কাক কথনে দীক্ষা
মেহনাজ মুস্তারিন
অনেকক্ষণ ধরে একটা শব্দ কানে আসছে। বুঝতে চেষ্টা করছি কী সেটা, কিসের শব্দ হতে পারে? এমন নানারকম ভাবনা ভর করছে মাথায়। কান খাড়া করে আছি। মনে হচ্ছে শক্ত পায়ে কেউ ধুপধাপ হাঁটছে, আবার মন বলছে সড়সড় শব্দে কেউ কিছু টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে রাশভারি কোন মিটিং চলছে, যেখানে বক্তারা বেশ গম্ভীর গলায় কথা বলছে, দিচ্ছে নানান দিক নির্দেশনা; যেন জাতীয় সংসদে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলছে। হঠাৎ মনে হলো ধারালো কোনকিছু দিয়ে ঘসঘস করে কেউ কিছু কাটছে। পরক্ষণে মনে হলো, না এটা আসলে কাটাকাটির শব্দ না। যাহোক, চিন্তার জগত ক্রমেই একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে; যেন কোন কূলকিনারা নাই তাদের। অনেক আগের কথা বলি যখন টিনের বাড়িতে বসবাস ছিল, একখানাই ঘর। পুরো বাড়ি নানা জাতের গাছে ঢাকা। বর্ষার সময় সারা বাড়ি ঝুপঝুপ, নিরবতা সবটুকু জুড়ে। গাছের ডালে ভেজা শরীরে জুজুথুবু বসে থাকতো কাক। কখনো রাতদুপুরে বাদুড় ডানা ঝাপটাতো। আর নানাবর্ণের পাখিদের আসা যাওয়া তো ছিলোই। সন্ধ্যা নামতেই বাড়িটা বেশ শুনশান মনে হতো। আমরা তাতেই অভ্যস্ত ছিলাম। ঠিক তখনও এমন ধরণের নানা আওয়াজ শুনতে পেতাম। অবচেতন মনে অনেক কিছু দেখতেও পেতাম। কখনো কখনো তা ভয়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। বয়স তখন কিই-বা! জীন, ভুত, পেত্নীর গল্প শুনতে শুনতে কেবল গায়েগতরে বড় হয়ে উঠছি। এখনকার মতো করে বোঝার বয়স হয়নি। পরে সেই শব্দের কারণ উদ্ধার করতাম ঠিকই, কিন্তু তার আগে হাতে বা কোমরে দু-একখানা তাবিজ পরানো হয়ে যেত।
নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে দরজায় একটু কোনা করে দাঁড়ালাম। চশমার কাঁচ মুছে নিতে ভুললাম না। উদ্ধার করতেই হবে কীসের শব্দ! আজ রহস্য উদঘাটনের নেশা পেয়ে বসেছে আমায়। ছাদের পূর্ব আর দক্ষিণে প্রকৃতিগতভাবে বেড়ে ওঠা দুটো কাঁঠাল গাছ। গাছ দু’টোর একগাদা ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে ছাদ আর রেলিং এর বেশখানিকটা জায়গা জুড়ে। ওরা দেহপল্লব এলিয়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে। গাছপালাগুলো আনন্দধারায় এপাশ ওপাশ দুলে হট্টগোলে নিজেদের মাতিয়ে রেখেছে। হঠাৎ নজরে এলো আনন্দে আত্মহারা হয়ে কিছু কাক পাতার ফাঁকে ফাঁকে একে অপরের সাথে লুকোচুরি খেলছে। চুপটি করে ওদের এই কোলাহল দেখতে বেশ লাগছে। ওদের গল্পগুলো যদি বুঝতে পারতাম দারুন হতো! একটা কাক বাইরে থেকে খাবার মুখে নিয়ে ফিরলো। আর সঙ্গে সঙ্গে বাকী কাকগুলো সেই খাবারের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলো। কোন হট্টগোল নাই, কী চমৎকারভাবে একে অপরের সাথে খাবার ভাগ করে নিচ্ছে তারা। আমি টুশব্দ না করে দেখছি, পরম মমতায় একটা কাক আরেকটা কাকের ঠোঁটে খাবার পুরে দিচ্ছে। খাবার শেষ হতেই উড়াল দিচ্ছে কেউ, আবার ফিরে আসছে ছন্দের মত। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সেই চমৎকার মুহুর্ত। টানাটানি, একা খেয়ে নেওয়ার প্রবণতা, লুকিয়ে রাখা, ‘আমি আনলাম সেটা আমার’, সে সবের কোন বালাই নাই। মিলেমিশে একে অপরের সাথে যেন কোন উৎসব পালন করছে, যেভাবে আমরা জন্মদিন পালন করি।
