচ্ছা জাগল, তাকে জিজ্ঞাস করতাম তারা কি পেটের অন্ধ নাকি গুটি বসন্তে চোখ হারিয়েছিল। আমি ভিক্ষুকটির কাছে যেতে না যেতেই সে বলল, তোমার ঘাটা দেখছিনু।

চোখে দেখতে পেলে হয়তো তার লজ্জা  লাগতো, কিন্তু  অন্ধ হয়ে এ এক সুবিধা সেই লজ্জাটা এই না দেখার ব্যাপারে অনেকটা পুষিয়ে নিয়েছে। সে কিন্তু কিছু একটা বলার মধ্যেই আছে, হু কহছি যে হারঘে বরিন দিয়াড়্যা মানুষের মইধ্যে এ আর এমন কি! অরা তো জ্যান্যাই লিয়্যাছে যে হামি কানা আর ভিখ করি টেনে টেনে (ট্রেনে)। অর্থাৎ জীবনের কাছে লজ্জা শরম টানতে নাই।

তারপর কেন যেন মনে হল কৃষকের অন্ধ দুই মেয়ে আমার দু’কানে ভর করেছে, তারা বলছে, তুমি কি জানো আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।

আমি বললাম, আপনারা নিজেদের বলছেন অন্ধ কিন্তু দেখছি সবই দেখতে পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে, তারা বললেন কই আমি বলিনি তো যে আমরা দেখতে পাইনা। অন্ধের ভান করা দুনিয়ার সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের বুলি যে আমরা অন্ধ, হ্যাঁ সত্যিই আমরা অন্ধ, অন্ধত্ব আমাদের শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের বিকাশ এবং প্রকাশ এই অন্ধত্ব থেকেই। দেখেছ রংহীন অন্ধত্বের দোহায় দিয়ে ভিক্ষুকটি আজও বেঁচে আছে, বাল বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে, অন্ধত্ব তার শরীর বা চক্ষু জুড়ে আছে বলেই যখন তখন এই দুনিয়াটাকে বন্ধ, সুরক্ষিত নিজের ঘর মনে করে সঙ্গমে গিয়ে বছর বছর নিজের অন্ধত্ব কণা উপহার দিচ্ছে এই পৃথিবীকে। আমরা কি অনুমান করছি তার অন্ধত্ব লাভের মজা অথবা যখন তখন উসকে যাওয়া তার প্রেমের পরশ। তাকে এখন দিনের বা আলোর জগতে নিয়ে গেলে সে নিশ্চিত সেখানে বেশিদিন থাকতে চাইবে না কারণ অন্ধত্বের মজা যে একবার পেয়েছে সে রঙিন আলোর জটিলতায় ফিরতে চাইবে না। এমন কি আমরাও চাইবো না। তবে তুমি যে আমাদের ভান করার ব্যাপারটা মনে মনে ধরে ফেলেছ এতে মোটেও আশ্চর্য হইনি কারণ যারা আমাদের এই ব্যাপারে জেনেছে তারা সবাই একই চরিত্রের অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত।

তাদের সংজ্ঞায় প্রত্যেকটা মানুষ অন্ধ।

এবার আমি আমাদের ‘কল্পনা’ নামক বগির শেষ প্রান্তে এসে দেখি, একটা জটলা। এখানে বেশ হৈ চৈ। তবে কেন?

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার (দেখে শিক্ষিত মনে হল) কাছ থেকে জানলাম, দেড় বছরের এক শিশুর জন্যই এত কাণ্ড।

আমি বললাম, এই দেড় বছরের শিশু আবার কি করল?

আপনি জানেন না শিশুটি ট্রেনে উঠার পর থেকে এত কাঁদছিল যে, অগত্যা তার মা মুখ ফসকে বলে বসে তুই যদি না চুপিস তাহলে তোকে জানলা দিয়ে ফেলে দেব। অমনি ব্যস হয়ে গেল।

-এটুকুই কাহিনি!

-তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি জানেন না যে চলন্ত ট্রেনে কিংবা নৌকায় এসব কথা বলতে হয়না। ওই হতভাগী মায়ের জন্যই তো ট্রেনটা থেমে আছে।

না বলে ঐ কথা আর না আমাদের দেখতে হয় একসাথে দুজনের করুণ পরিণতি।

-ট্রেনটা কি অন্য কোন ভাবেই গড়ানো সম্ভব নয়।

-না। এটা অসম্ভব। আমরা এই কথা বহু বছর ধরে মেনে আসছি। শিশুটিকে

জানালা দিয়ে না ফেললে আমরা কেউ-ই কোথাও যেতে পারবো না।

-এসব কুসংস্কারে এখনো বিশ্বাস করেন আপনারা?

এ ফাঁকে শুনতে পেলাম বুলন্দ শাহের মাজার থেকে আসা জনৈকা মহিলার কণ্ঠস্বর তিনি আফসোস নিয়ে বলছেন, আহারে বহুটা মনে হয় ডাবের গাছের গোড়ায় পিতলের কলসি ভরা পানি ঢালেনি।

কি আর হতভম্ব হব! জটলা হটিয়ে দেখতে পেলাম মেয়েটি কীভাবে তার কোলের শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে। সে তার ভাগ্যকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। হাত চাপড়ে মাথায় মাথায় বাড়ি দিচ্ছে। আর তা কোথায় লাগছে, ভাগ্যে, জন্মে, নাকি পরিহাসমূলক বিশ্বাসে! জানিনা।

ভূগোল ক্লাসে স্যারের বকবকে থুথু ছিটানো ভূতত্ত্বের ব্যাখ্যাগুলো আজো মনে পড়ে, তখন বহু কিছু জানার আগ্রহ ছিল। সেই ভূগোল ক্লাসের স্মৃতির কিছু অংশ মনে করে এই সময় মহাশূন্যের গহব্বরে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।  জানিনা সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের কথা যেটা পরিচিত সিরিয়াস বা লুব্ধক নক্ষত্র নামে ।  হতে পারে তার উজ্জ্বলতা  আমাদের বিশ্বাসের মতো বিকট চকচকে অথবা ধারালো। যেটাকে আমরা ছোটোবেলায় কালপুরুষের কুকুর বলে জানতাম। ভূগোল ক্লাসে স্যারের সেই ব্যাখ্যা, ভাবনার ভুলগুলো চুরমার করে দিতে থাকে। আচ্ছা সেই লুব্ধক নক্ষত্র কিংবা ছোটোবেলার শুভ কালপুরুষের কুকুর যদি আমাদের কল্পনায় আটকে পড়া কুসংস্কারের ট্রেনটাকে টেনে নিয়ে যেত। সম্ভব কি?

তবে সম্ভব হয়েছে আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে যাওয়া। সেখানে সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা ছাড়া একুশ ইঞ্চি টিভির পর্দার সামনে বুক ফুলিয়ে সিংহের সিংহভাগ কামড়ে হরিণভাগ হয়ে যেতে দেখেছি। আর সেই ভাগ বা শিকার শেষে সিংহ যেভাবে গা ঝাড়া দিয়ে গর্জন ছাড়ে তেমনি ভাবে ট্রেনটি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার পর গর্জন হিসেবে হুইশেল দিলো। দ্রুত গড়তে থাকল ট্রেনের চাকা, যাত্রীরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বাচ্চাটিকে জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার পর, তার মা অজ্ঞান হয়ে যায়। জানালা দিয়ে দেখি বোবা গাছপালা সহ চলন্ত ভূমি, তেলে চলা যন্ত্রটির সাথে কীভাবে সাই – সাই শিশ তুলে নগ্ন পাল্লা দিয়ে ছুটছে। থামো… থামো, দেখছি আমার চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না, মনে হয় গন্তব্যে ফেরার আনন্দে সবাই নিশ্চুপ।  দ্রুত আমি দৌড়ে গাঢ় লাল রঙের শেকলটা খুঁজতে থাকি যার পাশে লেখা সতর্কীকরণ বার্তা, “প্রয়োজনে গাড়ি থামাইতে শেকল টানুন, অযথা টানিলে ২০০ টাকা জরিমানা।”

আসলে এই মুহূর্তে আমার কি শেকল টানা উচিৎ?