কল্পলোকে পাঠকক্ষ
মনজুরুল ইসলাম
আকস্মিক বন্যায় তৃষ্ণার্ত নদীর হাস্যোজ্জ্বল রূপ দেখে তৃপ্তি লাভের কোনো কারণ নেই। সেই স্বল্পায়ু হাসির অভ্যন্তরে দীর্ঘ সময়ের কষ্টকে গ্রহণের যন্ত্রণা ক্রিয়াশীল। এই যন্ত্রণা নদী যেমন অনুভব করতে পারে তেমনি তার প্রকৃত রূপটি প্রত্যক্ষ করতে পারে সবাই। সময়ের পরিক্রমায় তার পুরনো হতশ্রী রূপ দেখে প্রকৃতির পাশাপাশি কষ্ট পায় সাধারণ মানুষ। একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবন হতে পারে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতোই যদি তার শিক্ষা গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হয় শুধুই জীবিকা নির্বাহ। যেহেতু এমন শিক্ষার্থী ব্যক্তিজীবনে নানাবিধ সমস্যার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন সেই অপরিপক্ব শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে। সেই শিক্ষার মাধ্যমে জীবনকে উপলব্ধি করা হয়ে ওঠে তার জন্য সীমাহীন কষ্টের।
তাহলে কীভাবে অর্জিত শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী প্রাত্যহিক জীবনের সংকটগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে? পেশাগত জীবনে সকল সুবিধা নিশ্চিতির পরেও অস্থিতিশীল জীবনকে স্থিতিশীলতায় পরিণত করতে সক্ষম হবে? অবশ্যই সেই ধরনের শিক্ষা অর্জনে ব্রতী হওয়া যা শিক্ষার্থীর হৃদয়ে সৃষ্টি করবে অনুপম সরলতা, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবার ক্ষেত্রে জোগাবে অকৃত্রিম অনুপ্রেরণা। সন্দেহ নেই- সীমাহীন প্রচেষ্টার দ্বারা প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে অন্তর্নিহিত প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ, বিবেক এবং বোধের রশ্মিগুলোকে অতিমাত্রায় উদ্বোধিত করানো সম্ভব হলে আত্মজ তৃপ্তি অর্জিত হবে। পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর স্থিতিশীলতার প্রভাব পড়বে অনিবার্যভাবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ যে ব্যক্তিজীবনের সংকট মোকাবেলার মাধ্যম সেটি বিশ^াস করতে হবে। এটি করতে পারলে প্রাত্যহিক এবং জাতীয় জীবনে সকল সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়ে উঠা সহজ হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে Prevention is better than cure কথাটি বহুলভাবে প্রচলিত। এই কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর প্রয়োগ করা যায় এভাবে-একটি শ্রেণি থেকে আর একটি শ্রেণিতে শুধু উত্তীর্ণ হবার জন্য সার্টিফিকেট অর্জনের চাইতে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা গ্রহণ শ্রেয়তর। তাহলে একটু আগেই শিক্ষা গ্রহণের যে চিরন্তন উপযোগিতার কথা বলা হয়েছে সেটি অর্জন করা সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার জ্ঞান অর্জনের মাপকাঠিটি কী হবে? সেক্ষেত্রে জ্ঞান আহরণের বিষয়ে শিক্ষক কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা যদি সে শিক্ষার্থী আত্মস্থ করে থাকে তাহলে তার অনুত্তীর্ণ হবার প্রশ্নটিই আসবে না। অর্থাৎ শিক্ষার্থী যদি জ্ঞান আহরণের পথটিকে নিজে রুদ্ধ না করে তাহলে সে যতদূর সম্ভব জ্ঞানার্জনে সফলতা লাভ করবে। এবং যদি সেই শিক্ষার্থী এই সফলতাটুকু লাভ করতে পারে তাহলে ব্যক্তিজীবনের সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হবে। পরীক্ষায় ফেল করেও জ্ঞানার্জনের ধারাবাহিকতা অর্জনের মাধ্যমে জীবনে সুখ লাভে সক্ষম হবে।
এ প্রেক্ষিতে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনে শৈশবের দিকে ফিরতে হয়। যেহেতু একজন শিক্ষার্থী পাঠের ভুবনে বিচরণ করা শুরু করে শৈশবেই। বিদ্যালয়ে প্রবেশের পরপরই সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যায়। বিদ্যালয় এবং পরিবার থেকে গৃহীত শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে তার মূল্যবোধীয় গুণ অর্জিত হয়। শিক্ষার্থীদের মননে প্রকৃত শিক্ষার বীজ বপনে পিতামাতা এবং শিক্ষকবৃন্দের ভূমিকা যে অপরিহার্য- সেটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রত্যয়টিকে সহজবোধ্য করে তুলবার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় মাধ্যম হিসেবে পাঠদান এবং গ্রহণ প্রক্রিয়া যে অবশ্যম্ভাবী সেটিও স্বীকৃত হয়। তাই জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে পাঠদান ও গ্রহণের আদর্শ ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যে কোনো সভ্য জাতি বিনির্মাণের ক্ষেত্রে অনিবার্য শর্ত বলে বিবেচিত হয়।
নির্দিষ্টভাবে জ্ঞানার্জনের নির্ধারিত কোনো সীমা নেই। মানুষ যে কোনো পরিস্থিতিতে তার মননের জানালাটি উন্মুক্ত করবার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পথ সৃষ্টি করতে পারে। এটি করার কারণে জ্ঞান নামীয় বিশাল ব্রহ্মা-টি তার দৃষ্টিসীমায় আপনা থেকেই অফুটিত পাপড়ির মতো ডানা মেলতে থাকে। মনে রাখতে হবে, “জ্ঞান” নামের ধারণাটি কোনোভাবেই উচ্চ শ্রেণির নির্দিষ্ট কোনো পরিমন্ডল থেকে আহরিত হয় না। সব শ্রেণির মানুষই তাদের নৈমিত্তিক জীবন থেকে জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। সহজ কথায়, প্রকৃতির মাঝেই সকল জ্ঞানের অঙ্কুর অদৃশ্যমান থাকে। এই অঙ্কুরকে পল্লবায়িত করবার জন্য যদি জল সি ন করা যায় তাহলে যে পল্লবটি জন্মাবে তার শিরা-উপশিরা থেকে বিভিন্ন মাপের, বিভিন্ন চরিত্রের জ্ঞান সেই ব্যক্তিটি অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
তবে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা যে সর্বাধিক প্রতিষ্ঠানের ওপর গুরুত্ব দেই- সেই বিষয়ে সবাই একমত। আর ঠিক এখান থেকেই একটি ছন্দোবদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞানার্জনের রুদ্ধ দরজাটি উন্মুক্ত করার সুযোগটি পেয়ে থাকে। তখনই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মাঝে সাধারণত যে দূরত্ব দেখা দেয় সেটির অন্তর্ধান ঘটে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী একে অপরের কাছাকাছি আসবার একটি সেতুবন্ধ রচনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। উভয় পক্ষের অগ্রগামিতায় এই ধারাবাহিকতা শুধু শিক্ষার্থীকে নয় বরং শিক্ষককেও তার পাঠদানের ক্ষেত্রটিকে প্রাঞ্জল করে তুলতে অনুপ্রাণিত করে।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদান এবং গ্রহণ প্রক্রিয়ার আদর্শগত মানের ওপরই নির্ভর করে জাতীয় শিক্ষার মান। সেই মানের উৎকর্ষ নিশ্চিতে শিক্ষকবৃন্দই সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবেন এটিই স্বাভাবিক। প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলো আনন্দের মাধ্যমে পরিবেশনের দিকে মনোযোগী থাকবেন, সময়ের দিকে গুরুত্ব প্রদান করবেন বিশেষ সচেতনতায় সেটিও প্রত্যাশিত। যেহেতু একজন শিক্ষকের ০১ মিনিটের অবহেলায় নষ্ট হতে পারে ৫০, ১০০ কিম্বা ১৫০ শিক্ষার্থীর মূল্যবান সময় সেহেতু সময় ব্যবস্থাপনার ওপর সচেতন থেকে সময়ের পূর্ণ ব্যবহারে শিক্ষক উদ্যোগী হবেন সেটিই যৌক্তিক। সময়ের প্রতি শিক্ষকের পালিত সচেতনতা শিক্ষার্থীদের মননে অবচেতনভাবে সৃষ্টি করে সময়ের মূল্যের ওপর চিরন্তন উপযোগিতা। যেহেতু শ্রেণিকক্ষ একজন শিক্ষার্থীর কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হয় সেহেতু শিক্ষকেরও দায় হওয়া উচিত সেই সময়ের পূর্ণ ব্যবহার করা।
এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মনোযোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী দেরিতে ক্লাসে আসে, কারো মুঠোফোন অকস্মাৎ বেজে ওঠে। ফলে শিক্ষক হয়ত কোনো একটা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন, কাক্সিক্ষত কোনো বিষয়ের খুবই কাছাকাছি চলে গেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে এমন পরিস্থিতির অবতারণা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর কাছে যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে পরিগণিত হয়। উভয়েরই মনঃসংযোগকে ব্যাহত করে চরমভাবে। মোটের উপর, ক্লাসের পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয় এমন দু’একটি পরিস্থিতির কারণে। শিক্ষকের পক্ষে হয়ত কখনোই পূর্বোক্ত বিষয়ের আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে শ্রেণী আচরণ ও শিখন ফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মাঝেই সীমাহীন সম্ভাবনা অর্ধপ্রস্ফুটিত পুষ্পের মতো লুকিয়ে থাকে (Cognitive Knowledge)। শিক্ষকবৃন্দের এই উপলব্ধি জাতির ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক পর্যায় থেকে যথাযথ যত্নশীল হবার মাধ্যমে যে কোনো শিক্ষার্থীকে একটি অমূল্য রত্ন হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সেক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, উচুঁ নিচু অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যে পরিবেশ থেকেই আসুক না কেন, শ্রেণিকক্ষে তাদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন অনুচিত। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সকল শিক্ষার্থীর চেতনার বিনির্মাণে কাজ করবেন একজন শিক্ষক এটিই মুখ্য। এতে করে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের মাঝে দূরত্বটি হ্রাস পাবে। পাঠদান পদ্ধতিতে আসবে প্রাঞ্জলতা।
একটি ক্লাসে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষার্থীদের মনোনিবেশ করতে হয়। সেক্ষেত্রে ক্লাস প্রাঞ্জল না হলে পাঠ কখনই ফলপ্রসূ হয় না। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিডেনডর্ফ এবং অ্যালান ক্যালিকা তাদের গবেষণার ফলাফলে দেখতে পেয়েছেন-কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষে একটানা ১০ মিনিট মনোসংযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ১ সেক্ষেত্রে পাঠদানের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করলে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হবেন (Teacher as Facilitator)। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পঠিত বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের ভাবনা এবং জিজ্ঞাসা আহ্বানের মাধ্যমে তাদের মনোযোগের নিষ্ক্রিয় অবস্থাকে সক্রিয় অবস্থায় পরিবর্তন করতে পারবেন।