তাহলে কি আজ কাকের জন্মদিন? হতে পারে। পাখিকুলে বোধকরি কাক হচ্ছে সবচেয়ে অবহেলিত; অন্য পাখি তো বটেই, আমরা মানুষকুলও তাদের একদম গোনায় ধরি না। তো তারা যদি অবহেলার বঞ্চণা থেকে নিজেদের জন্মদিন পালন করে, তো অবাক হবো না। মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা তাদের জন্মদিন নিরবে চলে যেতে দেয়। ধরে নিলাম সে রকমই কিছু! কাককে অবহেলা করলেও আমাদের বাস্তসংস্থানে, পরিবেশ পরিশোধনে তার অবদান অপরিসীম। ওরা আমাদের ফেলে দেয়া আবর্জনা থেকে নোংরা খাবার টেনে-হেঁচড়ে খায়; মানুষের কাছে যা কিছু নোংড়া ও পরিতাজ্য সেটাই তাদের আহার্য। মানুষের উচ্ছিষ্টগুলো চমৎকারভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খাওয়া, পরষ্পরের হৃদ্যতা ধরে রাখা, সংঘবদ্ধতার মতো দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়গুলো আমাদের দেখার চোখ এড়িয়ে যায়। আপাতঃ দৃষ্টিতে কাককে নোংরা মনে হলেও বাড়তি মনোযোগে তাদের মধ্যে আলোকিত হওয়ার মতো অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কাকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যদি গভীরভাবে অনুভব করি তাহলে ওদের কর্কশ আওয়াজ একেবারে মন্দ লাগবে না। কাকের গলার কর্কশ শব্দ কি প্রতিবাদের ভাষা? হবে হয়তো। আমরা নিজেরাই যেখানে নিজেদের প্রতিবাদের ভাষা বুঝি না, সেখানে কাকের ভাষা! আমার মনে হয় সমস্যা আমাদের অভিজ্ঞানের মধ্যেই লুকানো। সংসারে যে বেশি কষ্ট করে, যে সকলের হাসিমুখ দেখার জন্য দিনরাত খেটে মরে, দিনশেষে দেখা যায় তাকে ঘিরে কোন আলোচনা নাই, তাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কেউ অপেক্ষা করা তো দূরের কথা, প্রয়োজনটাও বোধ করে না। মজার বিষয় এটাই যে, খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলে দিতে পারলেও মানুষ লোভ, লালসা, অহংকার, ঘৃনা, দলাদলি, কুসংস্কার আর অসততার মতো নেতিবাচক উচ্ছিষ্টগুলো ফেলে দেয়া তো দূরের কথা বরং এগুলো প্রতিনিয়ত লালন করে এবং সযত্নে ঢেকে রাখে। আর অনেকেই এসব নেতিবাচক দিকগুলো এড়িয়ে চলার যে চেষ্টা করেন তার বেশীর ভাগই অংলকার আর সাজসজ্জার প্রদর্শনের মহড়া তা বিলক্ষণ বুঝতে পারি।
আজ কাকের জন্মদিন, এই সিদ্ধান্তে অটল আমি গভীরভাবে তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। ওদের কারবার দেখতে দেখতে মনের মধ্যে এক আজব অনুভূতির জন্ম নিলো, যা একেবারেই নতুন। আমার মনে হলো খাবারের উচ্ছিষ্টগুলো হজম করার পাশাপাশি মানুষের বিবেকহীন আচরণ, লোভ, হিংসা, অহংকারের মতো কদর্য দিকগুলোও যদি ওরা গিলে নিতে পারতো তাহলে আমাদের বসবাসযোগ্য পরিবেশ কতই না নির্মল আর সজীব হয়ে উঠতো। আহ! কতই না ভালো হতো! ভাবতে ভাবতে আমি নির্বাক হয়ে যাই, আমার চাহনির দিকে যেন তাকিয়ে থাকে কাঁঠালগাছের পাতাগুলোও। ওরা দুলছে, এপাশ-ওপাশ দুলছে, আর পালন করছে কাকের জন্মদিন। দেয়ালে লেপ্টে থাকা কাঁঠাল গাছের শরীর ঘষা খাচ্ছে ইটের সাথে আর শব্দ হচ্ছে ঘস্ ঘস্ ঘস্। এভাবে একসময় আমি হারিয়ে যাই বহুবছর আগের আমার ছোট্ট বেলায়। ঠিক তখনও প্রকৃতি আমাকে নানা শব্দে বিভোর করে রাখতো আর আমি তৈরি করতাম শব্দের সম্ভার। বলতাম লোভ, লালসা, অহংকার, ঘৃনা, দলাদলি, কুসংস্কার, অধর্ম, মিথ্যা, প্রতিদ্বন্দীতা, স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারীতা, হিংসা, মৌলবাদ, অসততা নয়। বরং আমার বুকে বাসা বাঁধতো সত্য, সংঘবদ্ধতা, সহমর্মিতা, ত্যাগ, সমতা, ভালবাসা, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা, স্বার্থহীনতা, খোলামেলা সংস্কার, সার্বজনীন সংস্কৃতি, মানবিক ধর্ম, প্রগতিশীল রাজনীতি, প্রতিবাদ, সাহসিকতা, সচেতনতা, প্রগতিশীলতা, উদারতা, আত্মরক্ষা, বিবেক, সত্যিকারের প্রেম, বৈজ্ঞানিক জীবনবোধ ও সততার মত শব্দগুলো। যে শব্দগুলো আমাকে সততই ন্যায্য ও যৌক্তিক জীবনযাপনে তাড়িত করবে।
