You are currently viewing কাজী লাবণ্যের আয়োলিতার পুরুষ ||  শাহাব আহমেদ

কাজী লাবণ্যের আয়োলিতার পুরুষ ||  শাহাব আহমেদ

কাজী লাবণ্যের আয়োলিতার পুরুষ 

শাহাব আহমেদ

কাজী লাবণ্যের আয়োলিতার পুরুষ পড়লাম। ২০২২ সালের চলন্তিকা পাণ্ডুলিপি পুরস্কার প্রাপ্ত ১৩টি গল্প নিয়ে তন্বী একটি বই। সময় খুব একটা লাগে না, একটু বেশি মনোযোগ দিলে, একটু বেশি লাগে এই যা। অতিরিক্ত অলংকারহীন সহজ সরল মসৃন বাক্যে প্রবাহমান প্রতিটি গল্প নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা যায়, কিন্তু কখনও কখনও তা পাঠকের জন্য রেখে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। সময় ও সমাজ সচেতন এই লেখকের চরিত্রেরা আমাদের আশেপাশের মানুষ, তাদের মুখের দিকে তাকালেই আমরা চিনতে পারি এদের ঠাঁই ঠিকানা, ঠিকুজি, খুব একটা খুঁজতে হয় না। 

কিন্তু ওই আয়োলিতা?

আয়োলিতা কে? 

একজন লেখক। সৃজনশীল নিঃসঙ্গ এক সত্তা। সব সৃজনশীল মানুষই কি নিঃসঙ্গ নয়? সবার চেয়ে সে একটু বেশি, তার সংসার নেই, অথবা সংসারে সে নেই। পিতা মৃত, মা দূরে, সন্তান থাকতে পারতো কিন্তু স্বামী ভ্রুণহত্যায় বাধ্য করেছে, তারপরে? তারপরে এক সুন্দর সকালে বা সন্ধ্যায়, বা চাঁদনি রাতে, অথবা কোনো ঝরঝর বৃষ্টির ক্ষণে স্বামী পালিয়ে গেছে অন্য নারীর হাত ধরে। সমাজে এটা নতুন কিছু নয়, গল্পের প্লট হিসাবেও প্রায় প্রাগৈতিহাসিক। 

কিন্তু না, গল্প আছে, চমতকার গল্প এই আয়োলিতায়, এবং কাজী লাবণ্য তা খুব দক্ষভাবে তুলে ধরেছেন।

আয়োলিতা লেখক, সে তন্ময় হয়ে লিখছে তার শেষ উপন্যাস সাঁঝবাতি। 

দিন যায় টের পায় না, রাত যায় ঘুম নেই।

ভক্ত পাঠক আছে, কেউ কেউ টোকা দেয় হৃদয় দরজায় কিন্তু সামনেটা আয়োলিতার পেছনের দিকে।

চিংড়ি মাছের মত, ওই মাছটাও একা থাকতে পছন্দ করে এবং অন্য মাছেরা সামনের দিকে যায় তো, সে যায় পেছনের দিকে।

 

কফিশপে দেখা হয় তার এক সুদর্শন যুবকের সাথে, আয়োলিতার মনে হয় সে তাকে চেনে, কিন্তু চিনতে পারে না। অথচ যুবক 

তার লেখার সাথে পরিচিত, “আপনার সব বই আমার কাছে আছে, আপনার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি, ভালোবেসে পড়ি। শেষের উপন্যাসটি অদ্ভুত ভালো লেগেছে।”

এবং কফিশপ থেকে চলে যেতে যেতে বলে, “ও হ্যাঁ, ওই কথাটি ভীষণ সত্যি। আপনি মার্গারিটার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর!”

সুনীলের সুদর্শনা মার্গারিটা।

কে যেন এ কথা বলেছিল? আয়োলিতা ভাবে। আশ্চর্য কে এই যুবক? করোটির খোপে খোপে হাতড়ায়, কিন্তু খুঁজে পায় না।

কিন্তু জীবনের একঘেয়েমি, একাকীত্ব, হতাশা, শূন্যতা, অতল গহ্বর, রাত্রি জাগরণ পাইথনের মত আষ্ঠেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে। 

বিষণ্ণতা উঁই পোকার মত তার মগজ খেয়ে ফেলে। 

কী হয় লিখে? লেখকের চিরায়ত প্রশ্ন পরশুরামের কুঠারের মত তার অস্তিত্বের স্তম্ভগুলো চুর চুর করে দেয় এবং সত্তার পাড় ভাঙে, ভাঙে আর ভাঙে এবং সে আত্মহত্যা করতে যায়। এক হাতে জলের মগ, অন্য হাতে শুভ্র মৃত্যুদানা। মুখে দিতে যায়, চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় সেই সুদর্শন যুবক। 

“আয়োলিতা এ তুমি কী করছ? এ কাজ তোমার জন্য নয়। তুমি একজন লড়াকু মানুষ, তুমি এটা করতে পারো না। এ পরাজয় তোমাকে মানায় না। তুমি সাঁতার জানো, ডুবতে চাচ্ছো কেন!”

“আর না, নিজেকে টানা, মানে এই একাকীত্ব, এই দহন আমার আর….”

“একা হবে কেন! তুমি তো একা নও আয়োলিতা। তোমার একটি পরিপাটি সাম্রাজ্য আছে। সেখানে তুমিই রাজা, তুমিই প্রজা। তোমার ভেতরের শক্তিতে তুমি দেবী দুর্গা। তুমি দশভুজা….” এবং সে তাকে শক্তির সন্ধান দেয়, যে শক্তি একজন মানুষের, বিশেষ করে একজন নারীর অস্তিত্বে অন্তর্নিহিত এবং বিস্মিত আয়োলিতা প্রশ্ন করে, তুমি কে?

অদ্ভুত শুভ্র এক হাসি যুবকের মুখে, তুমিই বলো আমি কে?

এবং আয়োলিতা তাকে চিনতে পায়, চিনতে পায়… এ যে তারই আত্মজ, তারই সত্তার প্রসূণ-পাদপ, সাঁঝবাতি উপন্যাসের সুদর্শন পুরুষ, যার পথ চেয়ে কেটে যায় প্রতিটি নারীর জীবন!

আমি আয়োলিতা নই। স্বভাবে, চরিত্রে, চিন্তায়, চেতনায় আমি একজন শুষ্ক রুক্ষ্ন পুরুষ কিন্তু এমন সুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি আয়োলিতা হয়ে যাই।

*****************************