সঙ্গত কারণেই শিক্ষককে পাঠসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি তার চিন্তাপ্রবাহে স্থান দেবার মাধ্যমেই প্রস্তুত থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দুর্বলতাটি চিহ্নিত করে যখন একজন শিক্ষক পাঠদানে বিরাজিত থাকবেন তখন সেই শিক্ষার্থীও নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে আগ্রহী হবে। শিক্ষক তখন সহজেই উপলব্ধি করবেন-ঠিক কোন পরিস্থিতিতে পঠিত বিষয়ের বাইরে সময়ে সময়ে উপদেশাশ্রিত গল্প, বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ইতিহাস এবং দেশ ও বহির্বিশ্বের পাঠদান সংক্রান্ত বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। এবং অবশ্যই শিক্ষার্থীদের শখ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানবার মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে গড়ে তুলবার ইচ্ছেটি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন (Scaffolding Teaching)। অতঃপর মূল পাঠে ফিরে গিয়ে গভীর থেকে গভীরতর আলোচনায় ব্যাপৃত থাকলেও তা শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠবে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মাঝে অন্তর্নিহিত ইতিবাচক দিকগুলোকে ব্যাখ্যা করে যদি তার মধ্যে প্রবল উদ্দীপনা সৃষ্টি করা যায় তবে পেছনের সারির শিক্ষার্থী হলেও সে অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রকৃত শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে আগ্রহী হবে। শিক্ষকের আকাশছোঁয়া অনুপ্রেরণা এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা তাকে সবসময়ই শিক্ষকের বিষয়-সংশ্লিষ্ট নির্দেশাবলি পালনে মনোযোগী করে তুলবে (Teacher as Motivator)। ধরিত্রীর প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে থাকেন, এক্ষেত্রে তিনি ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থীই হোন অথবা পেছনের সারির। শিক্ষক যদি অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ত কথোপকথনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত স্বপ্নকে শিক্ষার্থীর মনোজগতে প্রবিষ্ট করাতে পারেন তবে অবশ্যই ওই ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হবে এক ধরনের দায়বদ্ধতা।
সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যদি ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সমস্যা বোধ করে তবে তার সমাধানে শিক্ষকের দরজা সবসময়ের জন্যই যে উন্মুক্ত-এ ধরনের একটি আত্মবিশ্বাস শিক্ষার্থীর ভেতরে আপনা আপনি জন্মলাভ করবে। তখন আক্রান্ত সমস্যাটি যেমনই হোক না কেন তার মননে সেই শিক্ষকের আদর্শ উজ্জ্বলতম হয়ে সেই সমস্যা মোকাবেলায় অগ্রগামী করে তুলবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি করা একজন শিক্ষকের জন্য হবে অনেক বড় অর্জন। ডরষষরহমযধস মনে করেন, ‘A teacher can be considered as success, whenever his students will be able to hone their thinking skill exponentially and solve problem. 2২ কিন্তু যে কোনো ক্লাসে যদি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না যায় তবে সেই ক্লাসটি কখনোই কার্যকরী ক্লাস বলে বিবেচিত হবে না। সম্পর্ক তো নয়ই।
পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন জাগিয়ে তুলবার প্রবণতা সৃষ্টি করা বাধ্যতামূলক। সেই উত্থিত প্রশ্নের সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার দরজা প্রতি মুহূর্তে খোলা রাখতে হবে। এমনকি সে প্রশ্নগুলো হতে পারে জীবন সম্পর্কিত, যার সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের কোন সম্পর্ক নেই। যদি কোনো ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে দোদুল্যমানতার সৃষ্টি হয় তাহলে শিক্ষার্থী পাঠ্যবই থেকে সাহায্য নিয়ে সমাধান করতে পারবে। অথবা বিষয়টি নিয়ে তার শিক্ষকের সাথে আলোচনা করতে পারবে (Teacher as Collaborator)। অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদেরকে সহজ প্রশ্ন করবার মাধ্যমে তাদের ভেতর ইতিবাচকতা সৃষ্টি কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণীয় হবে। একইভাবে মাঝারি এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধানী প্রশ্নের (Probing question) মাধ্যমে যে কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী বার বার উত্তর প্রদান করতে সক্ষম হচ্ছে, সেই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর অনুসন্ধানের বিষয়টিকে সকল শিক্ষার্থীদেরকেও পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত করবে -যার অর্থ দাঁড়াবে নিগূঢ় জ্ঞান অর্জনের সুযোগ লাভ।
এ প্রসঙ্গে সময়ের প্রশ্নটি একটি অনিবার্যতা। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয় বরং সকল প্রাণসমৃদ্ধ বস্তুর ক্ষেত্রে। একটি নির্দিষ্ট বয়সে ‘স্ন্দুর’ এবং ‘অসুন্দর’ উভয়ই সেই শিক্ষার্থীর মননকে তার অনুকূলে নেবার জন্যে সর্বোচ্চ প্রলোভনে প্রলোভিত করবার চেষ্টা করতে থাকে। এ সময়টিতে যদি শিক্ষার্থী সুন্দরের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে অসুন্দরকে আহ্বান জানায় তাহলে সেই অসুন্দরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীটি নিজের পরিণতিটিকে মর্মান্তিক করুণ অবস্থানে স্থাপন করবে। এখানে শিক্ষকের বিচক্ষণতা এবং দায়বদ্ধতা যদি সেই শিক্ষার্থীটিকে অসুন্দরের আহ্বানকে উপেক্ষা করে সুন্দরের বৃত্তে স্থাপিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেটি হবে সেই শিক্ষকের সর্বোচ্চ দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীটি আর সুন্দরের প্রতি কখনোই আকৃষ্ট হবে না, যার ফল হিসেবে দেখা যাবে শুধু সেই শিক্ষার্থীটিই নয় বরং অন্যান্য শিক্ষার্থীও তাকে অব্যাহতভাবে অনুসরণ করছে। কারণ অসুন্দরের প্রভাব যে মাত্রায় একজন তরুণের ভেতরে ভাবাবেগের সৃষ্টি করতে পারে সেদিক বিবেচনায় “সুন্দর” এত উগ্র হতে পারে না। এর অর্থটি দাঁড়াবে, ধীরে ধীরে একটি সমাজ, একটি শ্রেণি চূড়ান্ত অর্থে চরম ব্যর্থতার ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
প্রসঙ্গত এখানে যে দুটি বিষয় উদ্ধৃতিযোগ্য তাহলো-কৈশোর এবং তারুণ্য। দুটিই একটির অপরটির বিপরীত। আরও স্পষ্ট করে বললে -কৈশোরের শেষ এবং তারুণ্যের শুরু। অর্থাৎ কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পদার্পণের মুহূর্তটি একটি চরম ক্রান্তিকাল। এখন এই ক্রান্তিকালটিকে একজন কিশোর অথবা তরুণ শিক্ষার্থী কীভাবে গ্রহণ করবে-সে বিষয়টিই বিবেচিত হবে মৌলিক প্রশ্ন হিসেবে। আর এখানেই ঐ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটির যথাযথ উত্তর শিক্ষককেই প্রদান করতে হবে। যেহেতু অন্তঃসারশূন্য অসুন্দর সবসময়ের জন্যই বহিরঙ্গে চাকচিক্যময়-যা সুন্দরের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য। যে কারণে স্বাভাবিক নিয়মেই উদ্ধৃত শিক্ষার্থীরা চাকচিক্যের দিকে সাময়িকভাবে হলেও প্রলোভিত হবে ঐ ক্রান্তিকালে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই প্রলোভনের বৃত্ত থেকে সেই সব শিক্ষার্থীকে অসুন্দরের মোহাচ্ছন্নতা থেকে বের করে এনে সুন্দরের বেদীমূলে প্রতিষ্ঠা করবার দায়িত্বটি আপনা আপনি শিক্ষকের ওপর এসে বর্তায় ( Motivation for Transitional Crisis)।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকবৃন্দের বিষয়টিও আপনা আপনি চলে আসে। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাদান করবেন একটি নির্ধারিত শ্রেণিকক্ষের ভেতর থেকে। কিন্তু অভিভাবকবৃন্দ সেটি করতে পারবেন জীবনব্যাপী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ বিষয়ে শিক্ষক এবং অভিভাবকের মধ্যে সুসম্পর্কের সেতুবন্ধ রচিত হতে পারে ঐ শিক্ষার সূত্রটি ধরে-যা শুধু শিক্ষার্থীদেরকেই নয় বরং একই সঙ্গে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের জন্যে অবশ্যই একটি ত্রিমাত্রিক মঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসবে (Co-ordinating Method)।
এ বিষয়টিকে নির্মোহ ভাবনায় স্থাপিত করলে ‘অনুষঙ্গ’-এর বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষাদানের প্রয়োজনে শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা, সেই সংখ্যানুপাতে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হবে অবশ্য কর্তব্য। পাশাপাশি শীত, গ্রীষ্ম এবং বর্ষায় শ্রেণিকক্ষের ভেতরে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না করলে শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টিই দুর্বল হয়ে পড়বে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রশ্নটি যেহেতু দ্বিমাত্রিক সেহেতু শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীকে একে অপরের কাছাকাছি আসবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় (Reciprocal Teaching)। সেহেতু একজন শিক্ষক নিঃসংকোচে একজন শিক্ষার্থীকে অনুসন্ধিৎসু (Inquisitive) হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। এটি করলে শিক্ষার্থী নিশ্চিতভাবেই বিষয়ভুক্ত শিক্ষাকার্যক্রমের বাইরেও অন্যান্য বিষয়ের ওপরে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে পারঙ্গম হয়ে উঠবে ( Co-curricular Learning)।
এর ফলে সেই শিক্ষার্থীটিও সেই শিক্ষকের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে। সময়ের অনিবার্যতাকে অস্বীকার না করেই শিক্ষার্থীটি তখন নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক কোনো আলোচনা, বিষয়ের বাইরেও কোনো বক্তব্য প্রদান, কোনো অনুষ্ঠানে শিক্ষকবৃন্দের সারগর্ভ বক্তব্য, উপদেশাত্মক পরামর্শ শুনতে সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিতিকে নিশ্চিত করে তুলবে (Scaffolding Learning)। মূলত এখানেই শিক্ষার্থীটির ‘‘ধৈর্য”-এর বিষয়টি একটি বিশেষ ইতিবাচক মাত্রা হিসেবে শিক্ষার্থীটির মননে স্থায়ী আসন গড়ে তুলবে যা শিক্ষার্থীটির ভবিষ্যৎ জীবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি অসামান্য উপাদান হিসেবে কাজ করবে। তবে যে কোনো পর্যায়ের শিক্ষার্থী যদি মনে করে ভালো ফল অর্জনের ক্ষেত্রে প্রকৃত জীবনবোধ গঠনের নিমিত্তে উপদেশমূলক বক্তৃতা শ্রবণ অপ্রয়োজনীয়। এবং সেই উপলব্ধিকে যদি তারা প্রথম শর্তেই বাঞ্ছনীয় মনে করে বক্তৃতা প্রদানকালীন মুঠোফোনের বাটন টিপতেই ব্যস্ত থাকে অথবা বন্ধুরা মিলে অপ্রয়োজনীয় কথোপকথনে ব্যস্ত রয়ে যায় তবে তা হবে তাদের জন্য বড় ভুল । এবং এই ভুলের নেতিবাচক প্রভাব হবে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।