আমার মা আধুনিক মনের মানুষ। এটা কেবল কথার কথা নয়, কিংবা একান্তই সন্তান হিসেবে দাবি না। যারা তাঁকে চেনেন বা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা আমার সাথে ঐকমত্য পোষণ করবেন, কোন সন্দেহ নাই। মা বেড়ে উঠেছেন এমন এক পরিবেশে যেখানে আধুনিকতার কোন বিকল্প ছিল না। আমার মামা এবং কাছের আত্মীয়স্বজন সচেতনভাবে প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। সচেতন শব্দটা আমি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম, কারণ সেই সময় বামপন্থী গোপন সংগঠন করাটা কোন শখের বিষয় ছিল না। বাড়িতে চীনপন্থী বামধারার রাজনৈতিক কর্মীদের আসা-যাওয়া ছিল অবারিত। তখন ভারিভারি বই বাড়ির টেবিল, খাটের নিচে, সবখানে। সেগুলোর নাম উচ্চারণ করলেই বোঝা যেত কত শক্তিশালী ছিলেন মানুষগুলো। কার্লমার্ক্স, লেনিন, ম্যাক্সিম গোর্কি, মাও-সে-তুং ওরে বাবা এত ওজনদার সব নামের সাথে সেই ছোটবেলাতেই আমরা পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। তাদের জীবনযাপন এবং চিন্তাভাবনার গল্প শোনার জন্য নানান পেশার লোকজনের দেখা আমরা বাড়িতে বসেই পেতাম। মনে পড়ে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের কথা। মাসুম মামার সাথে আসতেন, তাই তিনিও মামা, মতিন মামা। গায়ে জীর্ন পোশাক, আর ঘাড়ে সবসময় ঝুলতো কাপড়ের তৈরী পুরনো একটা ব্যাগ, পায়ে চপ্পল তাও রং-চটা। মানুষটা যখন মাসুম মামার সাথে বাসায় আসতেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। চোখেমুখে সে কী দীপ্তি আর কী উজ্জ্বলতা তাঁর চাহনিতে। যখন কথা বলতেন, প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যে কী বিচক্ষণতা, কত জ্ঞান, কতকিছু জানতেন, বুঝতেন। আমরা দুই ভাইবোন হা করে তাকিয়ে থাকতাম তাঁর মুখের দিকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মতিন মামার অগ্রনী ভূমিকার কথা তখন জানতাম না। তবে আন্দোলনের প্রবল ঢেউ তাঁরা কীভাবে সামলেছিলেন সেগুলোর গল্প অল্পবিস্তর শুনেছিলাম। এটাও শুনেছিলাম যে, সেই আন্দোলনে নারীর ভূমিকা সমাজের পুরোনো স্থিরচিত্রকে বদলে দিয়েছিলো। কত ত্যাগ, কত মানবিকতা, কত অভিঘাতের মধ্য দিয়ে কেটেছিল সেই সময়। মতিন মামা রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি পেলেন অনেক বছর পরে। সবসময় যেমনটা দেখেছি, স্বীকৃতির পরেও তেমনটাই। তিনি নির্বাক, যেন-বা স্বীকৃতিতে তাঁর কিছুই যায়-আসে না। কত সাদামাটা ছিল তাঁর জীবন। অথচ এতটুকু আফসোস তাঁর কথায় ছিলো না। খুব অবাক লাগে কীভাবে এতটা নিবেদিত ছিলেন দেশ এবং জাতির জন্য। আমার খুব সৌভাগ্য যে, ছোটবেলাতেই এমন অনেক ব্যক্তির কাছাকাছি যাবার, তাদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছিল। আর সে জন্যই হয়তো প্রগতিশীল জীবনবোধ সম্পর্কে কিছুটা ধারনা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। সেইসাথে অন্তরে লালন করেতে পেরেছি কিছু বিশ্বাস। তাই ছোট্টবেলা থেকেই ভালো আর মন্দের তফাৎটা খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করতে শিখেছি। সংগত কারনেই আমার মা-ও এসব প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের কাজের সাথে পরিচিত ছিলেন, ক্ষেত্রে বিশেষে জড়িয়ে পড়েছিলেন, নানাভাবে এদের সহযোগীতা করেছেন। তবুও মা’র ভেতর কিছু কুসংস্কার দেখেছি ছোটবেলা থেকেই। এত কাছ থেকে সংগ্রামী মানুষগুলোকে দেখভাল করার পরেও আমার মা কেন আজব কিছু কুসংস্কার থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি সেটা নিয়ে মাঝেমধ্যে ভাবি। মা লেখালেখি করেন, এখনও নিয়মিত গান শোনেন, বই পড়েন, সামাজিক সেবামূলক বিষয়গুলোও আছে তাঁর আচরণে। নিজে শিক্ষক ছিলেন, হাজার হাজার শিশুর অন্তরে তিনি আলো জ্বালিয়েছেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সেটাই খুঁজে পাবার চেষ্টা করতাম, এখনও করি। কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া একটা গল্প বলি………