শিক্ষার্থীরা যে-কোনো বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না পেলে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে দুর্বলতা অনুভব করলে শিক্ষকবৃন্দের পাশ কাটিয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং যতক্ষণ কোনো শিক্ষার্থীর উক্ত বিষয়ে বোঝার আগ্রহ থাকবে ততক্ষণ তিনি বোঝানোর চেষ্টাটি অব্যাহত রাখবেন। অথবা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বুঝাবার পরও যদি তারা বুঝতে না পারে, তবে কেন বুঝছে না নাকি তিনি বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন এমন চিন্তায় আবৃত থাকবেন। শিক্ষকের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হবে শিক্ষকের প্রতি অনুপম শ্রদ্ধাবোধ। সংস্কৃতের পাঠ অপেক্ষাকৃত কঠিন মনে হওয়ায় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মহাত্মা গান্ধী যখন ফারসি ক্লাস শুরু করেছিলেন তখন তার স্কুল শিক্ষক কৃষ্ণশংকর ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। সংস্কৃত বিষয়টি পড়ানোর জন্য গান্ধীকে শিক্ষক হয়েও অনুরোধ করেছিলেন। এবং যথাযথভাবে বোঝাতে সাধ্যের সবটুকু উৎসর্গের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিশোর গান্ধী লজ্জা পেয়ে পুনরায় সংস্কৃত অধ্যয়ন শুরু করেছিলেন। শিক্ষক কৃষ্ণশংকরের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় সংস্কৃত ভাষায় পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলেন, যা তাঁর ভবিষ্যত জীবনে অধীত বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল।৩
অর্থাৎ এক প্রান্তে শিক্ষা প্রদান এবং অন্যপ্রান্তে শিক্ষা গ্রহণ। এ দু’য়ের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হলে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন সম্ভব (Reciprocal Learning)। লক্ষণীয় হলো, সুষ্ঠু পাঠদানের মাধ্যমে একজন শিক্ষকের আত্মবিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঠভীতি দূরীকরণের অকৃত্রিম প্রচেষ্টা। পাশাপাশি ওই শিক্ষার্থীর ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নেয়া। সেক্ষেত্রে একটি বিষয়ে সবাই একমত হবেন-প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হবে তখনই যখন প্রশ্ন উত্থাপন, সমস্যা বিশ্লেষণ এবং সমাধানের অভিপ্রায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী একই ভাবনায় মগ্ন থাকবেন,তাদের মধ্যে চিন্তার বিনিময় করবেন। এক্ষেত্রে তখনই constructivist learning environments তৈরি হবে যেখানে নতুন নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটবে।
এখন শিক্ষকবৃন্দ কর্তৃক পাঠদানকৃত বিষয়গুলোর ওপর কীভাবে প্রকৃত অর্থেই শিক্ষার্থীদের অনুধাবন (Realization) প্রক্রিয়ায় মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়? প্রথমত-পাঠ্যক্রমের (Lesson Plan) কতটুকু বিষয় পড়ানো হবে সেটি নির্ধারণ করা। দ্বিতীয়ত-সেই পঠিত বিষয়ে কতটুকু অংশ শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ে প্রস্তুতি নিয়ে আত্মস্থ করতে পারবে সেটিও নির্ধারণ করা। পাশাপাশি এককভাবে এবং দলীয়ভাবে নির্ধারিত পঠিত বিষয়ের ওপর উপস্থাপন ক্লাসের আয়োজন, বিশ্লেষণমূলক রচনা লিখন, বিতর্ক এবং সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে ধাঁধা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা (Scaffolding Learning)। অর্থাৎ শিক্ষকবৃন্দ পাঠদানের কাজটি সম্পন্ন করবার পর শিক্ষার্থী কতটুকু অনুধাবনে (জবধষরুধঃরড়হ) সক্ষম হলো সে লক্ষ্যে তাদেরকে ব্যক্তিগত এবং দলবদ্ধভাবে অধ্যয়নের পাশাপাশি তাদের চিন্তাশক্তির স্ফুরণ ঘটানোর চেষ্টা করা। শিক্ষার্থীরা যখন উক্ত বিষয়ে উপস্থাপনার জন্য শিক্ষককে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন করতে শুরু করবে তখনই এটি স্পষ্ট হবে যে- শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে কতদূর অগ্রগামী হয়েছে। শিক্ষককে অবশ্যই এ বিষয়গুলোতে পূর্বাপর সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। আর তখনই পাঠদানের মূল উদ্দেশ্য সহজেই চরিতার্থ হওয়ার সম্ভাবনাটি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হবে ভিন্ন ধরনের প্রবল উৎসাহ এবং উদ্দীপনা।
বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য শাখার শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সমস্যা শনাক্ত করে ক্লাসের মধ্যেই নির্দিষ্ট কিছু গ্রুপে ভাগ করে সমাধানের দায়িত্ব প্রদান সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে (Focus Group Discussion)। কোনোভাবে যদি কোনো দুর্বল শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিতি কিংবা সংকোচের কারণে উপস্থাপনা করতে ব্যর্থ হয় তবে অবশ্যম্ভাবীরূপে পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে পরবর্তী পর্যায়ে সবার আগেই উপস্থাপনে উদগ্রীব হয়ে উঠবে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীটির সংকোচের মাত্রাটি তখন হ্রাস পাবে। বিপরীত চিত্রটি ফুটে উঠলে শিক্ষার্থীদের চেতনাবোধ এবং চিন্তার স্রোত বটবৃক্ষের মতো বর্ধিত না হয়ে বনসাইয়ের মতো কুক্ষিগত হবে। পল্লবগ্রাহী হয়ে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো অতিক্রম করে যেমন রাষ্ট্রীয় বোঝা হিসেবে স্বীকৃত হবে, তেমনি ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে তাদের পরিবারের।
উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সহায়তা নেয়া যেতে পারে যদি সেই ধরনের সুবিধা এবং সক্ষমতা শিক্ষার্থী এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা কিংবা উপস্থাপনার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ধারণা অর্জন এবং উপস্থাপন করা সম্ভব হয় সহজভাবে। উদাহরণস্বরূপ জাতীয় সংসদ কিংবা কোনো ফুল যদি পঠিত বিষয় হয় তবে তার চিত্র উপস্থাপিত হলে সন্দেহাতীতভাবে ধারণা স্বচ্ছ হবে। যেহেতু মূল বিষয়গুলো চিত্র এবং পয়েন্ট আকারে প্রদর্শিত ও নির্দেশিত হবে। আবার মাঝে মাঝে পঠিত বিষয়গুলো যেমন নদী, গাছ, প্রাণীর বাস্তব দৃশ্য যদি শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তবে সেই বিষয়ে শিক্ষার্থী অর্জন করতে পারবে প্রকৃত জ্ঞান। এবং তার মননে আপনা আপনি এক ধরনের ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদের আভ্যন্তরীণ গুরুত্ব উদ্ধার করতে (Connective Learning)। ১৯৯০ সালের পূর্বে সে অর্থে পাঠকক্ষগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না। পাঠ সীমাবদ্ধ ছিলো শুধুমাত্র ফেস টু ফেস পদ্ধতির মধ্যেই। মূলত ১৯৯০ এর দশকের পর শ্রেণিকক্ষে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ের উপর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পাঠ পদ্ধতিকে প্রাঞ্জল ও যুগোপযোগী করবার উদ্দেশ্যে উন্নত দেশের শ্রেণিকক্ষে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল, প্রজেক্টরসহ অন্যান্য উপকরণ বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।৪ ২০১৭ সালে আমেরিকার শিক্ষা বিভাগ শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলে, The application of technology in
teaching can reinvent the approaches of learning to meet up the demand of the students .৫ তার মানে আবার এই নয় যে, তারা গতানুগতিক (Traditional Method) পদ্ধতিকে এড়িয়ে গেছে। সমন্বয়ের (Blended Method) মধ্য দিয়ে পাঠদানকে যুগোপযোগী করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
সে কারণেই প্রজেক্টর ব্যতীত ক্লাসগুলোতে আলোচনাকে প্রাসঙ্গিকভাবে বিস্তৃত আকারে বর্ণনা করা হবে অত্যন্ত কার্যকরী। যখন ইন্টারনেটের এত ব্যাপক প্রচলন ছিল না তখন শিক্ষকবৃন্দ তাদের অর্জিত প্রজ্ঞার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভাবনার অতল গহ্বরে নিয়ে যেতেন (Core Learning)। একটি বিষয়কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের যোগ্যতা রাখতেন। তবে সব শিক্ষকই যে এই ভাবে পাঠদান করতে পারবেন সেটি প্রত্যাশা করা মোটেও সমীচীন নয়। তবে আমরা যদি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের প্রাজ্ঞ শিক্ষককে চিহ্নিত করে যথার্থভাবে তার কাছ থেকে জ্ঞানের সিকি পরিমাণ অংশও অর্জন করতে পারি তবে সেটি হবে শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত প্রাপ্যতা। কারণ জ্ঞানভিত্তিক পরিবেশনায় ( Knowledge Based Learning) শিক্ষার্থীরা প্রচ-ভাবে তাড়িত হবার পাশাপাশি প্রলুব্ধ হয়ে থাকে। এবং ভবিষ্যতে সেই অর্জিত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রকে সততার সাথে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
কোনো শিক্ষক যদি শ্রেণিকক্ষে কোনো শিক্ষার্থীর হৃদয়ে নবজীবনের স্ফুরণ ঘটাতে আগ্রহী হন, জীবনের গতি পরিবর্তনের চেষ্টায় একাগ্র থাকেন তবে তা তখনই সম্ভব হবে যখন তিনি সংগ্রামী, সাহসী এবং সফল ব্যক্তিদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যক্ত করবেন। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠিত জাতির গৌরবোজ্জ্বল সাংগ্রামিক ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে যখন সমর্থ হবেন তখন আপনা আপনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজ জাতির উন্নয়নের আকাঙ্খা জাগ্রত হবে (Inspirational Teaching)। অস্ট্রিয়ান শিক্ষক ড. লিওপোল্ড পোয়েটিস লিনৎজ স্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের এমনভাবে পাঠদান করতেন যাতে শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়েই বর্তমানকে ভুলে হাজার বছর পেছনের এক ধূসর অতীতে চলে যেত। উপমার পর উপমা প্রদান করে অস্ট্রিয়া, হাবর্সবুজর্গসহ বিশ্ব ইতিহাসের করুণ অধ্যায়গুলো এমনভাবে বর্ণনা করতেন, শ্রেণিকক্ষের সকল শিক্ষার্থী তাদের অশ্রু সম্বরণ করতে ব্যর্থ হতো। এ কারণেই হয়ত হিটলারের মতো একজন অতি সাধারণ শিক্ষার্থী তার মননে বিশ্ববিশ্রুত নেতা হিসেবে বেড়ে উঠার দৃঢ়তা ধারণ করতে পেরেছিল।৬ ইতিহাসভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের প্রবল ইচ্ছে তার অন্তঃকরণজুড়ে প্রবলভাবে অধিকার করেছিল বলেই শিক্ষকের কাছাকাছি থেকে জ্ঞানের অমিয় সুধা পান করে নিজেকে ঋদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিল। শিক্ষক লিওপোল্ডের পাঠ প্রভাব পরবর্তী কালে তার সার্বিক কর্মকা-ে প্রক্ষেপিত হয়েছে যা এডলফ হিটলারকে একজন ধ্রুপদী নেতা হিসেবে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে – এটি অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। হিটলার নিজেও সেটি তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করে গেছেন অকপটে। যদিও হিটলার যে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন সেই শিক্ষার আদর্শের উজ্জ্বলতায় শেষ পর্যন্ত তিনি উজ্জ্বল থাকতে পারেন নি। তার অতি-জাতীয়তাবাদ তার এই শিক্ষার ঔজ্জ্বল্যকে কখনো কখনো ম্লান করে দেবার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে তিনি ইহুদি জাতিকে নির্মূল করবার জন্যে লক্ষ লক্ষ সাধারণ ইহুদিকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। জার্মান জাতিসত্তার বাইরে কোনো জাতির অস্তিত্বকেই তিনি স্বীকার করতে চান নি-এখানেই হিটলারের সকল অর্জনের সমাপ্তি ঘটেছে। অথচ এডলফ হিটলার নিজেই জার্মান বংশোদ্ভুত ছিলেন না।
কিন্তু, শিক্ষক যদি একতরফাভাবে কেবল প্রেষণা প্রদান ( Motivational learning) এবং পুঁথিগত উপদেশ (Advice based learning) প্রদানের মাধ্যমে শ্রেণি পরিচালনা করেন তবে তা কখনোই সাফল্যের মাত্রাকে স্পর্শ করবে না। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ শিক্ষকের আগ্রহকে যাতে প্রলুব্ধ করতে পারে সে বিষয়টির দিকেও শিক্ষককে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। কারণ একজন সফল শিক্ষার্থী হিসেবে কাউকে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটি শিক্ষককেই পালন করতে হবে (Teacher Leader)। এটি করতে পারলেই শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হবে। এবং উভয়ই প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের দিকে ধাবিত হতে থাকবে। শিক্ষক তখন মানসিক তৃপ্তি নিয়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ এবং মূল্যবোধহীন মানুষের জীবনের মধ্যে যে চিরন্তন পার্থক্য সেটি বোঝাতে সক্ষম হবেন। এবং উভয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিদের পরিণতি যুক্তিগ্রাহ্য করে ব্যাখ্যা করবেন অকপটে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মননে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হবার আকাক্সক্ষা তীব্রভাবে তেজোদ্দীপ্ত হবে। ভবিষ্যতে দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে জাতীয় সম্পদের অপচয় ও রক্ষার জন্য নিজেদের তৈরি করবে- যেটি হবে জাতির প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার একটি চৌম্বকীয় দৃষ্টান্ত। তাদের সামনে যত সুযোগই আসুক না কেন জাতীয় স্বার্থের কাছে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থগুলো পরিত্যাগ করবেন সেই শিক্ষকের প্রতিমূর্তি স্মরণ করে।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রেণিকক্ষের আধুনিকায়ন যেমন জরুরি তেমনি বোধের জাগরণের জন্যে প্রকৃতির সান্নিধ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে শুধু প্রকৃতির সান্নিধ্যই নয় বরং প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে লীন করে দিয়ে প্রকৃতির কাছ থেকেই বিপুল বিচিত্র জ্ঞানকে বোধায়ত্ত করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে জরুরি। বহির্বিশ্বের কথায় এসেও যদি আমরা আমাদের নিজেদের দেশের প্রকৃতির লীলাভূমি রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, বৃহত্তর সিলেট ও সমতলীয় মফস্বল শহরগুলোতে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে বি¯তীর্ণ খোলা মাঠ এবং পেছনে বেড়ে ওঠা আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া পাহাড়ের বিশালতার দিকে দৃষ্টি প্রক্ষিপ্ত করি তাহলে অবশ্যই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো যে, সেই নির্মল প্রকৃতি শিক্ষার্থীদের অন্তর্জগতে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে (Natural Learning)। কিন্তু, শহরের উঁচু দালানের মাঝে স্বল্প সীমায়তি জুড়ে অবস্থিত বিদ্যানিকেতনগুলোয় শিক্ষার্থীরা কীভাবে সেই নির্মল প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবে? সে বিষয়টিও ভাবনার দুয়ারে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরী। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে বিশালতা সৃষ্টিকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিক্ষাবান্ধব করতে না পারি তবে তা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে বিশালতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সৃষ্টি করবে এক বিশাল প্রতিবন্ধকতার।
প্রতিষ্ঠানের মানভেদে ক্লাসের পদ্ধতি পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভালো প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষায় কিংবা তুলনামূলক জটিলভাবে ক্লাস পরিচালনা করলেও শিক্ষার্থীরা তা সাবলীলভাবে অনুধাবনে সক্ষম হয়। এর কারণ তাদের মৌলিক জ্ঞানের ভিত্তি শুরু থেকেই অনেক সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু, দুর্বল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্রটি বিপরীত হতে পারে। বিদেশি ভাষায় পাঠদানের মূল বিষয় অনুধাবন তো দূরের কথা, প্রমিত বাংলা ভাষায় সমস্যা হয়ে থাকে প্রকট আকারে। এক্ষেত্রে প্রাজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দকে সেই সকল শিক্ষার্থীদের ধারণ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে পাঠদান চালিয়ে যাওয়া হবে যুক্তিযুক্ত। অনর্থকভাবে নিজের বিদ্যা জাহিরের জন্য জটিলভাবে পাঠদান হবে শুধুই সময়ের অপচয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই কেন্দ্রিক অধ্যয়নে আগ্রহী করে তোলেন তবে সেই সময়ের জন্য সেটিই হবে যথোচিত। পড়াশুনার ভেতরেই মানসিক আনন্দ এবং জীবন গঠনের মূল বীজ নিহিত। এবং সেই বীজটি নিজের মধ্যে বপনের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে নিজের জোরালো ভূমিকাটির গুরুত্ব বোঝাতে পারলে শিক্ষার্থীরা স্ব-প্রণোদিত হয়ে পাঠ গ্রহণে ইচ্ছুক হবে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্বের অবহেলিত দেশগুলোর নিপীড়নের চিত্র এবং উন্নত দেশের উন্নয়ন চিত্র তাদের সামনে উপস্থাপন করে তাদের চেতনাবোধকে জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সীমানার ফ্রেমে অঙ্কন করতে পারলে তারা শিক্ষার্থীদেরকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়াস পাবেন। এভাবেই নেতৃত্ব প্রদানের স্বভাবজ প্রবৃত্তি যখন তাদের পেয়ে বসবে তখন আপনা আপনি নিজ দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। তবে প্রতিষ্ঠান ভেদে শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননশীলতার মধ্যে পার্থক্য যতটুকুই থাক না কেন, সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যাতে ন্যূনতম আদর্শিক মাত্রায় উপনীত হতে পারে সেই মাত্রায় পৌঁছে দেওয়া রাষ্ট্র এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সকলেরই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভবিষ্যৎ প্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানগত পার্থক্য যেন অধিক না হয় সেদিকটির প্রতি গুরুত্ব রাখাও অপরিহার্য হয়ে উঠবে ভবিষ্যত উন্নয়নেরই জন্য।
বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের শ্রেণিকক্ষগুলোতে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের অনুপাত উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। প্রকৃত এই সত্যটি মেনে নিয়ে যতদিন এই সংখ্যার মাত্রাটি আদর্শিক পর্যায়ে উন্নীত হবে না ততদিন পর্যন্ত নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে শিক্ষকবৃন্দকেই। ধরে নেয়া যাক, শ্রেণিকক্ষে ৬০ জন শিক্ষার্থী, সেক্ষেত্রে দ্বৈতভাবে সকল শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তর পর্ব রাখলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে। অথবা প্রতিটি আলাদা ক্লাসে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় অনুশীলনের মাধ্যমে পাঠদানের গতি সচল রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষক মহোদয় চাপে নুয়ে পড়ে যেতে পারেন। তাই ব্যক্তিগত অনুশীলন প্রদানের মাধ্যমে চাপ কমাবার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকতায় বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করানো যেতে পারে। তবে যত চাপই অনুভূত হোক না কেন, ক্লাসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি আনুবীক্ষণিক দৃষ্টি স্থাপন করে তাদের গুণগত মানের উন্নয়নের নিমিত্তে উজাড় করবার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়া জরুরি- যখনই কোনো শিক্ষক পাঠদানের উদ্দেশ্য শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করবেন। সেক্ষেত্রে শিক্ষকবৃন্দ যদি সেই চাপটিকে গ্রহণ করতে অপরাগ হন তবে সেটিকে ব্যর্থতা বলাটাও বোধ করি সমীচীন হবে না। যেহেতু শিক্ষকরা পাঠ প্রদানের সকল সুবিধা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাপ্ত হন না। সেই প্রেক্ষিতটিকে বিবেচনায় নিয়ে Lecture Method এ পরিচালিত ক্লাসটি যাতে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে সেটি নিশ্চিত করা হবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে-এই Lecture Method ভিত্তিক পাঠদান দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের আগ্রহকে ধরে রাখতে সক্ষম হয় না।