আমার ছেলে মর্ম’র পরীক্ষা। রান্না করেছি মুরগি, ডাল, ভাজি, ভর্তা আর সবজি। এরমধ্যে সবজিটা ছিল কচু দিয়ে। তাতেই মা’র আপত্তি! তাঁর কথা, পরীক্ষার দিনে কচু কেন? এর কী জবাব দেব বুঝতে পারিনি। তবে রক্ষা সেদিন ছেলে পরীক্ষা মন্দ দেয়নি। কচু নিয়ে মা’র মনে দুঃশ্চিন্তা একটাই, এটা খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে ফলাফল কচু পাবে। কচুর মন্দ কপাল, তা না হলে এত এত পুষ্টিগুন থাকার পরেও তাকে কেন মন্দের কাতারে ফেলা! কেবল কি কচু? কলা কিংবা ডিমের মতো পুষ্টিগুন সম্পন্ন খাবারের ভাগ্যও খারাপই বলতে হবে। কবে, কোনকালে কচু, কলা বা ডিম খেয়ে পরীক্ষা দেবার কারনেই কেউ ফলাফল খারাপ করেছে এটা নিশ্চিত বলা যাবে না। কিন্তু ওই যে তকমা এঁটে যাওয়া, সেটাই টিকে আছে। কারনে-অকারনে আমার শরীরে তাবিজ সেটে দেবার বিষয়টা বলেছি। আপনি যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন এগুলো একধরণের কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু না।
নানা ধরনের কুসংস্কার এই ডিজিটাল সময়েও সুন্দরভাবে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারছে, সেটা নিয়েই আমার ভাবনা ঘুরপাক খায়। তাহলে হচ্ছেটা কী! তবে কি আমরা এসব থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি? কুসংস্কারমুক্ত সমাজের স্বপ্নপথ কি এখনও সুদূর পরাহত? এখনও মাঝেমধ্যে যখন আগের যুগের নারীদের সাথে বর্তমানের তুলনা করি, দেখি সবদিক থেকে তাঁরা এসময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। কী সাহিত্য চর্চা, সামাজিকতা, কিংবা রাজনৈতিক সচেতনতা, সবকিছুতে তারা ছিলেন অগ্রগামী। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? ধর্মীয় গোড়ামী এবং ধর্মাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি এখন সবকিছুকে অতিক্রম করে গেছে। এযুগের মেয়েরা যে বেশি বেশি ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির চর্চা ও লালনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে এটা চোখে পড়ার মতো। পাঁচ বছর আগেও হিজাব, আধুনিক বোরখার দোকান চোখে পড়তো না, এখন সয়লাব। এর সাথে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, তাদের লুন্ঠনের জন্য মানুষকে ধর্মান্ধ করে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। ফলে আন্ত:ধর্ম তো বটেই অন্ত:ধর্মেও মৌলবাদ আঘাত হানছে। আর ক্রমাগত লাভবান হচ্ছে ধনীরা, পুঁজিপতিরা। সেটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সর্বক্ষেত্রে। অন্যদিকে কমে গেছে সামাজিক কাজ, সংঘবদ্ধতা, প্রতিবাদ, সাহসিকতা, সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহন, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, প্রগতিশীলতা, সর্বোপরী সততা।