এক্ষেত্রে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর ওপর আস্থা অর্জনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই আস্থা অর্জনে সক্ষমতা অর্জন করবেন তখন শিক্ষক কর্তৃক গৃহীত সকল শিখন পদক্ষেপই শিক্ষার্থীরা আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করবে। এমনকি শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর প্রতি কোনো আচরণ, পরামর্শ তাৎক্ষণিকভাবে পছন্দ না হলেও শিক্ষার্থীরা আস্থার জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসবে না। এরই মাধ্যমে শিক্ষকের দায়বদ্ধতা আরো দ্বিগুণ আকারে বৃদ্ধি পাবে। তিনি তার পাঠ্যসূচি কিংবা প্রক্রিয়াটি স্পষ্টভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে অবগত করবার প্রয়াস পাবেন যাতে তার প্রতি শিক্ষার্থীদের অর্জিত আস্থা পুরোপুরি অক্ষুণœ থেকে যায়। কিন্তু কোনোভাবেই যদি “স্যার, আজ কি ক্লাস হবে, ক্লাস কি দেরিতে হবে, ক্লাস নেবেন কি”- এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সামনে শিক্ষার্থীদের সম্মুখীন হতে হয় তবে তা হবে শিক্ষার্থীদের জন্য চরম দুর্ভোগের। এ ধরনের প্রশ্নের দরজা যেন শিক্ষার্থীদের কাছে চিরদিনের জন্য অবরুদ্ধ থাকে, সে ব্যবস্থা অবশ্যই শিক্ষকবৃন্দ তাদের কর্ম ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে প্রমাণ করবার চেষ্টায় রত থাকবেন। কারণ আমরা সবাই খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি- ভঙ্গুর গ্লাসের টুকরো দিয়ে কখনোই পূর্বের আদলে একটি নতুন গ্লাস তৈরি করা সম্ভব নয়। স্পষ্টতই শিক্ষক কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রতিনিয়ত যদি ব্যর্থতার চিত্রটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তবে নিশ্চিতভাবেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ওপর আস্থা খুঁজে পাবে না কিংবা কাক্সিক্ষত অর্জনের জন্য বিন্দুমাত্র উৎসাহ বোধ করবে না। শিক্ষার্থীদের কোমল হৃদয়ে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেই শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।
এই ক্ষেত্রে শিক্ষকবৃন্দ হয়ত শ্রেণিকক্ষে প্রকৃত শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হয়ে শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে শাস্তি প্রদানের মতো বিপজ্জনক কাজটির আশ্রয় গ্রহণ করতে উদ্যত হবেন। তিনি তার পারিপার্শি¦ক নেতিবাচক অবস্থার প্রতিফলন নিষ্পাপ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে প্রদর্শন করতে থাকবেন। তিনি ক্রমান্বয়িকভাবে ভুলে যেতে থাকবেন-একজন শ্রদ্ধেয় কুমোর, স্বর্ণকার, রাজমিস্ত্রী কিংবা নির্মাণকর্মী যেভাবে ধৈর্য নিয়ে তাদের সৃষ্টিটিকে সকলের কাছে দৃষ্টিনন্দন করে তোলেন ঠিক একইভাবে একজন শিক্ষক অসীম ধৈর্যের পাশাপাশি সীমাহীন ভালোবাসা নিয়ে জাতিকে একজন প্রকৃত মানুষ উপহার দেয়ার মহান কাজটি করে থাকেন। শ্রেণিকক্ষকে আমরা যদি বাগানের সঙ্গে তুলনা করবার চেষ্টা করি খুব সহজেই উপলব্ধির দুয়ারে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে – কত পরম মমতায় একজন মালি পরিচর্যার মাধ্যমে বাগানকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে তোলেন, বৃদ্ধি করেন পৃথিবীর সৌন্দর্য। বাগানের মালির মতো একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কি শ্রেণিকক্ষে পাঠরত প্রতিটি কুমুদকলিকে প্রস্ফুটিত করে তোলেন না? কত সুন্দরভাবে নির্মল প্রতিমূর্তি গড়ে তোলেন শিক্ষকবৃন্দ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মননে। আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা বিনিময়ের মাধ্যমেই কেবল শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত নিষ্পাপ অনুভূতিতে রেখাপাত করা সম্ভব। কিন্তু, আমরা যতই কোনো শিক্ষার্থীকে ভীতি প্রদর্শন,শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করতে উদ্যত হবো ততই শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণে নিরুৎসাহিত হবে।
এ ক্ষেত্রে ফল দাঁড়াবে, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণে যে নির্মোহ আনন্দ সেটি অনুভব করতে পারবে না। কিন্তু শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে যে-কেনো পর্যায়ে এমনভাবে পাঠ পরিবেশন করা-যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু জ্ঞান লাভের আনন্দ খুঁজতেই শ্রেণিকক্ষে ভিড় করে। এটি শুরু করতে হবে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়েই। এই পর্যায়ে যদি মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরি করা না যায় তবে উচ্চ পর্যায়ে যতই উন্নতভাবে পাঠ পরিবেশনের চেষ্টা করা হোক না কেন, শিক্ষার্থীরাও যেমন সেই পাঠ গ্রহণ করতে পারবে না তেমনি শিক্ষকদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে শিক্ষার্থীদের গুণগত মান এবং মানসিক উন্নয়ন ঘটানো। তাই সেই ধরনের পাঠ দান করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা এই ধারণা অর্জন করে প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয় যে-অধ্যয়ন একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া ( Life Long Learning)। জীবন যতই পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে পাঠাভ্যাসও সেই গতিতেই পরিপূর্ণ হতে থাকবে। শিক্ষাবিজ্ঞানী পেসটালটসি, মার্টিন লুথার, মন্তেসরি, রবীন্দ্রনাথ এবং বার্ট্রান্ড রাসেল সহ বিশ্ববিশ্রুত শিক্ষাবিজ্ঞানীগণ শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদানের বিপক্ষে তাদের সুচিন্তিত যুক্তি এবং ব্যাখ্যা প্রদান করে গেছেন।৭
মার্কিন সাহিত্যিক হেনরি ডেভিড থরো ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে পাবলিক গ্রামার স্কুলে শিক্ষকতাকালীন শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত দমনের পক্ষে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।৮ তাঁর মননে শিক্ষা প্রত্যয়টিকে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে আনন্দদায়ক হিসেবে উপস্থাপনে একটি দৃঢ় প্রত্যয় সচলমান ছিল। কিন্তু, তাঁর প্রবল আপত্তির মুখেও যখন প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাতের মতো নিবর্তনমূলক প্রথাটি চালু রেখেছিলেন তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু যার ভেতর প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের অকৃত্রিম আগ্রহ বিরামহীনভাবে ক্রিয়াশীল তিনি কি শিক্ষকতা ছাড়া থাকতে পারেন? চাকরি ছাড়ার পরবর্তী বছরেই থরো তাঁর ভাইকে নিয়ে আদর্শ বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় চালু করেছিলেন। সেই বিদ্যালয়ে থরো তাঁর শিক্ষা চেতনার পুরোপুরি প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। খোলামনে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে নিবিড় সম্পর্কের সেতু স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। যেহেতু তিনি স্থিরভাবে বিশ্বাস করতেন-এই নেতিবাচক উপায়ে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
সুতরাং শাস্তি কিংবা ভীতি প্রদানের আদলে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবার এই নীরস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে কর্মসংস্থান লাভের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই পড়াশুনার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানবেন শিক্ষার্থীরা। সেক্ষেত্রে অধ্যয়নকে জীবন গঠনের মূল বিষয় হিসেবে অন্তর্জগতে ঠাঁই না দিয়ে জীবন যাপনের মূল প্রপ হিসেবে গড়ে তুলবেন।
অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক থেকে শুরু কওে অভিভাবক পর্যন্ত ঠুনকো বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অপবাদ দিতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা যদি দৃষ্টিনন্দন না হয় তবে তার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। এমনটি করলে সেটি শিক্ষার্থীদের মননে গভীরভাবে নেতিবাচক প্রভাব জেগে উঠবে। বরং এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে সরাসরি না বলে শিক্ষক যদি নিজেই একটি বর্ণ লিখবার পর শিক্ষার্থীকে বলে, বর্ণটি কেমন হলো কিংবা এভাবে লিখলে কেমন হয় তবে সেটিই হবে বিজ্ঞতার পরিচায়ক। মোটা দাগে বললে, যে কোনো বয়সের শিক্ষার্থীকে যে কোনো পর্যায়েই তার দুর্বলতার ওপর সরাসরি আঘাত করা কখনোই সমীচীন হবে না। এতে করে শিক্ষার্থীর মনোজগতে সৃষ্টি হবে প্রবল আত্মিক সংকট। আমাদের অভিভাবকরা এ কাজটি বেশি করেন। নিজেদের সন্তানদের অতিরিক্ষ প্রশংসা কিম্বা নিন্দা করে, অপরের সন্তানদের সাথে তুলনা করে তাদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেন।
আজ দেশের উচ্চতর বিদ্যাপীঠ থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির ওপর নম্বর প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। উপস্থিতির হার কম হলে জরিমানাও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই জরিমানা প্রকারান্তরে একজন শিক্ষার্থীকে ক্লাসে উপস্থিত না থাকারও একটি সুযোগ করে দিয়েছে। কেননা অর্থের বিনিময়ে যদি Attendance Percentage বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা থাকে তাহলে উপস্থিতি বৃদ্ধি না পেয়ে বরং হ্রাস পেতে শুরু করবে। তাই অনেক সময় বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়- শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতাকে পুঁজি না করে শুধু জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে পাঠকক্ষে উপস্থিত হয়- এই প্রত্যাশাটি দেশের সকল শিক্ষকবৃন্দের। তাছাড়া গভীরভাবে চিন্তার জাল বিস্তৃত করলে শিক্ষার্থীরাই যে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে তা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সঠিকভাবে পাঠদানের পরক্ষণই মূল্যায়ন ( Assessment of Learning) পদ্ধতিটি গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করেই শিক্ষার্থীর গুণগত মানদ- নির্ণীত হয়। সামষ্টিক মূল্যায়ন (Summative Assessment) তখনই ইতিবাচক হবে যখন গঠনকালীন মূল্যায়ন (Formative Assessment) প্রক্রিয়া অধিকতর শক্তিশালী হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবকবৃন্দ সামষ্টিক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন। শিক্ষার্থী যদি এ প্লাস গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয় তাহলে ধরে নেয়া হয় যে, সে একজন ভালো শিক্ষার্থী। অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকবৃন্দও এক ধরনের প্রশস্তি অনুভব করেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কি শুধু একটি ভালো গ্রেড এর ওপর নির্ভরশীল? শিক্ষার্থী যদি ইংরেজি বিষয়ে ভালো পয়েন্ট পেয়ে ইংরেজিতেই নিজের পরিচয়টুকু প্রদানে ইতস্তত বোধ করে অথবা কেউ যদি শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা অন্য কোনো পেশায় প্রবেশের পর দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট পরিমাণ পেশাদারিত্ব প্রদর্শনে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে মেধাবী বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?