আমরা দেখেছি ধর্মান্ধতা কীভাবে একটা জাতিকে বিছিন্ন ও সংকুচিত করে ফেলে, সকলক্ষেত্রে একটা জাতিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। বিশ্বমুসলিম, বিশ্বখৃষ্টান বা যেকোন বৈশ্বিক ধর্মীয় বন্ধনও পুঁজি আহরনের কাছে মার খাচ্ছে। তা হলে ধর্ম কী ? ধর্ম নিয়ে নানা মুণির নানা মত। আমি সেই বিতর্কে যাবো না। খুব সাধারণভাবে আমরা এটা জানি যে, মানুষ সামাজিক প্রাণী, সমাজবদ্ধতা মানুষের টিকে থাকার প্রধানতম অস্ত্র। একইসাথে মানুষের আছে কল্পনাশক্তি, যাকে কাজে লাগিয়ে অতিবাস্তব, বাস্তব, পরাবাস্তব, কিংবা অবাস্তব যেকোন ধরণের কল্পলোক তৈরী করা এবং সেই কল্পলোকের উপর হাজার হাজার মানুষকে বিশ্বাসী করে তোলার এক অসাধারণ গুন। সমাজবদ্ধতার প্রয়োজনে মানুষকে তার কয়েক হাজার বছরের পথযাত্রায় নানা ধরণের গল্প হাজির করতে হয়েছে এবং এরমধ্যে যে গল্পগুলোতে অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস রেখেছে সেটাই টিকে গেছে। কেবল টিকে থাকা না, সেই গল্পকে কেন্দ্র করে তারা সমাজ নির্মান ও সামাজিক কাঠামো ঠিক করেছে। এই অগ্রসরতার পথে আদিকালে মানুষ তার চাহিদাকে সমতার ভিত্তিতেই পূরণ করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে শারিরীক সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে নেতা-দলপতি তৈরী হয়েছে, তৈরী হয়েছে দল। এসবের পরিক্রমায় আজ বিশ্বের এই বিভাজন। এসব দলের ক্ষমতা, সম্পদ, প্রতিপত্তি ইত্যাদি প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করার জন্য এবং একই সাথে বৈশ্বিক সংঘর্ষ, হানাহানি এসবকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য এসেছে নানা মত ও পথ। আদিকাল থেকে পর্যায়ক্রমে তৈরী হয়েছে সমাজবদ্ধ জীবন, সামন্তপ্রথা, জমিদারি ব্যবস্থা, গির্জা-মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডা ইত্যাদি ধমীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যবস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্র। কিন্তু সাম্যবাদ বা সমতার সামাজিক কাঠামো মানুষ পায়নি, বরং সমাজতন্ত্র থেকে আবার পেছনের দিকে সবকিছু হাঁটা ধরেছে। মানুষের এই সামাজিক কাঠামোর পথ পরিক্রমায় যুদ্ধবিগ্রহ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সব সময়ই একটা বড় ভূমিকা রেখেছে।
এযুগে আমরা যাকে প্রজাতন্ত্র বলি এবং যা অর্জনের জন্য আমরা দিনের পর দিন সংগ্রাম করে যাচ্ছি সেটিও মানুষের কল্পলোকে তৈরী করা একটা সামাজিক কাঠামোর আধুনিকতম রূপ মাত্র, যা একটা নির্দিষ্ট ভূখন্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। অনুরূপভাবে ধর্মের কাজও মানুষের জন্য সামাজিক কাঠামো নির্মান করা এবং প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে এখন পর্যন্ত সেই কাজটি সে করে চলেছে। কিন্তু ধর্ম নামক কল্পলোকের সুবিধা হচ্ছে যে একে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের মত কোন ভূখন্ডের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় না। বৃহত্তর সমাজ নির্মানের জন্য মানুষের আকাঙ্খা পুরণে তাই ধর্মের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নাই। ঝামেলা বাঁধে যখন কোন একটি গল্প অপর গল্পগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তখন। মজার বিষয় হচ্ছে আধিপত্য বিস্তারের বেলায় পুরোনো আর নতুনের মধ্যে প্রায়শই মৌলিক কোন ফারাক দেখতে পাওয়া যায় না। দুটো ভিন্ন ধর্ম তো বটেই, একই ধর্মের বিভিন্ন দলের মধ্যে যে সংঘাত, তা বারবার রক্তাক্ত করেছে মানুষের সমাজবদ্ধতার ঐতিহ্যকে। একইভাবে হাল আমলের গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রের বহুমাত্রিক গল্পগুলোও যখন আধিপত্য বিস্তারে নামে, তখন মানুষই হয়ে ওঠে আক্রমনের লক্ষবস্তু। এমনকী শ্রেণিসংগ্রামের নামেও মানুষ খুন করা হয়েছে। মানুষকে খুন করতে হবে কেন? কারন, সে আমার গল্পে বিশ্বাসী