গঠনকালীন মূল্যায়নে যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্ব আরোপ করে শিক্ষার্থীদের দু’ভাবে শিক্ষা প্রদান করা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় হওয়া উচিত। প্রথমত চরিত্র গঠন, দ্বিতীয়ত- বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান এমনভাবে প্রদান করা যাতে পরীক্ষার্থীরা সামষ্টিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে কোনো পরীক্ষাকে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মতো মনে করতে পারে। এটি করতে পারলে কেবল তখনই পরীক্ষা বিষয়টিকে কোনো ভয়ের বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিবেচিত হবে না। চূড়ান্ত অর্থে তারা স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের সাথে শিক্ষা গ্রহণে নিজেদের ব্যাপৃত রাখবে।
স্বভাবতই দেখা যায় যে – একটি শ্রেণিকক্ষে প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের মৌলিক ভিত্তি অনেক দৃঢ় থাকে কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের থেকে অনেকখানি পিছিয়ে থাকে। কিন্তু, একটি শ্রেণিকক্ষকে আমরা তখনই আদর্শ শ্রেণিকক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবো যখন গুণগত মানের ক্ষেত্রে পার্থক্যটি খুব কাছাকাছি থাকবে। গঠনকালীন সময়ে যদি কোন শিক্ষক দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে বিশেষভাবে তাদের ওপর যত্ন রাখতে পারেন, নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে তাদের অন্তর্জগতে পাঠ গ্রহণের বোধ এবং উপযোগিতা প্রবিষ্ট করতে পারেন তবেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিতকরণের নিমিত্তে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত চাপ থেকে অব্যাহতি প্রদানের বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে বিশেষভাবে- ওই গঠনকালীন মূল্যায়নেই। তারা যেন পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে (Co-curricular Activities) অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকতে পারেন সেদিকে দৃষ্টি দেয়াও আবশ্যিক।
গঠনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আর একটি বিষয়ে দৃষ্টি প্রদান শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক। যে কোনো ধরনের পরীক্ষা সম্পন্ন করবার পর প্রত্যেক শিক্ষার্থীই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে তার মূল্যায়িত খাতাটি প্রত্যক্ষ করবার। এতে অবশ্যম্ভাবীরূপে আত্মপ্রসাদ লাভের যেমন সুযোগ থাকে তেমনি সুযোগ থাকে নিজের ভুলগুলো শুধরানোর। মূল্যায়িত খাতা প্রদর্শনের এই সময়টিতে শিক্ষক যদি সবল এবং দুর্বল উত্তরপত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়পূর্বক উত্তরণের উপায়টি নির্দেশ করেন তবে সেটি শিক্ষার্থীদের শিখনে যোগ করবে ভিন্ন মাত্রা।
সুতরাং, এটি স্পষ্ট দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে- প্রকৃত পাঠদানের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষককে সবসময়ই জীবনব্যাপী শিক্ষার্থী হিসেবে ভাবাই হবে শ্রেয়। একই সাথে পাঠ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তার মননে কোনো ধরনের চিন্তা সবসময় সক্রিয় থাকলে সর্বোচ্চ সফলতা আসবে তার সমাধান খুঁজতে শিক্ষাবিজ্ঞানী ডেভিড. এ. কব এর Experimental Learning Model-এর ব্যাখ্যা প্রদান করা যেতে পারে।৯ উক্ত Model অনুযায়ী সুষ্ঠু পাঠদানের নিমিত্তে প্রথমত একজন শিক্ষক জ্ঞান অর্জন করবেন এবং সেই অর্জিত জ্ঞান তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রয়োগ করবেন তা নিয়ে অনবরত ভাবতে থাকবেন। সুচিন্তিত ভাবনার পর অবশ্যম্ভাবীরূপে তার অন্তর্জগতে পাঠদানের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম প্রক্রিয়াটি উদ্ভাবিত হবে। কিন্তু পাঠদানের মতো অত্যন্ত কঠিন এবং মহৎ কাজটি আনন্দের সঙ্গে উপস্থাপনের নিমিত্তে শিক্ষকের মনোজগত কিম্বা চিন্তা প্রবাহ যদি আন্দোলিত না হয় তবে তা মানসম্মত পাঠদানের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করবে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা।
সত্যিকার অর্থে একজন প্রকৃত শিক্ষক, তিনি যত ভালোভাবেই পাঠদান করুন না কেন, সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তার অন্তরের আঙ্গিনায় সেই শিক্ষার্থীকে নিয়ে ভাবনার জালটি বিস্তৃত থাকবে। এই অবস্থায় সদা সন্ত্রস্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অমনোযোগী ও উদাসীন থাকছে কি না, তার পাঠ কতটুকু গ্রহণ করছে এই ভাবনা হৃদয় সরোবরকে তোলপাড় করতে থাকবে। আকাশ বৈরি হলে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিতে শ্রেণিকক্ষগুলোতে দিনের আলোয় যখন রাত্রির নীরবতা সৃষ্টি হবে তখন তিনি অনুভব করবেন অপরিসীম অপ্রসন্নতা। সান্ত¡না খুঁজবার পাশাপাশি এক ধরনের গর্ব অনুভবের চেষ্টা করবেন- আমাদেরই দেশের পাহাড়ি এবং নদী তীরবর্তী অ লের শিক্ষার্থীদের পাহাড় এবং নদী বেয়ে প্রতিনিয়ত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার দৃশ্য কল্পনা করে। একই সাথে কলম্বিয়া, ফিলিপাইন, চীন এবং ইন্দোনেশিয়ার শিশু শিক্ষার্থীরা নদীর ওপর দিয়ে তৈরি ঝুলন্ত দড়ি, উঁচু পাহাড়ের পাশে শীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক বেয়ে কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জ্ঞান অর্জনে প্রবৃত্ত হচ্ছে সেই উদাহরণগুলো উপস্থাপন করে নিজ শিক্ষার্থীদের সকল বাধা উপেক্ষা করে শ্রেণিকক্ষে আসার জন্য আহ্বান জানাবেন।
অবশ্যম্ভাবীরূপে শিক্ষার্থীর মনোজগতে শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টি ইতিবাচকরূপে গ্রহণের পাশাপাশি শিক্ষকবৃন্দের মনোজগতকে ইতিবাচকভাবে জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন হবে যদি প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ শ্রেণিকক্ষে নিশ্চিতের বিষয়টি উভয়ের বোধে উপলব্ধ হয়। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী যখন একই ধরনের মনোবৃত্তি অর্জন করে একই গতিতে এগুতে থাকবে তখন কাজটি সম্পন্নকরণের ক্ষেত্রটি অনেকটাই মসৃণ হয়ে উঠবে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো- কীভাবে আমরা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠদান এবং গ্রহণের অকৃত্রিম গতি সৃষ্টি করতে পারি। অনুভূতির কোন জায়গাটিকে স্পর্শ করে দুরন্ত গতি সৃষ্টি করতে পারি?