না। কেউ বলছে তার গল্প ঈশ্বরের, কেউ বলছে তার গল্প বিজ্ঞানের, আর এসব বলে তারা খুনকে ন্যায্যতা দেবার চেষ্টা করছে। এই যে দেশে দেশে চলমান যুদ্ধ, তার পেছনেও আছে কল্পলোকের কোন গল্পের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের তাগিদ। কচু খেলে পরীক্ষা খারাপ করবে গল্পটা যতই ছোট হোক, তারও পেছনে কাজ করে সেই আধিপত্য বিস্তারের তাগিদ। তা না হলে পুষ্টিগুনের বাছবিচার নাই, কোনো সবজি হয়ে যায় জাতের আর কোনোটা অজাতের! এ হচ্ছে কবি নজরুলের ভাষায় ‘জাতের নামে বজ্জাতি’। অথচ এর বিপরীতটাই দেখতে পাই কাকের মধ্যে। অন্য প্রাণীর আক্রমন থেকে নিজেদের রক্ষায় হেন কাজ নাই যা দলবদ্ধভাবে করতে তারা দ্বিধা করে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আক্রমন ? উ-হু, কখনোই না। বোধকরি সারা বিশ্বের কাকের মধ্যেই কোন ভেদাভেদ, দ্বন্দ, ধনী-গরীব, জাত-পাত এসবের কোন বালাই নেই। বিশ্বের যেকোন এক প্রান্তের কাক অন্যপ্রান্তের কাকের বিপদে এগিয়ে আসে, নিজের খাবার-সম্পদ ভাগ করে নেয়। বিশ্বের কাকদের মধ্যে কোন বিভাজন নাই। এজন্যই তো বলে, ‘সর্বভূক কাকও কোন অবস্থাতেই অন্য কাকের মাংস খায় না, কিন্তু মানুষ তার চরিত্র হারালে প্রয়োজনে অন্য মানুষের মাংস খায়’।
আচ্ছা, কাকেদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে যে কবরস্থ করা হয়, এটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন? আমার নিজের দেখা একটা ঘটনা বলি। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমার কর্মস্থল ছিল গাছগাছালিতে ভরা একটা নিরিবিলি জায়গায়। পূর্বদিকে ছোট্ট একটা ঝিল আর তার পাশেই গোরস্তান, বেশ ফাঁকা ফাঁকা। বিভিন্ন মৌসুমে নানা প্রজাতির পাখি আনাগোনা করতো। মাঝেমধ্যে চমৎকার রঙের একদল বক এসে বসতো। প্রায়ই দেখতাম ঝিলে ওরা মাছ খুঁজছে। বাঁচার ইচ্ছে কার নাই? তবে সবচেয়ে বেশি আনাগোনা দেখতাম কাকের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওদের কা-কা শব্দে ভারি হয়ে থাকতো আমাদের অফিস। একসাথে অনেকগুলো কাক ডাকলে নাকি অমঙ্গল হয়, এমন কথা অনেকের মুখে শুনে বড় হয়েছি। একদিন ওদের ভীষণ ডাকাডাকি দেখে আমরা সকলে অস্থির, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। তো সেটা দেখার জন্য বের হলাম। দেখি ছোট্ট একটা কাক পড়ে আছে গাছের নিচে, নড়চড়া নাই। কার বাচ্চা, কখন থেকে মরে পড়ে আছে, কে জানে। ততক্ষণে অন্য কাকগুলো সজাগ হয়ে ডালেডালে ছুটাছুটি করতে শুরু করেছে। কেউ যেন মৃত কাকটাকে নিতে না পারে, সেজন্য সতর্কতার সাথে পাহারা দিচ্ছে। আমি দূর থেকে ওদের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছি। কিছুক্ষণ পরে দেখি একটা কাক নিচে নেমে এলো, আর মুহূর্তেই ছোঁ মেরে মরা কাকটাকে মুখে নিয়ে দিল এক ছুট। ওদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কেউ আছে যে এসব কাজে পারদর্শী, আর সেজন্যই বুঝি এত হাঁকডাক। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সেই ঘটনা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল অনেকদিন আগে মুছে যাওয়া এক স্মৃতিকে। ছোটবেলায় আমরা যে মাঠে খেলতাম প্রায়শই তার পাশে মৃত কাকদের এরকম মুখে করে আনতে দেখতাম। দেখতাম মৃত কাকদের ভীষন যত্নে মাটি চাপা দেয়ার কাজটি কী নিখুঁত ও মর্যাদার সাথে অন্য কাকরা করে। সেদিন ঠোঁটে করে যে মৃত কাককে ওরা নিয়ে গেল, নিশ্চয়ই তাকে পরম ভালোবাসায় মাটি দিয়ে থাকবে। আমার বিস্ময় যেন কাটছিল না। ভাবি এত ছোট্ট একটা প্রাণী, তাদেরও কী সুন্দর একটা মন। যেখানে আছে উদারতা, ত্যাগ, সংঘবদ্ধতা, বিবেক আর সত্যিকারের প্রেম। মানুষ আরো বেশি সংবেদনশীল প্রাণী। মৃত মানুষের অন্তিম যাত্রাকে মহিমান্বিত করতে আমরা কত কিছু করি। কিন্তু জীবিত মানুষগুলোর কেউ কেউ কেন নিজ স্বার্থে পরস্পরের মধ্যে এমন নির্দয় অমানুষিক আচরণ করে।