শিক্ষবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম শিখন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তিনটি ক্ষেত্রের (Domain) কথা উল্লেখ করেছেন। ক্ষেত্র ((Domain) তিনটি যথাক্রমে – Cognitive (বুদ্ধিবৃত্তিক), Affective (আবেগীয়) এবং Psychomotor (মনোপেশিজ)।১০ একই সাথে কোনো শিক্ষার্থীর নিহিত জ্ঞান (Psychomotor), অনুশীলনের মাধ্যমে সেই জ্ঞানের বিকাশ ((Constructivism) এবং সেই বিকাশকে নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের শরণাপন্ন (Connectivism) হওয়া অবশ্য পালনীয় শর্ত। এই তিনটি ক্ষেত্রের সমন্বয় পাঠ প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করে দুর্দান্ত সাফল্য। কিন্তু পাঠগ্রহণ কিংবা জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে কোন ক্ষেত্রটি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী তাদের অন্তর্জগতে বুনতে পারলে সফল হবে, বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া দুটো উদ্ধৃতির মাধ্যমে বিষয়টি পরিস্কার করা যেতে পারে-
০১
ঋতুটি বর্ষা। রাতদিন কেবল বৃষ্টিরই লুটোপুটি। বৃষ্টির সাথে কখনো আবার তীব্র বেগে ধাবিত বাতাসের উন্মাদনা। মাঠ, ঘাট, প্রান্তর ছড়িয়ে যেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যায়-শুধু পানি আর পানি। বৃষ্টির মাত্রা কখনো কখনো তীব্র থেকে তীব্রতর আবার কখনোবা কিছুটা স্তিমিত। গ্রামীণ পথের দু’ধারে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজির সব শাখা পল্লব বৃষ্টির পুলক মিশ্রিত স্পর্শে স্পর্শিত। সম্মুখে কিছু দূরেই মোটামুটি প্রশস্ত ম্লান স্রোতোবাহী একটি নদী। নদীটি খরস্রোতা নয়। বর্ষা ঋতুতে স্রোতের কিছুটা মাতামাতি থাকলেও অন্যান্য ঋতুতে ধীরস্রোতা। নদীটির দু’পাশের উপকূল থেকে পায়ে চলা সীমার মধ্যেই স্থানীয় সাধারণ মানুষের বসতি। ওই লোকালয়ের মানুষজন ভেবে পায় না কীভাবে একটি মানুষ নিয়মিত নিরন্তর একটি বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে? তারা প্রত্যক্ষ করছে, উপলব্ধি করছে, মানুষটির সঙ্গে কথাও বলছে, কিন্তু তারপরও মানুষটি চলে যাবার পর নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও বিশ্বাস করতে পারছে না এটি হওয়া সম্ভব!
নদীটির নাম কাড়ালুনড়িপূজা। ভারতের কেরালা রাজ্যের অন্তর্গত মান্নাপুরাম নামীয় একটি শহরে অবস্থিত গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। সে নদীতেই একটি মানুষ তার ডান বাহু শূন্যে উত্তোলিত করে, যে বাহুর আঙুলগুলিতে ধরা রয়েছে তার পরনের কিছু শুকনো কাপড় চোপড় এবং সাথে দু’একটি বই। অপর বাহু দিয়ে লোকটি প্রাণপণ দুঃসাধ্য চেষ্টা করে প্রায় ৫০ মিটার চওড়া নদীটি সাঁতরে অতিক্রম করে। এটি নৈমিত্তিক। যদিও নৈমিত্তিক তবুও নদীটি সাঁতরে পার হবার ঘটনাটি ঘটে শুধু বর্ষায়। যেহেতু বর্ষা ঋতুতে নদীটির পানি উৎপ্লবিত থাকে। অন্যান্য ঋতুগুলিতে পানির উচ্চতা নেমে এসে গলা অবধি দাঁড়ায়। সেই সব ঋতুতে মানুষটিকে গলা পরিমাণ পানিতে নেমে সাঁতরে নদীটি পার হতে হয় না, সাঁতরে পার হতে না হলেও গলা পর্যন্তপানি শুধু মাথা এবং বাহুটি পানির উপরে রেখে পায়ে হেঁটে নদীটি অতিক্রম করতে হয়। এই নৈমিত্তিকতার পতন কখনোই ঘটে নি। শুধু কিছু কিছু ছুটির দিন ব্যতীত।
মানুষটির নাম আবদুল মালিক। বাড়ি থেকে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে অতঃপর সাঁতরে তাঁর বিদ্যালয়ে পৌঁছে যান। এই বিদ্যালয়টিই সূর্য উদিত হবার পর থেকেই তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে থাকে। তিনিও এই আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারেন না। যে কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সঠিক অবস্থানে না থাকা সত্ত্বেও এত দুর্বার কষ্ট সহ্য করেও বিদ্যালয়টিতে আসবার লক্ষ্যে ঠিক সময়টিতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, নদীটির পাড়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন আপনা আপনি বুঝে নেয় এ মুহূর্তে দিবসের কতটি সময় উত্তীর্ণ হয়েছে।
শিক্ষক আবদুল মালিককে নিয়ে এত কথা বলবার, তাঁর সম্পর্কে এত কিছু ভাববার কারণ মূলত শিক্ষকতার প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ দায়বদ্ধতা, শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবার একটি উতুঙ্গ মাত্রার আন্তরিক আগ্রহ। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে প্রকারান্তরে গোটা জাতিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবার অভঙ্গুর প্রতিশ্রুতি। যে প্রতিশ্রুতি থেকে জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত আবদুল মালিক এতটুকু বিচ্যুত হন নি। বিরামহীনভাবে জীবনের কুড়িটি বছর কাটিয়েছেন তিনি যেভাবে বর্ণিত হলো ঠিক সেভাবেই। তাঁর অপরিসীম দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ তাঁকে সেই দৃষ্টান্তের মাত্রায় উন্নীত করেছে। “মূল্যবোধ” নামীয় যে শব্দটি রয়েছে সে শব্দটির ভাবসত্যকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য তিনি আমৃত্য সংগ্রাম করে গেছেন। এবং এই সংগ্রামের স্ফুরণ যাতে তাঁর শিক্ষার্থীদের অন্তরে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন সে লক্ষ্যেই তাঁর নিজের জীবনটিকে উৎসর্গ করেছেন।১১
০২
প্রশান্ত নদীর মতো আঁকা বাঁকা আর উঁচু উঁচু পাহাড়ের স্নিগ্ধ শ্যামল গ্রাম কুনু। বিশাল উপত্যকা আর দূর নীলিমার দিকে মিতালির হাত বাড়ানো বড় বড় বৃক্ষরাজির সেই গ্রাম। সে বৃক্ষরাজির ছায়াতলে থরে থরে সাজানো উপজাতীয় রীতিতে নির্মিত কুঁড়েঘরে সাধারণ মানুষের বসতি। এ ধরনেরই একটি বসতিতে মায়ের সঙ্গে বসবাস করতো বালক রোলিহলাহলা। মেঘের শরীর দীর্ণ করে বেড়ে ওঠা পাহাড় আর প্রকৃতির সবুজ শ্যামলিমাময় বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছাগল ও মেষ শাবক চড়াতেন রাখাল বালক রোলিহলাহলা। বয়স তখন পাঁচ বছরের সীমাকেও অতিক্রম করে নি। নিষ্পাপ উচ্ছ্বাস নিয়ে ধনুকের শরাঘাতে ধরাশায়ী করতো উড়ন্ত পাখি, আবার কখনও বা গাছের কোটর থেকে পাখির ছানা তুলে প্রতিপালন করে হতো আনন্দিত। আবার কখনও গভীর জঙ্গলের মৌচাক থেকে সংগ্রহ করতো মধু, আর সংগ্রহ করতো মাটি খুঁড়ে খাবার উপযোগী মূল-কন্দ। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা, হীম ঠা-া নদীর পানিতে প্রবল উচ্ছ্বাসে লুটোপুটি করা, লাঠি খেলার পাশাপাশি মারামারির বিষয়টিও ছিল রোলিহলাহলার নৈমিত্তিক কাজের একটি অংশ। কখনও নিজে মার খেত আবার কখনওবা বন্ধুটিকে মার দিতো।
সে সময়ে গোটা গ্রাম জুড়ে উচ্চশিক্ষিত লোক তো দূরের কথা, সামান্য কিছু পড়বার অথবা লিখবার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য। লেখাপড়ার ধারণাটি ছিল মূলতঃ একটি বিদেশি কনসেপ্ট। কলম ও খাতা নিয়ে শব্দ চর্চা করবে এটি ছিল রাখাল বালক রোলিহলাহলার কাছে নিতান্তই অকল্পনীয়। কিন্তু সেই অকল্পনীয় বিষয়টি বাস্তবে রূপ নিয়েছিল যখন এমাফেঙ্গু সম্প্রদায়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জর্জ এম্বেকেলা রোলিহলাহলার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাকে স্কুলে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। রোলিহলাহলার মা নোসেকেনি ফ্যানি তার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কুনুর পাহাড়ের নিচে দেয়াল ও বেড়াবিহীন এক রুম বিশিষ্ট স্কুল। সেই স্কুলে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিল রোলিহলাহলা। কিন্তু স্কুলে যেতে তো ভদ্রস্থ পোশাক পরিধান করা চাই। এক প্রস্থ কম্বল কাঁধের নিচে প্যাঁচ দিয়ে কোমরের কাছে গিট দিয়েছিল বালক রোলিহলাহলা। ব্যবস্থা হয়েছিলা উপরের অংশের। অতঃপর বাবা গাডলা হেনরি এক জোড়া পুরোনো পায়জামা এনে হাঁটুর নিচের কিছু অংশ কেটে ফেললেন,পরিয়ে দিয়েছিলেন পরম মমতায়। কিন্তু পরার উপযোগী হলেও লম্বায় কিছুটা সমস্যা হওয়ায় মাজায় রাখা যাচ্ছিল না। কোমরের অংশটি অনেকটাই প্রসারিত ছিল। বাবা তখন রোলিহলাহলার কোমরে একটা শক্ত দড়ি বেঁধে দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু এতে করে রোলিহলাহলাকে সার্কাসের ক্লাউন ছাড়া সেই মুহূর্তে আর কিছুই ভাবা যাচ্ছিল না। তারপরেও সেই পাজামা পরেই অতি উৎফুল্ল রোলিহলাহলা সেদিন যে গর্ব অনুভব করেছিল সে রকম উচ্ছ্বাস ও গর্বময় অনুভূতি পরবর্তী জীবনে আর কখনোই অনুভব করে নি। পিতা-মাতার আশীর্বাদ নিয়ে শুরু করেছিল সংগ্রামী শিক্ষাজীবন।
রোলিহলাহলা বাবাকে হারিয়েছিল সেই সময়েই। বাধ্য হয়ে মা পুত্রকে পালক হিসেবে রেখেছিলেন থেম্বুল্যান্ডের প্রাদেশিক রাজধানী এমখকেজওয়েনির প্রধান জনজিনতাবা দালিনদিয়েবোর কাছে। কান্নাকাটি, উপদেশ, আদর এর কোনোটিই মেলেনি সদ্য পিতৃহারা বালক রোলিহলাহলার। এতটাই স্বাভাবিক ছিল তার মা নোসোকেনি ফ্যানি বিদায়ের মুহূর্তটিতে। শুধু শারীরিক ভাষায় সন্তানকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন তাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার উচ্চাশা। “আমি বুঝতে পারছিলাম সাফল্যের দিকে অবিরাম এগিয়ে যাওয়ার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। আমার সবচেয়ে বড় মানসিক সান্ত¡নার বিষয় ছিল আমি আমার পালক পিতাকে খুশি করতে পেরেছিলাম। তার গোত্রে আমিই প্রথম কেউ যে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জন করতে পেরেছে।”