আত্মরক্ষা, সহমর্মিতা বা সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো মানবপ্রজাতির একচেটিয়া গুন নয়, এগুলো অন্যান্য প্রাণীকূলের মধ্যেও কমবেশি বিদ্যমান। কিন্তু অন্য প্রাণীতে যা দেখতে পাওয়া যায় না, তা হচ্ছে কল্পলোকে তৈরী কোন গল্প দিয়ে সমাজকাঠামো নির্মান। তাদের সমাজটা গড়ে উঠেছে বেঁচে থাকার জেনেটিক জেদ থেকে। সেজন্য তাদের সমাজটা তত বড় না। আর মানবপ্রজাতি তার সমাজটাকে বড় করতে গিয়ে কল্পলোকের গল্পে এতটাই বিশ্বাসী হয়ে ওঠে যে, ভালোবাসায় যেমন, তেমন হানাহানিতেও তাদের কোন ক্লান্তি আসে না। ভালোবাসার বিপরীতে হানাহানি কেন প্রবল হয়ে উঠছে, সেটাই জিজ্ঞাসা। কেন ভালোবাসা, পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মতো মানবিক গুনাবলির সংমিশ্রণে আমরা সমাজকে এগিয়ে নিতে পারছি না? কেন আমরা প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছি, কেন হারাচ্ছি আমাদের শান্তিপূর্ন সামাজিক সহাবস্থান? ভাবনা হয় আগামীর জন্য। চিন্তা হয় ক্রমশই বদলে যাওয়া এই সমাজ ব্যবস্থার জন্য, যেখানে কিছু মানুষ বড় একাকি হয়ে যাচ্ছে, কোনঠাসা হয়ে পড়ছে তাদের জীবন। সমাজে অবক্ষয় বাড়ছে, অনাচার বাড়ছে, বেড়ে যাচ্ছে কৃত্রিমতা। তবে আশার কথা মানবপ্রজাতি যেহেতু কল্পলোকের গল্পগুলোকে বাস্তবায়ন করতে পারে সে জন্য প্রয়োজনে তারা সহযোগীতা ও ভালোবাসার যে অফুরন্ত ভান্ডার তৈরী করতে পারবে, অন্য কোন প্রাণী সেটা পারে না। এজন্য বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে কল্যাণকর চিন্তার জগত প্রসারিত করলে হানাহানি কমে আসবে, কমবে প্রতিদ্বন্দিতা। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সম্পদ তৈরীর অবিরত ধারা অব্যাহত থাকবে। মানবিকবোধে উদ্বুদ্ধ হলে সকলেই তার উদ্বৃত্ত ভাগাভাগি করে নেবে, বিশ্বব্যাপি তৈরী হবে স্বর্গীয় পরিবেশ।
কুসংস্কারের কথায় একটু ফিরে যাই। আমার মা সেই সময়ের মানুষ, যেটিকে আমরা নারীজাগরণের সেরা সময় বলে জেনে এসেছি, কিন্তু এখনও তাঁর মধ্যে বসবাস করে আজব কিছু ভাবনা। মা’র কথা যখন ঘুরেফিরে আসছে, তখন তাঁকে নিয়ে একটু বিস্তারিত বলার লোভ সামলাতে পারছি না। মার ছোটবেলাটা ছিল অসম্ভব সংগ্রামের। বলা যায় পাঁচ বছর বয়স থেকেই মাতৃহারা। কারণ এই বয়সেই তাকে নিজ মায়ের আদর-সোহাগ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করে সৎমা-র হাতে সোপর্দ করা হয়েছিল। এত অল্প বয়সই নিজের মা থাকতেও তাঁকে বেড়ে উঠতে হয়েছিল সৎমা-র সংসারে। মুখ খুলে কিছু বলার উপায় তাঁর ছিল না, ছিল না কোন স্বাধীনতা। এমনকি শিশুদের পছন্দের খাবার বলে কিছু একটা যে থাকে, সেটিও তাঁর ছিল না। নানা ভুল তথ্য নিয়ে তাঁকে বড় হতে হয়েছিল। ভালো-মন্দের তফাত সেভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। ভালো হোক কি মন্দ, নানা কুসংস্কারের জালে জড়িয়ে ছোট করে ফেলা হয়েছিল তাঁর চিন্তার জগত। সখ-আহ্লাদের বালাই বলে কিছুই ছিল না। বাইরে যতই সাহসিকতার পরিচয় দিক, অন্তরের গহীনে নিজেকে লুকিয়ে রাখা একজন মানুষ আমার মা। বিয়ে করে স্বামীর সংসারে যে নতুন করে স্বপ্ন বুনবেন, সেই সুযোগটাও তাঁর মেলেনি। খুব অল্প বয়সেই বৈধব্য তাঁকে করে তুলেছিল এক বিমর্ষ মানুষ। সবমিলিয়ে অনেক বিষয়ে আধুনিক