উদ্ধৃত কথাগুলি রাখাল বালক থেকে পরিণত হওয়া এমন একজন বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তিত্বের কথা যিনি তার জীবনে তার নিজ রাষ্ট্রের জন্যে, জাতির জন্যে রীতিমতো এক সর্বোচ্চ মাত্রার অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। গেঁয়ো ও কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে ক্লার্কবারি স্কুল, হিলটাউন কলেজ এবং ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন নানা অপমান ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। নিজেকে যোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করবার নিমিত্তে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের প্রত্যেক পর্বে অংশ নিয়েছিলেন। সফল হবার রুদ্ধ পথটিকে সবসময়ই মসৃণ করেছিলেন রোলিহলাহলা তার কঠোর অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে। অনিঃশেষ শ্রদ্ধা আর আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষক গারট্রুড এনতালাবাদি, বেন মাহলেসসা, রেভারেন্ড হ্যারিস, ফ্রাঙ্ক লেবেলটেলে, রেভারেন্ড মোকিতিমি এবং ডি.ডি.টি জাবাভুর হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলেন। তার এই অসম্ভবকে সম্ভবে রূপান্তরিত করা কোনোক্রমেই সম্ভব হয়ে উঠতো না যদি তার মানসলোকে নিজেকে চিনবার, নিজেকে জানবার একই সঙ্গে তার নিজ রাষ্ট্রের তার গোটা জাতিকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করবার বোধের সৃষ্টি না হতো।
মার্কিন বংশোদ্ভুত মার্টিন লুথার কিংকে আমরা সবাই জানি। তাঁর কর্মকা- সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষ সম্যক অবহিত। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র বর্ণবাদ বিরোধী বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলেন। এবং সে চলমান আন্দোলনের এক পর্যায়ে তাঁকে আততায়ীর মাধ্যমে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু হত্যা করবার পরেও সেই আন্দোলনের শিখাটি তীব্র না হলেও মিটমিট করে আজ পর্যন্ত জ্বলে চলেছে। আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত যে আফ্রিকান কিশোরটিকে নিয়ে আলোচনা করলাম সে কিশোরটি হলো এক অসমসাহসী এবং দূরদর্শিতার প্রাখর্যে উজ্জ্বল নেলসন ম্যান্ডেলা যিনি মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গ শাসিত তাঁর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় যে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সে আন্দোলনের সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করেই তিনি তাঁর দেশের সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতির আসনে উপবেশন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর আন্দোলনের শুরু থেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত সমগ্র সময়ের মধ্যে ২৭টি বৎসর তাঁকে শ্বেতাঙ্গ সরকারের নির্দেশে কারা অভ্যন্তরেই কাটাতে হয়েছিল। এর মধ্যে সরকার পক্ষ থেকে বহুবার বহুভাবে সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতার মাধ্যমে সরকারে অংশগ্রহণ করবার প্রলোভনও তাঁকে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনো প্রলোভনকে ভ্রুক্ষেপ না করেই তাঁর জাতির মঙ্গলের স্বার্থে তিনি তাঁর জীবন থেকে ২৭ টি বছরকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। আর এই নির্বাসনের মাধ্যমে তিনি এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছিলেন বলেই অন্তিমে এসে তাঁর স্বপ্নকে সফল করতে পেরেছিলেন।১২
এ প্রসঙ্গে ফরাসি দার্শনিক এবং যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্ব রেনে দেকার্ত -এর একটি মন্তব্যকে উদ্ধৃত করছি। “মতের যে ভিন্নতা আমরা দেখি তা বুদ্ধির ভিন্নতা থেকে হয় না বরং ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার এবং ভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নেয়ার জন্য হয়। সেজন্যই শুধু উন্নত মনই যথেষ্ট নয় তাকে ভালোভাবে ব্যবহার করাও একটি অপরিহার্য শর্ত। মহাত্মারা যে সব শ্রেষ্ঠ নৈতিক উৎকর্ষ (Virtue) উপহার দিতে পারেন তেমনি করতে পারেন চরম অনৈতিকতারও। তাই যারা দ্রুত ভুল রাস্তায় দৌঁড়ায় তাদের চাইতে যারা ধীরে সঠিক পথ ধরে চলেন তাঁরা অনেক দূরে যেতে পারেন।”১৩ এখন দার্শনিক রেনে দেকার্তের দর্শনকে বিবেচনায় নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। যদি নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করবার জন্য গতির অতি দ্রুততাকে অবলম্বন করতেন এবং শ্রেষ্ঠ নৈতিক উৎকর্ষ সাধনে সীমাহীন ধৈর্যের সাথে দৃঢ় পদক্ষেপে ধীরে ধীরে সম্মুখের দিকে এগিয়ে না যেতেন তাহলে হয়ত তিনি সব দিক থেকে উচ্চতার যে স্তরে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটি হয়ত তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না।
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি দুটোর বিশ্লেষণ করলে সহজেই প্রতিভাত হয়-শিক্ষক আব্দুল মালিক এবং শিক্ষার্থী নেলসন ম্যান্ডেলা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সফল হবার প্রচ- আগ্রহ নিয়ে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। চেষ্টিত হয়েছেন চন্দ্রালোকে আশ্রিত সাফল্যকে ছিনিয়ে আনতে। তাঁরা তাদের জীবন দর্শনের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বলেই অনন্ত কাল ধরে শিক্ষার আলোর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব চরাচরকে আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে কারণেই উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি দুটো এবং পাশাপাশি বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তিত্ববৃন্দের শৈক্ষিক আদর্শ থেকে এটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে-মানবমনীষা যদি পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে অবস্থান করে যে-কোনো দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করতে আগ্রহী হন তবে তিনি তখনই সক্ষম হবেন যখন তার চিত্তে সেই কাজটি করবার প্রবল আগ্রহকে অন্তর্লোকে সার্বক্ষণিকভাবে জাগ্রত রাখতে পারবেন।
অর্থাৎ বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম প্রদত্ত তত্ত্ব অনুযায়ী শিক্ষার প্রকৃততা অর্জনে আবেগীয় ক্ষেত্রটিই (Affective Domain) প্রথম শর্তেই আবশ্যক। শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার যদি শিক্ষার্থীর আবেগকে প্রকৃত অর্থেই স্পর্শ করতে পারে তবে নেতিবাচক কোনো ধরনের প্রভাবই জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। আপনা আপনি Cognitive (বুদ্ধিবৃত্তিক) এবং Psychomotor (মনোপেশিজ) দুটো ক্ষেত্রই (Domain) ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে।১৪ পাশাপাশি এটি সহজেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে-একজন শিক্ষকের মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার প্রজ্ঞা, বিবেক এবং মানবীয় মূল্যবোধ। শ্রেণিকক্ষ, সীমাহীন ছাদের নিচে সবুজ চত্বর, মিলনায়তন কিংবা যে পরিবেশই জ্ঞান পরিবেশনের ক্ষেত্রে যতই কণ্টকাকীর্ণ হোক না কেন শিক্ষকবৃন্দ তাদের অর্জিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পুরো নির্যাসটুকু যখন সমর্পণ করবেন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কেবল তখনই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অনুসৃত পদ্ধতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষার্থী হিসেবে পরিণত হয়ে উঠবে। এবং চূড়ান্ত অর্থে কল্পলোকে অঙ্কিত পাঠ প্রতিকৃতি বাস্তবে রূপ লাভ করবে।
তথ্য সূত্র:
১। দীর্ঘ ক্লাস আর নয় -সালমান খান, অনুবাদ অঞ্জলি সরকার, সম্পাদকীয়, প্রথম আলো তারিখ-১৭-১০-২০১২ খ্রিষ্টাব্দ।
২। Willingham, D. T. (2006). How knowledge helps: It speeds and strengthens reading comprehension, learning-and thinking. American
Educator, 30(1), 30.
৩. Mahatma k. Gandhi- The story of my experiments with truth- Indialog publications pvt. ltd New Delhi India Page -20.
৪. Mentor Hamiti*, B. R. (2012). Teaching with Technology . Procedia Social and Behavioral Sciences, 46, 1171-1176.
৫. Reimagining the Role of Technology in Education . Educational Policy, OFFICE OF Educational Technology , U. S. DEPARTMENT
OF EDUCATION (2017).
৬. এডলফ হিটলার, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৭, মাইন ক্যাম্ফ (আমার সংগ্রাম), অনুবাদ- আনান প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং ১৭।
৭. খোন্দকার মুস্তাফিজুর রহমান, প্রকাশকাল- অগস্ট ১৯৮০, শিক্ষা দর্শন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং ১৩২, ১৯৯
৮. সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স- হেনরি ডেভিড থরো, নির্বাচিত মার্কিন কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ অনুবাদ খুররম হোসাইন প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০১৩, ফ্রেন্ডস বুক কর্ণার, ঢাকা পৃষ্ঠা নং-৩৩
৯. David .A. kolb educational theory, Encyclopedia of Education.
১০. David R. Krathwohl, A Revision of Blooms Taxonomy, autumn, 2002, Volume 41, Number 4, College of Education, The Ohio State
University.
১১. ১৯ বছর ধরে সাঁতরে স্কুল যাচ্ছে শিক্ষক আবদুল মালিক, দৈনিক সমকাল ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ পৃষ্ঠা নং ২২.
১২. নেলসন ম্যান্ডেলা, প্রকাশকাল ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, লং ওয়াক টু ফ্রিডম, অনুবাদ সারফুদ্দিন আহমেদ, ওমর ফারুক, অন্যধারা প্রকাশন, বাংলাবাজার ঢাকা। পৃষ্ঠা নং ২২, ৩০,৩৫,৫৬,৫৭,৫৮,৬১,৬২,৬৩,৭২।
১৩. ডিসকোর্স অন মেথড- রেনে দেকার্ত, অনুবাদক ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৪, দ্বিতীয় সমাবেশ মুদ্রণ, পৃষ্ঠা নং-২৭।
১৪. David R. Krathwohl, A Revision of Blooms Taxonomy, autumn, 2002, Volume 41, Number 4, College of Education, The Ohio State
University.
*************************************
লেখক: শিক্ষক, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।
*************************************