হলেও সমাজ-সংসারের বাস্তবতায় দু-একটি বিষয়ে তাঁর মনে কুসংস্কার বাসা বেঁধেছিল। তবে এটা ঠিক এসকল কুসংস্কার অন্যের জন্য ক্ষতিকর ছিল না, এগুলো ছিল নেহায়েতই তাঁর দূর্বল-অসহায় সংসারের নিরাপত্তার জন্য। হয়তো-বা তিনি এই দু-একটি বিষয়ের সুদূর পরাহত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না খুঁজে কাছে যা পেয়েছেন তাই আঁকড়ে ধরে এতিম বাচ্চা দুটোর কল্যানের কথা ভাবতেন। তাঁর ধ্যান জ্ঞান ছিলাম আমরা দুই ভাইবোন। যেকোনোভাবে আমাদের রক্ষা করার ব্যাকুলতায় তিনি আশ্রয় নিতেন তাবিজ বা পানি পড়ায়।
বাড়িতে তখন নানা ধরনের ফকির-মিশকিনের আনাগোনা। আমি কারো দাদিমা, কারো বা খালা। সারা মুল্লুক ঘোরাঘুরি করে পড়ন্ত দুপুরে তাঁরা আমাদের ছায়াঘেরা বাড়িতে আসতেন, জিরিয়ে নিতেন। সেই ফকির দাদু-দাদিরা যখন শুনতো আমি নানা শব্দের জালে আঁটকে গেছি তখন তাঁদের চোখেমুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠতো। কী করে সেসব শব্দের উৎপাত থেকে আমাকে রক্ষা করবে তা নিয়ে ছিল তাঁদের নানা জল্পনা-কল্পনা। দূর থেকে খেলার ছলে আমি তাদের সেই কথাবার্তা শুনতাম। তারপর গভীর স্নেহভরে খুব যত্ন করে তাঁরা ছোট্ট টিনের তাবিজ আমার হাতে বা কোমরে পরিয়ে দিয়ে বন্দী করে দিতে চাইতেন আমার চিন্তার জগত। আমিও বিনা শর্তে তা শরীরে জড়িয়ে নিতাম, সোহাগ আহ্লাদে যাই বলি না কেন। কিন্তু তাবিজের ভেতরে কী আছে তা দেখার অদম্য ইচ্ছা সারাক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত আমায়। তাই তারা চলে যাওয়া মাত্র চুপিচুপি সেটা খুলে ফেলতাম। দেখতাম পরম যত্নে খড়কুটো আর খুব পুরনো জীর্ণ হলুদ হয়ে যাওয়া কোন কাগজে আরবি অক্ষরে কিছু লেখা। সেটা কোনো সুরা নাকি হাদিস সে সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। সত্যি বলতে কি, আরবি বর্ণমালায় আমি বরাবর মৃত্যুর শব্দ শুনতে পেতাম। আমার জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার আগেই বাবার মৃত্যু এবং তাঁকে ঘিরে আরবী শব্দমালার আয়োজন হয়তো আমার শিশু মনে রেখাপাত করে থাকবে। তা না হলে নিরীহ আরবী শব্দে মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া কেন? তবে সেই তাবিজের ভেতরে অকারণে আমার চিন্তাচেতনার জগতকে বন্দী করার চেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছে তা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি। কিন্তু এতদিন পরে আজ আবার কেন ছোটবেলার এলোমেলো সেই শব্দগুলো অমন করে আমার পিছু নিয়েছে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি কোন জবাব খুঁজে পাই না। তাহলে কী আমি ফিরে গেছি অনেকটা পেছনে, সেই ছোট বেলায়! হবে হয়তো। কারণ ছোটবেলায় সমাজের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারতাম। তাবিজে বিশ্বাস অবৈজ্ঞানিক সেটা মানি, তবে আমার উপর এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব ছিল খুবই নগণ্য। এগুলো ছিল মূলত আমার প্রতি গরীব ফকির দাদু-দাদিদের ভালোবাসার একটা প্রকাশ। তবে সেই অল্পবয়সেও আমি এসব নগণ্য ক্ষতি মেনে নিতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু বড় হওয়ার পর যে ধরণের হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, পারষ্পরিক অবিশ্বাস, লোভ- লালসা, অহংকারের সাথে পরিচিত হয়ে চলেছি, তা আমাকে ব্যথিত করে। এর ক্ষতি যে কত ব্যাপক আর ভয়াবহ হতে পারে, তা ভাবলে শিউরে উঠি। তারপর যখন ছাদে এসে কাকের রাজ্যে ঢুকে তাদের আনন্দলোকের খোঁজ পাই, তখন মনে হয় মানবজাতি আসলে কোথায় চলেছে?